১০. সজল চক্রবর্তীর পর এলো সুহাস মিত্র

সজল চক্রবর্তীর পর এলো সুহাস মিত্র। নিয়মিত ব্যায়াম করলে যেমনটি হয়, তেমনি সুগঠিত চেহারা, পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। কালোর উপর সব কিছু মিলিয়ে সুহাস মিত্রের চেহারাটা যাকে বলে সুশ্রী তাই। সমস্ত মুখে একটা আত্মবিশ্বাস ও বুদ্ধির ছাপ।

বসুন সুহাসবাবু–কিরীটী বললে।

সুশীলবাবু বলছিলেন, আপনি নাকি কি সব আলোচনা করতে চান।

হ্যাঁ—দু-একটা প্রশ্ন আর কি মিত্রানী সম্পর্কে।

ক্ষণকাল সুহাস মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো–তারপর শান্ত গলায় বললে, তা শুনতে পারি কি কি প্রশ্ন আপনার মিত্রানী সম্পর্কে : অবিশ্যি উত্তর আমার জানা থাকলে নিশ্চয়ই পাবেন।

ধন্যবাদ।

কিন্তু কিরীটীবাবু, কি হবে আর তার কথা জেনে। সে তো আজ অতীত। কোনদিনই সে ফিরে আসবে না।

শেষের দিকে কিরীটীর যেন মনে হলো, সুহাস মিত্রের গলাটা যেন কেমন রুদ্ধ হয়ে এলো।

সুহাসবাবু, আপনি তো তার একসময় সহপাঠী ছিলেন—অনেক দিনের পরিচয় আপনাদের ছিল—কিছুটা হয়ত ঘনিষ্ঠতাও ছিল—

না। পরিচয় ছিল ঠিকই—তবে ঘনিষ্ঠতা বলতে যা বোঝায় সে রকম কিছুই ছিল না।

আপনি তাকে–মানে মিত্রানীকে ভালবাসতেন?

সাধারণ একজন মার্চেন্ট অফিসের কেরানীর ভালবাসা কি আজকের দিনে ভালবাসা!

টাকা-পয়সা-মান-সম্পদ বা মর্যাদা দিয়ে তো ভালবাসার বিচার হয় না। যাক সে কথা, আপনি কি কখনো তাকে আপনার মনের কথা জানিয়েছেন?

না।

কেন?

প্রয়োজন বোধ করিনি শেষ পর্যন্ত—

কে প্রয়োজন বোধ করেননি?

কখনো কখনো মনে হতো বলি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যখন জানতে পারলাম—সে অন্য একজনকে ভালবাসে–

কি করে জানলেন? নিশ্চয়ই কেউ আপনাকে বলেছিল?

ধরে নিন তাই!

কিন্তু সে যে সত্য বলেছে তার প্রমাণ কি আপনি কিছু পেয়েছিলেন?

সত্য যা তার কি আবার কোন প্রমাণের দরকার হয় কিরীটীবাবু! ও-কথা থাক। আর কি আপনার জানবার আছে বলুন।

সেদিন যখন ঝড় ও ধুলোর অন্ধকারে সকলের কাছ থেকে ছিটকে পড়ে অন্ধের মত পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন আপনার আশেপাশে আর কারো গলা শুনছিলেন বা আর কারোর সাড়া পেয়েছিলেন কিংবা কারো কোনরকম চিৎকার বা আর্তনাদ আপনার কানে এসেছিল সুহাসবাবু? এ

না, তাছাড়া আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই একটা ভারী গাছের ডালের তলায় অকস্মাৎ আমি চাপা পড়েছিলাম, সব অন্ধকার হয়ে যায়—আমি জ্ঞান হারাই।

আচ্ছা ঠিক যে মুহূর্তে ঝড়টা ওঠে, তখন আপনার আশেপাশে কারা ছিল মনে আছে?

হাত দুয়েকের মধ্যে ছিল বিদ্যুৎ, আর তারই পাশে ছিল বোধ হয় মিত্রানী—

তার কাজল বোস?

ঠিক মনে নেই—তবে কাজল বোধ হয় আমার কাছাকাছিই ছিল।

হুঁ। আর একটা কথা। সেদিন যতক্ষণ গার্ডেনে ছিলেন, দূরে বা কাছে কোন তৃতীয় কাউকে আপনার নজরে পড়েছিল কি—যার মাথায় ধরুন একটা বেতের টুপি ছিল আর হাতে বা গলায় একটা বায়নাকুলার ঝোলানো ছিল?

বায়নাকুলার—বায়নাকুলার, হা হ্যাঁ, মনে পড়েছে—-খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা সকলে যখন গঙ্গার ধারে গিয়ে বসি, যেন একজনকে মুখে চাপদাড়ি, চোখে রঙিন চশমা, পরনে কালো প্যান্ট ও গায়ে স্ট্রাইপ দেওয়া একটা হাওয়াই শার্ট দেখেছিলাম বার দুই ভদ্রলোক বায়নাকুলার দিয়ে গঙ্গার মধ্যে যেন কি দেখছিলেন—আমাদের কিছুটা দূরেই–

আপনার পরিচিত কেউ নন?

না। তাছাড়া পরিচিত হলে তো আমাদের কাছে বসতো।

ঝড়টা যখন ওঠে তখন তাকে দেখেছিলেন?

ঠিক তেমন নজর করিনি—নিজেরাই হঠাৎ ধুলোয় পড়ে বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম

আচ্ছা সুহাসবাবু, আপনি নিশ্চয় রুমাল ব্যবহার করেন? কিরীটীর প্রশ্ন।

করি বৈকি।

সেদিন নিশ্চয়ই আপনার পকেটে রুমাল ছিল?

ছিল। সিলকের রুমাল ছিল কি সেটা?

না মশাই, সাধারণ ক্যালিকোর রুমাল একটা-সাদা।

আপনার রুমালের কোণে নাম লেখা থাকত বা কোন চিহ্ন?

হ্যাঁ–আমার ডাক নাম টুটু ইংরাজীতে টি অক্ষরটা লেখা থাকত।

হঠাৎ পকেট থেকে একটা সিল্কের রুমাল বের করলো কিরীটী—সাধারণ জেন্টস রুমালের সাইজের থেকে সামান্য একটু বড়-তার এক কোণে ইংরাজী টি অক্ষরটা সবুজ সুতো দিয়ে বোনা। বললে, দেখুন তো, এই রুমালটা একবার!

দেখি রুমালটা, রুমালটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে সুহাস বললে, আশ্চর্য!

কি হলো?

রুমালটা আমারই মনে হচ্ছে—কিন্তু–, রুমালটা কিরীটীর হাতে আবার ফিরিয়ে দিল সুহাস।

আপনারই রুমাল! এটা তো সিল্কের?

হ্যাঁ  গত বছর কাজল আমার জন্মদিনে সবুজ সুতো দিয়ে টি লিখে এই রুমালটাই আমাকে উপহার দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ পিকনিকের দিন দুই আগে কোথায় যে রুমালটা ফেললাম আর খুঁজে পাই নি, অথচ মনে আছে সেটা অফিসে আমার পকেটেই ছিল।

ঠিক বলেছেন—ঠিক চিনতে পেরেছেন ওটা আপনারই রুমাল?

হ্যাঁ—তাছাড়া দেখুন ওর এক কোণে লাল কালির একটা দাগ আছে—

কথাটা মিথ্যা নয়, কিরীটী দেখতে পেল, সত্যিই এক কোণে একটা লাল কালির দাগ আছে রুমালটায়।

কিন্তু এটা—এটা আপনি পেলেন কোথায় কিরীটীবাবু? ব্যগ্র কণ্ঠেই প্রশ্ন করে সুহাস মিত্র কিরীটীকে।

এই রুমালটাই পাকিয়ে ফাঁস দিয়ে মিত্রানীকে সেদিন–

না-না-না—একটা যেন চাপা আর্তনাদ করে ওঠে সুহাস, না, না, না।

কিরীটী তাড়াতাড়ি রুমালটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর শান্ত গলায় ডাকল, সুহাসবাবু?

আঁ।

আপনার ফেবারিট ব্রান্ড সিগারেট চার্মিনার, তাই না?

হ্যাঁ—

দিনে কতগুলো সিগারেট খান?

তিন-চার প্যাকেট।

আচ্ছা আপনি মিত্রানীর হত্যার ব্যাপারে দলের মধ্যে কাউকে সন্দেহ করেন?

আমাদের দলের মধ্যে-না, না—এ অসম্ভব—

কিন্তু পুলিশের ধারণা, সেদিন আপনাদের মধ্যেই কেউ–

হরিবল! কি বলছেন আপনি?

আমার কি ধারণা জানেন?

কি?

ঐ ধুলোর ঝড় আর অন্ধকারের ভেতরেও আপনাদের মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ কিছু অস্পষ্টভাবে দেখেছেন বা শুনেছেন, যেটা সেদিন আপনাদের জবানবন্দিতে কেউই আপনারা সুশীল নন্দীর কাছে প্রকাশ করেননি–অথচ যে কথাটা জানতে পারলে মিত্রানীর হত্যাকারীকে ধরার ব্যাপারে হয়ত অনেক সাহায্য পেতো পুলিস!

আমি-আমি—আমার কথা আমি বলতে পারি—অন্তত আমি কিছু আপনাদের কাছে গোপন করিনি—সুহাস মিত্র বলে উঠলো জবাবে—

কিরীটী তার কথাটার আর জের টানলো না। সে সম্পূর্ণ অন্য এক প্রশ্ন করলো। বললে, আচ্ছা সুহাসবাবু, কাজল বোস সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

সুহাস মিত্র প্রথমটায় কিছু সময় চুপ করে রইলো তারপর ধীরে ধীরে বললে, মিত্রানীকে ও বোধ হয় একটু হিংসা করতে

সেটা ওর সঙ্গে আমি কথা বলেই বুঝতে পেরেছি—তা নয়, আমার প্রশ্ন আপনি নিশ্চয়ই জানেন।

কি?

উনি আপনাকে ভালবাসেন!

জানি।

ওঁর প্রতি আপনার মনোভাবটা বোধ হয় বিপরীত?

আমি ওকে ঠিক পছন্দ করি না।

তার কোন কারণ আছে?

আসলে ও দেহে মেয়েছেলে হলেও মনের গঠনের দিক দিয়ে ঠিক যেন তা নয়— র্যাদার ওর মধ্যে একটা যেন পুরুষালী ভাব আছে

মৃদু হেসে কিরীটী বললে, আপনি যে মিত্রানীকে মনে মনে ভালবেসেছিলেন, সেটা বোধ হয় উনি অনুমান করতে পেরেছিলেন!

মিত্রানীর প্রতি আমার মনোভাব তো কখনো ঘুণাক্ষরেও কারো কাছে আমি প্রকাশ করিনি—

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ভালবাসার ব্যাপারটা মুখ ফুটে প্রকাশ না করলেও মেয়েদের কাছে অস্পষ্ট থাকে না সুহাসবাবু।