০৯. নো এন্ট্রি

নো এন্ট্রি

রাসবিহারী গুরদোয়ারায় উৎসব। চেতলা সেন্ট্রাল রোডে নো এন্ট্রি।

ট্যাক্সি সদানন্দ রোডে ঢুকে ঘুরপথ দিয়ে ব্রিজে উঠল। ড্রাইভার বলছিল, দেখুন সার। এরকম একটা ইমপর্টেন্ট রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে।

আমি বললাম, ইমপর্ট্যান্ট নয়? সাউথ আর এনটায়ার সাউথ-ওয়েস্ট, আলিপুর, হেস্টিংস, খিদিরপুর, বেহালা–সব কিছুকে তো এই একটা রাস্তাই কানেক্ট করছে।

সার।ব্রিজের ওপর উঠে ড্রাইভার বলল, তাছাড়া একটা ইমপর্টেন্ট শ্মশানও রয়েছে।

হ্যাঁ। মাঝে মাঝে শবপোড়া বা মড়াদাহর গন্ধ নাকে লাগে বটে। মাছির মতো উড়িয়ে দিয়েছি বরাবর। কই, এ প্রশস্ত রাজপথের এই কানেকশনটির কথা তো কোনওদিন ভাবিনি। চুনারের লালুর কথা মনে পড়ল।

 

লোডশেডিং না থাকলে, রাস্তায় নেমেই চারতলার দিকে তাকানো আমার অভ্যাস। যে, আছে, না, নেই। আজ ট্যাক্সি থেকেই দেখতে পেলাম, বাকিটা অন্ধকার, কিন্তু শোবার ঘরে আলো জ্বলছে : অর্থাৎ আছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, আমার মনেও পড়ে গেল, ও, হ্যাঁ, রিডার্স ডাইজেস্টের একটা আর্টিকেলে। মানুষ সারাজীবন যত অ্যাংজাইটিতে ভোগে তার শতকরা ৮০ ভাগের কোনও ভিত্তি নেই। বাকির ৮ ভাগের মধ্যে দুভার্গ্য চেহারা নিতে পারে বটে, কিন্তু ওই ৮ ভাগের শতকরা ৭৫ ভাগ ক্ষেত্রে নেয় না। কার্যত, মানুষের জীবনভর দুশ্চিন্তার শতকরা মাত্র ২ ভাগ নাকি পোটেনশিয়াল। এদিক থেকে সারাজীবন বিপদগ্রস্ত হতে হতে কী হাস্যকর বিপজ্জনকভাবেই না আমরা বেঁচে আছি।

বেল বাজছে না। এই তো কদিন আগেই সারিয়ে দিয়ে গেল। আবার খারাপ হয়েছে। আবার কুমুদ মিস্ত্রিকে ধরে আনা। উঃ, আবার একটা কাজ।

ল্যাচে চাবি ঢোকাতে দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। সেই যথাবিহিত কাঁচশব্দে আজ তার অস্তিত্বের জানান দিল না তো।

দরজা খুলে কমুহূর্ত? দুই-তিন-চার-পাঁচ?

আমি বাইরে থেকে দরজাটা ধীরে টেনে দিলাম,নাকি, আমাকে বাইরে রেখে সেটা নিজেই ওভাবে বন্ধ হয়ে গেল, তা আজ আর বলতে পারব না। এটা নিয়ে আমি পরেও ভেবেছি। সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। পরে এ-টুকু মাত্র বুঝেছি যে, ওই কমুহূর্ত আমার চেতনা খুন হয়ে পড়ে ছিল। নিশ্চিত বন্ধ ছিল হৃৎস্পন্দন। কতক্ষণ আমি তা জানি না। কিন্তু, টেকনিক্যালি আমি ছিলাম মৃত। ততক্ষণ।

হাওয়াতে স্রোতের মতো আরও একটা স্রোতের হাওয়া আছে। ভয়ের। সে হাওয়াও ফুরফুর করে গায়ে এসে লাগে। টের পাওয়া যায়।

তারপর…সেই ভয়াবহ ভয় এসে আমার হাত ধরল।

প্রথমে চুলের গোড়াগুলো ভিজে উঠল। পরমুহূর্তে সারা গা ঘামে জবজবে হয়ে উঠল। তৃতীয় মুহূর্তে, একি, আমি শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে! ঘাম আমার পায়ের পাতা মৌন স্রোতধারায় ভিজিয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এ জমতে লাগল।

এখন আমি কী করব। আমি কি বন্ধ দরজার পাশে এ-ভাবে দাঁড়িয়ে থাকব। নাকি, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাব। আমি ছাদে উঠে যাব কী! আর-একবার দরজা খোলা, খুলে দেখা, সেটা কি আমার পক্ষে ভাল হবে?

মুখোমুখি সামনের ফ্ল্যাটে তালা। ওপরে বা নিচে ২ বা ৬ নং ফ্ল্যাটে গিয়ে বেল টিপব? আমি কি পালাব?

একটা ভাবনারও শেষ পর্যন্ত আমি ভাবতে পারছিলাম না। বাস্তবতা নেই, কোনও গঠন বা চেহারা নেই, এরকম কিছু বিমূর্ত বিপদগ্রস্ততার মধ্যে তারা বারবার জন্ম-মুহূর্তেই মরে যাচ্ছিল।

একসময় দেওয়াল ধরে আমি সিঁড়িতে বসে পড়ছি দেখি। এবং, পরে ভেবে বুঝেছি, সেই বসে পড়তে পড়তেই আমি প্রথম বুঝতে পারি, এখন আমাকে কিছু করতে হবে। কী আমি তা জানি না। কিন্তু আমার কিছু করণীয় থেকে গেছে। এবং, এই মুহূর্ত থেকে তা শুরু করতে হবে। যদি না করি, এবং এখনই, অবশ্যম্ভাবী ধ্বংস আমার সামনে।

ধ্বংস এড়াতে আমি আর-একবার ধ্বংসের দরজা ফাঁক করি।

ডাইনিং স্পেস অন্ধকার।

ডাইনিং টেবিলের পাশে চিত হয়ে দীপ্তি পড়ে আছে। ডালা-খোলা ফ্রিজ থেকে জেনারেটরের হু-হু হাওয়ার সঙ্গে বেরিয়ে এসে মৃত্যুর ঠান্ডা আলো পড়ে রয়েছে ওর মুখে চোখে।

এবার দেখলাম, দীপ্তির নীলাভ মুখের পাশে ফান-মাঞ্চের একটা খালি প্যাকেট পড়ে আছে। পাখা চলছে। হাওয়ায় দু-একটা হলুদ আরশোলা আনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েকটি ওয়েফার্স।

দীপ্তির মাথার নিচে জমাট, স্তব্ধ রক্তস্রোত।

লাল চালচিত্র।

তার গলা কাটা।

ওকে কি একটু আগে আমিই খুন করে যাইনি?

হঠাৎ, আমার দাঁতের পাটি কাপতে শুরু করে কিটকিট করে। দেখলাম, একে থামাবার সাধ্য আমার নেই। আমি খুন করিনি, একথা ভাববার সাধ্য আমার নেই।

খোলা দরজা দিয়ে ফ্রিজের ঠান্ডা হাওয়া ফুরফুর করে আমার গায়ে এসে লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *