০৯. কাজলের মনের গভীরে

নবম পরিচ্ছেদ

কাজলের মনের গভীরে ছন্দপতনের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা আছে। জিনিসটা সে সব সময় ভাষায় প্রকাশ করিয়া বলিতে পারে না। যে জিনিসটার যেমন থাকিলার কথা, যেখানে যে জিনিসটা মানায়, সেখানে তাহা না থাকিলে কাজল ভীষণ অস্বস্তি বোধ করে। অস্বস্তিটাও অদ্ভুত। ব্ল্যাকবোর্ডে খড়ি পিছলাইয়া কিঁ-চ্‌ করিয়া তীক্ষ্ণ শব্দ হয়—তাহা শুনিলে যেমন গা গুলাইয়া ওঠে, অনেকটা তেমনি। সুন্দর কিছুর মধ্যে সামান্যতম ক্ৰটি, তাহার মতে, সমস্ত ব্যাপারটাকে একেবারে মাটি করিয়া দেয়। বাবার সঙ্গে বেড়াইতে গিয়া সুন্দর বিকেলবেলাটায় রেললাইনের পাশে বীভৎস দৃশ্য দেখিয়া সে চমকাইয়া উঠিয়াছিল। এই কারণেই তখন কারণটা বুঝিতে পারে নাই, এখন আবছাভাবে আন্দাজ করিতে পারে। জগতে সমস্ত দিক ব্যাপিয়া এত অতিমানবিক সংগীত বাজিতেছে, তাহার মধ্যে অসুন্দর কিছু মানায় না। সেতার বাজাইতে বাজাইতে ভুল তারে হাত পড়িয়া যাইবার মতো লাগে।

বাবা তাহাকে একখানি ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ কিনিয়া দিয়াছিল। বইখানি শিশুদের জন্য সংক্ষিপ্ত করা। আজ তাহার ইচ্ছা হইল বইখানি নির্জনে কোন জায়গায় বসিয়া পড়িবে। এ জিনিসটা তাহার বাবাকে দেখিয়া শেখা। কোন ভালো বই অপু সাধারণত বাড়ির মধ্যে বসিয়া পড়িত না।

দুপুরে কাজল বাড়ি হইতে বাহির হইয়া সোজা গ্রামের পথ ধরিল। হাতে বইখানা, পকেটে আনা দুই পয়সা-সকালে সুরপতির নিকট হইতে লইয়াছে। পিচের রাস্তা যেখানে দূরের এক মহকুমা শহরের দিকে বাঁকিয়া গিয়াছে, কাজল সেখানে রাস্তা ছাড়িয়া মাঠে নামিল। মাঠে ধান বুনিয়াছেগাছ এখনও খুব লম্বা হয় নাই, কাজলের কোমর বরাবর হইবে। মাঠের মাঝখানে আসিয়া চারিদিকে তাকাইলে ব্যাপারটাকে একটা সবুজ ধাঁধা বলিয়া মনে হয়। সামান্য বাতাসেই মাঠ জুড়িয়া সবুজের ঢেউ শুরু হয়, ভারি ভালো লাগে দেখিতে। একদিক হইতে ঢেউ শুরু হয়, একেবারে অপর প্রান্তে গিয়া শেষ হয়।

মাঠ পার হইয়া সামনে একটা বড়ো বাঁশবন পড়ে। দিনের বেলাতেও তাহার ভিতরটা আধো অন্ধকার থাকে। লম্বা সরু বাঁশপাতা ঝরিয়া ঝরিয়া তলার মাটি একেবারে ঢাকিয়া গিয়াছে। মাঠের উজ্জ্বল আলোক ছাড়িয়া বাঁশবনে ঢুকিলেই মনে হয়, হঠাৎ সন্ধ্যা নামিল। বেশ ঠাণ্ডা জায়গাটা। বাতাসে বাঁশ গাছ দুলিয়া আওয়াজ হইতেছে কট্‌-কট্‌, ক্যাঁ-চ।

বাঁশের গা হইতে কতকগুলি খোলা টানিয়া ছিঁড়িয়া কাজল তাহার উপর বসিল। বই খুলিয়া পড়িতে পড়িতে সে মগ্ন হইয়া যায়। ডেভিডের দুঃখ, ডেভিডের সংগ্রাম করিতে করিতে বড়ো হওয়া, সব তাহার মনে দাগ কাটে। মানুষের জন্য লেখকের সমবেদনার অশ্রু তাহাকে ডিকেনসের প্রতি আকৃষ্ট করে। অন্য কে এমন ভাবে লিখিতে পারিত? অনাদৃত শুষ্কমুখ ডেভিডকে সে যেন স্পষ্ট দেখিতে পায়।

একটা কঞ্চি সামনে বাঁকাভাবে মাটির উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। তাহার উপর হঠাৎ একটুনটুনি আসিয়া বসিল। কাজল তাকাইয়া দেখিতেছে, পাখিটা বসিয়া আছে–ভয় পাইয়া উড়িয়া যাইতেছে না। কঞ্চিটা অল্প অল্প দুলিতেছে।

কাজল অনুভব করিল। তাহার মনে কোনো দুঃখ নাই, গতকাল রেললাইনের ধারে যে ভয়টা হৃৎপিণ্ড চাপিয়া ধরিয়াছিল, তাহাও অদৃশ্য। চারিদিকে শুধু ছায়াছায়া আলো, পাখির ডাক, ঘন বাঁশবনে নিঃকুম দুপুরে বাঁশ দুলিবার শব্দ। আর সবকিছুর সঙ্গে মিলাইয়া রহিয়াছে–ডেভিডের জীবনচিত্র।

বইটি রাখিয়া কাজল চিত হইয়া শুইল। গতকাল বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, মাটি সামান্য ভিজা। উপরে বাঁশপাতা জড়াজড়ি করিয়া একটা সবুজ চাঁদোয়া বানাইয়াছে, তাহার ফাঁক দিয়া আকাশ দেখা যায়। মাটি হইতে সোদা গন্ধ আসিতেছে। আবার বোধহয় বৃষ্টি হইবে-এক সার পিঁপড়া মুখে ডিম লইয়া ছুটিতেছে। বৃষ্টি হইবার আগে পিঁপড়া নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধ্যানে ঘোরে। একটা বাছুর গলায় দড়ি এবং দড়ির প্রান্তে আটকানো খোঁটাসুদ্ধ তাহার সামনে আসিয়া পড়িল। ছোট্ট বাছুরটা, কাহাদের কে জানে–খোঁটা উপড়াইয়া এখানে হাজির হইয়াছে। বাছুরের চোখের শান্ত দৃষ্টি তাহাকে মুগ্ধ করিল। সে হাত বাড়াইয়া ডাকিল–আয়, আয়।

নাক উঁচু করিয়া বাতাসে কী শুঁকিয়া বাছুরটা উলটা পথ ধরিল।

কেমন আরামে তাহার সময় কাটিতেছে। কাজলের একবার দেবেশের কথা মনে পড়িল। সে এখনও মৌপাহাড়িতে তেমনই বন্ধুদের সহ্যিক অকারণে হৈ হৈ কারিয়া কাঁটাইতেছে। একটা বই পড়া নাই, দুদণ্ড একলা বসিয়া চিন্তা করা নাই। এই ছায়ায় বসিয়া বই হাতে সে চিন্তা করিয়া যে আনন্দ পাইতেছে, সে আনন্দের সন্ধান কি সারা জীবনেও উহারা পাইবে?

বিকাল হইয়া আসায় সে বাঁশবাগান ছাড়িয়া গ্রামের ভিতরে চলিল। এক জায়গায় একটা পানাপুকুর টোপাপনায় আচ্ছন্ন হইয়া আছে। পানা সরাইয়া এক কিশোরী থালা মাজিতেছিল। কাজলকে দেখিয়া ত্বরিতপদে তালগাছের গুড়ির তৈয়ারি ঘাট বাহিয়া উপরে উঠিয়া দৌড়াইল। একটা কুকুর, বেশ স্বাস্থ্যবান, তাহার দিকে পুকুরের ওপার হইতে তাকাইয়া আছে। কাজলের মনে হইলআমার কালু বেঁচে থাকলে ঠিক অত বড়ো হত।

কালুর কথা মনে পড়িতে তাহার মন খারাপ হইয়া গেল। কালু মারা যাইবার পরেও তাহার গলার চেনটা উঠানের কাঠচাপার ডালে ঝুলিত।

সামনে একটা খোড়োচালের বাড়ি। কাজল উঠানে দাঁড়াইয়া ডাকিল–শুনছেন?

খাটো ধুতি পরা একজন বাহির হইয়া আসিল।

–কে? কী চাই?

–একটু খাবার জল দেবেন?

লোকটা কাজলকে আপাদমস্তক দেখিয়া বলিল–আমরা কিন্তু মুসলমান।

কাজল বলিল–হোক গে, আপনি দিন জল।

–ওখানে কেন? এই দাওয়ায় এসে বোসো খোকা।

–এই গ্রামে বুঝি সবাই মুসলমান?

লোকটা হাসিয়া বলিল–না, না। সবাই নয়, আমরা কয়েকঘর আছি আর কী?

তাহার পর যেন একটা খুব গোপনীয় কথা হইতেছে, এমনভাবে মুখটা কাজলের কাছে আনিয়া ফিসফিস করিয়া বলিল–মুড়ি খাবে দুটো?

ভাব জমিয়া গেল।

একটু পরেই কাজল দাওয়ায় বসিয়া মুড়ি খাইতে খাইতে গল্প করিতেছে, নাক দিয়া সর্দি ঝরা একটা বাচ্চা পাশে রাখা ডেভিড কপারফিল্ডখানা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছে।

লোকটা বলিল–আর দেবো মুড়ি?

–না, এই অনেক। তোমার নাম কী?

লোকটা নাম বলিবাব আগে গামছায় একবার মুখ মুছিয়া লইল, যেন তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইতেছে।

–আমার নাম আখের আলি।

ভিতর হইতে একটি বৌ আসিয়া তাহার সামনে একটা বাটি নামাইয়া রাখিল। কাজল অবাক হইয়া বলিল–এ কী! দুধ কে খাবে?

বৌটি বলিল–খেয়ে নাও। আমাদের নিজেদের গরুব দুধ, ছিটেফোঁটাও পানি নেই। চিনি দেওয়া আছে, মুড়ি দিয়ে খাও। শুধু মুখে মুড়ি খেতে নেই।

কাজল আখেরকে জিজ্ঞাসা করিল–এ কে?

-আমার বৌ। ওর নাম রাবেয়া।

-এত দুধ খেতে হবে?

আখের আলি বলিল–উপায় নেই, রাবেয়া বিবি যখন ধরেছে, তখন আর–আমাকেই কেবল মোটে আদর যত্ন করে না।

রাবেয়া অনুচ্চ কণ্ঠে বলিল–আঃ!

কাজল ভাবিল, বড়ো হইয়া সে তাহার দেখা মানুষ লইয়া–ইহাদের জীবন লইয়া উপন্যাস লিখিবে ডিকেন্সের মতো। এমন সময় গলায়-খোঁটা সেই বাছুরটা গুটিগুটি আখেরের উঠানে আসিয়া ঢুকিল। আখের বলিল–ওই এতক্ষণে এসেছে। সারাদিন ঘুরে ফিরে এখন আসা হলো। আমি গিয়ে দেখি, বুঝলে, খোটা উপড়ে কোথায় হাওয়া হয়েছে। তারপর আসছে আসছে করে এই এলো

কাজল এক চুমুকে কিছুটা দুধ খাইয়া বলিল–তোমাদের বাছুর?

খাওয়া হইলে আখের কাজলকে লইয়া তাহার পোষা হাঁস মুরগি ইত্যাদি দেখাইল। বলিল–কিছুদিন বাদে এসো, তোমাকে একটা হাঁসের বাচ্চা দেবো।

বইখানি বগলদাবা করিয়া কাজল আবার সেই বাঁশবন পার হইয়া মাঠে পড়িল। সূর্য ড়ুবিয়া গিয়াছে। বাঁশবাগানে ঘন ছায়া। সে যেখানটায় শুইয়াছিল, সেখানে বাঁশের খোলাগুলি এখনও পড়িয়া আছে। ছোটবেলায় নিশ্চিন্দিপুরে এই সময়টায় অন্ধকার বনের মধ্য দিয়া যাইতে ভয় করিত, ভাবিলে এখন হাসি পায়। গা ছমছমে অনুভূতি একটা হয় ঠিকই, তবে তাহা ভূতের ভয় নহে।

বাঁশবনটার মাঝখানে সে হঠাৎ দাঁড়াইয়া গেল। ঘনায়মান অন্ধকারে সে একা। জনপ্ৰাণী নাই কোথাও কোনোদিকে। সন্ধ্যার শব্দহীনতায় বাঁশ দুলিবার শব্দটা আরও স্পষ্ট লাগে।

মাঠের ভিতর দিয়া হাঁটিতে হাঁটিতে কাজল দেখিল, দিগন্তে মেঘ জমিয়া বিদ্যুৎ চমকাইতেছে। মনে অদ্ভুত আনন্দ। আখেরের সহিত সন্ধ্যাটা খুব ভালো কাটিয়াছে। অচেনা অজানা মানুষ কত তাড়াতাড়ি আপন হইয়া যায়। আবার সে এখানে আসিবে।

মাঠের উপরে সেই সন্ধ্যায় তাহার এক অপূর্ব অনুভূতি হইল। বুঝিল, তাহার জীবন অন্যদের বাঁচিবাব প্ৰণালী হইতে একেবারে ভিন্ন রকম। অযথা সে পৃথিবীতে আসে নাই, তাহার একটা কিছু করিবার আছে। দিগন্তের ওই বিদ্যুচ্চমকের মতো সে জীবনের একঘেয়ে আকাশে চমক লাগাইয়া দিয়া যাইবে। উত্তেজনার প্রাবল্যে জোরে জোরে হাঁটিয়া কাজল বাড়ি পৌঁছিয়া গেল।

ঘরে ঢুকিতেই সুরপতি ডাকিয়া বলিলেন-কোথায় ছিলি দাদু?

–বেড়াতে গিয়েছিলাম দাদু, ওই গ্রামের দিকে।

–রাত বিরেতে মাঠে-ঘাটে বেশি থাকিস নে, সাপ-খোপ বেবোয়।

কাজল হাসিয়া জামাকাপড় ছাড়িয়া মুখ ধুইতে গেল। সুরপতি ডাকিয়া বলিলেন—চট করে হাতমুখ ধুয়ে আয়। আজ একটু আলো নিভিয়ে বোস তো। বড়ো চঞ্চল হয়েছিস, তোর মনঃসংযোগ হবে না ইয়ে হবে–

মেঘ আকাশের অনেকখানি ঢাকিয়া ফেলিয়াছে। বাতাস একদম বাহিতেছে না। ঝড় আসিতে পারে।

আঃ! মনে কোনো ভার নাই, মালিন্য নাই। দুপুরের দেখা সেই মাঠের মতো দিগন্তবিস্তৃত সবুজ জীবন।

ঘরে ফিরিয়া হৈমন্তীকে জড়াইয়া ধরিয়া কাজল বলিল–বড় ভালো লাগছে মা, আজ বড়ো ভালো লাগছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *