১০. খোকার গল্পের এখানে সমাপ্তি

খোকার গল্পের এখানে সমাপ্তি।

নুরুদ্দিন, মওলা মুরাদ, বেলী নীলাভাবী কিংবা রাজীব ভাইয়ের পরিচিত সেই খোকা সম্পর্কে এই ঘটনার পর বলবার মতো আর কী-ই বা এমন থাকতে পারে! দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এমন এক সর্বনাশা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভিতরে গিয়ে পড়েছিলো যে খোকা নিজের কাছে নিজেই বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট ছিলো না।

দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত জ্বলেছিলো সর্বগ্রাসী আগুন। উন্মত্ত সৈন্যরা দেশকে ধ্বংসস্তূপ কিংবা শ্মশান তৈরির পরিকল্পনায় নৃশংস বর্বরতার চরম পথই বেছে নিয়েছিলো। দেশের বিরাট একটি অংশ লাল মরনোল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মুক্তিযুদ্ধে।

মুরাদ, রহমান, এমন কি ইয়াসিনও মুক্তিযোদ্ধা হয়ে লড়াই করেছে! রহমান নিহত। ইয়াসিন পঙ্গু। গেরিলা কমান্ডার মুরাদের বীরত্বের খ্যাতি গোপনে গোপনে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো।

খোকার গল্পের এইখানেই সমাপ্তি, কেননা খোকা এমন কিছুই করে নি যে ইতিহাসের পাতায় তার নাম থাকবে। মুমূর্ষু বাঙালি জাতি ইতিহাস তৈরির নেশায় মেতে উঠেছিলো; এক পলায়ন ছাড়া সেখানে খোকার কোনো ভূমিকা নেই, ইতিহাসের ধূসর আড়ালে খোকারই তো প্রথম মুখ লুকোবার কথা।

দুদিন পর কয়েক ঘণ্টার জন্যে কারফিউ তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে রাজীব ভাইয়ের লাশ ফেলে বাড়িতে ছুটেছিলো সে, এবং রঞ্জুকে পেয়েছিলো।

কিন্তু তারপর? খোকার নিজেরই এখন আর সবকিছু হুবহু মনে নেই। কেবল অস্পষ্টভাবে কিছু কিছু ছবি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। প্রাণভয়ে ভীত হাজার হাজার নরনারীর সঙ্গে বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠেছিল সে; প্রতিটি গাছের ছায়া তখন এক একটি বিরাট অট্টালিকা সেখানে।

আর্মি ক্র্যাক ডাউনের প্রথম রাত্রেই বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো রঞ্জু। গাছের নিচে শতরঞ্চি বিছিয়ে তাকে শুইয়ে রেখেছিলো খোকা। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে থৈ-থৈ মানুষ, যে যার নিজের পরিবারকে, নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। এই অবস্থায় হলো তুমুল ঝড়, সেই সঙ্গে শিলাবৃষ্টি।

বৃষ্টিতে ভিজে সেই রাত্রেই জ্বর এসেছিলো রঞ্জুর। মাথা ঠিক ছিলো না খোকার। বুদ্ধি লোপ পেয়েছিলো, কি করবে, কি করা উচিত, কিছুই। সাব্যস্ত করতে পারে নি সে।

তারপর কি কোথায় সব ঘটেছিলো এখন আর তা মনে নেই খোকার। আমি কি সেখানে ছিলাম, খোকা জিগ্যেস করে নিজেকে, আমি কি স্বচক্ষে কোনো কিছু দেখেছি, হাবুডুব খেতে থাকে খোকা এইভাবে। ভোর না হতেই পলায়মান ভীতসন্ত্রস্ত নরনারীর ওপর অতর্কিতে পাশবিক উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো মেশিনগান ও মর্টার সজ্জিত ক্ষিপ্র সৈন্যদল, এখনো মানুষজন এইসব বলাবলি করে। অচৈতন্যপ্রায় রঞ্জুকে গাছতলায় শতরঞ্চির উপর ফেলে প্রাণঘাতী গুলিবৃষ্টির ভিতর হাজার হাজার নরনারীর মতো আমিও কি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালিয়েছিলাম, ভেবে পায় না। খোকা; যেন একটা দুঃস্বপ্ন। মন থেকে সবকিছু মুছে ফেলতে চায় খোকা। একলক্ষ চল্লিশ হাজার পায়ের তলায় পড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছিলো কি নিরঞ্জুন রঞ্জু?

কিছুই জানে না খোকা। সে শুধু চেয়েছিলো রঞ্জু বেঁচে থাকুক। সে জানতো না এটা তার ভুল। একা বেঁচে থাকার অধিকার তার বিষণ্ণ দেশ কিছুতেই দিতে পারে না রঞ্জুকে, খোকা পরে বুঝেছিলো।

দেশ তাহলে একটা পুকুর। অঞ্জু মঞ্জুর মতো এর নিস্তরঙ্গ নিথর তলদেশে চিরকালের জন্যে হারিয়ে গিয়েছে রঞ্জু। এই নির্জন পুকুর পাড়ে একা একা সারাটা জীবন যে সে কি করে কাটাবে খোকা তা ভেবে পায় না; সে তো জানেই সহজে তার মৃত্যু নেই, কেননা কোনো অসতর্ক মুহূর্তে যদি এমন কথা তার মনে উঁকি দেয়, তখনই রঞ্জু তাকে শাসন করে বলে, দাদা, আমি না তোর বুকে থুতু দিয়েছি!

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ June 2, 2022 at 7:53 pm

আহ্, খুবই দুঃখজনক, কষ্টদায়ক। কেন যে আগে পড়লাম না। হুমায়ূন আহমেদ পড়ে‌ই নিজের কৈশোরকে নষ্ট করেছি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *