০৯. মন্ত্রণা

নবম পরিচ্ছেদ
মন্ত্রণা

সিংগড়ের প্রাসাদের একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে গোপন মন্ত্রণাসভা বসিয়াছিল। গৌরী, ধনঞ্জয় ও বজ্ৰপাণি গালিচার উপর আসীন ছিলেন, রুদ্ররূপ দ্বারে দাঁড়াইয়া পাহার দিতেছিল। রাত্রি এগারোটা বাজিয়া গিয়াছে; নগরের আমোদ-প্রমোদ রাজার মৃত্যুসংবাদে থামিয়া গিয়াছিল, আবার দ্বিগুণ উৎসাহে আরম্ভ হইয়াছে। দুর হইতে তাহার কলরব কানে আসিতেছে।

বজ্ৰপাণি ললাটের একটা কাল-শিরার উপর সন্তর্পণে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন— বিপদ এই যে, এ নিয়ে বেশী ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে রাজ্যসুদ্ধ এমন একটা সোরগোল পড়ে যাবে যা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। ময়ুর নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য যদি ভিতরের কথাটা ফাঁস করে দেয় তাহলে আমাদের অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে উঠবে। শঙ্কর সিং-এর বদলে অন্য একজনকে রাজা খাড়া করেছি, এমন কী অভিষেক পর্যন্ত করিয়েছি, এই অভিযোগ যদি সে প্রকাশ্য দরবারে আনে— তার সদুত্তর আমাদের পক্ষ থেকে কি আছে?

ধনঞ্জয় জিজ্ঞাসা করিলেন–এ অভিযোগ লোকে বিশ্বাস করবে?

বজ্ৰপাণি বলিলেন— বিশ্বাস না করুক, একটা সন্দেহ তত জন্মাতে পারে। ময়ূরবাহন যে-প্রকৃতির লোক, তার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত সে উদিতকেও ফাঁসিয়ে দিতে পারে, বলতে পারে আসল রাজাকে উদিত শক্তিগড়ে বন্দী করে রেখেছে।

ধনঞ্জয় বলিলেন— ওকথা যদি বলে তাহলে সে নিজের জালে নিজে জড়িয়ে পড়বে, শঙ্করকে গুম করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়বে।

বজ্ৰপাণি বলিলেন— কিন্তু তাতে আমাদের কোনো লাভ হবে কি? বরং শঙ্কর সিং যদিবা এখনো বেঁচে থাকেন, তাঁর প্রাণ সংশয় হয়ে উঠবে।

গৌরী অজ্ঞাতসারে একটু অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল, হঠাৎ বজ্ৰপাণি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন—এ যে ময়ুরবাহনের কাজ তাতে আপনার কোনো সন্দেহ নেই?

গৌরী বলিল–বিন্দুমাত্র না। সে হাসি ময়ুরবাহনের, একথা আমি হলফ নিয়ে বলতে পারি।

আপনি তাকে চোখে দেখেননি?

না।

এক হাসি ছাড়া আপনার আর কোনো প্রমাণই নেই?

না— কিন্তু–

বজ্ৰপাণি হাত তুলিয়া বলিলেন—জানি। এ যে ময়ূরবাহনের কাজ তাতে আমারও কোনো সংশয় নেই। সে ছাড়া এমন কাজ করবার দুঃসাহস উদিত সিং-এরও নেই। কিন্তু কথা তো তা নয়। ময়ূরবাহনকে শাস্তি দিতে গেলে তার অপরাধ সকলের সামনে সাবুদ করতে হবে। ময়ূরবাহন কি নিজের দোষ স্বীকার করবে ভেবেছেন? বরঞ্চ পঁচিশটা সাক্ষী এনে প্রমাণ করে দেবে যে, ও-সময় সে আর এক জায়গায় ছিল। তখন তার বিরুদ্ধে আমাদের প্রমাণ কি? শুধু ঐ হাসি ছাড়া আর কিছু আছে কি?

ধনঞ্জয় অধীর হইয়া বলিয়া উঠিলেন–কিন্তু এত প্রমাণ খুঁজে বেড়াবারই বা দরকার কি? রাজার হুকুমে যদি আমরা তাকে ধরে এনে কয়েদ করে রাখি কিম্বা যদি কোতল করি, তাহলেই বা কে কি বলতে পারে? প্রজার দণ্ডমুণ্ডের উপর রাজার সম্পূর্ণ অধিকার আছে অন্তত আমাদের দেশে আছে। রাজা আইন মেনে চলতে বাধ্য নয়।

বজ্ৰপাণি ক্লান্ত হাসিয়া বলিলেন–তুমি বুঝছ না ধনঞ্জয়, রাজার দণ্ডমুণ্ডের অধিকার আছে সে আমিও জানি। কিন্তু ময়ূরবাহন একজন সামান্য মজুর বা দোকানদার নয়, সে দেশের একজন। গণ্যমান্য লোক, তার একজন মস্ত মুরুব্বি আছে। রাজা সিংহাসনে বসেই যদি তাকে ধরে এনে বিনা বিচারে কোতল করেন, তাহলে রাজ্যে কি ভীষণ অশান্তির সৃষ্টি হবে–সেটা ভেবে দেখ। উদিত এই নিয়ে দেশের লোককে ক্ষেপিয়ে তুলবে, ইংরেজ গভর্নমেন্টকে এর মধ্যে টেনে আনবে। তার ওপর জাল রাজার কথাটা যদি কোনোক্রমে বেরিয়ে পড়ে তখন ব্যাপারটা কি রকম দাঁড়াবে একবার বুঝে দেখ।

কিছুক্ষণ সকলে নতমুখে নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন, বৃদ্ধ মন্ত্রীর অকাট্য যুক্তিজাল ভেদ করিয়া ময়ূরবাহনকে শাস্তি দিবার কোনো পন্থাই খুঁজিয়া পাইলেন না।

ধনঞ্জয় জিজ্ঞাসা করিলেন–আপনি কি করতে বলেন?

দীর্ঘকাল নীরব থাকিয়া শেষে বজ্ৰপাণি বলিলেন— আজ রাগের মাথায় মরিয়া হয়ে ওরা এই দুঃসাহসিকতার কাজ করে ফেলেছে, তাদের নৌকাখানা ড়ুবে না যেতেও পারত— মাঝি-মাল্লারা ধরা পড়তে পারত, এমন কি স্বয়ং ময়ূরবাহন হাতে হাতে গ্রেপ্তার হতে পারত। সুতরাং এরকম কাজ আর তারা সহজে করবে বলে মনে হয় না। এক ভয় গুপ্তহত্যা— এঁকে গুপ্তভাবে খুন করবার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু সেজন্য আমি ভয় করি না। সতর্ক থাকলে ওদিক থেকে কোনো আশঙ্কা নেই।

গৌরী নড়িয়া চড়িয়া বসিয়া বলিল— রাজা হবার সুখ তো অনেক দেখতে পাচ্ছি।

বজ্ৰপাণি বলিলেন— আমার মতে এখন কিছুদিন চুপচাপ বসে থাকাই একমাত্র যুক্তি। শঙ্কর সিং যে শক্তিগড়ে আছেন এটা আমাদের অনুমান মাত্র— সে-সম্বন্ধে আগে নিঃসংশয় হয়ে তারপর তাঁকে উদ্ধার করবার মতলব ঠিক করা যাক। ইতিমধ্যে ময়ূরবাহনকে যদি কোনো রকমে ফাঁদে ফেলতে পারি কথাটা অসমাপ্ত রাখিয়া তিনি অন্যমনস্কভাবে কপালের স্ফীত স্থানটায় হাত বুলাইতে লাগিলেন।

গৌরী জিজ্ঞাসা করিল— কিন্তু ইতিমধ্যে শঙ্কর সিংকে উদিত যদি খুন করে?

মাথা নাড়িয়া ধনঞ্জয় বলিলেন— তা করবে না। আপনি যে জাল রাজা তার একমাত্র প্রমাণ তাহলে লুপ্ত হয়ে যাবে। উদিত নিজের ভাইকে খুন করে আপনাকে গদিতে বসাবে— এতবড় পাগল সে নয়।

এই সময় বাহিরে পদধ্বনি শুনা গেল। রুদ্ররূপ তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া গেল; দ্বারের বাহিরে কিছুক্ষণ নিম্নস্বরে কথোপকথন হইল, তারপর রুদ্ররূপ ফিরিয়া আসিয়া বলিল— মাঝিমাল্লার কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। নৌকার জন্য ড়ুবুরি নামানো হয়েছিল কিন্তু নৌকা পাওয়া গেল না; খুব সম্ভব কিস্তার স্রোতের টানে তলায় তলায় ভেসে গেছে।

সকলেই নিস্তব্ধ হইয়া সংবাদ শুনিলেন। কিয়ঙ্কাল পরে ধনঞ্জয় একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–হুঁ। ময়ূরবাহনের কপাল ভাল।

প্রাসাদের দেউড়িতে মধ্যরাত্রির ঘন্টা বাজিল। কিন্তু কাহারো কানে তাহা পৌঁছিল না, সকলে নিজ নিজ চিন্তায় নিমগ্ন রহিলেন।

বাহিরে আবার পদশব্দ হইল। এবার পদশব্দ অপেক্ষাকৃত লঘু, অন্দর মহলের দিক হইতে আসিল। রুদ্ররূপ আবার বাহিরে গেল, অল্পকাল পরে ফিরিয়া আসিয়া গৌরীর কানে কানে কি বলিল।

গৌরী চমকিয়া উঠিয়া বলিল–কি! চম্পা আমার জন্যে জেগে বসে আছে! সত্যিই তো, আমি

ঘুমুলে যে সে বেচারীর ঘুমোবার হুকুম নেই! কচি মেয়েটার ওপর কি অত্যাচার দেখ দেখি! না, কালই আমি ওকে ওর বাপের কাছে পাঠিয়ে দেব। এখন তোমরা মন্ত্রণা শেষ কর সদর, আমি চললাম! বলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

ধনঞ্জয়ও উঠিয়া অর্ধপথে একটা হাই নিরুদ্ধ করিয়া বলিলেন–চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে যাই। আজ রাতটাও আমাকে বসেই কাটাতে হবে।

গৌরী বাধা দিয়া বলিল— না না—সর্দার, তুমি ভারি ক্লান্ত হয়েছ, যাও, নিজের বাড়িতে একটু বিশ্রাম করে নাও গে। তোমার বদলে রুদ্ররূপ আমার কাছে থাকবেখন।

ধনঞ্জয় বলিলেন— তা হয় না—আমাকেই থাকতে হবে।

গৌরী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল— আমি হুকুম দিচ্ছি সর্দার, তুমি এই মুহূর্তে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম কর গে, বেলা আটটার আগে বিছানা ছেড়ে উঠবে না। যাও রাজার আদেশ দ্বিরুক্তি করো না।

গৌরী পরিহাসের ভঙ্গিতেই কথাটা বলিল বটে, কিন্তু এই পরিহাসের অন্তরালে যে সত্যকার একটা জোর আছে তাহা ধনঞ্জয়ও অনুভব করিলেন। এই বাঙালী যুবকটিকে তাঁহারা রাজা সাজাইয়াছেন। বটে, কিন্তু ইহার যে একটা অত্যন্ত জোরালো স্বাধীন ইচ্ছা আছে, সকল সময় ইহাকে লইয়া পুতুল-খেলা চলিবে না—তাহার প্রথম ইঙ্গিত পাইয়া ধনঞ্জয় ও ভার্গব দুইজনেই সবিস্ময়ে তাহার দিকে চাহিলেন।

ধনঞ্জয় জিজ্ঞাসুভাবে ভাৰ্গবের দিকে ফিরিতেই তিনি মৃদুস্বরে বলিলেন–উনি ঠিক বলেছেন। তুমি যাও, তোমার বিশ্রাম করা নিতান্ত দরকার। রুদ্ররূপ আজ ওঁর প্রহরীর কাজ করুক।

ধনঞ্জয় গৌরীর দিকে ফিরিয়া ফৌজী স্যালুট করিয়া বলিলেন-যো হুকুম! তাহার চোখের দৃষ্টিতে যদি বা একটু শ্লেষের আভাস প্রকাশ পাইল, কণ্ঠস্বরে তাহার লেশমাত্র ধরা পড়িল না।

গৌরী একটু হাসিল, তারপর রুদ্ররূপের স্কন্ধে হাত রাখিয়া ঘর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

.

সিংগড়ের রাজপ্রাসাদে যখন এইরূপ মন্ত্রণা শেষ হইতেছিল, বেতপুরের রাজ-অন্তঃপুরেও একটি শয়নকক্ষে তখন সখীতে-সখীতে গোপন মন্ত্রণা চলিতেছিল। মন্ত্রণা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। শয়নকক্ষের নিভৃত নির্জনতায় দুইটি অন্তরঙ্গ সখীতে যে-সকল মনের কথা হয়, তাহা সাধারণের শ্রোতব্য নয়। শুধু সত্যের অনুরোধেই তাহা প্রকাশ করিতে হইতেছে।

কস্তুরীর শয়নকক্ষ হইতে অনেক রাত্রে নিদ্রালু সখীরা একে একে প্রস্থান করিলে পর কৃষ্ণা বলিল—এবার ঘুমোও। আলো নিবিয়ে দিই?

শয়নঘরে দুইটি পালঙ্ক; একটিতে কস্তুরী শয়ন করে, অন্যটিতে প্রিয়সখী কৃষ্ণা। কস্তুরী শুইয়া পড়িয়াছিল, কৃষ্ণা তখনো চুলের বিনুনি খুলিতে খুলিতে ঘরে অলসভাবে ঘুরিতেছিল।

কস্তুরী বলিল— আর একটু থাক! তোর বুঝি ঘুম পাচ্ছে?

কৃষ্ণা একটা হাই গোপন করিয়া বলিল— হ্যাঁ। মৃদু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল— তোমার বুঝি আজ আর চোখে ঘুম নেই?

কস্তুরী কৃষ্ণার দিকে চাহিয়া একটু সলজ্জ হাসিল।

কৃষ্ণা নিজের পালঙ্কে গিয়া বসিল, বলিল— কি ভাবা হচ্ছে জানতে পারি কি?

কিছু না। তুই খানিক আমার কাছে এসে শো।

কৃষ্ণা চোখে দুষ্টামি ভরিয়া বলিল-এরি মধ্যে একলা শুতে ভাল লাগছে না?

দূর হ পোড়ারমুখি!

দূর তো হবই। তখন কি আর আমাকে ঘরে ঢুকতে দেবে?

তুই না হয় তখন বিজয়লালের ঘরে যাস।

তাই যাব। তুমি চলে গেলে আর কি আমি এ মহলে থাকব ভেবেছ? হঠাৎ কৃষ্ণার দুইচক্ষু অপুর্ণ হইয়া উঠিল।

কস্তুরী দুই হাত বাড়াইয়া বলিল— আয় কৃষ্ণা। —আচ্ছা, আলোটা নিবিয়েই দে।

আলো নিবাইয়া কৃষ্ণা কস্তুরীর পাশে আসিয়া শয়ন করিল। দুই সখী কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল। তারপর কৃষ্ণা বলিল— আচ্ছা, বিয়ের পরও তো তুমি এ বাড়িতে থাকতে পার। তখন তো দুই রাজ্যই এক হয়ে যাবে। তিনি কি তোমাকে এখানে থাকতে দেবেন না?

কস্তুরী জবাব দিল না; কৃষ্ণা আবার নিজমনেই বলিল-না, তা কি করে দেবেন? তাঁকে তো সিংগড়েই থাকতে হবে, আর তোমাকে ছেড়েও তিনি থাকতে পারবেন না। এ বাড়ি তখন শূন্য পড়ে থাকবে।

কৃষ্ণার গলা জড়াইয়া কস্তুরী বলিল—তখন তুই এ মহলে থাকিস। আমি রোজ কিত্তা পার হয়ে তোকে দেখে যাব।

কৃষ্ণা বলিল— তা কি করে হবে? তোমার মালিক যেমন তোমাকে নিজের রাজ্যে নিয়ে যাবেন, আমার মালিকও তো আমাকে নিজের ভাঙা কুঁড়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে পুরবে।

কস্তুরী বলিল—সেই ভাঙা কুঁড়ে ঘরে যাবার জন্যে তোর প্রাণ কি করছে তা যদি না জানতাম, তাহলে কি তোকে আমি ছেড়ে দিতাম কৃষ্ণা? আমার সঙ্গে নিয়ে যেতাম।

দুই সখীতে অনেকক্ষণ নীরবে শুইয়া রহিল। শেষে একটা প্রবল বাষ্পেচ্ছ্বাস দমন করিয়া কৃষ্ণা বলিল— ও-কথা থাক—ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়। আজ কেমন দেখলে বল।

কাকে?

আহা, বুঝতে পারোনি যেন।

কস্তুরী একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল— আগে তুই বল, তোর কেমন লাগল।

আমার আর কেমন লাগালাগি কি? ভাল লাগলেও তুমি তো আর প্রাণ ধরে কাউকে ভাগ দিতে পারবে না।

ভাগ চাস?

চাইলেও অন্যায় হয় না।

কেন?

আমার প্রিয়সখীকে তিনি যে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তার বদলে আমায় কি দিয়েছেন? খালি শাস্তি দেবেন বলে ভয় দেখিয়েছেন।

কস্তুরী ধরা-ধরা গলায় বলিল— তোর সখীকে তোর কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না কৃষ্ণা। এ জন্মে নয়।

এ জন্মে নয়? ঠিক?

ঠিক।

আচ্ছা, আমিও তবে আর কিছু চাই না। আমার সখী আর আমার–কানে কানে–বিজয়লালের কুঁড়ে ঘর যতদিন আমার আছে ততদিন আমি তাদের বদলে স্বর্গও চাইনে।

এবার তবে বল, তোর কেমন লাগল।

কৃষ্ণা অনেকক্ষণ উত্তর দিল না; তারপর আস্তে আস্তে যেন চিন্তা করিতে করিতে বলিল—দেখ, ওঁর নামে অনেক কথাই আমাদের কানে এসেছে। কথাগুলো এতদিন অবিশ্বাস করবার কোনো কারণ হয়নি— রাজপুত্রেরা বেশীর ভাগই তো ঐ রকম হয়ে থাকেন। কিন্তু আজ তাঁকে দেখে মনে। হল, তাঁর সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম তার অধিকাংশই মিথ্যে কথা।

কস্তুরী বলিয়া উঠিল সব মিথ্যে কথা কৃষ্ণা–একটা কথাও সত্যি নয়!

কৃষ্ণা বলিল–হ্যাঁ।–দেখ, এক বিষয়ে আমরা গেরস্তর মেয়েরা রানীদের চেয়ে সুখী–আমরা স্বামীকে পুরোপুরি পাই। তাই, তোমার কথা ভেবে মনকে চোখ ঠারছিলাম বটে, কিন্তু প্রাণে আমার সুখ ছিল না। আজ একটিবার মাত্র এঁকে দেখে আমার প্রাণে শান্তি ফিরে এসেছে; বুঝেছি, আমার এই অনাঘ্রাত ফুলটি সত্যিই মহেশ্বরের পায়ে পড়বে।

কস্তুরী নীরবে উদ্বেলিত হৃদয়ে এই অমৃততুল্য কথা শুনিতে লাগিল। তাহার মনে হইল কৃষ্ণাকে এত মিষ্টি কথা বলিতে সে আর কখনো শুনে নাই। মাটির ঠাকুরকে অভ্যাসমত পূজা করিতে বসিয়া যাহারা অপ্রত্যাশিতভাবে জীবন্ত হৃদয়দেবতাকে সম্মুখে পায় তাহাদের মনের ভাব বুঝি এমনিই হয়।

কৃষ্ণা বলিতে লাগিল—পুরুষ মানুষ মন্দ কি ভাল, তার চোখের চাউনি দেখে ধরা যায়। আজ উনি তোমার দিকে চাইলেন, মনে হল যেন চোখ দিয়ে তোমার আরতি করলেন। যার মনে স্ত্রীলোক সম্বন্ধে লোভ আছে সে অমন করে চাইতে পারে না। সত্যি বলছি, ওঁর সম্বন্ধে কোনো কুৎসাই আর আমার বিশ্বাস হয় না।

অর্ধ রুদ্ধকণ্ঠে কস্তুরী বলিল— আমারও না। যতদিন দেখিনি ততদিন মনে হত হয়তো সত্যি। কিন্তু এখন

এখন আমার সখীর জীবন-যৌবন সফল হল। কবি গেয়েছেন জান তো?—তব যৌবন যব সুপুরুষ সঙ্গ!

অতঃপর দুইজনে বহুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল। শেষে কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করিল– কি ভাবছ?

কস্তুরী থামিয়া থামিয়া বলিল— ভাবছি—একটা কথা।

কি কথা?

বলব না।

লক্ষ্মীটি বল। আমার কাছে মনের কথা লুকোলে কিন্তু ভারি রাগ করব।

কৃষ্ণার বুকে মুখ গুঁজিয়া মৃদু অস্ফুটস্বরে কস্তুরী বলিল— ভাবছি, আবার কবে দেখতে পাব। কৃষ্ণা কলকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল—এখনো যে তিন ঘণ্টা হয়নি–এরি মধ্যে আর না দেখে থাকতে পারছ না?

কস্তুরী বলিল— তুই যে বিজয়লালকে রোজ দেখিস, একদিন যদি ঘোড়ায় চড়ে তোর জানলার সামনে এসে না দাঁড়ায় তাহলে সারাদিন ছটফট করে বেড়াস! সে বুঝি কিছু নয়?

আমার কথা ছেড়ে দাও, আমার বদ অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু তোমার এরি মধ্যে এই! এখনি দেখেছ—আবার এখনি দেখবার জন্য পাগল! তুমি যে শকুন্তলাকেও হার মানালে!

কতটুকুই বা দেখেছি?

কেন, আর একটু বেশী করে দেখে নিলেই পারতে? তখন তো কেবলই পালাই পালাই করছিলে?

ভারি যে লজ্জা করছিল।

তা আমি কি করব— এখন লজ্জার ফল ভোগ কর।

কৃষ্ণা–সত্যি বল, আবার কবে দেখা হবে?

বিয়ের রাত্রে।

কস্তুরী চুপ করিয়া রহিল; কৃষ্ণা তাহার মনের ভাব বুঝিয়া বলিল— অতখানি বুঝি সবুর সইবে? তার আগেই দেখতে হবে?—বেশ, মন্ত্রীমশায়কে বলি তিনি রাজাকে নিমন্ত্রণ করে পাঠান।

দূর। সে কি ভাল হবে?

কেন মন্দই বা কি হবে? তিনি আজ যেভাবে এসেছিলেন তাতে আমরা তাঁকে সমুচিত সংবর্ধনা করতে পারিনি। তাই তাঁকে যদি এবার নিমন্ত্রণ করে আনা হয় তাতে দোষ কি হবে?

কস্তুরী নীরব রহিল দেখিয়া কৃষ্ণা বুঝিল, ইহাও তাহার মনঃপুত নয়, বলিল—এতেও মন উঠছে? তবে কি চাই, খুলে বল না।

কস্তুরী বলিল— আর আমি বলতে পারি না। বুঝেছিস তো।

কি?

তুই একবার দেখা।

কৃষ্ণা হাসিল— অর্থাৎ লুকিয়ে লুকিয়ে—কেউ জানবে না—এই তো?

কস্তুরী মৌন। কৃষ্ণা তখন বলিল—আচ্ছা, তা আর শক্ত কি? শুধু একবারটি দেখা নিয়ে তো কথা? উনি কিস্তায় জলবিহার করতে বেরুবেন তার বন্দোবস্ত করছি তুমি ঘাটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখো। তাহলে হবে তো?

কৃষ্ণা, তুই বড় জ্বালাস!

হুঁ, তার মানে শুধু দেখলে মন ভরবে না, দেখা দেওয়াও চাই। কেমন?

কস্তুরী কৃষ্ণাকে জড়াইয়া ধরিয়া চুপ করিয়া রহিল, কৃষ্ণা বলিল— বুঝেছি। কিন্তু কাজটি তো সহজ নয়। একটু ভাবতে হবে।

তা ভাব না—কে বারণ করেছে?

কিন্তু আজ নয়, ওদিকে সকাল হতে চলল— হুঁশ আছে? এবার ঘুমিয়ে পড়।

কৃষ্ণা উঠিয়া পড়িল, নিজের শয্যায় গিয়া শুইবার উপক্রম করিয়া বলিল— কিন্তু আমার একার বুদ্ধিতে বোধ হয় কুলোবে না—আর একজনের সাহায্য চাই।

কার?

আমার একজন মন্ত্রী আছে–তার।

কস্তুরী হাসিয়া বলিল–তা বেশ ভো, কাল বাড়ি যা না। অনেক দিন তো যাসনি।

কৃষ্ণা বলিল— উঃ কি দরদ। অনুমতি দিতে একটুও দেরি হল না। বলিয়া কৃষ্ণা শুইয়া পড়িল।

একটা কৌতূহল কস্তুরীর মনটাকে চঞ্চল করিয়া তুলিল, সে জিজ্ঞাসা করিল— আচ্ছা কৃষ্ণা, তুই বিজয়লালকে খুব ভালবাসিস?

কেন বল দেখি?

সব সময় তার কথা ভাবিস?

হ্যাঁ।

আচ্ছা, দেখা হলে কি করিস?

হাসি, কথা কই, গল্প করি।

আর—

আর কিচ্ছু না— ঐ পর্যন্ত। একটু থামিয়া বলিল—একদিন শুধু পান দিতে গিয়ে হাতে হাত ঠেকে গিয়েছিল।

সেটি বুঝি মনে গেঁথে রেখেছিস?

কৃষ্ণা চোখ বুজিয়া আবার সেই স্পর্শটা নূতন করিয়া অনুভব করিয়া লইল, বলিল— ইচ্ছে করে মনে গেঁথে রেখেছি তা নয়–ভুলতে পারা যায় না।

কস্তুরী একটা নিশ্বাস ফেলিয়া চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল— আচ্ছা, এবার ঘুমো।

দুজনেই ঘুমাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু ঘুম সহসা আসিল না। দীর্ঘকাল এইভাবে কাটিবার পর কৃষ্ণা একবার জিজ্ঞাসা করিল,–ঘুমোলে?

না। কেন?

একটা কথা ভাবছি।

কি কথা?

তোমাদের দেখা-সাক্ষাৎ আমি ঘটাতে পারি, কিন্তু লোকে জানতে পারলে তোমার নিন্দে হবে।

এইবার কস্তুরীর কণ্ঠে রানীর সতেজ অভিমান প্রকাশ পাইল, সে বলিল–আমার মালিকের সঙ্গে যদি আমি দেখা করি কার কি বলবার আছে? আর, আমার কাজের সমালোচনাই বা করে কে?

এই অসহিষ্ণুতায় কৃষ্ণা অন্ধকারে মুখ টিপিয়া হাসিল, বলিল— তা ঠিক কাল তাহলে আমি বাপের বাড়ি যাব?

হ্যাঁ।

আচ্ছা, আজ তবে আর কথা নয়।

দুই সখী পাশ ফিরিয়া শুইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *