১১. গাত্রোত্থান করব মহান্তি সাহেব

কিরীটী বললে, এবারে আমরাও গাত্রোত্থান করব মহান্তি সাহেব। কিন্তু আজ রাত্রে আপনাকে একটু প্রস্তুত থাকতে হবে।

প্রস্তুত থাকতে হবে!

হ্যাঁ।

কি ব্যাপারে?

লতিকা গুঁইয়ের ভীতি বা আশঙ্কাটা মিথ্যা নয়। এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো নিশ্চয়ই হত্যাকারী তার ওপরে একটা অ্যাটেম্পট নেবে।

সত্যি তাই মনে করেন আপনি?

হ্যাঁ।

কিন্তু কেন?

আমার মনে হচ্ছে যেহেতু উনি হত্যাকারীর একটা পরিচয় জানেন—যেটা আমাদের কাছে ভাঙলেন না, জানি না বলে গোপন করে গেলেন, সেটা সর্বসমক্ষে প্রকাশ হয়ে পড়ুক এটা হত্যাকারী নিশ্চয়ই চায় না।

কি সে পরিচয়?

পরিচয়টা হচ্ছে আসলে সে কে! কিন্তু আর দেরি করা চলবে না। বেলা এখন প্রায় পৌনে পাঁচটা। সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে ছটার মধ্যে আমি একটা ট্রাঙ্ক কল কলকাতা থেকে এক্সপেক্ট করছি–

ট্রাঙ্ক কল! কার? প্রশ্নটা করলাম আমিই।

কালী সরকারের সলিসিটারের। চল। তারপরই ঘুরে তাকাল কিরীটী বিজয় মহান্তির দিকে। বলল, মহান্তি সাহেব, লতিকা দেবীর হোটেলে পাহারা রাখবেন। প্লেন ড্রেস পুলিস রাখবেন। আর রাত এগারটায় আমার হোটেলে আসবেন। চলি

বের হয়ে এলাম আমরা থানা থেকে।

.

সী-সাইড হোটেলের কাছাকাছি এসেছি, হঠাৎ চোখে পড়ল একটা সাইকেলরিকসায় চেপে রামানুজ যাচ্ছে।

কিরীটী রামানুজকে দেখে হাতের ইশারায় থামতে বলল।

রিকশাটা থামল। আজ রামানুজের পরনে একটা আমেরিকান প্যাটার্ণের ড্রেন-পাইপ প্যান্ট ও চিত্র-বিচিত্র একটা সিল্কের হাওয়াই শার্ট। মুখে চিউয়িং গাম ছিল বোধ হয়। অনবরত চিবোচ্ছে।

রামানুজ সাহেব যে-কোথায় চলেছেন?

থানায় গোয়িং—

থানায় কেন বলুন তো?

হ্যাঁ-দিদির কাছে শুনলাম আপনিই তো অর্ডার করেছেন থানায় যেতে, আমাকে মহাতি সাহেবের নাকি প্রয়োজন আছে। কিন্তু হোয়াই বলুন তো?

কোথায় গিয়েছিলেন আপনি দুপুরে?

ফিসিং করতে সীতে। নাইস! চলুন না একদিন।

বেশ তো। যাওয়া যাবে।

হঠাৎ কিরীটী বলে ওঠে, আচ্ছা রামানুজ সাহেব, মনে হচ্ছে কি একটা বাংলা ফিল্মে অনেকটা আপনার মত একজনকে দেখেছিলাম—আপনি কি কখনও

কিরীটীর কথা শেষ হয় না।

একগাল হেসে ফেলে রামানুজ, ইউ ঠিকই কট মি। ধরেছেন তো ঠিক। ইয়েস, একজন কমেডিয়ান হিসাবে আমার নাম আছে।

তাহলে আপনি একজন অভিনেতা বলুন? চিত্রাভিনেতা–ফিল্ম-আর্টিস্ট?

হেঁ-হেঁ-ঠিক ধরেছেন-রাইটলি কট!

আচ্ছা যান, আপনাকে আর আটকাব না। থানাতেই যাচ্ছেন তো?

হ্যাঁ।

রামানুজ চলে গেল।

আমি তখনও সেই দিকে তাকিয়ে।

কিরীটী শুধায়, কিরে—কি দেখছিস?

একটা ক্লাউন। মৃদুকণ্ঠে বললাম।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, হ্যাঁ, কোন প্রেমিক-প্রেমিকার জীবনে হঠাৎ আসা কোন বসন্তরজনীর একটি ফল।

কি বললি?

চল, কিছু না। বড় চায়ের পিপাসা পেয়েছে। একটু পা চালিয়ে চল্।

কিন্তু হোটেলে আমাদের ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালাম। দরজা খোলা-ঘরে আলো জ্বলছিল। ঘরের মধ্যে একটা ইজিচেয়ারে বসে লতিকা গুঁই।

আমাদের পদশব্দে সে নিঃশব্দে মুখ তুলে তাকাল।

লতিকা দেবী—আপনি—

লতিকার দুচোখে টলটল করছে জল।

কিরীটীই আবার বলে, আপনি হোটেলে যাননি?

না—আপনাকে আমি একটা কথা বলতে এসেছিলাম—

কী কথা বলতে এসেছেন আমি জানি।

চমকে সঙ্গে সঙ্গে মুখ তুলে তাকায় লতিকা এবং ক্ষীণকণ্ঠে বলে, আ-আপনি জানেন!

জানি। কালী সরকারের সঙ্গে আপনার সত্যকার পরিচয়টা দিতে এসেছেন।

লতিকা দেবী চুপ করে রইল।

তাই তো।

হ্যাঁ, মানে-আ-

আমি জানি, বললাম তো। আপনি-মানে কালীর সঙ্গে আপনার বিয়ে হয়েছিল।

কি কি করে আপনি জানলেন?

দুটো জিনিস থেকে।

দুটো জিনিস! বিস্ময় লতিকার কণ্ঠে।

হ্যাঁ। প্রথমতঃ কালীর ঘরে যে নোট-বই একট ছিল তার মধ্যে কালীর সলিসিটারের একটা চিঠি ছিল। যার মর্মার্থ হচ্ছে-সে আসছে দুচারদিনের মধ্যেই পুরীতে কালীর স্ত্রী লতিকা সম্পর্কে উইলের আলোচনা করতে।

আর–

আর আপনার হীরের লকেটটা যেটা আপনার হোটেলের ঘরের মেঝেতে কুড়িয়ে পেয়েছেন মিঃ মহান্তি—এই যে আপনাদের দুজনের ফটো এর মধ্যে-বলতে বলতে লকেটটা এগিয়ে দেয় কিরীটী লতিকার দিকে।

লতিকা বোকার মতই যেন হাত বাড়িয়ে লকেটটা কিরীটীর হাত থেকে নেয়।

কিরীটী বলে, এখন তো বুঝতে পারছেন কেন হত্যাকারী আপনাকে threaten করেছিল? তার সেটা জানবেন কেবল মৌখিক threaten-ই নয়—তার intention-ও তাই ছিল এবং তাই করতও। কিন্তু আর সে হবে না—হবারও নয়। আপনি নিভাবনায় হোটেলে ফিরে যান। মিসেস সরকার। হত্যাকারীকে ধরা দিতেই হবে-তার পালাবার কোন পথই আর নেই। যান-বরং সুব্রত তুই যা ওঁকে একটু এগিয়ে দিয়ে আয়।

চলুন। আমি বলি।

লতিকা উঠে দাঁড়াল।

আমরা ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম।