০৮. দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে

দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে প্রায়ই যাদের ব্রিং খেলতে দেখা যেত সেইসব ধূসর আবছা ছেলেদের সকলের নামই এখন জানা হয়ে গিয়েছে। কারো নাম ফকিরা কারো নাম টোকানি,—গেনদু লাটু ফালানি, মিয়াচাঁন আরো অনেকে।

অনুকেও তারা চিনেছে।

একদিন পকেট বোঝাই করে মার্বেল নিয়ে এলো, খেলা শিখলো। কিন্তু ফকিরা বা ফালানিদের মতো তুখোড় ওস্তাদ খেলুড়ে সে নয়, আগলিতে মারতে গিয়ে পিরিতে লাগিয়ে কিংবা পিছলির বদলে আগলিতে লাগিয়ে তার সব ব্রিং অতি অল্পক্ষণের মধ্যে সহজেই নিঃশেষিত হয়ে গেল। বেশকিছু পয়সাও গেল তার। জিত্তির মার্বেলগুলো প্রতিটি তিন পয়সা দরে তার কাছে বেচলো টোকানি, আবার খেললো এবং যথারীতি খোয়া গেল পরক্ষণেই।

কোনো আক্ষেপ নেই। মার্বেলগুলোর বিনিময়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই দলের কাছে খুব সহজ হতে পেরেছে, এতেই আনন্দ। সে খুশি। যারা হেরে গিয়ে নিঃসঙ্কোচে ফতুর হতে পারে সব বাহবা তো তাদেরই–এই রকমই একটা উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্য করেছিলো ফকিরা।

ফকিরা আর টোকানি বয়েসে কিছুটা বড় দলের মধ্যে। ওরা দুজন তাই সময়-অসময়ে খিস্তি আর গায়ের জোরে আপন-আপন মর্জিমাফিক নিছক স্বেচ্ছাচার চালিয়ে যায়, ছিনিয়ে নেয় অনেক কিছু এবং অনুর চেয়েও ছোটো লাটু গেনদুর মতো অসহায় ছেলেরা সে হামলা প্রতিরোধ করতে না পেরে ব্যর্থ আক্রোশে ফুলতে থাকে। বরং তুলকালাম শুরু হলে অনু মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, চেষ্টা করে কোনো একটা সন্তোষজনক মীমাংসায় পৌঁছে দিতে; এখানে আর কিছুই করার নেই তার, যা সে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছের জোরে অনায়াসে চালাতে পারে।

ফকিরারা এখন লামাদের বাগানে ব্রিং-এর পাট উঠিয়ে দিয়েছে। লামার মামা–যিনি রেডিওতে খাম্বাজ হাম্বীর মালহার ইত্যাদি গেয়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন এখন আর তিনি জীবিত নন। তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন বলেই লামাদের ছায়াঢাকা বাগানের আনন্দ বাজেয়াপ্ত হয়ে গিয়েছে।

বৃত্তান্তটা ফকিরার মুখ থেকে শোনা।

মরাকাডের কসম কর‍্যা কতাছি হালার পো হালা পাগলাডা হেইদিনকা আমারে একলাটি পায়া যা তারাডি করছিলো।

ফালানি প্রথমে বিশ্বাস করে নি।

সে বলেছে, গানজা মারোনের আর জাগা পাইতাছস না বুঝি?

ফকিরা নাছোড়বান্দার মতো বলেছে, যা না বে, ঘুইরা আয়না দেহি, হিম্মত আছে নি? পেরথম দেহিকি ভূত হয়া বয়া বয়া চক্ষুবন করা হালার পো হালায় গামা-উমা কয়া কাওয়ালি গাইবার লাগছে। আমার আতে আছিলো এউগা আস্তা মালপো। চক্ষু খুইলা আমারে দেইখাই অক্করে ভান কর‍্যা আয়া মালপোয়াডা লয়া গেলগা–

সত্য-মিথ্যা জানে না, মোটকথা এইসব সূত্রেই লামাদের বাগানের বদলে তাদের সকলকে অন্যত্র স্থান বেছে নিতে হয়েছে।

বেশকিছুটা দূর হয়ে যায়। তবু সে খুশি। সবসময় নিজেদের বাড়িটা চোখের সম্মুখে পাহারাদারের মতো খাড়া দাঁড়িয়ে থাকলে অনায়াস হওয়া যায় না, অহেতুক ভয় ভেতরে ভেতরে কেবলই দুরু দুরু করতে থাকে।

হাম্মাদের নড়বড়ে দোকানের পেছনে খুব নিরাপদ স্থান বেছে নিয়েছে ফকিরারা। ছিপ হুইল বড়শি পিঁপড়ের ডিম আর রকমারি মাছের চার এইসব সাজিয়ে বুড়ো হাম্মাদ হাতের তালুর ওপর কাত হয়ে শুয়ে থাকে, মেথির গন্ধে বুদ হয়ে সারাদিন অকাতরে ঘুমায়।

অনুর মনে হয় পিঁপড়ে কিংবা তাদের বিভিন্ন গোত্র জীবনযাপন সবকিছু একেবারে শেষ পর্যন্ত হাম্মাদের (আহম্মদ?) জানা হয়ে গিয়েছে, আর সেই জন্যই তার আর কিছু করণীয় নেই, ভাবনার নেই, শুধু এই একটা কারণেই সে নির্বিবাদে ঘুমায়।

হাম্মাদের দোকান থেকে খানিকটা দূরে একটা নুয়ে পড় আখড়া আছে। দোকানের পেছনে দাঁড়ালে আখড়ার মটকার ত্রিশূল দেখা যায়। কয়েকদিন থেকেই জয়ঢাকের গায়ে চ্যাটাং চ্যাটাং শব্দে কাঠির ঘা পড়ছে। চড়কপুজোর প্রস্তুতি। শিবের গাজনের সময় এসে গিয়েছে, দুএকদিনের মধ্যেই গাজনের সং বের হবে, পুরোদমে তারই মহড়া চলছে আখড়ায়।

গেনদু অনুকে সাধলো, চলনাবে, গিয়া একনজর দেইখা আহি! মিয়াচাঁন গেনদু আর সে, তিনজনে মিলে গাজনের সং দেখতে চললো আখড়ায়। চলতে চলতে মিয়াচাঁন হু হু করে গান জুড়লো। গেনদু ভেংচি কেটে বললো, চিল্লায়া গানাবে চান-কপাইলা, সবতে মিলা হুনুম। বিয়া হয়া গেলে সোয়ামীর লগে তো চইলাই যাবি!

অনু অবাক হয়ে গেনদুর মুখের দিকে তাকাতেই গেনদু বললে, বুঝচি, বুঝবার পারচ নাই। মিয়াচানের চারা তো সোন্দর আর হেয় গায়ও মিড়া, ঘাটুদলের মাইনসে বিয়া কর‍্যা লয়া যাইবার চায়। বুঝচস কিছু? অর বাপে রাজি অইতাছে না। এতোড়ি মাল ছারবার পারলেই অরে দিয়া দিবো হাত দিয়ে পরিমাণটা দেখালো সে, যাইকগা! গানা বে!

মিয়াচাঁন চিকন গলায় গান জুড়লো;

নাহে নোলক কানে ঝুমকা
মাইয়া একখান বডে
নদর গদর চলে মাইয়া
ফুশুর-ফাশুর রডে

গেনদু বাধা দিয়ে বললে, আব্বাসউদ্দিনের গীত গা না বে, রেকটের গীত ছাড়া অনু হালায় বুঝবার পারবো না। এই হালারে লয়া মুসিবত বাইধাই রইছে।

একটু ভেবে নিয়ে মিয়াচাঁন গাইতে শুরু করলো :

সগাঁর বেড়ায় টাডি টাডি
লালশাড়ি পিনদিয়া
তোলা আছে ঢাকাই শাড়ি
কাঁয় যাইবেক পিনদিয়া
ওকি খশস্যোর কি মশস্যোর করিয়া–

এইভাবে গানে সুর তুলে চালালাৎ-কি-চালালাৎ আর ক্যাররোৎ-কি ক্যাররোৎ করতে করতে মিয়াচাঁন গেনদুর হাত ধরে আখড়ার চৌহদ্দিতে পৌঁছুলো।

ঘেসোভঁড়ি জটাধারী শিব ঘেমে চাবচুব হয়ে চৌকিতে বসে বসে হাতপাখার বাতাস খাচ্ছিলো। আর একটা নড়বড়ে টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে কাত হয়ে ফুক ফুক করে সিগারেটে ঘনঘন টান মারছিলো দশমহাবিদ্যার এক অর্থাৎ কালী, হাতে টিনের লাল জিভ।

কিছু একটা বলতে হয় কতকটা সেই জন্যই সম্ভবত অনু বললে, এখন আর নাচবে না মনে হচ্ছে।

কতো আর নাচবো, হালারা অহনে রেস্ট লইতাছে।

টেবিলের ওপর বসা কালী পা দোলানি বন্ধ করে হাতের পোড়া সিগারেটের টুকরো গেনদুর গায়ের দিকে ছুঁড়ে বেঁকিয়ে উঠলো, বেজাইতা পোলাপান আয়া জুটচে সব, আব্বে নাটকির জানারা ভাগলি?

গেনদু অনুর হাত ধরে বললে, চলবে! হলািগো ডট অইচে। এলায় ফয়-ফকিরনী ভারাইটা কালীর খেতায় আগুন!

হাম্মাদের দোকানের পেছনে টোকানি আর ফকিররা যথারীতি ব্রিং খেলায় মশগুল হয়ে আছে। গেনদু সেদিকে না গিয়ে অন্য পথে পা বাড়ালো।

অনু বললে, ওদিকে যাবে না?

গেনদু মুখ কালো করে বললে, টোকানি আমার গনজি ফাইরা ফালাইচে, জোর কইরা তিনগা পাই কাইরা লইচে, ও হালার লগে আর দোস্তি না, হালায় চোর-চোট্টা। আমাগ পোলাপান পায়া বহুৎ বাহাদুরি দেহায়। কাউলকাই তো অর বাপে কল্লায় মাটামের বারি দিয়া অক্করে খুন

বাইর কর‍্যা দিছিলো!

বটোকানির বাবা ছুতোরের কাজ করে। খুবই গরিব ওরা, কিন্তু টোকা নিকে দেখলে কখনোই তা মনে হয় না, মনে হয় কতো সুখী, দুনিয়ায় ওর কোনো সমস্যাই নেই, কোনো কাজ নেই, কোনো দুর্ভাবনা নেই, এপাড়া ওপাড়ায় বিভোর হয়ে ব্রিং খেলছে তো খেলছেই।

সুখী মনে হয় গেনদুকেও। তার বাবা গাড়োয়ান। ওরা প্রায়ই দুবেলা পেটপুরে খেতে পায় না। পিটুনি খেতে খেতে গেনদু শুকনো উঁটার মতো। হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার শরীরের পাচনবাড়ির অসংখ্য গভীর কালো বিষণ্ণ দাগের মতো দুঃখের অন্য কোনো করুণ চিহ্ন গেনদুর চেহারায় ছিটেফোঁটাও নেই। সেও সময় অসময়ে ব্রিং খেলায় মশগুল হয়ে থাকে। কাচের মার্বেল ফুরিয়ে গেলে কাইবিচি দিয়ে খেলে। কাইবিচি না থাকলে মাটির বাটুল।

চারপেয়ে ফ্রেমে আটকানো লোহার দাঁতাল চাকায় অসময়ের শীর্ণ আখ মাড়াই হচ্ছিলো মসজিদের মুখে, গেনদু অনুর হাত চেপে ধরে অনুনয় করে বললে, খিলাইবা নিহি বন্দু?

সে সহজেই রাজি হয়।

তিনজনে তিন গ্লাস সবুজ রস পান করলো বারো আনায়। মনে হলো তার পেট কেমন যেন ঢকঢক করছে, জিভে জড়িয়ে আছে লোহার গন্ধ।

অনু মুখ সিটকে বললে, ইশ! কী কসটে গন্ধ!

গেনদু ক্ষেপে গিয়ে বললে, তরা এসবতের কি জানস? লর গন্দে শরীল মোডা অইবো, কেঁচকি মাইরা টোকানিরে কাইত কইরা ফ্যালান যাইবো, বুঝচস? তুই হালায় অক্করে বোদাই।

সত্যিই সে অনেক কিছুই জানে না। অনেক জানে এরা। গাছের পাতায় জমে থাকা ধুলো ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করতে পারে গেনদু। গাছের ছায়া নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলতে জানে মিয়াচাঁন। টোকানি ফালানি গেনদু লাটু মিয়াচাঁন নাড়িনক্ষত্র জানে পথঘাটের। ছাগলের গলায় নুনুড়ি দেখলে কি হয়, জোড়া শালিখ দেখলে কি হয়, লাউ কিংবা পুঁইশাকের মাচায় আনজিরা দেখলে কিভাবে হ্যাক থু করে বুকে থুতু দিতে হয়, এক চোখ দেখলে কি কি অঘটন ঘটতে পারে কিংবা অসতী মেয়েমানুষের লক্ষণ কি কি—সবকিছুই ওদের নখদর্পণে। কথায় কথায় হয়তো ফালানি বললে, কি নিয়া চাটগাঁ? পট করে অন্য কেউ জবাব দিলো তখনকার তখনই, সারেঙ শুটকি দরগা! তারপর হয়তো ফালানির পালা। মিয়াচাঁন পালটা জিগ্যেস করলে, কি নিয়া ঢাকা? ফালানি বললে, মশা মোল্লা শাখা।

কখনো তর্ক হয়। গেনদু হয়তো বললো, কিন্তু যে হালায় বানাইছে কডি হেই হালায় মুতবারও আহে নাই ঢাহায়, আইলে বাখরখানির কডি ঢুকাইয়া ছারতো, তরা কি কচ?

হাঁটতে হাঁটতে গেনদু সাপের গল্প জুড়লো।

অনেকদিন আগে গেনদুদের ঘরে একটা সাপ পুরোনো তেঁতুলের হাঁড়ির গায়ে পাক দিয়ে জড়িয়ে ছিলো। কালো কুচকুচে গা, চকচকে চোখ, ঘনঘন জিভ বের করে–

শেষে ওঝা এলো।

ওঝা হেঁট হয়ে দাত মুখ খিচিয়ে একটানে পটাপট কয়েকগাছা মাথার চুল ছিড়ে দুচারটে তুড়ি লাফ মেরে প্রায় এক নিশ্বাসে বলতে লাগলো :

ধ্যাড়ধুড়ধুড়ধ্যাড়ধুড়ধুড়পাহাইড়াবুড়ি
ম্যাড়মুড়মুড়ম্যাড়মুড়মুড়হজরতেরমায়।
ক্যাড়কুড়কুড়ক্যাড়কুড়কুড়কুবেকলাই
প্যাড়পুড়পুড়প্যাড়পুড়পুড়হবেকনাই–

কিন্তু সাপ তেঁতুলের হাঁড়ির গায়ে যে গেরো দিয়েছে কিছুতেই তা আর খুলতে চায় না। ওঝা মুখ কাঁচুমাচু করে কাঁদো কাঁদো গলায় বললে, কাম বাজছে। এযে মাজারের হাপ!

উপায় জানা থাকলে মাজারের সাপও খেদানো যায়। পাঁচসিকে পয়সা, পাঁচপোয়া সেদ্ধচাল, পাঁচটা আলু আর পাঁচটা পিঁয়াজ নিয়ে বিকেল ঠিক পাঁচটায় ওঝা পাঁচবার হাতজোড় করে সবিনয়ে মিনতি জুড়লো, হুজুর আপনে মেরবানি কইরা অহনে যান গিয়া, আমি অনে হিন্নিগুলি দিয়া আইতাছি! তারপর লাঠির মাথায় তুলো দিয়ে লাল নীল সবুজ হলুদ আর কালো এই পাঁচরঙা সুতোয় তা জড়িয়ে দুবার খোঁচা মারতেই সাপটা ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে ডালিমগাছের কোল ঘেঁসে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এদিকে ওঝার নাকে-মুখে রক্ত ওঠার জোগাড়।

মেঝের ওপর চড়াৎ চড়াৎ আছাড় খেয়ে ঠোঁট কামড়ে মাথার চুল ছিড়ে জাবনা খাওয়া গরুর মতো ফোশ ফোঁশ করে ঝোড়ো নিশ্বাস ফেলতে লাগলো সে। যায় যায় অবস্থা। অনেক পরে গামছা দিয়ে গলার ঘাম মুছে সুস্থির হয়ে বললে, যা বাঁচাড়া বাঁচছেন হেইয়া আর কইলাম না। ইচ, যাওনের সমৎ অক্করে আমার কইলজার হিকড় ধইরা টান দিয়া গ্যাছে!

গল্প শেষ হলে গেনদুর মুখের দিকে তাকিয়ে অনু সবিস্ময়ে বললে, এমন হয়?

অইবো না কেল্লা? গেনদু বললে, তুই এলায় অক্করে ম্যানথামারা পোলা, তরে লয়া চলে না।

অনু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বললে, ওঝা মন্ত্র শোনালে কি হবে সাপ তো আর কানে শোনে না।

কান দিয়া না হুনুক জিব্বা দিয়া হোনে।

বাজে কথা।

গেনদু বিরক্ত হয়ে বললো, তরে কইছে! তর যেমুন সব প্যাটবানান্তি কথা, এইগুলি পাচ কই?

খার, মুতা লই বলে মিয়াচাঁন একটা কেন্নোর গায়ে পেচ্ছাব করতে করতে খুব মনোযোগ দিয়ে তার গুটিয়ে যাওয়ার খুঁটিনাটি দেখলো। তারপর বললে, বিয়ার গীত হুনছস?

অনু বললে, না।

গেনদু ভারিক্কি চালে বললে, হুনায়া দে হুনায়া দে, কামে আইবো–মিয়াচাঁন তার চিনচিনে গলায় শুরু করলো :

ঘরসে নিকলা বাবু খানেকা বাস্তে–
মুরগিক আণ্ডা খা লিয়া রসগুল্লা সমঝকে
হায় হায় রসগুল্লা সমঝকে।
ঘরসে নিকলা বাবু পিনেকা বাস্তে-–
ঘোড়ে কা মুত পি লিয়া বেরানডি সমঝকে
হায় হায় বেরানডি সমঝকে।

অনু বললে, সত্যিই খুব মজার গান।

মিয়াচাঁন চোখ ট্যারা করে বললে, বুঝবার পারচস?

গেনদু ভেংচি কেটে বললে, থো! এণ্ডা বুঝছে। ক দেহি বেরানডি কি?

অনু বললে, তুমিই বলো না হে!

তরে লয়া আমাগ এক মোশকিল বাজছে। বেরানডি অইলো গিয়া রানডিগো খাওনের জিনিস।

মিয়াচাঁন গম্ভীর স্বরে বললে, তারিউরি অইবো আর কি।

গেনদু বললে, ওইসব মাইনসে খায় ক্যান ক দিহি, কি অয় খাইলে?—

তারপর উত্তরের কোনো পরোয়া না করে পরক্ষণে নিজেই বলে উঠলো, নিশা অয়, আবার কি অইবো। আর নিশা অইলে আতের মদে নবাবি আয়া যায়, চালারে–!

মাঝে মাঝে অনুকেও কিছু বলতে হয়, শুনতে চায় ওরা, বিশেষ করে গেনদু। কিন্তু অনু নিজে ওদের গল্প যতোটা আগ্রহ নিয়ে শোনে ওরা তার ধার দিয়েও যায় না।

চা-এর জন্মবৃত্তান্ত শোনালো অনু।

একদিন বোধিধর্মা ধ্যানে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলে রাগে নিজের চোখের পাপড়ি দুটোই কেটে ফেলে দিয়েছিলেন। চোখের পাতাজোড়া যেখানে পড়েছিলো পরে সেখান থেকেই চা গাছ জন্মায়।

খুব যে তুষ্ট হয়েছে ওরা কারো মুখ দেখেই তা মনে হয় না। গেনদু আর মিয়াচাঁন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো। লজ্জায় কুঁকড়ে গেল অনু।

কিন্তু এসবই নেহাৎ ক্ষণস্থায়ী গরমিলের ব্যাপার। এইসব গান গল্প গাজনের সং কিংবা আখের সবুজ রসের লোহা লোহা গন্ধে নিবের পিঠ দিয়ে ব্লটিং পেপারে দাগ টানা কিংবা ছবি আঁকার মতো অনির্দিষ্ট আনন্দ খুঁজে পায় সে। ফলে মাঝপথে দমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় না, ভাটা পড়ে না উৎসাহে।

একসময় দুপুর ঝিমিয়ে আসে।

কাকের চিৎকারে অন অবসাদ ঝরে পড়ে।

চিৎপাত ব-এর মতো বেঢপ হলুদ বাড়ির ছাদে রেডিওর এরিয়েলের বাঁশ খানিকটা হেলে আছে। অনুর মনে হয় বর্বর বাতাস বাড়ির মাথায় রেফ দিয়ে গিয়েছে।

ভালো লাগে অনুর।

খুব ভালো লাগে। যে ঘরকে রাগী দুপুরের দংশন যন্ত্রণায় নিষ্পেষিত জঠর বলে মনে হতো, যে জঠরে মেঝের লাল ফরাশে শুয়ে শুয়ে এক সময় সে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে শিউরে উঠতো,—সেই ঘর, যন্ত্রণা, দুঃস্বপ্ন, বৈচিত্র্যময় উঠতি আনন্দের অবাধ্য গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে বিবর্ণতার নিলয়ে বিলীন হয়ে গিয়েছে কবেই। ছত্রাখান জগতের এই ব্যাকুল আহ্বান নিঃশব্দ জানালায় দাঁড়িয়ে শোনার চেয়ে রৌদ্রের হিংস্রতায় পোড়া, পথ হারিয়ে পাগলের মতো ঘোরাঘুরি করা, কিংবা রাস্তার পাশের পাইপকলে মুখ লাগিয়ে এক নিশ্বাসে তৃষ্ণা নিবারণ করা তার কাছে গভীর আন্তরিকতার এক একটা চিহ্ন বলে মনে হয়।

এইসব প্রকীর্ণ চিহ্নের প্রতি অনুরক্ত অনু এখন আর মার জন্যে ভরা দুপুরে অকারণে দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয় না। অসংখ্য হাত বাড়ানো। পাকুড় আর গরান গাছের গরিব চেহারার মাঝখানে সে তার মার সুদ স্নিগ্ধ মুখের সেই পরম নির্ভরযোগ্য আলো দেখতে পায়।

কিন্তু গেনদু, মিয়াচাঁন, ফকিরা কিংবা ফালানি—এদের কারো মুখেই আলো খুঁজে পায় না অনু; এদের মুখের ধারালো অন্ধকারে রক্তনে রৌদ্র বিদ্যুতের মতো ঝলসে ওঠে কখনো কখনো, এইমাত্র। চৌ-পহর দিন এরা বিষদাঁত হাতড়ে ফিরছে। সামান্য একটা ব্যাঙকে যখন এরা পা দিয়ে চটকায় কিংবা এতোটুকু হালকা ঝিঝিপোকা কি প্রজাপতির ফিনফিনে শরীরকে শতেক টুকরো করে কুটকুটিয়ে ছিঁড়তে থাকে তখন এদের চোখমুখে উল্লাসের যে আগুন ঝলসে উঠে অনু তা দেখে ভয় পায়। এইতো কয়েকদিন আগেই মাঞ্জা দেওয়া করকরে লাল সুতোর টান মেরে একজনের কান উড়িয়ে দিয়ে ছুটে পালিয়েছিলো গেনদু, বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়েছিলো। চলতে চলতে অকারণে ঢিল ছুঁড়লো কখনো। যদি কারো মাথায় গিয়ে পড়ে, কিংবা রক্তপাত ঘটে, তাহলে তার আনন্দ দেখে কে।

মিয়াচাঁন, বারিখান তাকায়া দ্যাখ, অক্করে টেডি মাইয়াগ রহম।

গেনদুর কথায় অনুও তাকালো ঐদিকে।

বেঢপ খাড়া চারতলা লাল বাড়ি রাস্তার একপাশে তালগাছের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। দোতলার মাঝখানে ঝোলানো বারান্দায় একটি ছেলে নিচের দিকে ঝুঁকে রাস্তা দেখছে। অনুর মনে হলো ইটের তৈরি এক অবিশ্বাস্য ক্যাঙ্গারু পেটের থলিতে শিশু নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে নিরুপদ্রব বিকেল পোহাচ্ছে।

বাড়ির সামনে শাদা ন্যাকড়ার মতো কি একটা পড়েছিলো, চোখ পড়লো তিনজনেরই। গেনদু ছুটে গিয়ে তুলে নিলো।

হিহি করে হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে ধরে বললে, এলায় ছেরিগ দুদে বান্দনের জামা! আয়না মিয়াচাঁন, তরে লাগায়া দেহি!

প্রথমে তারা সেই বেঢপ বাড়িটা ছাড়িয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেল, তারপর ঝুরিওলা এক বুড়ো বটের নিচে পঁাড়িয়ে বুকের দিক পিঠে দিয়ে মিয়ানের গায়ে শক্ত করে ফিতেগুলো এঁটে দিল গেনদু। বললে, নাচনা বে।

মিয়াচাঁন দম দেওয়া পুতুলের মতো তখনকার তখনই হাতপা ঘুরিয়ে, মাজা দুলিয়ে আগু-পিছু করে, বসে, দাঁড়িয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে, চর্কিবাজির মতো ঘুরপাক খেয়ে, সুর ধরে। তারপর তার নিজের কায়দায় নাচন শুরু হয়। আর গেনদু দুহাতে পেটের ওপর থাবড়া দিয়ে হেইহেই হেইহেই করে মালসাট মারতে থাকে।

ঘরমে আয়া বাবু শোনেকা বাস্তে–
শালীকো লেকে শো গয়া ঘরওলী সমঝকে। হায় হায় ঘরওলী সমঝকে!

অনু দেখলো বটগাছের চুড়ায় পাতা নেই একটিও, নুলো নুলো ডাল, সেখানে শকুনের দঙ্গল ঘোঁট পাকাচ্ছে। মেলা বসিয়েছে কাকের ঝক; কেউবা ঠুকরে পালকের উকুন খুঁটে দিচ্ছে, কেউবা শকুনের পিঠে গাড়িচাপা করে খেলছে।

হঠাৎ নাচ বন্ধ করে মিয়াচাঁন রুষ্টমুখে বললে, পহা ছাড়না বে, হুদাহুদি দেহামু নিহি?

গেনদু রসিকতা করে বললে, এউগা কিচ খায়ার পারি!

মিয়াচাঁন বললে, তয় অনুরে দেওন লাগবো–

অনু খুশি মনেই পকেট থেকে দশ পয়সা বের করে দিলো।

আপন মনে পেয়ারা চিবুতে চিবুতে একটি মেয়ে একা একা এই পথ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলো; গেনদু ওদের দুজনকে পিছনে রেখে নিতান্ত ভালোমানুষের মতো কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর সহসা এক ঝটকায় মেয়েটার হাত থেকে আধ-খাওয়া পেয়ারা কেড়ে নিয়ে চেঁচো করে দে দৌড়।

সেই সঙ্গে মিয়াচাঁনও। চোরা চাহনিতে ভেতরে ভেতরে কখন যে দুজনের ভাবের আদান-প্রদান হয়ে গিয়েছে সে তা কিছুমাত্র অনুমান করতে পারে নি।

ছুটতে ছুটতে চোখের আড়াল হবার আগে সেই দূর থেকে চিৎকার করে গেনদু বললে, কাউলকা দেহা অইবো বন্দু হাম্মাদের ওহানে–-

একেবারে ভোজবাজির মতো উধাও হয় দুজন।

বিকেলের গা থেকে হাওয়ার আঁচল ধুলোয় খসে পড়ে গিয়েছিলো, ঘূর্ণি উঠলো মেয়েটাকে চক্রাকারে বেষ্টন করে। শুকনো বিবর্ণ পাতা হেঁড়া কাগজ আর ধুলোবালি তাকে মাঝখানে রেখে প্যাঁচানো স্কুর মতো শঙ্খিল গতিতে ওপরের দিকে উঠলো ফরফর করে পাক খেয়ে; এক মুহূর্ত তাকে দেখা গেল ঝাপসা, যেন পর্দা সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।

দলের কেউ নেই, অনু এখন একা।

প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিলো মেয়েটি, তারপর বিদ্যুৎগতিতে এক টুকরো ঝামা তুলে নিয়ে অন্ধের মতো যেদিকে পারলো ছুঁড়লো। যখন দেখলো গেনদু আর মিয়াচাঁন ভেলকিবাজির মতো চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গিয়েছে, হাতের পাতায় চোখ ঢেকে সে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো।

দারুণ বিপর্যস্ত অবস্থা অনুর। এই গেনদু আর মিয়াচাঁনরা যখন ফালানিদের হাতে অসহায়ের মতো মার খায়, ঘাড় গুঁজে মুখ বুজে সহ্য করে অন্যায় উৎপাত, তখন অন্যরকম মনে হয়েছে অনুর। কতো রকমেরই চেহারা এদের, কতো অচেনা, কতো ঝোপের আড়ালে না আত্মগোপন করে আছে এরা সকলে।

কি করবে ভেবে পেলো না সে।

কিছুক্ষণ একেবারে হাবার মতো হা করে দাঁড়িয়ে থকিলো, তারপর ভয়ে ভয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছুটা সাহস দেখিয়ে বললে, ওরা খুবই বজ্জাত, আমি তোমাকে পেয়ারা কিনে দিতে পারি, নেবে?

মেয়েটা চোখ মুছে কি যেন ভাবলো। ধরাগলায় বললে, পাবি কোথায় যে কি দিবি?

অনু সাগ্রহে বললে, চলো না, খুঁজে দেখি কোথাও পাওয়া যায় কিনা।

বোঝা গেল মেয়েটি খুব খুশি হয়েছে। ইচ্ছেমতো অনেকক্ষণ ধরে তাকে দেখলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর বললে, না পেলে তোর যা খুশি কিনে দিবি।

পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগলো অনু। হাঁটতে হাঁটতে বারবার তার আপাদমস্তক মুখস্থ করতে লাগলো মেয়েটি।

এক সময় বললে, তুই খুব সুন্দর দেখতে রে। তোরা সায়েব মানুষ তাই?

উত্তরের কোনো অপেক্ষা না রেখে তারপর আবার বললে, আমার আরো বন্ধু আছে। আমাদের পাড়ার বিশুয়ালাল আর হরিয়া। ওরা কতো কিছু দেয়। আমাকে। কাঁচপোকা ধরে এনে দেয়। দাদাপাখির পাখনা কুড়িয়ে এনে দেয়। ফলশা মিছরি এসব কিনে এনে দেয়। আমি মিছরি খেতে খুব ভালোবাসি।

অনু বললে, তুমি কোন্ পাড়ায় থাকো?

ঋষিপাড়ায়। আমার নাম সরুদাসী।

কতোদূর এখান থেকে তোমাদের বাড়ি?

কাছেই তো। চলনা আমার সঙ্গে, দেখে আসবি।

কি মনে করে অনু জানতে চাইলো, তোমাকে কেউ বকবে না?

বলে আমার বয়েই গেল! আমি কি কারো বকুনির পরোয়া করি? মা উঠতে বসতে কম গুতান পুঁতায় নাকি। চামারনীটা মরেও না, মরলে আমার হাড়ে বাতাস লাগতো!

পাশে একটা মুদিখানা দেখতে পেয়ে অনু সাগ্রহে বললে, পেয়ারা তো কোথাও দেখলাম না, মিছরি কিনে এনে দেবো তোমাকে?

সরুদাসী বললে, গুঁড়ো নিসনে যেন আবার, বড়ো বড়ো দেখে বেছে নিস।

তারপর হাতে মিছরি নেবার পর বললে, ভালো বাছতে পারিসনিরে, হুঁশো পেয়ে ঠকিয়ে দিয়েছে। আমি যদি যেতুম তা হলে আর ফাঁকিবাজি চলতো না। রতিরঞ্জন পসারীটার মতো বাঁদর এ তল্লাটে আর একটাও নেই, বুঝলি?

চেন নাকি তুমি?

হাড়ে হাড়ে চিনি। ওর ওই কানটো করা হাসি দেখলে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। বেহায়ার রাজা। আশপাশের ধুমসী চাকরানী হুঁড়িগুলোর মাথা ওই-ই তো খাচ্ছে। জামা তুলে গা দেখালে দুটো বাতাসা, গায়ে হাত দিতে দিলে তেল-সাবান, কম নচ্ছার ওটা! জুতসই একটা ঠ্যাঙানি না পড়লে সিধা হবে না। আমার কাছে কিন্তু পাত্তা পায় না, হু! আমাকে কি বলে জানিস? বলে তুই এখনো এক বাতাস, দু বাতাসার যুগ্যি হস নি। পোক্ত হয়ে নে তারপর দেখবো তোকে। আমিও বলেছি, দেখিস, বাপের বেটা হলে দেখিস?

অনু চুপচাপ সব শোনে।

সরুদাসী কি মনে করে আবার বললে, জানিস, কাল দুপুরে আমি কিন্তু হরিয়ার কাছ থেকে মিছরি নিই নি–

খুব আশ্চর্য হয়ে অনু বললে, কেন?

ইশ! তখন যে আমার ঘুগনি খেতে সাধ হচ্ছিলো। আমি কি শুধু মিছরি খাবো বলেই জন্মেছি? মাখনা, ফলশা, চানা, সেঁকামাংস এসবও তো খুব মজার জিনিস। সেঁকামাংস যা মজার, ইশ! একটা কথা, তুই ওইসব হাঘরে ছোটোলোক ছেলেদের সাথে খুব মাখামাখি করিস, নারে? কুটোকাটাগুলো সব পচা জাতের, তোর ঘেন্না করে না? তুই কতো ভালো। কতো সুন্দর। আমি যদি তোর মতো হতে পাত্তাম!।

অনু নিজের অভ্যন্তরে নদী হয়ে গেল একথায়। তার মনে হলো সরুদাসী খুব ভালো মেয়ে। ফকিরা, ফালানি, মিয়াচাঁন, গেনদু সরুদাসীর পায়ের কড়ে আঙুলের যোগ্যও কেউ নয়। কি সুন্দর কথা বলে সরুদাসী; পাকা গিন্নী মনে হয় তার। কি ঝকঝকে সরুদাসীর দাঁতগুলো!

আর মনে হয় বিশুয়ালাল (কুশ্রীময়লাদরিদ্র) যা পারে না, হরিয়া যা পারে, খুব সহজে সে তা পারে। সরুদাসী ইচ্ছে করলেই যে-কোনো সময় তার কাছে থেকে খুশিমতো ঘুগনি নিতে পারে, মাখনা নিতে পারে।

এমন একটা স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে উঠলো তার ভেতরে যে গেনদ মিয়াচাঁনের দ্বিপ্রহরিক সব সঙ্গকে এক লহমায় ঘৃণ্য মনে হলো; এরা সবাই তাকে গাড়লের মতো গাছের গুঁড়ি বানিয়ে চারপাশে লুকোচুরি খেলা খেলছে। তাকে ঠকিয়েই ওদের আনন্দ। ওরা চায় অনু বোকা থেকে ওদের খেয়ালখুশির রসদ জুগিয়ে চলুক। কতকটা অস্বাভাবিকরকম মরিয়া হয়ে সে বললে, আমি ঘেন্না করি ওদের! ওরা লোভী হ্যাংলা।

সরুদাসী খুব সংযতকণ্ঠে বললে, মিশিস না ওদের সঙ্গে। চোর-হঁচড়া আর গাঁটকাটার পাল ওগুলো। সবকটা জোচ্চোর আর ক্ষুদে বাটপাড়! আচ্ছা তোদের বাড়ি অনেক বড় নারে?

অনু বললে, দোতলা।

ইশ কি আরাম তোদের ওপর থেকে নিচের দিকে দেখতে যা ভালো লাগে! আমি একবার চারমানবাবুদের বাড়ির দোতলায় উঠেছিলুম, মা-ও ছিলো। মা চারমানবাবুর বৌয়ের ছেলে ধত্তে গিয়েছিলো, সঙ্গে আমিও গিয়েছিলুম। আর শোন, খুব মজার একটা কথা–

অনু খুশিতে উচ্ছল সরুদাসীর মুখের দিকে ঘাড় ফেরালো।

চারমানবাবুর ছোটো মেয়েটার না, বিয়ে না হতেই পেট হয়েছে! হেসে। গড়িয়ে পড়ার উপক্রম করে মুখে হাত চাপা দিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ সরুদাসী, তারপর আবার বললে, মাকে বলে কিনা পেট ফেলে দিতে পারলে পঁচিশ টাকা দেবে। যা তা ব্যাপার নাকি? মা পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছে, একশো টাকা না হলে ও কাজে হাত দেবে না, পাপ আর কি। ইশ, কী উঁচু নাকই না ছিলো হুঁড়িটার। ধরাকে একেবারে সরা জ্ঞান, দেমাকে মাটিতেই পা পড়তো না। আমি দোতলায় উঠেছিলুম বলে দূর দূর করে তাড়কা রাক্ষসীর মতো খেকিয়ে এসেছিলো আমার দিকে, তলে তলে আবার এতো! আমি হলে গলায় দড়ি দিয়ে মরতুম, ছি করো, ছি করো!

অনু বললে, তোমার বাবা কোথায় কাজ করে?

সরুদাসী কড়মড় করে দাঁতের মাড়ি দিয়ে মিছরি ভেঙে জড়িয়ে জড়িয়ে বললে, কি আবার করবে, জুতো সেলাই করে। ঋষিপাড়ায় সব্বাই তো ওই কাজই করে। অনেক ভালো ভালো কাজ পেয়েছে বাবা, কিন্তু ঠাকুরের মানা বলে সেসব করে নি। আমাদের জাত অন্য কিছু কত্তে গেলে ঠাকুরের শাপ লাগে।

অনু বললে, তোমাদের ঠাকুর বোধ হয় খুব রাগী?

কি জানি! প্রথমে উদাস থেকে তারপর চোখ বড় বড় করে সরুদাসী বললে, হ্যারে তোদের ঘরে অনেক জিনিশপত্তর, নারে?

অনু বললে, তা আর বলতে। অনেক দামি দামি সব জিনিশ, সব কাজেও লাগে না।

আবার উদাস হয়ে সরুদাসী আক্ষেপের সুরে বললে, আমাদের ওসবের কোনো বালাই নেই। বাবা সারাদিন রাস্তার মোড়ে লাইটের খাম্বার নিচে বসে জুতো সেলাই করে। সন্ধেবেলা যন্ত্রপাতির বাক্স মাথায় নিয়ে আবার ফিরে আসে। বগলি ঝেড়ে দুতিন টাকার বেশি কোনোদিনই নামে না। তারপর আবার চামড়া কেনা আছে, কাঁটা কেনা আছে। আমাদের খুব কষ্ট। এখন আগের মতো মাও আর তেমন বাইরে যায় না। কেউ ডাকেই না তো যাবে কি করে! আজকাল ধুমসী ধুমসী পোয়াতীরা গাট গ্যাট করে সোজা হাসপাতালে চলে যায় পয়সা বাঁচাবার জন্য। মদ্দা ডাক্তারের হাতে খালাস করায়। ঘেন্নায় আর বাচিনে বাপু! তুই বুঝি ইস্কুলে পড়িস?

অনু সগর্বে বললে, না পড়লে চলবে কেন। লেখাপড়ায় আমার সুনাম আছে। শক্ত শক্ত অনেক বই পড়তে হয়।

এতোটা বিশ্বাস হয় না তার, ঠিক এমনি সন্দেহের সুরেই সে বললে, যাহ, তুই বাড়িয়ে বলছিস!

সত্যি বলছি। অনু জোর দিয়ে বললে, প্রতিবারই আমি ফার্স্ট হই। সব স্যারেরাই আমাকে ভালোবাসেন!

এখন থাম—সরুদাসী অন্যদিকে তাকিয়ে নিস্পৃহকণ্ঠে বললে, আর বেশি বিদ্যে জাহির করতে হবে না।

অনুর মনে হলো তার একটুও বাড়িয়ে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। স্কুলে সত্যিই সে নামজাদা সুবোধ ছেলে। এমন কি অঙ্কস্যার ইয়াসিন লোদী (কুইনিনস্যার) আর বাংলার খিটখিটে রতিকান্ত কুণ্ডু (ক্যালসিয়ামস্যার) সবাই তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। সৎ এবং সুসভ্য ছাত্র হিশেবে সকলের মুখেই তার প্রচুর সুনাম। রতিকান্ত কুণ্ডু-খাই তোর মুণ্ডু কিংবা ব্ল্যাকবোর্ডে কুণ্ড দাবানল—এইসব যাচ্ছেতাই লেখার দলে সে কখনোই ভেড়ে নি। যেমন ইংরেজি টিচার টি. এ. লস্করকে নিয়ে ছাত্রদের বাজেকথা রটনা করাকে সে রীতিমতো ঘৃণা করে। লস্করস্যার (আন্ডারওয়ারস্যার) পাতলা ট্রাউজার পরেন বলে ছাত্ররা স্কুলময় রটিয়ে বেড়িয়েছে—স্যারের আন্ডারওয়ার দেখা যায় কেন, না উনি পুরোনো মশারির কাপড় দিয়ে ট্রাউজার তৈরি করনি, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আকাশের একটা কোণে নিঃশব্দে মেঘ জমেছে। খুব আকস্মিকভাবে অল্পক্ষণের মধ্যেই আয়োজন শেষ হলো মেঘের, বলতে কি একবারে তাদের অগোচরে; দুজনের কেউই খেয়াল করতে পারে নি আসন্ন বর্ষণকে।

চোখের পলকে চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরে গেল। ভালুকের গায়ের মতো এমন কালো অন্ধকার যে অনুর মনে হলো আর একটু পরেই তারা কেউই পরস্পরকে দেখতে পাবে না, খুঁজে পাবে না।

শীতল হাওয়ার স্রোত হঠাৎ খ্যাপাটে বুনো মোষের মতো যখন দাপাদাপি শুরু করলো তখন সরুদাসীর মুখ কালো হয়ে এলো, সে বললে, আই সেরেছে! উঠোনে ছাগলের শুকনো নাদি উঁই হয়ে রয়েছে, সব ভিজে

কাদা হয়ে যাবে। কপালে আজ নির্ঘাৎ পিটুনিলেখা আছে।

সেই অমল অন্ধকারে, দামাল হাওয়ায়, অনুর একবারও ঘরে ফেরার কথা মনে এলো না। মনে পড়লো একদিন বাড়ি থেকে কোথাও না কোথাও পালিয়ে যেতে হবে তাকে, সেখানে হয়তো ঠিক এমনই ঠাণ্ডা, হাওয়া, অন্ধকার।

কি যে করছে মা ভেতরে ভেতরে—জটিল মনে হয় অনুর, সব দরোজাই বন্ধ, উপায় নেই বোঝার। রাক্ষুসে ঘরগুলো সুযোগ পেলেই বিকট দাঁত বের করে তাকে দেখে হিংস্র হাসি হাসে। সাপের মতো হিলহিলে ভয় তাকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়ায়; যেমন করেই হোক পালাতে তাকে হবেই—মনে করিয়ে দিতে হবে মাকে।

আর কতোদূর?

খুব কাছাকাছি এসে গেছি। ওরে, বিষ্টি পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে রে–

দৌড় মার, দৌড় মারা

অনু ব্রিত হয়ে বললে, এখন যে আমরা ভিজে চাবচু হয়ে যাবো। কচি খোকা, কথা শুনলে হাসি পায়! সরুদাসী মাথার ওপর হাতের তালু বিছিয়ে বললে, আমার পিছন পিছন চলে আয়, শিল পড়ছে।

কেঁপে বৃষ্টি এলো। পলকের মধ্যে ভিজে সপসপ হয়ে গেল অনু। চুটপুট চুটপুট গুড়ুম গাড়া করে বড় বড় শিল পড়ছে। অনু রোমাঞ্চিত হলো।

কি সুন্দর এই (ঝঞাঝরঝরঝাপতালঝিঝিঝিঝিট) বৃষ্টি! কি অদ্ভুত এই বৃষ্টি! কি সীমাহীন।

বৃষ্টি। বৃষ্টি!

বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি।

ফুঁসে উঠছে হাওয়া, কখনো গলায় ঘুঙুর বাঁধা বাছুরের মতো, কখনো কুঁদুলে ষাঁড়ের মতো শিঙ উঁচিয়ে; কখনো রনোন্মত্ত সিংহের মতো, দুর্দান্ত দস্যুর মতো কখনো।

ঢুকে পড় ঢুকে পড়, শিগগির ঢুকে পড়–বলে সরুদাসী একটা দোকানের ঝাপ ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে সাঁধায়।

অনুও ঢোকে তার পিছনে পিছনে। দোকানের ভেতরে কেউ নেই।

একটা ডালাভাঙা কাঠের ক্যাশবাক্স শীতল পাটি বিছানো চৌকির ওপর পড়ে আছে, কোণগুলো পিতলের নকশা দিয়ে মোড়া। এক পাশে থাক করা জ্বালানির চেলাকাঠ। মাঝখানে ঝোলানো বড়সড় একটা কাটাপাল্লা।

অনু ভয়ে ভয়ে বললে, বকবে না দোকানদার?

সরুদাসী নির্বিকারচিত্তে বললে, দেখলে তবে তো! আমরা তো আর চুরি কত্তে আসিনি, দেখলেই বা।

ফালুক-ফুলুক করে এদিক-ওদিক দেখতে লাগলো সরুদাসী; এমন সন্ধানী সে দৃষ্টি যেন কোনো কিছু একটা আবিষ্কার না হওয়া অবধি তার স্বস্তি নেই।

পেয়েছি পেয়েছি, কি মজা–বলে এক সময় ছুটে গেল ক্যাশবাক্সের কাছে, তারপর তার ভেতর থেকে বের করলো একটা কাঁচা আম ঘষা ঝিনুক আর নুনের পুঁটলি। ওলন-দোলন ওলন-দোলন এই বলে সে দোলনা চাপার মতো করে পাল্লার একদিকে বসে অপরদিকের দড়িআঁটা। তক্তায় বসতে নির্দেশ করলো অনুকে। সরুদাসীর দিকটা খানিক উঁচুতে উঠলো।

সরুদাসী একটু পরে হেসে বললে, তুই ভারে কাটিস, আমি ধারে কাটি, তাই না?

অনু বললে, ঘোড়ার ডিমের কথা, মাথামুণ্ডু নেই!

আমার ধার ঘষা ঝিনুকের চেয়েও কিন্তু বেশি, বুঝেশুনে কথা বলিস! আমের গা থেকে ঝিনুকের ফুটো দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে গালে পুরে চিবুতে লাগলো সরুদাসী। কখনো এক চিমটি নুন নিলো। কখনো মাড়িতে নিয়ে চিবুলো। কখনো টকাস টকাস করে শব্দ তুললো টাকরায়।

এক সময় বাইরে বৃষ্টি থেমে এলো। প্রচণ্ড শব্দে ঢেউটিনের চালের ওপর দুড়ুম-দাঁড়াম্ শিল পড়া শুরু হলো। মনে হয় ডাকাত পড়েছে, বর্শা ছুড়ছে এলোপাতাড়ি।

শিলপড়া বন্ধ হলো আবার।

আবার বৃষ্টি শুরু হলো।

বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি!

এবারে একেবারে আকাশ ভেঙে।

অনুর মনে পড়ে যায় চল নামি, আষাঢ় আসিয়াছে—যদিও বৈশাখ চলছে এখন। চলো নামি, বৈশাখ আসিয়াছে, তাই বৃষ্টির ঢল নামছে, আকাশ ফুটো হয়ে গিয়েছে।

সরুদাসীর পরনে শাড়িছেঁড়া ফালি লুঙ্গির মতো জড়ানো। গায়ে ঘটির মতো ফোলাহাতা ছিটের ব্লাউস, যার একটাও বোতাম নেই, নাভির উপরে। গিটমারা। কোমরে কড়িবাঁধা লাল ঘুনসি। ভিজে কাপড়ে ছুটতে গিয়ে পিছনের দিকে খানিকটা ফেঁসে গিয়েছিলো। সরুদাসী ছেঁড়া জায়গায় হাত রেখে হঠাৎ মুখ কালো করে তিরস্কারের সুরে বললে, তুই কি অসভ্যরে, হাঁ করে আমার পাছা দেখছিলি বুঝি এতোক্ষণ?

অনু লজ্জিত হয়ে বললে, যাঃ, মিথ্যে কথা!

ঠিক আছে, আর দেখিস না কখনো। তুই আর আমি যদি স্বামী-স্ত্রী হতুম তাহলে কিন্তু তোকে একথা বললে আমার পাপ হতো। বিশুয়ালালটা কি অসভ্য জানিস? শুধু পুতপুতু করে আর আমার পাছা দেখতে চায়। একটা আস্ত ভীতুর ডিম। এক ধমকেই আবার লেজ গুটিয়ে সুড়সুড় করে পালায় মেনিমুখো ছোঁড়াটা। কিন্তু হরিয়াটা একটা আস্ত গুণ্ডা। ওর গুণ্ডামি একদিন বার করবো আমি, ছাইকপালে। সেদিন বাগানে না তুই আবার মন্দ ভাববি, তোকে বলবো না। জানিস আমার মায়ের একটা খুব সুন্দর রুপোর গুজরি আছে। বিয়ের সময় আমাকে দিয়ে দেবে সেটা, মা নিজমুখে বলেছে।

অনু হাঁপানি রুগীর মতো ঘড়ঘড় শব্দ তুলে বললে, হরিয়ার কথা বলবে না?

সরুদাসী চট করে বললে, এমন গুণ্ডা তোকে আর কি বলবো! কথায় কথায় কুটকাট কোমরে চিমটি দেবে আর ছুতোনাতা করে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিশফিশিয়ে কেবল খারাপ খারাপ অসভ্য কথা বলবে। যা ঘেন্না করে আমার, ছি করো! সেদিন বাগানে আমার সঙ্গে রান্নাপাতি খেলা খেলতে খেলতে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে বুকে খামচি কেটে দে দৌড়, নচ্ছার একটা! বড় জ্বালায় ছোঁড়াটা!

অনু গম্ভীর মুখে অভিযোগের সুরে বললে, তুমি তো বকতে পারো ওদের, তোমার মা-বাবাকে বলে দিতে পারো।

তুই একটা আস্ত ইয়ে! এইসব নাকি আবার কাউকে বলা যায়, মরে যাই মরে যাই! আমি সেধে না মিশলেই হলো। ছোঁড়া তো নয়, প্যাকাটি! নচ্ছারটার দুকান দুরকম, আবার ট্যাগরাও। অমাবস্যার রাতে জন্মালে নাকি অমন ছিরি হয়। এমনও হতে পারে ওর মা এঁটো হাতে পেচ্ছাব করতে বসেছিলো কখনো। একদম মড়াখেকো চেহারা, ওর মিছরি নিতে আমার বয়েই গেছে।

অনু বললে, তুমি যদি ওদের সঙ্গে আর কথা না বলো তোমাকে বাড়ি থেকে সুন্দর সুন্দর জিনিশ এনে দেবো।

ইশ, ওদের সঙ্গে ভাব জমাতে সরুর যেন আর ঘুম হচ্ছে না। আমি যেচে কথা বলি ভেবেছিস? বেহায়া কি আর গাছ থেকে পড়ে? কুকুর দুটো নিজেরাই নানান ছুতোয় সুড়সুড় করে পিছনে ঘোরে। এবার থেকে দেখা হলে গায়ে থুতু দেবো, তুই দেখিস। আমার আর কি দোষ বল, আমি তো আর এর আগে তোকে চিনতাম না। এই তোর নাম কি এখনো বললি না তো? আমারটা দিব্যি কায়দা করে জেনে নেওয়া হলো, বেশতো চালাকি!

অনু—

ওমা আমি কোথায় যাবো, ওতো হুঁড়িদের নাম রে! হেসে গড়িয়ে পড়লো সরুদাসী। তারপর চোখের নিক্তিতে হুট করে মেপে নিলো দুজনের বয়েস। অনুর চেয়ে কিছুটা বড়োই হবে সে, তার ধারণা। তবু কি যেন ভেবে খুব আন্তরিকতার সুরে সে বললে, নাহ্, নাম ধরে ডাকবো না তোকে। তুই বেশ আমার—তুই বেশ আমার মনসাপাতা।

অনু বুঝতে না পেরে বললে, সে আবার কি?

তোর মুণ্ডু! ওমা কি গাধারে তুই, মনসাপাতাও বুঝিস না, আবার নাকি গণ্ডায় গণ্ডায় বই পড়া হয়? বিশুয়ালাল আমার কি ছিলো জানিস, তেঁতুলপাতা!

আর হরিয়া?

বিছুটি পাতা!

উভয়ে নীরব থাকলো কিছুক্ষণ।

কান পেতে বৃষ্টির শব্দ শুনলো। মনে মনে বাজ পড়ার শব্দ গুনলো। বৃষ্টিভারাক্রান্ত হু হু হিমেল হাওয়া ঠিক ওদের মতোই ঝাপ ঠেলে ভেতরে ঢুকলো হুড়মুড়িয়ে কোনো এক সময়। ঝমঝমে বৃষ্টিতে ছাউনির করোগেট একটানা রিনরিনিয়ে উঠছে।

অনু বললে, আমি যদি রোজ আসি তুমি খেলবে তো?

বারে, খেলবো না কেন? সরুদাসী তার দিকে স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে বললে, তোর মিছরি খুব মিষ্টি, তোকে আমি খুব পছন্দ করি। বাবুদের বড় বাগান চিনিয়ে দেবো তোকে, সেখানে রোজ আমরা খেলবো। আচ্ছা মাগ ভাতার খেলা জানিস তো?

না!

তোকে সব শিখিয়ে দেবো। বাবুদের বাগানে কাটামুদি আর ভাঁটঝোপের ভেতর আমার খেলাঘর পাতা আছে, সেখানে তোতে আমাতে মাগ-ভাতার খেলা খেলবো। আমি মিছিমিছি চান সেরে ন্যাংটো হয়ে কাপড় বদলাবো, তুই চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকবি। দেখলে কিন্তু ভালো হবে না বলে রাখলুম। তারপর কাপড় পরে আমি তোকে বুকড়ি চালের মোটাভাত, কাঁকরোল-ভুষো চিংড়ি, মাগুরের ঝোল কিংবা জলপাই। কুচিয়ে দেওয়া গাংদাড় মাছের চচ্চড়ি দিয়ে পেটপুরে খেতে সাধবো। তুই মিথ্যে মিথ্যে রাগ করবি। বলবি, মেয়েটা কেঁদে কেঁদে সারা হলো সেদিকে খেয়াল আছে নচ্ছার মাগীর, মাই দিতে পারিস না, এইসব। পিচের কালো পুতুলটা বেশ আমাদের মেয়ে হবে। তারপর আমি তোর কাছে ঘাট মানবো। তুই ফিক করে হেসে ফেলবি। খেয়ে-দেয়ে দুজনে পাশাপাশি শোবো। তুই রাগ করে চলে যাবি। তারপর মিছিমিছি তাড়ি খেয়ে মাতলামি কত্তে কত্তে এসে আমাকে রানডি মাগী ছেনাল মাগী বলে যাচ্ছেতাই গাল পাড়বি। বেশ মজা হবে যাই বল, তাই না রে?

অনু আমতা আমতা করে বললে, আমি কিন্তু তোমাকে অতোসব বকাবকি করতে পারবো না!

দূর বোকা! খিস্তি-বিখিস্তি না করলে, মেরে গতর চুরিয়ে না দিলে, তোর মাগী কি ঠিক থাকবে নাকি? ভাতারের কিল না খেলে মাগীরা যে নাঙ ধরে তা-ও জানিস না বুঝি? আমাদের ঋষিপাড়ায় শিউশরণের সেবার কি হলো! বৌয়ের ওপর ভোদা মেনিমুখোঁটার অগাধ বিশ্বাস, ঝোপ বুঝে কোপ মেরে মাগীটা চোখে ধুলো দিতে শুরু করলো ঐ ভালোমানুষির সুযোেগ নিয়ে। রোজ রাত্তিরে শিউশরণ যখন নেশার ঘোরে আধমরা, মুখে কুকুরে মুতে দিলেও বোঝার যো নেই, রাক্ষসী বারোভাতারীটা তখন অন্য নাগরের সঙ্গে পা টিপে টিপে পিরিত করতে বেরিয়ে যায়। শেষে ধরা পড়লো একদিন। ঘরের দাওয়ায় বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো আঁটিচোষা কেলেভূতটা, আর ওর মাগীটা তোর ঘর করবো না এই ঊনপাঁজুরে মিনসে তোর ঘর আর করবো না বলে মুখ ঝামটা দিয়ে তেজ দেখাতে লাগলো সমানে।

ওসব বাদ দাও! অনু বিরক্ত হয়েই বললে।

সরুদাসী তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকালো, তারপর হেসে লুটিয়ে পড়ে বললে, বুঝেছি বুঝেছি, তুই অন্য কথা বলবি ঐ সময়, পেটে পেটে এতো–-ওরে বজ্জাত কম না তো তুই। ওরে তিলেখচ্চর–

ধরো হরিয়া যদি আমাদের সঙ্গে শয়তানি করে?

লাথি না! অতো খ্যামাতা থাকলে তো! সে আমি একাই সামলাবো, তোকে অতোসব ভাবতে হবে না। যেমন বেটা তেমনি বাপ। হরিয়ার মড়াখেগো বাপটা দিনরাত গাঁজা-চরসে মশগুল হয়ে থাকে, আর ওর মড়াঞ্চে পোয়াতি মাটা একমুনে ধামার মতো পেট নিয়ে দোরে দোরে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে শুধু নাকিসুরে কাঁদুনি গেয়ে বেড়ায়।

অনু হাবার মতো হাঁ করে নীরবে শুনতে থাকে।

তোকে একটা কথা বলা হয় নি, প্যানপ্যান করে নাকিসুরে কাঁদুনি গাইলে কি হবে ওর মা মাগীটাও কম নচ্ছার না, নটঘট লাগাবার ওস্তাদনী যাকে বলে। ঐ যে শিউশরণের কথা বললুম তোকে, ব্যাপারটা হয়েছিলো ওর থুথুড়ি মাকে নিয়ে। একশো তিরিশ বছর বয়েস বুড়ির। বাবুদের বাগানে ঝুরিওলা বট আর অশথগুলো বয়সে বুড়ির নাতজামায়ের চেয়ে ছোট হবে। বাঁ গালে এক মস্ত তিল ছিলো বুড়ির, তিলের গায়ে ছিলো কয়েকটা চোঁচের মতো লোম। হরিয়ার মা মাগী ঘুমন্ত বুড়ির ঐ তিলের নোম চুরি করে বেচে দেবে না, সে এক হুলস্থুল ব্যাপার। তাড়ির ফেনার মতো মুখে গাঁজলা তুলে হাত-পা টেনে খিচে খিচে বুড়ি তো পটল তুললো, পাড়াসুদ্ধ সবাই মিলে মেরে তুলোধােনা করে ছাড়লো মাগীকে। তবু কি এখনো শিক্ষা হয়েছে মাগীর, টোটকা-ফোটকা এখনো চালায় মৌকা। পেলে। চুল কাটা, শাড়ির আঁচল কেটে আনা, পান-সুপুরি চালান করা, শতেক বিদ্যের জাহাজ মাগী। হাতযশও ছিলো একসময়; বাড়ি বাড়ি থেকে রীতিমতো ডাক আসতো। ওর ওই কূটকচালে নষ্ট স্বভাবই ওকে ডুবিয়েছে। এখন আর কেউ বিশ্বাস তো করেই না, বরং ওর নাম শুনলে লোকে ক্ষেপে যায়, বলে মাগী জ্যান্ত ডাইনী, পেটে বাণ মেরে বাচ্চা নষ্ট করতে না পারলে ওর নাকি ঘুমই আসে না চোখে।

প্রায় আপন মনে, কেউ শুনলো কি শুনলো না তার ভ্রক্ষেপ না করেই অনর্গল কথার তুবড়ি ফোটাতে থাকে সরুদাসী; একটা স্রোত—তোড়ের মুখে সবকিছু খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়।

অবাক হয় অনু। সরুদাসী নিজেই আশ্চর্য রূপময় এক জগৎ। তার সবকিছুই কমবেশি আকর্ষণীয়। গল্প বলার ভঙ্গি, হাত পা নাড়া, ঠোঁট উল্টানো, চোখ বড় বড় করে তাকানো, সবকিছুর সঙ্গেই বুঝিবা মখমলের (মালীরা কখনো দূরে যায়?) সুন্দর কোমলতা জড়িয়ে আছে। স্বপ্নের ভেতরে নিজেকে দোল খাওয়াচ্ছে সরুদাসী,—নিঃসঙ্কোচ, অনর্গল, সহজ, তীব্র, আবার আচ্ছন্ন।

বাঞ্ছারামপুরের কথা মনে পড়লো অনুর। রানিফুফুও কখনো কখনো অনর্গল কথা বলে, কিন্তু তার ভেতরে সত্যিই যেন প্রাণ নেই। খুব ভোরে উঠে ফজরের নামাজ শেষ করে এই যে মুখে কথার খৈ ফোটাতে শুরু করে সারাদিন তার আর কোনো অন্ত নেই। সকলে কাজে ঢিলে দিচ্ছে, ফাঁকি দিচ্ছে, সংসারের ক্ষতি করছে এক ধরসে সবাই, একপাল কাজের মানুষের বিরুদ্ধে অন্তহীন তার অভিযোগ। চোখের সামনের জিনিস খুঁজে না পেয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠা, কারণে-অকারণে পরচর্চায় জুবড়ে পড়ে থাকা, রানিফুফু বলতে এই-ই বোঝায়। রানিফুফু বিধবা বলে মুখ নিচু করে সবাই নীরবে সবকিছু মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। রানিফুফু যখন তুচ্ছ একটা কারণে এইরে ঘরদোর নোংরা করে ফেললি কিংবা এ বাড়িতে অনেক বৌ শোবার সময় একটা করে কুলোয় না এইসব ঝাড়তে থাকে তখন রীতিমতো অসহ্যই মনে হয় সকলের কাছে। অন্যের দোষ ধরতে জুড়ি নেই ফুফুর, ভুলেও কখনো প্রশংসা করে না কাউকে, এক অন্য ধাতের মানুষ। তুলনা চলে না সরুদাসীর সঙ্গে, অনু মনে মনে হিশেব-নিকেশ করলো বহুভাবে।

একসময় তার বাঁ হাতের কনুয়ের কাছে একটা গেঁয়ো পিঁপড়ে কামড়ে দিলো। জায়গাটা ফুলে লাল হয়ে উঠলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তাকে চুলকাতে দেখে সরুদাসী বললে, চুলকাচ্ছে বুঝি? ঠাকুর-দেবতা মানবি না তো হবে না ঐসব! ঠিক আছে, আমি ঘন্টাকন্নের কাছে প্রার্থনা করবো তোর জন্যে, দেখিস সব চুলকানি সেরে যাবে। জানিস, আমার বাবার মায়ের দয়া হয়েছে। লোহাগাড়িয়া বের হয়েছে সারা গায়ে। আমাদের খু-উ-ব চিন্তা।

হাসপাতালে যায় না কেন?

কেন, আমাদের কি ঠাকুর-দেবতা নেই নাকি? তুই না একটা জ্যান্ত বুন্ধু! তোকে শিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষ করে নিতে গিয়ে আমার নিজের মাথাটাই না শেষ অব্দি খারাপ হয়ে যায়। তাতে অসুবিধে নেই, তুই খুব তাড়াতাড়ি সব শিখে যাবি। নচ্ছার হরিয়াটা কি বলে জানিস? বলে খেলতে খেলতেই তো মানুষ সব শেখে।

অনু প্রতিবাদ করে বলে, পড়তেও হয়।

পড়ে ঘণ্টা হয়! পড়লে বুঝি সব জানা যায়? তুই জানিস কি করে জুতো সেলাই কত্তে হয়? কটা লোক ঠিকমতো জুতো সেলাই কত্তে পারে, বুকে হাত দিয়ে সত্যি করে বল দিকি। শ্রীনাথ জ্যাঠা তো সকলের মুখের ওপর পষ্ট করে বলেই। বলে কাজের কী জানিস তোরা, ফাঁকি মেরে কোনো মতে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করছিস, একে জুতো সেলাই বলে না, গোঁজামিলের কাজ, জোচ্চুরি করে পয়সা নিচ্ছিস, জুতো সেলাই অতো সোজা নয়, শিখলি কবে তোরা যে পারবি, এইজন্যেই তো ঋষিদের ঘরে ভাত এমন বাড়ন্ত এখন।

অনু বললে, ও আর এমন কি কঠিন কাজ! ইশ, জুতো সেলাই কত্তে কত্তে বাবুর হাতে কড়া পড়ে গেছে কিনা, উনি সব জানেন! যত্তোসব হেঁদো কথা তোর। শ্রীনাথ জ্যাঠা ঋষিপাড়ার ফঁকিবাজ ছোড়াগুলোকে তো বলেই, বলে সব কাজই কঠিন, তাকে ভালোবাসতে হয়, নিজের মাগী করতে হয়, মাগী করলি তো ধরা দিলো, তোর যে মাগী সে তোরই জানা। পায়ের জুতো পায়েই থাকবে মাথায় উঠবে না কখনো—স্রেফ গোজামিল দিয়ে চালা, এই যদি তোর মনের কথা হয়, তাহলে শিখবিটা কেমন করে। পায়ের সেবা করলেই মাথা পাবি, মাথার মধ্যেই সব, মাথার মধ্যে বিশ্ব!

অনু বললে, আমাদের কুইনিনস্যারও এই ধরনের কথা বলেন।

সরুদাসী বললে, আচ্ছা বিশ্ব মানে কি রে?

তোমার শ্রীনাথ জ্যাঠা বলে নি?

চালাকি মারা হচ্ছে? জানিস না তাই বল। পড়লে কি আর সবকিছু জানা যায়, সেই কথাই তো বলছিলাম। নাভির ওপর কোন্ গাছের শেকড় রাখলে তাড়াতাড়ি বাচ্চা খালাস হয় বল দিকি, দেখবো কেমন সরেস তোমার ঐ হেঁড়েমাথাটি?

নিরুত্তর অনু নিষ্পলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

বৃষ্টির শোঁ-শোঁ শব্দে কান পেতে এক সময় সরুদাসী প্রগাঢ় আচ্ছন্ন কণ্ঠে তাকে জিগ্যেস করলে, হ্যারে মনসাপাতা, আমাকে তোর কেমন লাগে সত্যি করে বল না।

খুব ভালো।

সত্যি করে বলছিস?

সত্যি!

দিব্যি?

তাই! তুই আমাকে বিয়ে করবি?

অনু একথার কোনো উত্তর না দিতে পেরে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো।

বুঝেছি–দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরুদাসী সকাতরে বললে, আসলে আমাকে তোর একরত্তিও পছন্দ নয়, একটা আস্ত মিথুক তুই। আর পছন্দ হবেই বা কি করে, বুঝি সব, আমরা তো আর বাবুজাতের মেয়েদের মতো চোখ কানের মাথা খেয়ে বেহায়াপনা কত্তে পারিনে। বুক উইঢিবির মতো উঁচ করে, পাছা দুলিয়ে, রঙ-চঙ মেখে, অন্যদের বোকা বানিয়ে মন ভাঙানো আমাদের ভেতরে নেই বাপু। আমরা যা—তাই!

অনু বললে, সত্যিই আমি তোমাকে পছন্দ করি, সত্যি বলছি।

মিথ্যে কথা, ডাহা মিথ্যে কথা!

একটুও মিথ্যে নয়!

তুই আমাকে ঘেন্না করিস!

বলেছে—

হরিয়া কিন্তু আমাকে ঘেন্না করে না।

আমিও করি না।

তুই একটা হাঁদু–রাঙামুলো!

বেশ তাই!

বাবুর বুঝি রাগ হলো? আচ্ছা আচ্ছা, আর বলবো না, এই ঘাট মানছি। তুই একটুতেই বুঝি চটে যাস, গায়ে মাছি বসতে পারে না—বাব্বাহ! আমি কি আর সত্যি সত্যিই তোকে রাঙামুলো বলেছি, ওতো ঠাট্টা। তোর সঙ্গে ঠাট্টা না করলে আর কার সঙ্গে করবো বল? তুই না আমার মনসাপাতা, গুলে খেয়ে ফেলেছিস বুঝি এরি মধ্যে?

তাতে হয়েছে কি?

তোর মাথায় শুধু গোবর। ইশ কি বিষ্টিটাই না হচ্ছে! যেন আকাশ ফুটো হয়ে গিয়েছে।

কি করে ঘরে ফিরবে?

দোলায় চেপে।

তার মানে?

বুঝলি না বুঝি?

সত্যিই বুঝি নি—

যাক অতো বুঝে কাজ নেই, যা সরেস মাথা তোর।

খিলখিল করে হাসতে হাসতে পাল্লার দড়ির গায়ে ঠেস দিলো সরুদাসী, তারপর হাসির দমক সামলে নিয়ে বললে, তোর কাঁধে চেপে, বুঝলি রে, গোবর-গণেশ কোথাকার!

বয়েই গেছে আমার—

কেন, তুমি বুঝি স্কন্ধকাটা, সেইজন্যে কাঁধে নিতে পারবে না? তবে লেজে বেঁধে টেনে নিয়ে যাবি!

হেসে উলটে পড়লো সরুদাসী।

পরে কি ভেবে আবার বললে, কিরে, নিয়ে যাচ্ছিস তাহলে কাঁধে করে?

ধরো নিয়েই গেলাম, তোমাকে বাড়ির কেউ বকবে না?

বয়েই গেল, বয়ে গেছে আমার ঘরে ফিরতে। কপালে যা আছে তাই হবে!

কি করবে?

তোর গলা জড়িয়ে ঐ চৌকিতে শুয়ে থাকবো। চলনারে, তোতে আমাতে শুয়ে থাকি!

তুমি যাও।

রাগ করেছিস বুঝি? গোবর-গণেশ বলেছি তাই? মনসাপাতাকে অমন অনেক কথাই শুনতে হয়। চলনা ভাই! বুঝেছি তোর লজ্জা করছে, কেউ এখানে দেখতে আসছে নাকি আমাদের? আমরা তো শুধু গলা ধরাধরি করে চৌকিতে শুয়ে থাকবো।

আজ থাক আর একদিন হবে—

ভয় করছে বুঝি?

না, তোমার গায়ে কেমন যেন আঁশটে গন্ধ। এত নোংরা থাকো কেন

তুমি?

সরুদাসী প্রায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললে, মরার কথা শোনো। গন্ধ আবার কোথায়! তোর নাকে গন্ধ। আমরা তো আর বাবুজাতের লোক নই। তোরা তো আমাদের চেয়ে অনেক নিচুজাত।

অনু ক্ষীণকণ্ঠে আপত্তি করে বলে, বললেই হলো আর কি!

তবে কি? সরুদাসী ভঁটো মেয়েমানুষের মতো খাড়া হয়ে মাজায় একটা হাত রেখে তর্জনী উঁচিয়ে বললে, তোদের ঠাকুর-দেবতা আছে? তোরা পুজো করিস? মরা মুরগি খাস? বল না, চুপ করে আছিস কেন?

অনু ঝট করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললে, আমাদের জাত সব জাতের চেয়ে বড়।

সরুদাসী ধারালো কণ্ঠে বললে, অতোই যদি বড় তাহলে যেচে মিশতে আসিস কেন? কাদের জাত কতো বড় সে আমার খুব ভালো করেই জানা আছে, আমি কচি খুকি নই। কি ঝগড়াটে ছোঁড়া—ইশ!

অনু বললে, আমি আবার কখন ঝগড়া করলুম?

ন্যাকা! জাত তুলে কথা বলতে লজ্জা করে না তোর? যার যার জাত তার নিজের কাছে। তোর জাত নিয়ে কি আমি দুবেলা ধুয়ে খাবো, না তাতে আমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়ে যাবে? বলতিস এসব হরিয়ার কাছে তো জলবিছুটি দিয়ে ঝড়িয়ে আচ্ছামতো ঢিট করে দিতো। ওর প্যাদান একবারটি খেলে বাপের নাম আর মনে থাকবে না। যা, ভাগ এখান থেকে।

অনু প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে নিতান্ত অসহায়ের মতো বললে, আমি তো তোমার জাত তুলি নি–

তা তুলবি কেন, সে সাহস থাকলে তো! শুধু আড়চোখে ঠারেঠোরে আমার পাছা দেখছিলি হ্যাংলার মতো, অসভ্য বাঁদর কোথাকার। পচা মায়ের পেটে জন্ম।

অনুর মাথায় রক্ত চনমন করে উঠলো একথায়।

এক পলকে একটা গজারির চেলা উঁচিয়ে সে ওর সামনে গিয়ে বললে, মা তুললে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি, চুরমার করে দেবো মাথা!

সরুদাসীও একটা চেলাকাঠ হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে এসে বললে, ওরে মিনমিনে চাঁদমুখো শয়তান, তোর পেটে পেটে এতো বজ্জাতি! আমিও ছাড়বো ভেবেছিস, আমি কি ননীর পুতুল? কুত্তা কোথাকার। আগাপস্তলা চুরিয়ে দেবোমার না। মার না! মার না।

ভালো হবে না ভালো হবে না–

যাযাহ্!

আমি কিন্তু–

কতো না তোর মুরোদ, শুয়োর–

অনেকক্ষণ জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো অনু। কোনো কিছু ভেবে না পেয়ে চেলাকাঠটা এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে সেই ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় করে ছুটে বেরিয়ে গেল।

ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে গলা বের করে সরুদাসী চিৎকার জুড়লো, মর মর, মাথায় বাজ পড়ে মর! তুই আমার—তুই আমার মুড়োঝাটা! গয়েরখেকো, খ্যাংরা মারি তোর মুখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *