০৮. রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সন্ধ্যা নামেনি

রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সন্ধ্যা নামেনি। চারদিকের বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। খুব সুনসান লাগছে এলাকা। মনে হচ্ছে, সেপাইরা সবাই মিলে বড় কোনো অপারেশনে গেছে। চারদিক সুনসান হয়ে আছে। আর্মির জিপ ব্যারাকের সামনে এসে দাঁড়ালে মাহমুদা শরীরের ভেতরে শৈত্যপ্রবাহ অনুভব করে। ও বুঝতে পারে, যারা ওকে এখানে পাঠিয়েছে, তাদের সম্মানের দিকে তাকিয়ে ওরা এই পর্যন্ত ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওরা খারাপ ব্যবহার করবে না। সবাই তো চক্ষুলজ্জার ধার ধারবে না। তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং ছিন্নভিন্ন করবে ওকে।

গাড়ির দরজা খুলে যায়। একঝলক ঠান্ডা বাতাস স্পর্শ করে মাহমুদাকে।

বাঙালি ড্রাইভার নরম স্বরেই বলে, আপা, নামেন। তার পরে ফিসফিসিয়ে বলে, এইটা একটা দোজখখানা। আপনাকে কেন এখানে আনল? আপনার স্বামী-শ্বশুর আপনার এত বড় সর্বনাশ করতে পারল? কেমন মানুষ তারা?

মাহমুদা কথা বলে না। একটু সময় নিয়ে গাড়ি থেকে নামলে পেছন থেকে একজন রাইফেলের নল ঠেকিয়ে বলে, চলিয়ে।

ও মুখ ঘুরিয়ে বলে, কিধার?

ওপর মে।

সেপাই সিঁড়ি দেখিয়ে দেয়। খাড়া সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়।

মাহমুদা একটি একটি করে সিঁড়িতে পা রাখে। এক ধাপ এক ধাপ করে ওঠে। ও জানে, ও কোথায় যাচ্ছে। ও জানে ওর পরিণতি কী। তার পরও নিজেকে শক্ত রাখে। নিজেকেই বলে, পাকিস্তানের অখণ্ডতার সঙ্গে তার শরীর জড়িত। তার শরীরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার শ্বশুর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য নারীর শরীর দরকার হয় বলে মনে করেছে তার শ্বশুরবাড়ির দুজন পুরুষ। পিতার হুকুম পালন করেছে তার স্বামী, শফিকুল ইসলাম। বলেছে, যাও, ওদের খাদ্য হও। দেশের স্বাধীনতার কথা বলো। যাও, স্বাধীনতা কেমন তা বুঝে আসসা! দেখো, স্বাধীনতার স্বাদ কত মধুর! আমরা তোমার স্বাধীনতার স্বপ্নের শোধ ওঠাব।

কী ভয়াবহ ক্রুর ছিল শফিকুলের কণ্ঠস্বর। ওর শারীরিক সৌন্দর্যের জন্য ওকে বিয়ে করেছিল লোকটি। মানসিক-মানবিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি লোকটির সঙ্গে। মাহমুদা থু করে স্বামীর মুখের ওপর থুতু দিলে শফিকুল ওর গলা চেপে ধরেছিল। ওর গোঁ গোঁ ধ্বনি তীব্র হয়ে উঠলে হাত ছেড়ে দেয়। অনেকক্ষণ পড়ে ছিল বিছানার ওপর। উঠে দাঁড়াতে পারছিল না। অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য ভারী গয়না পরতে হয়েছিল শাশুড়ির নির্দেশে। সবকিছুর বোঝা বইবার সামর্থ্য হারিয়ে কতক্ষণ পড়ে ছিল, তা বুঝতে পারেনি মাহমুদা। এখনো ঘোরের মতো লাগছে সবকিছু। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে একজন। সামরিক পোশাকে নয়। ক্যাজুয়াল ড্রেস। পায়জামা-কুর্তা পরে আছে। পুরু ঘন মোছের আড়ালে ক্রুর হাসি ঝলকায়। ও কাছাকাছি যেতেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আইয়ে।

মাহমুদা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটি যে শব্দ উচ্চারণ করেছে, তা ভৌতিক ধ্বনির মতো ওর চারপাশ অন্ধকার করে দেয়। ওর মনে হয়, ও কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।

আইয়ে।

অফিসার হাত বাড়িয়েই রাখে। মাহমুদা হাত বাড়ায় না। শক্ত হয়ে যায়। এই জীবনে কেয়ামতের এমন প্রত্যক্ষদর্শী হতে হবে, ও তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তা-ও আবার তার মাধ্যমে, যে তার বাবাকে বলেছিল, আপনার মেয়েটিকে আমাদের পরিবারে নিতে চাই। ও আমার পুত্রবধূ হবে। বছর দেড়েক আগে ও এই পরিবারের পুত্রবধূ হয়েছিল। বিত্তশালী পরিবার। মগবাজারে অনেক বড় একটি বাড়ির মালিক। কোনো কিছুর অভাব নেই। ও ঘর পেয়েছিল, কিন্তু স্বামী পায়নি। মাতাল, জুয়াড়ি একটি লোক। আগে একটি বিয়ে করেছিল। বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এই তথ্য তাদের গোপন করা হয়েছিল, নাকি ওর বাবা বিষয়টি জানত, সেটা ও অভিমানে জিজ্ঞেস করেনি। মাঝেমধ্যে অভিমান তীব্র হলে ভেবেছে, ঘরে সত্য বলে বাবা ওর দায় এড়িয়েছে এমন একটি জুয়াড়ি লোকের কাছে বিয়ে দিয়ে। পরবর্তী সময়ে মেয়ের তেমন খোঁজখবর করেনি। এমনকি কতটুকু ভালো আছে, এটাও জিজ্ঞেস করেনি। মাহমুদা একা একা দহন করেছে নিজেকে।

সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি হুংকার দিয়ে ওঠে। হুংকারের বীভৎস শব্দে আচমকা চমকে ওঠে ও। এমন সম্মুখ বজ্রপাত ওর জীবনে আর কখনো ঘটেনি। একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে লোকটি ওকে হেঁচকা টান দেয়। তারপর বারান্দার ওপর উঠিয়ে নিয়ে যায়। মাহমুদা ধাক্কা সামলানোর আকস্মিকতায় লোকটির হাত চেপে ধরে। পড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে নিজেকে।

লোকটি ওকে একরকম টানতে টানতে ঘরে নিয়ে ঢাকায়। তারপর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। মাহমুদা চোখ বুজে নিজেকে সামলায়। দাঁত কিড়মিড় করে। একটি লাথি মারার প্রবল বাসনায় নিজেকে তৈরি করতে চায়। কিন্তু পারে না। লোকটি ওকে বিছানায় ফেলে দিলে ও চেঁচিয়ে বলে, শুয়োরের বাচ্চাদের পাকিস্তানের অখণ্ডতা। শুয়োরের…বাচ্চাদের…পাকিস্তানের…অখণ্ডতা…এর শোধ…আমি…নেবই-নেবই-নেবই।

লোকটি শক্ত থাবায় ওর মুখ চেপে ধরে।

ভোরের দিকে ওর মনে হয় বিছানা থেকে ওঠার কোনো সাধ্য নেই। আলোর তীব্রতা দেখে বুঝতে পারে, বেলা বেড়েছে। ও হাত বাড়িয়ে শাড়ি নেওয়ার চেষ্টা করে। নাগাল পায় না। তারপর গড়িয়ে খানিকটুকু এগিয়ে শাড়িটা টেনে নিতে পারলে সেটা গায়ের ওপর ছড়িয়ে দেয়। মনে করতে পারছে না যে কয়জন ঢুকেছিল ঘরে। পাঁচজন পর্যন্ত মনে আছে। তারপর জ্ঞান হারিয়েছিল। এখন মাথা ঝিমঝিম করছে। তার পরও স্মৃতিতে প্রথম ভেসে ওঠে শ্বশুরের চেহারা। দাড়ি-টুপিতে একজন পরহেজগার মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করেন। বন্ধুবান্ধব অনেক। ব্যবসার হিসাব-নিকাশ নাই। বাতাসে টাকা ওড়ে। প্রথম দেখায় তাঁকে একজন পরহেজগার মানুষ বলে মনে হবে, কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষটি নিজের ছেলের বউকে ব্যবহার করতে পিছপা হলেন না।

মাহমুদা চেতনে-অবচেতনে বিড়বিড় করে, আপনি রফিকুল ইসলাম। শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য। অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য জীবনপাত করে ফেলছেন অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকে। নিজের ছেলের বউকে ওদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ওরা যখন আমাকে গাড়িতে ওঠায়, তখন আপনি ওদের বলেছেন, তোমরা খুশি থাকো। তোমাদের যা দরকার, তা আমরা সাপ্লাই দেব। তোমরা পাকিস্তানকে হেফাজত করো।

আমার অপরাধ ছিল, আমি আপনাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকার জন্য বলেছিলাম।

আমার অপরাধ আমি গেরিলাযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কথা বলেছি।

মার অপরাধ আমি দেশের স্বাধীনতা চাই।

আমার অপরাধ আমি আমার ঘরে বাংলাদেশের পতাকা রেখেছি।

আমার অপরাধ আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতাম।

আমার অপরাধ আমি আপনাদের না বলে সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম।

মাহমুদা নিজের অপরাধের খতিয়ান করে বড় শ্বাস টানে। তখন শুনতে পায় দরজার তালা খোলার শব্দ। আবার চোখ বোজে মাহমুদা। যে আসে আসুক। আর কোনো পরোয়া নাই। আমার অপরাধ একটি ভুল ঘরের তালা খুলে আমাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি তালা খুলে বের হতে পারিনি। এই কঠিন কাজটি করা আমার সাধ্যের বাইরে ছিল।

এখন কেউ তালা খুলে ঘরে ঢুকছে। ও পায়ের শব্দ পায়। চোখ খোলে। কেউ একজন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মনে হয় ওকে দেখেছে-প্রবল কৌতূহলে কিংবা বিতৃষ্ণায়। মুহূর্ত সময় মাত্র। ভেসে আসে কণ্ঠস্বর, আপা।

নারীকণ্ঠে চমকে ওঠে মাহমুদা। এই দোজখে কোথায় থেকে উড়ে এসেছে হুরপরি!

কে? কে আপনি?

আমি রাবেয়া। পুলিশ লাইনের সুইপার। আমাকে পাঠানো হয়েছে আপনাকে দেখাশোনা করার জন্য।

দেখাশোনা! বিড়বিড় করে মাহমুদা। ও আর ওকে কী দেখাশোনা করবে। দেখাশোনা খুব সহজ কথা নয়। এখন থেকে একটি কঠিন কাজের মধ্যে ওর প্রবেশ ঘটল। জয় বাংলা। জয় বাংলা বলার সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদার সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পন্ন হয়।

রাবেয়া মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাপড়গুলো কুড়িয়ে ভাঁজ করে। মাহমুদার পায়ে হাত রেখে বলে, আপা, উঠবেন?

ও উঠে বসে। দুই হাতে চুল সামলায়। লম্বা চুলের গোছা ছড়িয়ে ছিল পিঠের ওপর। রাবেয়া হাঁ করে তাকিয়ে থেকে ভাবে, এত সুন্দর! ওর দৃষ্টি সরে না মাহমুদার মুখের ওপর থেকে। আবারও বলে, এত সুন্দর! পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে কুড়িয়ে তোলা কাপড়গুলো এগিয়ে দিয়ে বলে, পরেন।

আমি তো পরতে পারব না। তুমি আমাকে সাহায্য করো, রাবেয়া।

ক্লান্ত-বিষণ্ণ কণ্ঠস্বরে কোনো জোর নেই। মাহমুদার দৃষ্টি দেখে ঘাবড়ে যায় রাবেয়া। ভাবে, মানুষটি কী মরে যাবে! না, মরতে দেওয়া হবে না। দরকার হলে পায়ে ধরে ডাক্তারকে ডেকে আনবে। ও যখন দেখতে পায় মাহমুদা ঝিম মেরে আছে, তখন ও নিজের চোখের জল মোছে।

আপনাকে কোথায় থেকে ধরল ওরা?

ধরেনি।

মানে? তাহলে–

ওরা আমাকে জোর করে আনেনি। ওদের গাড়িতে আমাকে তুলে দেওয়া হয়েছে।

কে? কে এমন কাজ করল?

আমার শ্বশুর আর স্বামী।

শ্বশুর? স্বামী?

রাবেয়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মেঝেতে বসে পড়ে। মাহমুদার মাথা ঝুঁকে আসে হাঁটুর ওপর। শরীরের ব্যথা যে কোথা থেকে আসছে, নিজেই বুঝতে পারে না। কখনো মনে হয় এখান থেকে, কখনো ওখান থেকে। কখনো মনে হয় সবখান থেকে। সেদিন আর্মির কয়েকজন অফিসারকে দাওয়াত খাইয়েছিল তার শ্বশুর। খাবার সার্ভ করার দায়িত্ব ছিল মাহমুদার। যতক্ষণ ওরা খেয়েছে, ততক্ষণ টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল ওকে। শুনেছে ওদের ফিসফিস কথা, বহুত খুব সুরত। বহুত আচ্ছি।

হা-ভাতের মতো খেয়েছিল বিরিয়ানি, মাংসের রেজালা, মুরগির রোস্ট, পুডিং, ফিরনি, আম, লিচু…। তারপর ওরা যাবার সময় ওকে গাড়িতে তুলে দিয়ে বলেছিল, তুমিও ওদের খাদ্য। তোমাকেও ওরা হা-ভাতের মতো খাবে।

আপা।

তুমি কে?

আমি সুইপার রাবেয়া।

বিরক্ত করছ কেন আমাকে? দেখছ না আমি নড়তে পারছি না।

ওরা আমাকে পাঠিয়েছে আপনাকে পরিষ্কার করতে। আজ রাতে আবার আসবে আপনার কাছে। আর আমি যদি পরিষ্কার না করি, তাহলে আমাকে চাবুক মারা হবে।

চাবুক?

ওরা চাবুক হাতে ঘোরে। ওই সব ঘরের মেয়েরা ওদের খামচে-কামড়ে দিলে ওদের চাবুক মারা হয়। লোহার শিকের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

তুমি আমাকে এসব কী বলছ, রাবেয়া? তোমার কথা আমি ঠিকমতো বুঝতে পারছি না।

এখানে তো এসবই হচ্ছে। আমি মিথ্যা কথা বলছি না।

মেয়েরা কি জয় বাংলা স্লোগান দেয়?

কাউকে কাউকে দিতে শুনেছি। তবে বেশির ভাগ দিতে পারে না। ওদেরকে সারাক্ষণ কাঁদতেই দেখি।

আমি এখানে বসে জয় বাংলা স্লোগান দিতে চাই, রাবেয়া।

আমি দরজা বন্ধ করে রেখেছি, আপনি যত খুশি স্লোগান দেন।

জয় বলে চিৎকার করতে গিয়ে মাহমুদা দেখল, শরীরের কোথাও কোনো শক্তি নেই। ধ্বনি দুটো বুকের ভেতরে গোঙানির মতো ঘুরপাক খায়। ও দম ফেলে ভাবে, থাক, জয় বাংলা ওর বুকের ভেতরে থাক।

আপা।

বলো, রাবেয়া।

দরজা খুলি?

খোলো। ওটা বন্ধ করারই বা দরকার কী? যার যার খুশি আসতে দাও।

সেটা তো হবে না, আপা। আপনি তো মাত্র কয়জনের।

ও, তা-ই, তাহলে তুমি তোমার মতো কাজ করো।

রাবেয়া দরজা খোলে। হাট করে খুলে দেয় দুই পাল্লা। এক ঝলক দমকা বাতাস ঢোকে ঘরের ভেতরে।

মাহমুদার জন্য নাশতা পাঠানো হয়েছে। ট্রেতে করে আনা হয়েছে খাবার। রাবেয়া প্রথমে একটু ধাক্কা খায়। ক্যানটিনের ছেলেটি বলে, ওপরের হুকুম। ও চোখের ইশারায় ট্রে দেখায়। ছেলেটি কিছু বলে না। রাবেয়া বুঝে যায় যে কোনো বড় ঘরের কেউ হবে। সে জন্য এই যত্ন। তা ছাড়া এই চালান ওপরের বসের জন্য, যত্ন তো একটু করতেই হবে।

রাবেয়া ট্রে নিয়ে দরজা বন্ধ করে। টেবিলের ওপর ট্রে রেখে নাশতার প্লেট নামায়। লুচি, ভাজি, ডিম, কলা দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে ছোট ফ্লাস্কে চা।

আপা, খান। ওঠেন। এমন নাশতা এখানকার কাউকে দেওয়া হয়নি।

আমার শ্বশুর যে একজন নামী মানুষ। সে জন্য দিয়েছে। এটা আমার শ্বশুরকে দেওয়া হয়েছে। আমাকে না।

আপনার শ্বশুর অনেক বড়লোক?

হ্যাঁ, বড়লোকও। চারদিকে তার টাকাপয়সার ছড়াছড়ি।

এত নামী মানুষের এমন ভীমরতি কেন, আপা?

আরও দাম ওঠানোর জন্য। আরও টাকার জন্য।

আপনাকে ঘরে নেবে?

ঘরে রাখলে কি আর বের করে দেয়।

আপনার বাবা কেমন মানুষ গো?

তুমি আমাকে একটু বাথরুমে নিয়ে যাও, রাবেয়া। আমার ভীষণ বমি পাচ্ছে।

আপনি তো কিছু খাননি।

রাতে আমি বিরিয়ানি-রোস্ট খেয়েছি না। শ্বশুরবাড়ির শেষ খাবার আমি পেট পুরে খেয়েছি, রাবেয়া।

মাহমুদা রাবেয়াকে ধরে পা টানতে টানতে বাথরুমে যায়। ওয়াক করার পরও বমি আসে না। আসে কান্না। মাহমুদা বুকভাঙা কান্নায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

বাথরুমের দরজায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে রাবেয়া। বুঝতে পারে, নড়ার শক্তি ও হারিয়েছে। কিছুক্ষণ পর কান্নার রেশ কমে এলে রাবেয়া পাশে গিয়ে বসে।

আপা, মুখ-হাত ধোন। গোসল করবেন?

কিছুই করব না, রাবেয়া।

আপনাকে পরিষ্কার করে রাখতে না পারলে ওরা আমাকে চাবুক দিয়ে পেটাবে।

পেটাক। মনে রাখবে, চাবুকের প্রতিটি বাড়ি স্বাধীনতার জন্য। আমি প্রতিশোধ নেব, রাবেয়া।

কীভাবে?

শান্তি কমিটির ওই দালালের বাড়িতে গিয়ে বোমা মেরে ওড়াব রফিকুল আর শফিকুল ইসলামকে।

আপনিও তো মারা যাবেন।

যাব। স্বাধীনতার জন্য শরীর দিয়েছি। এর পরে জীবন দেব। এরা যদি আমাকে এখান থেকে বের হতে না দেয়, তাহলে তুমি আমাকে পালাতে সাহায্য করবে, রাবেয়া। পারবে না?

মনে হয় পারব। আমার একটি শাড়ি পরিয়ে আপনাকে সুইপারের বেশে পার করে দেব।

কিন্তু ওরা তো সারাক্ষণ তালা লাগিয়ে রাখছে।

পালাতে হবে দিনের বেলা। যখন খাবার দিতে আসে, তখন ক্যানটিন বয়ের সঙ্গে সলাপরামর্শ করব।

মাহমুদা বাথরুমের দরজা বন্ধ করে। মনে হয়, যৌবনের সব শক্তি শরীরে ফিরে এসেছে। ওরা কিছুই নষ্ট করতে পারেনি। এখন প্রতিরোধের সময়। গ্রেনেড চাই, বোমা চাই। ও শরীর ভেজায়। শরীরের শক্তিকে আবাহন জানায়। এবং গুনগুন করে—মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম…।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে গুনগুন ধ্বনি শুনে স্বস্তি বোধ করে রাবেয়া। ওর মনে হয়, ওর আর দুঃখ নেই। ব্যারাকের অন্য জায়গার মেয়েরা যেমন ওর শক্তি বাড়িয়েছে, বড়লোকের বাড়ির বউ ওকে সেই শক্তি দিচ্ছে। দরজার তালা খোলার শব্দ শুনে ও দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ক্যানটিন বয় ট্রে ফেরত নিতে এসেছে।

ট্রে-থালাবাটি ফেরত দাও, খালা।

খায়নি তো কিছু।

কেন? খিদে নেই?

এত নির্যাতনের পরে কি খাওয়া মুখে ওঠে?

হিহি করে হাসে ক্যানটিন বয়।

না খেলে বলো পাবে কোথায় থেকে? রাতে আবার শুতে হবে না।

আবার হিহি করে হাসে ও।

খেতে বলো, খালা। নইলে তুমি খাবার মুখে তুলে দাও। না খেলে তোমার আমার দুজনের কারও রেহাই থাকবে না।

তুই যা এখন। এখানে দাঁড়িয়ে হিহি করে হাসতে হবে না। শয়তান একটা।

তুমি কেমন করে বুঝবে যে এটা দুঃখের হাসি! অনেক দুঃখেও মানুষের হাসি আসে। আমি এখন আর আসব না। একবারে দুপুরের ভাত নিয়ে আসব। যাই।

বারান্দার শেষ মাথায় গিয়ে আবার ফিরে আসে। দেখতে পায়, রাবেয়া তখনো দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ও এক দৌড় দিয়ে কাছে আসে। বলে, এ মাসের বেতন পেলে এখান থেকে চলে যাব।

কোথায় যাবি?

যেদিকে দুই চোখ যায়। গেরামেও যেতে পারি। এখানে আর থাকা সম্ভব না।

রাজাকার হবি না তো?

থু, আমি বেইমান না। আমার বাপ-দাদার ঠিকানা আছে। আমার নদীর নাম আগুনমুখা।

ও আর দাঁড়ায় না। দ্রুত ফিরতে থাকে। সিঁড়ির মাথায় গিয়ে ফিরে দাঁড়ায়। দেখতে পায়, রাবেয়া তখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তখন ওর খেয়াল হয়। চাবি ওর হাতের মুঠোয়। দরজায় তালা দেওয়া হয়নি। দরজার কড়ার সঙ্গে খোলা তালা ঝুলছে। ওকে আবার আসতে দেখে রাবেয়া ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে। শুনতে পায় ছেলেটি তালা লাগাচ্ছে। ডিউটি করছে ও।

 

পাঁচ দিন পার হয়েছে।

প্রতিটি রাত নরক-যন্ত্রণায় পার হচ্ছে। শরীর আর নড়তে চায় না। তবে মানসিক শক্তি সঞ্চয় করেছে মাহমুদা। মনে পড়ে শ্বশুরের সঙ্গে শেষ কথা, তিনি ছাত্র ফেডারেশন আয়োজিত সভায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিলেন। সভার আলোচনার বিষয় ছিল—পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা। চায়ের টেবিলে তিনি জোর গলায় সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেন। বলেন, দুষ্কৃতিকারী ও বিভেদ সৃষ্টিকারীদের উৎখাত করার জন্য সামরিক বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাতে হবে। ওরা প্রথম রাতে বিড়াল মেরে উচিত শিক্ষা দিয়েছে।

মাহমুদা আঁতকে উঠে বলেছিল, বিড়াল? আব্বা, সেনাবাহিনী তো গণহত্যা ঘটিয়েছে।

কী বললে? তিনি ক্রুদ্ধ চোখে মাহমুদার দিকে তাকিয়েছিলেন।

আব্বা, আব্বা, আপনি তো বাঙালি। আপনি পাঞ্জাবি না।

আমি পাকিস্তানি। আমি মুসলমান। আমি মালাউন না। সেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতা শুনলে না। তিনি একজন সাচ্চা মুসলমান।

আপনি যাদের দুষ্কৃতিকারী বলেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা, আব্বা। দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে।

খামোশ! স্বাধীনতা!

তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ওকে শাস্তি না দিলে তোকে ত্যাজ্যপুত্র করব। আমার সম্পত্তির কোনো কিছু তোর কপালে নাই।

শফিকুল ওকে এক হেঁচকায় চেয়ার থেকে টেনে তুলে এনে ঘরের দরজা বন্ধ করেছিল। ও কোনো বাধা দেয়নি। যেন শফিকুল জোরজবরদস্তির সুযোগ না পায়, সেটা খেয়াল রেখেছিল। দরজা বন্ধ করলে আঙুল উঁচিয়ে বলেছিল, গায়ে হাত তুলবে না। গায়ে হাত তুললে আমিও তোমাকে ছাড়ব না।

তোমাকে আমি কুকুর দিয়ে খাওয়াব। ভেবেছ কী? বেশি বাড় বেড়েছে তোমার।

তোমাকে কি আমি ছেড়ে দেব? আমি যা বলি, সরাসরি স্পষ্ট কথা বলি। আড়ালে-আবডালে কথা বলা আমার পছন্দ না।

কী করবে, শুনি? কী সাধ্য আছে তোমার? বাপ তো একটা কেরানি। ফুটো পয়সা দিয়েও বিকাবে না।

খবরদার, আমার বাবাকে নিয়ে কথা বলবে না। নিজে তো একটা মাতাল-জুয়াড়ি। আগে একটা বিয়ে করেছিলে। সেই বউয়ের কাছ থেকে লাথি খেয়েছিলে। আমার বাবার কাছে সেই বিয়ের কথা স্বীকার করারও সাহস ছিল না।

চুপ কর, হারামজাদি, টাকা দিয়ে মাগি কিনেছি। তার জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি? আর একটা কথা বললে–

তুই কথা বলবি না, ইবলিস।

ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শফিকুল। ও কখনো ঠেকিয়েছে। মার খেয়েছে, মার দিয়েছে। মাঝে সময় গেছে দুই দিন। শফিকুল বাড়ি ফেরেনি। কোথায় ছিল, কেউ তা জানতে চায়নি। সবাই জানে ও এমনই। কোনো কলগার্ল পছন্দ হলে তাকে নিয়ে হোটেলে থাকে।

তৃতীয় দিনে পাঁচজন কর্নেল-মেজরের জন্য ডিনারের আয়োজন হয়। শাশুড়ি চুপচাপ ধরনের মানুষ। ওর ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। ওর ওপর কর্তৃত্বও ফলায় না। বিয়ের পরদিনই বলেছিল, এই বাড়িতে তুমি মেয়ের মতো থাকবে। ছেলেটা বড্ড মেজাজি, বুঝেসুঝে চলবে। কোনো কিছুর দরকার হলে আমাকে বলবে।

ও তো কোনো কিছু অকারণে চাওয়ার মেয়ে নয়। শাশুড়ি প্রয়োজনীয় জিনিস নিজের থেকেই অনবরত দিয়েছে। ও বাইরে কোথায় যাবে, সে ব্যাপারেও নাক গলায়নি। এমনকি জানতেও চায়নি। মাহমুদার মনে হয়েছে, এত উদাসীন মানুষ ওর বাইশ বছরের জীবনে দেখা হয়নি।

ডিনারের দিন ও সেনা অফিসারদের সামনে যাবে না বললে শফিকুল বলেছিল, বাড়াবাড়ি করবে না। সামনে না গেলে ওই চারজন অফিসারের সঙ্গে

এই ঘরে ঢুকিয়ে দেব। বুঝবে ঠেলা।

কী বললে? মাহমুদা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিল।

আমি যা বলি, তা করি। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা আমাদের জন্য ফরজ।

যদি দেশ স্বাধীন হয়?

চুপ, হারামজাদি। স্বাধীনতার কথা মুখে আনবি না। এই বাড়ির ভাত খেয়ে স্বাধীনতার কথা…

আমি এখনই চলে যাব। ঠিকই বলেছ। যার ভাগ্যে জুয়াড়ি স্বামী জোটে, তার আবার স্বাধীনতা কী!

এরপর শুরু হয় দুজনের মারামারি। মাহমুদা নিজের সব শক্তি প্রয়োগ করে মারতে ছাড়ে না শফিকুলকে। নখের খামচিতে দাগ পড়ে গালে। একসময় দুজনে আপন ইচ্ছায় থামে। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফেঁসে।

সন্ধ্যার আগে শাশুড়ি ওকে ডেকে পাঠান তার ঘরে। মাহমুদা কাছে গেলে বলে, তুমি রেডি হও, বউমা। আমি চাই না এই বাড়িতে আর্মি অফিসাররা তোমার ঘরে ঢুকুক। আমার ছেলে এমন কাণ্ড করতে পারে।

তারপর নিজেই ওকে কাপড় বের করে দেন। গয়না দেন। কসমেটিকসও। মাহমুদা সেগুলো নিয়ে নিজের ঘরে আসে! মেহমান আসার আগে পর্যন্ত অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সাজে। মনে মনে ভাবে, আজই এ বাড়িতে শেষ দিন। কাল সকালে বাসে উঠে রাজশাহী যাবে। ছোট খালার কাছে। তারপর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। লোক পেলে ইন্ডিয়ায় শরণার্থী হবে।

মেহমান বাড়িতে আসার আগে শফিকুল ওর দিকে তাকিয়ে শিস দেয়।

ভেরি গুড, দারুণ সেজেছ। লাইক এ হোর।

হোর? মাহমুদার শরীরে আগুন জ্বলে ওঠে।

শফিকুল বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলেছিল, তাই তো বলেছি। হোর মানে বোঝো না? বেশ্যা। বেশ্যা। ও তখন দাঁত কিড়মিড় করে বলেছিল, বাস্টার্ড।

শফিকুল কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এই মুহূর্তে নিজেকে সংযত রাখা ওর স্বার্থ। মেজর-কর্নেল আসার আগে মাহমুদার সাজগোজ নষ্ট করতে চায় না। পরিস্থিতি নষ্ট করা চলবে না।

মাহমুদা মাথা চেপে ধরে বসে থাকে। ও তো জানে, লোকটা জাতে মাতাল তালে ঠিক। পরিবার নিয়ে আর ভাবতে চায় না। বাড়ির লোকজন বলাবলি করত, শান্তি কমিটির লোকেরা মেয়েদের আর্মি ক্যাম্পে পাঠায়।

নিজের জীবন দিয়ে এমন নির্মম অভিজ্ঞতা হবে—এটা ওর স্বপ্নেরও অতীত।

রাবেয়া এসে ডাকে, আপা।

বলো, রাবেয়া।

আপনাকে বোধ হয় অন্য কোথাও নিয়ে যাবে।

কোথায়?

সেটা আমি জানি না। ক্যানটিনের লোকটা বলেছে, কাল থেকে এ ঘরে আর খাবার আসবে না।

আমি তো উঠে দাঁড়াতেও পারছি না। আমি অন্য জায়গায় যাব কী করে।

আপনার শরীর থেঁতিয়ে গেছে। ওরা আর আপনার কাছে আসবে না। আজই বোধ হয় শেষ রাত।

মাহমুদা কথা বলে না। ওর মাথা কাজ করছে না। ওর নিমীলিত চোখের পাতায় সন্ধ্যা ঘনায়। ও বুঝতে পারছে, ওর চেতনা লোপ পাচ্ছে। ও ড়ুবে যেতে থাকে। ওর আর কিছুই মনে থাকে না।

যখন ওর জ্ঞান ফেরে, ও দেখতে পায় রাস্তার ধারে পড়ে আছে। কত রাত ও জানে না। নাকি সকাল হব-হব করছে? ও চোখ ববাজে। ঘাসের ওপর পড়ে থাকার কারণে কেমন অস্বস্তি লাগছে। ঘাস-গুল্মের খোঁচা লাগছে। জ্ঞান না ফিরলেই হয়তো ভালো ছিল। ও উঠে বসার চেষ্টা করেও পারে না। রাস্তায় গাড়ি নেই। মানুষ নেই। মাহমুদার মনে হয়, ও এখন সচেতনভাবে নিজের অবস্থা বুঝতে পারছে। শুধু বুঝতে পারছে না কোথায় ওরা ওকে ফেলে রেখে গেছে। ওদের চাহিদা পূরণের সাধ্য ওর ছিল না। তাই ফেলে দেওয়া। শহরের একজন নামী লোকের পুত্রবধূ বলে এটুকু খাতির ওকে করেছে।

শুধু কি নামী লোক? সে তো ওদের পা-চাটা কুকুর। নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বোঝে না।

চোখ খুলে রাখতে অসুবিধা হচ্ছে। আলো ফুটছে একটু একটু করে। এখন ও কোথায় যাবে? ওঠার চেষ্টা করে। পারে না। মাথা কাত হয়ে যায়। মাথা সোজা রাখা কঠিন। ও আবার চোখ বোজে।

 

ভোররাতেই লঞ্চ এসে পৌঁছেছে সদরঘাটে। নিজের ছোট ব্যাগটি নিয়ে লঞ্চ থেকে নেমে আর কোথাও দাঁড়ায় না আলতাফ। লঞ্চে সারা রাত ঘুমোতে পারেনি। লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে সেই আগুনমুখা নদীর পারের গ্রাম থেকে। এত সকালে রিকশা বের হয়নি রাস্তায়। ও হেঁটেই বাড়ি যাবে বলে ঠিক করে।

কতক্ষণ হেঁটেছে জানে না। ফুরফুরে বাতাসে হাঁটতে ওর ভালোই লাগছে। নিজের ভেতরে সতেজ ভাব অনুভব করছে। দূর থেকেই একজন নারীকে দেখতে পায় ও। রাস্তার ধারে পড়ে আছে। একবার হাত নাড়িয়েছে। আলতাফ দৌড়ে কাছে যায়।

আপা, আপা, কী হয়েছে আপনার?

পাকিস্তানি সেনারা আমাকে এখানে ফেলে রেখে গেছে।

হায় আল্লাহ, এখন আমি কী করব! হায় আল্লাহ, আপনাকে তো হাসপাতালে নিতে হবে। রিকশাও তো নেই।

মাহমুদা চোখ বুজে ওর কথা শোনে। বুঝতে পারে, লোকটি দালাল নয়। রাজাকারও না। বুকের গভীর থেকে ওর স্বস্তির নিঃশ্বাস আসে। মৃত্যুর আগে একজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কাউকে দেখা হলো। এত দিন যে বাড়িতে ছিল, সেখানে এসব কথা শোনা যেত না। সেটি ছিল পাকিস্তানের পক্ষের পরিবেশ। যখন-তখন কারণে-অকারণে মুক্তিযোদ্ধাদের গাল দিয়েছে তারা। ওদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে, এমন আলোচনাই হতো সারাক্ষণ। আজকের সকাল আমার জন্য পুণ্যের সকাল আর মৃত্যুর জন্য শান্তির মৃত্যু। আমি খুশি। আল্লাহ মেহেরবান।

আলতাফ ওর পাশে বসে বলে, আপা, আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। আমি স্যারের কাছে যাচ্ছি। স্যার আপনাকে ঠিকই হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আপনি যতক্ষণ পারেন এখানেই থাকেন।

মাহমুদা ঘাড় কাত করে দেখতে পায়, আলতাফ দৌড়াচ্ছে। ওর পায়ের সবটুকু জোর দিয়ে ও রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করছে। গভীর প্রশান্তি মাহমুদাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ও উঠে বসার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না।

বাড়ির গেটে পৌঁছে যায় আলতাফ।

কলিংবেল চাপতেই গেট খোলেন আকমল হোসেন। তিনি ভোররাত থেকেই নিজের টেবিলে বসে কাজ করছিলেন। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর আর বিছানায় যেতে পারেননি।

আকমল হোসেনকে বারান্দায় দেখে আলতাফ উৎকণ্ঠিত স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, স্যার, স্যার!

আস্তে আলতাফ। বুঝেছি, কিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু চেঁচিয়ো না। আশপাশের বাসার লোকেরা জেগে যাবে।

গেটের ভেতরে ঢুকে হাঁফ ছাড়ে ও। ততক্ষণে আয়শাও বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। আলতাফ হাতের ব্যাগ বারান্দায় রাখতে রাখতে বলে, স্যার, রাস্তার ধারে একজন আপা পড়ে আছে। পাকিস্তানি আর্মি তাকে শেষ করেছে। উঠে দাঁড়াতেও পারে না। একটা কিছু করা দরকার, স্যার। হাসপাতালে নিতে হবে।

আয়শা খাতুন বলেন, গাড়ি বের করো। আমরা তাকে উঠিয়ে নিয়ে আসব।

হ্যাঁ, আমারও তা-ই মত। গ্যারেজ খোলো, আমি চাবি নিয়ে আসছি। তুমি আমার সঙ্গে যাবে, আশা।

হ্যাঁ, আমি তো যাবই। মেরিনা ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক।

কতটুকু সময় মাত্র। তিনজন মানুষ গাড়িতে ওঠে। মন্টুর মা গেট বন্ধ করে।

কতটুকু সময় মাত্র। গাড়ি এসে দাঁড়ায় মাহমুদার পাশে। সবাই মিলে ওকে ধরে গাড়িতে ওঠায়। পেছনের সিটে আয়শা খাতুন ওকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরে রাখেন। মাহমুদার মাথা নিজের ঘাড়ের ওপর রাখেন।

মাহমুদা মৃদুস্বরে বলে, আমি কোথায় যাচ্ছি?

আপনি কিছু ভাববেন না। আমরা আপনাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। আপনি শান্ত থাকেন।

শান্ত থাকা কী? মাহমুদা অস্ফুট স্বরে কথা বললে আয়শা তাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরেন।

অল্পক্ষণ সময় মাত্র।

সূর্য এখনো ঠিকমতো ওঠেনি। দিনের প্রথম আলো ছড়িয়েছে মাত্র। তারা পৌঁছে যায় বাড়িতে।

গেষ্ট-রুমের বিছানায় শুইয়ে দিলে মেরিনা এসে দরজায় দাঁড়ায়।

কী হয়েছে, মা? তোমরা কোথায় গিয়েছিলে? আমাকে ডাকোনি কেন?

এখন প্রশ্ন না। ওকে দেখো। মন্টুর মাকে ডেকে ওকে বাথরুমে নাও। আমার আলমারি থেকে শাড়ি-কাপড় বের করে আনো। আমি ডাক্তারের ব্যবস্থা করছি।

কতটুকু সময় মাত্র।

আয়শা খাতুন ফোন করেন ড. রওশন আরাকে।

এক্ষুনি আসতে হবে। রেডি হন। আমি আসছি।

আকমল হোসেন তো তৈরিই ছিলেন।

ঢাকার রাস্তায় গাড়ি ছুটে যায়।

দিন বাড়ছে। রাস্তায় রিকশা-গাড়ি নেমেছে। লোক চলাচল শুরু হয়েছে। তার পরও গাড়ি চালাতে অসুবিধা হচ্ছে না আকমল হোসেনের। অল্পক্ষণে পৌঁছে যান ডাক্তারের বাসায়। তিনি তৈরি ছিলেন। ডাক্তারি ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে ওঠেন। আয়শা খাতুনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করেন। আয়শা খাতুন ঘাড় কাত করে বলেন, একটা কিছু ঘটেছে। এখন না। পরে বলব। বাড়িতে চলেন আগে।

কতটুকু সময় মাত্র।

গাড়ি পৌঁছে যায় হাটখোলার বাড়িতে। মেরিনা আর মন্টুর মা মাহমুদাকে পরিচর্যা করেছে। গোসল করিয়েছে। আয়শা খাতুনের আলমারি থেকে সুতির শাড়ি-পেটিকোট-ব্লাউজ এনে পরিয়েছে। মাথা আঁচড়ে দিয়েছে। মুখে হাতে লোশন লাগিয়েছে। আর দুজনেই বারবার ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে। মনে মনে বলেছে, এত সুন্দর! তারপর পানি খাইয়েছে। জুসও। এখন একটু স্বস্তিতে আছে ও।

ডাক্তার দেখলেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ আনতে গেলেন আকমল হোসেন। সবকিছু মিলিয়ে যা ঘটল, তা দেখে মাহমুদা ভাবল, তার যুদ্ধের একটা পর্ব দেখা হলো। এই মানুষদের দেখা না হলে ওকে প্রবল দুঃখ নিয়ে মরে যেতে হতো। এখন ওর কোনো দুঃখ নেই। মৃত্যুবরণ খুব সহজ কাজ বলে মনে হয় ওর।

কতটুকু সময় মাত্র।

ওর জন্য ওষুধ এসে যায়। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওকে ওষুধ দেওয়া হয়। ওকে ওষুধও খাওয়ানো হয়। ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়। ওর বিছানার চারপাশে বসে থাকে সবাই। ওর কোনো কিছু না আবার ঘটে যায়, এমন আশঙ্কায় সবাই উদ্বিগ্ন।

ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার আগে ও খুব দ্রুত ওকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলে। শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য রফিকুল ইসলামকে চিনতে পারেন আকমল হোসেন। মগবাজারে তার বাড়ি, কোথায় তা-ও জানেন। বিভিন্ন সভায় তাঁকে দেখেছেন।

ও ঘুমিয়ে পড়ার আগে বলে, আপনি আমাকে বোমা দেবেন। আমি ওই বাড়িতে বোমা ফাটাতে চাই। আমার শেষ যুদ্ধে আমি জিততে চাই।

সবাই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাহমুদা বালিশে ঘাড় কাত করে। আয়শা ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেন, হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার আছে?

আমার মনে হয় দরকার নেই। ওষুধ ঠিকমতো খেলে ঠিক হয়ে যাবে। তা ছাড়া ও যেভাবে কথা বলেছে তাতে মনে হয়েছে, ওর মানসিক জোর আছে। ট্রমা আক্রান্ত না হয়, এদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মেরিনা যেন ওর বন্ধু হয়ে যায়।

আকমল হোসেন বলেন, ওকে হাসপাতালে নিতে হচ্ছে না, এটাই আমাদের ভরসা। হাসপাতাল আমাদের জন্য বিপজ্জনক হবে। ওকে আমরা কেন রাস্তা থেকে উঠিয়ে ঘরে এনেছি—এটি একটি প্রধান ইস্যু হবে। হাসপাতালের লোকজনের কৌতূহলের কারণ হবে ও। ডাক্তারদের মধ্যে কেউ রাজাকার থাকলে ওরাই খবর ফাঁস করে দেবে।

সবাই মাথা নেড়ে বলে, ঠিক।

আমি রোজ ওকে দেখতে আসব। কোনো কিছু জরুরি হলে জানাবেন।

রওশন আরাকে বিদায় দিয়ে প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আয়শা মেরিনাকে বলেন, কতটুকু সময়, কত কিছু ঘটে গেল!

মেরিনা দুহাত মুঠি করে ধরে বলে, মাহমুদা খুব শক্ত মেয়ে। একটুও ঘাবড়ায়নি। ও বলেছে, ওর শরীর স্বাধীনতার। ও বোমা দিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ি উড়িয়ে স্বাধীনতার শহীদ হবে।

আল্লাহ ওকে হায়াত দিক।

ও হায়াত চায় না, আম্মা। ও ঠিকই করে ফেলেছে যে ও স্বাধীনতার শহীদ হবে।

আয়শা মাথা নাড়েন। বুঝতে পারছি, ও আমাদের একজন গেরিলাযোদ্ধা। চল, বারান্দায় বসে তোর আব্বার জন্য অপেক্ষা করি। ফিরে এলে আমরা একসঙ্গে নাশতা খাব।

মাহমুদার জন্য স্যুপ বানাতে বলেছি।

ভালো করেছিস। আলতাফকে পাঠিয়ে ওর জন্য আলাদা বাজার করতে হবে। তুই একটা তালিকা করিস।

কিছুক্ষণ পর ফোন আসে মারুফের।

আমি রূপগঞ্জ চলে যাচ্ছি, মেরিনা।

কবে ফিরবি, ভাইয়া?

কয়েক দিনের মধ্যে। তখন এসে বাড়িতে থাকব। আমাদেরকে ফার্মগেটে একটা অপারেশন করতে হবে।

আমাদের বাড়িতে একজন অতিথি আছে, ভাইয়া। আজ সকালেই তাকে আনা হয়েছে।

আনা হয়েছে মানে কী রে? কোথায় থেকে আনা হয়েছে। কে সে?

একজন গেরিলাযোদ্ধা।

গেরিলাযোদ্ধা? আমার পরিচিত কেউ? আমি কি চিনি?

না। তুমি তাকে চেনা তো দূরের কথা, কোনো দিন দেখোইনি।

সে কি আলতাফ ভাইয়ের কেউ?

না।

তার নাম কী? তার নাম কী? ঠিক করে কথা বলছিস না কেন? আমার খুব রাগ হচ্ছে, মেরিনা। তার নাম বল।

মাহমুদ।

তুই কি আমার সঙ্গে ফান করছিস? এটা কি আমাদের ইয়ার্কি করার সময়।

ফান নয়, রিয়ালিটি, ভাইয়া।

ঠিক আছে, আমি এসে দেখব। আম্মা-আব্বা কেমন আছে?

দুজনেই ভালো।

আব্বাকে দে।

আব্বা ডাক্তার খালাম্মাকে পৌঁছে দিতে গেছেন।

ডাক্তার? আম্মার কিছু হয়নি তো?

রাখছি, ভাইয়া। আমরা সবাই ভালো আছি।

আকমল হোসেন ফিরে আসেন। গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে এসে বারান্দায় বসেন। আয়শা বলেন, কয়েক ঘণ্টা সময় মাত্র। কিন্তু কত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল।

আমার ডায়েরির পাতা আজ ভরে যাবে। আমরা ইতিহাসের একটি বড় সাক্ষী হলাম।

শুধু কি সাক্ষী?

আমরা তো অংশও নিলাম। মাহমুদাকে বাড়িতে আনাও আমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ।

আকমল হোসেন পা থেকে স্যান্ডেল খুলতে খুলতে বলেন, সামনে একটা অপারেশন আছে। ছেলেরা প্রস্তুত হচ্ছে।

কোথায় হবে?

ফার্মগেট এলাকায়।

আকমল হোসেন উঠতে উঠতে বলেন, ভীষণ খিদে পেয়েছে, আশা।

গোসল করে টেবিলে এসো। নাশতা টেবিলে দিয়ে দিচ্ছি। দেরি কোরো না।

আসছি। তাড়াতাড়ি আসব। গায়ে শুধু পানি ঢালব আর মুছব।

দুজনে হাসতে হাসতে দুদিকে চলে যায়।

 

মাহমুদাকে বিশ্রামের বেশি সুযোগ দেয় সবাই। ও বেশ দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে। হাঁটতে পারছে। ডাইনিং টেবিলে গিয়ে খেতে পারছে। বাকি সময় নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। বেশি কথা বলে না।

মেরিনাকে বলে, মগবাজারের বাড়িতে ঢোকা আমার জন্য সহজ। ওরা তো আমাকে দেখে চমকে উঠবে। ভাবতেই পারবে না যে আমি আবার ওই বাড়িতে যেতে পারব। আমি শাশুড়িকে সব কথা বলব। অসুস্থ হয়ে গেলে ওরা আমাকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল, বলব। আশপাশের লোকজন আমাকে মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, বলব। এর পরে কাপড়চোপড় নিতে এসেছি বলতে পারব। আমার দু-তিনটি বোমা ও গ্রেনেড দরকার, মেরিনা। কোথায় থেকে জোগাড় করা যাবে?

ধরো, বোমা পাওয়া গেল। কিন্তু ওই বাড়িতে গিয়ে বোমা ফাটালে তুমি কি…

তুমি আমার কথা ভাবছ কেন?

আমি তো নিজের মৃত্যু হাতে নিয়েই ওই বাড়িতে ঢুকব। যারা যুদ্ধ করছে, তারা কি মৃত্যুকে সামনে রেখে যুদ্ধ করছে না?

মেরিনা চুপ করে থাকে। মাহমুদার দিকে তাকিয়ে ওর চোখের পলক পড়ে না। একসময় চোখ নামিয়ে বলে, আমরা ঠিক করেছি, আগস্ট মাসে পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে আমরা শহরজুড়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেব। আমাদের অনেক পতাকা বানাতে হবে। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে, মাহমুদা?

না। পতাকা বানানোর সময় আমি পাব না। আমি দু-এক দিনের মধ্যে মগবাজারের বাড়িতে ঢুকতে চাই। আঙ্কেল যদি আমাকে গ্রেনেড আর হাতবোমা জোগাড় করে দেন।

জোগাড় করতে হবে না। এ বাড়িতেই তোমার চাহিদার জিনিস আছে, মাহমুদা।

এই বাড়িতে?

হ্যাঁ, এটা একটা দুর্গবাড়ি। আগামীকাল ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা আসবে বাড়িতে। এখান থেকে অস্ত্র নিয়ে ওরা অপারেশনে যাবে।

মাহমুদা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে, কখন আসবে? আমার সঙ্গে দেখা হবে?

হ্যাঁ, দেখা তো হবেই। ওরাও তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য আগ্রহী হবে।

পরক্ষণে ও চুপ করে যায়। ঝিম মেরে বসে থাকে।

কী হয়েছে, মাহমুদা?

মায়ের কথা মনে হচ্ছে।

মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমি তোমার সঙ্গে যাব।

না, আমি মায়ের দুঃখ বাড়াতে চাই না। ওই পরিবারে আমি আর ঢুকতে চাই না। বাবা যখন আমাকে বিয়ে দিয়েছিলেন, তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আব্বা, ওদের সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ নিয়েছেন তো? আব্বা বলেছিলেন, ওরা নামী লোক,। মগবাজারে বড় বাড়ি আছে, অনেক সম্পদের মালিক। তুই সুখে থাকবি।

আমি বাবাকে বলেছিলাম, আব্বা, টাকাপয়সা থাকলে সুখ হয়? বাবা আমাকে বললেন, মাগো, তর্ক দিয়েও সুখ হয় না। আমি বললাম, আব্বা, আপনি তো ছেলেটির কথা কিছুই জানেন না। বাবা বললেন, দরকার নেই, মা। তোমাকে তোমার সুখ…। আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, আল্লাহ আপনাকে সুখে রেখেছে, আব্বা। সে জন্য আপনি সুখের উল্টা পিঠটা কেমন, তা বুঝতে পারেন না।

তারপর একদিন বাবাকে বলেছিলাম, যে জুয়াড়ি এবং মাতাল তার সঙ্গে তো সুখ হয় না, আব্বা। বাবা বলেছিলেন, মানিয়ে নাও। বাচ্চাকাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি ঠিক করার চেষ্টা করিনি, মেরিনা। ভেবেছিলাম দিন গড়াবে না। এখানকার পাট আমার চুকাতে হবে। আমার মাস্টার্স পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। এর মধ্যে যুদ্ধ। আমি বুঝলাম যে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছি। আমার মা-ও আমার পথের বাধা ছিলেন। তিনি কিছুতেই চাননি যে ওই বাড়ি থেকে আমি চলে আসি। তাহলে তার মেয়ের কলঙ্ক হবে। মেয়ের কলঙ্কের বোঝা তিনি সইতে পারবেন না। মায়ের সুখের দিকে তাকিয়ে আমি নিজেকে দমন করেছি। হায় আল্লাহ, সেটা যে এভাবে গড়াবে, তা কি আমি জানতাম!

মাহমুদা দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে। মেরিনা ওকে এক গ্লাস পানি দিলে ও একচুমুকে পানি খায়। মেরিনা গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলে, কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকো।

ও বিছানায় গড়িয়ে পড়ে বালিশে মুখ গোঁজে। বালিশ থেকে চমৎকার গন্ধ আসছে। কিসের গন্ধ ও বুঝতে পারে না। ফুলের, নাকি কোনো সুগন্ধির? মাহমুদা ভুলে যেতে থাকে পুরো অতীত। ওর সামনে এখন শুধুই ভবিষ্যৎ। আর তা আশ্চর্য সুগন্ধিময়। ওর চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৌরভ ছড়াতে থাকে।

 

কয়েক দিন পর মারুফ বাড়ি ফিরে আসে।

মেরিনার কাছ থেকে প্রথমে পুরো ব্যাপারটা শোনে। বলে, ওহ্, এই ঘটনা! এখন এ বাড়িটা শুধু দুর্গবাড়ি নয়, এ বাড়ি এখন একটি যুদ্ধক্ষেত্র।

সে জন্য মাঝেমধ্যে আমি শঙ্কিত থাকি, ভাইয়া। মনে হয়, কখন এই বাড়িটা আবার রাজাকারদের নজরে পড়ে। ওরা আর্মি দিয়ে এই বাড়ির ভিটেয় ঘুঘু চরাবে।

থাক, এসব এখন ভাবিস না। তুই মাহমুদা আপাকে ডেকে নিয়ে আয়।

আয়শা খাতুন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ছেলের কাছে আসেন।

কী খাবি, বাবা? আলাদা কিছু রাঁধব?

পুঁইশাক আর চিংড়ি মাছ, মা।

বাতাসি মাছের চচ্চড়ি? তুই খেতে ভালোবাসিস।

মাছ কি ফ্রিজে আছে?

আছে তো। কবেই কিনে রেখেছি।

দারুণ হবে। মুগের ডাল, মা।

মেন্যুটা ভালোই দিয়েছিস। মাহমুদাও এমনই খেতে চায়। মাংসমুরগি—এসব ও খেতেই চায় না।

মেরিনা আর মাহমুদা একসঙ্গে ঘরে ঢোকে।

মারুফ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি আপনাকে চিনি। দেখিনি, এইটুকুই যা।

মাহমুদা মৃদু হেসে বলে, এই বাড়ির সবাই এমন। আপনি আলাদা হবেন কেন?

মারুফ ওর কথায় থমকে যায়। হঠাৎ করে কী বলবে বুঝতে পারে না। মেরিনা এক বাটি চালতা-মাখা সবার সামনে ধরে।

খেয়ে দেখো একটু। নুন-মরিচ দিয়ে মাখিয়েছি।

কেউই খেতে রাজি হয় না। মেরিনা কোনার চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে চালতা-মাখানো খায়। আয়শা খাতুন রান্নাঘরে চলে গেছেন। আকমল হোসেন নিজের ঘরে পড়ার টেবিলে। মারুফ আগামীকালের অপারেশনের কথা মাহমুদাকে বলে যাচ্ছে। কীভাবে কী ঘটবে, তার পুরো বর্ণনা দিচ্ছে। মাহমুদা এখন এক মনোযোগী শ্রোতা। এক দিনের কম সময় ওর সামনে। মারুফের কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে ও রোমাঞ্চিত হয়।

ফার্মগেট অপারেশন আমাদের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, গ্রিন রোডে ঢোকার মুখে হাতের বায়ে যে সিনেমা হলটি হচ্ছে, ওখানে পাহারা দেয় একজন সেনা। ওখানে লাইট মেশিনগান বসানো আছে। ট্রাফিক আইল্যান্ডের ওপর এবং ফুটপাতেও পাহারা বসানো আছে। ওখানে তাঁবু খাঁটিয়ে মিলিটারি পুলিশ ও ওদের সহযোগী রাজাকার থাকে।

এত পাহারার মধ্যে আমরা ঢুকে পড়ব।

আমাদের সঙ্গে থাকবে চায়নিজ এএমজি আর স্টেনগান! আরও থাকবে ফসফরাস বোমা ও গ্রেনেড-৩৬। আমাদের অপারেশনের সময় ঠিক হয়েছে রাত ৮টা থেকে ৮টা ৫ মিনিট।

মাত্র পাঁচ মিনিট?

মাহমুদার মনোযোগী দৃষ্টিতে বিস্ময়। মাত্র পাঁচ মিনিটে অপারেশন হবে।

মারুফ বলতে থাকে, আমরা এখন একটি ফক্স ওয়াগন গাড়িতে করে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছি। আমার আব্বা আমাদের হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র গুছিয়ে দিয়েছেন। আমরা প্রথম রেকি করেছি দুপুরের দিকে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ফাইনাল রেকির কাজ শেষ করা হয়। ওই সময় আমরা খেয়াল করেছি, চেকপোস্টে মিলিটারি পুলিশ ও রাজাকার পাহারা দিচ্ছে। মিলিটারি কেউ নেই। ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে এবং ক্যান্টনমেন্টের দিকে জিপ ও কনভয় আসা-যাওয়া করছে।

আমাদের সময় মাত্র পাঁচ মিনিট।

আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটাব।

আমরা ছয়জন গেরিলাযোদ্ধা।

আমরা ফার্মগেটে পৌঁছে গেছি। আমাদের লক্ষ্য আইল্যান্ড ও ফুটপাত।

গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওপেনিং কমান্ড হয়, ফায়ার।

পুরো এক মিনিট ব্রাশফায়ার চলে।

ঠিক এক মিনিট পর কমান্ড হয়, রিট্রিট।

মুহূর্তের মধ্যে গাড়িতে উঠে পড়ে সবাই। তার আগে ছুড়ে দেওয়া হয় ফসফরাস বোমা ও গ্রেনেড-৩৬।

আমরা দেখলাম, বোমা ও গ্রেনেড ফাটল না। ভুলে ওই দুটোতে ডেটনেটর ফিউজ লাগানো ছিল না।

আমরা দেখেছি, ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছে পাঁচজন মিলিটারি পুলিশ ও ছয়জন রাজাকার।

আমরা নিরাপদে চলে আসতে পেরেছিলাম।

আমরা পাঁচ মিনিট সময় রেখেছিলাম আমাদের পরিকল্পনায়। কিন্তু আমাদের পাঁচ মিনিট সময় লাগেনি।

মাত্র তিন মিনিট সময়ে আমরা শেষ করেছি অপারেশন।

এবং আমাদের অপারেশন সাকসেসফুল।

আমাদের গাড়ি ছুটছে। আমরা হাইডে চলে যাচ্ছি।

 

ফোনের এপাশ থেকে মাহমুদা বলে, আপনাদের কনগ্রাচুলেশনস। আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলেন।

মাহমুদা রিসিভার আকমল হোসেনকে দেয়। মারুফের সঙ্গে ওর কথা হয়েছিল, অপারেশন থেকে ফিরে ও বাড়িতে একটি ফোন দেবে। মাহমুদা সবাইকে বলেছিল, ফোনটা ও ধরবে। ঘড়ি দেখে আকমল হোসেন সবাইকে নিয়ে ফোনের কাছে এসে বসেছিলেন। ফোন বেজে উঠলে তিনি মাহমুদাকে

বলেছিলেন, ফোনটা ধরো, মা। মারুফই হবে।

নিজে কথা বলে ফোনটা আকমল হোসেনকে দেয় মাহমুদা। তিনি হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসে মারুফের কণ্ঠ, আব্বা, সবকিছু ঠিকঠাকমতো হয়েছে। আমরা হাইডে চলে এসেছি।

কনগ্রাচুলেশনস, বাবা। সাবধানে থেকো।

ফোন রেখে দেয় মারুফ। আকমল হোসেন রিসিভার রাখার সময় চেঁচিয়ে ওঠে মেরিনা।

হিপ হিপ হুররে। মনে হচ্ছে, বাড়িতে একটা ফসফরাস বোমা ফাটাই।

হাসিতে ভেঙে পড়ে সবাই।

এই বাড়িতে আসার পর মাহমুদা এই প্রথম প্রাণখোলা হাসিতে উচ্ছ্বসিত হয়।

হাসতে হাসতে বলে, মনে হচ্ছে আকাশে হাজার হাজার বেলুন ওড়াই। সঙ্গে হাজার হাজার পায়রাও থাকবে।

আয়শা খাতুন বলেন, তোমাকে আজ মিষ্টি খাওয়াব, মা। তুমি একদিনও মিষ্টি খাওনি।

হ্যাঁ, খাব। চমচম খাব। আজকে যা দেবেন, তা-ই খাব।

আয়শা চমচম আনার জন্য আলতাফকে দোকানে পাঠান। ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করেন। দু-তিন রকম পিঠা বানানো হয়েছিল মারুফের জন্য, সেগুলোও বের করেন। বেশ কিছুক্ষণের জন্য আড্ডা জমে ওঠে। আবার বিষণ্ণ হয় মাহমুদা। বুঝতে পারে, আনন্দের মধ্যে নিজেকে ধরে রাখা খুবই কঠিন। সেদিনের ঘটনার পর থেকে জীবনের চিত্রপট পাল্টে গেছে। ও চেষ্টা করেও অনেক কিছু খুঁজে পায় না।

রাতে খাবার টেবিলে বসে ও সবার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি কাল সকালে সূর্য ওঠার আগে মগবাজারের বাড়িতে যেতে চাই, আঙ্কেল।

এত ভোরে?

ভোরেই যেতে চাই। নইলে বাবা-ছেলে কাজে বেরিয়ে যেতে পারে।

কেউ আর কথা বাড়ায় না। তিনজনই জানে, ও কারও কথা শুনবে না। ও দুদিন ধরে নিজেকে প্রস্তুত করেছে।

আঙ্কেল, আপনি কখন আমাকে ফসফরাস বোমা আর গ্রেনেড দেবেন?

কাল সকালে। তুমি বের হওয়ার আগে।

ও মাথা নেড়ে বলে, আচ্ছা।

মেরিনা-মাহমুদা খাবার টেবিল থেকে উঠে যায়। দুজন বারান্দায় গিয়ে বসে। আকমল হোসেন আর আয়শা উঠতে পারেন না। এঁটো হাত ধুতেও ওঠেন না। দুজনে থালার ওপর আঙুল নাড়ান। দুজনেই এক চুমুক পানি খান। দুজনেই খুব বিষয় বোধ করেন। আগামীকাল কী ঘটবে, তা তাঁরা জানেন না। শুধু জানেন, এ মেয়েটিকে তারা হারাবেন। ও কঠোর প্রতিজ্ঞায় নিজেকে যুক্ত করেছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর আয়শা বলেন, তুমি চা খাবে?

হ্যাঁ, চা চাই। কিন্তু তুমি উঠবে না। মন্টুর মাকে বলো।

মন্টুর মা কাছেই ছিল। বলে, চুলায় গরম পানি আছে। আমি এখনই চা আনছি।

তখন গুনগুন ধ্বনি তোলেন আয়শা, এই শ্রাবণের বুকের ভেতর আগুন আছে—সেই আগুনের কালো রূপ যে আমার চোখের পরে নাচে…

মাহমুদা চমকে উঠে মেরিনার হাত চেপে ধরে।

মেরিনা মৃদুস্বরে বলে, আমার মা। এ জন্য মুক্তিযোদ্ধারা আমার মাকে জয় বাংলা মামণি ডাকে।

আমিও তা-ই ডাকব। গান শেষ হলেই আমি জয় বাংলা মামণির পায়ে চুমু দেব। বলব, আজ আমার জীবন ধন্য হলো।

ধ্বনি ছড়াতে থাকে—ও তার শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে ওই দিগন্তরে—তার কালো আভার কাঁপন দেখো তালবনের ওই গাছে গাছে…।

টেবিলে চা আসে। আকমল হোসেন চায়ের কাপ সামনে নিয়ে বসে থাকেন। দুকান ভরে বাজতে থাকে গানের বাণী। গেটের কাছে বসে থাকা আলতাফ কান খাড়া করে। খুশিতে হাত নাড়তে নাড়তে বলে, জয় বাংলা মাগো। রান্নাঘরে বসে মন্টুর মা ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে পারে না। মুঠিভরা ভাত নিয়ে হাত থালার ওপর স্থির হয়ে থাকে। ভাবে, আজ রাতে ভাত না খেলেও ওর খিদে পাবে না।

গানের সুরে মগ্ন হয়ে গেছে মাহমুদা। ওর মনে হয়, এই মুহূর্তে গানের গুনগুন ধ্বনি ছাড়া বিশ্বসংসারের আর কোনো কিছুই ওর সামনে নেই। আগামীকাল ও একটি মৃত্যুর ঝুঁকি নেবে, সে কথাও ওর মনে আসে না। সুরের ব্যাপ্তি ওর সবটুকু দখল করে রাখে।

আয়শার কণ্ঠস্বর কখনো চড়া হয়-বাদল-হাওয়া পাগল হলো সেই আগুনের হুংকারে—দুন্দুভি তার বাজিয়ে বেড়ায় মাঠ হতে কোন মাঠের পারে—ওরে, সেই আগুনের পুলক ফুটে কদম্ববন রাঙিয়ে উঠে—সেই আগুনের বেগ লাগে আজ আমার গানের পাখার পাছে…

একসময় গুনগুন ধ্বনি থেমে যায়।

একসময় ঘুমানোর সময় হয়।

রাত বাড়ে। আকাশে নক্ষত্রপুঞ্জের জ্বলজ্বলে আভা পৃথিবীর ওপর নেমে আসে। মাহমুদা চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলে, আশ্চর্য এক সুন্দর রাত পেয়ে আমার জীবন ধন্য হলো। মেরিনা, আরেক জীবনে তুমি আমার বন্ধু হবে।

চলল, তোমাকে তোমার ঘরে দিয়ে আসি। মাহমুদা কথা বাড়ায় না। উৎফুল্ল থাকার চেষ্টা করে। বলে, তুমি আমাকে অ্যালার্ম ঘড়ি দিয়েছ, সে জন্য থ্যাংকু, মেরিনা।

আমার ঘরেও একটি অ্যালার্ম ঘড়ি আছে। মা-বাবাও ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়েছেন, মাহমুদা। তুমি ঘুমাও।

গুড নাইট, মেরিনা।

মাহমুদা দরজায় সিটকিনি লাগায় না। দরজা মুখে মুখে লাগিয়ে রাখে। মশারির নিচে ঢুকতে ঢুকতে বলে, আম্মা, বিদায়। আব্বা, বিদায়। সনজিদা, ফাহমিদা, আশফাঁক, বিদায়। আমার সব আত্মীয়স্বজন, বিদায়। আজ রাতই আমার শেষ ঘুমের রাত। বিদায়, মুক্তিযোদ্ধারা।

মাহমুদা বালিশে মাথা রাখলে ওর ঘুম আসে। ও দ্রুত গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

 

টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে আকমল হোসেন নিজের কাগজপত্রের পাতা উল্টান। দেখতে চান কোথায় কী ঘটছে। দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় লেখা হয়েছে, কয়েকটি সামরিক আদেশ জারি করা হয়েছে। এই আদেশে রাজাকারদের যেকোনো লোককে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

তিনি একমুহূর্ত ভাবলেন। আয়শার দিকে তাকালেন। দেখলেন, আয়শা মনোযোগ দিয়ে সোয়েটার বুনছেন। ভাবলেন, ও ওর মতো থাকুক। ওর সঙ্গে এত রাতে এসব শেয়ার করার দরকার নেই। সকালে মেরিনাকে বলবেন যে সামরিক আইনকে আরও নিপীড়নমূলক করা হয়েছে। রাজাকারদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাবে।

পাতা উল্টাতে উল্টাতে শান্তি কমিটির নেতা মাওলানা নুরুজ্জামানের বিবৃতি পান। তিনি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ছাত্রছাত্রীদের অভিনন্দন জানান। রাজাকারদের কৃতিত্ব দিয়ে বলেন, একমাত্র তাদের তৎপরতার কারণেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আকমল হোসেন পরিস্থিতি আঁচ করেন। ধরে নেন যে হাতে অস্ত্র পাওয়া রাজাকাররা অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার হলে ঢুকিয়েছে। মেরিনাকে এই কথা বললে ও বলবে, আব্বা, আপনি যে কেন পত্রিকার এসব খবর পড়েন।

পাতা উল্টাতে গিয়ে চোখে পড়ে শান্তি কমিটির নেতাদের সভা। তারা দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। কথার ফুলঝুরি ছড়িয়েছে তারা।

তিনি পত্রিকা বন্ধ করে রাখেন। আয়শার দিকে তাকালে দেখতে পান, আয়শা তার দিকে তাকিয়ে আছেন।

ঘুমাবে না?

তুমি?

মনে হচ্ছে, আজ রাতে ঘুমাতে পারব না।

আমারও তো সে রকম লাগছে।

তার পরও আমরা তো শুয়ে থাকতে পারি।

আকমল হোসেন উঠতে উঠতে বলেন, সেটা হতে পারে। টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে পানি খান। আয়শা খাতুন উল-কাঁটা গুটিয়ে রাখেন।

কতগুলো সোয়েটার হলো?

অনেক বাড়িতেই বানানো হচ্ছে। শ দুয়েক হয়েছে।

অনেক হয়েছে। শীত আসতে আসতে আরও হবে।

শ পাঁচেক তো হবেই।

আয়শা খাতুনও উঠে পানি খান।

আকমল হোসেন বিছানার ধারে দাঁড়িয়ে বলেন, আজকের রাতটা অন্য রকম।

হ্যাঁ। ঘড়িটা মাথার কাছে আনব?

না। টেবিলে আছে টেবিলেই থাকুক। অ্যালার্ম বাজলে ঠিকই শুনতে পাব।

দুজনে ঘুমাতে গেলেন। কিন্তু কেউই ঘুমাতে পারলেন না। বুঝলেন, রাতটা অনেক দীর্ঘ।

 

একসঙ্গে ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজে তিনটি ঘরে।

আকমল হোসেন ধড়মড়িয়ে উঠে বসেন। মাথা ঝিমঝিম করে। আয়শা খাতুন শুয়ে থাকেন। গুটিসুটি হয়ে বালিশ আঁকড়ে ধরেন।

মেরিনা হাত বাড়িয়ে ঘড়ি নেয়। অ্যালার্ম পুরো বাজতে না দিয়ে সেটা বন্ধ করে। ঘড়িটা বালিশের নিচে ঢুকিয়ে রাখে। বিছানায় উঠে বসে থাকে। ওর মনে হয়, ওর সামনে সময় স্তব্ধ হয়ে গেছে। বিছানাই এখন ওর পৃথিবী। ও মাথা ঝাঁকায়।

মাহমুদা কানভরে অ্যালার্মের শব্দ শোনে। এই ভোরে শব্দের রেশ—ওর ভালোই লাগে। ও বিছানা ছাড়ে। বিছানা গোছায়। বাথরুমে ঢোকে। মুখহাত পোয়। পানির স্পর্শের স্নিগ্ধতায় নিজেকে সজীব মনে করে। আলমারিতে গুছিয়ে রাখা নিজের শাড়িটা বের করে সেটা পরে। চুল আঁচড়ায়। একমুহূর্ত বিছানার ওপর বসে থাকে। যেদিন ওকে আর্মি অফিসারদের গাড়িতে জোর করে তুলে দেওয়া হয়েছিল, সেদিন ওর কোনো অস্ত্র ছিল না। আজ ওর কাছে অস্ত্র থাকবে। ফসফরাস বোমা আর গ্রেনেড। ওই বাড়ির বাথরুমে ঢুকে ও সেগুলোর পিন খুলবে। তারপর প্রতি ঘরে…। রফিকুল ইসলাম সকালে ড্রয়িংরুমে বসে কাগজ পড়েন। ওখানে একটি। শফিকুল ইসলামের ঘরের দরজা খোলা না পেলে ও নিজেই ধাক্কা দিয়ে ডাকবে। ওর কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠবে শফিকুল ইসলাম। দরজা খুলে বলবে, তুমি! ও বলবে, অফিসাররা আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। আমি কয়েকটি কাপড় নিতে এসেছি। ওদের সঙ্গে থাকতে হলে তো সেজেগুজে থাকতে হয়। ওরা আবার আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসবে। দশ মিনিট সময় দিয়েছে।

পরক্ষণে নিজেকে ধমকায়। এসব ভাবার সময় এটা নয়। ওই বাড়িতে গিয়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। ও বারান্দায় আসে।

আকমল হোসেন বারান্দায় বসে ওর জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছেন—ফসফরাস বোমা আর গ্রেনেড। ওসবের ওপর আয়শা খাতুনের কাপড় দেওয়া হয়েছে। তার ওপরে খবরের কাগজ। মাহমুদার কাছে এলে বলেন, তুমি চা খেয়ে নাও, মা। আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসব।

না, আঙ্কেল। আপনার যেতে হবে না। আমি রিকশায় যাব।

এসব নিয়ে রিকশায় যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি চা খাও। আমি গাড়ি বের করছি। আলতাফও যাবে আমাদের সঙ্গে।

এসো, মা। ডাইনিং টেবিলে মেরিনা বসে আছে তোমার জন্য।

আয়শার দিকে তাকিয়ে মাহমুদার বুক ধক করে ওঠে। এই মানুষটি সেদিন ওকে রাস্তা থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। কালকে তার গুনগুন ধ্বনি দিয়ে ওর জীবন ভরে দিয়েছে।

টেবিলে বসলে মেরিনা ওর দিকে একটি চমচম এগিয়ে দিয়ে বলে, মা তোমাকে খেতে বলেছেন। কালকে তুমি চমচম পছন্দ করেছিলে, সে জন্য মায়ের ইচ্ছা, তুমি একটা চমচম খাও।

আর কিছু না কিন্তু।

সে আমরা বুঝেছি। চমচম খেয়ে চা খাও। তোমার সঙ্গে আমি আর মাও যাব।

সত্যি? মাহমুদা খুশি হয়।

তুমি মাঝখানে বসবে। আমরা দুজন দুপাশে।

মন্টুর মা চা এনে টেবিলে রাখে, আপা, আপনি আবার আসবেন। আপনি তো পোলাও-রোস্ট খাননি। আবার এলে পোলাও-রোস্ট খেতে হবে।

মাহমুদা মুখে কিছু না বলে শুধু ঘাড় নাড়ে।

তখন গাড়ি রেডি করে খবরের কাগজে চোখ বোলান আকমল হোসেন। শিক্ষার পাঠ্যসূচি সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পাঠ্যসূচি থেকে উদারনৈতিক চিন্তা-চেতনা বাদ দিয়ে মৌলবাদী চেতনার বিকাশ ঘটানোর কথা বলা হয়। এ প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানান জামায়াতে ইসলামী নেতা গোলাম আযম। তিনি পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলাম-পরিপন্থী সব লেখা বাদ দেওয়ার কথা বলেন।

শিক্ষা সংস্কারকে অভিনন্দন জানিয়ে স্মারকলিপি দেয় ইসলামী ছাত্রসংঘ। বলা হয়, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সমাজের জন্য প্রবলভাবে ক্ষতিকর। এই শিক্ষা সমাজকে হিন্দুবাদ-ইহুদিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা জন্মগতভাবে পাকিস্তানি। কিন্তু পাঠ্যসূচিতে অনেক কিছু আছে, যা পাকিস্তানের আদর্শ, সংহতি ও অখণ্ডতার পরিপন্থী। ইসলামি সমাজ কায়েমের লক্ষ্যে ইসলামি শিক্ষা প্রবর্তন করা উচিত।

ইসলামী ছাত্রসংগঠন সহশিক্ষা বাতিলের দাবি জানায়। তারা বলে, সহশিক্ষা আমাদের সমাজের জন্য অভিশাপ। এর দ্বারা তরুণসমাজের চারিত্রিক অধঃপতন ঘটছে। সহশিক্ষা ব্যবস্থা আর চলতে দেওয়া উচিত না। একে বিলুপ্ত করতে হবে।

আকমল হোসেন এটুকু পড়ে মৃদু হেসে অন্য পাতায় যান। ডাইনিং টেবিল থেকে মাহমুদা আর মেরিনার কথা ভেসে আসছে। আকমল হোসেন উফুল্ল বোধ করেন। মেয়েটির স্পিরিট তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। মেয়েটি ভীত নয়। বেঁচে থাকার চিন্তায় তাড়িত নয়। আয়শা খাতুন তার পাশে এসে বসেন। বলেন, আমি রেডি। তুমি কি চা খাবে?

এখন না। ফিরে এসে খাব। আমি ওদের জন্য অপেক্ষা করছি। ওরা আসুক আমার কাছে। আমি ওদের ডাকব না।

তিনি আবার কাগজের পৃষ্ঠায় ফিরে যান। দেশের কত জায়গায় শান্তি কমিটির নেতারা সভা করে, সে খবর পড়েন। প্রথমে কুমিল্লার হাজীগঞ্জ-তারা দেশের পরিস্থিতির জন্য ভারতকে দায়ী করে। তার পরের সভা হয় সিলেটের রেজিস্টার ময়দানে। সভা শেষে রাজাকাররা কুচকাওয়াজ করে। সভা হয় চৌমুহনীতে। তারপর চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে। এখানে ছয়জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ঘাঁটি আক্রমণ করে। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এরপর ময়মনসিংহ। শান্তি কমিটির গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা রাজাকারের হাতে তুলে দেয় দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে। এরপর পাংশা। এলাকার দালালেরা বলে, রাজাকার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সার্বক্ষণিক সতর্ক প্রহরার কারণে এলাকায় শান্তি বিরাজ করছে।

একনজরে সবটুকু পড়ে তিনি কাগজ ভাঁজ করেন। শান্তি কমিটির দালালেরা কোথায় কী করছে, তা জেনে রাখা তিনি জরুরি মনে করেন। সে জন্য খুঁটিয়ে কাগজ পড়েন।

কাগজ ভাঁজ করে সামনে তাকালে তিনি দেখতে পান, আলতাফ গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পুবের আকাশ লাল করে সূর্য উঠি-উঠি করছে। আকমল হোসেন আয়শার দিকে তাকিয়ে বলেন, চমৎকার আগুনে-আভার আকাশ।

আয়শা চুপ করে থাকেন। একটু পর কী হবে, তা ভেবে বুক ধড়ফড় করে। তোলপাড় করছে তার ভেতরের সবটুকু।

মাহমুদা আর মেরিনা কাছে এসে দাঁড়ায়।

মাহমুদা শান্ত কণ্ঠে বলে, আমি এখন যেতে চাই। আমাদের এখনই বের হতে হবে। আর দেরি করা ঠিক হবে না।

আকমল হোসেন ব্যাগটা এগিয়ে দিয়ে বলেন, এটা তোমার ব্যাগ। আমি তোমাকে পিন খোলা শিখিয়েছি।

আমার ভুল হবে না। আপনার কাছ থেকে যা শিখেছি, তা আমি ঠিকঠাকমতো করতে পারব। বাকিটা আমার ভাগ্য। আমার জয় বাংলা মামণির দোয়া। মেরিনার ভালোবাসা। আর আপনার মতো একজন বাবার স্নেহচ্ছায়ায় কয়েকটি দিন কাটানো আমার জীবনের বিরল সৌভাগ্য। আমি রেডি।

তাহলে চলো। তোমার যাত্রা শুভ হোক, মা।

মাহমুদা একমুহূর্ত দাঁড়ায়। দুহাতে চোখ মুছে আয়শা খাতুনের পায়ের কাছে বসে পড়ে। আয়শা খাতুন ওকে টেনে তোলেন। বলেন, এখন তোমার মনের জোর দরকার।

মনের জোর আমি একটুও হারাইনি মামণি।

আয়শা খাতুন ওর গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

আপনারা আমাকে শান্তির মৃত্যু দিচ্ছেন, সে জন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।

কাউকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ও সোজা আলতাফের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

আপনার কাছে আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আপনি যদি সেদিন আমাকে পথ থেকে তুলে না আনতেন, তাহলে আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য এই কাজটুকু করার সুযোগ পেতাম না।

আলতাফ দুহাতে চোখ মুছে নিজেকে সামলায়। চোখ মোছেন আয়শা আর মেরিনা। রান্নাঘরে বসে হাউমাউ করে কাঁদে মন্টুর মা।

গেট থেকে গাড়ি বের হয়। মাহমুদার কোলের ওপর ব্যাগ। ও দুহাতে ব্যাগ ধরে রাখে। ওর দুপাশে বসে আছে আয়শা আর মেরিনা।

আঙ্কেল, আপনি আমাকে মগবাজার রেললাইনের কাছে নামাবেন। তোমার ঠিকানা তো আরেকটু সামনে।

আমার মনে হয়, বাড়ির কাছাকাছি যাওয়া ঠিক হবে না। আশপাশে রাজাকাররা থাকতে পারে। আমি একটি রিকশা নেব।

আচ্ছা। তুমি যা বলবে আজ আমি সেটাই করব। সিদ্ধান্ত তোমার। আমরা তোমার সহযোগী মাত্র।

অল্পক্ষণেই মগবাজার রেললাইনের কাছে পৌঁছে যায় গাড়ি।

আকমল হোসেন গাড়ি থামান। মেরিনা দ্রুত দরজা খুলে নামে। ওর হাতের ব্যাগ নিজে নিয়ে ওকে নামতে সাহায্য করে। আলতাফ নেমে একটি রিকশা দাঁড় করিয়েছে।

মাহমুদা মৃদুস্বরে বলে, বিদায়, জয় বাংলা মামণি।

বিদায়, মেরিনা।

রিকশাটা চলে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকেন আকমল হোসেন। আয়শা খাতুন-মেরিনা গাড়ির ভেতরে। তিনি দেখতে পান, আলতাফ নিজেকে সামলাতে পারছে না। কেঁদেকেটে বুক ভাসাচ্ছে।

আকমল হোসেন ধমক দিয়ে বলেন, থামো।

ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, স্যার, বাড়ি চলেন।

এখানে আর কিছুক্ষণ থাকব।

আশপাশের লোকজন কিছু ভাবতে পারে। সন্দেহ করতে পারে। দুচারজন দেখেছে যে রিকশাওয়ালার ভাড়া আপনি দিয়েছেন।

আমাদের গাড়ির ইঞ্জিন খারাপ হয়েছে, এমন ভান করতে হবে। গাড়ির ঢাকনা খোলো।

আয়শা খাতুন বলেন, তুমি এখানে থাকতে চাইছ কেন? আমাদের কাজ তো শেষ হয়েছে।

পনেরো মিনিট এখানে অপেক্ষা করে ওই বাড়ির গলিতে ঢুকব। জানতে হবে তো মাহমুদা কিছু ঘটাতে পেরেছে কি না।

মেরিনা সোৎসাহে বলে, আব্বা ঠিকই বলেছেন। আমাদের শেষ দেখে যাওয়া উচিত।

আকমল হোসেন গাড়ির ইঞ্জিনের ওপর ঝুঁকে পড়েন। চারদিকে রোদ ছড়িয়েছে। আলো-ঝলমল দিনের শুরু হয়েছে। রাস্তায় মানুষের চলাচল দেখা যাচ্ছে। তিনি ঘড়ি দেখেন। দশ মিনিট শেষ হয়েছে। ভাবেন, এখন সরে পড়াই দরকার। দরকার হলে মালিবাগ-রামপুরা চক্কর দিয়ে এসে মগবাজারের গলিতে ঢুকবেন, যেখানে মাহমুদার রাজাকার শ্বশুরের বাড়ি।

রেলগেট ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে মগবাজার চৌরাস্তা থেকে বাঁয়ে মোড় নিতেই সামনে হইচইয়ের শব্দ পান। মানুষজন চেঁচামেচি করছে। বোমা বোমা—পালাও পালাও!

তার পরও তিনি গাড়ি গলিতে ঢুকিয়ে শাঁই করে সেই বাড়ির সামনে দিয়ে বেরিয়ে যান। গাড়িতে বসে অন্যরা বাড়িটা দেখে। জানালা দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচিতে চারদিকে হুলস্থুল। আকমল হোসেন গাড়ি নিয়ে মেইন রোডে ওঠেন।

গাড়ি ছুটছে তীব্র গতিতে।

পার হয়ে যাচ্ছে বেইলি রোড, কাকরাইল, বিজয়নগর, দৈনিক পাকিস্তান চৌমাথা, মতিঝিল।

মেরিনা মায়ের হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলে, স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বড় মূল্য দিয়েছে মাহমুদা।

ও আমাদের ইতিহাস।

গাড়ি তখন হাটখোলার বাড়ির সামনে এসে থামে। আলতাফ গেট খুলে দেয়।

আকমল হোসেন আয়শার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, আজ আমার ডায়েরির পৃষ্ঠায় সবচেয়ে বড় অক্ষরে মাহমুদার কথা লিখব।

আলতাফ নিজেকে আর সামলাতে পারে না। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *