০৯. এক প্রস্থ ধোঁয়া গেলার পর

এক প্রস্থ ধোঁয়া গেলার পর অলবানি স্ট্রীটের তেতালা এখন কিছু সময়ের জন্যে না মর্তে না সুনীলে। ভিনসেন্ট দৃশ্যতই প্রত্যেকের ওপর বিরক্ত হয়েছে। তার বিরক্তির কারণ, একই সঙ্গে সকলের ভাড়ার তলানিতে এসে ঠেকেছে, সেটা তাকে আগে জানান হয় নি কেন? গ্যাবি, তার বান্ধবী এবং শয্যাসঙ্গিনী, তাকে পর্যন্ত সে একটা লাথি মেরেছে। এমন কিছু প্রচণ্ড লাথি নয়, ইয়াসমিন বাধা দেয়ায় গুরুত্বটা বেশি পেয়ে যায়। ভিনসেন্ট ক্ষণকাল এ ইচ্ছা লালন করে, ইয়াসমিনকেও লাথি মারবে কিনা।

নিমিলীতি চোখে মার্ক গিটার হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিল। খুব অল্পটানেই তার দশা হয়ে যায়। সবার থেকে এমনিতেই সে আলাদা, দশা-র পর তাকে ভিন্নগ্রহের বলে বোধ হয়। ইয়াসমিন তবু তার কাছেই আসে, কাঁধ ঘেষে বসে। অন্য কারো কাছে যাবার প্রশ্ন ওঠে না। গ্যাবি বাথরুমে গিয়ে সেই যে স্নান করছে, বেরুবার নাম নেই। ভিনসেন্ট কুদ্ধ। পিটার। আর কোকো পরস্পর জিহ্বা লেহন করছে সবাইকে অনুপস্থিত গণ্য করে। প্যাম আর জো, দুজনে মুখোমুখি জোড়াসন হয়ে বসে দীর্ঘতর ধ্যানের অভ্যেস করছে।

মার্ক। মার্ক সাড়া দেয় না। দ্বিতীয়বার ডাকতে সে একটা হাত ইয়াসমিনের হাতের ওপর আলতো করে রাখে।

মার্ক, সে কেন লাথি মারিল?

উহা তাহার চুম্বন।

বুঝিতে পারি না।

উহা আদর।

এ কীরূপ আদর? লাথি হয় লাথি। নয়?

হাঁ, লাথি হয় লাথি, চুম্বন হয় চুম্বন এবং ভিনসেন্ট হয় ভিনসেন্ট।

ইয়াসমিন খানিকটা ভীত চোখে দূরে ভিনসেন্টের দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করে। এই ঘণ্টাখানেক আগেও জন্মগ্রহণের যে অনুষ্ঠান হয়ে গেছে, তার সৌন্দর্য আবিষ্কার করে সে মুগ্ধ হয়েছিল। এখন সে মুগ্ধতাবোধে যেমন সূক্ষ্ম একটা চির ধরে যায়, তেমনি ভিনসেন্টও অন্য কোনো বালক বলে মনে হয় তার।

মার্ক, আমি পছন্দ করিতে পারিলাম না।

গাঁজার সরবরাহ পর্যাপ্ত যতক্ষণ, ভিনসেন্ট আকর্ষণীয়। তাহার তুলনায় প্রতিটি ব্যক্তি কর্কশ। গাঁজা ফুরাইল, ভিনসেন্ট ক্রুদ্ধ হইল।

আমি ভিনসেন্টকে তিরস্কার করিব।

না, করিবে না।

কেন?

তুমি অনুতপ্ত হইবে।

কেন? অনুতপ্ত হইব কেন?

এই গৃহ তাহার।

গৃহ তাহার কেন হইবে? এ কীরূপ কথা বল। গৃহ সকল সন্তানের।

অধিকারবোধের পুরাতন ধারণা চলিয়া গিয়া নতুন ধারণা স্থান করিয়া লয়।

স্বীকার করি না।

শূন্যতা যে প্রকৃতি বিরুদ্ধ।

তাহা হউক। গৃহ ভিনসেন্টের হইল কী প্রকারে?

সে এখানে প্রথম দখল লইয়াছিল। তাহারই নিমন্ত্রণে অন্য সকলে আসিল। যাহারা ভিন্ন। গৃহের সন্ধান পায়, তাহারা চলিয়া যায়।

উত্তম করে।

সেখানেও তাহারা অপর কোনো ভিনসেন্টের অধীনস্থ হয়।

সামান্য গাঁজার জন্য ভিনসেন্ট লাথি মারিল। গ্যাবি সহ্য করিল?

গ্যাবি শয্যায় ইহার প্রতিশোধ লইবে।

ইয়াসমিন মনের ভেতরে দ্রুত চিন্তা করে।

মার্ক ধীর লয়ে হেসে উঠে বলে, নারী স্বাধীনতার কালেও নারীর মারাত্মক অস্ত্রটি এখনো শয্যাতেই তাহাদের ব্যবহার করিতে হয়।

ইয়াসমিন জামার একটা বোতাম খোলে, নিজের বুকের ভেতরে একটা হাত ঢুকিয়ে দেয়।

 কী করিতেছ? আমারই ওপর অস্ত্র প্রয়োগ করিবে নাকি? মার্ক কৃত্রিম আঁতকে উঠে বলে।

না, ইহা দ্যাখো।

ইয়াসমিন বুকের ভেতর থেকে সোনার লকেট বের করে। আবুধাবি থেকে তার বাবা এটা আনিয়ে দিয়েছিলেন। খুব ছোট বাঁধানো বইয়ের মতো দেখতে। সোনার ওপর মিনা করা নক্সা। ভেতরে পুরো কোরান শরিফের অনুবীক্ষণে দেখা সম্ভব এত ক্ষুদ্র অনুলিপি।

মার্ক মুগ্ধ হয়ে যায়।

সুন্দর!

ইয়াসমিন চেন ঘুরিয়ে হুকের মুখ বিযুক্ত করে। ঝপ করে হাতের তেলোর ওপর লুটিয়ে পড়ে সোনার চেন লকেট। দূরে ভিনসেন্টের দিকে তাকিয়ে দ্যাখে সে একবার। মার্ক বিস্মিত হয়ে বলে, খুলিলে কেন?

ইহাতে আমার প্রয়োজন নাই।

ইয়াসমিন উঠে গিয়ে ভিনসেন্টকে বলে, এই লও।

ভিনসেন্ট কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে বস্তুটার দিকে, তারপর খপ করে হাতে তুলে নেয়।

ইয়াসমিন বলে, ইহা স্বর্ণ। কোথায় বিক্রয় করিবে জানি না। প্রথম দিনেই কলহ আমি চাই না। আমরা আনন্দ করিব।

ভিনসেন্ট দাঁড়ায়।

হাঁ, তুমি সত্য বলিয়াছ। আমার ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত। আমাকে পূর্বাহ্নে বলিলেই ব্যবস্থা করিতে পারিতাম। যাহা হউক, আমি আসিতেছি।

ভিনসেন্ট দ্রুত ঘর ছেড়ে যায়।

ইয়াসমিন তখন দেয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে।

আমাকে কেহ একটা সিগারেট দিবে?

কোকোর মুখ থেকে মুখ সরিয়ে পিটার বলে, দৈর্ঘ এবং আয়তন সম্পর্কে ধারণা দিলে, বিবেচনা করিতে পারি।

কোকো তার চুল ধরে নিজের মুখের কাছে আবার টেনে আনে। ইয়াসমিনের হঠাৎ ইচ্ছা হয় পিটারকে লাথি মারে। এবং মনে হবার সঙ্গে সঙ্গেই স্মরণ হয়। ভিনসেন্ট যে গ্যাবিকে লাথি মেরেছিল, সেটা আর এখন এতখানি পীড়াদায়ক মনে হয় না। আসলে সে নিজেও জানে না, সকালে এবং দুপুরে দুইপ্রস্থ পায়া নেবার পর সে এবং সকলেই কী ক্ষিপ্রগতি উভচর যুক্তিবোধের জ্যোত্সক্রান্ত প্রান্তরে পৌঁছে গেছে।

ইচ্ছাই বা অপূর্ণ থাকে কেন? ইয়াসমিন উঠে গিয়ে পিটারের পাছায় লাথি কসিয়ে দেয়।

বলে, দৈর্ঘ এবং আয়তন জানিতে চাও বটে। তবে তোমারটা দেখিয়া বিবেচনা করিব, চলিবে কি না।

প্যাম ওদিক থেকে বিরক্তিসূচক শব্দ করে ওঠে, আহ, তোমরা কী লাগাইলে? আমার ধ্যান ভঙ্গ করিয়া দিলে?

জো বলে, ইয়াসমিনের সঙ্গে কে পারিবে? পিটার? শুস।

প্যাম তখন জো-কে নিয়ে পড়ে।

এই তোমার ধ্যান? তুমি সব শুনিতেছিলে। আমি মন্দিরে গিয়া গুরুকে বলিয়া দিব।

ইয়াসমিন হেসে উঠে বলে, কেন? গুরুকে নালিশ দিবে কেন? শয্যায় অস্ত্র প্রয়োগ করিবে। জো সিধা হইবে।

প্যাম তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে আবার ধ্যানে বসে।

মার্ক, আমার ক্ষুধা পাইয়াছে।

সংগীত ছাড়া আপাতত আমার কাছে দ্বিতীয় কোনো আহার্য নাই।

তুমি কি অনাহারে থাকিবে?

হাঁ, অন্য ব্যবস্থা না হইলে, সন্ধ্যাবেলায় চ্যারিং ক্রস যাইব। সেখানে পাদ্রীরা সুপ বিতরণ করিতে প্রত্যহ আইসে।

তোমার কি অর্থ নাই?

ছিল, ফুরাইয়া গিয়াছে। সোমবারে ভাতা তুলিব, তবে খাইব।

ইয়াসমিন নিজের ক্ষিদে সত্ত্বেও মার্কের ক্ষিদের জন্যে কষ্ট পেতে থাকে। ভিনসেন্ট লকেট বেচে সব টাকাই গাঁজায় খরচ করবে, না খাবারও আনবে— সেই সংশয়ে কিছুক্ষণ সে দোলে। প্রার্থনা করে, ভিনসেন্ট যেন কিছু খাদ্য আনে।

গান শুনিবে, ইয়াসমিন? তবে শোন। ক্ষুধাতৃষ্ণা ভুলিয়া যাইবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *