প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৯. যজমান শব্দের সাক্ষ্য

যজমান শব্দের সাক্ষ্য

নৃতত্বের আলোয় বৈদিক যজ্ঞের উৎস-সন্ধান এবং সমাজতত্বের আলোয় যেগুলির রূপান্তর-নিরূপণ করবার দায়িত্ব সম্যকভাবে পালিত হয়নি বলেই বৈদিক গবেষকদের কাজ আজো অনেকাংশে অসমাপ্ত আছে। আমরা সেদিকে যোগ্য বেদবিদ্‌দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

অবশ্যই আমাদের পক্ষে এখানে সে-আলোচনার সুযোগ বা প্রাসঙ্গিকতা নেই। কেননা আমাদের যুক্তির পক্ষে তা প্রয়োজন নয়। আমাদের যুক্তির পক্ষে এখানে শুধু এটুকু প্ৰতিপন্ন করবার প্রচেষ্টাই পৰ্যাপ্ত যে, বৈদিক সমাজের মতোই বৈদিক অনুষ্ঠানগুলিরও একটা ইতিহাস আছে। উত্তরকালের সাহিত্যে আমরা বৈদিক যজ্ঞের যে-রূপ দেখছি, তাই যজ্ঞের আদিরূপ নয় এবং এই রূপ-পরিবর্তন বলতে শুধুমাত্র এটুকু বোঝায় না যে, কালক্রমে যজ্ঞ অত্যন্ত জটিল ও পল্লবিত হয়েছিল; তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, পরবর্তীকালে যজ্ঞের উদ্দেশ্য এবং চরিত্রও মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের প্রতিপাদ্য হবে, অধ্যাত্মবাদের আবির্ভাব এই মৌলিক পরিবর্তনেরই পরিণাম ।

আমরা প্ৰথমে এ-বিষয়ে যজমান শব্দটির সাক্ষ্য গ্ৰহণ করবো, কেননা এই শব্দটির পিছনে একটা ইতিহাসের ইংগিত আছে। যজমান শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ এবং বাস্তব অর্থের মধ্যে যে-বিরোধ, তা থেকেই ওই ইংগিত পাওয়া যায়।

মনিয়ার উইলিয়াম্‌স্‌(৫৮) বলছেন, যজমান শব্দের অর্থ হলো,

The person paying the cost of a sacrifice, the institutor of a sacrifice who, to perform it, employs a priest or priests, who are often hereditary functionaries in a family), any patron, host, rich man, …

অর্থাৎ, যিনি নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যজ্ঞসম্পাদন করান। দ্রষ্টব্য হলো, যজ্ঞ-সম্পাদনের দায়িত্ব যজ্ঞীয় পুরোহিতদের বা ঋত্বিকদের উপর, যজমান নিজে যজ্ঞকৰ্ম করেন না। যজ্ঞ-ফল কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তারই ; এবং তার হয়ে যজ্ঞ করে দেবার জন্য তিনি ওই পুরোহিতদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দান করেন। এই কারণেই যজমান ধনী ও বিত্তশালী patron, host, rich man

বলাই বাহুল্য, উত্তরকালের সাহিত্যে আমরা যজমান শব্দটিকে এই অর্থেই নিযুক্ত হতে দেখি। উদাহরণ-স্বরূপ আমরা এখানে ছান্দোগ্য-উপনিষদ(৫৯) থেকে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে পারি।

কুরুদেশ শিলাবৃষ্টিতে বিনষ্ট হইলে ঊষন্তি চাক্রায়ণ…অত্যন্ত দুর্দশা প্রাপ্ত হইয়া ইভ্য-গ্রামে বাস করিতেছিলেন।…পরদিবস প্রাতঃকালে ঊষন্তি নিদ্রাত্যাগ করিয়া স্ত্রীকে বলিলেন, “হায়, যদি কিঞ্চিত অন্ন পাইতাম, কিছু অর্থলাভ হইত। ঐ রাজা যজ্ঞ করিবেন; ঋত্বিকগণের সমুদয় কাৰ্য সম্পাদনের জন্য তিনি আমাকে বরণ করিতে পারিতেন”। (জায়া তাঁহাকে পূর্বদিবসের ভূক্তাবশিষ্ট কূল্মাষ দিলেন এবং তাহা ভক্ষণ করিয়া তিনি সেই প্রারব্ধ যজ্ঞে গমন করিলেন এবং ঘোষণা করিলেন যে, ইতিমধ্যে যে-ঋত্বিকগণ যজ্ঞসম্পাদন আরম্ভ করিয়াছেন তাহারা অনধিকারী)।… অনন্তর যজমান তাঁহাকে বলিলেন, “আমি আপনাকে জানিতে ইচ্ছা করি।” ঊষন্তি বলিলেন, “এই সমুদয় ঋত্বিক-কর্মের জন্য আমি সর্বত্র আপনার অন্বেষণ করিয়াছিলাম। আপনার সন্ধান পাই নাই বলিয়াই অন্য সমুদয় লোককে বরণ করিয়াছি। আপনিই আমার সমুদয় ঋত্বিক-কার্যের ভার গ্রহণ করুন”। ঊষন্তি বলিলেন, “তাহাই হউক। এখন ইয়াহ্রাই আমার অনুমতিতে স্তুতিগান করুক। আপনি ইহাদিগকে যে-পরিমাণ অর্থ দিবেন। আমাকেও সেই পরিমাণ অর্থ দিবেন”। যাজমান বলিলেন, “তাহাই হইবে” ।

অবশ্যই, পরবর্তী সাহিত্যে যজমান শব্দটিকে আমরা এই অর্থেই প্ৰযুক্ত হতে দেখি : ঋত্বিকদের তিনি অর্থ দেবেন এবং এই পারিশ্রমিকের বিনিময়েই ঋত্বিকেরা তার হয়ে যজ্ঞ-সম্পাদন করে দেবেন।

কিন্তু আমরা যে-অর্থে বৈদিক যজ্ঞের আদিরূপ বোঝবার চেষ্টা করছি তার সঙ্গে যজমান শব্দের এ-তাৎপর্যের সঙ্গতি নেই। কেননা, যজ্ঞ বলতে আদিতে যদি প্ৰাচীন সমাজের অনুষ্ঠান-নির্ভর উৎপাদন-ক্রিয়াই বুঝিয়ে থাকে, তাহলে তা অনিবাৰ্যভাবেই যৌথকর্মপদ্ধতি হতে বাধ্য। অর্থাৎ, স্বয়ং যজমানের পক্ষে তাতে অংশগ্ৰহণ করা প্ৰয়োজন।

অতএব, যজ্ঞ-প্রসঙ্গে আমাদের কাছে একটি প্ৰধান প্রশ্ন এই হয়েছে যে, উত্তরকালে যজমান শব্দের তাৎপৰ্য যাই হোক না কেন, আদিতে তার স্বতন্ত্র কোনো তাৎপৰ্য ছিলো কিনা; এবং যদি তা থাকে তাহলে সেই স্বতন্ত্র তাৎপর্যের মধ্যে আমরা এমন কোনো ইংগিত পাই কিনা যা থেকে অনুমান করা সম্ভব যে, এককালে স্বয়ং যজমানেও যজ্ঞে অংশগ্ৰহণ করতেন?

এই প্রশ্নের উত্তর পাবার আশায় আমরা প্ৰথম যজমান শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ বিচার করবার চেষ্টা করেছি।

যজ্‌+শানচ্‌=যজমান। এখানে আত্মনেপদ (শানচ্‌) ব্যবহৃত হয়েছে। এবং ব্যাকরণের নিয়ম হলো, ক্রিয়াপদের ফল যখন কর্তার অভিপ্রায় সিদ্ধ করে তখন ধাতুর আত্মনেপদ হয় এবং অতএব, আত্মনেপদ ব্যবহৃত হয় :  “স্বরিতাঞিতঃ কর্ত্রভিপ্ৰায়ে ক্রিয়াফলে”।

তাহলে, বুৎপত্তির দিক থেকে যজমান শব্দের অর্থ হলো, যিনি নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য যজ্ঞকৰ্ম করেন। যজমান শব্দটিকে আমরা বাস্তবভাবে যে-অর্থে নিযুক্ত হতে দেখি তার সঙ্গে এর তফাত কোথায়? সেখানেও যজমানই যজ্ঞফলভোগী; কিন্তু তিনি স্বয়ং যজ্ঞকর্মে অংশ গ্রহণ করছেন না–তার বদলে অর্থব্যয় করে যজ্ঞ-সম্পাদনকারী নিযুক্ত করছেন।

আমরা নিশ্চয়ই আশা করতে পারি যে, ওই বুৎপত্তিগত অর্থের মধ্যেই যজমান শব্দের আদি-তাৎপর্যের পরিচয় পাওয়া যাবে এবং ঋগ্বেদ যেহেতু বৈদিক মানুষদের প্রাচীনতম সাহিত্য-নিদর্শন সেইহেতু ঋগ্বেদে যজমান শব্দের ওই আদি-অর্থে ব্যবহার খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হওয়া উচিত নয়। অতএব আমরা প্রশ্ন তুলেছি, অর্থব্যয় করে ঋত্বিক নিয়োগের পরিবর্তে নিজে যজ্ঞ করছেন—এই অর্থে ঋগ্বেদে যজমান শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায় কি?

এ বা নৃভিরিন্দ্রঃ সুশ্রবস্যা প্রখাদঃ পৃক্ষো অভিমিত্রিণো ভূৎ।
সমৰ্য ইষঃ স্তবতে বিবাচি সত্ৰাকরে যজমানস্য শংসঃ॥
অর্থাৎ,–(ইন্দ্র) কর্মনির্বাহক নবরূপ যজমানগণ কর্তৃক প্রদত্ত হবিযুক্ত অন্ন শোভন অন্নের ইচ্ছায় ভক্ষন করেন; মিত্রযুক্ত যজমানের জন্য বিবিধ কোলাহলযুক্ত সংগ্রামে তাহার প্রশংসা করিয়া মঙ্গলবিধান করেন।। ঋগ্বেদ : ১.১৭৮.৪ ৷৷

দ্রষ্টব্য হলো, যজমান এখানে ব্যক্তিবিশেষ নন; মিত্রযুক্ত ও বহু। তাঁরা নিজেরাই সমবেতভাবে হবিযুক্ত অন্ন প্ৰদান করছেন এবং মঙ্গললাভ করছেন–যজ্ঞ-ফল অভিলাষী কোনো এক যজমানের দ্বারা অর্থবিনিময়ে নিযুক্ত হয়ে ঋত্বিকেরা যজ্ঞ করে দিচ্ছেন না। এই প্রসঙ্গেই মনে রাখা যায় যে, ঋগ্বেদে সাধারণ-হবি বা  common oblation-এর উল্লেখ পাওয়া যায় : “তদিৎ সমানমাশাতে বেনন্ত ন প্ৰ যুচ্ছতঃ ধৃতব্ৰতায় দাশুষে”—তাঁহারা দুইজন (মিত্র ও বরুণ) সেই সাধারণ (হবি) ভক্ষণ করেন, তাঁহারা অভিলাষযুক্ত হইয়া দানশীল ব্রতধারীকে সিদ্ধমনস্কাম করেন (ঋগ্বেদ : ১.২৫.৬)।

ঋগ্বেদে বহুবচনে এবং নিজেরাই যজ্ঞ-সম্পাদনকারী অর্থে যজমান শব্দের ব্যবহার বিরল নয় :

যদিষ্ঠং ত্বা যজমানা হুবেম জ্যোষ্ঠমঙ্গিরসাং
বিপ্র মন্মভির্বিপ্রেভিঃ শুক্র মন্মভিঃ।
পরিজমানমিব দ্যাং হোতারং চর্ষণীনাম্‌।
শোচিষ্কেশং বৃষণং যামিমা বিশঃ প্রাবস্তু ভূতয়ে বিশঃ।।

অর্থাৎ,–যজনীয়দিগের শ্রেষ্ঠ তোমাকে (অগ্নিকে) আমরা যজমানগণ আহ্বান করি,–হে অঙ্গিরাগণের জ্যেষ্ঠ বিপ্র, জ্বালাময় জনন ও মন্ত্রসমূহের দ্বারা, সূর্যের ন্যায় চতুর্দিকে গমনকারী, হে মনুষ্যদিগের মুখপাত্ৰ, তোমাকে সেই স্বর্গে প্রবেশকামী যজমানগণ প্রীত করুক, হে জ্বালাময় কেশযুক্ত (অগ্নি)।। ঋগ্বেদ : ১.১২৭.২।।

ঈলে চ ত্বা যজমানো হবির্ভিরীলে সখিত্বং সুমতিং নিকামঃ।।
অর্থাৎ, –তোমাকে (অগ্নিকে) যজমানগণ হবিসমূহের দ্বারা স্তব করে এবং সুমতির অভিলাষ করিয়া তোমার সখিত্বের জন্য স্তব করে।। ঋগ্বেদ : ৩.১.১৫।।

মা তে হরী বৃষণা বীতপৃষ্ঠা নি রীরমন্‌ যজমানাসো অন্যে।
অত্যায়াহি শশ্বতো বয়ং তে অরং সুতেভিঃ কৃণবাম সোমৈঃ।।
অর্থাৎ, –তোমার (ইন্দ্রের) কোমল পৃষ্ঠযুক্ত অশ্ব দুইটি অন্য যজমানদিগের প্রীতির কারণ যেন না হয়; তাহাদের অতিক্রম করিয়া তুমি আগমন কর, আমরা তোমার রথের অরদণ্ডগুলিকে অভিসূত সোমের দ্বারা মসৃণ করিয়া দিব।। ঋগ্বেদ : ৩.৩৫.৫।।

আসানেভির্ষজমানো মিয়েধৈর্দেবানং জন্ম বসুয়ূর্ব্ববন্দ।।
অর্থাৎ,–যজ্ঞফললাভার্থ উপবিষ্ট ব্যক্তিগণের সহিত যজমান ধনকামনায় দেববৃন্দকে বন্দনা করিয়াছিলেন।। ঋগ্বেদ : ৬.৫১.১২ ৷।

রায়স্পোষং যজমানেষু ধত্তম।।
অর্থাৎ, –(হে ইন্দ্রাবরণ), যজমানদিগের ধন বর্ধিত কর। ঋগ্বেদ : ৮.৫৯.৭ ৷৷

রায়স্পোষং যজমানেষু ধারয়।।
অর্থাৎ,–(হে অগ্নি), যজমানদিগের ধন বর্ধিত কর। ঋগ্বেদ ; ১০.১২২.৮ ৷৷

উত্তরকালের সাহিত্যে যজ্ঞের যে-রূপটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় সেখানে দেখা যায় হবি-প্রদান, সোমসবন প্রভৃতি কাজ যজমান-নিযুক্ত ঋত্বিক-বিশেষেরই দায়িত্ব; যজমানের দায়িত্ব নয়। কিন্তু পুরাকালে এ-জাতীয় কাজ যে-যজমানদেরই ছিলো,–অর্থাৎ, যজমানেরা নিজেরাই যে যজ্ঞে অংশগ্ৰহণ করতেন,–সে-কথা ঋগ্বেদ-রচনার যুগেও বৈদিক ঋষিদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।

শান্তে যজমানঃ হবির্ভিঃ।
অর্থাৎ, –যজমান হবিসমূহদ্বারা শাসন করেন।। ঋগ্বেদ : ১.২৪.১১।।

যজমানায় শিক্ষসি সুন্বতে ভূরি তে বসু।
অর্থাৎ,–(হে ইন্দ্র), তুমি সোমসবনকারী যজমানকে তোমার প্রভৃত ধনসম্পদে শিক্ষা দিয়া থাক।। ঋগ্বেদ : ১.৮১.২।।

ভদ্রা শক্তিঃ যজমানায় সুন্বতে।
অর্থাৎ,–সোমসবনকারী যজমানকে মঙ্গলময় শক্তি ( প্ৰদান করেন ) ।। ঋগ্বেদ : ১.৮৩.৩।।

সুকৃতে সুদানবে বিশ্বেদহ যজমানায় সুন্বতে।
অর্থাৎ,–শোভনকর্মকারী দানশীল সোমসবনকারী যজমানকে…।। ঋগ্বেদ : ১.৯২.৩ ৷৷

পূষন্ননু প্র গা ইহি যজমানস্য সূন্বতঃ অস্মাকং স্তবতামূত।
অর্থাৎ,–হে পুষণ, সোমসবনকারী যজমানের গরুগুলির অনুগমন কর; স্তবকারী আমাদের (গরুগুলির অনুগমন কর)।। ঋগ্বেদ : ৬.৫৪.৬।।

ইন্দ্ৰাগ্নী শৃণুতং হবং যজমানস্য সুন্বতঃ।
অর্থাৎ,–হে ইন্দ্র-অগ্নি, সেবনকারী যজমানদের আহ্বান শ্রবণ কর।। ঋগ্বেদ : ৬.৬০.১৫।।

সুন্বতো বৃধো যজমানস্য সৎপতে
অর্থাৎ,–সোমসবনকারী যজমানের মঙ্গলকারী ও বর্ধক। ঋগ্বেদ : ৮.১২.১৮ ৷৷

ধেনুষ্ট ইন্দ্ৰ সুনৃতা যজমানায় সুন্বতে গামশ্বং পিপ্যুষী দুহে।
অর্থাৎ, –হে ইন্দ্ৰ, তোমার স্তুতিরূপ বাক্য গাভীরূপে, সোমসবনকারী যজমানকে গরু, অশ্ব দোহনদ্বারা সমৃদ্ধ করায়।।ঋগ্বেদ : ৮.১৪.৩।।

অবশ্যই বৈদিক সাহিত্য সুদীর্ঘ যুগের রচনা। আমরা আগেই বলেছি, এক ঋগ্বেদ-সংহিতার প্রাচীনতম ও অর্বাচীনতম অংশের মধ্যে সময়ের ব্যবধান দ্বিসহস্ৰাধিক বছর হতে পারে। অতএব, এই ঋগ্বেদ সংহিতার আগাগোড়াই–সমস্ত ঋকেই–যে একই রকম সমাজবাস্তব প্রতিফলিত হবে, তা কল্পনা করা যুক্তিবিরুদ্ধ। এবং বাস্তবভাবেও দেখা যায় যে, তা নয়। এই ঋগ্বেদ-সংহিতার মধ্যেই চোখে পড়ে, যজ্ঞে যজমানের ভূমিকায় পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে এবং তারই ফলে যজমান শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ও এমন কি অজ্ঞ অভিলাষী-মাত্রে পরিণত হচ্ছে : তখন শুধু যজ্ঞের ফলাটাই তার, কিন্তু যজ্ঞকর্মে তার কোনো অবদান নেই।

এই পরিবর্তনের বিভিন্ন স্তরের পরিচয় দেখা যাক। প্ৰথম স্তরে আমরা দেখতে পাই, যজমানের সঙ্গে স্তোতার একটা পার্থক্য ফুটে উঠছে, যে-পার্থক্যের পরিচয় পূর্বোক্ত ঋকগুলিতে চোখে পড়ে না।

প্ৰ হি ক্ৰতুৎ বৃহথে যং বনুথো রধ্রস্য স্থো যজমানন্য চোদৌ।
অর্থাৎ,–(হে ইন্দ্রসোম), দ্বেষকারীকে উত্তমরূপে হিংসা কর, যজমানের শত্রুর প্রতি প্রেরক হও।। ঋগ্বেদ : ২.৩০.৬।।

শাকী ভব যজমানস্য চোদিতা বিশ্বেত্তা তে সধমাদেষু চাকন।
অর্থাৎ, –(হে ইন্দ্র), শক্তিমান হইয়া তুমি যজ্ঞেযুক্ত যজমানের প্রেরয়িতা হও এবং আমিও যজ্ঞে তোমার সমন্ত কর্ম কীর্তন করিতে অভিলাষী। ঋগ্বেদ : ১.৫১.৮।।

এখানে যজমানের সঙ্গে স্তোতার যে-প্ৰভেদ সুচিত হচ্ছে তাই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা যায়—

আষাম প্রাঞ্চো যজমানমচ্ছ–
অর্থাৎ, –আমরা যজমানের অভিমুখে আসি। ঋগ্বেদ : ৫.৪৫.৫ ৷৷

সুতংভরো যজমানস্য সৎপতির্বিশ্বাসামুধঃ স ধিয়ামুদঞ্চনঃ।
অর্থাৎ,–পুত্রবর্ধনকারী (ব্যক্তি) যজমানের সর্বপ্রকার শোভন ফলের প্রাপয়িতা।। ঋগ্বেদ : ৫.৪৪.১৩।।

……সবিত্রে যজ্ঞং নয় যজমানায় সাধু।।
অর্থাৎ,–(হে অগ্নি) যজমানের পক্ষে সবিতার উদ্দেশ্যে যজকে বহন কর।। ঋগ্বেদ : ৬.১৫.১৬।।

যজমান কীভাবে যজ্ঞকর্মের বাস্তব দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছে তা দেখবার জন্যে ঋগ্বেদের ৪.১৭.১৫ ঋকের সঙ্গে ১.২৪.১১ ঋকের ইংগিতকে তুলনা করা যায়। ১.২৪.১১-র দেখি “শাস্তে যজমানঃ হবির্ভিঃ”–যজমান হবিসমূহদ্বারা শাসন করে; অতএব এখানে যজমান আর হোতা অভিন্ন। অথচ, ৪.১৭.১৫-য় দেখা যায়, “অসিক্‌ন্যাং যজমানো ন হোতা,”–অৰ্থাৎ, অসিক্‌নীতীরে যজমানই যেন হোতা। এখানে ‘ন’ বা ‘যেন’ শব্দটি বিশেষ চিত্তাকর্ষক; এর থেকে অনুমান করা যায় যে, অসিক্‌নীতীরে তখনো হোতা ও যজমানের মধ্যে প্ৰভেদ প্রকট হয়নি, অথচ আলোচ্য ঋকের রচয়িতার অভিজ্ঞতায় তা হয়েছে।

ঋত্বিক এবং যজমানের মধ্যেও প্ৰভেদ ফুটে উঠতে দেখা যায় :

কৃধি রত্নং যজমানায় সুক্রতো ত্বং হি রত্নধা অসি।
আ ন ঋতে শিশীহি বিশ্বম্‌ ঋত্বিজং সুশংসো যশ্চ দক্ষতে।।
অর্থাত,–হে শোভনকর্মযুক্ত (অগ্নি), তুমি রত্নাকর, যজমানকে রত্ন প্রদান কর; আমাদের যজ্ঞে সমস্ত ঋত্বিকগণকে অনুপ্রেরিত কর, যাহাতে শোভন স্তুতি বর্ধিত হয়।। ঋগ্বেদ : ৭.১৬.৬।।

ঋগ্বেদে অধ্বর্যুর উল্লেখও পাওয়া যাচ্ছে এবং যজমানের সঙ্গে তার প্ৰভেদ ঠিক কতোখানি পরিস্ফূট হয়েছে তা বিচার করা দরকার :

শংসাবাধ্বৰ্যো প্ৰতি মে গৃণীহীন্দ্রায় বাহঃ কৃণবাব জূষ্টম।
এদং বহির্যজমানস্য সীদাথা চ ভূদুক্‌থ্যম্‌ ইন্দ্ৰায় শস্তম্।।
অর্থাৎ,–অর্ধ্বযু উদ্দেশ্যে শ্ৰীতিযুক্ত স্তব করিব, আমার সহিত চুক্তিবদ্ধ হও, ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে প্রীতিযুক্ত স্তব করিব, যজমানের এই কুশে উপবেশন কর, ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে উক্‌থ্য প্রশস্ত হউক।। ঋগ্বেদ : ৩.৫৩.৩।।

যজ্ঞকর্মে বাস্তব অংশগ্রহণের দায়িত্ব-মুক্ত হতে হতে শেষ পর্যন্ত যজমান কী ভাবে শুধু নিশ্চেষ্টই নয়, চেতনাহীন ব্যক্তিমাত্রে পরিণত হয়েছিলেন—এই বিষয়টি দেখবার জন্য আমরা এখানে ঋগ্বেদের একটি অর্বাচীনতম ঋক উদ্ধৃত করবো।

যমৃত্বিজো বহুধা কল্পয়ন্তঃ সচেতসো যজ্ঞমিমং বহন্তি।
যো অনূচানো ব্রাহ্মণো যুক্ত আসীৎকা স্বিৎ তত্র যজমানস্য সংবিৎ৷।
অর্থাৎ, –যাঁহাকে বহুরূপে কল্পনা করিয়া ঋত্বিকগণ এই যজ্ঞকে সচেতনভাবে বহন করিয়া থাকেন এবং যিনি বেদবিদ্যাপারঙ্গম ব্ৰাহ্মণদ্বারা যুক্ত (আরাধিত),–সেখানে আর যজমানের চেতনার কী প্রয়োজন?।। ঋগ্বেদ : ৮.৫৮.১।।

এই ঋকটি বালখিল্য সূক্তের অন্তর্গত। অষ্টম মণ্ডলের কয়েকটি সূক্তকে বালখিল্য সূক্ত বলা হয়। অত্যন্ত অর্বাচীন বলেই এগুলির মূল্য কম—সায়ন এগুলির টীকা দেননি। কিন্তু আমন অর্বাচীন বলেই এর সাক্ষ্য আমাদের বর্তমান যুক্তির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ : এখানে যজমানকে যে-ভাবে যজ্ঞ-ব্যাপারে অজ্ঞ ও সম্বিতহীন বলে কল্পনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে পূর্বোক্ত ঋকগুলির তুলনা করলে বোঝা যায় যে, যজমানের ভূমিকায় ইতিমধ্যে অনেক তফাত হয়ে গিয়েছে।

আলোচ্য ঋকটির ব্যাখ্যায় আধুনিক বেদ-বিদ্‌ বলেছেন, “যৎ কর্মনি ঋত্বিগেব সাবধানোহস্তি, তত্ৰ যজমানস্য প্ৰজ্ঞাপাটবেন কিং প্রয়োজনমস্তি? ন কিঞ্চিৎ অপীতি ভাবঃ” ।

 

সংক্ষেপে : যজমান শব্দের ইতিহাস বিশেষ চিত্তাকর্ষক। এর থেকে বৈদিক যজ্ঞের ইতিহাস এবং এমনকি বৈদিক মানুষদের সমাজ-ইতিহাসেরও আভাস পাওয়া যেতে পারে। আমরা অনুমান করবার চেষ্টা করেছি, আদিতে যজ্ঞ বলতে যৌথ-অনুষ্ঠান বোঝাতো। যাঁরা যজ্ঞফলাভিলাষী তাঁরা—যজমানেরা–নিজেরাই যজ্ঞ-কর্মে অংশগ্ৰহণ করতেন। যজমান শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থের মধ্যে এ-ইংগিত পাওয়া যায় এবং ঋগ্বেদের অংশবিশেষে যজমান শব্দের বাস্তব প্রয়োগ এই ইংগিতটিকেই সমর্থন করে। এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য হলো, যজমান শব্দের বহুবচনে প্ৰয়োগ। অতএব এই সাক্ষ্যগুলিকে আমরা বৈদিক মানুষদের সমাজ-জীবনের প্রাক-বিভক্ত পৰ্যায়ের স্মারক বলে সনাক্ত করবার চেষ্টা করেছি। কেননা, প্ৰাক-বিভক্ত পর্যায়ে শ্রম বা উৎপাদন-কর্ম একান্তই যৌথ যদিও অবশ্যই তা জাদু-অনুষ্ঠান বা ritual-এর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। কালক্রমে পৃথিবীর অন্যান্য মানবজাতির মতোই বৈদিক মানুষদেরও প্রাক্‌-বিভক্ত প্রাচীন সমাজ-সংগঠন ভেঙে যায় এবং তারই ফলে যজ্ঞ ও যজমান শব্দের আদি-তাৎপৰ্যও পরিবর্তিত হয়। শেষ পর্যন্ত আমরা দেখি যজমান বলতে একরকম বিত্তশালী ব্যক্তিকেই বোঝানো হচ্ছে–যজ্ঞ বিষয়ে তাঁর নিজের কোনো জ্ঞান বা চেতনার প্রয়োজন নেই, কেননা তিনি যজ্ঞে অংশগ্রহণ করবার দায়িত্ব-মুক্ত—তাঁর হয়ে যজ্ঞ করে দেবার জন্য অর্থব্যয় করে পেশাদার পুরোহিত নিয়োগ করেই তিনি ক্ষান্ত।

তাহলে, যজমান শব্দের ইতিহাস থেকেই অনুমান করা যায় যে, বৈদিক যজ্ঞের আদি-তাৎপৰ্য ও উত্তর-তাৎপৰ্য অভিন্ন নয়—কেননা, যজ্ঞ বলতে এককালে যৌথ-অনুষ্ঠান বোঝাতে যদিও উত্তরকালে তা বোঝায়নি। কিন্তু অতীতের ওই যৌথ-অনুষ্ঠান ঠিক কিসের উদ্দেশ্যে ছিলো? বৈদিক সাহিত্যের অন্যান্য সাক্ষ্য বিচার করে এবার আমরা এই প্রশ্নটির উত্তর অনুসন্ধান করবো।

যজুৰ্বেদ নামটির মধ্যেই একটা অতীতের ইংগিত আছে। যজুঃ+ বেদ। যজুঃ=যজ্‌+লিট্‌ উস্‌–অর্থাৎ যজ্ঞ করিয়াছিল (বহুবচনে)।

যজ্ঞানুষ্ঠান—অর্থাৎ, আদি অকৃত্রিম অর্থে যজ্ঞানুষ্ঠান—অতীদের ঘটনা।

অতীতে, ঠিক কিসের উদ্দেশ্যে, যজ্ঞের অনুষ্ঠান? যজুর্বেদেরই একটি শাখার নাম বিশ্লেষণ করলে এ-প্রশ্নের উত্তর-অন্তত উত্তরের ইংগিত—পাওয়া

অসম্ভব না হতেও পারে। শাখাটির নাম, বাজসনেয়ী সংহিতা। বাজ মানে অন্ন–ঋগ্বেদে এই অর্থে শব্দটির ব্যবহার বারবার পাওয়া যায়। বাজম্‌ অন্নম সনেীতি বর্ধয়তি ইতি বাজ+সন+অচ্=বাজসন। তস্য কৃতি (তৎকৃত গ্ৰন্থ) বাজসন+ ষ্ণেয়= বাজসনেয়।+স্ত্রিয়াং ঙীপ্‌=বাজসনেয়ী। অতএব, এই বাজসনেয়ী নামটির মধ্যেই অন্নবর্ধক-কৌশলের-productive technique-এর-ইংগিত পাওয়া অসম্ভব নয়।

——————-
৫৮. M. Monier-Williams SED—যজমান।
৫৯. ছান্দোগ্য উপনিষদ : প্রথম অধ্যায়, দশম ও একাদশ খণ্ড।