০৯. সেই যে প্রায় মাসখানেক পূর্বে

সেই যে প্রায় মাসখানেক পূর্বে পশুপতিবাবু কিশোরকে ত্যাজ্যপুত্র করিবার দৃঢ় সঙ্কল্প জানাইয়া ট্যাক্সি চড়িয়া প্রস্থান করিয়াছিলেন, তারপর হইতেই তাঁহার আর কোন সংবাদ পাওয়া যায় নাই। তিনি যে সত্যিই তাহার সহিত সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করিয়া দিয়া চলিয়া গেলেন, পত্র লিখিয়াও আর সমাচার লইবেন না, ইহা কিশোর অসম্ভব বলিয়াই মনে করিয়াছিল। কিন্তু সপ্তাহকাল অধীরভাবে প্রতীক্ষা করিবার পরও যখন তাঁহার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না, তখন একদিন বিমলাকে লুকাইয়া কিশোর নিজেই পত্র লিখিল। সমস্ত ব্যাপার সবিস্তারে বিবৃত করিয়া বহু মিনতি জানাইয়া লিখিল যে, এ অবস্থায় বিমলাকে ত্যাগ করা শুধু যে নিষ্ঠুরতা হইবে, তাহা নহে, ঘোর অধর্ম হইবে; এবং মৃতা জননীর শপথ করিয়া লিখিল যে, বিমলার সহিত তাহার সম্পর্ক ভ্রাতা-ভগিনীর ন্যায় নিষ্কলুষ, একথা যেন তিনি অবিশ্বাস না করেন।

সর্বশেষে পত্ৰ সমাপ্ত করিবার সময় লিখিল—এত বলিবার পরও যদি তিনি বিশ্বাস করিতে না চাহেন, বেশ, বিমলাকে তিনি নিজের কাছে লইয়া গিয়া রাখুন; পরমারাধ্যা মাতৃদেবী সর্বদা তাহার। সঙ্গে থাকিবেন, কিশোর তাহার ছায়াও মাড়াইবে না। তাহা হইলে তো আর কোন গোল থাকিবে না?

পত্র পাঠাইয়া দিয়া গত তিন সপ্তাহ ধরিয়া সে উত্তরের অপেক্ষা করিতেছিল। কিশোরের প্রকৃতি স্বভাবতই প্রফুল্ল, দুশ্চিন্তা-ভাবনা সে সহজে ঝাড়িয়া ফেলিতে পারি, কিন্তু তবু পিতার সহিত এই অহেতুক মনোমালিন্য তাহার মনের কোণে গুপ্ত কাঁটার ন্যায় সর্বদাই খচখচ করিতেছিল। ইহার একটা সন্তোষজনক নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাহার মন একদণ্ডের জন্যও সুস্থির হইতে পারিতেছিল না।

সে দিনটা ছিল রবিবার। ভাল করিয়া ঘুম ভাঙিবার পূর্ব হইতেই আজিকার দিবসব্যাপী অনাহত অবকাশের কাল্পনিক চিত্রটা কিশোরের সর্বাঙ্গে যেন তৃপ্তির স্পর্শ বুলাইয়া দিল। সে তাড়াতাড়ি শয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল। কারণ, এমন দিনের একটা দণ্ডও ঘুমাইয়া নষ্ট করা যাইতে পারে না। হাত-মুখ ধুইয়া, ল্যাবরেটরি-ঘরের সব জানালা খুলিয়া দিয়া প্রাতঃকালের নবীন আলোতে সে কাজ করিতে শুরু করিয়া দিল। যথেচ্ছা কাজ করিবার স্বাধীনতাই যে পরম বিশ্রাম, তাহা জানিয়াই যেন এই নিত্য-নৈমিত্তিক কাজেও তাহার শ্রান্তি আসিল না।

ময়লা ন্যাতা জলে নিঙড়াইয়া গৃহস্থের মেয়েরা যেমন ঘরের মেঝে মুছিয়া ফেলেন, আকাশের কালো কালো মেঘগুলাও যেন আকাশটিকে তেমনই মাজিয়া ঘষিয়া পরিষ্কার করিয়া নিজেরা কোথায় সরিয়া গিয়াছিল। এই সদ্যোধৌত প্রফুল্ল প্রভাতটি যে আজিকার মত ছুটির দিনে বিধাতার বিশেষ একটি দান, ইহা কল্পনা করিয়া পরম আনন্দে নিজের মনে শিস দিতে দিতে কিশোর কাজ করিতে লাগিল। তাহার যদি দিব্যদৃষ্টি থাকিত তাহা হইলে দেখিতে পাইত, পাশের বাড়ির একটি মেয়েও এই মধুর প্রভাতের মোহে আকৃষ্ট হইয়া অতি প্রত্যুষে উঠিয়া নিজমনে গুন গুন করিয়া গান গাহিতে গাহিতে সুপ্ত বাড়িময় গৃহকর্ম করিয়া বেড়াইতেছে।

ঘড়িতে আটটা বাজিতেই কিশোরের মন এদিক ওদিক পলাইতে আরম্ভ করিল। একটা পরিচিত কণ্ঠের আহ্বানের জন্য তাহার ইন্দ্রিয়গুলা সতর্ক হইয়া রহিল। রবিবারে সকালবেলাও বিনয়বাবুর। বাড়িতে সভা বসিতে আরম্ভ করিয়াছিল, দীনবন্ধুবাবুও এ সভায় আসিয়া যোগ দিতেন। কিশোর পলাতক মনটাকে ধরিয়া আনিয়া কাজে জুড়িয়া দিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু কিছুতেই মন স্থির থাকিতে চাহিল না।

ওদিকে দীনবন্ধুবাবু বোধ করি কোন কাজে পড়িয়া আসিতে পারিলেন না; সুহাসিনী অন্যমনস্কভাবে দু-তিনবার ড্রয়িংরুমে ঘুরিয়া গিয়া লাইব্রেরি-ঘরে উঁকি মারিয়া দেখিল, বিনয়বাবু কি একটা লেখায় ব্যাপৃত আছেন। আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকিয়া সে তাঁহার পশ্চাতে গিয়া দাঁড়াইল। বিনয়বাবু লক্ষ্য করিলেন না। তখন সে শেলফ হইতে একখানা বই টানিয়া লইয়া গদি-মোড়া চেয়ারে গিয়া বসিল। ক্ষুদ্র একটি নিশ্বাস ফেলিয়া তাহার পাতা উল্টাইতে লাগিল।

সাড়ে আটটা বাজিয়া গেল। কিশোর তখন টেস্ট টিউব ফেলিয়া হাত ধুইয়া ভোয়ালেতে হাত মুছিতে মুছিতে এবার কি করিবে ভাবিতেছে, এমন সময় নীচে সদর দরজার নিকট হইতে ডাকপিয়নের সাড়া আসিল, চিঠি হ্যায়।

চিঠি কিশোরের বড় একটা আসে না, কেই বা লিখিবে? সে সচকিত হইয়া তাড়াতাড়ি নীচে নামিয়া গেল।

দুখানি চিঠি। একখানি হস্তাক্ষর দেখিয়াই চিনিল, তাহার বাবার। চিঠি দুইখানা লইয়া ঘরে ফিরিয়া আসিয়া কিশোর ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিয়া দিল।

তারপর খাম ছিড়িয়া চিঠি বাহির করিয়া পড়িল। পত্রের আরম্ভে কোন সম্বোধন বা শিরোনামা নাই। পত্র এইরূপ,–

তোমার পত্রে যে অসম্ভব স্পর্ধা প্রকাশ পাইয়াছে, তাহা দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছি। তোমার যে এতদুর ধৃষ্টতা হইতে পারে, তাহা তোমার শোচনীয় অধঃপতন দেখিয়াও কল্পনা করিতে পারি নাই। তোমার বিমাতা একটা ভ্ৰষ্টা রমণীর সাহচর্যে বাস করিবেন, এই কদর্য প্রস্তাব করিয়া তুমি আমাকে যে অপমান করিয়াছ, তাহার উত্তরে আমি তোমাকে জানাইতেছি যে, তোমাকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করিলাম; আজ হইতে তোমার সহিত আমার কোন সুবাদ রহিল না। আমার মৃত্যুর পর আমার বিষয়-সম্পত্তিতে তোমার কোন দাবি রহিল না জানিবে। আমার অন্যান্য পুরো বিষয় পাইবে, সেইরূপ উইল করিয়াছি। আশা করি, তাহারা কালে তোমার মত নষ্টচরিত্র গুরুর অবমাননাকারী কুপুত্র হইয়া দাঁড়াইবে না। ভবিষ্যতে আমাকে পত্র লিখিয়া কোন উপরোধ অনুরোধ করিবার চেষ্টা করিও না, পত্র অপঠিত অবস্থায় বিনষ্ট হইবে। ইতি–
পশুপতিনাথ চক্রবর্তী।

পত্র হাতে করিয়া কিশোর স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তিক্ত মনে ভাবিতে লাগিল, ইহা ছাড়া আর কি সে প্রত্যাশা করিয়াছিল? সেদিন সম্মুখে যাহা বলিয়া গিয়াছিলেন, আজ পত্রে তিনি সেই কথারই পুনরুক্তি করিয়াছেন, কোথাও এতটুকু গরমিল নাই। শুধু তিনি যে কিশোরকে ত্যাগ করিতে কতদূর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাহাই যেন পত্রের প্রতি ছত্রে আগুনের মত জ্বলজ্বল করিতেছে। কিশোরের সমস্ত হৃদয় নিঙড়াইয়া দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে এই সত্যটাই বাহির হইয়া আসিল যে, হায় রে, আজ তাহার মা জীবিত নাই, তাই তাহার বাপ তাহাকে বিষয় হইতে বঞ্চিত করিয়া এ পক্ষের সন্তানদের সংস্থান করিতে এত ব্যর্থ যে, একটা সত্যকার অপরাধের জন্য অপেক্ষা করিতে পারিলেন না, মিথ্যা কলঙ্ক লেপন করিয়া তাহাকে লোকসমাজে অস্পৃশ্য করিয়া দিলেন।

চিঠিখানা সে কুচি কুচি করিয়া ছিড়িয়া জানালা গলাইয়া ফেলিয়া দিল। বিমলার চোখে যদি এ চিঠি পড়ে, তবে হীনতা ও অপমানের লজ্জা বাড়িবে বৈ কমিবে না। তাছাড়া নিজের পিতার সম্বন্ধে আর একজনের মনে অশ্রদ্ধার সৃষ্টি করিয়া লাভ কি? এ চিঠির যুক্তিহীন ক্রোধের আড়ালে যে কি স্বার্থান্ধ ক্ষুদ্রতা লুকাইয়া আছে, তাহা বুঝিতে বিমলার এক মুহূর্ত বিলম্ব হইবে না। তখন পিতার লজ্জায় তাহার নিজের মর্যাদাও যে ধূলায় লুটাইয়া পড়িবে।

অন্য চিঠিখানা তুলিয়া লইয়া সে চোখ বুলাইয়া দেখিল, কিন্তু কে লিখিয়াছে সহসা বুঝিতে পারিল না। স্ত্রীলোকের লেখা চিঠি, মীচে স্বাক্ষর হেমাঙ্গিনী দেবী। বিস্মিত হইয়া পাঠ করিতে করিতে তাহার স্মরণ হইল, সেদিন রাত্রে যাঁহার সহিত পরিচয় হইয়া গিয়াছে, ইনি সেই অনুপমের জননী হেমাঙ্গিনী দেবী।

এই সময়ে ঘরের বদ্ধ দ্বারে ঘা পড়িল।

ঠাকুরপো, দোর বন্ধ কেন? চিঠি কোত্থেকে এল?

রবিবারে কলেজের রান্না নাই বলিয়া বিমলা প্রায় বেলা নয়টা পর্যন্ত পূজা-অর্চনায় কাটাইত। এইমাত্র পূজার ঘর হইতে বাহির হইয়া ঝির মুখে চিঠি আসার খবর পাইয়া কিশোরের কাছে খোঁজ লইতে আসিয়াছিল। কিশোরের কাছে চিঠিপত্র যে সাধারণত আসে না, তাহা তাহার অজ্ঞাত ছিল না।

দ্বার খুলিয়া হাতের চিঠিখানা দেখাইয়া কিশোর বলিল, একখানা নেমন্তন্নর চিঠি, হেমাঙ্গিনী দেবী লিখেছেন।

তিনি কে?

অনুপমের মা।

ও, যাঁর কথা সেদিন বলছিলে। তা নেমন্তন্ন কিসের?

কী জানি কিসের নেমন্তন্ন, তা তো কিছু লেখেননি। আর মাত্র একদিনের পরিচয়ে আমাকে নেমন্তন্ন করবার মানেও তো কিছু বুঝতে পারছি না। ছাপানো চিঠি নয়, হাতে লেখা। এই দেখো না।

বিমলা চিঠিখানা হাতে লইয়া দেখিল, ছোট চিঠি, তাহাতে এই কয়টি কথা লেখা আছে,–

বাবা কিশোর,

কাল রবিবার সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে সামান্য একটু চা-পানের আয়োজন করিয়াছি। গুটিকয়েক বন্ধু বান্ধব উপস্থিত থাকিবেন। তুমি আসিতে পারিলে বড়ই আনন্দিত হইব। ইতি–

আশীর্বদিকা
হেমাঙ্গিনী দেবী।

চিঠি ফিরাইয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে বিমলা বলিল, তোমার ওপর এঁর ভারি মায়া পড়ে গেছে দেখছি, একেবারে বাবা কিশোর লিখে ফেলেছেন। একটু সাবধানে থেকো, ঠাকুরপো।

কিশোর বলিল, হুঁ, সেদিন মায়ার ঠেলায় ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। বলিতে বলিতে তাহার মুখখানা মলিন হইয়া গেল। স্মরণ হইল, এই স্ত্রীলোকটিই সেদিন বলিয়াছিলেন যে, তাহার বাবা তাহার পর হইয়া গিয়াছেন। কথাটা তখন তাহার ভাল লাগে নাই।

বিমলা তাহার মুখের ভাব লক্ষ্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, মুখখানা শুকনো শুকনো দেখছি। রাত্রে কি ঘুম ভাল হয়নি?

কিশোর মাথা নাড়িয়া বলিল, না, ঘুম বেশ হয়েছিল, এই মহিলাটির কথা ভেবেই মনটা খারাপ। হয়ে যাচ্ছে। কি জন্যে নিমন্ত্রণ কিছুই জানি না—চা পানও করি না—আমার যাওয়াটা কি উচিত হবে?

বিমলা বলিল, সে কি কথা, যেতে হবে বৈকি! চা না হয় না খাবে। তুমি কুঁড়ে মানুষ, কোথাও যেতে হলেই তোমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে—এক ঐ বাড়ি ছাড়া। বলিয়া অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া জানালার দিকে দেখাইল।

কিশোর কী একটা প্রতিবাদ করিতে যাইতেছিল, বিমলা বাধা দিয়া বলিল, তোমার কৈফিয়ত শোনবার এখন আমার সময় নেই। উনুন জ্বলে যাচ্ছে, রান্না চড়াতে চললুম। বলিয়া হাসিতে হাসিতে প্রস্থান করিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *