১১. পুলিশ লাইনের ড্রেনের ধারে

রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ড্রেনের ধারে বসে রাবেয়া পরদেশীকে বলে, পাকিস্তানিদের আজাদি দিবসে আকাশে বাংলাদেশের পতাকা দেখেছি। মহল্লার ছেলেমেয়েরা ওই বেলুনটা ধরার জন্য ছোটোছুটি করছিল। বুড়োরা ওদের থামিয়েছে। বলেছে, গুলি খেতে চাস? ওই পতাকার জন্য ছুটতে দেখলে মহল্লার সবাইকে মেরে সাফা করে দেবে। চুপ করে বসে থাক তোরা।

ছেলেমেয়েরা মুখ চুপসে থেমে গিয়েছিল।

বেলুন তো আর কলোনিতে নামেনি। উড়তে উড়তে কোথায় গিয়েছে, কে জানে।

চুপ কর, রাবেয়া।

পরদেশী ওকে মৃদু ধমক দেয়।

কেন চুপ করব, কেন?

দেয়ালেরও কান আছে, জানিস না!

থাকুক। ইচ্ছা করে চিল্লাই। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পুলিশ লাইনের ব্যারাকে যে আজাব চলছে মেয়েগুলোর ওপর, তা কি সহ্য করা যায়! বলল, সহ্য করি কীভাবে! আমি আমার এক জীবনে শত মরণ দেখতে পাচ্ছি। মরণের এত চেহারা দেখে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে।

থাম, রাবেয়া। থাম বলছি। তুই আমাদেরও মরণ ডেকে আনবি। মেয়েদেরকে মিলিটারির কাছে রেখে আমি মরতে চাই না। আমি ওদের দেখব।

ড্রেনের ভেতরে যে ছুরিটা রাখা হয়েছে, তুই তা বের কর।

কাকে দিবি?

নীলুকে। দুই দিন ধরে আমাকে ছুরির জন্য পাগল করে ফেলছে। বলছে, ছুরি না দিলে ও দোতলা থেকে লাফ দেবে।

ব্যাপার কোথায় দাঁড়াবে, বুঝিস তো?

বুঝি, বুঝি। তুই আমাকে এত শেখাতে আসিস না তো, পরদেশী। তোর শাসনে আমি অতিষ্ঠ। এদেরকে রেখে তুই মরবি না। বলিস পাহারা দিবি। কী ছাতুর পাহারা দিচ্ছিস? এটা কোনো পাহারা হলো?

তুই তো বুঝতে পারছিস যে একজনের জন্য সব মেয়েকে ওরা মারবে।

ওরা তো মরেই আছে। ওদের আবার বাঁচা কী? শহরে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ জোরদার হয়েছে। মোনায়েম খানকে মেরে ফেলেছে জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি। পেট্রল পাম্প পুড়িয়েছে। রাজাকার মরেছে কতগুলো।

চুপ কর, রাবেয়া। তোর আজকে কী হয়েছে? তুই এত কথা কেন বলছিস? অন্যদিন তো তুই এত কথা বলিস না।

পরদেশী, তোর কি মনে হয় না মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে? বিজয় কত দূর, ভেবে আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি। দেশ যেদিন স্বাধীন হবে, সেদিন আমি এই মেয়েদের নিজের হাতে স্নান করিয়ে একটি করে বকুল ফুল দেব। বলব, দেখো, ফুলের গন্ধে চারদিক ম-ম করছে। তোমরা জোরে জোরে শ্বাস টানো। পরদেশী, আমরা বিজয়ের পথে যাচ্ছি তো?

যাচ্ছি, যাচ্ছি। আর বেশি দিন সময় লাগবে না। আকাশে পতাকা উড়লে অপেক্ষার সময় বেশি থাকে না।

পরদেশী ড্রেনে নেমে ছোট ছুরিটা তুলে এনে লুঙ্গিতে মুছে কচু পাতায় মুড়িয়ে রাবেয়াকে দেয়। রাবেয়া কচু পাতাসহ ছুরিটা ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়। হাতে কী নিয়ে যাচ্ছে, এটা যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তাহলে কী বলবে ও? ঘাবড়ে গেলে ধরা পড়ে যাবে। সময়টা এখন প্রবলভাবে অবিশ্বাসেরও। নানাভাবে বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে। তাই ছুরিটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে ব্যারাকে ঢুকতে হবে। কোনোভাবেই ধরা পড়ে সব মাটি করা চলবে না। রাবেয়া ড্রেনের ধার থেকে উঠে পড়ে। নিজের কাপড় ঝেড়েঝুড়ে ঘাসের কুচি ছাড়িয়ে নেয়। ব্যারাকের দিকে পা বাড়ানোর আগে মাটিতে হাত ছুঁইয়ে কপালে ঠেকায়।

 

দুপুরের খাবার আসে ব্যারাকে।

মেয়েরা বারান্দায় লাইন করে বসেছে। ওরা ক্ষুধার্ত। বালতি ভরা ডাল। গরুর মাংস আর আলুর তরকারি। ওরা হাপুস-হুপুস খায়। শুধু খেতে পারে না নীলুফার। এক গ্রাস মুখে দিলে গিলতে ওর সময় লাগে।

রাবেয়া একটু দূরে বসে ছিল। ওর নজর ছিল নীলুফারের ওপর। যতক্ষণ ক্যানটিনের সেপাইরা খাবার দিচ্ছিল, ততক্ষণ রাবেয়া দূরে ছিল। ও কাছাকাছি আসুক, সেটা ওরা চায় না।

ওরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই রাবেয়া নীলুফারের মুখোমুখি এসে বসে।

খাচ্ছ না যে? দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছ। আজ তো গরুর মাংসের তরকারি দিয়েছে। শুধু ডাল না। খাও।

খেতে পারছি না। খেতে ভালো লাগছে না।

না  খেলে শরীর ভালো থাকবে?

শরীর? কার জন্য? ওই লুচ্চাদের জন্য?

লুচ্চাদের জন্য না, নিজের জন্য।

বাঁচার সাধ নাই। শরীর এখন বোঝ। বোঝা টানতে চাই না।

নীলু, দেখো। তুমি যা চেয়েছিলে তা আছে। বেশি বড় না, তবে কাজ হবে। খুব ধার আছে। পরদেশী এনেছে।

রাবেয়া ব্লাউজের ভেতরে ছুরি রাখার ইঙ্গিত করে। নীলুফার বুঝে যায়।

তোমার কাছে রাখো। নেব। তুমি ভাত খাবে?

মাথা খারাপ। আমাকে খেতে দেখলে মারবে। তুমি তো জানো সব।

তে দেখলে মারইয়া তুমি আমারটা খাও। এই প্লেটে যা আছে তা। আমি আমার ভাগ তোমাকে দিচ্ছি।

না, না, তুমি আমাকে খেতে বলো না।

একপাশ থেকে এইটুকু খেয়েছি। এঁটো হয়নি।

না গো, খেতে বলল না। খিদায় জীবন গেলেও খেতে পারব না। চাবুক দিয়ে মারবে। তুমি কি চাও যে আমার পিঠ কেটে রক্ত পড়ুক?

নীলুফার আর কথা বলে না। উঠে হাত ধুয়ে নেয়। বারান্দার কোনায় দাঁড়িয়ে রাবেয়ার কাছ থেকে ছুরিটা নেয়। কলা পাতাটায় ভালো করে প্যাচিয়ে নিজের কোমরের কাছে পায়জামার সঙ্গে গুঁজে রাখে। রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমাকে ওই সাদা ফুলটা এনে দেবে, রাবেয়া খালা, এমন সুন্দর ফুল আমি কোনো দিন দেখিনি। কী ফুল ওটা?

রাবেয়া ভালো করে তাকিয়ে দেখে, ব্যারাকের দেয়ালের পাশে যে ফুলটি ফুটেছে, ওটা একটা চালতাগাছ। সাদা বড় পাপড়ি-মাঝে হলুদ রঙের খানিকটাতার ওপরে সাদা ছোট্ট ফুল, ওর মাঝে আবার একটু হলুদ রং-রাবেয়া তাকিয়ে থাকে। এর বেশি বর্ণনাও করতে পারে না। প্রতিবছর বর্ষায় এই ফুল ফোটে। আষাঢ় শেষ হলে শ্রাবণের শুরুতে বৃষ্টিতে ভিজে ফুলের পাপড়ি মেলে ওঠে। কারুকাজ করা পাতার মধ্যে এমন সাদা ফুল দেখা খুব ভাগ্যের মনে হয় রাবেয়ার।

মাঝেমধ্যে ও নিজেও এই ফুলটা দেখে। এত সুন্দর! হঠাৎ ওর বুক ধড়ফড় করে ওঠে। এই মৃত্যুপুরীতে দাঁড়িয়ে মেয়েটির চোখ গেছে ফুলটির দিকে। আশ্চর্য! একটি ছুরি নিজের কোমরে গুঁজে রেখে ফুলের নাম জানতে চায় কেন মেয়েটি? মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে ধরার খুব সাধ হয় ওর। কিন্তু ধরতে পারে না। সাহস হয় না। যে মেয়ে মৃত্যু সামনে রেখে ফুল খোঁজে, তাকে স্পর্শ করার সাধ্য হয় না রাবেয়ার। ও নিজের ভেতর অভিভূত হয়ে থাকে।

কী ভাবছ, খালা? ফুলের নামটা তো বললে না?

ওটা তো চালতা ফুল।

চালতা ফুল? আমি নুন-মরিচ মাখিয়ে চালতা খেয়েছি। কিন্তু ফুল দেখিনি। ও মা গো, এত সুন্দর ফুল! আমার জন্য একটা ফুল ছিঁড়ে আনো, খালা।

কী করবে?

ওটা একটা শান্তির ফুল।

কী করবে?

মরণের আগে খোপায় খুঁজে রাখব। এই মরণের খাঁচায় কালই আমার শেষ দিন।

রাবেয়া দুহাতে মুখ ঢাকে।

নীলুফার ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, কেঁদো না। এটা আমার গৌরবের মৃত্যু। এই মৃত্যুর কথা ছড়িয়ে দিয়ে চারদিকে।

পুলিশরা উঠে আসে বারান্দায়। রাবেয়া দ্রুত পায়ে অন্যদিকে সরে যায়। ও জানে, এখন থালাবাসন গোছানো হবে। তারপর মেয়েদের ঘরে ঢুকিয়ে তালা দেওয়া হবে।

 

পরদিন কিছু ঘটাতে পারে না নীলুফার।

তার পরদিনও না।

তৃতীয় দিনে একজন নগ্ন ধর্ষকের পেটে ঢুকে যায় নীলুফারের ছুরি। ওর চিকার যখন ঘরের চারদেয়ালে আছড়াতে থাকে, তখন নীলুফার হাসতে হাসতে বলে, এটা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। তোমাদের একটাকে না মেরে আমি এই আজাবখানা থেকে বের হব কেন, কুত্তার বাচ্চারা!

ও হাত বাড়িয়ে অপরূপ শান্তির ফুলে হাত রাখে।

গত বিকেলে বাড়ি যাওয়ার আগে একটি ফুল ওকে দিয়ে গেছে রাবেয়া। ও ধীরেসুস্থে ওর নিজের কাপড় পরে। দেখতে থাকে লোকটির মৃত্যু। প্রবল রক্তস্রোতের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে ওর নাড়িভুঁড়ি।

খবর ছড়িয়ে যায় পুলিশ লাইনের চারদিকে। ছুটে আসে অফিসার এবং পুলিশ। শত শত সেপাই জড়ো হয় ব্যারাকের সামনে। প্রত্যেকে বিস্মিত, হতভম্ব। এত সাহস মেয়েটির! কোথায় থেকে এত সাহস পেল? ছুরি কোথায় পেল? সবার চোখে ধুলা দিয়ে কোনো মুক্তিযোদ্ধা কি ব্যারাকে ঢুকেছিল? কীভাবে ঢুকল? চারদিকে এত পাহারার মধ্যে ঢোকা তো সম্ভব না, তাহলে কেউ কি সাহায্য করেছে? যদি করে থাকে, তাহলে সে কে?

বারান্দায় পাঁচজনের বুটের নিচে চিত হয়ে পড়ে আছে নীলুফার। ওরা তখনো বুট দিয়ে পিষ্ট করেনি ওকে। ওর কাছ থেকে জানতে হবে, কে ওকে সহযোগিতা করেছে। ও ছুরি কোথায় পেল?

একটু আগে মৃত অফিসারের লাশ সরানো হয়েছে। স্ট্রেচারে করে তুলে নিয়ে গেছে তাকে। বারান্দায় পড়েছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। সে রক্ত উত্তেজিত সেনাদের বুটের নিচে গড়াচ্ছে। বারান্দায় লেপ্টে যাচ্ছে। সেই রক্তমাখা বুট এখন নীলুফার শরীরের ওপর। ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ও নিজেও চেষ্টা করছে প্রতিটি নিঃশ্বাস না ফেলার জন্য। ওর ডান হাত শুধু চুলে গুঁজে রাখা সাদা ফুলটির ওপর রাখা আছে। ওকে বুট দিয়ে পিষ্ট করলে ওর হাত ওখান থেকে ছিটকে পড়বে। ওকে ওরা উর্দুতে প্রথমে প্রশ্ন করে। ও কোনো উত্তর দেয় না। পরে একজন বাঙালিকে লাগানো হয়।

লোকটি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করে, বল, ছুরি কোথায় পেয়েছিস?

একজন মুক্তিযোদ্ধা দিয়েছে।

নাম কী?

জানি না।

বল, নাম কী?

বাইরে থেকে মুক্তিযোদ্ধা ঢুকতে পারবে না। তাহলে ভেতরের কেউ।

বুট চেপে বসে শরীরের ওপর। তখন সাদা ফুলের ওপর নীলুফারের হাত। ও ফুলটিকে অক্ষত রাখতে চায়। শান্তির-স্বাধীনতার এই ফুল যেন ওরা থেতলাতে না পারে।

নীলুফারের মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ ধ্বনি বের হয়।

কথা বলবি না? এত তেজ কিসের?

পাঁচ-পাঁচটি বুট ওর শরীর চেপে ধরলে ও ঘাড় কাত করে। দম বেরিয়ে যায়। চুলের পাশে আশ্চর্য সজীব হয়ে থাকে চমক্কার সাদা-হলুদ রঙের চালতা ফুল।

ড্রেনের পাশে বসে থাকে সুইপাররা। আজ ওরা সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। সবার আতঙ্ক রাবেয়াকে নিয়ে। ও মেয়েগুলোর দেখাশোনা করেছে। দায়টা ওর ওপর বেশি আসবে। নির্দেশ হয়েছে, কেউ যেন পুলিশ লাইনের বাইরে না যায়। গেলে, চাবুক দিয়ে পিটিয়ে জর্জরিত করা হবে।

সেনারা যত বলছে, তার চেয়ে বেশি বলছে বাঙালিগুলো। বলছে, কার গায়ে হাত দিয়েছিস, বুঝবি। স্বাধীনতার সাধ মিটিয়ে দেব।

রাবেয়া চুপচাপ থাকে। পরদেশী ওকে এক খিলি পান দিয়েছিল, সেটা চিবোয়। মেয়েদের চিৎকার ভেসে আসছে। ওর বুক ধড়ফড় করে। একটু পরে দেখতে পায়, মেয়েগুলোকে মারতে মারতে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। ব্যারাক খালি করে ফেলছে ওরা। রাবেয়া বুঝে যায় যে ওদেরকে কোথাও নামিয়ে দেবে। লাথি দিয়ে নামাবে। তারপর নতুন মেয়েদের নিয়ে ভর্তি করবে ব্যারাক। ও দুহাত পেছনে দিয়ে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নীরব হয়ে যায় এলাকা। থমথম করে চারদিক। সুইপার কয়েকজন ড্রেনের পাশে বসে থাকে। রাবেয়া খাতুন পা মেলে দেয়, আবার পা গোটায়। পরদেশীর দিকে তাকিয়ে বলে, আমার একটা কাজ করা হলো না। আর করা হবে বলে মনে হয় না।

কী কাজ? কোনো কাজই আর করা যাবে না। আমাদেরকেও হয়তো বের করে দেওয়া হবে। চাকরি খতম। তার পরও বল, কী কাজ করতে চেয়েছিলি?

ঝরনাকে কথা দিয়েছিলাম যে সুইপারের কাপড় পরিয়ে ব্যারাক থেকে বের করে দেব। হলো না।

পরদেশী সঙ্গে সঙ্গে বলে, এই জন্য তুই আমার বউয়ের পুরান শাড়ি চেয়েছিলি?

তুই বলেছিলি, দিবি। তোর কাছে ওর দুটো শাড়ি আছে, তার একটা দিবি।

আমি তো কাগজে মুড়ে রেডি করে রেখেছিলাম। আনার সময় তো পেলাম।

তোরা চুপ কর। ওই দেখ, পাঁচজন পুলিশ আমাদের দিকে আসছে। এবার বোধ হয় আমাদের পালা।

রাবেয়া সোজা হয়ে বসে বলে, কী আর করবে। কচু করবে। যা করবে করুক। তোরা কিন্তু ওদের হাতে-পায়ে ধরবি না।

কেউ কোনো কথা বলে না। শুধু সামনে তাকিয়ে থাকে। যমদূতের মতো এগিয়ে আসার দৃশ্য দেখে।

ওরা পাঁচজন এসে সামনে দাঁড়ায়। সরাসরি রাবেয়ার দিকে তাকায়।

তোকে নিয়ে যেতে বলেছে। আমাদের সঙ্গে আয়। সাহস দেখিয়েছিস। এখন ঠেলা বুঝবি।

যাচ্ছি। আমাকে ভয় দেখানোর দরকার নেই।

রাবেয়া সামনে এগিয়ে যায়। একটু জোরেই যায়। দেখাতে চায় যে তোদেরকে ডরাই না। ওর ভেতরে এখন আর মৃত্যুভয় কাজ করছে না। ভয় করবে কেন? এর জন্য তো ওর প্রস্তুতি ছিল। ও শাড়ির আঁচল কোমরে পেঁচায়। ওর কাঁচা-পাকা চুল বাতাস এলোমেলো করলে ও দুহাতে খোঁপা বাঁধে।

পেছন থেকে একজনে ছোট লাঠি দিয়ে গুঁতো দেয়। ও ফিরে রুখে দাঁড়ায়। চোখ জ্বলে ওঠে। নিজেকে বোঝায় যে মৃত্যু সামনে থাকলে সাহসী হতে হয়।

মারছ কেন? যেতে বলেছ, যাচ্ছি। দোষ করলাম কী?

গেলে টের পাবি, হারামজাদি। বেশ্যার হাতে ছুরি দিয়েছিস তুই। তুই ছাড়া আর কে দেবে?

কেউ একজন পাছায় লাথি দিলে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। পরদেশী ছুটে এসে রাবেয়াকে টেনে তোলে।

সুইপার এবং ডোমরা এতক্ষণ ওদের পিছে পিছে আসছিল। রাবেয়াকে সামনে রেখে ছোটখাটো একটা মিছিল যেন। পুলিশের হাঁকে বন্দীদের মিছিল।

পরদেশী মৃদুস্বরে বলে, ব্যথা পেয়েছিস, জানি। উঠে দাঁড়া। আমাকে ধর।

রাবেয়া উপুড় হয়ে পড়েছিল। উঠতে কষ্ট হচ্ছে। ঠোঁট কেটে গেছে। হাঁটু ইটের ওপর পড়ে টনটন করছে। চামড়া উঠেছে।

পরদেশী আস্তে করে আবার বলে, ওঠ।

পারছি না। পা টনটন করছে। হাঁটু বুঝি ভেঙেই গেছে।

উঠে দাঁড়া, নইলে আবার লাথি দেব।

পরদেশী টেনে তুললে রাবেয়া উঠে দাঁড়ায়। বুঝতে পারে, হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। ও পরদেশীর হাত চেপে ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে।

রাবেয়াকে অফিসে এনে প্রথমে চাবুক দিয়ে মারা হয়। জিজ্ঞেস করা হয়, মেয়েটিকে ছুরি দিয়েছে কে?

রাবেয়ার মুখে কথা নেই।

বল, কথা বল। কেন ওকে ছুরি দিয়েছিস?

রাবেয়া কথা বলে না।

ওর শরীরের ওপর পাঁচটি বুট উঠে আসে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অন্য সুইপাররা। ওরা সবাই জানে, রাবেয়া কথা বলবে না। রাবেয়া মরে যাবে, তা-ও কথা বলবে না।

একসময় অফিসার হুকুম দেয় ওকে গাছে ঝুলিয়ে রাখার। বলে, ও ঝুলে থেকে মরবে। ওকে উলঙ্গ করে ঝুলিয়ে দাও। পা বেঁধে ঝোলাবে, ওর মাথা নিচের দিকে থাকবে। কাক এসে ওকে ঠোকর দেবে। শকুন এসে ওর মাংস খুবলে তুলবে। ওকে মারার জন্য গুলি খরচ করা হবে না। ওর শাস্তি ঝুলে থেকে একটু একটু করে মরণ।

হুকুম শুনে সুইপাররা চোখ মোছে। ওরা বুঝে যায় যে রাবেয়াকে মেরে ফেলা হবে। ওকে বাঁচানোর আর কোনো সুযোগ নেই। এই চালতাগাছের নিচে রাবেয়াকে কখনো বসতে দেখেনি ওরা। এ গাছের ফুল কখনো খোপায় দেয়নি রাবেয়া। মৃত্যুর সময় গাছ ওকে বুকে টেনে নিয়েছে। ওই গাছে ঝুলে থেকে রাবেয়ার স্বাধীনতার স্বপ্ন ফুল হয়ে ফুটবে।

ব্যারাকের দেয়ালের পাশের চালতাগাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ওকে। ছোট গাছ বলে ওর উল্টে থাকা হাতের আঙুল মাটি ছুঁয়ে থাকে। লম্বা চুলের গোছা মাটি ছুঁই-ছুঁই করে। যেহেতু রাবেয়ার জ্ঞান নেই, সেহেতু ও তাকাতে পারছে না এবং দেখতে পারছে না যে চালতার সুন্দর সাদা ফুলটি ওর হাতের কাছে ঝরে পড়েছে।

 

সন্ধ্যা নামে।

পরদেশী এসে দাঁড়ায় আকমল হোসেনের বাড়ির গেটে। দরজা খুলে দেয় আলতাফ। ওকে কাঁদতে দেখে বুঝে যায় কিছু একটা ঘটেছে। সে পরদেশীকে হাত ধরে বারান্দায় এনে বসায়। তার পরে মৃদুস্বরে বলে, কান্না আমাদের মানায় না। আমরা কাঁদব না।

পরদেশী তার দিকে তাকিয়ে বলে, চোখের জল আটকানো কঠিন। জল আটকালে বুক ফাটবে। দেখব নর্দমা সাফ করতে গিয়ে ওখানে মরে পড়ে আছি। অহেতুক মরার চেয়ে একটাকে মেরে মরাই তো উচিত।

আলতাফ ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। দুজনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বলে, জয় বাংলা।

কেউ এসেছে সাড়া পেয়ে ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে আসেন আকমল হোসেন, আয়শা খাতুন ও মেরিনা। ওদের দেখে প্রথমে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেও অল্পক্ষণে নিজেকে সামলায় পরদেশী। আকমল হোসেন ওর পাশে বসে ঘাড়ে হাত রাখেন। পরদেশী চোখ মুছে নীলুফারের কথা বলে, রাবেয়ার ঝুলে থাকার কথা বলে। চালতাগাছ, শ্রাবণের বৃষ্টি, সাদা ফুলের কথা বলতেও ও ভোলে না। নীলুফারের জন্য ও কোথায় থেকে ছুরি কিনেছে, সে কথা বলে। কয়েক দিন ছুরিটা নর্দমায় লুকিয়ে রেখেছিল, সে কথা বলে। রাবেয়ার সাহসের কথা বলে। ঘটনার দিন রাবেয়া ওকে বলেছে, ছুরির কথা আমি একা স্বীকার করব। কোনো কথা না বলে স্বীকার করা। তুই কিছু জানিস না, পরদেশী। মেয়েগুলোর দেখাশোনার জন্য তোকে এখানে থাকতে হবে, পরদেশী। তোর ধরা পড়া চলবে না। মনে থাকবে তো?

থাকবে। আমি দম বন্ধ করে মাথা নেড়েছিলাম। এই রাবেয়াকে আমি বাইশ বছর ধরে চিনি। চাকরি শুরুর প্রথম থেকে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাবেয়া আমাকে চোখ খুলে দিয়েছে। আমি রাবেয়াকে ফুটে উঠতে দেখেছি। ওহ্, রাবেয়া।

পরদেশী বেশ কিছুক্ষণ ধরে কাঁদে। কেউ ওকে কাঁদতে মানা করে না। সবাই ভাবে, ও কেঁদে নিজেকে হালকা করুক। অনেকক্ষণ ধরে কেঁদে ও চোখ মোছে। আলতাফ ওর জন্য খাবার নিয়ে আসে। ও আয়শার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলে, মাইজি, আজ আমি খেতে পারব না। আমাকে জলও ছুঁতে বলবেন না, মাইজি।

আয়শা ওর মাথায় হাত রেখে বলেন, তুমি সুস্থ থাকো, পরদেশী। ভালো থাকো, এই প্রার্থনা করি। এই দরজা তোমার জন্য খোলা থাকবে। যখন খুশি আসবে।

সবাইকে স্তব্ধ বসিয়ে রেখে পরদেশী চলে যায়। যেন অনন্তকাল বয়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। অনেকক্ষণ পর আয়শা খাতুন বলেন, চলো, আমরা ওদেরজন্য প্রদীপ জ্বালাই।

হ্যাঁ। চলো। ওদের স্মরণে গুনগুন ধ্বনি হবে না?

হবে। আয়শার ভেজা কণ্ঠস্বর শুনে আকমল হোসেন মনে করেন, একই ক্ষরণ তার ভেতরেও হচ্ছে। তাদের দূরে সরার উপায় নেই।

একই ভাবনা নিয়ে মেরিনা উঠে যায় প্রজ্বলিত মোম আনার জন্য।

গুনগুন ধ্বনি বয়ে যায় ঘরে। আয়শার মনে হয়, আজ ওর হৃদয়ে মৃদু কাপন। তার পরও সুর ওঠে

ভয়েরে মোর আঘাত করো ভীষণ, হে ভীষণ।
কঠিন করে চরণ ’পরে প্রণত করো মন।।

গানের সুর মেরিনাকে আপ্লুত করে। ও তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। মায়ের দৃষ্টি মোমবাতির শিখার ওপর—ধেয়ে যায় গুনগুন ধ্বনি–

বেঁধেছ মোরে নিত্য কাজে প্রাচীরে-ঘেরা ঘরের মাঝে
নিত্য মোরে বেঁধেছে সাজে সাজের আভরণ।।

আকমল হোসেনের মনে হয়, আয়শা গানটি তার জন্য গাইছেন। বাঁশির সবটুকু তার বুকের ভেতরে গেঁথে যাচ্ছে। তিনি প্রবল মনোযোগে গানটি শোনার জন্য কান পেতে রাখেন। আয়শা খাতুন দৃষ্টি সামনে ছড়িয়ে দেন–

এসো হে ওহে আকস্মিক, ঘিরিয়া ফেলো সকল দিক৷৷
মুক্ত পথে উড়ায়ে নিক নিমেষে এ জীবন!
তাহার পরে প্রবেশ হোক
উদার তব সহাস চোখ—তব অভয় শান্তিময় স্বরূপ পুরাতন।।

গানের রেশ শেষ হওয়ার আগেই আয়শা উঠে যান। হাঁটতে হাঁটতে গেয়ে শেষ করেন বাকিটুকু। মোমবাতির শিখা নিবুনিবু হয়ে আসে। ফোন বেজে ওঠে। আকমল হোসেন উঠে ফোন ধরেন।

হ্যালো, আঙ্কেল, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি আগে, আমি আরিফ, আঙ্কেল। আজ আমরা মন্ত্রীর গাড়িতে গ্রেনেড ছুড়েছি।

কোন মন্ত্রী, আরিফ?

মাওলানা মোহম্মদ ইসহাক।

ও বুঝেছি, মৌলিক গণতন্ত্র ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন দপ্তরের মন্ত্রী। তার পার্টি নেজামে ইসলাম। ঘটনাটা কোথায় ঘটালে?

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের রাস্তায়। সময় ছিল বেলা বারোটা পঞ্চাশ মিনিট। মাওলানা লালবাগে নেজামে ইসলামের এক কর্মিসভায় যোগদান করে সেক্রেটারিয়েটের দিকে যাচ্ছিল। লালবাগের এক রেস্তোরাঁয় বসে মন্ত্রীকে ফলো করার জন্য অপেক্ষা করি। আবুল হোন্ডার নাম্বার প্লেটে আবছাভাবে চুন লাগিয়ে নিয়েছিল। আমাদের সঙ্গে ছিল গ্রেনেড-৩৬ ও ফসফরাস-৭৭।

মন্ত্রী বের হলে আমরা তার গাড়ির পিছু নেই। গাড়ি মেডিকেল কলেজের সামনে আসতেই ট্রাফিকের লাল আলো জ্বলে ওঠে। গাড়ি থেমে যায়। আমরা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে হাত ঢুকিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে দিই। তারপর হোন্ডা নিয়ে ছুটে যাই। পেছনে শুনতে পাই বিস্ফোরণের শব্দ।

কনগ্রাচুলেশন! তোমাদের জন্য দোয়া করি, বাবা।

ফোন রেখে দেন তিনি।

আয়শা খাতুন পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, সফল অপারেশন?

হ্যাঁ। মন্ত্রীর গাড়িতে গ্রেনেড ছুড়েছে আরিফ। এমন দিনদুপুরে অপারেশন করে খুব সাহস দেখিয়েছে ওরা। নিরাপদে যেতে পেরেছে এটাও খুশির খবর।

শোকর আলহামদুলিল্লাহ। আমার ছেলে কোথায় আছে খবর পেয়েছ? গত দশ দিনে ওর কোনো খবর পাইনি।

শুনেছি ও ফার্মগেটের বাড়িতে আছে। এখনো আছে কি না, তা তো জানি না।

যাক, ভালো থাকুক। ও একটা ফোন করলে পারত।

ওই বাড়িতে ফোন নেই। তা ছাড়া সব সময় ওর খবর পাব, এমন আশা না করাই ভালো বোধ হয়। কত দিকে কত জায়গায় থাকছে, তার কি ঠিক আছে!

মন বলে যে জিনিসটি আছে, সেটা সব সময় যুক্তি মানে না। আয়শার ভেজা কণ্ঠস্বর আবার ঘরে ছড়ায়। সে কণ্ঠস্বর আকমল হোসেনের বুকে বেঁধে।

মন খারাপ করলে? আকমল হোসেন অপরাধীর ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেন।

একটু তো খারাপ হয়েছেই। এমন করে বললে, যেন এ সময় আমি বুঝি বা ছেলের চলাচল আমি নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছি।

সরি, আশা। আমি এতটা বোঝাতে চাইনি। তোমার ভাবনা ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছি। হয়তো বলাটা ঠিক হয়নি।

এসো। বুঝেছি, আর বলতে হবে না।

আয়শা মৃদু হেসে আকমল হোসেনের হাত ধরেন। দুজনে পেছনের বারান্দায় এসে বসেন। ঝোপঝাপের জোনাকি দেখেন। আয়শা বলেন, আজকের ঘটনাগুলো খুবই আকস্মিক।

যুদ্ধের সময় কোনো কিছু আকস্মিক থাকে না, আশা। সবটাই প্রস্তুতির ঘটনা। প্রতিটি ঘটনার ভেতরে গভীর অর্থ আছে। তা আমাদের বুঝে নিতে হবে। আমি যে সময়ের ইতিহাস লেখার উপকরণ সংগ্রহ করে যাচ্ছি, এসব সে ইতিহাসের বড় তথ্য। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এই ইতিহাসের উপকরণ।

হয়তো তা-ই। এত কষ্টের অভিজ্ঞতার ইতিহাস কি পৌঁছাবে স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে?

আয়শা দীর্ঘশ্বাস ফেললে আকমল হোসেন আয়শার মাথা নিজের ঘাড়ের ওপর রাখেন। হাত দিয়ে জড়িয়ে রাখেন তাঁকে। আয়শা, আমরা একসঙ্গে এই বাড়িতে স্বাধীনতার পতাকা ওড়াব।

 

সেই রাতের শেষ প্রহরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছের একটি দুর্গবাড়িতে ঢোকে পাকিস্তান আর্মি। এই বাড়ির পেছনে কাঁঠালগাছের নিচে গর্ত করে হাউস বানিয়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখা হয়েছে।

ওরা প্রথমেই প্রত্যেককে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে, আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?

আমি। তিনি সামনে এগিয়ে যান।

সেনা অফিসারদের একজন রাইফেলের বাঁট দিয়ে ভীষণ জোরে তার বুকে আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠে আসে।

এরপর হুকুম দেয়, যেখানে অস্ত্র রাখা আছে, সেটা খুঁড়ে অস্ত্র বের করতে। মাত্র দিন কয়েক আগে আরও দুই বাক্স অস্ত্র আনা হয়েছিল। আলতাফ মাহমুদ তার কালো রঙের অস্টিন কেমব্রিজে করে গোলাবারুদ নিয়ে আসেন তার বাড়িতে। একটি টিনের বাক্সে ভরা ছিল সেগুলো। বাড়ির চারজন মুক্তিযোদ্ধা অনেক রাত পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে অস্ত্রের বাক্স রেখে তার ওপর ইট-বালু দিয়ে ঢেকে রেখেছিল।

আগস্ট মাসে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির ভারত সফর করার কথা ছিল শরণার্থী শিবির দেখার জন্য। পাকিস্তান সরকার চেয়েছিল, তাকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক পরিস্থিতি দেখাবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কেনেডির অবস্থান দেখে তারা সে আমন্ত্রণ বাতিল করে। কেনেডি কলকাতা থেকে ফিরে যান। ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকার কথা ছিল কেনেডির। ইন্টারকন্টিনেন্টালে বোমা ফাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্যোগ নিয়েছিল জানান দিতে যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। শহরজুড়ে আমরা আছি।

গেরিলাদের বড়সড় আক্রমণের জন্য গোলাবারুদ জোগাড় করা হয়েছিল অনেক। পরিকল্পনামতো কাজ না হওয়ায় অল্প বারুদ দিয়ে বোমা ফাটানো হলো ঠিকই, রয়ে গেল অনেক। সেগুলো রাখার জন্য নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন আলতাফ মাহমুদ।

যমদূতের মতো এসে দাঁড়াল ইবলিসরা।

ওদের দিয়ে অস্ত্র-গোলাবারুদ তুলিয়ে গাড়িতে ওঠানো হলো। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে ওঠানো হলো বাড়ির সব কয়জন গেরিলাযোদ্ধাকে। আলতাফ মাহমুদের বুকে-মুখে তখনো রক্তের দাগ।

গাড়ি যখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়, তখন দিনের আলো শুরু হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া তেমন নেই। প্রচুর কাক উড়ছে শহরের ওপর দিয়ে। পুব আকাশে সূর্য লাল হয়ে বেরিয়ে আসছে। গাড়ি ছুটছে তেজগাঁওয়ের এমপি হোস্টেলের দিকে। সেটি এখন একটি বন্দিশিবিরে পরিণত হয়েছে। ওদের সেই বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হলো।

রাতে প্রায় নির্মুম কাটিয়েছেন আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুন। বারান্দায় আসতেই দেখলেন সিঁড়ির ওপর মেরিনা বসে আছে।

কিরে, তুই এত ভোরে?

ঘুম আসছিল না, মা। বারবার মনে হচ্ছিল, কেউ বোধ হয় গেটে ধাক্কা দিচ্ছে। আমার মনে হয়েছিল, মাঝেমধ্যে গোলাবারুদ রাখার জন্য যারা আসে, তাদের কেউ হবে। তাই উঠে পড়েছি। দেখছি কোথাও কেউ নেই। বাইরে এসে দেখি, আলতাফ ভাইও ঘাসের ওপর বসে আছেন।

আমিও ঘুমোতে পারিনি। কেমন জানি লাগছিল, বলতে পারব না। অন্য সময় ভোররাতের দিকে ঘুম আসে। কালকে তা-ও হয়নি। আমি তো সেই ভোররাত থেকে উঠে বসে আছি। রাস্তাটা এমন ফাঁকা। গেট খুলে বাইরে এসে বুক খা খা করছিল। ভয়ে আবার গেটের ভেতরে ঢুকে পড়ি।

আলতাফ থামতেই আকমল হোসেন এবং আয়শা খাতুনের দৃষ্টি মন্টুর মায়ের ওপর পড়ে। ও বারান্দার এক কোনায় গুটিসুটি শুয়েছিল। আলতাফের কথা শুনে উঠে বসেছে।

মেরিনা বলে, আমি ঘুম থেকে উঠে বুয়াকে বারান্দার কোনায় শুয়ে থাকতে দেখেছি। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? বলল, ভোররাত থেকে শরীর খারাপ লাগছে। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে। আমি বললাম, নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকেন। আমাকে বলল, ঘরে ভালো লাগছে না। মনে হয়, দম আটকে আসছে।

সবার কথা শুনে আকমল হোসেন আর আয়শা খাতুন বিষণ্ণ হয়ে যান। বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকেন। দেখতে পান, মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে সূর্য। চারদিকে ম্রিয়মাণ দিন। প্রবল বিষণ্ণতায় আক্রান্ত দুজন মানুষ তো এই সময়কে দেখছেন একটি বড় ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে। সেই ঘটনার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারা তাদের প্রত্যেকের কাছেই গৌরবের অংশীদারি হওয়া। তবে তারা কেন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবেন?

দুজনে একই ভাবনায় আত্মস্থ হওয়ায় ফাঁকে মেরিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি নিজের ঘরে গেলাম, আম্মা। আমি নাশতা খাব না। আমাকে ডাকবেন না।

তুমিও রান্নাঘরে ঢুকবে না, মন্টুর মা?

আমি তো ঢুকবই। আমার মনে হচ্ছে, আপনাদের দেখে শরীর আর তেমন খারাপ লাগছে না। আমি ঠিক হয়ে গেছি।

মন্টুর মা শাড়ির আঁচল নিজের মাথার ওপর তুলে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়। আলতাফ কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলে, আজ বোধ হয় বাজার লাগবে না। কালকে তো অনেক বাজার করেছি।

তোমার কি বাজারে যেতে ইচ্ছে করছে না?

করছে। বাজার করতে আমার ভালো লাগে। আপনি বললে আমি এখনই যাব।

তুমি তো জানো, আমার ছেলেটা যখন-তখন আসতে পারে। ওর জন্য…

ও একা নয়, খালাম্মা। আমাদের এখানে গেরিলাযোদ্ধা যে যখন আসবে, তাদের জন্য আমাদের কিছু-না-কিছু খাবার মজুত রাখতেই হবে। আমি কি বাজারে যাব?

আমি দেখে নিই ফ্রিজে কী আছে। তারপর ঠিক করব বাজার লাগবে কি। তুমি তো সকালে কিছু খাওনি, আলতাফ?

এখনো কিছু খাইনি। খাব। আমি তো পান্তা ভাত খেতে চাই।

আয়শা হাসতে হাসতে বলেন, সঙ্গে পোড়া মরিচ আর পেঁয়াজ। এবং ভাতের সঙ্গে থালাভর্তি পানিও চাই।

আলতাফ আর কথা বাড়ায় না। হকার খবরের কাগজ নিয়ে আসে। আলতাফ গেটের কাছে গিয়ে কাগজ নেয়। আকমল হোসেন হাত বাড়িয়ে রাখেন কাগজের জন্য।

পত্রিকায় অস্ত্রের ছবির ওপর সহজে দৃষ্টি আটকে যায়। প্রথমে ক্যাপশন পড়েন : শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার : কয়েকজন গ্রেপ্তার।

তিনি কাগজ মুড়ে ফেলেন। চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়। কীভাবে কী হলো? কোথায়? কাদের ধরল সেনা অফিসাররা?

ফোন করলেন আশরাফকে।

আশরাফ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, সর্বনাশ হয়েছে। বেশ কয়েকটি বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। ধরা পড়েছে কয়েকজন গেরিলাযোদ্ধা।

আবার কান্নার শব্দ ভেসে এলে মর্মাহত আকমল হোেসন বলেন, বুঝেছি। আমি পরে শুনব। এখন থাক।

আকমল হোসেন নিজেকে সামলান। বুকের ভেতরে প্রবল তোলপাড়। হাত থেকে রিসিভার পড়ে যায়।

আয়শা রিসিভার ওঠাতে ওঠাতে বলেন, কী হয়েছে?

আকমল হোসেন একটুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে নেন। তার পরও তিনি একজন পর্যদস্ত মানুষ। গলা দিয়ে স্বর বের হতে চায় না। দুবার কাশেন।

আয়শা খাতুন তাঁর হাত ধরে বলেন, এসো, বসবে।

দুজনে সোফায় গিয়ে বসেন।

যুদ্ধ তো একতরফা হয় না। যুদ্ধক্ষেত্রে নানা বিপর্যয় আছে। আমরা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। আমাদেরকে এই সহজ কথাটা বুঝতে হবে।

আয়শা প্রথমে চমকে ওঠেন। তারপর নিজেকে নিজে সামলে বলেন, গেরিলাদের কিছু হয়েছে?

হ্যাঁ।

ধরে পড়েছে?

বেশ কয়েকজন।

শহীদ?

এত খবর একবারে নিতে চাইনি। আশরাফ কাঁদছিল। আমি নিজে বের হব। বিভিন্ন বাড়িতে যাব।

আমিও যাব।

হ্যাঁ, যাবে।

নীরব হয়ে যায় বাড়ি।

আয়শার গুনগুন ধ্বনি ছড়াতে থাকে ঘরে–

অনেক দিনের আমার যে গান আমার কাছে ফিরে আসে
তারে আমি শুধাই, তুমি ঘুরে বেড়াও কোন বাতাসে।।
যে ফুল গেছে সকলে ফেলে
গন্ধ তাহার কোথায় পেলে।

গুনগুন ধ্বনি শুনে মেরিনা দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। কী ঘটল? মায়ের কণ্ঠে শুনগুন ধ্বনি কেন? ও দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের ভেতর ঢোকে না। আয়শা খাতুনের কণ্ঠে সুর জেগে ওঠে—

যার আশা আজ শূন্য হলো কী সুর জাগাও তাহার আশে॥
সকল গৃহ হারাল যার তোমার তানে তারি বাসা,
যার বিরহের নাই অবসান তার মিলনের আনে ভাসা॥

আকমল বারান্দায় উঠে আসেন। তিনি বুঝে গেছেন গুনগুন ধ্বনির অর্থ কী। কোথায় কী ঘটল? তার পা কাঁপে। তার চোখ ভিজে আসে।

রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে মন্টুর মা। কোথায় কী হলো? কেন গুনগুন ধ্বনি ছড়িয়ে গেছে বাড়িতে? কেন এই ধ্বনি বুকে এসে বাধে? কেন হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে? মন্টুর মা দরজায় মাথা রেখে নিজেকে সামলায়। সুর ছড়াতে থাকে–

শুকালো যেই নয়নবারি
তোমার সুরে কাঁদন তারি।৷
ভোলা দিনের বাহন তুমি
স্বপন ভাসাও দূর আকাশে।।

গুনগুন ধ্বনি শেষ হয়ে যাচ্ছে। মেরিনা সেই সুর বুকে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যায়। মন্টুর মা রান্নাঘরে ঢুকে স্টোভ থেকে চায়ের কেটলি নামায়। আলতাফ বারান্দায় বসে খবরের কাগজ খোলে আর ভাঁজ করে।

গান শেষ হয়ে গেছে। জেগে থাকে রেশ।

অকস্মাৎ আকমল হোসেন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। ফোপাতে থাকেন। যেন সারা জীবনের কান্নার সঞ্চয় আজ এক লহমায় শেষ করবেন। শেষ না করে তার উপায় নেই। কারণ রোধ করার সাধ্যও নিঃশেষ।

একসময় আয়শাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। জীবনের শেষ রক্ত দিয়ে প্রভাতের আলো দেখতে চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *