০৮. সে রাতের রাজবাড়ি

অষ্টম পরিচ্ছেদ

সে রাতের রাজবাড়ি অন্যান্য রাতের চাইতে কিছু পৃথক হয়ে উঠলো। অনেক বেশি আলো এবং নোক-চলাচল। পালকি যখন সদর-দরজায়, তখনই আলোগুলো চোখে পড়েছিলো। নয়নতারার। কাছারির বড়ো চত্বরটা পার হয়ে যেতে যেতেই নয়নতারা দেখলো, প্রাসাদের কাছাকাছি হাতিটা বসেছে। তার চোখে পড়লো হাতিটাকে কিছু দূরে রেখে রাজকুমার তার। ঘোড়ায় আর-একটা দরজার দিকে গেলো। হাতির হাওদা থেকে সিঁড়ি বেয়ে বিলেতি পোশাকের একজন নামছে। তাকে সাহায্য করতে, এগিয়ে নিতে বরকন্দাজ ও পরিচারকেরা এগিয়েছে। কিন্তু রূপচাঁদই এদিকে এদিকে বলে তার পালকির আগে আগে ছুটে পালকিটাকে খিলানের তলা দিয়ে অন্দরে নিয়ে গেলো।

নয়নতারা ভাবলো, সত্যি কি তাই হয়, সময় কি নদীর স্রোতের মতো সরে যায়? তা কি ওড়াগের মতো কোনো ব্যক্তিত্বের আধারে স্থির থাকে না?

আমাদের চিন্তার প্রবাহ অবিরত অখণ্ড কিনা তা নিয়ে তর্ক আছে, কিন্তু আলাপ যে তার খানিকটাকে কিছু সময়ের জন্য আয়ত্তে আনতে পারে সন্দেহ নেই।

রানীমাকে তার দোতলার বসবার ঘরেই পাওয়া গেলো। নয়নতারাকে বাড়ি যাওয়ার আগে তো দিনের খবরগুলো দিয়ে যেতে হবে। রানীকে মন্দির সম্বন্ধে বলা শেষ হলে নয়নতারা নদীর বাঁধানো পাড়ে ফাটলের কথাও বললো। রানী বললেন–তাই? অবশ্য বাঁধানো পাড় ধীরে ধীরে ঢালু স্বাভাবিক পাড় হয়ে গেলেই বা ক্ষতি কি? নয়নতারার মনে পুরোহিতের রসিকতাটা এলো। তা কিন্তু রানীর সামনে বলা যায় না। রানী নিজেই বললেন, নদী ফিরলে ভয়ের কথা। কিন্তু তা ফিরবেই তা বলা যায় না। তখন আবার বাঁধ দেওয়া শক্ত কি? হাসলেন রানী, বললেন আবার-ওদিকে কিন্তু সময়ের বন্যা আছে।

রানী সেই রাতে নতুন কিছু করলেন, অভাবিতভাবে, যেমন শুধু রাজকুমারের বেলাতে তার আবদারেই হয়ে থাকে, নয়নতারাকে পাশে নিয়ে রাত্রির আহার করলেন। ব্যাপারটা কাল সকাল থেকেই গল্প হয়ে ছড়াবে। আর তাই যেন রানী, যাঁর এসব ব্যাপারের কড়াকড়ি সার্বভৌম পাড়াকে হার মানায়, তিনিই চাইলেন।

সে কিন্তু কিছুটা রাত হলে। তার আগে, রানী তখন বসবার ঘরেই, নয়নতারা তো ছিলোই, হৈমীকে ডাকিয়ে আনলেন। বললেনবসো হৈমী, সারাদিনে তা করোনি। হেসে বললেন–এ দিকের ঘরগুলোকে দেখেছো, নয়ন? চিনতে পারবে না। ইকিরিন, শোপা, টেবিল গাচেতে ছয়লাপ। হৈমী এসব বোঝে ভালো।

সেখানেই রূপচাঁদ এদিকে এদিকে বলে ছ-আনির কুমারকে নিয়ে এলো।

রানী বললেন–বসো। জলযোগ হয়েছে তো? পথে নিশ্চয় খুব ক্লান্ত হয়েছে। তোমার থাকবার জায়গা পছন্দ হলো তো? এঁর নাম হৈমী। ইনি তোমার দেখাশুনা করবেন। কাল তোমার চীনের গল্প শুনবো। কালই হরদয়াল আর নায়েবমশায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো। রাজুর সঙ্গেও তখন আলাপ হতে পারবে।

ছ-আনির কুমার প্রণাম করে বসেছিলো, প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। তখন রানী-হৈমীকে বললেন–ইনি মুকুন্দকুমার। কাছে কাছে থেকে ওঁর যত্ন কোরো।

নয়নতারার একটু অবাক লাগলো। প্রথম, অবশ্য, কৌতূহলের নিবৃত্তি। এই তাহলে কায়েতবাড়ির কুমার। এসবক্ষেত্রে অবগুণ্ঠন থাকে, নয়নতারা ও হৈমীর তা ছিলো। কিন্তু সে অবগুণ্ঠন রেশমের, যা স্বচ্ছ। আলাপে না আনলেও বোঝা যায় তা রানীর অভিপ্রেত ছিলো,নতুবা সঙ্গে নিয়ে বসতেন না। কিংবা নাকি মনের চঞ্চলতাকে আড়ালে রাখতে পার্ষদ নিয়ে বসা। নয়নতারা অনুভব করলো কায়েতবাড়ির কুমার সম্বন্ধে রানী কি কিছু বলতে চাইছেন? যেন, যা একদিন গোপন ছিলো এখন প্রকাশ হতে চলেছে, কিন্তু প্রকাশটাকে আয়ত্তে রাখতে হবে।

কথা বলার আগে রানীউঠলেন। নয়নতারাকে নিয়ে এ-ঘর ও-ঘর ঘুরলেন। তার নিজের শোবার ঘরের পাশের ঘরটিতে এসে বললেন–দ্যাখো। এ ঘরে ঘুমোতে কি অসুবিধা হবে তোমার? রাত করে আর বাড়িতে ফিরো না।

বসবার ঘরে ফিরে কথা বলার আগে কী এক আমোদ পেয়ে হাসলেন নিঃশব্দে, বলতে বলতে একটু জোরে হেসে উঠলেন। শুনেছো নাকি? পিয়েত্রোর এক বাবুর্চি নাকি তার বাংলোতেই থেকে গিয়েছিলো। বন্দা না কী নাম। রাজু তাকে পিলখানায় রেখেছে কিছুদিন হয়। নাকি ভালো রসুই। তো পিয়েত্রো তো ফরাসী। বড়ো বড়ো সোনা ব্যাং দেখেছো?

ম্যাগো! সেসব রাঁধতো কিনা বন্দা কে জানে! রূপচাঁদ বলতেই হৈমী বললো–সে থাকলে সুবিধা হয়। বন্দা ব্যাং না রাঁধুক শোর যে রাঁধতে সন্দেহ কি? শোর মেরে মেরে একটাও কি আর রেখেছিলো এ তল্লাটে!

নয়নতারা বললো– বুনো শোর বিপজ্জনক হয়ে থাকে। কমিয়ে দেওয়াই ভালো হয়েছে।

–ও হরি, তাই, পরোপকার ভেবেছো? প্রতি রবিবারে ঘোড়ায় চড়ে বল্লমে বিধে মারা! কী হৈ রৈ! এখানকার রাজাও সঙ্গী। খেতে অমর্ত! ঘেন্নায় মরি। তা বন্দার এখানে এই প্রথম রাঁধা। রাজু আবার একদিন তার হাতে ভগবতী খেতে চাইবে কিনা কে জানে! একবার…হরদয়াল বলেছিলো, কলকাতার ভদ্রলোকের ছেলেরা নাকি আজকাল…।

