১০. কিছু নাটক সৃষ্টি

কিরীটী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে বললে, এবারে সমীরণ দত্তকে নিয়ে এস, সুদৰ্শন।–

সুদৰ্শন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

এবং একটু পরেই সমীরণকে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল।

মিঃ স্বামীনাথন!

স্বামীনাথন কিরীটীর ডাকে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল।

এঁকে চেনেন আপনি? সমীরণকে দেখিয়ে বললে।

না।

সমীরণবাবু?

সমীরণ তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

স্বামীনাথনকে দেখিয়ে কিরীটী প্রশ্ন করল, একে আপনি চেনেন সমীরণবাবু?

না, চিনি না।

কখনো দেখেননি আগে?

কোন দিন উনি শান্তিনিকেতনে যাননি, যখন আপনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন?

দেখিনি যেতে।

বিজিতা দেবীর মুখে কখনো ওঁর কথা শোনেননি?

না।

ভাল করে ভেবে বলুন! সত্যিই কখনো ওঁকে আপনি দেখেননি?

সমীরণ চুপ করে থাকে।

কিন্তু আমার ধারণা ওঁকে আপনি দেখেছেন আগে—

ঠিক মনে পড়ছে না—তবে–

বলুন?

একবার যেন মনে হচ্ছে দেখেছিলাম।

কবে?

মাসখানেক আগে।

কোথায়?

বিজিতাকে আমার ফ্ল্যাটে উনি ওঁর গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন।

গাড়ি!

হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা যেন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। কিরীটীর চোখের মণি দুটো যেন ঝকঝক করে ওঠে, বলে, কিরকম গাড়ি? কি রং ছিল গাড়িটার?

বোধ হয় একটা কালো রংয়ের অ্যামবাসাডার।

কালো রংয়ের অ্যামবাসাডার!

মিঃ স্বামীনাথন, আপনার গাড়ি আছে?

অফিস থেকে ব্যবহারের জন আমাকে একটা গাড়ি দিয়েছে।

গত পরশু তাহলে দুপুরে সেই গাড়িতে করেই আপনি সি. আই. টি. র ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন?

না, গাড়ি গত পরশু আমি ব্যবহার করিনি।

তবে কিসে গিয়েছিলেন?

ট্যাক্সিতে।

আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।

মিথ্যা আমি বলছি না—কিছুদিন ধরেই রিপেয়ারের জন্য গাড়িটা গ্যারেজে আছে।

কোন গ্যারেজে?

নিউ অটোমোবাইলস গ্যারেজে।

কিরীটী এবারে ফিরে তাকাল সুদর্শনের দিকে, ঐ গ্যারেজে ফোন করে একটা খবর নাও তো গাড়িটা সম্পর্কে!

সুদৰ্শন ফোন করল।

…কি বললেন? গাড়িটা পরশুই ডেলিভারি হয়ে গিয়েছে। আই সি, আচ্ছা। ধন্যবাদ।

দাদা, ওরা বলল গাড়িটা নাকি পরশুই সকালে ডেলিভারি দিয়ে দিয়েছে!

মিঃ স্বামীনাথন? কিরীটী তাকাল স্বামীনাথনের দিকে।

হতে পারে-অফিস হয়তো ডেলিভারি নিয়েছে—আমি জানি না।

কিরীটীর দৃষ্টি তীক্ষ—ও চেয়ে আছে স্বামীনাথনের মুখের দিকে।

মিস্টার স্বামীনাথন, আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে!

কেন বলুন তো?

বিজিতা দেবী ও তাঁর শিশুসন্তান এবং মিঃ বোসকে হত্যা করার অপরাধে।

কি পাগলের মত যা-তা বলছেন!

আমরা যে পাগলের মত যা-তা কিছু বলছি না-আদালতে সেটা প্রমাণ করতে পারব আমরা। সুদৰ্শন ওঁকে পাশের ঘরে নিয়ে যাও।

সুদৰ্শন স্বামীনাথনকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।

কথাটা বলেই কিরীটী সমীরণের দিকে তাকাল, সমীরণবাবু, এবারে বলুন—বিজিতা দেবীর চিঠি পাওয়ার পর সেখানে গিয়ে তার ঘরের দরজা বন্ধ দেখে আপনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন-কাউকেই আপনি দেখেননি?

সমীরণ চুপ।

চুপ করে থাকবেন না, বলন। আই অ্যাম সিওর, ইউ মেটু সাম ওয়ান—

সমীরণ তথাপি চুপ।

ইউ মেটু সাম ওয়ান অ্যান্ড ইট ওয়াজ—আমি বলছি আপনি দেখেছিলেন মিঃ ঘোষালকে। ডিড নট ইউ! বলুন—স্পীক আউট দি ট্রথ!

হ্যাঁ-দেখেছি, কিন্তু একটা সুটকেস হাতে উনি এত তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন যে আমাকে হয়তো ভাল করে নজরই করেননি।

তাহলে সুটকেসটা তখন মিঃ ঘোষালের হাতে দেখেছিলেন!

হ্যাঁ!

হোয়াই ডিডনট ইউ টেল দি ট্ৰথ দেন?

আমি–

বলুন?

আমি ভেবেছিলাম মণিশঙ্করই হয়তো হত্যা করেছে—

কাকে?

বিজিতাকে।

আপনি তো তখনো জানেন না যে বিজিতা দেবী নিহত? আপনি তাহলে মিথ্যা বলেছেন? ঘরের দরজা বন্ধ দেখে এবং দরজা থেকে ডাকা সত্ত্বেও খুলল না দেখে যে ফিরে এসেছেন—সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা?

হ্যাঁ।

বলুন তাহলে কি দেখেছিলেন?

মণিশঙ্করের ফ্ল্যাটের দরজাটা খোলাই ছিল—খোলা দরজার পাশেই সামনে দাঁড়াতেই মৃতদেহ দুটো রক্তে ভাসছে আমি দেখতে পেয়েছিলাম—

তারপর?

আমার ধারণা হয়েছিল মণিশঙ্কর ই

তার স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করেছে?

হ্যাঁ

তারপর?

দরজাটা টেনে দিয়ে লোক করে আমি চলে আসি।

কিরীটিৗ এবারে মণিশঙ্করের দিকে তাকাল, মণিশঙ্করবাবু, এবারে আপনি বলুন, যা সত্যি গতকাল ঘটেছিল—সব কথা।

আমি তো ঘরের মধ্যে ঢুকে–

হ্যাঁ। মাথা ঘুরে গেল আমার–

মণিশঙ্করবাবু, আপনি খুব উঁচুদরের অভিনেতা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমরাও কিছু কিছু নাটক সৃষ্টি করতে যেমন জানি তেমন অভিনয়ও করতে জানি।

কি বললেন?

নাটক আর অভিনয়ের কথা–

আমি ঠিক—

বুঝতে পারছেন না। আমার কথাগুলো, তাই না?

হ্যাঁ, মানে–

বুঝতে পারবেন যখন ফাঁসির দড়িটা গলায় এঁটে বসবে।

ফাসি!

হ্যাঁ, ডায়াবলিক্যাল মার্ডা কেসে আসামীদের জন্য ইনডিয়ান পেনাল কোডের পাতায় যে শক্তির বিধান লেখা আছে সেটা হচ্ছে টু বি হ্যাংড বাই নেক টিল। ডেথ—ফাঁসি— ভাবছেন নিশ্চয়ই। তবে এতক্ষণ কি শুনলাম—কি দেখলাম–

আমি–

হ্যাঁ, আপনি যেমন দেখেছেন শুনেছেন—তেমনি আমারও আপনার মনের ঐ মুহুর্তের কথাটা না শুনতে পেলেও আপনার দু চোখ যে উল্লাসের দৃষ্টি দেখেছি—স্বামীনাথনকে অ্যারেস্ট করবার সময়ে মার্ডার চার্জে, সেটা আমার কাছে নিষ্ঠুর সত্যকে উদ্‌ঘাটিত করে দিয়েছে–আর আমার অভিনয়টুকুও সেইজন্যেই করা-কিন্তু এখন আপনি বুঝতে পারছেন—হোয়াট এ ব্লান্ডার ইউ হ্যাভ ডান—কত বড় ভুল আপনি করেছেন!

মণিশঙ্কর ঘোষাল যেন একেবারে পাথর!

কিরীটী বলতে থাকে—যে ভিন্ন প্রদেশের মেয়েটি ভালবেসে আপনার হাতে সর্বস্ব তুলে দিয়েছিল, যার ভালবাসার মধ্যে এতটুক খাদ ছিল না, তাকে এবং সেইসঙ্গে আপনার নিজের ঔরসজাত সন্তানকে হত্যা করলেন কি করে? একটি বারের জন্যে হাত আপনার কাঁপল না?

না, কাঁপেনি—হঠাৎ মণিশঙ্কর বলে ওঠে, সী ওয়াজ এ হারলট-বিশ্বাসঘাতিনী, আর ঐ সন্তানও আমার নয়, সমীরণের-আমি জানি, আমি জানি—ঠিক সমীরণের গায়ের রঙ— ঠিক ওরই মত চোখ-মুখ—

মণিশঙ্কর!

অস্ফুট কণ্ঠে যেন আর্তনাদ করে ওঠে সমীরণ হঠাৎ।

হ্যাঁ—হ্যাঁ, তুমি-তুমিই, আমার ঘরে আগুন জ্বেলে দিয়েছ সমীরণ-তোমার জন্য বিজিতা কোন দিনই আমাকে ভালবাসতে পারেনি—আমার বুকে মাথা রেখে সে তোমারই কথা ভেবেছে–

না, না—মণি, না—আমি–

দিনের পর দিন তুমি তাকে চিঠি লিখেছ—আমার মানা সত্ত্বেও সে লুকিয়ে তোমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছে ফ্ল্যাটে—বল, বল সমীরণ সেও মিথ্যে—সেও ভুল!

ভুল হ্যাঁ, ভুল তোমার—সব মিথ্যা—

না, ভুল নয়—বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীকে চিনতে কোন স্বামীরই ভুল হয় না কোন দিন। তুমি আমার মনের শান্তি—ঘুম সব কেড়ে নিয়েছিলে, কিন্তু পরশু আর কাল রাত্রে অনেকদিন পরে আমি ঘুমিয়েছি—আর জান, তোমারই একদা প্রেজেন্টেশান করা মহীশূর থেকে আমার জন্য আনা ছোরা দুটোর একটা দিয়ে তোমার বিজিতাকে আমি হত্যা করেছি!

কিন্তু মিঃ বোসকে আপনি হত্যা করলেন কেন? কিরীটী হঠাৎ প্রশ্ন করে।

সে আমায় বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিল—

তাই তাকেও হত্যা করলেন?

হ্যাঁ, ইচ্ছা ছিল ওকেও ঐ সমীরণকে হত্যা করব, সেই কারণেই অন্য ছোরাটা আমি–রেখে দিয়েছিলাম-কিন্তু ওর বাড়িতে গিয়ে শুনলাম ওকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে আসা হয়েছে; আমি যা করেছি। স্বেচ্ছায় করেছি—অ্যান্ড আই কিল্ড দেম ডেলিবারেটলি! ফাঁসির কথা বলছিলেন না? নাউ আই অ্যাম রেডি ফর দ্যাট!

সুদৰ্শন বলে ওঠে, হাউ ফ্যানটাস্টিক—হাউ হরিবল!

হাঃ হাঃ করে হঠাৎ ঐ সময় পাগলের মতই যেন হেসে ওঠে মণিশঙ্কর, তারপর বলে, খুব অবাক হয়ে গিয়েছেন ইন্সপেক্টর, তাই না?

কথাটা বলে মণিশঙ্কর সুদর্শনের দিকে তাকাল। মণিশঙ্করের চোখেমুখে তখনো হাসি।

সুদৰ্শন ভাবে, লোকটা বিকৃতমস্তিক নয় তো!

মে আই হ্যাভ এ সিগারেট? একটা সিগারেট খেতে পারি স্যার? মণিশঙ্কর বলল।

খান—সুদৰ্শন বলে। মণিশঙ্কর পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো, কিন্তু গোটা দুই টান দিতেই টলে পড়ে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

মণিশঙ্কর বলে, চললাম স্যার, গুড বাই—মণিশঙ্করের চোখ বুজল।