উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

১০. টেনিদার ভাষায় বলা—পুঁদিচ্চেরি

একেই বলে আসল পরিস্থিতি—টেনিদার ভাষায় বলা—পুঁদিচ্চেরি।

ঘরের ভিতরে বাজ পড়েছে—এই রকম মনে হল। চন্দ্রকান্ত আর বিন্দেবন হাউমাউ করে উঠল, আমরা চারজন একেবারে চারটে জিবেগজার মতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলুম। আর পাকা করমচার মতো খুদে-খুদে লাল চোখ দুটোকে বনবন করে ঘোরাতে ঘোরাতে খ্যাপা মোষের মতো চেঁচাতে লাগল সেই ভয়ঙ্কর জোয়ান খগেন মাশ্চটক।

আর এতক্ষণে আমার মনে হল, এই মোষের মতো খগেনটা আছে বলেই জায়গাটার বোধহয় নাম হয়েছে মহিষাদল। সেই সঙ্গে আরও মনে পড়ল, আজ সকালে বাড়ি থেকে বেরুবার সময়, কেন যেন খামকাই আমার বাঁ কানটা কটকট করছিল। তখনই বোঝা উচিত ছিল, আজ একটা যাচ্ছেতাই রকমের কিছু ঘটে যাবে।

আমরা পটলডাঙার চারজন বিপদে পড়লে কি আর ভয়-টয় পাই না? আমি যখন আগে ছোট ছিলুম, পেট-ভর্তি পিলে নিয়ে প্রায় জ্বরে পড়তুম, তখন, রাত্তিরে জানালার বাইরে একটা হুতুম প্যাঁচা হুমহাম করে ডেকে উঠলেও, ভয়ে আমার দম আটকে যেত। তারপর বড় হলুম, দু-একটা ছোটখাটো অ্যাঁডভেঞ্চার জুটে গেল বরাতে। তখন দেখতে পেলুম, বিপদে ঘাবড়ে যাবার মতো বেকুবি আর কিছু নেই। তাতে বিপদ কমে না বরং বেড়েই যায়। তার চাইতে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে হয়, এখন কী করা যায় কী করলে সব চাইতে ভালো হয়। তা ছাড়া আরও দেখেছি-যারা আগ বাড়িয়ে ভয় দেখাতে আসে, তারা নিজেরাই মনে মনে ভীরু। পিঠে সোজা করে, বুক টান করে, মনে জোর নিয়ে রুখে দাঁড়ালে তারাই অনেক সময় পালাতে পথ পায় না।

আমি দলের তিনজনের দিকে চেয়ে দেখলুম। আমার বুকটা একটু দুরদুর করছিল, হাবুল পা চুলকোতে-চুলকোতে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, এখন একটা মজা করব, চুপ কইরা বইস্যা থাক। ক্যাবলার হাতে একটা ঘড়ি ছিল, সে বার বার তাকাচ্ছিল তার দিকে। আর আমাদের টেনিদা—বিপদ এলেই যে সঙ্গে সঙ্গে লিডার হয়ে যাবে—আমি দেখলুম, সে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে খগেনের দিকে, আর একটু একটু করে শার্টের আস্তিন তুলছে ওপরদিকে।

তখন আমার মনে পড়ল—টেনিদা বক্সিং জানে, জুডো —মানে জাপানী কুস্তিটাও সে শিখে নিয়েছিল গত বছর; তখুনি আমর বুকের ধুকধুকুনি থেমে গেল খানিকটা। বুঝতে পারলুম, খগেন মাশ্চটক যত সহজে আমাদের পিটিয়ে পরোটা করতে চাইছে, ব্যাপারটা অত সোজা হবে না। আর যদি টেনিদা একা ওকে সামাল দিতে না পারে, আমরা তিনজন তো আছি, এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ব খগেনের ওপর। যদি কিছু অঘটন ঘটেই যায়—ওই মোষের মতো খগেনটার ঘুষি-টুষি খেয়ে—আমি, রোগা-পট্রা প্যালারাম যদি বেমক্কা মারাই যাই, তাতেই বা কী আসে যায়। একবার বই তো দুবার মরব না! ভয় পেয়ে, কেঁচোর অধম হয়ে মাটিতে মুখ লুকিয়ে, বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়া ঢের ভালো।

আমি বুঝতে পারছিলুম—আমরা বাঘের গর্তে পা-ই দিই আর যা-ই করি, আমাদের চাইতেও ঢের বেশি ঘাবড়েছে বিবেন-চন্দ্ৰকান্তের দলবল। খগেন লম্ফঝম্ফ করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল, চন্দ্রকান্ত নাকেশ্বরই হাত বাড়িয়ে তাকে আটকে দিলে। আহা-হা, আগে থেকেই অমন মার মার করচ কেন হে খগেন? এয়ারা তো দেখচি ভদ্দরলোকের ছেলে সব শত্রু হতে যাবেন কী করে? বিত্তেন্তটা একবার খোলসা করে বলে দিকি।

বৃত্তান্ত আমার মাথা আর মুণ্ডু!–খগেন গাঁ গাঁ করে উঠল।–কলকাতায় আমি একটা বিচ্ছু ছেলেকে পড়াতে গিয়েছিলুম একদিন—তার নাম কম্বল। অমন হতচ্ছাড়া উনপাঁজুরে ছেলে দুনিয়ায় আর দুটো হয় না। গিয়ে তাকে পাঁচটা শক্ত শক্ত অঙ্ক কষতে দিয়ে বললুম, এগুলো চটপট করে ফ্যালকাল সারা রাত পাড়ার জলসায় গান শুনে আমার গা ম্যাজম্যাজ করছে, আমি আধ ঘণ্টা ঝিমিয়ে নিই। ঘুম ভেঙে যদি দেখি অঙ্ক হয়নি, তা হলে একটি কিলে তোকে একটা কোলা ব্যাং বানিয়ে দেব। বলেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙতে একটু দেরিই হয়ে গেল। জেগে দেখি, ঘরে কম্বল নেই, একটা অঙ্কও সে কষেনি। উঠে হাঁকডাক। করতে তার কাকা এসে বললে, কম্বলকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না—তোমাকে দেখেই সে নিরুদ্দেশ হয়েছে।

আমরা কান খাড়া করে শুনতে লাগলুম। বিন্দেবন বললে, তাপ্পর?

—তারপর আমার পকেটে হাত দিয়েই বুঝতে পারলুম, হতভাগা ছেলে আমার পকেট হাঁটকেছে। একটা কমলালেবু রেখেছিলুম খাব বলে—সেটা নেই, তার বদলে কাগজে মোড়া দুটো আরশোলা। আর সাংকেতিক কবিতা লেখা আমাদের কাগজটা, তাতে কালির দাগ-টাগ লাগা—নিশ্চয়ই কিছু করেছে সেটা নিয়ে। এখন বুঝতে পারছি, ছড়াটা নকল করে সে এদের হাতে দিয়েছে, আর এরা তাই থেকে খুঁজতে-খুঁজতে হাজির হয়েছে এখানে।

আমরা চারজনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলুম।

চন্দ্রকান্ত বললে, কিন্তু এঁয়ারা যে বললে রসিদ-টসিদ—

–একদম বাজে কথা, এরা রসিদ কোথায় পাবে? এ-চারটেকে আমি পটলডাঙায় চাটুজ্যেদের রকে বসে পাকৌড়ি-ডালমুট খেতে দেখেছি। আর কম্বলটাও এদের পেছনে প্রায় ঘুরঘুর করত। চন্দরদা, আর দেরি নয়, তুমি পারমিশন দাও—আমি আগে এদের আচ্ছা করে ঠেঙিয়ে নিই। তারপরে হাতের সুখ হয়ে গেলে—পোড়ো বাড়িটার ঠাণ্ডি গারদে সাত দিন আটকে রাখা যাক, কাঁকড়াবিছে আর চামচিকের সঙ্গে কদিন কাটাক-ব্যাস, দুরস্ত হয়ে যাবে। এর মধ্যে এখানকার মালপত্তর সরিয়ে দাও—শেয়ালপুকুরের আস্তানায় খবর পাঠাও।

চন্দ্রকান্ত তার প্রকাণ্ড নাকটা চুলকে বললে– কিন্তুক খগেন–

—কিন্তু পরে হবে, আগে আমি এদের দেখছি—

যমদূতের মতো এগিয়ে এল খগেন। বিবেন বললে, ওরে তোরা সব দেখছিস কী! দরজাগুলো বন্দ করে দে–

অথাৎ খাঁচায় বন্ধ করে ইঁদুর মারবার বন্দোবস্ত!

আর তক্ষুনি দাঁড়িয়ে উঠল টেনিদা। ঘর কাঁপিয়ে সিংহনাদ ছাড়ল : বুঝেসুঝে গায়ে হাত দেবেন মশাই, নইলে–

–ওরে, এ যে বুলি ঝাড়ছে! খগেন মাশ্চটকের দাঁত কিচ কিচ করে উঠল : তা হলে এইটেকেই আগে মেরামত করি। বাকিগুলো তো ছারপোকা, এক-একটা টিপুনি দিয়েই ম্যানেজ করে ফেলব।

বলেই, খগেন টেনিদার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

সেই লম্বা ঘরটার ভেতরে—যেখানে দেওয়াল ভর্তি করে জয় মা আর খাঁড়া-টাঁড়া এই সব লেখা রয়েছে, দেখতে-দেখতে তার ভেতরে যেন ভীম আর জরাসন্ধের যুদ্ধ বেধে গেল। আমরা সরে এলুম দেওয়ালের একদিকে—বিন্দেবনের দল আর-এক দিকে। খগেন টেনিদাকে জাপটে ধরতে গিয়েও পারল নাবক্সিংয়ের সাইড স্টেপিং করে সে চট করে সরে গেল একদিকে, আর দুহাতে খানিক বাতাস জাপটে ধরে মুখ থুবড়ে পড়তে-পড়তে সামলে গেল খগেন।

টেনিদা ঠাট্টা করে বললে, আহা, মাশ্চটক মশাই-ফসকে গেল বুঝি?

রাগে খগেনের মুখটা নিটোল একটা খাজা কাঁটালের মতো হয়ে গেল। লাল করমচার মতো চোখ দুটোকে ঘোরাতে ঘোরাতে খগেন বললে, অ্যাাঁআবার এয়ার্কি হচ্ছে। আমি খগেন মাশ্চটক, আমার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি! আমি যদি এক্ষুনি তোকে চটকে আলুসেদ্ধ বানিয়ে না দিই তো—খগেন আবার ঝাঁপ মারল।

আর তক্ষুনি বোঝা গেল টেনিদা কী, আর আমরাই বা তাকে লিডার বলে মেনে নিয়েছি কেন। এবার খগেন টেনিদাকে চেপে ধরল আর ধরার সঙ্গে সঙ্গেই সে ইলেকট্রিক কারেন্টের শক খেলো একটা। জাপানী জুডোর একটা মোক্ষম প্যাঁচে দড়াম করে তিন-হাত দূরে ছিটকে পড়ল খগেন চিতপটাং। আর তার গলা দিয়ে বেরুল বিটকেল এক আওয়াজ : গাং।

ঘরসুদ্ধ লোক একদম চুপ। চন্দ্রকান্ত, বিবেন, দুটো চাকর—চোখ কপালে তুলে পাথর হয়ে রইল। টেনিদা বললে, কী মাশ্চটক মশাই, আমাকে মেরামত করবেন না?

খগেন মাশ্চটক একবার ওঠবার চেষ্টা করেই আবার ধপাৎ করে শুয়ে পড়ল। কেবল বললে, গাং-ওফ্‌-ফ।

হঠাৎ বিলেবন লাফিয়ে উঠল : চন্দর দা—দেখচ কী? এরা খুদে ডাকাতের দল। খগেনের মতো অত বড় লাশকেও অমন করে শুইয়ে দিলে? আমি দলের আরও লোকজন ডাকি–সবাই মিলে ওদের–

টেনিদা আস্তিন গুটিয়ে বললে, কাম অন–সঙ্গে সঙ্গে আমরা তিনজনও লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলুম লিডারের পাশে। বললুম, কাম অন—কাম অন—

হাবুল আমার কানে কানে বললে, অখন আরও মজা হইব।

ঠিক তখন—

ঠিক তখন বন্ধ দরজার গায়ে ঝনঝন করে ঘা পড়ল। কে যেন মোটা গলায় ডাক দিয়ে বললে, পুলিশ—শিগগির দরজা খোলো—