একটু থেমে রানী বললেন আবার রাজু অবশ্য…আজকাল সে রোজ পিলখানায় যায় হাতির তদ্বির করতে। ওখানে নাকি বন্দার সঙ্গে তরোয়াল খেলে। রূপচাঁদের কথা, বলে বিপজ্জনক। রাজু অবশ্য হাসে। ওতে নাকি বুক কাঁধ চওড়া হয়, হাতের গুলকবজি ফোলে, চোখের ধার বাড়ে।

রানী একটু ভাবলেন-বললেন, যাক গে, একটা গল্প বলো শুনি।

নয়নতারা বললো–যদি আপনি বলেন দয়া করে

রানী একটু ভেবে নিয়ে বললেন–তোমরা ফার্সি পড়বে না, আরব্য উপন্যাসের গল্পও জানলে না। তুমি কি সিন্ধুবাদের গল্প শুনেছো?

নয়নতারা বললো–সেই সিন্ধুবাদ নাকি, যার কথা সেদিন মানদাদিদি বলতে শুরু করেছিলো?

-হ্যাঁ, সেই বটে। মস্ত বণিক, দুধর্ষ সাহস। ধনরত্নের জন্য প্রাণকে পণ রাখতে আপত্তি নেই। জাহাজ ডুবছে, শেষ রক্ পাখির পায়ে নিজেকে বেঁধে পাহাড়ের উপরে সাপের রাজ্য, নাকি অগ্নিয়গিরির গর্তে হীরার জন্য। হীরা যে প্রাণের চাইতে বড়। কিন্তু সেই হীরা পেয়েও কি ঘরে থাকতে পারছে?

নয়নতারা বললো–আপনি কি বলবেন এ সেই ন জাতু কামঃ।

রানী বললেন কী শক্তি দ্যাখো সেই কামের, যে বুদ্ধিমান সিন্ধুবাদকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়। যেন তাতেই ভালো হবে। সেই সিন্ধুবাদ একদিন দ্বীপের বুড়োর খপ্পরে পড়েছিল। বুড়ো তার কাঁধে বসে দুই হাঁটুতে এমন গলা চেপে ধরেছিলো যে প্রাণ যায়। বুড়ো ধুর্ত বটে, কিন্তু খোঁড়া।

নয়নতারা বললে–আপনি জ্ঞান বুদ্ধি এসবকে খোঁড়া বলছেন?

রানী হেসে বললেন–তুমি তো আবার ন্যায়রত্নের বোন;নব্যন্যায়ের ঘর। একটু হাসলেন তিনি।

তাঁর দৃষ্টি কোমল হলো। বললেন–তা হয় না, না? একটা জিনিস লক্ষ্য করো। সেই মহাভারতের সময়ে লোভ, হিংসা, ক্রোধ ছিলো, এখনো তারা সব তেমনি আছে, তখন বুদ্ধি করে করে যেসব নীতি করা হয়েছিলো এখন সেগুলোকে বোকামি বলা হয়। ভাবো দ্রৌপদীর সংসার, কিংবা অর্জুনের পত্নীমালা। মনে হয় না কি যে বুদ্ধিটার এক যুগ পার হয়ে অন্য যুগে যাওয়ার ক্ষমতা নেই?

নয়নতারা হেসে বললো–সমাজের নীতিটিতি মানুষ বুদ্ধি দিয়ে করে বটে।

কিন্তু রানীকে উঠতে হলো। হৈমী কায়েতকুমার মুকুন্দর ব্যবস্থা ভালোভাবেই করবে সন্দেহ নেই, রাজুর খোঁজও নেওয়া দরকার।

তখন রাতের আহার পর্ব মিটেছে। হৈমী নিজেই এলো। জানালো খাওয়া শোয়ার ব্যবস্থা মুকুন্দকুমারের পছন্দ হয়েছে। বন্দাকে আশ্বাস দিলেন।

রানী বললেন–নিশ্চিন্ত করলে।

এইসময়ে হৈমী বললো–উনি নাকি চীনে যাবেন। সেখানে নাকি ইংরেজ-চীনে যুদ্ধ, গর্ডন না কী গার্ডন নামে এক সেনাপতির জাহাজ কলকাতায় ভিড়েছে। অনেকে যাচ্ছে। কেউ কেউ কমিসরিয়াটের কাজে। তবে উনি যেতে চাইছেন যুদ্ধ করতে। আপনি অনুমতি দিলে আর কেউ আপত্তি করবে না।

এ সম্বন্ধে রানী তাকে আগেই বলেছেন, ভাবলো নয়নতারা। তাহলেও তার বিস্ময়বোধ হচ্ছে, কায়েতবাড়ির ছেলে এ বাড়ির অনুমতি চাইছে! কিন্তু তার চাইতে বিস্ময়ের, মানুষ কি স্বভাবতই যুদ্ধ থেকে দূরে থাকে না? তা তো অন্যের যুদ্ধ, অন্য দেশে।

কথার কথা বলার মতো ভঙ্গিতে নয়নতারা বললো–এরকম যেতে কি আপনি অনুমতি দেবেন?

রানী বললেন–এবার ওর একুশ পার হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে কিছু করতে চাইবে তো! এদিকে ইংরেজরা তো এদেশে আর কাউকে মনসবদার করছেনা। রানী যেন আমোদ পেয়ে হাসলেন।

হৈমী বললো–নিজেরই কিন্তু ঘোড়া, বন্দুক, তরোয়াল এসব কিনে দিতে হবে।

 রানী বললেন–তোমার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে তো!

নয়নতারা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো, সে ভাবলো, নিজের চিন্তার ভুল ধরলো যেন, সেজন্য অবাক লাগছে না। এটাও অবাক হওয়ার মতো। একই বয়সের। একজন চলেছে ইংরেজের পক্ষে অন্যদেশে যুদ্ধ করতে, আর অন্য একজন…?

কিন্তু রানীর হাই উঠলো।

রানীর পাশের ঘরেই তো নয়নতারার শোবার ব্যবস্থা। রানীমা শুয়ে পড়লে নয়নতারা নিজের জন্য নির্দিষ্ট শোবার ঘরে সামনে অলিন্দে দাঁড়ালো। রাত্রির রাজবাড়ির অন্দরমহল তার চোখে পড়লো। এখন চতুষ্কোণ উঠোনটার চারিদিকের সবগুলো ঘরেই আলো। লোকজনের সাড়াও যেন। দোতলার অলিন্দের দেয়ালগিরিগুলো জ্বলছে, কিন্তু অনেক ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অলিন্দে বরং কোমল অন্ধকার এখানে ওখানে। বাঁ দিকটায় বেশ কয়েকটা ঘরের পরে একটা ঘরের পর্দার আলো আসছে অলিন্দে। এবার সেটা বন্ধ হলো। ও ঘরটা কি হৈমীর, অথবা ও ঘরেই কি মুকুন্দকুমার? নয়নতারা এবার ডানদিকে চাইলো। বড়ো একটা থামের পাশ দিয়ে অলিন্দটা ঘুরে গিয়েছে কোণ তৈরী করে। থামটাই প্রমাণ যে ওখানেই দোতলায় উঠবার সিঁড়ি। সেজন্যই ওখানে একটা ঝাড় যা থামের পাশ দিয়ে খানিকটা চোখে পড়ছে। সিঁড়ির থাকটাই রাজকুমারের মহলকে রানীর মহল থেকে পৃথক করে। রানী শুয়ে পড়েছেন, দোতলা নিঃশব্দ হয়ে আসছে। কার্নিশের নিচে বসান ঝরোকায় আলো আসছে, আন্দাজ করা যায় ওটাই রাজকুমারের ঘর।

আশ্চর্য! নয়? –এই ভাবতে ভাবতে নয়নতারা তার শোবার জন্য নির্দিষ্ট রানীমার ঘরের পাশের ঘরে ফিরে এলো। অসাধারণ শয্যা। রানীমার নির্দেশে যে রকম হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কেন যে এমন করেন?

শয্যায় বসে সারাদিনের ক্লান্তি সত্ত্বেও নয়নতারার ঘুম আসতে দেরি হলো। বরং রানীর কথাগুলো মনে এলো তার। আলাপে আলাপে বাঁধের ফাটলের সমস্যা, তার সমাধান, কায়েতবাড়ির মুকুন্দকুমার, চীনের যুদ্ধ, বান্দা বাবুর্চির তরোয়াল খেলার কথা হয়েছিলো। দ্যাখো কাণ্ড, বলে ভাবলো নয়নতারা, জাঁ পিয়েত্রোর বাবুর্চির নাম বন্দা, যে নাকি তরোয়ালবাজ, যেমন বুজরুক ছিলো তার মসলিনরেশম কারবারের ম্যানেজার। এসব কি পিয়েত্রোর পরিকল্পনা না খেয়াল? হয়তো খোঁজ করলে জানা যাবে, বন্দা ছিলো প্রকৃতপক্ষে তাঁর অবিচল দেহরক্ষী।

তরোয়াল খেলার গল্পটা যেন হঠাৎ তার বুকের ভিতরে কিছুকে ধাক্কা দিলো। বন্দুকও প্রাণঘাতী। কিন্তু তরোয়াল খেলা, কি নকল তরোয়াল দিয়ে হয়? সে মনে মনে বললো, কী আশ্চর্য, এ তো আমাকে বলোনি! এ বিষয়ে আলাপ করা দরকার নয়? তরোয়ালকে কৃপাণ, করবাল ইত্যাদিও তো বলে। পিয়েত্রোর সেই মখমলে ঢাকা কিন্তু অদ্ভুত ধারালো। মস্ত তরোয়ালটা ব্যবহার করে নাকি? লোহার জামা গায়ে দিয়ে নেয় তো? দেখা দরকার। না, না। তা ভালো নয়। সে কাছে থাকলে যদি রাজকুমার অন্যমনস্ক হয়?

কিন্তু কী করে একা একা অনুভব করে সমস্যার সমাধান হয়। কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারলে হতো। শিকল বুনে বুনে জামা তৈরীর কথা যদি বলো (নয়নতারার অজ্ঞাতে এটা কি ইস্পাতের জামার ছায়া?) সোয়েটারটা কিন্তু বোনা হয়নি। কী আগ্রহে উল আনালো কলকাতা থেকে, কি আগ্রহে বুনতে শেখা। কিন্তু আশ্চর্য, আগ্রহটা কেন নেই? কারো সঙ্গে আলাপ করা দরকার নয় কি?

রাজকুমারকে একবার নিজের হাতে সুতো কেটে ধুতি চাদর উপহার দিয়েছিলো বটে। তেমন সেই এক উৎসবের রাতে অনভ্যস্ত মদে বিহ্বল কিশোর রাজকুমার তার বাড়িতে গিয়ে তার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো।

আলাপের কথাতে মনে পড়লো নয়নতারার, এ বিষয়ে একজনই মাত্র বেশ স্পষ্ট করে আলাপ করেছে। ঘটকী, সেই ব্ৰহ্মঠাকরুন। সেই যে অঙ্কের ধাঁধার মতো স্ত্রী-পুরুষের বয়সের পাশাপাশি হিসাব।

ছি ছি! এসব কি আলাপে আনা যায়? রাজকুমারের এখন একুশ হবে। যেন উপরের পাতার চাপে জল এসে নয়নতারার নিচের পাতার পক্ষগুলো জলবিন্দুতে ভারি হলো। সে। স্থির করলো সে ঘুমোবে। দরজা বন্ধ করে টিপয়ায় বসানো বড়ো ডোমদার সেজটাকে নিবিয়ে বিছানায় এলো সে। দেয়ালে লাল কাকড়ার মৃদু দেওয়ালগিরিটা জেগে থাকবে। এখন সে গায়ের কাপড় আলগা করে দিচ্ছে।

শুয়ে নয়নতারা ভাবলো, রানী কিন্তু বিচলিত নন। বাঁধটাকে নতুন করে শক্ত করে তুলবেন। ফাটলগুলো থাকবে না। পুরোহিত যেমন বলেছিলো, গঙ্গার সেই বুঢ়াকে…কিন্তু ক্ষতি কি যদি অগাধ শান্ত হয়ে নদীটা মন্দিরের কিছু দূরে প্রবাহিত হতে থাকে।

চোখে যখন ঘুম জড়িয়ে আসছে সার্বভৌমপাড়ার মেয়ের মনে হলো : তোমার কাছে। আকবর বাদশার কাল আর রাজুর কালে ব্যবধান নেই। রানীমার মন্দির কখন আকাশ স্পর্শ করে, কখন আবার মাটিতে মিশে যায়, দু-তিনশো বছরের সেব্যবধানও তোমার কাছে মূল্যহীন। কিন্তু তুমি তো মহাকাল, সৃষ্টির উৎস। স্নেহ নেই কেন? সময়ের ব্যবধানে আমাদের যা অতীত হয়ে যায় তা কি তুমি করুণায় পূর্ণ করো না?

এক দারুণ উৎকণ্ঠায় আর লজ্জায় ঘুম ভেঙে গেলোনয়নতারার। বিছানায় উঠে বসলো সে। কিন্তু বিছানা, ঘর, আলো যেন বিশ্বাসে আসছে না। স্বপ্নটা এরকম যেন : এক অগাধ জলরাশির পার বাঁধানো চলেছে কিংবা গতিশীল জলরাশিকে বাঁধেহ্রদে পরিণত করা হচ্ছে। রানীমা, হরদয়াল, নায়েবমশাই, লোকজন। কিন্তু যেন চিড় ধরলো। মেঘের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ফুলেফেঁপে সেই জল মন্দিরকে বিগ্রহকে গিলে ফেলছে। বিষণ্ণ উৎকণ্ঠায় যেন দম বন্ধ হবে। যেন হাহাকার করা হচ্ছে। কিন্তু যেন গোপনে নয়নতারা সুখী হয়ে উঠলো।

আশ্চর্য! সে বিছানার দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবলো, এ কি অন্যায় যে রানীমার পরাজয়ে সে এত সুখী হয়েছিলো! রানীমাকে সে কি বিদ্বেষ করে?

নয়নতারা উঠলো। দাঁড়াতে গিয়ে পা দুটো একটু শিরশির করলো। একটা জানলা খুলে দিলো সে। তখন পেটাঘড়িতে একটা একটা করে এগারোটা বাজলো। রাত হয়েছে বটে, তবে তেমন বেশি নয়। জানলা ধরে দাঁড়ালো সে। বাতাসটা বেশ ঠাণ্ডাই। সে কি একটা বাজনা শুনতে পেলো? মৃদু, যেন ক্রমশ ফুরিত হচ্ছে। আগে কি ছিলো? কিন্তু পিয়ানো বাজাতে বসার পক্ষে এখন কি বেশি রাত নয়?

.

নয়নতারা ভুল শোনেনি। বিছানা দেখে মনে হচ্ছে, সে এতক্ষণ বসেই ছিলো। স্থির হয়ে বড়ো চেয়ারটায় চিবুকের নিচে ডান হাতে চেপে ধরার ভঙ্গিতে ছুঁয়ে বসে থাকাকে আর কিছু বলে না। এখন সে উঠে পিয়ানোর সামনে বসলো। মিউজিক শীটটার গায়ে ইংরেজি অক্ষরে লেখা চপিন। শিশাওয়ালও তাই বলেছিলো। কিন্তু এতক্ষণ ভেবে সি ঠিক করেছে ফরাসী হলে সিএইচ শ হয়ে যাবে, শেষের এনটা চন্দ্রবিন্দু। এই উচ্চারণ বিভ্রাটই যেন তাকে ভাবাবে। সে স্কোর শীটটার উপরে চোখ বোলালো। অভ্যাসের ফলে টানা লাইনে নানাভাবে নিবদ্ধ স্বরগুলির শব্দ তার মনে মনে ঝংকার তুলতে লাগলো।

রাজচন্দ্র অবশ্যই এই চপিন-শপ্যাঁ সম্বন্ধে এই প্রথম জানছে। আজ সন্ধ্যাতেই পৌঁছানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শিশাওয়াল তার সঙ্গে দেখা করে মিউজিক শীটের রোলটা তাকে দিয়ে বলেছিলো, এটা সার, আপনার জন্য এই অধমের আনা উপহার। জঙ্গিলাটের প্রাইভেট সেক্রেটারির স্ত্রীর কাছে সংবাদ পেয়ে সেই রাতেই সংগ্রহ করি। তো স্পিংক সাহেব আমাকে বললো, এটা যখন রচনা হচ্ছে চপিন প্যারিসে, স্বদেশ পোল্যান্ড থেকে নির্বাসিত। যেন স্বদেশ স্বকাল থেকে বিচ্যুত। আর সেখানে খবর এসেছিলো পোল্যান্ডকে চিরকালের আগ্রাসপন্থী রাশিয়া গ্রাস করে ফেলছে। সেই রাগে এটার রচনা। শুনে হাসি পাওয়া স্বাভাবিক। শিশাওয়াল ভালো সেলসম্যানের মতো অনর্গল কথা বলতে পারে, কেউ তার কথা বিশ্বাস করছে কিনা তা পরোয়া করে না। তার গল্পের কোন অংশটা মিথ্যা কে বলবে?

কিন্তু পিয়ানোই রাজুকে আকর্ষণ করলো। নোটেশনগুলোতে চোখ পড়তে তার মনে হচ্ছে, বাজালে তা বুকের মধ্যে তরঙ্গ তুলবে। শীটের মাথায় ইংরেজ-প্রকাশক রিভলিউশনারী স্টাডি কথাটা জুড়ে দিয়েছে। রাজু বাজাতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সুর এমন হলো যে কিছু যেন ভেঙে পড়ছে, কোথাও বিদ্রোহ যেন, আক্রোশ আর বেদনা, হার না মানার প্রবল প্রতিজ্ঞা।

সে রাত্রিতে রাজু শপ্যাঁর সেই রিভলিউশনারী স্টাডি বারবার বাজিয়ে যেন মুখস্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। যেন রিহার্শাল, কাল তাকে শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত হতে হবে। অস্বীকার করা যায় না যে কোনো বিচক্ষণ শ্রোতার কানে ধরা পড়তে বাজানোর ব্যাপারটা প্রতিবারে শপার নির্দেশ মতো হচ্ছে না। ইম্প্রোভাইজ করা হচ্ছে যেন, অন্তত তীব্র কঠোর ধ্বনিগুলি দীর্ঘায়ত আর উচ্চরব হচ্ছে। যেন বাঁধনছেঁড়া, বাঁধভাঙা, তাকে তীব্রভাবে অস্বীকার করা যা তোমাকে স্বাধীন হতে দেয় না, আর ব্যর্থতা যখন ভাগ্যের মতো তখন বিষণ্ণতার ঘাটগুলো বেজে উঠছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *