উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

১০. টেনিদার বিদায়

১০. টেনিদার বিদায়

খানিক পরে হাবুল সেনই সামলে নিলে। মামার কপালে-তোলা মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলে, কী হইল মামা? অমন কইর‍্যা চক্ষু আকাশে তুইল্যা বইস্যা আছেন ক্যান?

কী ডাকল বাইরে? ভূত না রাইস?

কুট্টিমামার মুখখানা এবার ভীষণ ব্যাজার হয়ে গেল।

—দূর কী আর ডাকব? ও তো প্যাঁচা।

–প্যাঁচা ক্যাবলা আশ্চর্য হয়ে বললে, তাতে আপনি ভয় পেলেন কেন?

—ভয় পেলুম কখন? আমি বললুম, বা-রে, এই তো আপনি বললেন, কী সর্বনাশ কী সর্বনাশ। তারপরেই ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন।

—আরে, ঘাবড়ে গেছি সাধে?কুট্টিমামার ব্যাজার মুখটা আরও ব্যাজার হয়ে গেল : একটা বাঁধানো দাঁত ছিল, সেটা গেল খুলে আর মনের ভুলে ক্লিপ-টিপসুদ্ধ সেটাকে টক করে গিলে ফেললুম! যাই—এক্ষুনি একটা জোলাপ খেয়ে ফেলি-গে।

কুট্টিমামা উঠে চলে গেলেন।

হাবুল বললে, দাঁতটা প্যাটে থাকলেই বা ক্ষতি কী! মামার তো সুবিধাই হইল। যা খাইব তারে ডবল চাবান দিতে পারব: একবার চাবাইব মুখে, আর একবার কইস্যা প্যাটের মধ্যে চাবান দিতে পারব।

টেনিদা দাঁত খিঁচিয়ে বললে, চুপ কর, তোকে আর ওস্তাদি করতে হবে না! কাল আমি তোকে একটা দেশলাই, খানিক সর্ষের তেল আর আধসের বেগুন গিলিয়ে দেব। পেটের মধ্যে বেগুন ভাজা করে খাস!

ছোট্টুলাল এসে বললে, খানা তৈয়ার।

সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে পড়লুম আমরা। টেনিদা বললে, কেয়া বানায়া আজ?

ছোট্টুলাল বললে, ডিমের কারি, মাছের ফ্রাই—

টেনিদা বললে, ট্রা-লা-লা-লা-লা! কাল তো শিকারে যাচ্ছি। আমরা বাঘের পেটে যাব, হিপোপটেমাসেই গিলে খাবে কে জানে! চল—আজ প্রাণ ভরে ফাঁসির খাওয়া খেয়ে নিই!

ক্যাবলা বলতে যাচ্ছিল, ড়ুয়ার্সের জঙ্গলে কি হিপো—

কিন্তু বলবার সুযোগ পেলে না। তার আগে টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল : ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস–

আমরা কোরাস তুলে বললুম, ইয়াক-ইয়াক!

আর ছোট্টলাল চোখ দুটোকে আলুর দমের মতো করে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

সকালে উঠেই সাজ-সাজ রব।

দেখি, বেশ বড় একটা মোটর ভ্যান এসে গেছে। ওদিকে কুট্টিমামা বুট আর হাফপ্যান্ট পরে একেবারে তৈরি। গলায় টোটার মালা হাতে বন্দুক। কুলিদের সর্দারও এসে হাজির—তারও হাতে একটা বন্দুক। সদারের নাম রোশনলাল।

মামা বললেন, রোশনলাল খুব পাকা শিকারি। ওর হাতের তাক ফস্কায় না।

আমরাও চটপট কাপড়-জামা পরে নিলুম। কিন্তু টেনিদার আর দেখা নেই।

কুট্টিমামা বললেন, টেনি কোথায়?

টেনিদা—ভদ্রভাষায় যাকে বলে বাথরুম-তার মধ্যে ঢুকে বসে আছে। আর বেরুতেই চায় না। শেষে দরজায় দমাদম ঘুষি চালাতে লাগল ক্যাবলা।

—শিকারে যাওয়ার আগেই কি অজ্ঞান হয়ে গেলে নাকি টেনিদা? যদি সত্যিই অজ্ঞান হয়ে থাকো, দরজা খুলে দাও। আমরা তোমার নাকে স্মেলিং সল লাগিয়ে দিচ্ছি।

এর পরে কোনও ভদ্রলোকই অজ্ঞান হয়ে থাকতে পারে না। রেগেমেগে দরজা খুলে বেরিয়ে এল টেনিদা।

-টেক কেয়ার ক্যাবলাকে বলে আমি অজ্ঞান হয়েছি? কেবল পেটটা একটু চিন-চিন করছিল—

কুট্টিমামার হাঁক শোনা গেল : কী হল টেনি–রেডি?

হাবুল বললে, টেনিদার প্যাট চিন-চিন করে।

আমি বললুম, মাথা ঝিন-ঝিন করে—

ক্যাবলা বললে, বাঘ দেখার আগেই প্রাণ টিন-টিন করে।

টেনিদা ঘুষি বাগিয়ে ক্যাবলাকে তাড়া করলে–ক্যাবলা পালিয়ে বাঁচল।

হাঁড়ির মতো মুখ করে টেনিদা বললে, ভাবছিস আমি ভিতু? আচ্ছা—চল শিকারে। পটলডাঙার এই টেনি শর্মা কাউকে কেয়ার করে না! বাঘ-ফাগ যা সামনে আসবে—স্রেফ হাঁড়িকাবাব করে খেয়ে নেব দেখে নিস!

টেনিদার মজাই এই। ঠিক হাওড়া স্টেশনের গাড়িগুলোর মতো। লিলুয়া পর্যন্ত যেন চলতেই চায় না—খালি ক্যাঁচখালি কোঁচ। তারপর একবার দৌড় মারল তো পাঁই-পাঁই শব্দে সোজা বর্ধমান—তখন আর কে তার পাত্তা পায়। এই গুণের জন্যেই তো টেনিদা আমাদের লিডার।

যাই হোক, আমরা বেরিয়ে পড়লুম। কুট্টিমামা আর রোশনলাল বসলেন ড্রাইভারের পাশে, আমরা বসলুম ভ্যানের ভিতর। একটু পরেই গাড়ি এসে জঙ্গলে ঢুকল।

দুদিকে বড় বড় শাল গাছ—তাদের তলায় নানা আগাছার জঙ্গল। এখানে-ওখানে নানা রকমের ফুল ফুটেছে, মাথা তুলে আছে ডোরাকাটা বুনো ওলের ডগা। ছোট ছোট কাকের মতো কালো কালো একরকম পাখি রাস্তার উপর দিয়ে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে—ছোট-ছোট নালা দিয়ে তিরতির করে বইছে পরিষ্কার নীলচে জল।

সামনে দিয়ে কয়েকবার কান খাড়া করে দৌড়ে পালাল খরগোশ। মাথা নিচু করে তীরের গতিতে ছুটে গেল একটা হরিণ, সোনালি লোমের ওপর কী সুন্দর কালো কালো ছিট!

কুট্টিমামা বললেন, ইস-ইস! আর একটু হলেই মারতে পারা যেত হরিণটাকে!

কথাটা আমার ভালো লাগল না। এমন সুন্দর হরিণগুলোকে মানুষ কেন মারে। দুনিয়ায় তো খাবার জিনিসের অভাব নেই। দুমদাম করে হরিণ না মারলে কী এমন ক্ষতিটা হয় লোকের?

পাশের শিমুল গাছের ডালে বড় একটা পাখি ডেকে উঠল।

ক্যাবলা হাততালি দিয়ে বললে, ময়ুর–ময়ূর!

ময়ুরই বটে। ঠিক চিনেছি আমরা। অনেক ময়ুর দেখেছি চিড়িয়াখানায়।

বাঘের কথা ভুলে গিয়ে আমার ভারি ভালো লাগছিল জঙ্গলটাকে। কী সুন্দর–কী ঠাণ্ডা ছায়ায় ভরা! কত ফুল—কত পাখির মিষ্টি ডাক–কত খরগোশ–কত হরিণ। ইচ্ছে করছিল পাহাড়ি নালার ওই নীলচে ঝর্নার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্নান করি।

হঠাৎ চমক ভাঙল রোশনলালের গলার আওয়াজ।

–বাবু–বাবু!

কুট্টিমামা বললেন, হুঁ–দেখেছি।…বাহাদুর, গাড়ি রোখো!

গাড়িটা আস্তে আস্তে থেমে গেল। মামা আর রোশনলাল নামলেন গাড়ি থেকে।

মামা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা চুপচাপ বসে থাকো গাড়িতে। কাচ তুলে দাও। নেহাত দরকার না পড়লে নামবে না। আমরা আসছি একটু পরে।…বাহাদুর–তুম ভি আও–

মাটির দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখতে দেখতে তিনজনে টুপ করে মিলিয়ে গেল বনের ভিতর।

আমরা চারমূর্তি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলুম ভ্যানের ভিতর। কিন্তু কতক্ষণ আর এভাবে বোকার মতো বসে থাকতে ভালো লাগে? কাচ তুলে দেওয়াতে কেমন গরমও বোধ হচ্ছিল। অথচ বাইরে ঠাণ্ডা ছায়া-হাওয়া বইছে ঝিরঝিরিয়ে, টুপটুপিয়ে পড়ছে শালের পাতা। আমরা যেন জেলখানার মধ্যে আটকে আছি—এমনি মনে হচ্ছিল।

ক্যাবলা বললে, টেনিদা, একটু নেমে পায়চারি করলে কেমন হয়?

টেনিদা বললে, কুট্টিমামা বারণ করে গেল যে! কাছাকাছি যদি বাঘ-টাঘ থাকে—

হাবুল বললে, হঃ। এমন দিনের ব্যালা—চাইরদিক এমন মনোরম—এইখানে বাঘ থাকব। ক্যান? আর বাঘ যদি এইখানেই থাকব-তাইলে অরা বাঘের খোঁজে দূরে যাইব ক্যান?

পাকা যুক্তি। শুনে টেনিদা একবার কান, আর একবার নাকটা চুলকে নিলে। বললে, তা বটে—তা বটে! তবে, মামা বারণ করে গেল কিনা—

ক্যাবলা বললে, মামারা বারণ করেই। সংস্কৃতে পড়োনি টেনিদা? মা—মা—অথাৎ কিনা, না-না। ওটা মামা নামের গুণ—সবটাইতে মা-মা বলবে।

টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, ধ্যাত্তোর সংস্কৃত! ইস্কুলে পণ্ডিতের চাঁটিতে চোখে অন্ধকার দেখতুমকলেজে এসে সংস্কৃতের হাত থেকে বেঁচেছি। তুই আর পণ্ডিতি ফলাসনি ক্যাবলা—গা জ্বালা করে!

ক্যাবলা বললে, তা জ্বালা করুক। তো ম্যায় উতার ষাঁউ?

—সে আবার কী? হাউ-মাউ করছিস কেন?

—হাউ-মাউ নয়-রাষ্ট্রভাষা। মানে, নামব?

–সোজা বাংলায় বললেই হয়!—টেনিদা ভেংচি কেটে বললে, অমন ভুতুড়ে আওয়াজ করছিস কেন? আয়-নামা যাক। কিন্তু বেশি দূর যাওয়া চলবে না–কাছাকাছিই থাকতে হবে।

আমরা নেমে পড়লুম ভ্যান থেকে।

বেশি দূর আর যাব না ভেবেও হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা এগিয়েছি। চারদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্যটিশ্য দেখে আমি বেশ কায়দা করে বলতে যাচ্ছি; দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর–ঠিক এমন সময়–

জঙ্গলের মধ্যে কেমন মড়মড় শব্দ! পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি—

হাতি। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকেই!

আমি চেঁচিয়ে উঠলুম : টেনিদা–বুনো হাতি!

বাপরে—মা-রে। কিন্তু ভ্যানের দিকে যাবার উপায় নেই-হাতি পথ জুড়ে এগিয়ে আসছে!

–ক্যাবলা, হাবুল, প্যালা—গাছে গাছে–উঠে পড়-কুইক—টেনিদার আদেশ শোনা গেল।

কিন্তু তার আগেই আমরা সামনের একটা মোটা গাছে তরতর করে উঠতে আরম্ভ করেছি। যেভাবে তিন লাফে আমরা গাছে চড়ে গেলুম, তা দেখে কে বলবে আমাদের পেছনে একটা করে লম্বা ল্যাজ নেই।

হাতিটা তখন ঠিক গাছটার তলায় এসে পড়েছে। আর সেই মুহূর্তেই অঘটন ঘটল একটা। মড়মড় করে ডাল ভাঙবার আওয়াজ এল, একটা চিৎকার শোনা গেল টেনিদার, তারপর–

তারপর রোমাঞ্চিত হয়ে আমরা দেখলুম, টেনিদা পড়েছে হাতির পিঠের ওপর। উপুড় হয়ে দুহাতে চেপে ধরেছে হাতির গলার চামড়া। আর পিঠের উপর খামকা এই উৎপাতটা ভাদ্রমাসের পাকা তালের মতো নেমে আসাতে হাতিটা ছুট লাগিয়েছে প্রাণপণে।

আমরা আকুল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলুম : টেনিদা—টেনিদা—

হাতি জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়ার আগে আমরা শুনলুম টেনিদা ডেকে বলছে : তোদের পটলডাঙার টেনিদাকে তোরা এবার জন্মের মতো হারালি! বিদায়–বিদায়–