০৮. গৃহে পৌঁছাতে কৃষ্ণা বললে

গৃহে পৌঁছাতে কৃষ্ণা বললে, একেবারে রাত কাবার করে এলে, ব্যাপার কি? যাত্রা শুনছিলে নাকি? খুব ভাল যাত্রা হয়েছে বুঝি?

সুভদ্রা হরণ যাত্ৰা আর শেষ হল কোথায়? একটা সোফার উপরে গা এলিয়ে দিতে দিতে কিরীটী বললে, শেষ হওয়ার আগেই যবনিকাপাত।

কি রকম?

সামন্ত মশাই-সেদিনের সে ভদ্রলোককে মনে আছে? প্রাণভয়ে ভীত হয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছিলেন! শেষ পর্যন্ত তাঁর আশঙ্কাটাই সত্য হল।

মানে?

কিরীটী তখন সংক্ষেপে ব্যাপারটা বিবৃত করে গেল।

সব শুনে কৃষ্ণা বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, বল কি! শেষ পর্যন্ত তাহলে সত্যি-সত্যিই—

হ্যাঁ, বিষের ক্রিয়ায় মৃত্যু।

কে বিষ দিল?

সব তো তোমাকে বললাম–কে দিতে পারে বলে মনে হয়?

তুমি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছ?

একেবারে যে পারিনি তা নয়, তবে—

তবে? কৃষ্ণা সকৌতুক দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকাল।

হত্যার একটা মোটিভ থাকা দরকার। কিন্তু বর্তমানে হাতের কাছে যে মোটিভটা পাচ্ছি সেটা তেমন যেন খুব একটা জোরালো মনে হচ্ছে না।

আমার কি মনে হচ্ছে জান?

কি?

তোমার ঐ সুভদ্রা না কি যেন নাম বলেছিলে মেয়েটির—

তুমি কি সুভদ্রাকেই—কিরীটীর কথাটা শেষ হল না।

কৃষ্ণা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, কোন মেয়েছেলে যখন ভালবাসা নিয়ে খেলায় মাতে তখন তার কাছে নীতি বলে কিছুই থাকে না, আর–

আর কি? মেয়েদের স্বার্থে ঘা লাগলে তখন তারা একজন পুরুষের চাইতে অনেক নীচে নামতে পারে।

নারী হয়ে তুমি একজন নারীর এত বড় অপযশ গাইছ কৃষ্ণা?

অপযশ গাইব কেন, সত্য যা তাই বলছি। তাছাড়া কোন পুরুষমানুষ কি কোন নারীর সত্যিকারের মূল্যায়ন করতে পারে নাকি?

পারে না বুঝি?

না।

কেন?

কেন কি, সেইটেই তো পুরুষের স্বাভাবিক দুর্বলতা।

কিন্তু এক্ষেত্রে তোমার যুক্তিটা কি? ঐ স্বার্থে ঘা লেঘেছে বলেই কি?

আমার কথাই বা তুমি মেনে নেবে কেন?

আর একটু প্রাঞ্জল যদি হতে দেবী—

আমার মনে হয় সুভদ্রার অনেকখানি অভিনয় আছে—

সে যে একজন পাকা অভিনেত্রী সেটা অবিশ্যি আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু—

একটা কথা ভুলো না।

কি?

তোমায় বলেছি একটু আগে সুভদ্রা অন্তঃসত্ত্বা।

কৃষ্ণা মৃদু হাসল। বলল, বস, চা নিয়ে আসি।

কৃষ্ণা সোফা ছেড়ে উঠে লঘু পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।  

কিরীটীর চিন্তাধারাটাকে কিন্তু কৃষ্ণা যেন অন্য এক খাতে বইয়ে দিয়ে গেল। তবে কি সে ভুল পথে চলেছে!

স্ত্রীলোকের মন বিচিত্র পথে আনাগোনা করে মিথ্যা নয়, এমনিতেই মেয়েদের সহজাত একটা অভিনয়-প্রবৃত্তি থাকে–তার উপরে সুভদ্রা তো রীতিমত অনুশীলনের দ্বারা এত বছর ধরে সেই অভিনয়-প্রতিভাকেই তার ঝালিয়ে তুলেছিল।

সামান্য ইস্পাত আজ ঘষায় ঘষায় ধারালো হয়ে উঠেছে।

একটু পরে কৃষ্ণা দুকাপ কফি নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল।

একটা কাপ কিরীটীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে অন্যটা নিজে নিয়ে মুখোমুখি বসল।

কফির কাপে চুমুক দিয়ে কিরীটী বললে, কৃষ্ণা, আজ একবার বর্ধমান যাব।

হঠাৎ বর্ধমান?

একটু ঘুরে আসি।

সুভদ্রার মাসীর খোঁজ নিতে?

হ্যাঁ। বোনঝিটির পরিচয় পেলাম, মাসীটির সঙ্গে যদি পরিচয় করা যায়—

কখন যাবে?

দুপুরে।

.

রাত নটা নাগাদ বর্ধমান থেকে ফিরে দেড়তলার ঘরে প্রবেশের মুখে দরজার গোড়ায় নজর পড়ল একজোড়া ভারী জুতোর।

মনে হচ্ছে মণীশ চক্রবর্তীর আগমন হয়েছে।

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দেখল তার অনুমান মিথ্যা নয়, বাইরে মণীশ চক্রবর্তীর জুতোই সে দেখেছে।

মণীশ চক্রবর্তী একটা চেয়ারে বসেছিলেন, সামনে একটা খালি চায়ের কাপ।

মণীশবাবু যে! কতক্ষণ?

তা প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হবে। মল্লিক সাহেবকে আপনি ফোন করেছিলেন বুঝি?

হ্যাঁ।

তাঁকে বলেছেন কেসটার কথা?

কথায় কথায় বলেছিলাম।

আমি কি আপনাকে কোন অসম্মান করেছি বা কোনরকম অসহযোগিতা করেছি আপনার সঙ্গে?

না, না। সে কি কথা?

মল্লিক সাহেব মনে হলে যেন একটু ক্ষুন্ন হয়েছেন।

না না, ফোন করে দেবখন। বরং আমি আপনার দক্ষতার প্রশংসাই করছিলাম তাঁর কাছে। যাক, পোস্টমর্টেমের রিপোটা পেয়েছেন?

হ্যাঁ, সন্ধ্যায় পেয়েছি। এই যে দেখুন। আপনার অনুমানই ঠিক—a case of poisoning, stomach contents-এর মধ্যে লিকারের সঙ্গে মনে হচ্ছে কোন তীব্র বিষ ছিল। কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্য পাঠানো হয়েছে ফরেনসিক ল্যাবরেটরীতে স্টমাক কনটেন্টস–

খুব ভাল করছেন। কাচের গ্লাস আর বোতলটাও পাঠিয়েছেন তো?

হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে বললেন, আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানেন কিরীটীবাবু?

কি বলুন তো?

ঐ দোলগোবিন্দ না কি যেন নাম—যে সে রাত্রে হঠাৎ গা-ঢাকা দিয়েছে, এ তারই কীর্তি। নিশ্চয় তারই কীর্তি।

হতে পারে। তা হঠাৎ তারই উপরে সন্দেহটা পড়ছে কেন বিশেষ করে?

নচেৎ ব্যাটা হঠাৎ গা-ঢাকা দিলে কেন? কিন্তু যাবে কোথায়? আমি লোক লাগিয়েছি—ঠিক ধরবই ব্যাটাকে।  

ব্যাপারটা স্রেফ ভয় বা নার্ভাসনেসও তো হতে পারে মিঃ চক্রবর্তী।

না, না কিরীটীবাবু—আপনি যাই বলুন, এতকাল খুনে ডাকাতদের নিয়ে কারবার করছি—ও মশাই সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। আরও একটি লোককে আমার সন্দেহ হয়, ব্যাটা একটি বাস্তু ঘুঘু–

কার কথা বলছেন?

কার আবার—ঐ রাধারমণ পাল, দলের অধিকারী, কেমন ভিজে বেড়ালটির মত হাবভাব দেখাচ্ছিল!

ভদ্রলোক প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছিল বুঝতে পারেননি?

ওটা স্রেফ অভিনয়। বুঝতে পারলেন না, ও দুটোকেই আমি ভাবছি অ্যারেস্ট করব। অ্যারেস্ট করে থানায় এনে চাপ দিলেই দেখবেন স্বীকার করতে পথ পাবে না। হুঁ, বলে কত দেখলাম। মল্লিক সাহেবকে আমি বলে দিয়েছি দুটো দিন অপেক্ষা করুন স্যার, ও রহস্যের মীমাংসা। আমি করে এনেছি প্রায়।

হুঁ, তাহলে শ্যামলকুমারের উপর থেকে সন্দেহটা আপনার গেছে? হঠাৎ কিরীটী বলল।

যায়নি একেবারে, তবে—

তবে?

অতটা আর নেই, তবু তার উপরে আমার চোখ আছে বৈকি।

কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ঐ ধরনের হত্যার একটা মোটিভ—উদ্দেশ্য থাকে, আপনার মনে হয় এ ক্ষেত্রে মোটিভটা কি?

মোটিভ? বুঝতে পারলেন না—কথাটা বলে একটু বিজ্ঞের হাসি হেসে মণীশ চক্রবর্তী কিরীটীর দিকে তাকালেন।

না, ঠিক বোধ হয় এখনও বুঝিনি।

ওদের দুজনেরই strong motive আছে।

যথা?

আজ সকালে দোলগোবিন্দর ছোট ভাইকে থানায় ডেকে আনিয়েছিলাম।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। সে কি বললে জানেন? দোলগোবিন্দ লোকটা নাকি যেমন মাতাল তেমনি একের নম্বরের জুয়াড়ি।

মাতাল, জুয়াড়ি?

হ্যাঁ।

Rare combination বলতেই হবে। তবে পাল মশাইও যেন অমনিই কিছু বলছিলেন।

জানেন শনিবার শনিবার ঘোড়দৌড়ের মাঠে সে যেত, আর সেই ব্যাপারেই হরিদাস সামন্তর কাছে তাকে হাত পাততে হত।

হরিদাস সামন্ত টাকা দিত?

দিত।–হ্যাঁ, খেপে খেপে অনেক টাকা তাকে দিয়েছিল ধার সামন্ত, যার একটা পয়সাও নাকি শোধ করেনি আজ পর্যন্ত দোলগোবিন্দ।

টাকা ধার দিত? টাকা ফেরত পাবে না জেনেও টাকা ধার দিত? আশ্চর্য!

তাই তো শুনলাম। পাল মশাইকেও জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনিও তাই বললেন। এখন বুঝতে পারছেন, সেই টাকা যাতে কোনদিন দোলগোবিন্দকে শোধ করতে না হয় তাই কৌশলেই হয়তো সে হরিদাস সামন্তকে-and that was the motive–

সরিয়ে দিয়েছে বলতে চান?

ব্যাপারটা কি খুব অসম্ভব!

হুঁ, আর রাধারমণ পাল—তার কি স্বার্থ?

আমার কি মনে হয় জানেন?

কি?

লোকটার ঐ সুভদ্রা মেয়েটার উপরে লোভ ছিল।

লোভ?

কেন, থাকতে পারে না? অমন ডবগা ছুঁড়ি, চেহারাখানা ভাবুন তো একবার।

মনে হচ্ছে আপনারও মনে যেন দোলা লাগিয়েছে সুভদ্রা! মৃদু হেসে কিরীটী সকৌতুকে বললে।

যাঃ, কি যে বলেন।

আহা, এতে লজ্জার কি আছে মিঃ চক্রবর্তী! ভাল জিনিস সকলের মনকেই আকর্ষণ করে।

মণীশ চক্রবর্তী সলজ্জ হাসি হাসেন।