০৯. সামাজিক ও তামদুনিক জীবনের আরম্ভ

সামাজিক ও তামদুনিক জীবনের আরম্ভ

আমরা আমাদের কাহিনীর প্রথম বড় অধ্যায়ের শেষাংশে এসে পৌঁছেছি। ইসলামের বিজয় অভিযান ক্ষান্ত হয়েছে। একথা সত্য যে, সাম্রাজ্যের ভিতর সাম্রাজ্যের মৃত্যুর পূর্ব-মুহূর্ত পর্যন্ত অশান্ত যুদ্ধ-বিগ্রহ চলেছে, তথাপি এখন হতে আমাদের কাহিনীর প্রধান বক্তব্য বিষয় হবে যুদ্ধ-বিগ্রহ, জয়-বিজয় ছাড়া অন্য বস্তু ও মুসলিম-সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ভাবের অগ্রগমন, তমদ্দুনের বিকাশ; সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, চারু-শিল্প এবং ভাস্কর্যশিল্পের অভ্যুদয়–আর তলোয়ারের বিজয় যখন খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে ভেঙ্গে পড়ে, তখন বিভিন্ন তমদ্দুনের ব্যাখ্যার মারফত কেমন করে মানুষ তার আধ্যাত্মিক বিজয়ের ক্ষেত্রে চলে যায়, তারই প্রাণদায়িনী বিবরণ।

এ একটি আশ্চর্যের বিষয় যে, খৃস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে দামেস্কের সাধারণ জীবন যাত্রা যেমন ছিল, তা সে শহরের বর্তমান জীবন-যাত্রার চেয়ে বিশেষ ভিন্ন ছিল না। আজকের মত তখনো দামেস্কের সংকীর্ণ রাজপথে দেখা যেত, ফিলা পাজামা, লাল সরু-ঠোঁট জুতা ও বিরাট পাগড়ী পরিহিত পথিকের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে চলেছে মরুভূমির রোদ-পোড়া বেদুঈন–পরনে তার ঢিলা আল-খেল্লা, মাথায় ইকালবদ্ধ রুমাল। মাঝে মাঝে পথে দেখা যায় ইউরোপীয় পোশাক পরিহিত কোন একজন ইন্জী (ফিরিঙ্গী)–আজো ইউরোপীয়রা সবাই ঐ নামেই পরিচিত। এখানে সেখানে মাঝে মাঝে দেখা যায়, দামেস্কের অভিজাত-ঘোড়ার পিঠে সওয়ার’ গায় সাদা রেশমী আবা’, কোমরে ঝুলানো তলোয়ার কিংবা নেজা। শহরে ওরাই ধনীকশ্রেণী। বোরখায় সম্পূর্ণ রকমে ঢাকা দুই-চারটি রমনী রাস্তা পার হয়; অন্যরা চুপে তাদের বাড়ীর পরদাওয়ালা জানালার ফাঁকে ফাঁকে বাজার ও হাওয়া-খাওয়ার ময়দানের দিকে চেয়ে থাকে। রাস্তায় মানুষের হল্লার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শরবত আর হালুয়া বিক্রেতারা প্রাণপণে চীৎকার করে। আবাদী জমির ও মরুভূমির উৎপন্ন শস্য পিঠে বয়ে চলেছে গাধা উটের বহর। শহরের হাওয়া গন্ধ-ভারাক্রান্ত। দুনিয়ায় যত রকম সুগন্ধ আছে, সব ঐ হাওয়ার বুকে বাসা বেঁধেছে।

অন্যান্য শহরের মত দামেস্কেও আরবরা নিজ নিজ কওমের আনুগত্য মোতাবেক স্বতন্ত্র মহল্লায় বাস করত। দামেস্ক, হি, আলেপ্পো ও অন্যান্য। শহরে এই মহল্লাগুলির পার্থক্য আজো সুস্পষ্ট। প্রত্যেক বাড়ীর ফটক পার হলেই সম্মুখে ছিল উঠান। সাধারণতঃ, এসব উঠানের মাঝখানে পানির বড় চৌবাচ্চা থাকত আর চৌবাচ্চার মাঝখানে থাকত ফোয়ারা । ফোয়ারার মুখ হতে হীরক চূর্ণের মত পানির কণা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত। চৌবাচ্চার ধারে হয়তো থাকত একটা কমলালেবুর গাছ। উঠানের চারপাশ ঘিরে ঘরের কামরা সাজানো থাকত। বড় বড় বাড়ীতে এবাদতখানাও থাকত। উমাইয়াদের এ এক অবিনশ্বর গৌরব যে, তাঁরা দামেস্কে পানি সরবরাহের যে ব্যবস্থা করেছিলেন, তার চেয়ে ভাল ব্যবস্থা তকালে সমগ্র প্রাচ্যের আর কোথাও ছিল না। আর সে ব্যবস্থা আজো চালু আছে।

সাম্রাজ্যর সর্বত্র বাসিন্দারা চারটি সামাজিক ভাগে বিভক্ত ছিল। শাসক-শ্ৰেণীর মুসলমানরাই স্বভাবতঃ উচ্চতম শ্রেণীর ছিলেন। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন খলীফার পরিবার ও বিজেতা আরব অভিজাত-গোষ্ঠী। কোথায় এদের সংখ্যা কত ছিল বলা কঠিন। তবে হিস ও দামেস্কে এদের সংখ্যা ছিল ২০ হতে ৪৫ হাজার।

আরব-মুসলমানদের পরবর্তী স্তর-ভুক্ত ছিল নবদীক্ষিত মুসলমানগণ। নীতি হিসেবে এরা ইসলামের সর্বপ্রকার নাগরিক অধিকারের অধিকারী ছিল। উমাইয়া আমলের প্রায় আগা-গোড়াই জমির মালিকরা ধর্মনির্বিশেষে খাজনা দিত। তথাপি সরকারী আয় কমে যাওয়ার একটা নিঃসন্দেহ কারণ ছিল, ইসলামে নব দীক্ষা।

এই নব-দীক্ষিত মুসলমানরাই মুসলিম সমাজের নিম্নতম স্তর-ভুক্ত ছিল। তাদের এ সামাজিক মর্যাদাহীনতার জন্য তারা হামেশাই বিক্ষুব্ধ থাকত। আর এই জন্যই আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই যে, বার বার তারা ইরাকে শীয়া দল ও ইরানে খারেজী দলে যোগদান করেছে এবং তার ফলে ঘটেছে অন্তহীন আত্মকলহ ও রক্তপাত। এদের কেউ কেউ উত্তাপে বালি হয়ে সূর্যের চেয়ে দুঃসহ ছিল। তাদের ধর্মোৎসাহ অনেক সময় ধর্মোন্মাদনায় পরিণত হয়ে অমুসলমানদের উপর অত্যাচারের কারণ হত। প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পরমত-অসহিষ্ণু ছিল, তাদের মধ্যে ইহুদী খৃস্টান ধর্ম হতে ইসলামে দীক্ষিতের দলই বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিল।

মুসলমান সমাজে স্বভাবতঃ এরাই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় এবং চারুশিল্পের অনুশীলনে প্রথম আকৃষ্ট হয়; কারণ, এদেরই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল দীর্ঘতম। এরা মুসলমান আরবদের তুলনায় যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় শ্রেষ্ঠতর স্থান দখল করতে লাগল, তখন তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হল। বিজেতা আরবদের সঙ্গে বিয়ে-শাদী করে তারা আরব রক্তে মিশ্রণ আমদানী করল এবং পরিণামে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে আরব রক্তের পূর্ব বৈশিষ্ট্য আর বজায় রইল না।

তৃতীয় সমাজিক শ্রেণী গঠিত ছিল, সয়ে-নেওয়া-সম্প্রদায়সমূহের দ্বারা যারা প্রত্যাদেশ-প্রাপ্ত ধর্মে বিশ্বাসী ছিল–তথাকথিত ‘জিম্মী’ দল-খৃস্টান, ইহুদী, সেবীয়ান। এদের সঙ্গে মুসলমানরা চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। এই সয়ে-নেওয়া ধর্মের অনুসরণকারীগণকে নিরস্ত্র করে মুসলিম-আশ্রয়ে রক্ষা করা হত এবং এর বিনিময়ে তাদের একটা কর দিতে হত। হযরত মুহম্মদই (সঃ) এ নীতির প্রথম প্রবর্তন করেন। এর এক কারণ ছিল, বাইবেলের প্রতি মহানবীর শ্রদ্ধা এবং অন্য কারণ ছিল, কোন কোন খৃস্টান কওমের অভিজাত-সুলভ আত্মীয়তা।

জিম্মীরা তাদের এই সমাজ-স্তরে ভূমি-কর ও মাথাপিছু কর হতে অনেকাংশে মুক্ত ছিল। কোন মামলায় মুসলমান বিজড়িত না থাকলে দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন-ঘটিত ব্যাপারে তারা কার্যতঃ তাদের ধর্মগুরুর অধীনেই বাস করত। মুসলিম-কানুন এত পবিত্র যে, তাদের প্রতি প্রযুক্ত হতে পারত না। এই আইন-বিধির মৌলিক বংশ তুর্ক-সাম্রাজ্যে জারী ছিল এবং সিরীয় ও ফিলিস্তিনের অছি-জামানাতেও তা মরে যায় নাই, দেখা গেছে।

সমাজের নিম্নতম-স্তরে ছিল গোলাম। অতি প্রাচীনকাল হতে সেমিটিক সমাজে দাস প্রথার চল ছিল। ইসলাম এ প্রথাকে বর্জন করে নাই। ওল্ড টেস্টামেন্ট দাস-প্রথাকে আইনসঙ্গত প্রতিষ্ঠান বলেছে; তবে এ গ্রন্থ দাসদের ভাগ্যকে অনেকখানি উন্নত করেছিল। ধর্মীয় আইন এক মুসলমানের পক্ষে অন্য মুসলমানকে গোলাম করা হারাম করেছে। আর বাইরের কোন গোলাম ইসলাম কবুল করলে তাকে আযাদ করার প্রেরণা দিয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যুদ্ধবন্দীদের মধ্য হতে গোলাম সগ্রহ করা হত। এ যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে নারী এবং শিশুও থাকত। অবশ্য মুক্তি-মূল্য দিয়ে এদের আযাদ করে নেওয়া চলত। বাজারে খরিদ করে, কখনো বা অতর্কিত আক্রমণ দ্বারাও গোলাম সংগৃহীত হত। অল্পকাল মধ্যে দাস-ব্যবসায় মুসলিম-জগতের সর্বত্র জেঁকে উঠল এবং খুব লাভজনক তেজারতিতে পরিণত হল। পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার কতক গোলাম কৃষ্ণকায় ছিল; চীন-তুর্কীস্তানের গোলাম পীতকায় ছিল, নিকট প্রাচ্য কিংবা পূর্ব এবং দক্ষিণ ইউরোপের গোলাম ছিল শ্বেতকায়। স্পেনীয় গোলামদের প্রত্যেকের দাম ছিল হাজার দিনার; তুর্কী গোলামদের প্রত্যেকের দাম ছিল ছয়শ’ দিনার। ইসলামী বিধান মোতাবেক বাদীর গর্ভে গোলাম বা অন্য কারো কিংবা স্বয়ং মনিবের ঔরসজাত সন্তান (যেখানে মনিব সন্তানকে নিজ ঔরসজাত বলে অস্বীকার করত) গোলামরূপেই জন্মগ্রহণ করত। কিন্তু আযাদ নারীর গর্ভে গোলামের ঔরসজাত সন্তান আযাদরূপে ভূমিষ্ঠ হত।

বিস্তীর্ণ বিজয়ের ফলে গোলাম দ্বারা মুসলিম-সাম্রাজ্য কি ভয়াবহরূপে প্লবিত হয়েছিল, পরবর্তী অতিরঞ্জিত হিসেব হতে তার খানিকটা ধারণা পাওয়া যায় : মুসা উত্তর আফ্রিকা হতে ৩ লক্ষ বন্দী নিয়ে আসেন; এর ৬০ হাজার বন্দী তিনি খলীফাকে পাঠিয়ে দেন এবং স্পেনের গথ অভিজাতদের ঘর হতে ৩০ হাজার কুমারীকে বন্দী করেন –তুর্কীস্তানের একজন মুসলিম সেনাপতি একা ১ লক্ষ লোককে বন্দী করেন।

মনিব বাদীকে রক্ষিতা হিসেবে রাখতে পারত, কিন্তু বিয়ে করতে পারত না। এমন মিলনের সন্তানেরা মনিবের সন্তান বলে গণ্য হত; সুতরাং তারা আযাদ হিসেবে জন্মগ্রহণ করত। কিন্তু এতে রক্ষিতার সম্মান কেবল সন্তানের জননী’ পর্যন্তই উন্নীত হত–তাকে মনিব-স্বামী বিক্রি বা দান করতে পারত না এবং স্বামীর মৃত্যুর পর সে আযাদী লাভ করত। ক্রমাগত আন্তঃবিবাহের ফলে আরবজাতির সঙ্গে অনারবৃদের এই যে মিশ্রণ ঘটছিল, এ প্রক্রিয়ায় দাস-ব্যবসায় নিঃসন্দেহরূপে প্রচুর সাহায্য করেছিল।

আমরা আগে বলেছি যে, মরুভূমি হতে আগত আক্রমণকারীরা তাদের সঙ্গে বিজিত দেশে কোন জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য কিংবা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার আনে নাই। উমাইয়াদের জামানা আইয়ামে-জাহেলিয়াতের সন্নিকট ছিল বলে–আর এ জামানায় অসংখ্য যুদ্ধবিগ্রহে মুসলমানরা এত ব্যস্ত ছিল এবং মুসলিম জগতের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা এমন অনিশ্চিত ছিল যে, সে প্রাথমিক যুগে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিকাশের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে নাই। কিন্তু বীজ এই সময়েই বপন করা হয়েছিল এবং পরবর্তী বংশের আমলে বাগদাদে বৃক্ষ ফল-ফুলে পূর্ণ বিকাশ লাভ করেছিল। তার মূল নিঃসন্দেহ রকমে পূর্ববর্তী জামানার গ্রীক, সিরিয়া ও পারস্য সংস্কৃতির মধ্যে নিবদ্ধ ছিল। উমাইয়া জামানা মোটের উপর ডিমে তা দেওয়ার জামানা ছিল।

পারসিক, সিরিয়ান, কাপৃত, বার্বার এবং অন্যান্যদের ইসলাম কবুল এবং আরব রমনীর পানি গ্রহণের ফলে প্রাথমিক যুগে আরব ও অনারবের মধ্যে যে বিভেদ-দেয়াল গড়ে তোলা হয়েছিল, তার ক্রমে ধসে পড়ল। মুসলমানের মধ্যে কে কোন্ জাতি হতে উদ্ভূত, সে প্রশ্ন পেছনে পড়ে গেল। গোড়ায় জাতিতে যে যা-ই থাক না কেন, হযরত মুহম্মদের (সঃ) অনুসরণ করলেই সে আরব জাতি বলে গণ্য হয়ে যেত। অতঃপর কোন মানুষ আদতে সে যে জাতির অন্তর্গতই থাক না কেন, ইসলাম গ্রহণ কলেই এবং আরবী ভাষায় কথাবার্তা বল্লে ও লিখলেই সে আরব হয়ে যেতে পারত। আরব সভ্যতার ইতিহাসের এক বিশিষ্ট লক্ষণ। আরবী ভাষা-ভাষী মানুষ এতকাল ছিল কেবল আরব, এখন সে হয়ে পড়ল আন্তর্জাতিক। কাজেই যখন আমরা বলি আরব চিকিৎসা শাস্ত্র’, ‘আরব দর্শন’, অথবা আরব গণিত, তাতে এ বুঝায় না যে, ঐ আরব চিকিৎসা শাস্ত্র বা দর্শন বা গণিত কেবল আরবদের উপদ্বীপের বাসিন্দাদের সাধনার ফল। তাতে এই বুঝায় যে, ঐ সব জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থগুলি আরবী ভাষায় লিখিত এর লেখকেরা প্রধানতঃ খেলাফতী আমলে আবির্ভূত হয়েছিলেন; সে লেখকেরা ছিলেন পারসিক, সিরিয়াবাসী, মিসরবাসী, আরববাসী, খৃষ্টান, ইহুদী বা মুসলিম এবং তারা তাদের উপকরণের কতকাংশ সগ্রহ করেছিলেন গ্রীক, আরামিয়ান, ইন্দো-পারসিক অথবা অন্য উৎসমূল হতে।

আরবী ভাষা ও ব্যাকরণের বিজ্ঞান-সম্মত অধ্যয়ন শুরু হয় পারস্যের সীমান্ত ভূমিতে এবং প্রধানতঃ বিদেশী নও-মুসলিমরাই এ অধ্যয়ন চালিয়ে যান। নও মুসলিমদের অনেকে কোরআন অধ্যয়ন করতে সরকারী পদে স্থান পেতে এবং বিজেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতেই স্বভাবতই আগ্রহান্বিত ছিল। প্রধানতঃ, এই প্রয়োজন মিটানোর জন্যই উপরোক্ত অধ্যয়নের প্রথম তাগিদ আসে। কথিত আছে, আরবীর আদি ব্যাকরণ রচিত হয় এক খলীফার এই ফরমান অনুসারে যে, শব্দ প্রকারণের তিন ভাগ–বিশেষ্য, ক্রিয়া এবং অব্যয়। আসলে কিন্তু আরবী ব্যাকরণের বিকাশ ঘটে দীর্ঘকালব্যাপী, ধীর গতিতে এবং তার উপর গ্রীক তর্ক-শাস্ত্রের প্রভাব সুস্পষ্ট।

কোরআন অধ্যয়ন এবং তার তফসীরের প্রয়োজন হতে উদ্ভূত হয় শব্দ-তত্ত্ব, অভিধান রচনা এবং মুসলমানদের সেই একান্ত নিজস্ব সাহিত্য-সাধনা হাদীস বিজ্ঞান। হাদীসের শব্দগত মানে বর্ণিত বস্তু, আখ্যান; পরিভাষা হিসেবে এর মানে হচ্ছে, মহানবী বা তার কোন সাহাবীর কোন কাজ বা কথার বিবরণ। কোরআন এবং হাদীসের ভিত্তির উপরই রচিত হয় ধর্ম-তত্ত্ব ও আইন-কানুন। বর্তমান যুগে বিধান-তত্ত্ব (জুরি প্রডেন্স) বলতে যা বুঝায়, ইসলামে আইন তার উপর তত নির্ভরশীল নয়, যত নির্ভরশীল ধর্মের উপর। তালমুড এবং অন্যান্য সূত্রে রোমক আইন নিঃসন্দেহ রকমে উমাইয়াদের আইন প্রণয়নের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল; তবে সে প্রভাবের পরিমাণ নির্ণীত হয় নাই।

অমরা এই যুগে আরব-বিজ্ঞানের আরম্ভ দেখতে পাই। একজন ইহুদী আলেকজান্দ্রিয়ার জনৈক খৃস্টান পাদ্রীর গ্রীক ভাষায় লিখিত একখানি বইয়ের অনুবাদ করেন। আরবী ভাষার চিকিৎসা সম্বন্ধে এই-ই প্রথম পুস্তক চিকিৎসা শাস্ত্রের মত আল-কিমিয়াও পরবর্তীকালে আরব অবদানে বিশেষ পরিপুরি লাভ করে এবং আল-কিমিয়া সংক্রান্ত সাধনাও এই প্রাথমিক যুগেই শুরু হয়।

দামেস্কের দরবারে কবিতা ও সঙ্গীত বিশেষ উন্নতি লাভ করে। অবশ্য সমাজের রক্ষণশীলেরা সঙ্গীতের সমর্থক ছিল না; তারা মনে করত, সুরা পান ও জুয়া খেলার মত গানের আনন্দ-উৎসবকে মহানবী হারাম করে গেছেন। কাব্য রচনার ক্ষেত্রেই উমাইয়াদের আমলে সাংস্কৃতিক প্রগতি সবচেয়ে বেশি সাফল্য লাভ করে। উমাইয়াদের আগের আমল ছিল কঠোর বিজয়ের আমল। আরবরা কবির জাতি হওয়া সত্ত্বেও এ যুগে সে জাতির মধ্যে কোন কবির আবির্ভাব হয় নাই। দুনিয়াদার উমাইয়াদের ক্ষমতাসীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুরার দেবী, গানের দেবী এবং কবিতা দেবীদের সঙ্গে পুরাতন সম্বন্ধ পুনঃস্থাপিত হল। আরবী ভাষায় এই প্রথম প্রেমের কবি পুরোপুরি আত্মপ্রকাশ করল।

মুসলিম আরবদের বেলায় চারু-শিল্প সবচেয়ে বেশি উন্নতি লাভ করে তাদের ধর্মীয় দালান-কোঠা নির্মাণে। মুসলিম স্থপতিবিদ বা তাদের নিযুক্ত লোকেরা দালান-ইমারত নির্মাণের এক নব-পদ্ধতির উদ্ভাবন করে। তাদের নির্মিত দালান-কোঠা একাধারে সরল ও মহিমান্বিত ছিল। পুরাতন নমুনার উপরই এ পদ্ধতির বুনিয়াদ ছিল; কিন্তু তথাপি এ পদ্ধতিতে তাদের নব ধর্মের অন্তর্বাণী যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। এই জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং জাতির সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপিত হওয়ার ফলে যে ইসলামী-সভ্যতার বিকাশ ঘটে, তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস মিলে মুসলমানের মসজিদে। ইসলাম এবং তার প্রতিবেশীদের মধ্যে যে তামন্দুনিক আদান-প্রদান হয়েছে, মসজিদ ছাড়া তার স্পষ্টতর নিদর্শন বোধহয় আর কোথাও নাই।

ইসলামের প্রথম শতাব্দীতে হযরত মুহম্মদের (সঃ) মদীনাস্থ সাদাসিধা মসজিদটিই জামে মসজিদের মূল আদর্শ ছিল। এ মসজিদটি ছিল একটি ছাদহীন খোলা অঙ্গন; তার চারদিকে ছিল রোদে-পোড়া ইটের দেয়াল। রোদ হতে আত্মরক্ষার জন্য মহানবী পরে সংলগ্ন দালান হতে একটি সমতল ছাদ বাড়িয়ে এনে সমস্ত অঙ্গন ঢেকে দেন। এ ছাদ তৈরি ছিল খেজুর পাতা আর কাদায় এবং স্থাপিত ছিল খেজুর গাছের খামের উপর। খেজুর গাছের একটা খণ্ড মাটিতে পুঁতে মেহরাব তৈরি করা হয়; মহানবী তারই উপর দাঁড়িয়ে উপস্থিত সকলকে খোবা দিতেন। পরে খেজুর গাছের এ-খণ্ড তুলে ফেলে সেখানে সিরিয়ার গীর্জার অনুকরণে তিন ধাপ যুক্ত একটি কাঠের মঞ্চ স্থাপিত হয়। সুতরাং জামে মসজিদের জন্য সাধারণভাবে যা দরকার এখানে আমরা তার একটা মোটামুটি পরিচয় পাই–একটি অঙ্গন, মুসুল্লীদের শীতাতপ হতে রক্ষার জন্য খানিকটা ছাদ এবং একটি খোত্বা-মঞ্চ।

পরবর্তীকালে আরবরা পশ্চিত এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং অত্যন্ত উন্নত ভাস্কর্য-শিল্পের পরিচায়ক অগণ্য ভগ্ন ও অভগ্ন দালান-কোঠার অধিকারী হয়। কেবল তা-ই নয়, বিজিত জাতিরা যুগ-যুগান্তর হতে যে জীবন্ত শিল্প-জ্ঞান উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিল, আরবরা তার নিয়ন্ত্রণভার পায়। মুসলমানদের ধর্মীয় প্রয়োজনে এই জ্ঞান প্রযুক্ত হয় এবং তারই ফলে কালক্রমে বিকাশ লাভ করে সেই সুন্দর শিল্প, যাকে কেউ বলে সারাসেনী, কেউ বলে আরবী, কেউ বা বলে মুসলিম আর্ট। মুহম্মদী আর্ট’ শব্দ ব্যবহারে মুসলমানদের আপত্তি আছে। খৃস্টানরা খৃস্টের উপাসনা করে বলে খৃষ্টান; মুসলমানরা হযরত মুহম্মদের (সঃ) উপাসনা করে না; কাজেই তারা মুহম্মদী’ নয়।

বায়তুল মোকাদ্দেস বাইবেলের বহু ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তাছাড়া, হযরত মুহম্মদের (সঃ) মেরাজে যাওয়ার কালে এ স্থান ছিল তার এক মঞ্জিল। এ উভয় কারণে সেই প্রাথমিক যুগেই বায়তুল মোকাদ্দেস মুসলমানদের চোখে পবিত্র হয়ে ওঠে। পৌত্তলিক, ইহুদী, খৃস্টান এবং মুসলিম ঐতিহ্যে পবিত্র এক ভূখণ্ডের উপর ৬৯১ সালে পাথরের গম্বুজ নির্মিত হয়। কথিত আছে, ঐ স্থানেই ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর পুত্র ইসমাইলকে কোরবান করতে চেয়েছিলেন। এই গম্বুজ নির্মাণে সম্পূর্ণ নতুন স্থাপত্য-রীতি অনুসৃত হয় এবং খৃস্টানদের প্রধান গীর্জার চেয়ে সুন্দর করার জন্য এ প্রস্তর-গম্বুজকে এমন অভাবনীয় সুন্দর কারুকার্যে খচিত করা হয় যে, আজ পর্যন্তও তার চেয়ে সুন্দর অমন কিছু আর কোথাও নির্মিত হয়েছে বলে মনে হয় না।

দামেস্কের জামে মসজিদের দিকে চাইলে আরো স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, কিভাবে আরব-সভ্যতার বিকাশ ঘটে। ৭০৫ সালে খলীফা ওলীদ দামেস্কের খৃস্টান গীর্জার স্থান নিয়ে নেন। এ স্থানে আদি যুগে ছিল জুপিটারের মন্দির, খৃস্টানরা এ স্থানকে উৎসর্গ করে সেন্ট জনের নামে। এখানেই খলীফা উমাইয়া মসজিদ নির্মাণ করেন। খৃষ্টানদের গীর্জার কতটুকু মসজিদ নির্মাণকালে সংরক্ষিত হয়েছিল, তা বলা কঠিন। প্রাচীন গীর্জার বুরুজের উপর দক্ষিণের দুটি মিনার স্থাপিত; কিন্তু উত্তরের মিনার ওলীদ নিজে তৈরী করেছিলেন। এই মিনার আলোক-স্তম্ভ হিসেবে ব্যবহৃত হত এবং এরই অনুকরণে সিরিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে বহু মিনার নির্মিত হয়। যে সকল খুঁটি মুসলিম মিনার আজো টিকে আছে, তার মধ্যে এইটিই সবচেয়ে প্রাচীন। এই মসজিদ নির্মাণে ওলীদ পারসিক, গ্রীক এবং ভারতীয় কারিগর মোতায়েন করেন। ইদানীং যে প্রাচীন দলিল-পত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, কিছু কিছু মাল-মসলা ও কারিগর মিসর হতেও আনীত হয়েছিল। উপরে যা বর্ণিত হল এবং পরে যা বর্ণিত হবে, তা থেকে স্পষ্টই প্রমাণিত হবে যে, আরবরা দুনিয়াকে যুদ্ধ-বিদ্যায় তাদের যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জনেরও ক্ষমতা ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *