১০. তারপর একটা বরফযুগ চলে গিয়েছে

অনুর মনে হয় তারপর একটা বরফযুগ চলে গিয়েছে।

সে নিসাড় হয়ে পড়েছিলো। মাথা তুলতে পারে নি। চোখ খুলে তাকাতে পারে নি। কেমন করে সূর্য উঠেছে, কিভাবে দিন হয়েছে, রাত্রি গড়িয়েছে, তার কিছুই সে জানে না। ঝগড়ার সেই রাত্রেই তার জ্বর আসে। জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে, পাগলের মতো সে পৃথিবীময় একজন বুড়ো আইনস্টাইনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

দেখা হয়েছে লামার মামার সঙ্গে। ভাঙা করুণ বেহালা হাতে। পিঠের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা, আমি জেড. আহম্মদ সাহেবের শ্যালক, গাইয়ে।

বললেন, কি মনে করে সব শেখালেন, তারপর কি মনে করে আমার বেহালাটাকে জ্যান্ত জবাই করে কোথায় যে চলে গেলেন! আইনস্টাইন যেন কী!!

অনু বললে, পৃথিবীর মাস্তুল কোথায় দেখিয়ে দেবে? বললেন, সর্বনাশ, তার গায়ে যে টাটকা রক্ত। ধূর্ত কাকের ঝাঁক মাস্তুলের উপর বসে, মানে মাস্তুলের উপর বসে আহার সন্ধান করছে। তোমার একজোড়া নৌকোয় সূর্যের ডিম দুটি ঠুকরে ঠুকরে খাবে, অন্ধ হয়ো না!

তা খাক। অন্ধ হই সে-ও ভালো, তবু যেতে ভালোবাসি!

বললেন, এইমাত্র—

বললেন, এইমাত্র এইমাত্র—

বললেন, এইমাত্র এইমাত্র এইমাত্র–

অনু বললে, বুঝতে পারি না, চিৎকার করে কথা বলো, চিত্তার চিৎকার করে, চিৎকার!

এইমাত্র ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আইনস্টাইনকে—ঘোষণা করে দাও, বজ্রাঘাত হানো! এইমাত্র ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আইনস্টাইনকে—ঘোষণা করে দাও, দাবানল জ্বালো! ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, ওগো দয়া করো, ওগো দয়া করো; এদের কোনো ধর্ম দীর্ঘনিশ্বাস বলে আজো আমাকে ডাকলো না।

আর আমি, অনু বলে প্রত্যুত্তরে, কি যেন কি যেন বলে, ঝিনুকের ঝরনা দেখতে বেরিয়েছিলাম সেই সকালে, উপনীত হলাম জল্লাদের জঠরাগ্নির মত্তহাহায়; মত্তহাহা মহাহা—এ কি নিহত গরুড় মাটি কামড়ে পড়ে আছে যে! একা চিৎপাত হয়ে এমন চিৎকার করে ধ্রুপদ গাইছিলে যে অনেক হাঁপানি খেয়েছি এবার পানি দাও তৃষ্ণার শুনতে পাও নি। তোবড়ানো গালে সরুদাসীর ঘষা ঝিনুক উল্টে রেখেছো, এখন সরুদাসী বাজিয়ে ঝঝর ঝঝর ঝাঁপতাল ঝিঝি ঝিঝি শোনাও!

বললেন, পালাও!

বললেন, আবার পালাও।

বললেন, আবার আবার পালাও। প-লা-য়-ন-চা-ই-বি-শ্বে!

বললেন, জিডি সিগন্যাল পাঁচ শূন্যশূন্যশূন্যশূন্যশূন্য পাঁচ শূন্যশূন্যশূন্য শূন্যশূন্য কাক!

অনু বললে, আমি পালাতে আবার পালাতে, আবার আবার পালাতে পারি না। এই তো আইফেল টাওয়ারের নিচে পড়ে আছি।

কোতোয়াল কাকের পিঠে চেপে নেমে এলো মা, চলো আমার সঙ্গে শীর্ষে!

তারপর মা এখন তুমি শীর্ষে।

মা বললে, তাহলে তুমি—

মা বললে, তাহলে তুমি এখন—

মা বললে, তাহলে তুমি এখন শস্যের মতো শীর্ষে।

অনু বললে, বিকেলে নদীর উপর জামবাটি উপুড় করে মস্ত বড় ডিমের কুসুম ঢেলে দেওয়া চলবে না, আমি চিৎকার করে বলবো আর তোমাকে রাত্রি পড়তে দেবো না, আমি চিৎকার করে বলবো রাত্রির গায়ে উৎকট গন্ধ কি যে, আমি চিৎকার করে বলবো-হা চিইইইইইইইইইইইইইইইত্যার করে বলবো রাত্রিকে রাত্রিকে রাত্রিকে আমার ঘৃণা, আমি চিৎকার করে বলবো পনেরোটা দিন সমানে খুবলে খুবলে চাঁদ খায়, কানাচোখে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে–

তারপর, তারপর মা এক ফুৎকারে তার চিৎকারের প্রদীপটাকে, তার চিল্কারের লীলাচঞ্চল নীল শিখাকে নিস্তব্ধ করে দশ লক্ষ কালো চাদরে ঝিনুকের ঝরনা ঢেকে দিলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *