১০.৪ জন স্টুয়ার্ট মিল (নারীর শত্রুমিত্ৰ)

জন স্টুয়ার্ট মিল (নারীর শত্রুমিত্ৰ)

রুশো-রাসকিন পুরুষতন্ত্রের মহাপুরোহিত; নারীর জন্যে তাঁরা বিধিবদ্ধ করেছেন বিনোদযোগানো দাসীর ভূমিকা। জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁদের বিপরীত; পুরুষের মধ্যে তিনিই প্রথম নারীকে দেখেছেন মানুষরূপে, এবং নারীর জন্যে খুলে দিতে চেয়েছেন মানবিক সমস্ত এলাকা। ১৮৬৯-এ বেরোয় মিলের ‘দি সাবজেকশন অফ উইমেন’ [নারী-অধীনতা। মিল ছিলেন স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ব্যক্তির অধিকারের দার্শনিক; তিনিই প্রথম পুরুষ, যিনি একটি সম্পূর্ণ বই লেখেন নারীর অধিকারের সমর্থনে। তাঁর আগে কোনো পুরুষ নারীর দুর্দশার কথা ভাবে নি বা দুৰ্দশা থেকে উদ্ধার করতে চায় নি নারীদের, তা নয়; তাঁর আগে বাঙলায়ই আমরা পেয়েছি দুজন মানবিক নারীবাদী : রামমোহন ও বিদ্যাসাগরকে; তবে মিলই প্রথম বিস্তৃতভাবে দেখান পুরুষতন্ত্রের নারীশোষণের রূপটি। মিল রুশো বা রাসকিনের মতো ভাবালুতগ্রস্ত নন, তার মধ্যে নেই রুশোর স্ববিরোধিতা; মিল তথ্য ও যুক্তির সাহায্যে, মাঝেমাঝে ক্ষোভ মিশিয়ে, পেশ করেছেন নিজের বক্তব্য। মিল দেখান নারীর জীবনের শোচনীয় বাস্তবতা, পুরুষের অধীনে নারীর দুরবস্থা। তাঁর দেড় দশক পরে এঙ্গেলস ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’তে (১৮৮৪) উদঘাটন করেন শোষণের বিশ্বজনীন সূত্র। মিলের লেখায় পাওয়া যায় ভিক্টোরীয় পর্বের লৈঙ্গিক রাজনীতির বাস্তবতার দিকটি; ভিক্টোরীয় পুরুষ ও মহাপুরুষদের মতো নারী সম্পর্কে তিনি পরীর গল্প বলেন নি, বলেছেন নির্মম সত্য। মিলের নারী-অধীনতা প্রথাবিরোধী রচনা, তাতে প্রথার সমস্ত শেকড় তুলে ফেলা হয়েছে অকাট্য যুক্তির সাহায্যে। মানুষের অগ্ৰগতি ও স্বাধীনতার বড়ো বাধা হচ্ছে প্রথা, সুবিধাভোগীরা ওই প্রথাকেই ঐশ্বরিক, শাশ্বত, প্রাকৃতিক বলে প্রচার করে টিকিয়ে রাখতে চায় নিজেদের স্বার্থ। নারী প্রথার প্রধান শিকার। যিনি প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলেন, প্রথাবাদীরা তাঁর নিন্দা রটায়; নিন্দা রটানো হয়েছিলো মিলের বিরুদ্ধেও। মিল বইটি লিখেছিলেন ১৮৬১তে; বইটি লেখায় তাকে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন স্ত্রী হ্যারিয়েট টেইলর, এবং সহায়তা করেছিলেন সৎকন্যা হেলেন টেইলর। হ্যারিয়েট নারীবাদী আন্দোলনকারী ছিলেন, মিল তাঁকে বিয়ে করার সময় খ্রিস্টান স্বামীর সমস্ত আইনসঙ্গত অধিকার লিখিতভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কেননা তা স্বামীস্ত্রীর সাম্যের বিরোধী। তাই মিলের নারী-অধীনতা পারিবারিক আবেগ থেকেই জন্মেছিলো, যদিও বইটিতে আবেগের কোনো চিহ্ন নেই। মিলের ‘নারী-অধীনতা’য় উপস্থাপিত হয়েছে কালকালান্তর ধ’রে নারীর শোচনীয় অবস্থার বাস্তবতা; তিনি আক্রমণ করেছেন নারীর আইনগত দাসীত্বকে, শিক্ষার নামে অশিক্ষাকে, ভিক্টোরীয় যুগের স্ত্রীসুলভ অধীনতাকে। তাঁর বক্তব্য বিপ্লবাত্মক, যখন নারীর জন্যে দাসীর দর্শন রচনা করাই ছিলো মহাপুরুষত্ব, তখন তিনি দাবি করেছিলেন নারীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও পুরুষের সাথে বিশুদ্ধ সাম্য। মিলের মূল প্রতিপাদ্য (১৮৬৯, ১) :

‘যে-নীতি নিয়ন্ত্রণ করে দু-লিঙ্গের মধ্যে প্রচলিত সামাজিক সম্পর্ক–এক লিঙ্গের কাছে আরেক লিঙ্গের আইনগত অধীনতা–তা সম্পূর্ণ ভুল; এবং এখন মানুষের অগ্রগতির এক প্রধান বাধা; এর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিশুদ্ধ সাম্যের নীতি, এতে একপক্ষের থাকবে না বিশেষ কোনো ক্ষমতা বা সুবিধা, অন্যপক্ষেরও থাকবে না কোনো অসুবিধা।‘

পুরুষতন্ত্রের কাছে তখন এমন বক্তব্য ছিলো পুরুষতন্ত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। তিনি জানতেন তাঁর বক্তব্য কলহ বাধাবে, এবং তা বেধেছিলো প্ৰচণ্ডভাবে। তাঁর বক্তব্যে পাগল হয়ে গিয়েছিলো ভিক্টোরীয় পুরুষতন্ত্র; এবং মিলকে দিয়েছিলো উন্মাদ আর অনৈতিকের অপবাদ।

পুরুষতন্ত্রের কোনো যুক্তি ছিলো না, কিন্তু ছিলো প্ৰথা, আর গোঁড়ামি। মিল জানতেন, যাঁরা আক্রমণ করেন কোনো বিশ্বজনীন বিশ্বাস বা প্রথাকে, তাদের ভাগ্যে জোটে দুঃসহ দুৰ্দশা, কখনো সুপরিকল্পিত অবহেলা। মিলের নারী-অধীনতা প্রথার বিরুদ্ধে যুক্তির আক্রমণ; এতে নেই ভাবাবেগ বা মিথ্যার দোহাই, যদিও যে-সময় তিনি লিখছিলেন তখন প্রথাবদ্ধ গোড়াদের শক্তির প্রকাশ ঘটতো প্রথাগত ভাবাবেগের মধ্য দিয়ে, যেমন আজো ঘটে। মিল (১৮৬৯, ৫) বলেছেন, ‘আমি কলহ করতে চাই না তাদের সাথে, যাদের বিশ্বাস নেই যুক্তিতে, কিন্তু অতিবিশ্বাস রয়েছে প্রথায় ও সাধারণ আবেগে।’ নারী পুরুষের অধীনে, এ-সম্পর্কে মিল (১৮৬৯, ৮) বলেছেন, যারা মনে করে নারীদের থাকতে হবে পুরুষদেরই অধীনে, তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে বিশেষ এক তত্ত্ব। ওই তত্ত্বটি তারা গোঁড়ামির সাথে পোষণ করে আসছে, তাই ওই তত্ত্বের বিরোধী আর কিছু কখনো পরীক্ষা ক’রে দেখতে দেয়া হয় নি। নারীপুরুষের অসাম্য, মিলের মতে, বিশেষ বিচারবিবেচনার ফল নয়; এর উদ্ভব ঘটেছে পুরুষের শারীরিক শক্তির ফলে। পুরুষ শক্তিবশত নারীকে নিজের অধীন করেছে। পরে আইন বিধিবদ্ধ করেছে তাই। মিল দেখিয়েছেন শক্তিপ্রয়োগের ফলেই সূচনা ঘটেছে সব রকম আধিপত্য ও অধীনতার, তারপর আধিপত্য ও অধীনতাকেই পরিণত করা হয়েছে বিধানে। নারীর অধীনতাকে মিল তুলনা করেছেন দাসত্বপ্রথার সাথে। মিল দেখিয়েছেন দাসত্ব শুরুতে ছিলো প্ৰভু ও দাসের মধ্যে শক্তির ব্যাপার; কিন্তু পরে তা বিধানে পরিণত করা হয়। প্রভুরা একত্র হয়ে দাসত্বকে পরিণত করে বিধানে। মিলের মতে প্ৰাচীন কালে অধিকাং নরনারীই ছিলো দাস; পরে মুক্তি লাভ করে পুরুষ দাসেরা, আর নারীকে বিন্যস্ত করা হয় একটু কোমল ধরনের অধীনতার ভেতবে। বর্তমানে নারীপুরুষের যে-অসাম্য, তার মূলে রয়েছে শক্তিমানের আইন। মিল মনে করেন শক্তিমানের আইন এখন পরিত্যক্ত হ’লেও তা রয়ে গেছে নানা এলাকায়, যেমন নারীর বেলা। শক্তিমানের বিধি অনুসারে নারী পরিণত হয়েছে গৃহদাসীতে।

পুরুষতন্ত্র প্রচার করে যে পুরুষের প্রভুত্ব ও নারীর অধীনতা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক। কোনো কিছুকে প্রাকৃতিক/স্বাভাবিক বলার অর্থ হচ্ছে তা মানুষের তৈরি নয়, তা কোনো শাশ্বত বিধানের ফল। তাই তা প্রশ্নের ওপরে, তা অসংশোধনীয়। কিন্তু মানুষের জীবনে কোনো কিছুই শাশ্বত নয়; বিধাতা, ধর্ম, রাজা, প্ৰজা, ধনী, দরিদ্র সবই মানুষের তৈরি। সুবিধাভোগীরা চিরকালই দোহাই দেয় ঈশ্বরের, প্রকৃতির, স্বভাবের; কেননা তাতে রক্ষা পায় তাদের স্বার্থ। মিল (১৮৬৯, ২১) প্রশ্ন করেছেন, ‘এমন কি কোনো আধিপত্য রয়েছে, যা প্রাকৃতিক মনে হয় নি প্ৰভুদের কাছে?’ তিনি দেখিয়েছেন এক সময় মানবসমাজকে ভাগ করা হতো দুটি ভাগে : ছোটো ভাগটিতে পড়তো প্রভুরা আর বড়ো ভাগটিতে দাসেরা, এবং তাকেই মনে করা হতো প্রাকৃতিক; এমনকি শ্রেষ্ঠ পুরুষেরাও তাই মনে করতো। জ্ঞানী আরিস্তলের কাছেও প্ৰভু ও দাসের বিভাগকে মনে হয়েছিলো প্রাকৃতিক। তিনি মনে করতেন মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে দুটি ভাগ : একটি স্বাধীন প্রকৃতির, যেমন গ্রিকরা; আরেকটি দাসপ্রকৃতির, যেমন থ্রেসীয় ও এশীয়রা। মার্কিন দাসমালিকেরাও প্রাকৃতিক বলে মনে করতো শাদার প্রভুত্ব ও কালোর দাসত্বকে। রাজতন্ত্রবাদীরা সব সময়ই মনে করেছে যে রাজতন্ত্রই প্রাকৃতিক। এসবের মূলকথা হচ্ছে যারা জোর ক’রে ক্ষমতা দখল করেছে, যারা প্ৰভু হয়ে উঠেছে, তাদের কাছে প্ৰভুত্ব মানেই প্রাকৃতিক। চিরকাল বিজয়ীরা মনে করেছে যে প্রকৃতির নির্দেশ হচ্ছে বিজিতরা অধীনে থাকবে বিজয়ীদের। মধ্যযুগে সামন্ত প্রভুরা নিজেদের প্রভুত্বকে মনে করতো প্রাকৃতিক; নিম্নশ্রেণীর মানষেরা তাদের সমান হবে এমন ভাবনাকে তারা মনে করতো সম্পূর্ণ অপ্রাকৃতিক বা অর্থাভাবিক। তা-ই মানুষের কাছে অস্বাভাবিক/ অপ্রাকৃতিক বলে মনে হয়, যা অপ্রথাগত; যা প্রথায় পরিণত হয়েছে, তা যতোই অস্বাভাবিক উৎকট পাশবিক হোক-না-কেনো, তা-ই মানুষের কাছে স্বাভাবিক। মিল (১৮৬৯, ২২-২৩) তথাকথিত প্রাকৃতিককে নির্দেশ করেছেন প্ৰথা বলে :

‘এটা এতো সত্য যে অস্বাভাবিক বলতে সাধারণত বোঝানো হয় শুধু অপ্ৰথাগতকে, আর যা কিছু প্রথাগত তাকেই মনে করা হয় প্রাকৃতিক/স্বাভাবিক। নারীর পুরুষাধীনতা যেহেতু বিশ্বজনীন প্রথা, তাই এর থেকে সামান্য স’রে যাওয়াকে মনে হয় অস্বাভাবিক।‘

অপ্ৰথাগত ব’লে অস্বাভাবিক মনে হওয়ার নানা উদাহরণ দিয়েছেন মিল। বিলেতের শাসক একজন নারী, এটা খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার বলে মনে হয় পৃথিবীর নানাদেশের মানুষের কাছে; রানীর শাসন তাদের কাছে অবিশ্বাস্যরূপে অস্বাভাবিক। ইংরেজের কাছে এটা অস্বাভাবিক নয়, কেননা এতে তারা অভ্যস্ত; কিন্তু নারীদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া বা সংসদ সদস্য হওয়া তাদের কাছে অস্বাভাবিক। চিরকালই সুবিধাবাদী শোষকেরা নিজেদের আধিপত্য নিরঙ্কুশ রাখার জন্যে দোহাই দেয় প্রকৃতির। নারীকে বশে রাখার জন্যে তারা দোহাই দিয়েছে প্রকৃতির। মিল ‘প্রাকৃতিক’ ধারণাকেই বাতিল ক’রে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে নারীপুরুষকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা এবং তাদের সামাজিক, রাজনীতিক, আর্থনীতিক অবস্থাকে প্রাকৃতিক বলে দাবি করা একধরনের রাজনীতি। মিলের কাছে কোনো কিছুই প্রাকৃতিক নয়। পুরুষতন্ত্ৰ মনে করে পুরুষের প্রভুত্ব ও নারীর দাসীত্ব প্রাকৃতিক; মিল দেখিয়েছেন এটা সম্পূর্ণ কৃত্রিম।

পুরুষতন্ত্রের প্রবক্তারা বলে থাকে যে নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য ভিন্ন অন্যান্য আধিপত্য থেকে, কেননা এটা শক্তির আধিপত্য নয়; নারী এ-আধিপত্য মেনে নিয়েছে, গ্রহণ করেছে স্বেচ্ছায়। এর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই নারীর, নারী স্বীকৃতি দিয়েছে এ-আধিপত্যকে। আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হতে পারে; এখনকার নারীপুরুষের অবস্থা দেখে মনে হতে পারে যে পুরুষাধিপত্য নারীর কাছে আকর্ষণীয়। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে প্রকৃত সত্যটি যে নারী পুরুষাধীনতা মেনে নেয় নি। মিল বলেছেন, বহু নারী পুরুষাধিপত্যকে স্বীকার করে না; অনেকে লেখার মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে তাদের মনোভাব, এবং এখন নারীরা এর বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ জানাচ্ছে প্রকাশ্যে। নারীরা ভোটাধিকার চায়, চায় পুরুষের সাথে সমান শিক্ষা ও পেশা। মিলের সময় পর্যন্ত নারীবাদীরা স্পষ্টভাবে বলে নি যে তারা পুরুষাধিপত্য মানে না, তারা সম্পূর্ণ মুক্তি চায়; কিন্তু মিল তাদের আন্দোলনে দেখেছেন পূর্ণ মুক্তির অভিলাষ। মিল বলেছেন, কোনো পরাধীন শ্রেণীই একবারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে না। যারা বহুদিন প্রচলিত কোনো শক্তির অধীনে থাকে, তারা শুরুতেই ওই শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় না, প্রতিবাদ জানায় শুধু তার পীড়নের বিরুদ্ধে। অসংখ্য নারী প্রতিবাদ জানায় তাদের স্বামীদের পীড়নের বিরুদ্ধে। মিল বলেছেন, নারীরা একযোগে নানা কারণে পুরুষের ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে না। তারা অন্য সমস্ত অধীন-শ্রেণী থেকে ভিন্ন; তাদের প্রভুরা তাদের কাছে শুধু শ্ৰম চায় না, প্রভুরা তাদের কাছে শ্রমের থেকে কিছুটা বেশি চায়। পুরুষ শুধু নারীদের আনুগত্য চায় না, পুরুষ চায় নারীদের আবেগানুভূতি। শুধু বর্বর ছাড়া কোনো পুরুষই নারীকে একটি বাধ্য ক্রীতদাসী হিশেবে পেতে চায় না, চায় একটি স্বেচ্ছাদাসী; পুরুষ তার নারীর কাছে শুধু দাসী চায় না, চায় প্রিয়দাসী। তাই পুরুষ সব রকমের চেষ্টা চালায় নারীর মনকে দাসীতে পরিণত করার। অন্য ধরনের দাসদের প্রভুরা ভয় জাগিয়ে আনুগত্য আদায় করে দাসদের কাছ থেকে, আর নারীর প্রভুরা যেহেতু শুধু আনুগত্যে সুখী নয়, যেহেতু তারা নারীর কাছে চায় আবেগানুভূতি, তাই তারা নারীকে দেয় এক বিশেষ ধরনের শিক্ষা। পীড়ন ক’রে নয়, শিক্ষা দিয়ে পুরুষ নারীকে ক’রে তোলে প্রিয় ক্রীতদাসী। পুরুষতন্ত্রের উদ্ভাবিত নারীশিক্ষা হচ্ছে নারীকে পুরুষের দাসী করার শিক্ষা। শিশুকাল থেকেই নারীদের শেখানো হয় যে তাদের প্রকৃতি পুরুষের বিপরীত; নারীরা নিয়ন্ত্রণ করবে না, তারা আত্মসমৰ্পণ করবে। অন্যের নিয়ন্ত্রণের কাছে; সব ধরনের নীতিশাস্ত্র শেখায় যে পুরুষের কাছে আত্মসমর্পণই তাদের কর্তব্য; আর সব ধরনের ভাবালুতা তাদের শেখায় যে নারীর প্রকৃতি হচ্ছে অন্যের জন্যে বেঁচে থাকা, নিজেদের সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা। বঞ্চিত হওয়াই নারীত্ব! নিজের স্বার্থে নিজের অধীনে রাখার জন্যে পুরুষ নারীকে এমন শিক্ষা দিয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে, যাতে নারী হয়ে উঠেছে বিনম, বশ্যতাপরায়ণ, এবং নিজের অভিলাষ ছেড়ে দিয়েছে সে পুরুষের হাতে।

পুরুষতন্ত্রের মতে বর্তমানে নারীপুরুষের যে-অবস্থা, পুরুষের আধিপত্য ও নারীর অধীনতা, ঘটেছে নারীপুরুষের স্বভাব বা প্রকৃতি অনুসারে। মিল একে বাতিল ক’রে দিয়েছেন, কেননা তাঁর মতে নারীপুরুষের স্বভাব বিজ্ঞানসন্মতভাবে জানার মতো উপায় তখনো উদ্ধাবিত হয় নি। তাই তাদের স্বভাব বলে যা নির্দেশ করা হয়, তা বানানো জিনিশ। মিল (১৮৬৯,৩৮) বলেছেন :

‘একথা বলা যাবে না যে এ-দু-লিঙ্গের প্রকৃতি অনুসারেই তাদের বর্তমান ভূমিকা ও অবস্থান নির্ণীত হয়েছে, এবং এ-ই। তাদের জন্যে উপযুক্ত। সাধারণ বুদ্ধি ও মানবমনের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমি একথা স্বীকার করি না যে এ-দু-লিঙ্গের প্রকৃতি কেউ জানে বা জানতে পারে, বিশেষ ক’রে যখন তাদের দেখা হয় তাদের বর্তমান পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসারে।… এখন যাকে নারীপ্রকৃতি বলা হয়, তা সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম জিনিশ–একদিকে তা পীড়নের, আরেক দিকে তা অস্বাভাবিক প্ররোচনার ফল। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আর কোনো অধীন-শ্রেণীর চরিত্র তাদের প্রভুদের সাথে সম্পর্কের ফলে এতো অস্বাভাবিকভাবে বিকৃত হয় নি।‘

পুরুষ শিক্ষা দিয়ে বদলে, বিকৃত ক’রে দিয়েছে নারীর স্বভাবকে; নারীকে ক’রে তুলেছে বশ্যতাপরায়ণ, ভীরু, ভাবালুতগ্রস্ত, এবং এর ফলে নারীকে আর যোগ্য মনে হয়। না কোনো মানবিক কাজের। নারীপুরুষের স্বাভাবিক পার্থক্য কোথায়? পুরুষতন্ত্রের প্রবক্তারা বলে যে তারা তা জেনে গেছে সম্পূর্ণরূপে; কিন্তু মিলের মতে সমাজের বর্তমান অবস্থায় তা জানা সম্পূর্ণ অসম্ভব। মিল দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন স্বভাবের ওপর প্রতিবেশের প্রভাবের দিকে। নারীপুরুষের নৈতিক ও মননগত পার্থক্য যতো ব্যাপকই মনে হোক-না-কেনো এখন, মিল তাকে কিছুতেই স্বাভানিক পার্থক্য বলে মেনে নিতে রাজি নন। কেননা শিক্ষা ও প্রতিবেশের প্রভাবে নারী তার প্রকৃত স্বভাব হারিয়ে ফেলেছে, গ্রহণ করেছে কৃত্রিম স্বভাব। মিলের মতে, পুরুষ নারীকে যা মনে করে নারী তা নয়। পুরুষ নারী সম্পর্কে যা বলে তা ঠিক নয়, নারীর কথা বলতে পারে শুধু নারী।

পুরুষ সাধারণত ধারণা করে যে নারীর ভূমিকা হচ্ছে স্ত্রী ও মাতার। মিল একে শুধু ধারণা ব’লেই মনে করেন, ধ্রুব সত্য বলে মনে করেন না, কেননা সমাজের বর্তমান অবস্থায় জানার কোনো উপায় নেই নারী নিজেকে দেখতে পছন্দ করে কোন ভূমিকায়। এমনও হতে পারে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকাকে ঘেন্না করে তারা; তবে নারীদের যেহেতু স্বাধীনভাবে কোনো ভূমিকা বা পেশা বেছে নিতে দেয়া হয় নি, তাদের ওপর যেহেতু চাপিয়ে দেয়া হয়েছে স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকা, তাই তারা বাধ্য হয়ে তা পালন করে; কিন্তু একে তাদের স্বাভাবিক ভূমিকা মনে করার কোনো কারণ নেই। মিলের মতে দাসদের যেমন বাধ্য করা হতো বিশেষবিশেষ কাজ করতে, কারণ ওই কাজ সমাজের জন্যে দরকার, তেমনি নারীদের বাধ্য করা হয় বিয়েতে ও সন্তান লালনে, কেননা সমাজের তা দরকার। পুরুষ নারীর সমস্ত পথ বন্ধ করে খোলা রেখেছে। শুধু বিয়ের গলিটি, তাই ওই কানাগলিতে নারীকে ঢুকতেই হয়। মিলের মতে বিয়ে হচ্ছে নারীর সমাজনির্ধারিত নিয়তি। মিল দেখিয়েছেন এক সময় খ্রিস্টানদের মধ্যে স্বামী ছিলো স্ত্রীর জীবনমৃত্যুর অধিপতি। মিল (১৮৬৯, ৫৫) বলেছেন :

‘এখন স্ত্রী হচ্ছে তার স্বামীর দাসখত দেয়া দাসী : আইনের চোখে তারা ক্রীতদাসদের থেকে একটুও কম দাস নয়। বেদীতে সে স্বামীর প্রতি জীবনব্যাপী আনুগত্যের শপথ নেয়।… স্ত্রী নিজের জন্যে কোনো সম্পত্তি অর্জন করতে পারে না, স্বামীর জন্যে পারে; তার সম্পত্তি অবলীলায় স্বামীর সম্পত্তি হযে ওঠে। বিলেতের সাধারণ আইনে স্ত্রীর অবস্থা অনেক দেশের ক্রীতদাসের অবস্থার থেকেও খারাপ।‘

মিল অবশ্য দেখিয়েছেন যে আইনের চেয়ে মানুষ, এমনকি পুরুষও অনেক ভালো; যদি তা না হতো তবে পৃথিবীটা বেশ একটা নরক হয়ে উঠতো। আইন পুরুষকে যতোটা নিষ্ঠুরতার অধিকার দিয়েছে পুরুষ ততোটা নিষ্ঠুর নয়, বা পুরুষের পক্ষে অসম্ভব ততোটা নিষ্ঠুর হওয়া। তবে আইনে নারী পুরুষের দাসীই।

নারী পুরুষের ওপর নানা প্রভাব খাটাতে পারে, মেষ বানিয়ে রাখতে পারে পুরুষকে; কিন্তু নারীর ওই শক্তির কোনো কোনো মূল্য নেই। মিলের মতে নারীর এ-শক্তি কিছুতেই নারীর স্বাধীনতাহীনতার ক্ষতি পূরণ করতে পারে না। নারীর এ-শক্তি নারীকে অবৈধ অধিকার দিতে পারে, কিন্তু তাকে তার বৈধ অধিকার দাবি করার অধিকার দেয় না। মিল (১৮৬৯,৭০) বলেছেন, সুলতানের প্রিয় ক্রীতদাসীর অধীনেও থাকে অনেক দাসদাসী, তাদের ওপর সে উৎপীড়নও চালিয়ে থাকে; কিন্তু তাতে সে স্বাধীন মানুষ হয়ে ওঠে না, সে থাকে ক্রীতদাসীই। যা কাম্য তা হচ্ছে সে নিজেও দাসী হবে না, আর তার অধীনেও থাকবে না দাসদাসী। কোনোকোনো নারী থাকে অশেষ সুখ ও শক্তির মধ্যে, তবে তা দাসীর সুখ ও শক্তি; সে ওই সুখশক্তি পায় প্রভুকে সেবার ও প্রমোদ দেয়ার বিনিময়ে। মিল ভিক্টোরীয় সমাজের একটি ভণ্ডামোরও সমালোচনা করেছেন। ভিক্টোরীয়রা বারবার বলতো যে নারী পুরুষের থেকে অনেক উৎকৃষ্ট, আর একথা বেশি বলতো তারা, যারা নারীদের আসলেই মনে করতো দাসী। এটা কি এক পরিহাস নয় যে উৎকৃষ্টরা থাকবে নিকৃষ্টদের অধীনে? ভিক্টোরীয়রা নারীদের উৎকৃষ্টতায় বিশ্বাস করতো না, তবে তাদের বশে রাখার জন্যে করতো। এ-তোষামোদটুকু। মিল প্রশ্ন করেছেন, নারীরা উৎকৃষ্ট কিসে, এবং দেখিয়েছেন নারীরা পুরুষের থেকে উৎকৃষ্ট শুধু আত্মোৎসর্গপরায়ণতায়! কেননা পৃথিবী জুড়েই শিশুকাল থেকেই নারীদের শেখানো হয় যে তারা জন্ম নেয় আত্মোৎসর্গের জন্যে; তারা নিজেদের যতো বঞ্চিত কববে ততোই উন্নতি ঘটবে পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার! নারী বেঁচে থাকে নিজেকে বঞ্চনা করে, কেননা আত্মবঞ্চনাই পুরুষতন্ত্রের মতে নারীত্ব। মিল মনে করেন নারীপুরুষ যদি সমানাধিকার পায়, তবে লোপ পাবে নারীর এ-আত্মঘাতী প্রবণতা। ভিক্টোরীয়রা বড়াই করতো নৈতিকতায়, মিল তাদের নৈতিকতার ভেতরে লুকোনো অনৈতিকতার রূপটিও তুলে ধবেছেন। মিল মনে করেন সাম্যই নৈতিকতা, আর সে-সমাজই নৈতিক যেখানে রয়েছে সাম্য। এতোদিন ধরে যে-সমাজ চলে এসেছে, সেটা বলতান্ত্রিক সমাজ; সেখানে সমান হওয়ার অর্থই হচ্ছে শত্রু হওয়া। ওই সমাজ ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত শেকল বা মইয়ের মতো, সেখানে কেউ ওপরে কেউ নিচে; তাতে কেউ আধিপত্য করে কেউ থাকে অধীনে। তাই প্ৰচলিত নৈতিকতা হচ্ছে আধিপত্য ও অধীনতার নৈতিকতা। মিল মনে করেন আধিপত্য ও অধীনতা হচ্ছে সমাজের বিকার; সমাজের স্বাভাবিক রূপ হচ্ছে পারস্পরিক সাম্য। তিনি মনে করেন মনুষ্যত্ব নিহিত পরস্পরের সাথে সমভাবে বসবাসের মধ্যে। তিনি দেখিয়েছেন বর্তমান ব্যবস্থায় পরিবার হচ্ছে স্বৈরাচারের রাজ্য; তবে তিনি মনে করেন ঠিক মতো গড়ে উঠলে পরিবার হবে স্বাধীনতার রাজ্য। মিল আক্রমণ করেছেন পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকে, যেখানে পুরুষ প্ৰভু নারী তার অধীন। মিল দাবি করেছেন নারীপুরুষের আইনগত সমানাধিকার, পরিবারে কেউ প্ৰভু বা দাসদাসী হবে না; স্বামীস্ত্রী হবে সমান।

পুরুষতন্ত্র নারীপুরুষের বিশ্বকে দুটি পরিচ্ছন্ন ভাগে ভাগ করে; নারীর জন্যে বরাদ্দ করে ঘর, পুরুষের জন্যে বাইর। ভিক্টোরীয়রা ছিলো ঘরে বাইরে তত্ত্বের একনিষ্ঠ উপাসক। পুরুষ নারীকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে, তাকে মা-স্ত্রী-কন্যার ভূমিকা দিয়ে কেড়ে নেয তার সমস্ত মানবিক অধিকার। মানবিক প্রায় সব পেশাই তারা নিষিদ্ধ করে নারীর জন্যে। নারী যে ওই সব পেশার অযোগ্য, তা নয়; তবে পুরুষ জোর ক’রেই নারীকে ঘোষণা করে ওইসব পেশার অযোগ্য বলে। পুরুষের সমান হয়ে ওঠার জন্যে নারীর ফিরে পাওযা দরকার সমস্ত মানবিক পেশা। নারীপুরুষের সাম্যের জন্যে মিল নারীর জন্যে চেয়েছেন সে-সব ভূমিকা ও পেশা, যা এতোদিন ধরে রয়েছে পুরুষের অধিকারে। তিনি দেখিয়েছেন নারীকে সব পেশা ও ভূমিকা থেকে দূরে রাখা হয়েছে, যাতে নারী পরিবারের মধ্যে সহজে মেনে নেয় পুরুষের আধিপত্য। তাঁর মতে অধিকাং পুরুষ সমান কারো সাথে বসবাসের কথা ভাবতেই পারে না। তাই পুরুষ নারীকে দূরে রেখেছে সমস্ত আকর্ষণীয় পেশা থেকে, যা নারীকে ক’রে তুলবে পুরুষের সমান। পুরুষ অবশ্য যুক্তি দেয় যে নারী ওই সব কাজের উপযুক্ত নয়, নারীর নেই ওই সব কাজের প্ৰতিভা বা যোগ্যতা। মিল ইতিহাস থেকে উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন যে নারী সম্পর্কে এ-ধারণা সত্য নয়; সত্য হচ্ছে নারী সব কাজই যোগ্যতার সাথে সম্পন্ন করতে পারে। তবে নারীকে অনেক কাজ করতেই দেয়া হয় নি, তাই তারা যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পায় নি। তাদের যে-কাজ করতেই দেয়া হয় নি, সে-কাজে তাদের অযোগ্যতা প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও বলা হয় তারা সে-কাজের উপযুক্ত নয়। মিল বলেছেন, এখনো কোনো নারী হোমার, আরিস্তাতল বা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো দেখা দেয় নি; তাই ব’লে মনে করা যায় না যে কোনো কালে ওই মাপের কোনো নারী দেখা দেবে না। তবে নারীরা এলিজাবেথ বা জোয়ান অফ আর্ক হয়েছে। মিল দেখিয়েছেন এখনকার আইনের এক বিস্ময়কর বিধান হচ্ছে যে-কাজে নারীরা দক্ষতা দেখিয়েছে, সে-কাজ থেকেই বহিষ্কার করা হয়েছে নারীদের। এমন কোনো আইন নেই, যাতে নারীদের শেক্সপিয়র বা মোৎসার্ট হওয়া নিষেধ, তবে নারীরা রাজ্যশাসনে দক্ষতা দেখালেও তাদের রাজনীতিক ক্ষমতা লাভ নিষিদ্ধ। এলিজাবেথ বা ভিক্টোরিয়া ক্ষমতা পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে, নইলে তাদের রাজনীতিক ক্ষমতা পাওয়ার কোনো পথ ছিলো না। পুরুষতান্ত্র নারীর বিরুদ্ধে তোলে যে-সব অভিযোগ, মিল সেগুলোর উত্তর দিয়েছেন এক-এক করে, এবং দেখিয়েছেন সব অভিযোগই বানানো; সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। নারীর মেধা কম নয়, শক্তিও কম নয়; নারী কোনো কিছুতেই নিকৃষ্ট নয় পুরুষের থেকে; নারী পুরুষের সমান। তাই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার পরিপূর্ণ সাম্য। স্টুয়ার্ট মিল নারীপুরুষের সাম্য চেয়েছেন শুধু নারীর কল্যাণের জন্যে নয়, চেয়েছেন মানবজাতি ও সভ্যতার কল্যাণের জন্যে। মিলের বইটিকে সে-সময়ের নারীবাদীরা নিজেদের পবিত্র বই হিশেবে গ্রহণ করেছিলেন; এবং তাঁর বিভিন্ন যুক্তি গত একশতকের বেশি সময়ে ছড়িয়ে পড়েছে বই থেকে বইয়ে। নারীর মুক্তিতে মিল ও নারী-অধীনতার ভূমিকা অশেষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *