০৯-১২. ফজল বাড়ি যায় না

ফজল বাড়ি যায় না। বাড়ি গেলেই তার বাবা হয়তো জেরা শুরু করবে, রাত্রে কোথায় আছিলি? কাইল নায়েবের লগে অমুন কইর‍্যা কথা কইতে গেলি ক্যান্?

সোজা খুনের চর চলে যায় ফজল। তাকে দেখে পুলকি-মাতব্বর আর কোলশরিকেরা কোলাহল করে ওঠে। যার যার ভাওর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে তারা। রমিজ মিরধা বলে,

কাইল আসুলিগ একখান খেইল দ্যাহাইয়া আইছ হোনলাম?

জাবেদ লশকর : এই মিয়া মাতবরের পো না খেললে কাইল চরের ইজ্জত থাকত না।

ধলাই সরদার : হোলাম আসুলিগ কোন বড় খেলুরে তুমি এমুন চিবি দিছিলা, চিবির চোডে হের জিব্বাডা বোলে সোয়া আত বাইর অইয়া গেছিল?

ফজল : আরে না মিয়া। এমন কথা কার কাছে শোনলেন?

ধলাই সরদার : যারা খেইল দ্যাখতে গেছিল তাগ কাছেই হুনছি।

গতদিনের হা-ডু-ডু খেলার আলোচনায় মেতে উঠে সবাই। তাদের মুখে ফজল আর সোলেমানের খেলার তারিফ।

সবাই চলে গেলে ফজল নিজেদের ভাওর ঘরে গিয়ে ঘরের ঝপ খোলে। তাদের গাবুর একাব্বর তার অনুপস্থিতিতে বেড়ের মাছ ধরে অন্যান্যদের সাথে তারপাশা গেছে মাছ বেচতে।

মাচানের ওপর হোগলা বিছানো রয়েছে। একপাশে রয়েছে ভাঁজকরা একটা কাঁথা। রাত্রে বারবার তাড়া খেয়েছে যে ঘুম, তা এসে বিছানাটার কোথাও লুকিয়ে রয়েছে যেন। তার অদৃশ্য হাতের আলতো পরশ অনুভব করে ফজল। তার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। সে কাথার তলা থেকে বালিশ টেনে নেয়। তারপর বিছানার ওপর ঢেলে দেয় সে তার ঘুমকাতর শরীরটাকে। কিন্তু বালিশের ওপর মাথা রাখতেই হঠাৎ চমকে ওঠে সে। লাফিয়ে ওঠে তড়াক করে।

হায়, হায়, হায়! কি সর্বনাশের মাথার বাড়ি! এখন উপায়? ফিরে যাবে নাকি সে শ্বশুরবাড়ি?

কিন্তু এখন গিয়ে কোনো লাভ নেই, ফজল ভাবে। এতক্ষণে কাছারি ঘরের বিছানাটা তোলা হয়ে গেছে। বালিশের তলায় রাখা খোঁপার কাঁটাটা নিশ্চয় পেয়ে গেছে রূপজান। কি কেলেঙ্কারিটা ঘটে গেল তার ভুলের জন্য।

রূপজান কি কিছু বুঝতে পারবে? বুঝতে না পারার কোনোই হেতু নেই। একটা মাত্র কাঁটা। কয়েকটা হলেও রূপজানকে ফাঁকি দেয়া যেত। সে নিজেই ভেবে আশ্বস্ত হতে, কাঁটাগুলো তারই জন্য এনে রেখেছিল ফজল। দিতে ভুলে গেছে। এখন ওই কাঁটা বালিশের নিচে রাখার যে কোনো কৈফিয়তই নেই। তাছাড়া কাঁটাটা যার খোঁপার, সে ঐ বাড়িতেই রাত্রে ছিল। তার খোঁপায় নিশ্চয় রয়েছে ওটার মতো আরো কাঁটা।

ফজলের শিরা-উপশিরায় ঠাণ্ডা স্রোত ওঠা-নামা করছে।

খোঁপার কাঁটাটা সম্ভবত তারই পয়সায় কেনা। জরিনাকে এ রকম এক ডজন কাঁটা দিয়েছিল সে।

নিজের পয়সার কেনা কাঁটাটা এমন নিমকহারামি করল! দুশমনি করল! নাহ্, প্রাণহীন এ কাঁটাটার আর কী দোষ? দুশমনি করেছে জরিনা, সেই জাহান্নামের লাকড়িটা।

ফজল ভাবে, এ ঠিক পাপের শাস্তি। পাপ খাতির করে না পাপের বাপকেও। সে কবিরা গুনা করেছে। তার জন্য এখন কড়ায়-গণ্ডায় সুদে-আসলে জরিমানা দিতে হবে।

জরিনার জন্য ফজলের মনের কোটরে বাসা বেঁধেছিল অনেক স্নেহ-মতো, অনেক। সহানুভূতি। কিন্তু এ মুহূর্তে রাগ ও বিতৃষ্ণার ঘূর্ণিঝড় উড়িয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে সে সব কোমল অনুভূতি। জরিনাকে সে মনে মনে গাল দেয়, বেহায়া ঢেনি মাগিডাই তো তারে ঠেইল্যা নামাইছে পাপের আঠাই দরিয়ায়। এখন কত যে চুবানি খাইতে অইব তার শুমার নাই।

ফজল তার মনশ্চক্ষে দেখতে পায়–রূপজান ঝাঁটা মেরে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে জরিনাকে।

জরিনার জন্য আবার কেমন করে ওঠে ফজলের মন। তাড়া-খাওয়া মমতা আর সহানুভূতি মনের আশ্রয়ে ফিরে আসার জন্য পথ খোঁজে।

ফজল রূপকথার বইয়ে পড়েছিল রাজপুত্র আর রাজকন্যার পেছনে ধাওয়া করছে এক দৈত্য। তার গতিরোধ করার জন্য রাজকন্যা ছুঁড়ে ফেলে দেয় তার মাথার চিরুনি। সেই চিরুনি থেকে সৃষ্টি হয় কাঁটার এক দুর্ভেদ্য জঙ্গল। জরিনার খোঁপার কাঁটটাও বুঝি তার শ্বশুরবাড়ির চারদিকে সৃষ্টি করছে দুর্ভেদ্য কাঁটার বেড়া। সে বেড়া ভেদ করে সে কি রূপজানের কাছে যেতে পারবে আর?

ফজু কইরে?

ফজলের চিন্তার সূত্র ছিঁড়ে যায়। পিতার ডাকে সাড়া দিয়ে সে ঝুপড়ি থেকে বেরোয়। তার পিতার সাথে রয়েছে মেহের মুনশি, ধলাই সরদার আর জমিরদ্দি।

হোন্ ফজু, কোলশরিকগ খবর দিছি। এহনই আইয়া পড়ব। তুই ঘরের আড়ালে ছায়ার মইদ্যে হোগলা বিছাইয়া দে। বৈডক আছে আইজ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মাতব্বরের দলের লোকজন এসে হাজির হয় বৈঠকে।

এরফান মাতব্বর বলে, হোন মিয়ারা, আল্লার ফজলে কাম পাকা-পোক্ত অইয়া গেছে। জমিদারের সেলামি দিয়া খাজনাপাতি দিয়া পরিষ্কার অইয়া আইছি। এহন এমুন কোনো ব্যাডা নাই যে চরের তিরিসীমানায় আউগগায়।

আহাদালী বলে, কত ট্যাহা খাজনা দিলেন, মাতবরচাচা?

দেদার টাকা ঢাছিরে বাপু। তোমার মতো মাইনষে গইন্যা শুমার করতে পারব না। এহন কও দেহি তোমরা, ক্যামনে ভাগ করতে চাও জমি?

জমির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আলোচনা চলে অনেকক্ষণ। অবশেষে মাতব্বরের প্রস্তাবই মেনে নেয় সকলে। চরটাকে মাঝ বরাবর লম্বালম্বি দু’টুকরো করে আটহাতি নল দিয়ে মেপে ভাগ করতে হবে। চরের মাঝখান থেকে নদীর পানি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে এক এক জনের জমি। অবস্থানের দিক দিয়ে সকলের জমিই এক ধরনের হবে। তাই উৎকর্ষের দিক দিয়েও জমিতে জমিতে বড় বেশি পার্থক্য থাকবে না।

ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আলোচনা শেষ হলে এরফান মাতব্বর বলে, আমি তো ফতুর অইয়া গেছি সেলামি আর খাজনা দিয়া। এইবার আমার সেলামির যোগাড় করো।

নল পিছে কত কইর‍্যা সেলামি নিবেন মাতব্বরের পো? ধলাই সরদার জিজ্ঞেস করে।

আর সব মাতবররা যেই রহম নেয়।

রুস্তম বলে, আর সব মাতবররা তো ডাকাইত। তাগ মতন ধরলে আমরা গরিব মানুষ বাচমু ক্যামনে?

কদম শিকারি সায় দিয়ে বলে, মাতবরভাই, এট্টু কমাইয়া ধরেন।

তাইলে তোমরাই কও, কত কইর‍্যা দিবা।

রমিজ মিরধা বলে, নল পিছে বিশ ট্যাহা করেন।

বিশ টাকা! তোমাগ খায়েশ খানতো কম না! গত ছয় বচ্ছর খাজনা চালাইছি এই নাই চরের। তহন একটা আধা-পয়সা দিয়াও তো কেও সাহায্য করো নাই। এহন কোন আক্কেলে এমুন আবদার করো তোমরা?

উপরে আল্লা আর নিচে আপনে আমাগ বাপের সমান। আপনের কাছে আবদার করমু তো কার কাছে করমু?

তোমরা বিবেচনা কইর‍্যা কইও। চাইরশ বিশ আত দিঘল এক এক নল জমি। এক নলে কততুক জমি অয় ইসাব করছনি মেহের?

হ, করছি। এই ধরেন সাড়ে দশ কাঠার মতন। কানির ইসাবে অয় দুই গণ্ডার কিছু বেশি। একরের ইসাবে সাড়ে সতেরো শতাংশ। মেহের মুনশি বলে।

এহন তোমরাই কও। সাড়ে দশ কাঠা জমির লেইগ্যা তিরিশ টাকাও দিবা না কেমুন কথা?

জমিরদ্দি : দিতাম মাতবরের পো। কিন্তুক চরের জমি, আইজ আছে কাইল নাই।

ধলাই সরদার : হ, হ, গাঙ্গে ভাঙ্গনের ডর না থাকলে তিরিশ ক্যান্, একশ ট্যাহাই দিতাম।

এরফান মাতব্বর : অইচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা পঁচিশ টাকা কইর‍্যা দিও। সবাই রাজি?

সবাই রাজি হয়।

মাতব্বর আবার বলে, হোন মিয়ারা, যারা আগে সেলামির টাকা দিতে পারব, তাগ ইচ্ছামতো, পছন্দমতো জমি দিয়া দিমু।

ভালো সরেস জমি পাওয়ার আশায় সে-দিনই সেলামির টাকা নিয়ে এরফান মাতব্বরের বাড়ি হাজির হয় অনেকে। একদিনেই আদায় হয় সাত হাজার টাকা।

বহুদিন পরে এক সাথে অনেকগুলো টাকা হাতে পেয়ে মাতব্বরের মন খুশিতে ভরে ওঠে। তার বয়সের বোঝা হালকা মনে হয়। ভাটাধরা রক্তে অনুভূত হয় জোয়ারের পূর্বাভাস।

টাকা অনেকগুলো। কিন্তু টাকার কাজও রয়েছে অনেক। প্রথমেই ঋণ সালিশি বোর্ডের মীমাংসা অনুযায়ী দুই মহাজনের দেনার কিস্তি শোধ করতে হবে। তারপর যেতে হবে জণ্ড পোদ্দারের দোকানে। পুতের বউর বন্ধক-দেয়া গয়নাগুলো ছাড়িয়ে আনতে হবে। ফজুর মা’র দু’গাছা গয়নাও বন্ধক পড়ে আছে আজ দু’বছর। বাড়ির সবার জন্য কাপড়চোপড় কিনতে হবে। ঘাসি নৌকাটা মেরামত করা দরকার। পানসি গড়াতে হবে একটা। মাতব্বরির মান মর্যাদা বজায় রাখতে হলে পানসি একটা রাখতেই হয়। আগেও একটা পানসি ছিল মাতব্বরের। চর ভাঙার পর অভাবের সময় সেটা বেঁচে ফেলতে হয়েছিল।

পরের দিন। এরফান মাতব্বর হাশাইল বাজারে যায়। জগু পোদ্দারের দোকানে গিয়ে ছাড়িয়ে নেয় বন্ধক-দেয়া সবগুলো গয়না। পুতের বউর গলার হার, কানের মাকড়ি, হাতের চুড়ি আর অনন্ত। ফজুর মা’র গলার দানাকবচ আর কানের করণফুল। এগুলো বন্ধক দিয়ে পাঁচশ টাকা নিয়েছিল সে। এখন সুদে আসলে দিতে হলো আটশ টাকা।

সুদ যে কেমন করে ব্যাঙের বাচ্চার মতো পয়দা হতে থাকে বুঝে উঠতে পারে না মাতব্বর। সে মনে মনে বলে, ব্যাডা পোদারের পুত কি দিয়া যে কি ইসাব করল, বোঝতেই পারলাম না। ফজলরে সঙ্গে আনা উচিত আছিল। ও ইসাবপত্র বোঝে ভালো।

কাপড়চোপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা শেষ করে এরফান মাতব্বর নৌকায় গিয়ে ওঠে। তাদের গাবুর একাব্বর নৌকা ছেড়ে দেয়।

মাতব্বর বলে, সোজা নলতা মোল্লাবাড়ি চইল্যা যা। আইজ বউ না লইয়া বাড়িত যাইমু না।

ভাটি পানি। তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। গয়নার পুটলিটার ওপর হাত বুলাতে বুলাতে এরফান মাতব্বর মনে মনে বলে, আইজ দ্যাহাইয়া দিমু আরশেদ মোল্লারে। ও বিশ্বেস করে নাই আমার কথা। মনে করছে ওর মাইয়ার গয়না আর ছাড়াইতে পারমু না। আইজ দশটা চউখ উধার কইর‍্যা আইন্যা দেখবি, যেই গয়না বন্দুক দিছিলাম, তা বেবাক ছাড়াইয়া আনছি। দেহি, এইবার তুই আমার পুতের বউ কোন ছুতায় আটকাইয়া রাখস।

আরশেদ মোল্লা নিজের ও গরুর গা ধোয়ার জন্য নদীতে নেমেছিল। দুটো বলদ ও একটা গাইকে গলাপানিতে দাঁড় করিয়ে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে সে ওদের গা ঘষামাজা করছিল। হঠাৎ একটা উদলা নৌকার ওপর তার চোখ পড়ে। নৌকাটা তার বাড়ির দিকে আসছে আর ওতে বসে আছে এরফান মাতব্বর।

আরশেদ মোল্লা তাড়াতড়ি একটা ডুব দিয়ে আধা নাওয়া গরুগুলোকে খেদিয়ে নিয়ে যায় বাড়ির দিকে।

ভেজা কাপড়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মোল্লা তার স্ত্রীকে ডাকে, কইগো রূপির মা, আমার লুঙ্গি আর নিমাডা দ্যাও দেহি জলদি।

এত জলদি কিয়ের লেইগ্যা? মাইর করতে যাইব নি?

আগো চুপ করো। রূপজান কই?

নাইতে গেছে।

হোন, এরফান মাতব্বর আইতে আছে।

কুড়ুম আইতে আছে ভালো কথা। পুরান কুড়ুমের কাছে যাইতে আবার সাজান-গোছন লাগবনি?

দুত্তোরি যা! বিরক্ত হয়ে মোল্লা ভিজা কাপড়েই ঘরে যায়। লুঙ্গি বদলে নিমাটা গায়ে চড়িয়ে সে বেরিয়ে আছে। স্ত্রীকে বলে, হোন, মাতবর আমার কথা জিগাইলে কইও, দিঘিরপাড় হাটে গেছে।

ক্যান্? কুড়ুমের ডরে উনি পলাইতে আছে নি?

পলাইতে আছি তোমারে কে কইল? হোন, আমার মনে অয় মাতবর আইতে আছে তোমার মাইয়া নিতে। আমি থাকলেই তক্কাতক্কি অইব। জোরাজুরি করব মাইয়া নেওনের লেইগ্যা। আমি বাড়ি না থাকলে আর জোরাজুরি করতে পারব না। তুমি কইও, উনি বাড়ি নাই। খালি বাড়িরতন মাইয়া দেই ক্যামনে?

কই গেলেন বেয়াইসাব? এরফান মাতব্বরের গলা।

আরশেদ মোল্লা খাটো গলায় বলে, ঐ যে আইয়া পড়ছে! আমি গেলাম।

আরশোদ মোল্লা বাড়ির পেছন দিক দিয়ে সটকে পড়ে।

বেয়াইসাব কই? আবার হাঁক দেয় এরফান মাতব্বর। আরে–আরে–আরে! গরুতে ক্যালার ড্যামগুলা খাইয়া ফালাইল। কই গেলেন মোল্লাসাব?

এরফান মাতব্বর তার হাতের লাঠি উঁচিয়ে হেঁই হাঁট-হাট করে গরুগুলোকে তাড়া দেয়।

রূপজানের মা সোনাভান ওরফে সোনাইবিবি মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে আসে গরু বাঁধবার জন্য।

আসলামালেকুম বেয়ানসাব। কেমন আছেন?

আল্লায় ভালোই রাখছে।

মোল্লাসব কই?

উনি হাট করতে গেছে দিঘিরপাড়।

হাট করতে গেছে! তয় এই মাত্র গরু নাওয়াইতে দ্যাখলাম কারে?

হ উনিই। ঐ পুবের বাড়ির তারা হাটে যাইতে আছিল। তাই ত্বরাত্বরি গিয়া ওঠছে তাগো নায়। গরু বান্ধনেরও অবসর পায় নাই।

সোনাইবিবি গরু বাঁধবার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু গরুর শিং নাড়া দেখে সে ভয়ে পিছিয়ে আসে। তার মাথার ঘোমটা পড়ে যায়, নাকের দোলায়মান সোনার চাঁদবালিটা চিকমিকিয়ে ওঠে।

মাতব্বর বলে, আপনে পারবেন না। আমি আমার গাবুররে ডাক দিতে আছি। ওরে একাব্বর, এই দিগে আয়। গরুগুলারে গোয়ালে বাইন্দা রাখ।

মাতব্বর বেঠকখানায় গিয়ে চৌকির ওপর বসে। তার প্রশ্ন এড়িয়ে অন্দরে চলে যেতে পারেনা সোনাইবিবি। সে অন্দরমুখি দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে মাতব্বরের সাথে কথা বলছে।

বউমা কই, বেয়ান সাব? নাইতে গেছে।

আইজ বউমারে নিতে আইছি। একটা মাত্র পুতের বউ আমার। বউ বাড়িতে না থাকায় বাড়ি-ঘর আমার আন্দার অইয়া রইছে।

আপনেরা আমাগ মাইয়ার মোখৃখান যে আন্দার কইর‍্যা থুইছেন হেই কথাতো কন্ না। মাইয়ার গয়নাগুলারে বেবাক–

গয়নার কথা কেন? এই দ্যাহেন, বেবাক গয়না ছাড়াইয়া আনছি।

গয়নার পুটলিটা উঁচু করে দেখায় মাতব্বর। তারপর আবার বলে, বউমারে ডাক দ্যান। তার গয়না তার আতে বুঝাইয়া দিমু আইজ।

কিছুক্ষণ পর রূপজান আসে। শ্বশুরের কদমবুসি করে সে দাঁড়ায় তার কাছে।

মাতব্বর বলে, তোমার এই বুড়া পোলার উপরে রাগ অইয়া রইছ মা? এই দ্যাহো। মাতব্বর। গয়নার পুটলি খোলে। এই নেও মা, তোমার গলার হার। নেও, গলায় দ্যাও। শরম কিয়ের?

হারটা গলায় পরে রূপজান।

আর এই ধরো কানের মাড়িজোড়া। কানে দ্যাও মা, কানে দ্যাও। তুমি তো জানো মা, কেমুন বিপাকে পইড়া গেছিলাম। তা না অইলে কি আমার মা-র গয়না বন্দুক দেই আমি? কানে দিছ মা? হ্যাঁ এইতো এহন কেমুন সোন্দর দেহা যায় আমার মা-লক্ষ্মীরে।

একজোড়া অনন্ত ও ছয়গাছা চুড়িসহ পুটলিটা রূপজানের দিকে এগিয়ে দিয়ে মাতব্বর আবার বলে, এই নেও মা। কিছু থুইয়া আহি নাই। বেবাক ছাড়াইয়া আনছি। আর দ্যাহো, কেমুন চকমক-ঝকমক করতে আছে। সবগুলারে পালিশ করাইয়া আনছি।

রূপজানের গয়না পরা হলে মাতব্বর বলে, এইতো এহন আমার মা-র মোখখান হাসি খুশি দ্যাহা যায়। আর এই নেও শাড়ি। দ্যাহো কী সোন্দর গুলবদন শাড়ি। যাও মা শাড়ি পিন্দা তোমার মা-র কদমবুসি করো গিয়া। আর জলদি কইর‍্যা তৈয়ার অইয়া নেও।

সোনাইবিবি দরজার আবডালে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলে, কর্তা বাড়িতে নাই। খালি বাড়িরতন মাইয়া দেই ক্যামনে?

কর্তা নাই, কর্তানি তো আছে। যান বেয়ানসাব, বউমারে সাজাইয়া-গোজাইয়া দ্যান।

উনি বাড়ি না আইলে তো মাইয়া দিতে পারমু না।

উনি কোন সুম আইব, তার তো কোনো ঠিক নাই!

হ, হাটে গেছে, আইতে দেরি অইব। আপনে আর একদিন আইয়েন।

আর একদিন আর আইতে পারমু না। আইজই বউ লইয়া বাড়িত যাওন চাই। এইখানে এই পাড়া গাইড়া বইলাম আমি। যান, খাওনের যোগাড় করেন। পালের বড় মোরগাড়া জবাই করেন গিয়া।

.

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা। কিন্তু এখনো বাড়ি ফিরে এল না আরশেদ মোল্লা। চৌকির ওপর শুয়ে বসে বিরক্তি ধরে গেছে এরফান মাতব্বরের। অস্বস্তিতে ছটফট করে সে। এর মধ্যে রূপজান তামাক সাজিয়ে দিয়ে গেছে বার কয়েক। প্রত্যেক বারই তাকে জিজ্ঞেস করেছে মাতব্বর, কি মা, তোমার বাজান আইছে?

অধৈর্য হয়ে ওঠে রূপজানও। সে বার বার ছাঁচতলায় গিয়ে নদীর দিকে তাকায়। কিন্তু তার বাজানকে দেখা যায় না কোনো নৌকায়। তার ব্যাকুলতার কাছে হার মানে লজ্জা সঙ্কোচ। সে মা-কে বলে, মা, বাজান এহনো আহেনা ক্যান?

উনির আহন দিয়া তোর কাম কি?

দ্যাহো না, মিয়াজি যাওনের লেইগ্যা কেমুন উতলা অইয়া গেছে।

তোর মিয়াজি উতলা অইছে, না তুই উতলা অইছস?

লজ্জায় মাথা নত করে রূপজান। মেয়ের দিকে চেয়ে মায়ের মন ব্যথায় ভরে ওঠে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে।

রূপজানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সে বলে, আমি আর কী করতে পারি, মা। তোর বাপ বেবুঝ, গোঁয়ার। আমার কোনো কথা কানে লয় না।

যেই গয়নার লেইগ্যা আমারে আটকাইছে, হেই গয়না তো বেবাকই দিছে আবার। বাজান বাড়িত থাকলে যাইতে মানা করত না। তুমি মিয়াজিরে কও আমারে লইয়া যাইতে।

কোন্ ডাকাইত্যা কথা কস, মা। উনির হুকুম ছাড়া তোরে যদি এহন যাইতে দেই, তয় কি আমারে আস্ত রাখব! কাইট্যা কুচিকুচি কইর‍্যা গাঙে ভাসাইয়া দিব না!

যদি যাইতে না দ্যাও, তয় গয়নাগুলা রাখবা কোন মোখে? এগুলা ফিরাইয়া দেই?

ফিরাইয়া দিবি ক্যান্? উনি বাড়িত আহুক। ওনারে বুঝাইয়া-সুজাইয়া তোরে পাড়াইয়া দিমু একদিন।

এরফান মাতব্বর মাগরেবের নামাজ পড়েও অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু আরশেদ মোল্লার আসার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না তার। মনের এ সন্দেহ তার আরো দৃঢ় হয়। সে বুঝতে পারে, আরশেদ মোল্লা তাকে দেখে পালিয়েছে। সুতরাং সে যতক্ষণ এ বাড়িতে আছে ততক্ষণ মোল্লা কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না।

মাতব্বর এশার নামাজ পড়ে বাড়ি রওনা হয়। যাওয়ার সময় বেয়ানকে বলে যায়, গয়নার লেইগ্যা মাইয়া আটকাইছিল। সবগুলো গয়না বুঝাইয়া দিছি। এইবার ভালমাইনষের মতন আমার পুতের বউরে যে আমার বাড়ি দিয়া আহে।

.

১০.

কার্তিক গেল, অগ্রহায়ণও প্রায় শেষ হয়ে এল। কিন্তু রূপজানকে দিয়ে গেল না আরশেদ মোল্লা। লোকটার মতলব খারাপ বলে মনে হচ্ছে এরফান মাতব্বরের। মোল্লার চেহারা মনে। ভাসতেই তার রক্ত টগবগ করে ওঠে, ‘জাক্কইর’ দিয়ে ওঠে সারা শরীরের রোম। তার ইচ্ছে হয়–মোল্লাকে শড়কি দিয়ে গেঁথে কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ি নিয়ে আসে।

রাগ হয় তার নিজের ওপরেও। কেন সে আহাম্মকের মতো এতগুলো গয়না তুলে দিয়ে এল মোল্লার মেয়েকে? যে মোল্লা ফেরেববাজি করে নিজের নাবালক ভাইপোর দুই কানি জমি আত্মসাৎ করতে পারে, জমির লোভী সেই মোল্লা যখন নতুন চরের জমির জন্য তার কাছে এল না, তখনই সে বুঝতে পেরেছিল, লোকটার মনে খন্নাস’ভর করছে। এতটা বুঝেও কেন বোকামি করল সে! কেন দিয়ে এল গয়নাগুলো! ওগুলো থাকলে ও দিয়েই আবার সে ফজলের বিয়ে দিতে পারত।

হুঁকো টানতে টানতে উঠানে বেরোয় এরফান মাতব্বর। সেখানে বরুবিবি রোদে দেয়া ধান ঘাটছিল পা চালিয়ে।

মাতব্বর বলে, হোন ফজুর মা, এত টাকার গয়না খামাখা দিয়া আইলাম। আমার মনে অয় গয়নাগুলা অজম করনের তালে আছে মোল্লা।

আমারও মনে অয় গয়নাগুলো মাইরা দিব।

কিন্তু অজম করতে দিমু না। আইজ মানুষজন খবর দিতে আছি।

ক্যান, মানুষজন দিয়া কি অইব?

কি অইব আবার! এত চর দখল করলাম এই জিন্দিগিতে, আর এহন নিজের পুতের বউ দখলে আনতে পারুম না!

ওনার কি মাথা খারাপ অইল নি? কাইজ্যা-ফ্যাসাদ কইর‍্যা বউ ছিনাইয়া আনলে মাতবর বাড়ির ইজ্জত থাকব? মাইনষে–

কি করতে কও তয়? পাজির লগে পাইজ্যামি না করলে দুইন্যায় বাঁইচ্যা থাকন যায় না।

আবার মোল্লাবাড়ি গিয়া দেহুক না একবার।

উঁহু! আমি আর যাইতে পারমু না। তোমার পোলারেই পাড়াইয়া দ্যাও।

ও গেলে তো দিবইনা।

হে অইলে ঐ মাইয়ার আশা ছাইড়া দ্যাও। গেছে গয়না যাইক। তুমি মাইয়া বিচরাও। ফজুরে আবার আমি বিয়া করাইমু।

কিন্তুক ফজুরে রাজি করান যাইব না।

ক্যান্ যাইব না? এমুন খুবসুরত আর ঢাক-চেহারার মাইয়া যোগাড় করমু, মোল্লার মাইয়ার তন তিন ডফল সোন্দর।

উঁহু। কত জায়গায় কত মাইয়া দ্যাখলাম। আমার রূপজানের মতন এমুন রূপে-গুণে কামে-কাইজে লক্ষ্মী মাইয়া আর পাওয়া যাইব না।

মাইয়াডা তো লক্ষ্মী, কিন্তু বাপখান কেমুন? ওর মতো অলক্ষ্মী, পাজির পা-ঝাড়া আছে দুইন্যার মাঝে? ওর মাইয়া লক্ষ্মী অইলেই কি, আর না অইলেই কি! তুমি জিগাও তোমার পোলারে।

উঁহু, ও রাজি অইব না কিছুতেই।

ক্যামনে বোঝলা তুমি?

আমি মা, আমি কি আর বুঝি না?

তয় এমুন না-মরদের মতন চুপচাপ রইছে ক্যান্ তোমার পোলা? যায় না ক্যান্ হউর বাড়ি? আলগোছে ভাগাইয়া লইয়া আইলেই তো পারে।

এই বুদ্ধিলাই ভালো। চুপে-চাপে কাম অইয়া গেলে কেও টের পাইব না।

হ তোমার পোলারে এই পরামিশই দ্যাও। নেহাত যদি বউ স্ব-ইচ্ছায় না আইতে চায়, তয় জোর কইর‍্যা লইয়া আইব। তা না পারলে গয়নাগুলা যে কাইড়া লইয়া আহে।

ফজলও এ রকমই ফন্দি এটেছিল। দ্বিধা-লজ্জার চাপে তা ছিল তার মনে মনেই এত দিন। বাপ-মায়ের প্ররোচনা ঝেটিয়ে দেয় তার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। সে তার মামাতো ভাই হাশমতের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করে, তার শ্বশুর যেদিন দূরে কোথাও যাবে, রাত্রে বাড়ি ফিরবে না, সেদিন সে চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি। রাত্রে সে থাকবে সেখানে। রাত দুপুরের পর নৌকা নিয়ে সেই বাড়ির ঘাটে হাজির হবে হাশমত।

দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে। কিন্তু সুযোগ আর আসে না। ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত ফজল মিস্ত্রিদের কাজ দেখাশুনা করে। নতুন চরে পানসি তৈরি হচ্ছে তাদের। রাতের বেলাও ভাওর ঘর ছেড়ে সে কোথাও যায় না। বসে থাকে খবরের আশায়। গোপন খবরের জন্য সে তার চাচাতো শালা কাদিরকে লাগিয়েছে।

চুপচাপ বসে থাকলেই ফজলের মনে হানা দেয় জরিনার খোঁপার কাঁটাটা। রূপজান নিশ্চয় পেয়েছে কাঁটাটা। তার বুঝতে বাকি নেই কিছু।

বুঝুক, বুইঝ্যা জ্বইল্যা পুইড়া মরুক। ও-ই তো এর লেইগ্যা দায়ী। ঐ দিন রাইতে দেরি করল ক্যান্ ও? ফজলের মনে ক্ষুব্ধ গর্জন।

কিন্তু তবুও তার মনের দ্বিধা দূর হয় না। সে কেমন করে গিয়ে দাঁড়াবে রূপজানের সামনে? কাঁটাটার কথা জিজ্ঞেস করলে কি বলবে সে?

নাহ্, মিছে কথা ছাড়া উপায় নেই, ফজল ভাবে। এমন কিছু বানিয়ে রাখতে হবে যাতে জিজ্ঞেস করলেই ঝেড়ে দেয়া যায়।

কিন্তু রূপজানের সাথে দেখা করার সুযোগই যে পাওয়া যাচ্ছে না।

সুযোগের নাগাল পাওয়ার আগেই একদিন বাড়ি থেকে নূরু এসে বলে, দুদু, পা-না ধোয়া জঙ্গুরুল্লা হুছি চর দখলের আয়োজন করতে আছে!

কার কাছে শুলি?

আইজ ইস্কুলতন আইতে লাগছি, একজন মাইয়ালোকে আমারে ডাক দিয়া নিয়া চুপে চুপে কইছে এই কথা।

মাইয়া লোক! কে চিনস না?

উঁহু। হে কইছে, আইজই তোর চাচার কাছে খবরডা দিস।

মাইয়া লোকটা দ্যাখতে কেমন?

শ্যামলা রঙ। নীলা রঙের শাড়ি পরনে।

মোডা না চিকন?

বেশি চিকন না। মোডাও না।

বয়স কত অইব? বুড়ি, না জুয়ান?

বুড়ি না। চাচির মতই বয়স অইব।

ফজল চিনতে পারে না কে সে মেয়েলোকটি। কিন্তু সে যে-ই হোক, নিশ্চয়ই কোনো শুভাকাক্ষী আপন জন। তার খবরটা বেঠিক বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। জঙ্গুরুল্লা দাঙ্গাবাজ। তার তবে অনেক কোলশরিক, লাঠিয়াল-লশকর। ডাইনগাঁয়ের পুব দিকে অনেক কয়টা চর দখল করেছে সে। ফজল চিন্তিত হয়।

নূরু ও চার-পাঁচজন পুলকি-মাতব্বরকে সাথে করে ফজল বাড়ি যায়।

এরফান মাতব্বর শুনে বিশ্বাস করতে চায় না। সে বলে, নিজের এলাকা ছাইড়া জঙ্গুরুল্লা এত দূরে আইব কি মরতে?।

মেহের মুনশি বলে, কওন যায় না চাচাজান। জঙ্গুরুল্লার দলে অনেক মানুষজন।

হ ব্যাডা ট্যাহার কুমির। সমর্থন করে বলে জাবেদ লশকর। মাইনষে কয়, জঙ্গুরুল্লা পাল্লা-পাথর দিয়া ট্যাহা মাপে। গইন্যা বোলে শুমার করতে পারে না।

হে অইলে তো তৈয়ার থাকতে অয়, এরফান মাতব্বর বলে। চাকইর‍্যা ভাড়া করণ লাগব, না, তোমরাই ঠেকা দিতে পারবা?

ফজল : আমরাই পারুম।

মেহের মুনশি : এক কাম করলে অয়। আমাগ জমিরদ্দির মাইয়া বিয়া দিছে জঙ্গুরুল্লার কোলশরিক মজিদ খালাসির পোলার কাছে। জমিরদ্দিরে পাড়াইয়া দেই খালাসি বাড়ি। মাইয়ার কাছতন খবর লইয়া আইব গিয়া।

যুক্তিটা পছন্দ হয় সকলের। সেদিনই জমিরদ্দিকে বেয়াই বাড়ি পাঠিয়ে এরফান মাতব্বর চলে যায় খুনের চর। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেয়ার জন্য সে তার লোকদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে। এক এক দল পালা অনুসারে নদীর কিনারা দিয়ে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেবে। মাতব্বর নিজেও আস্তানা গাড়ে ভাওর ঘরে।
.

চর দখলের কিছুদিন পরেই বোরো ধানের রোয়া লাগানো হয়েছিল নদীর কিনারার কোনো কোনো জমিতে। নতুন মাটিতে ফসলের জোর দেয়া যায় খুব। কিছুদিন আগে আরো কিছু জমিতে লাগানো হয়েছে বোরা ধানের রোয়া। সেগুলোও সতেজ হয়ে উঠছে।

রোদ পোহাতে পোহাতে চরটার চারদিকে চোখ বোলায় এরফান মাতব্বর। সবুজের সমারোহ তার চোখ জুড়িয়ে দেয়। নতুন চর বলেই মনে হয় না তার কাছে। চর জাগার সাথে সাথে এমন ফসল ফলানো সম্ভব হয় না সব সময়। অপেক্ষা করতে হয় দু-এক বছর।

জমিরদ্দি খবর নিয়ে ফিরে আসে।

খবরটা সত্যি। বিশুগাঁওয়ের জমিদার রায়চৌধুরীরা এ তৌজির এগারো পয়সার মালিক। তাদের কাছ থেকে বন্দোবস্ত এনেছে জঙ্গুরুল্লা, তার লোকজন তৈরি হচ্ছে। জন পঞ্চাশেক চাকরিয়াও নাকি এনেছে সখিপুরার চর থেকে।

খবর শুনে মুখ শুকিয়ে যায় উপস্থিত পুলকি-মাতব্বর আর কোলশরিকদের। তাদের উদ্বেগভরা মুখের দিকে তাকিয়ে মাতব্বর বলে, জমিতে ফসল দেইখ্যা চর দখলের লোভ অইছে। আহে যে চরের কাছে। আমারে চিনে না। আমি যখন থিকা মাতবর তখন জঙ্গুরুল্লার নাম-নিশানাও আছিল না।

রুস্তম বলে, হ, পা-না-ধোয়া জঙ্গুরুল্লা এহন চদরী নাম ফুডাইছে।

হ, মাইনষে যেমুন কয়–বাপ-বয়সে ঘোড়া না, লেজেতে লাগাম। তোমরা ঘাবড়াইও না। ওর চর দখলের খায়েশ মিডাইয়া দিমু।

কিন্তু মুখে যত সাহসের কথাই বলুক, মাতব্বর মনে মনে শঙ্কিত হয়। মহাভাবনায় পড়ে সে। তার দলের বেশির ভাগ লোকই আনাড়ি। তারা লাঠিও ঘোরাতে পারে না ঠিকমত । ঘোরানোর চোটে যদি বো-বো আওয়াজই না ওঠে, তাকে কি লাঠি ঘোরানো বলে? মাত্র দশ বারোজন শড়কি চালাতে পারে, বেতের ঢাল দিয়ে নিজেদের বাঁচাবার কৌশল জানে। কিন্তু পেশাদার চাকরিয়াদের সামনে তারা ধরতে গেলে কুকুরের মোকাবেলায় মেকুর।

মাতব্বর বলে, মেহের মুনশি চইল্যা যাও ট্যাংরামারি। ঐ জাগার আলেফ সরদার। আমার পুরান চাকইর‍্যা। বিশ-পঁচিশজন শাগরেদ লইয়া যেন তোমার লগেই আইয়া পড়ে। আর কদম চইল্যা যাও জাজিরার চর। গদু পালোয়নের পোলা মেঘু ওর বাপের মতোই মর্দ অইছে। ওরে আর ওর দলের পনেরো-বিশজন শড়কিদার লইয়া আইয়া পড়বা জলদি।

একটু থেমে মাতব্বর আবার বলে, আমাগ হাংগাল-বাংগালগুলারে লইয়া কি করি? এইগুলার আতে শড়কি দিতে ভস্সা পাই না। ওরা শড়কি আতে পাইলে বিপক্ষের মাইষের বুকের মইদ্যে হান্দাইয়া দিব। এই গুলার আতে দিতে অইব লাডি। কিন্তুক একজনও ঠিকমত লাডি চালাইতে পারে না।

হ, ঠিকই কইছেন। একজনও ভালো কইর‍্যা লাডি চালাইতে হিগে নাই। বলে রমিজ মির।

ফজল, এক কাম কর। তুই লোনসিং চইল্যা যা। তুই না কইছিলি লোনসিংয়ের কে খুব ভালো লাডি খেইল শিখছে?

হ, তুরফান। ফজল বলে। আমার লগে নড়িয়া ইস্কুলে পড়তো। পুলিন দাসের এক শাগরেদের কাছে সে লাঠি খেলা শিখছে।

পুলিন দাস আবার কে? আহাদালী জিজ্ঞেস করে।

পুলিনবিহারী দাস। বাড়ি লোনসিং। স্বদেশী আন্দোলনের বড় নেতা। এখন বোধ করি জেলে আছে।

আমরা হুনছি, সে এত জোরে বোঁ-বোঁ কইর‍্যা লাডি ঘুরাইতে পারত, বন্দুকের ছা তার লাডির বাড়ি খাইয়া ছিট্যাভিট্যা যাইত, তার শরীলে লাগতে পারত না। মাতব্বর বলে। ফজল গিয়া তুরফানরে লইয়া আয়। আমাগ হাংগাল-বাংগালগুলারে কয়ডা দিন লাডি খেলার তালিম দিয়া যাইব।

আমি আইজই যাইতে আছি।

হ, তোমরা কিছু মোখে দিয়া এহনই বাইর অইয়া পড়। যাইতে-আইতে পথে দেরি কইর‍্য না কিন্তুক।

দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে তিনটা উড়োজাহাজ আসছে। বিকট আওয়াজ তুলে ওগুলো মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় উত্তর-পূর্ব কোণের দিকে।

এরফান মাতব্বর শুনেছে, সারা দুনিয়া জুড়ে তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেছে। সে জিজ্ঞেস করে, কোন মুলুকে যাইতে আছে এগুলা, জানোনি?

মনে অয় আসাম মুলুকে যাইতে আছে। বলে জাবেদ লশকর।

উড়োজাহাজগুলো দূর-দিগন্তে মিলিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মাতব্বর তবুও চেয়ে আছে সেদিকে। ওগুলোর আওয়াজ যেন বাসা বেঁধেছে তার বুকের ভেতর। যেন লড়াইয়ের কাড়া নাকাড়া বেজে চলেছে সেখানে।

মাতব্বর শক্ত করে ধরে তার হাতের লাঠিটা। তার শিথিল বাহুর পেশি কঠিন হয়ে ওঠে। স্পষ্ট হয়ে ওঠে কোঁচকানো মুখের রেখাগুলো। ঘোলাটে চোখ দুটো ঝলকে ওঠে আক্রোশে।

.

১১.

ফজল পরের দিনই তুরফানকে নিয়ে আসে। এসেই তুরফান পুলকি-মাতব্বর আর কোলশরিকদের জোয়ান তরুণ ছেলেগুলোকে লাঠি খেলার সবক দিয়ে শুরু করেছে। ফজল নিজেও নিচ্ছে খেলার তালিম।

আলেফ সরদার এসেছে তার তিরিশজন সারগেদ নিয়ে। মেঘু পালোয়ান নিয়ে এসেছে ঊনিশজন। মাতব্বরের দলের আশিজনও হাজির। যার যার হাতিয়ার–ঢাল-কাতরা, লাঠি শড়কি, গুলেল-গুলি সব তৈরি।

দূর থেকে কেমনে গগম্ আওয়াজ শোনা যায়, যেমন শোনা যায় হাটের হট্টগোল। সত্যি যেন হাট বসে গেছে খুনের চরে।

চাকরিয়াদের সাথে নিয়ে পালা অনুসারে পাহারা দিচ্ছে কোলশরিকেরা। যাদের অবসর তারা বয়স ও প্রকৃতি-প্রবণতা অনুসারে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আড্ডা দেয়। একদল মাটিতে দাগ কেটে ষোলগুটি খেলে তো আর একদল কেচ্ছা-শোলকের আসর জমিয়ে তোলে। কোনো ভাওর ঘরে বসে যায় পুঁথি-পাঠের মজলিস। সুর করে পড়ে গাজী-কালু আর সোনাভানের পুঁথি। যেখানে পানসি নৌকা তৈরি হচ্ছে, সেখানকার আসর সবচেয়ে বেশি জমজমাট। বুড়ো আকু মিস্ত্রি টান দিয়েছে গানে–

ও-ও জীর্ণ কাষ্ঠের একখান তরী,
তার উপরে এক সওয়ারি,
পাড়ি ধরছে অকুল দরিয়ায় ॥
ওরে উওরায় পানি টুবুটুবু,
তাইতে তরী ডুবুডুবু
এখন ঢেউ উঠিলে হইব অনুপায় ॥

আছরের নামাজের সময় হয়নি তখনও। এরফান মাতব্বর ভাওর ঘরে বসে কোরানশরিফ পড়ছিল। গানের আওয়াজ কানে আসতেই তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়, বিরক্তি ধরে। গানের আওয়াজ যাতে কানে না আসে সেজন্য গলার স্বর উঁচু পর্দায় চড়িয়ে কোরান তেলাওয়াতে মন দেয় সে। কিন্তু পাক কোরানের পাতা ছেড়ে তার মনমাঝি এক সময়ে চড়ে বসে জীর্ণ কাষ্ঠের তরীতে।

ও-ও জীর্ণ কাষ্ঠের একখান তরী,
তার উপরে এক সওয়ারি,
পাড়ি ধরছে অকুল দরিয়ায় ॥
ওরে কালা মেঘে আসমান ছাওয়া
খাড়াঝিলিক করে ধাওয়া
এখন তুফান ছাড়লে হবে কি উপায়?
ওরে ও মন-মাঝি–
সাবধানে ধরিও হাল,
কৌশলে বান্ধিও পাল,
উজান গাঙে পাড়ি পাওয়া দায় ॥

গান শেষ হলে এরফান মাতব্বরের সংবিৎ ফিরে আসে। নিজেকে সে তিরস্কার করে বারবার। কোরান-মজিদের পাক কালামের ওপর কেন সে তার মনকে নিবিষ্ট রাখতে পারেনি। আল্লার কালাম সে অশেষ ভক্তি নিয়ে পড়ে, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে না বলে কি তার মন উড়াল দেবে ঐ গানের কথা আর সুরের পেছনে পেছনে!

মাতব্বর আলোয়ানের কয়েক প্যাঁচে ঢেকে নেয় তার মাথা আর কান দুটো। তারপর আবার শুরু করে কোরানশরিফ তেলাওয়াত।

আছরের নামাজ পড়ে মাতব্বর আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। শীতে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার সারা শরীর।

আবার শোনা যায় গান। দোতারা বাজিয়ে এবার গাইছে বোধহয় পাঞ্জু বয়াতি।

দয়ালরে তোর দয়ার অন্ত নাই,
এই আসমান জমিন
আর সাগর গহিন।
সবখানে তার পরমান পাই ॥

মাতব্বরের মন গানের পাখায় ভর দিয়ে আবার উড়ে চলে। তাকেও টানে গানের আসরের দিকে। সে ঝুপড়ি থেকে বেরোয়। একপা-দু’পা করে এগিয়ে যায় ধীরে ধীরে। তাকে দেখে সচকিত হয়ে ওঠে সবাই। বন্ধ হয়ে যায় গান। মাতব্বরের ইচ্ছে হয় চেঁচিয়ে বলে, ওরে গানে ক্ষ্যান্ত দিলি ক্যান্? চলুক, চলতে দে।

মাতব্বর নিজেকে সামলে নেয়। সে সকলের মুরব্বি মাতব্বর। তার উচিত নয় এদের সাথে হৈ-হুঁল্লোড় করার। এছাড়া একবার যদি এরা প্রশ্রয় পেয়ে যায় তবে গান-বাজনায় মেতে যাবে সবাই। আর ওদিক দিয়ে বিনা বাধায় জঙ্গুরুল্লা দখল করে নেবে চর।

মাতব্বর ডাকে আকু মিস্ত্রিকে, কিও মিস্ত্রি, আর কদ্দিন লাগাইবা?

এই ধরেন কুড়ি-বাইশ দিন।

অনেক দিন লাগাইতে আছ। জলদি করো। এর পর আবার ছই লাগাইতে অইব।

একটু থেমে সে ডাক দেয়, ফজল কইরে?

জ্বী। ভিড় থেকে বেরিয়ে আসে ফজল।

তোর লাডির খেইল কেমুন চলতে আছে?

খুব ভালো চলতে আছে।

উন্নতি অইছে কিছু? না খালি খালি–

না অনেক উন্নতি অইছে।

আরো ভালো কইর‍্যা শিখতে অইব। আর হোন, তুই, হাশমত, লালু, ফেলু, বক্কর, টিটু, একাব্বর শড়কি চালানও শিখ্যা রাখ। আর কে কে শিখতে চায়?

আমি, আমি, বলে আরো দশ-বারোজন এগিয়ে আসে।

মাতব্বর বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ সাবাস! তোমরা আলেফ সরদার আর মেঘু পালোয়ানের শাগরেদ অইয়া যাও। শড়কি চালান শিখ। খামাখা সময় নষ্ট কইর না। কি ভাই আলেফ সরদার, কই মেঘু, পারবা না আমাগ এই হাংগাল-বাংগালগোরে এট্টু লায়েক বানাইতো?

পারমু না ক্যান্, মেঘু পালোয়ান বলে।

মেঘু রাজি অইয়া গেল নি ও? হাসতে হাসতে বলে আলেফ সরদার। এই জমিনওলাগো এই বিদ্যা হিগাইলে হেষে আমাগ ভাত জুটব না কিন্তু কইয়া দিলাম। কি কন মাতবর-ভাই?

আরে না-না। ভাত দেওনের মালিক আল্লা। আমরা চাইলেও কি আর তোমাগ ভাত মারতে পারমু?

তা ঠিক কইছেন। লইয়া আহেন মণ্ডা-মিডাই। মোখ মিষ্টি কইর‍্যা তয় না পয়লা সবক দিমু।

পরের দিন মিষ্টিমুখ করে আলেফ সরদার আর মেঘ পালোয়ান নতুন নতুন সাগরেদদের শড়কি চালনা শেখাতে আরম্ভ করে। এরফান মাতব্বর নিজে দাঁড়িয়ে দেখে। সেও এক কালে ভালো শড়কি চালাতে পারত।

এরফান মাতব্বর নতুন সাগরেদদের উপদেশ দেয়, মাইনষে কইতেই কয়, বাঙ্গালের মাইর, দুনিয়ার বাইর। তোমরা হেই রকম বাঙ্গাল। তোমরা কাবু পাইলে এক্কেবারে মাইরা ফালাইবা, আবার বেকাদায় পড়লে নিজেরা মরবা। এর লেইগ্যা তোমাগ তালিম দিতাছি। চরের কাইজ্যা কিন্তু রাজা-বাদশাগ লড়াই না যে যারে পাইলাম তারে খুন করলাম। চরের কাইজ্যা অইল বিপক্ষরে খেদানের লেইগ্যা। তাই নিজেরে বাঁচাইতে শিখ একদম পয়লা। তারপর শড়কি দিয়া খোঁচা দিতে শিখ। খোঁচা কিন্তু বুকে মাথায় দিবা না। খোঁচা দিবা আতে, পায়ে। খোঁচা খাইয়া যে লাঠি-শড়কি ফালাইয়া ভাইগ্যা যায়।

রোজ ভোর বেলা তিন-চার ঘণ্টা চলে শড়কি চালনা শিক্ষা। আর বিকেল বেলা আলেফ সরদারও মেঘু পালোয়ান তাদের দল নিয়ে লাঠি-শড়কি খেলার প্রতিযোগিতায় নামে। কখনও জঙ্গুরুল্লার দল সেজে একদল আক্রমণ করে, অন্য দল এরফান মাতব্বরের পক্ষ নিয়ে তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে এগিয়ে যায়। মহড়ার সময় ন্যাকড়া দিয়ে বেঁধে দেয়া হয় শড়কির ফলা।

চাকরিয়ারা মাথাপিছু এক টাকা হিসেবে রোজানা পায়। তাদের সরদার দু’জন পায় দু’টাকা করে। এর ওপর আবার মাগনা খোরাক দুবেলা। কম করে খেলেও আধা সের চালের ভাত খায় এক-এক জনে এক-এক বেলা।

চাকরিয়া এসেছে আজ বিশ দিন। এ ক’দিনে দেড় হাজার টাকার ওপর খরচ হয়ে গেছে এরফান মাতব্বরের। আরো কতদিন রাখতে হবে চাকরিয়াদের কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। কিন্তু এই হারে খরচ হলে কিছুদিনের মধ্যেই সে ফতুর হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে যা আদায় হয়েছিল সেলামি বাবদ। কোলশরিকদের কাছ থেকেও কিছু আদায় করা যাবে না এখন, আর তা উচিতও নয়। সেলামির টাকাই বহু কষ্টে যোগাড় করেছিল তারা। সে ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি অনেকে।

এই জমিদার আর জমিদারের নায়েবরাই যত নষ্টের গোড়া। মনে মনে গর্জে ওঠে এরফান মাতব্বর। যে এগারো পয়সার মালিকানা দেখায় রায়চৌধুরীরা, সেই জাগাতো আরো অনেক দক্ষিণে, এখনো পানির তলে। ছয়-সাত বচ্ছর আগে ঐখানে চর আছিল্‌।

নিজেগ জাগার নাম-নিশান নাই, এখন আমার চরের বন্দোবস্ত দিছে জঙ্গুরুল্লারে। জমিদার আর ওর নায়েবের পেডের ঝুলি বাইর করন দরকার। যত কাইজ্যা-ফ্যাসাদের মূলে এই জানোয়ারের পয়দারা।

মনের আক্রোশ মনেই চাপা দিয়ে এরফান মাতব্বর জঙ্গুরুল্লার হামলা প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে, কিন্তু এ পর্যন্ত একবারও হানা দেয়ার চেষ্টা করেনি বিপক্ষ দল। দিন দশেক আগে একবার, দিন দুই আগে আরো একবার রাত দুপুরে হৈ-চৈ করে উঠেছিল পাহারারত চাকরিয়ারা, ঐ আইতে আছে, আউগ্‌গারে, আউগ্‌গা…আউগ্‌গা…

মারমার করে এগিয়ে গিয়েছিল দলের সবাই। ফজল নদীর কিনারায় গিয়ে পাহারাওলাদের কাছে শোনে–অনেকগুলো নৌকা এদিকে আসছিল। এদিকের হাঁক-ডাক কুদা-কুদি শুনে ভেগে গেছে।

ফজল টর্চের আলো ফেলে।

চাকরিয়াদের একজন বলে, এহন কি আর দেহা যাইব? এতক্ষণে চইল্যা গেছে কোন মুলুকে!

মাতব্বর পুরানো ঘাগু। সে জানে, এ সব কিছু নয়। চাকরিয়াদের চাকরি বজায় রাখার ফন্দি আর কি। কিন্তু জেনেও সে বলে না এ কথা কাউকে। বললে শেষে হয়তো যেদিন সত্যি সত্যি বাঘ আসবে সেদিন রাখালকে বাঁচাবার জন্য আর এগিয়ে আসবে না কেউ।

হুড়মুড় করে চলে যাচ্ছে টাকা। প্রায় শ’খানেক টাকা খরচ হয় রোজ। দিন যত যাচ্ছে, তহবিলের টাকাও কমে আসছে তত। আর এ ভাবে খরচ করা উচিত নয়, ভাবে এরফান মাতব্বর। আলেফ সরদার ও মেঘু পালোয়ানের সাথে পরামর্শ করে সে দুই দল থেকে বেছে মাত্র দশজন রেখে বাকি সবাইকে বিদেয় করে দেয়। আলেফ ও মেঘুর ‘রোজানা’ দুটাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয় তিন টাকা।

.

১২.    

পান্‌সি তৈরি শেষ হয়েছে। ওটায় গাবও লাগানো হয়েছে তিন পোচ। এখন পানিতে ভাসিয়ে এতে পাটাতন বসাতে হবে, ছই লাগাতে হবে।

বুধবার জোহরের নামাজ পড়ে নৌকা ভাসানো হবে। শুভ দিন-ক্ষণ ঠিক করে রেখেছে এরফান মাতব্বর। কিন্তু বুধবার আসার তিন দিন আগেই তার জ্বর হয়। বাড়ি গিয়ে সে বিছানা নেয়।

শুভ দিন-ক্ষণ যখন ধার্য করা হয়েছে তখন ঐ দিন ঐ ক্ষণেই নৌকা ভাসানো হবে– ফজলকে খবর পাঠায় এরফান মাতব্বর। গাবুর একাব্বর খবরের সাথে নিয়ে আসে তিনটে ধামা ভরে খই আর সের কয়েক বাতাসা।

পাহারারত কয়েকজন ছাড়া আর সবাই জমায়েত হয়েছে নৌকা ঠেলবার জন্য।

নৌকার বুকের সামনে মাটিতে পাতালি করে রাখা হয়েছে চারখণ্ড কলাগাছ। একবার কলাগাছের ওপর চড়িয়ে দিতে পারলে নৌকাটা সহজেই গড়িয়ে নেয়া যাবে নদীর দিকে। গায়ে গায়ে মেশামেশি হয়ে নৌকা ধরেছে অনেকে। সবার ধরবার মতো জায়গা নেই। ফজল মাথার ওপর রুমাল নেড়ে হাঁক দেয়, জো-র আ…ছে…এ…এ…?

সকলে : আ….ছে…এ..এ…।

ফজল : এই জোর থাকতে যে জোর না দিব তার জোর নিব ট্যাংরা মাছে…এ..এ… হেঁইও…

সকলে : হেঁইও।

ফজল : মারুক ঠেলা।

সকলে : হেইয়ো।

ফজল : মারুক ঠেলা।

সকলে : হেঁইও…ও…ও…

ফজল : অ্যাই কলাগাছ ফ্যাল সামনে…এ…এ… মোরো ঠেলারে… এ…এ…।

সকলে : হেঁইও, নামছে, নামছে নামছেরে– হেঁইও।

নৌকা নেমে গেছে নদীতে। ফজল ও আরো কয়েকজন বসেছে নৌকায়। পাঁচখানা বৈঠা এগিয়ে দেয় একাব্বর।

সকলে চিলিবিলি করে খই আর বাতাসা ভরে নিজ নিজ গামছায়। একটা ধামায় করে কিছু খই-বাতাসা তুলে দেয়া হয় পানসিতে।

ফজল হাল ধরেছে। চারজন টানছে বৈঠা। নতুন পানসি তরতর করে চলছে পানি কেটে। কিনারায় দাঁড়িয়ে খই-বাতাসা খাচ্ছে সবাই, আর চেয়ে দেখছে নতুন নৌকার চলন দোলন। গড়নে কোনো খুঁত আছে কিনা তাও দেখছে মনোযোগ দিয়ে।

ও মিয়ারা?

ডাক শুনে বাঁ দিকে মাথা ঘোরায় সবাই। উত্তর দিক থেকে উধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে একজন অপরিচিত লোক।

কি কও মিয়া? দৌড়াইতেছ ক্যান? একজন জিজ্ঞেস করে।

দারোগা-পুলিস আইতাছে। লোকটি বলে। অ্যাঁ দারোগা-পুলিস! কই?

ভীত ও বিস্মিত প্রশ্ন সকলের। কারোটা উচ্চারিত হয়, কারোটা ভয়ে লুকিয়ে থাকে মুখের গহ্বরে।

ঐ চাইয়া দ্যাহো।

সবাই উত্তর দিকে তাকায়। সত্যি থানার নৌকা। আরো দুটি নৌকা আসছে ওটার পেছনে পেছনে।

লোকটিকে ছুটে আসতে দেখেই পাড়ের দিকে পানসি ঘুরিয়েছিল ফজল। তাড়াতাড়ি বৈঠা মেরে ফিরে আসে সে। নৌকার থেকে লাফ দিয়ে নেমেই জিজ্ঞেস করে, কি ও, কি কি?

দারোগা-পুলিস আইতাছে, ঐ দ্যাহো চাইয়া।

একই সঙ্গে অনেকগুলো সন্ত্রস্ত কণ্ঠের কোলাহলে শঙ্কিত হয় ফজল। সে থানার নৌকার দিকে চেয়ে অপরিচিত লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, কিয়ের লেইগ্যা আইতে আছে?

কাইল বোলে ডাকাতি অইছে কোনখানে?

হ অইছে এই চরের পশ্চিম দিগে।

গত রাত্রে এশার নামাজের পর ফজল ও তার মাছ ধরার সঙ্গীরা বেড়ের মাছ ধরতে গিয়েছিল। চাকরিয়াদের খাওয়াবার জন্যই শুধু পৌষ মাসের হাড়-কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে মাছ ধরতে যেতে হয় আজকাল। ভাটার সময় তিরতিরে পানির মধ্যে আছাড়-পাছাড় খেয়ে মাছ ধরছিল তারা। এমন সময় শোনা যায় ডাক-চিৎকার, আমারে মাইর‍্যা ফালাইছে রে। ডাকাইত–ডাকাইত। পরে জানা যায় পুব্যের চরের এক গেরস্ত পাট বিক্রি করে লৌহজং থেকে বাড়ি ফিরছিল নৌকায়। একদল ডাকাত তাকে মারধর করে তার পাট-বেচা পাঁচশ’ টাকা নিয়ে গেছে।

অপরিচিত লোকটি বলে, ঐ ডাকাতির আসামি ধরতে আইতে আছে।

আসামি! আসামির খোঁজ পাইছে? ফজল জিজ্ঞেস করে।

হ আপনের নামও আছে। আর কদম শিকারি কার নাম? আরো চৌদ্দ-পনেরো জন।

ফজল শুদ্ধ, বিমূঢ়। চোখে তার শূন্য দৃষ্টি।

মেহের মুনশি লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কে ভাই? কই হোন্‌ছ এই কথা?

আরে মিয়া আমার বাড়ি বাশগাও। ফজল মিয়া তো চিনে না। ওনার বাপ চিনে। তার লগে আমার বাপের গলায় গলায় খাতির আছিল। আইজ চুরির ইজাহার দিতে গেছিলাম থানায়। ফজল মিয়ারে আসামি দেওনের কথা হুইন্যা চিল-সত্বর আইছি দারোগার নাওরে পিছনে ফালাইয়া।

সংবিৎ ফিরে পেতেই ফজল দেখে তার লোকজন এমন কি চাকরিয়ারা পর্যন্ত ভেগে যাচ্ছে। কেউ ভাওর ঘরের দিকে ছুটছে। কেউ ছুটছে কিনারায় বাধা ডিঙিগুলোর দিকে।

রমিজ মিরধা বলে, কি মিয়া খাড়াইয়া রইছ কাঁ? ঐ দ্যাহো আইয়া পড়ল। সে এক রকম ঠেলে নিয়ে চলে ফজলকে।শিগগির নায় ওড।

ভাওর ঘর থেকে হাতিয়ার, বিছানাপত্র নিয়ে দৌড়ে আসে চাকরিয়াদের কেউ কেউ। ফজলের আগেই তারা নতুন পানসিটায় চড়ে বসে।

ফজল বলে, তোমরা ক্যান পলাইতেছ? তোমায় তো ধরতে আসে না।

তোমরা যেমুন পলাইতে শুরু করছ, মনে অয় তোমরাই ডাকাতি করছ। মেহের মুনশি বলে।

আমরা ডাকাতি করছি, কয় কোন হুমুন্দির পুত। আঁঝি মেরে ওঠে আলেফ সরদার।

এই চাকরা, মোখ সামলাইয়া কথা কইস।

দ্যাখ, মোখ দিয়া না, এই শড়কি দিয়া কইমু। আলেফ শড়কি উঁচু করে।

ফজল ধমকি দেয়, এইডা কি শুরু করলেন আপনেরা।

আরে আইয়া পড়ল! শিগগির ওড নায়। রমিজ মিরধা তাড়া দেয়।

ফজল : কেও বাকি নাইতো?

জাবেদ লশকর : আরে না–না। ঐ চাইয়া দ্যাহ্, জমিরদ্দির নায় ওঠছে দশ-বারোজন আর ঐ যে ধলাইর নাও।

মেঘু পালোয়ান : মিয়ারা তোমরা পুলিসের লগে দোস্তালি কর। আমরা নাও ছাইড়া দিলাম।

ফজল ও বাকি আর সবাই পানসিতে ওঠে। পাঁচ বৈঠার টানে ছুটে চলে পানসি।

দূরে মান্দ্রার খড়ির মুখে জড় হয় সব ক’টা নৌকা। গুনতি করে দেখা যায় সবাই পালাতে পেরেছে।

লালুর বাপ বলে, পুলিস আইজ একটা ঠক খাইব। একটা পোনাও পাইব না করে।

একাব্বর ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিল। পুলিসের কথা শুনেই নৌকার ডওরার মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আল্লা-আল্লা করছিল সে। এতক্ষণে তার প্রাণে পানি আসে। সে বলে, নাওডা আরো দূরে লইয়া যাও। পুলিস বন্দুক ছাইড়া দিব।

হো-হো হেসে ওঠে সবাই।

ফজল বলে, ব্যাডা কেমন নিমকহারাম। আমরা ভালোরে বুইল্যা আউগাইয়া গেলাম। আর আমাগ দিল আসামি!

মেঘু পালোয়ান : ঐ যে মাইনষে কয় না, উপকাইরারে বাঘে খায়।

মেহের মুনশি : আমার মনে অয় কেও পরামিশ দিয়া আমাগ নাম লাগাইয়া দিছে। না অইলে ঐ অচিনা ব্যায় নাম পাইল কই?

আলেফ সরদার : দুশমনের কি আকাল আছে? তোমায় চরের কাছে ডাকাতি অইছে, তাই সন্দ করছে, তোমরা ছাড়া আর কে করব এই কাম।

ফজল : আমাগ না অয় সন্দ করছে, আমরা পালাইছি। কিন্তু আপনেরা ক্যান্ পলাইছেন চর খালি থুইয়া?

আলেফ : মিয়া, তোমার একগাছ চুলও পাকে নাই। তাই বোঝতে পার না। দারোগা যহন জিগাইত–ও মিয়া তোমার বাড়ি কই? তহন কি মিছা কথা কইতে পারতাম? ট্যাংরামারির কথা হুইন্যা এক্কেরে তক্ষণ তক্ষণ মাজায় দড়ি লাগাইত। কইত এত দূর তন কি করতে আইছ এইখানে? তোমরাই ডাকাতি করছ।

নৌকার সবাই সায় দেয় তার কথায়। ফজলকেও মেনে নিতে হয় তার যুক্তি।

শীতকালের বেলা তাড়াতাড়ি পালায় শীতের তাড়া খেয়ে। দারোগা-পুলিস চর থেকে চলে যায়। তাদের নৌকা দৃষ্টির আড়াল হতেই মান্দ্রার খাড়ি থেকে বেরোয় সবকটি নৌকা।

মেহের মুনশি বলে, আস্তে আস্তে চালাও। আন্ধার অউক।

চইল্যাতত গেছে। আবার আস্তে আস্তে ক্যান? মেঘু পালোয়ান বলে। দুফরের খাওনডা মাইর গেছে। জলদি চালাও।

হ জলদি চালাও। আলেফ সরদার বলে। প্যাটার মইদ্যে শোল মাছের পোনা কিলবিলাইতে আছে।

তবু ধীরে ধীরে চলছে নৌকা। চরের কাছে পৌঁছতে সন্ধ্যা উতরে যায়।

এই ক্যাডারে? আর আউগ্‌গাইস্ না, খবরদার!

খাইছেরে! সব্বনাশতো অইয়া গেছে!

হায় আল্লা, জঙ্গুরুল্লা চর দখল কইর‍্যা ফালাইছে।

ফজল ও তার লোকজন হতভম্ভ। তাদের নৌকা থেমে গেছে। পানিতে টুপটাপ পড়ছে কিছু। গুলেল বাঁশের গুলি বুঝতে পারে তারা। দু-একটি গুলি তাদের গায়েও এসে লেগেছে।

আকস্মিকতার ঘোর কাটিয়ে ফজল হাঁক দেয়, কারারে তোরা? ভাইগ্যা যা ভালো থাকতে। নইলে জবাই কইর‍্যা ফালাইমু।

আইয়া দ্যাখ কে কারে জবাই করে।

তারপর দুই দলে চলতে থাকে অশ্রাব্য গালাগাল।

ফজল ও মেহের মুনশি জিজ্ঞেস করে আলেফ ও মেঘুকে, কি মিয়ারা, পারবানি লড়তে?

লড়তে পারমু না ক্যান্। কিন্তুক এই রাইতের আন্ধারে কে দুশমন কে আপন চিনা যাইব না। আউলাপাতালি লড়াই করতে গিয়া খামাখা জান খোয়াইতে অইব।

একজন লাঠিয়াল : আমার ঢাল-শড়কি আনতে পারি নাই।

মেঘু : অনেকের কাছেই আতিয়ার নাই। আতিয়ার থুইয়া পলাইছে আহাম্মকরা।

জাবেদ লশকর : তয়তো ওগো মজাই। আমাগ শড়কি দিয়াই আমাগ পেডের ঝুলি বাইর করতে পারব।

প্রত্যেকেই কাঁথা-বালিশ, ঢাল-কাতরা, লাঠি-শড়কি, মাছ ধরার সরঞ্জাম ইত্যাদি কিছু না কিছু হারিয়ে হায়-আফসোস করতে থাকে।

মেহের মুনশি বলে, জঙ্গুরুল্লাতো জবর ফেরেববাজ। দ্যাখছনি ক্যামনে ডাকাতি মামলা দিয়া আমাগ ছাপ্পরছাড়া কইর‍্যা দিল!

হায় হায়রে! এত কষ্ট কইরা ধান রুইছি। লালুর বাপ বলে।

মেঘু পালোয়ান : জঙ্গুরুল্লা কি মরদের মতো কাম করছে নি? হিম্মত থাকলে আইত সামনাসামনি।

জাবেদ : আহ্-হারে কতগুলা জমির ধান। এত কষ্ট কইর‍্যা–

আলেফ : আর হায়-হুঁতাশ কইর‍্যা কি অইব? চলো, মাতবরের কাছে যাই। দেহি উনি কি করতে বুদ্ধি দ্যা।

রমিজ মিরধা: কাইল রাইত পোয়াইলে আহন লাগব। কাইল যদি ওগ তাড়াইতে না পারো তয় ধানের আশা মাডি দিয়া থোও।

ফজল : দেহি, বাজান কি করতে কয়।

নতুন পানসি এরফান মাতব্বরের বাড়ির দিকে রওনা হয়। তার পেছনে সারি বেঁধে চলে ছোট-বড় বাইশখানা ডিঙি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *