১০. ট্রেন ছাড়ল সাড়ে নটায়

ট্রেন ছাড়ল সাড়ে নটায়।

কামরা প্রায় ফাঁকাই ছিল, শেষ মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল একদঙ্গল কলেজের মেয়ে। সঙ্গে এক মধ্যবয়সী গোলগাল চেহারার। অধ্যাপিকা। টুপুরদের কুপেই অধ্যাপিকার বার্থ, সুটকেস সিটের তলায় ঢুকিয়ে দিয়েই ছাত্রীদের উদ্দেশে কড়া গলায় চোস্ত হিন্দিতে হাঁক ছুড়তে শুরু করেছেন তিনি। এপাশে ওপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছাত্রীদের উচ্ছাস নিবে যাচ্ছে পলকের জন্য, পরক্ষণে আবার কলকল করে উঠছে তারা।

ডানকুনি পেরোনোর পর খানিকটা সুস্থিত হলেন অধ্যাপিকা। ওয়াটার বটল থেকে ঢকটক জল খেয়ে মিতিনের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললেন, আপলোগ কেয়া বাঙালি হ্যাঁয়?

মিতিন ঘাড় নাড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় প্রশ্ন, যাচ্ছেন কদ্দূর?

ভাগলপুর।

 আমিও। ভালই হল, গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।

আপনারা কি চেন্নাই থেকে করমন্ডলে এলেন? না ম্যাড্রাস মেলে?

ভদ্রমহিলা জোর চমকেছেন, বুঝলেন কী করে চেন্নাই থেকে আসছি?

মিতিন মুচকি হাসল, আপনার প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ দুটোয় চেন্নাই-এর দোকানের নাম ঠিকানা লেখা রয়েছে যে।

বাহ্, আপনার দৃষ্টি তো দারুণ!

দুমিনিটেই আলাপ জমে গেল। মহিলার নাম শর্মিলা মৈত্র, ভাগলপুরেই বাস, স্থানীয় সুন্দরবতী কলেজে ইতিহাস পড়ান, ছাত্রীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গিয়েছিলেন চেন্নাই-এ, বাড়ি ফিরছেন প্রায় দিন কুড়ি পর। এতদিন ধরে ছাত্রীদের সামলাতে সামলাতে তাঁর হাড়মাস কালি হয়ে গেছে, বাড়ি ফিরে এবার গঙ্গায় একটা ড়ুব দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবেন। চেন্নাই-এ ছাত্রীদের কীর্তিকাহিনী শোনাতে শোনাতে হঠাৎ থমকালেন শর্মিলা, চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাগলপুরে কোথায় যাচ্ছেন আপনারা? কোনও রিলেটিভের বাড়ি?

নাহ। যাচ্ছি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে। খরমনচকে।

ওমা, খুরমনচকে তো আমার বাপের বাড়ি। ওখানে কার কাছে যাবেন?

গণপতি চৌধুরী। চেনেন?

 কেকজেঠুকে চিনব না? বিলকুল চিনি। তা তাঁর কাছে যে হঠাৎ?

বিশেষ প্রয়োজনে।

 ও। শর্মিলা একটু থেমে থেকে বললেন, কেকজেঠুর শরীরটা ইদানীং ভাল যাচ্ছে না। গত মাসে দেখলাম বেশ নুয়ে পড়েছেন। বললেন কী সব জ্বরজারি হয়েছিল, তারপর থেকেই হাঁটাহাঁটি করলে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। প্রায় নব্বই বছর বয়স হল, চিরকাল দেখেছি টানটান হয়ে হাঁটছেন, এই প্রথম দেখলাম কেকজেঠুর হাতে লাঠি।

মিতিন প্রশ্ন করল, কেকজেঠু বলে ডাকেন কেন? গণপতিবাবুর বেকারি আছে বলে?

ঠিক ধরেছেন। ছোটবেলায় কেকজেঠু আমাদের কত কেক যে খাইয়েছেন। শর্মিলাকে সামান্য উদাস দেখাল, জানেন তো, কেকজেঠুর মাইকেল বেকারি একসময়ে আমাদের ছিল। মানে আমাদের ঠিক নয়, আমার এক দাদুর।

টুপুরের সঙ্গে চোখাচোখি হল মিতিনের। নড়েচড়ে বসেছে মিতিন। কৌতূহলী গলায় বলল, সুরেন মাইকেল আপনার…?

বাবার আপন জ্যাঠা।

কিন্তু তাঁর সঙ্গে তো শুনেছি আপনাদের পরিবারের কোনও সম্পর্ক ছিল না?।

না, না, তা কেন, সম্পর্ক একটা ছিল। আমি অবশ্য তাঁকে দেখিনি। তিনি আমার জন্মের বহুকাল আগেই গত হয়েছেন। তবে বাবার মুখে শুনেছি তিনি ভাইপো-ভাইঝিদের যথেষ্ট ভালবাসতেন। বাবারা তো প্রায়ই যেতেন তাঁর বাড়িতে। তবে আমাদের মেমসাহেব ঠাকুমা নাকি ওই মেলামেশা বিশেষ পছন্দ করতেন না। পাছে ভাগলপুরে থাকলে ছেলেটাও নেটিভ বনে যায় তাই সুরেনদাদুর মৃত্যুর পর পরই তিনি ভাগলপুর ছেড়ে চলে যান।

সুরেনদাদুর ছেলেকে আপনি দেখেছেন? কিংবা তাঁর বংশধরদের?

 সুরেনদাদুর ছেলেকে এক বার দেখেছি। প্রায় ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগে। কেকজেঠুরই বাড়িতে। আলাপও হয়েছিল সামান্য। শুনেছিলাম তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। সেই মেয়ে নাকি একবার এসেছিল ভাগলপুরে। গত ডিসেম্বরে। বরের সঙ্গে।

ডিসেম্বরে? আপনি শিওর? জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে নয়?

না, না, ডিসেম্বরেই। ক্রিসমাসের আগে। কেকজেঠুর বাড়িতে এখনও ক্রিসমাসের সময়ে ঢালাও কেক বানিয়ে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানোর প্রথা আছে। ওই দিনই কেকজেঠুর মুখে শুনেছিলাম। কেকজেঠু দুঃখ করে বলছিলেন, সুরেন মাইকেলের ছেলে নাকি বাড়ি বিক্রি করার জন্য মেয়ে জামাইকে পাঠিয়েছিলেন।

সে তো বিক্রি হয়ে গেছে।

তাও শুনেছি। শর্মিলার চোখে এতক্ষণে প্রশ্ন ঘনাল, তা আপনি এই সব খবরের সঙ্গে কীভাবে যুক্ত?

সরাসরি কোনও যোগ নেই। জোনাথন মাইকেলের সঙ্গে আমার সম্প্রতি পরিচয় হয়েছে, ওঁর মুখেই যা শুনেছি। মিতিন আড়চোখে টুপুরকে দেখে নিয়ে গলা ঝাড়ল, আমি ফার্স্ট জেনারেশান অ্যাংলোইন্ডিয়ানদের নিয়ে একটা সোশিওলজিকাল স্টাডি করছি। জোনাথন মাইকেলের পরিবারটা আমার কাছে একটা আইডিয়াল স্টাডি মেটিরিয়াল। মিস্টার মাইকেলের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে ডিটেল জানার জন্যই আমার এই ভাগলপুর পাড়ি দেওয়া। আশা করছি গণপতিবাবু আমায় এ ব্যাপারে বেশ খানিকটা সাহায্য করতে পারবেন।

আমিও আপনাকে কিছু বলে দিতে পারি। যেমন সুরেনদাদুর বাবা ছিলেন…।

না না, ওঁদের সম্পর্কে আমি মোটামুটি জানি। আমার আগ্রহ এখন সুরেনবাবুর স্ত্রীর পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে। মানে ইউরোপিয়ান পাস্ট অফ অ্যান অ্যাংলোইন্ডিয়ান ফ্যামিলি। মিস্টার মাইকেল বলেছেন গণপতিবাবু নাকি আমায় কিছু নতুন তথ্য দিতে পারেন।

কী আর বলবেন কেকজেঠু! বড় জোর বলবেন সুরেনদাদু এক অভিশপ্ত ইউরোপিয়ান বংশের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন…

অভিশপ্ত বলছেন কেন?

কারণ আমাদের মার্গারেট ঠাকুমার দিদিমার বাবাটি একটি ঘোরতর অন্যায় কাজ করেছিলেন যে।

কীরকম?

মহারাজা কানোয়ার সিং-এর নাম শুনেছেন? সিপাই বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক?

যিনি তাঁতিয়া টোপির খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন?

হ্যাঁ, সেই কানোয়ার সিং। বিহারের জগদীশপুরে ছিল তাঁর এস্টেট। আঠেরোশো সাতার সেরা নভেম্বর তিনি কানপুরে ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ হেনেছিলেন। গোলিয়ারের বিদ্রোহী সিপাইদের সঙ্গে নিয়ে পরাস্ত করেছিলেন জেনারেল উইল্ডহ্যামকে। পরে অবশ্য জেনারেল ক্যাম্পবেল এসে যাওয়ার ফলে তিনি পিছু হঠতে বাধ্য হন। পরের বছর আজিমগড়ের যুদ্ধেও কানোয়ার সিং ব্রিটিশদের কাছে হেরে যান। আঠেরোশো আটান্নর এপ্রিলে কানোয়ার সিংকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডটি ঘটানোর মূল হোতা ছিলেন ওই রবার্ট ম্যাকগ্রেগর। আমাদের মেমঠাকুমার দিদিমার সেই বাবাটি। কীভাবে তিনি কানোয়ার সিংকে মেরেছিলেন জানেন? আজিমগড়ের কাছে মন্নুহার বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে নৌকোয় চড়ে গঙ্গা পার হচ্ছিলেন মহারাজা কানোয়ার সিং, ব্রিটিশরা তাঁকে অভয়ও দিয়েছিল তিনি স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারেন, কোনওভাবেই তাঁকে আক্রমণ করা হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কথা রাখেনি। মন্নুহারের শেউপুরা ঘাট পার হওয়ার সময়ে কানোয়ার সিংকে আওতার মধ্যে পেয়ে মেগনা নামের এক গানবোট থেকে শুরু হল গোলাবর্ষণ। নৌকোতেই মারাত্মকভাবে জখম হলেন কানোয়ার সিং। মারা গেলেন দুদিন পর। তারিখটা ছিল তেইশে এপ্রিল। প্রচুর ধনরত্ন ছিল মহারাজা কানোয়ার সিং-এর সঙ্গে। সব সাফ করে দিয়েছিলেন ম্যাকগ্রেগর আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা। তবে অন্যায়ভাবে লুঠ করা মাল হজম করা তো কঠিন, বছর ছয়েক পরে অপঘাতে মারা যান ম্যাকগ্রেগর। ওই তেইশে এপ্রিলই। ম্যাকগ্রেগরের দুই ছেলেও বাঁচেনি, বাপের আগেই তারাও…।

মিতিন আর টুপুর মন দিয়ে শর্মিলার কথা শুনছিল। মিতিন দুম করে জিজ্ঞেস করল, এত গল্প আপনিই বা জানলেন কী করে?

হিস্টোরিকাল পোরশানটা বই ঘেঁটে ঘেঁটে। আর ম্যাকগ্রেগরের কাহিনী তো আমাদের ফ্যামিলিতে মুখে মুখে ঘোরে। সুরেনদাদুই কিছু কিছু গল্প করেছিলেন তার ভাইদের। তা ছাড়া মার্গারেট ঠাকুমার মা বাবা তো আমাদের ওখানে ভিখানপুরেই থাকতেন, ওই সাহেবপাড়া থেকেও গল্প ছড়িয়েছে কিছু। একটা গুজব তো এখনও জোর চালু। ম্যাকগ্রেগরের কলকাতার যে বাড়িটা মার্গারেট ঠাকুমা পেয়েছিলেন, সে-বাড়িতে নাকি এখনও কানোয়ার সিং-এর অনেক ধনরত্ন লুকোনো আছে। কানোয়ার সিং-এর অভিশাপে ম্যাকগ্রেগর সে সব তো ভোগ করতে পারেনইনি, আজ পর্যন্ত তাঁর পরিবারের কেউও সেই ধনরত্নের হদিস পায়নি। গুপ্তধন ও বাড়িতে যখের ধন বনে গেছে।

হুম। মিতিন মাথা নাড়ল, আমিও ওরকমটা শুনেছি। কিন্তু সত্যিই কি আছে কিছু?

যা রটে তার কিছুটা তো অন্তত সত্যি। নিশ্চয়ই কিছু আছে। তবে আমার ব্যক্তিগতভাবে ও ব্যাপারে কোনও কৌতূহল নেই। আমার শুধু ভাবতে খারাপ লাগে সুরেনদাদুর নাতি-নাতনিদের সঙ্গে আমাদের কখনও কোনও পরিচয়ই ঘটল না। অথচ সম্পর্কে তারা তো আমার ভাই বোনই হয়। কী বলেন?

টুপুর বলে উঠল, সত্যি কী অদ্ভুত, তাই না? একই বংশের হয়েও তারা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। পশ্চিমবাংলায় বাস করেও অবাঙালি। আর আপনার আজীবন বিহারে বসবাস করেও বাঙালি।

মন্দ বলোনি। শর্মিলা মাথা নাড়লেন, তবে কী জানো, আমরা কোনওকালেই ভাগলপুরকে আলাদা করে বিহার বলে ভাবিনি। ভাবতাম ওটা আমাদের বাঙালিদেরই শহর। কত বাঙালি যে ছিল ভাগলপুরে। নামকরা ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক… সব লাইনেই বাঙালিরা ছিল লিডিং পজিশানে।

মিতিন বলল, কালচারাল দিকটাই বা বাদ দিচ্ছেন কেন? সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও কি ভাগলপুরের অবদান কম? শরৎচন্দ্র থাকতেন ভাগলপুরে, বনফুল ছিলেন, কর্মসূত্রে বিভূতিভূষণও ছিলেন বেশ কিছুদিন। রবীন্দ্রনাথও তো বাস করে গেছেন ভাগলপুরে। রাজা রামমোহনও। এ ছাড়া আরও কত নামীদামি মানুষ…

ঠিক। শর্মিলা স্মিত মুখে বললেন, ভাগলপুরের বাঙালিরা কী বলে জানেন তো? বেড়াল যেমন বাঘের মাসি, ভাগলপুর তেমনি সংস্কৃতিতে বাংলার মামা।

মানে?

ওখানে কত বিখ্যাত বাঙালির মামার বাড়ি আছে, ভাবুন তো। অশোককুমার-কিশোরকুমারদের মামার বাড়ি ভাগলপুর। অভিনেতা অনিল চ্যাটার্জির মামার বাড়ি ভাগলপুর। সঙ্গে সবার মাথার ওপর শরৎচন্দ্র তো আছেনই। বলতে বলতে শৰ্মিলার মুখে যেন একটা ছায়া পড়ল, কিন্তু সেই মামার বাড়ির দেশ থেকে বাঙালিরা এখন ঘটিবাটি বেচে পালাচ্ছে। লাস্ট তিরিশ-চল্লিশ বছরে কত বাঙালি যে ওখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গেল। জানেন, এখন ইউনিভার্সিটিতে এমএ ক্লাসে বাংলার স্টুডেন্ট পাওয়া যায় না।

গল্পে গল্পে রাত হয়েছে অনেক। ট্রেন রামপুরহাট ছাড়িয়ে প্রায় বাংলা-বিহারের সীমানায়। শর্মিলার ছাত্রীদেরও হইহল্লা থেমে গেছে, যে যার বার্থে শুয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। অন্যান্য যাত্রীরাও ঘুমে প্রায় অচেতন।

পাকুড় পার হওয়ার পর শর্মিলাও চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। মিতিনও উঠে গেল আপার বাংকে। শুধু টুপুরের চোখে ঘুম নেই, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জানলার বাইরে। আজ বেশ চাদের আলো আছে, মনোরম জ্যোৎস্নায় ছেয়ে আছে চরাচর। বাংলার সমতলভূমি পার হয়ে এখন শুরু হয়েছে এবড়োখেবড়ো বিহার। মাঝে-মাঝেই দেখা যায় ছোট বড় টিলা। চাদের কিরণ মাখা টিলাগুলোকে কী মায়াবী যে লাগছে এখন। সরু একটা রুপোলি নদী পার হয়ে গেল ট্রেন। ঝুঁঝকো অন্ধকারের মতো এবার দুপাশে ছোট্ট জঙ্গল..

নিসর্গশোভা দেখতে দেখতে কখন যেন চোখ দুটো জুড়ে গিয়েছিল টুপুরের, জেগে উঠল মিতিনমাসির ধাক্কায়, এই ওঠ ওঠ, সাবর পেরিয়ে গেছে। এর পরই ভাগলপুর।

শর্মিলাও উঠে বসে চাদর ভাঁজ করছিলেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন, আপনারা উঠছেন কোথায়? কেকজেঠুর বাড়ি?

না। হোটলেই উঠব।..স্যান্ডিস কম্পাউন্ডের কাছে ভাল হোটেল আছে শুনেছি?

স্যান্ডিস নয়, স্যান্ডস কম্পাউন্ড। মুখে মুখে যদিও স্যান্ডিসটাই চালু হয়ে গেছে। স্যান্ড নামে একজন ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর প্রকাণ্ড মাঠটাকে উপবন বানিয়েছিলেন। সাহেব-মেমদের প্রমোদ ভ্রমণের জন্য। সুযোগ পেয়েই একটু জ্ঞান বিতরণ করে নিলেন শর্মিলা। হেসে বললেন, হ্যাঁ, ওইদিকটায় থাকাই ভাল। শহরের ওই সাইডটা এখনও যা একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বাকি গোটা টাউনটাই যা নোংরা হয়ে গেছে।

শর্মিলার কথা বর্ণে বর্ণে সত্যি। পুরনো শহরটা সত্যিই বেশ অপরিচ্ছন্ন। অসম্ভব ধুলো, রাস্তাঘাটে অজস্র খানাখন্দ, যত্রতত্র ষাঁড় গোরু গাধা চরে বেড়াচ্ছে, রাশি রাশি রিকশার আওয়াজে কানে তালা লাগার জোগাড়।

কালেক্টরেটের দিকটায় এসে বুকভরে নিশ্বাস নিতে পারল টুপুর। স্যান্ডস কম্পাউন্ড দেখে সত্যিই চোখ জুড়োল। কী প্রকাণ্ড মাঠ। শাল-সেগুন গাছে ভরা মাঠের বুকে হালকা জঙ্গলের আভাস। দেখতে বেশ লাগে।

কম্পাউন্ডের কাছেই হোটেল অমরে উঠল টুপুররা। ছিমছাম সাজানোগোছানো হোটল। রুমে ঢুকেই টুপুর বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে মিতিন তাড়া লাগিয়েছে, এই, একদম শুবি না। চটপট স্নান সেরে নে। ব্রেকফার্স্ট করেই আমরা বেরিয়ে পড়ব।

টুপুর মৃদু প্রতিবাদ জুড়ল, এক্ষুনি? এই সাতসকালে?

হ্যাঁ, সাতসকালেই। এখানকার গরম তো জানো না! বেলা বাড়লেই লু বইবে, চামড়ায় ফোসকা পড়ে যাবে।

অগত্যা কী আর করা, টুপুরকে উঠতেই হয়। আধ ঘণ্টার মধ্যে তরতাজা হয়ে টোস্ট ওমলেট কফি সাঁটিয়ে বেরিয়ে পড়ল দুজনে। সাইকেল রিকশা ধরে মিনিট দশেকের মধ্যে খরমনচক।

গণপতি চৌধুরীর বাড়ি খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধে হল না। মাইকেল বেকারির চৌধুরীবাবুকে অঞ্চলের প্রায় সবাই চেনে। লোহার গেটসলা বড়সড় দোতলা বাড়িটা দেখিয়ে দিলেন একজন স্থানীয় বাসিন্দা।

গেট ঠেলে ঢুকতেই এক প্রৌঢ়ের মুখোমুখি। মিতিন টুপুরকে দেখেই তার ভুরুতে ভাঁজ, কাকে খুঁজছেন?

গণপতি চৌধুরী।

বাবাকে? কিন্তু বাবার তো শরীরটা ভাল নেই।

আমরা অনেকদ্দূর থেকে আসছি। কলকাতার জোনাথন মাইকেলের কাছ থেকে। ওঁর সঙ্গে খুব জরুরি প্রয়োজন।

ভদ্রলোক ভীষণ অবাক হয়েছেন, কার কাছ থেকে? জোনাথন আঙ্কল?

হ্যাঁ।

আসুন আসুন।

একতলার একটা ছোট মতন বসার ঘরে মিতিনদের অপেক্ষা করতে বলে দোতলায় উঠে গেলেন ভদ্রলোক। মিনিট কয়েকের মধ্যেই নেমে এসেছেন এক বৃদ্ধ। পরনে লুঙ্গি, ফতুয়া, হাতে বাঁধানো ছড়ি। দীর্ঘদেহী মানুষটির চামড়া এখনও কুঁচকোয়নি তেমন, মাথা ভরতি ধবধবে সাদা চুল, ইয়া মোটা শুভ্র গুম্ফ শোভা পাচ্ছে মুখমণ্ডলে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কাশছেন অল্প অল্প।

মিতিন উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করল, আমার নাম প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি। আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার।

গণপতিবাবুর কাশি থেমে গেল। চোখ বড় বড় করে জরিপ করলেন মিতিনকে। সন্দিগ্ধ স্বরে বললেন, ডিটেকটিভ?

হ্যাঁ।

একটু সময় নিয়ে ধাতস্থ হলেন গণপতিবাবু। তবু চোখ থেকে বিস্ময় যেন কাটেনি। সোফায় বসে বললেন, কলকাতার জোনাথনের কাছ থেকে আসছ? কী ব্যাপার বলো তো? কিছু অঘটন ঘটেছে কি?

না। ঘটার উপক্রম হয়েছে। জোনাথন মাইকেলের জীবন বিপন্ন। কে একজন তাকে ভয় দেখাচ্ছে।

ও। তা আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

আমার বিশ্বাস ওঁকে ভয় দেখানোর সঙ্গে এখানে ওঁর বাড়ি বিক্রি করার একটা কানেকশান আছে।

বুঝলাম না।

জোনাথন মাইকেলের তো এখানে দুটো বাড়ি ছিল, তাই না?

হ্যাঁ, একটা চার্চ রোডে, আর একটা গঙ্গার ধারে।

 মানে বুড়ানাথের মন্দিরের কাছে?

বলতে পারো। ওই বাড়ি দুটো বিক্রি করার পর থেকেই মিস্টার মাইকেলের ওপর নানা ধরনের হামলা শুরু হয়েছে। তাই আমি বিক্রির ডিটেলটা একটু জানতে চাই। মানে কাকে বিক্রি করেছেন, কত দামে…

 সে তো তুমি জোনাথনের কাছ থেকেই জানতে পারবে। আমার কাছে আসার দরকার কী?

উনি তো বলছেন ওঁকে নাকি নিজের বাড়ি পর্যন্ত আসতেই দেওয়া হয়নি। স্টেশনের কাছে এক হোটেলে উঠেছিলেন, সেখানেই সইসাবুদ হয়েছে।

আসতে দেওয়া হয়নি কথাটা ডাহা মিথ্যে। গণপতি চৌধুরীকে আগে খবর দিয়ে রাখলে ভাগলপুর শহরে কোন শর্মার সাহস আছে তাকে হোটেলে আটকে রাখত? গণপতিবাবুকে হঠাৎই বেশ উত্তেজিত দেখাল, আদতে জোনাথন আমার কাছে আসতেই চায়নি।

কিন্তু কেন?

 পাছে আমার ঠিক করা পার্টিকে বাড়ি বিক্রি করতে হয়। অথচ জোনাথন প্রথমে আমারই দ্বারস্থ হয়েছিল। ডিসেম্বর মাসে মেয়ে-জামাইকে পাঠিয়েছিল খদ্দের খুঁজে দেওয়ার জন্যে। এই নব্বই বছর বয়সে আমি ঘুরে ঘুরে লোকও ঠিক করলাম। প্রাথমিক কথাবার্তাও হয়ে গেল। ওই মেয়ে-জামাইয়ের সামনেই। বুড়ানাথ মন্দিরের বাড়িটা কিনবেন ডক্টর সতীশ ঝা, এগারো লাখ টাকায়। আর চার্চ রোডের বাড়িটা নিতে রাজি হয়েছিলেন প্রফেসার সহায়। চোদ্দো লাখ টাকায়।

মানে দুটো মিলিয়ে পঁচিশ লাখ?

তাই তো দাঁড়ায়। পরে শুনলাম সুলতানগঞ্জের এক পার্টির কাছ থেকে বেশি টাকার অফার পেয়ে…। গণপতিবাবুর চোয়াল শক্ত হল, আমার কাছে কথাটা সোজাসুজি এসে বললে আমি কি বাধা দিতাম? না বেশি টাকায় বেচছে বলে আমি অখুশি হতাম? কতকাল ধরে ওই বাড়ি দুটো আমি বুক দিয়ে আগলে রেখেছি..না, সুরেনকাকার ছেলের কাছ থেকে আমি ওই ব্যবহার আশা করিনি।

কিন্তু…। মিতিন অবাক মুখে বলল, জোনাথন মাইকেল যে বলেন দুটো বাড়ি বিক্রি হয়েছে মোট চোদ্দো লাখে?

অসম্ভব। হতেই পারে না। পঁচিশ লাখ টাকা দাম পাচ্ছে। জেনেও আমাকে খবর না দিয়ে এসে চুপি চুপি কেউ চোদ্দো লাখ টাকায় বাড়ি সেল করে যায়?

তাই তো। মনে হচ্ছে একটা ফাউল প্লে আছে।

সে কী আছে জোনাথনই জানে। তবে তুমি জোনাথনকে বলে দিয়ো, আমি যথেষ্ট আহত হয়েছি। গুণ্ডা প্রোমোটারকে না বেচে ভদ্ৰলোকদের বাড়ি বিক্রি করলে তার এমন কিছু লোকসান হত না।

যিনি কিনেছেন তাকে আপনি চেনেন?

গোটা ভাগলপুর ডিস্ট্রিক্ট তাকে চেনে। পাজির পা-ঝাড়া এক বজ্জাত। সে তো এখন শুনি কলকাতাতেও ব্যবসা ফেঁদেছে।

কী নাম বলুন তো?

রাজনাথ। রাজনাথ সিং। এখানে তিনি অবশ্য রাজুদাদা নামেই বেশি খ্যাত।

কলকাতা থেকে এত দূরে এসে ওই নামটা শুনবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি টুপুর। চোখ গোল গোল করে তাকিয়েছ। মিতিনমাসির দিকে। তবে মিতিনমাসি যেন তেমন চমকালই না, শুধু মুখখানা থমথমে হয়ে গেল সহসা। গোমড়া মুখে দু-চারটে কথা বলে উঠে পড়ল। গণপতিবাবুর চা-জলখাবারের অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করল সবিনয়। লোহার গেটের বাইরে এসেই ব্যাগ থেকে বের করেছে মোবাইল। টকটক বোতাম টিপছে।

টুপুর উৎসুক মুখে জিজ্ঞেস করল, কাকে ফোন করছ?

তোর মেসোকে। বলেই ফোন কানে চাপল মিতিন, হ্যালো?..এ কী, তুমি এখনও বেরোওনি?

…?

রোববার তো কী আছে, এক্ষুনি ইলেকট্রিশিয়ান নিয়ে চলে যাও। আর হ্যাঁ, মিস্টার জোনাথনকে আড়ালে ডেকে বোলো। তিনি যেন আজকের রাতটা একটু সজাগ থাকেন। কবরখানাতেও আজই চরকি মারবে। সমাধিটা কিন্তু আজই লোকেট করে ফেলা চাই।

…।

 ফিরে বলব। এটুকুই শুধু শুনে রাখ, জার্নি ফ্রুটফুল হয়েছে। কাজ মিটে গেছে। রাতের ট্রেনেই ফিরছি। মিস্টার মাইকেলের বাড়ি থেকে সন্ধের পর কোনও ফোন এলে আমায় সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ো।

…।

ছাড়ছি। ফোন অফ করে নিথর দাঁড়িয়ে আছে মিতিন। ভাবছে কী যেন।

টুপুর অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, কী গো মিতিনমাসি, সল্যুশান কিছু পেলে? দুম করে রাজনাথ সিং পিকচারে এসে গেল…!

হুম। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ।

 টুপুর ফ্যালফ্যাল তাকাল, মানে?

মানেটা কাল বুঝিসখন। এখন চল, রোদ বেশি বাড়ার আগে এখানকার তীর্থক্ষেত্রগুলো দেখে আসি।

তুমি মন্দিরে যাবে?

 মন্দিরই তো। গঙ্গার ধারে শরৎচন্দ্রের মামার বাড়ি, আদমপুরে বনফুলের বাড়ি, খেলাত ঘোষের যে কাছারিবাড়িতে বসে বিভূতিভূষণ লেখালিখি করতেন সেই বাড়িটা, সবই তো মন্দির। পুণ্য স্থান।

সামনে দিয়ে একটা রিকশা যাচ্ছিল। মিতিন হাত উঠিয়ে ডাকল, এই, রোকে, রোকে। বাঙালিটোলা যানা হ্যায়।