০৭. সেই প্রথম দিনের সাক্ষাতের পর

সেই প্রথম দিনের সাক্ষাতের পর, ইতিমধ্যে এই বাড়িতেই কিশোরের সহিত অনুপমের আরও দুই তিনবার দেখা হইয়াছে। কিশোর যে চোর-ডাকাত নহে, সত্য সত্যই একজন ভদ্রলোক, ইহা নিঃসংশয়ে প্রতিপন্ন হইয়া যাইবার পর অনুপমকে অনেক হাসি তামাশা, বিদ্রূপ ও গঞ্জনা সহ্য করিতে হইয়াছিল। সর্বাপেক্ষা বেশী খোঁচা দিয়াছিল সুহাসিনী। তাহার ভুরু দেখিয়া মানুষ চিনিবার ক্ষমতা সম্বন্ধে চোখাচোখা দুই-চারিটি কথা বলিয়া তাহার সর্বাঙ্গে জ্বালা ধরাইয়া দিয়াছিল। এই কারণে কিশোরের উপর অনুপম প্রসন্ন ছিল না। গুণ্ডার পরিবর্তে কলেজের প্রফেসর বনিয়া গিয়া কিশোর। যে তাহাকে সুহসিনী ও তাহার পিতার কাছে অত্যন্ত খেলো করিয়া দিয়াছে, এ আক্রোশ সে কিছুতেই ভুলিতে পারিতেছিল না। সর্বোপরি আরও একটা কারণ হইয়াছিল—যাহাতে কিশোরের বিরুদ্ধে তাহর মন একেবারে বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছিল।

কয়েক বৎসর পূর্বে বিনয়বাবু যখন প্রথম কলিকাতায় আসিয়া হাতিবাগান অঞ্চলে বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, তখন তাঁহার স্ত্রীর সহিত নিকট প্রতিবেশিনী অনুপমের মাতা হেমাঙ্গিনীর শীঘ্রই আলাপ জমিয়া উঠিয়াছিল। ইহারাও আলোকপন্থী হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিলেও পর্দাপ্রথার ধার রিতেন না। তাহার উপর হেমাঙ্গিনী বিধবা হইলেও খুব জবরদস্ত স্ত্রীলোক, অপরিণতবয়স্ক পুত্রের উ নির্ভর না করিয়া নিজেই স্বর্গীয় স্বামীর বিষয় সম্পত্তি পরিদর্শন ও রক্ষণাবেক্ষণ করিতেন। সুত্রং সুহাসিনীর মাতার সহিত তাঁহার আলাপ বন্ধুত্বে পরিণত হইতে বিলম্ব হইল না। সেই সুত্রে অনুপম এ বাড়িতে যাতায়াত শুরু করিল। কিন্তু বন্ধুর পুত্র হইলেও বিনয়বাবুর স্ত্রী তাহাকে হাসিনীর কাছে বেশী ঘেঁষিতে দিতেন না। এই অকালপক্ক নিরতিশয় জ্যাঠা ছোকরাকে তিনি গোড়া হইতেই দেখিতে পারিতেন না; এবং এই জন্যই পাছে পরে কোনরূপ গোলমাল হয়, সুহাসিনীকে তাহার সংস্পর্শ হইতে দূরে দূরে রাখিতেন।

কিন্তু ঠিক সঙ্কট সময়েই তিনি হঠাৎ মারা গেলেন। সুহাসিনীর বয়স তখন পনেরো বছর; অনুপমের তেইশ। অনুপম ঘন ঘন যাতায়াত আরম্ভ করিয়া দিল এবং সুহাসিনীকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করিবার বিধিমত চেষ্টা করিতে লাগিল। সে তখন আইন পাস করিয়াছে এবং পিতৃবন্ধু এক অ্যাটর্নির অফিসে কাজ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। সুতরাং সে যে সুহাসিনীর যোগ্য পাত্র, সে বিষয় কি তাহার মনে, কি তাহার মাতার মনে কোন সন্দেহ ছিল না। বিনয়কৃষ্ণবাবুর কিন্তু ওদিকে দৃষ্টি ছিল না, পত্নীর মৃত্যুতে তিনি দিশাহারা হইয়া পড়িয়াছিলেন। এইভাবে বছরখানেক কাটিবার পর শোকের প্রথম ধাক্কাটা কিছু প্রশমিত হইলে, হেমাঙ্গিনী আসিয়া কথায় কথায় যখন তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিয়া গেলেন যে, সুহাসিনীর বিবাহের বয়স হইয়াছে,এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অনুপমচন্দ্ৰ আসিয়া ভাবে ভঙ্গিতে জানাইয়া দিল যে, এই কন্যাটির পাণিগ্রহণ করিতে সে অনিচ্ছুক নহে, এমন কি বিশেষ ইচ্ছুক, তখন বিনয়বাবু চমকিত হইয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন। জগতে এই এক কন্যা ছাড়া তাঁহার আর কেহ নাই, সেই কন্যাকেও যে শীঘ্রই বিবাহ দিয়া পরের হাতে তুলিয়া দিতে হইবে, তাহা স্মরণ করিয়া এর বুক প্রায় ভাঙিয়া গেল। কিন্তু নিজের সুখ-সুবিধার জন্য কন্যাকে তো চিরকাল কুমারী করিয়া রাখা যায় না! তাই একদিন ভারাক্রান্ত বুকে তিনি কন্যার সম্মুখে কথাটা পাড়িলেন। কিন্তু বিবাহের নাম শুনিয়াই সুহাসিনী তাঁহার বুকের উপর পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল এবং অস্ফুটভাবে যাহা বলিল, তাহা হইতে এইটুকুই বুঝা গেল যে, পিতাকে ছাড়িয়া সে কোনমতেই কোথাও যাইতে পারিবে না।

সেই অবধি পিতাপুত্রীর মধ্যে ও প্রসঙ্গ আর উঠে নাই। কিন্তু অনুপম তিলমাত্র হতাশ না হইয়া অপরিসীম ধৈর্য সহকারে লাগিয়া আছে। সম্প্রতি তাহার মনে একটা আশাও জাগিয়াছিল যে, শীঘ্রই ইহার একটা নিষ্পত্তি হইতে পারে। সুহাসিনীর জন্মতিথির রাত্রিতে সে একটা সঙ্কল্প মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিল।

এমন সময় কোথা হইতে পাপগ্রহের মত কিশোর আসিয়া উদয় হইল, তখন আশঙ্কায় দুর্ভাবনায় অনুপমের মনে তিলমাত্র সুখ রহিল না। এতদিন সে, সুহাসিনী তাহারই বাগদত্তা, এমন একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়া অন্যান্য সম্ভব অসম্ভব প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঠেকাইয়া রাখিয়াছিল; কিন্তু কিশোরকে সে কী করিয়া ঠেকাইবে, কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। কিশোর সুহাসিনীর প্রতি আকৃষ্ট হইয়াই যে ইহাদের সহিত মেলামেশা আরম্ভ করিয়াছে, এ কথা বলা চলে না। বরং অপরপক্ষ হইতেই মিশিবার আগ্রহটা যেন একটু বেশী। গোবেচারা বিনয়বাবু গায়ে পড়িয়া তাহার সহিত ঘনিষ্ঠতা করিতে উৎসুক, এবং সুহাসিনীও—

সুহাসিনীর ব্যবহারই অনুপমকে সর্বাপেক্ষা বেশী আঘাত করিয়াছিল। কয়েক বৎসর ধরিয়া সে সুহাসিনীর পাশে পাশে ফিরিতেছে এবং নানা কৌশলে তাহাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করিবার চেষ্টা করিতেছে। সুহাসিনীও তাহার সহিত বাড়ির লোকের মত ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়াছে, কিন্তু এত মাখামাখি সত্ত্বেও কোথায় যে একটা অলক্ষ্য সীমারেখা রহিয়া গিয়াছিল, অনুপম তাহা অতিক্রম করিতে পারে নাই। সুহাসিনীর মনের অলঙ্ঘনীয় কৌমার্যের গণ্ডীর মধ্যে সে কোনদিন পা বাড়াইতে সমর্থ হয় নাই। কিন্তু এখন সে সন্দেহের দূরদৃষ্টি দিয়া দেখিল যে, এতদিনে সে যাহা পারে নাই, আর একজন লোক দুই হপ্তার মধ্যে সেই গণ্ডীর মধ্যস্থলে ন্যায্য অধিকার স্থাপন করিবার বন্দোবস্ত করিতেছে। সে দেখিতে পাইল, যে দ্বার তাহার কাছে চিরদিন রুদ্ধ ছিল, সেই দ্বারে দাঁড়াইয়া সুহাসিনী সলজ্জ স্মিতহাস্যে আর একজনকে ভিতরে পদার্পণ করিবার জন্য আহ্বান করিতেছে। ইহাতে সে উদ্বেগ ও ঈর্ষার জ্বালায় নিরন্তর ছটফট করিতে লাগিল, কিন্তু বাহিরে তাচ্ছিল্য দেখাইয়া এমন ভাব প্রকাশ করিতে লাগিল, যেন তাহার দীর্ঘ-প্রতিষ্ঠিত প্রভাব অক্ষুণ্ণই আছে, কোন নবাগত উমেদার তাহার উপর আঁচড়টি কাটিতে পারে নাই।

আজ এই বাদল সন্ধ্যায় হঠাৎ একটা আশঙ্কা মনে উদয় হওয়াতে সে ঝড়বৃষ্টি ভেদ করিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছিল এবং এ বাড়িতে প্রবেশ করিবামাত্র যখন সে কিশোরের গলা শুনিতে পাইল, তখন একপ্রকার মরিয়া হইয়াই স্থির করিল যে, আর বিলম্ব নহে, আজই একটা হেস্তনেস্ত সে করিয়া ফেলিবে।

অনুপম আসন গ্রহণ করিলে বিনয়বাবু সরলভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, এই দুযোগে কী এমন কাজ ছিল যে বেরুতে হল?

প্রশ্নটা এড়াইয়া গিয়া অনুপম মুখ বিকৃত করিয়া বলিল, বিষ্টি পড়ে কলকাতা শহরটা হয়ে দাঁড়িয়েছে যেমন নোংরা, তেমনই প্যাচপেচে। এখন থেকে দুমাস ধরে এই কাদা আর বিষ্টি চলল। রেনি সীজনের মত এমন যাচ্ছেতাই ন্যাস্টি সীজন আর নেই।

যে ব্যক্তি দুমাইল পথ জল ভাঙিয়া ও ধাবমান মোটরের ছিটা খাইয়া আসিয়াছে, সে এ কথা বলিতে পারে; কিন্তু এই ঘরে কিছু পূর্বেই এই বর্ষাঋতু লইয়া আর এক প্রকারের আলোচনা হইয়া গিয়াছে। রেনি সীজন যে বেশ উঁচুদরের সীজন, তাহা গান ও বক্তৃতার ভিতর দিয়া উপস্থিত তিনজন একমত হইয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। ইতিমধ্যে বাহির হইতে আসিয়া অনুপম যখন। বিরক্তভাবে সেই রেনি সীজনের নিন্দাবাদ আরম্ভ করিল, তখন ঘরের মধ্যে মনের ঐক্য ও সহানুভূতিতে যে একটি আবহাওয়া সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা ছিড়িয়া যাইবার উপক্রম হইল। পলকের জন্য কিশোর ও সুহাসিনীর চোখাচোখি হইল কিন্তু দুজনেই তৎক্ষণাৎ যেন পরস্পরের মনের ভাব বুঝিয়া ঈষৎ লজ্জিতভাবে দৃষ্টি সরাইয়া লইল।

অনুপমের কথার বেসুরা ভাবটা সারিয়া লইবার অভিপ্রায়ে কিশোর বলিল, আপনি সারাটা পথ কাদা ঘেঁটে আসছেন বলেই ওরকমটা মনে হচ্ছেনইলে বর্ষা ঋতুটা আমাদের তো ভালই লাগে।

অনুপম তাচ্ছিল্যভরে বলিল, সিলি সেন্টিমেন্ট! ও-সব স্কুলমাস্টারি ঢঙ!

কিশোর হাসিতে হাসিতে বলিল, তা হবে। এখানে কিন্তু স্কুল মাস্টারই দলে ভারী। সে যাক, কিন্তু কাজের লোক হবার কত বিপদ দেখুন! আপনাকে এই দুর্যোগ মাথায় করে বেরুতে হয়েছে, আর আমরা বেকার লোক কেমন আরামে বসে বসে গল্প করছি।

এ কথার মধ্যে আপত্তিজনক কিছুই ছিল না, কিন্তু অনুপম মনে করিল, কিশোর তাহাকে বক্র। কটাক্ষ করিয়া আসিতেছে। তাই সে-ও কণ্ঠস্বরে তীব্র শ্লেষ পুরিয়া নীরসভাবে বলিল, তাই তো দেখছি। সন্ধ্যাটা আজকাল আপনার মন্দ কাটছে না। বলিয়া ভ্ৰভঙ্গি করিয়া একবার সুহাসিনীর দিকে তাকাইল।

কিশোর কিন্তু সে ইশারার ধার ঘেঁষিয়াও গেল না, সহাস্যে বলিল, তা বলতে নেই—একরকম ভালই কাটছে। অন্তত উদরের দিক দিয়ে আমার অনুযোগ করবার কিছু নেই।

তা তো বটেই! ভদ্রসমাজে মেশবার সুযোগটা ঘাড়ে চেপে আদায় করে নিচ্ছেন—চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। কথাটা এত রূঢ় যে, বলিয়া ফেলিয়া অনুপমও যেন আড়ষ্ট হইয়া গেল। তারপর কাষ্ঠ-হাসি হাসিয়া কথাটা লঘু করিবার চেষ্টা করিল বটে, কিন্তু কৃতকার্য হইল না।

সুহাসিনী তাহার দিকে বিস্ময়মিশ্রিত একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া আরক্তিমমুখে তাহার দিকে সম্পূর্ণ পশ্চাৎ ফিরিয়া বসিল। কিশোর কিন্তু এ কথাও গায়ে না মাখিয়া পূর্ববৎ হাসিমুখে বলিল, চক্ষুলজ্জা থাকলেই ঠকতে হয়। আর ভদ্রসমাজে মেশবার সুযোগ পেয়েও যদি ছেড়ে দিই, তাহলে আমার মত অভাগা আর কে আছে?

অনুপমের দিকে পিছু ফিরিয়া বসিতেই সুহাসিনীর চৌকিখানা ঠিক কিশোরের মুখোমুখি হইয়া পড়িয়াছিল। সুহাসিনী তাহার দিকে ঝুঁকিয়া বসিয়া বলিল, আমাদের যে কথা হচ্ছিল, তাই হোক। আপনার সঙ্গে যাঁকে ছাদে দেখলুম, তিনিই বুঝি আপনার বৌদি?

অনুপমের অশিষ্ট ও যারপরনাই ইতর ইঙ্গিতে যদি সে অপমানিত বোধ করিয়া থাকে, তাহারই সংশোধনের অভিপ্রায়ে যে সুহাসিনী এতটা কাছে সরিয়া আসিয়া এমন আগ্রহভরে কথা আরম্ভ করিয়াছে কিশোর তাহা বুঝিল, বলিল, হ্যাঁ, উনিই আমার বৌদিদি।

অনুপমের মুখের উপর কে যেন কালির উপর কালি ঢালিয়া দিতে লাগিল। সে কেবল বিদ্বেষপূর্ণ চক্ষু মেলিয়া অন্তরঙ্গভাবে কথোপকথননিরত দুজনের প্রতি চাহিয়া রহিল।

সুহাসিনী প্রশ্ন করিল, ওঁরই বুঝি সেরাত্রে মাথা ধরেছিল?

হ্যাঁ।

কিন্তু কী সুন্দর দেখতে আপনার বৌদিকে চোখ যেন ফেরানো যায় না। আজ কতটুকুর জন্যেই বা দেখেছি, কিন্তু মনে হচ্ছে, ওঁর মত সুন্দরী আর কোথাও দেখিনি।

আপনি ঠিক বলেছেন, আমার বৌদিদির মত সুন্দরী বড় একটা দেখা যায় না। বলিয়া কিশোর নিশ্বাস ফেলিল।

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া গভীর সহানুভুতিভরা দুই চোখ তুলিয়া সুহাসিনী বলিল, বয়স তো বেশী হয়নি, কতদিন ওঁর এ রকম হয়েছে?

এ রকম–? ও বৈধব্য! তা ছমাসের বেশী হতে চলল।

তেমনিই অনুচ্চকণ্ঠে সুহাসিনী জিজ্ঞাসা করিল, ওঁর স্বামী কি আপনার নিজের দাদা ছিলেন?

কয়েক ঘণ্টা পূর্বের ঘটনা স্মরণ করিয়া কিশোর আর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, তার চেয়েও বোধ হয় বেশী আপনার ছিলেন।

কথাটা ঠিক বুঝিতে না পারিলেও এ প্রসঙ্গ লইয়া সুহাসিনী আর প্রশ্ন করিতে পারিল না। কিশোরের পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে আরও অনেক কথা জানিবার জন্য তাহার মন উৎসুক হইয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু জিজ্ঞাসা করা শিষ্টতা-বিগর্হিত হইবে বলিয়া প্রশ্নগুলা তাহার ওষ্ঠাগ্রে আসিয়াও সসঙ্কোচে ফিরিয়া গেল।

ঘরের অপর প্রান্তে অনুপম ইহাদের অনুচ্চ কথাবার্তা কিছুই শুনিতে পাইতেছিল না। উপরন্তু কী একটা কথা বিনয়বাবু তাহার কানের কাছে অনবরত বলিয়া চলিয়াছিলেন, অনুপম মাঝে মাঝে তাহার সংক্ষিপ্ত জবাব দিতেছিল বটে, কিন্তু তাহার মন ও চক্ষু অন্যত্র পড়িয়াছিল।

দুইজন যুবক-যুবতী পরস্পরের খুব কাছাকাছি বসিয়া নীরব হইয়া থাকার মধ্যে এমন একটি নিবিড় বাণীহীন অন্তরঙ্গতা প্রকাশ পায়—যাহা কাহারও চক্ষু এড়াইবার কথা নহে। তাই দূর হইতে এই দুইজনকে সেইভাবে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া অনুপম অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। সে কিছুক্ষণ ছটফট করিয়া হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সুহাসিনীকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, তোমার সঙ্গে দু-একটা কথা কইতে চাই, একবার ও ঘরে শুনে যাও।

বিস্মিত দৃষ্টিতে ঘাড় ফিরাইয়া সুহাসিনী দেখিল, তাহারই উদ্দেশে অনুপম কথাগুলা বলিয়াছে। অনুপমের কণ্ঠস্বরে, তাহার অজ্ঞাতসারেই বোধ করি, এমন একটা আদেশের ভাব প্রকাশ পাইয়াছিল যে, মুহূর্তমধ্যে সুহাসিনীর মুখ কঠিন হইয়া উঠিল। এই হাস্যময়ী মেয়েটি যে প্রয়োজন হইলে স্ফটিকখণ্ডের ন্যায় কঠিন হইতে পারে, আজ তাহা প্রথম লক্ষ্য করিয়া কিশোর মনে মনে যেমন আশ্চর্য হইয়া গেল, তেমনই একটু পরিতৃপ্তিও অনুভব করিতে লাগিল। তাহার মনে হইল, নারীচরিত্রের একটি অপরূপ বিকাশলীলা সে দেখিতেছে। এ ক্ষেত্রে অনুপমচন্দ্র যে এই বিকাশলীলার আঘাতে ধূলিসাৎ হইবার উপক্রম করিয়াছে, তাহাতে তাহার পরিতৃপ্তির তিলমাত্র ব্যাঘাত ঘটিল না।

সুহাসিনীকে নিশ্চেষ্ট দেখিয়া অনুপম আবার বলিল, শুনতে পেলে? একবার এ ঘরে এসো।

সুহাসিনী দুই চোখে বিদ্রোহ ভরিয়া শক্তভাবে বলিল, আপনি কী বলতে চান এ ঘরেই বলুন, আমি শুনছি।

যাবে না?

না।

অনুপমের মুখ দেখিয়া মনে হইল, সে বুঝি এবার বারুদের মত ফাটিয়া পড়িবে। সুহাসিনী তাহ গ্রাহ্য না করিয়া মুখ ফিরাইয়া বসিল; কিন্তু অনুপমের দৃষ্টি তাহাকে অতিক্রম করিয়া কিশোরের নিরপরাধ মস্তকের উপর অগ্নিবর্ষণ করিতে লাগিল। সুহাসিনী তাহাকে অপমান করিয়াছে বটে, কিন্তু এই লোকটা বসিয়া বসিয়া সেই লাঞ্ছনা দেখিতেছে এবং সম্ভবত উপভোগ করিতেছে। তাই আর সকলকে ছাড়াইয়া এই লোকটার উপরেই তাহার ক্রোধের শিখা গগনস্পর্শী হইয়া জ্বলিতে লাগিল।

অনুপমের মুখ দেখিয়া কিশোরের ভয় হইল হয়তো এখনই সে একটা লজ্জাকর বিশ্রী কাণ্ড বাধাইয়া বসিবে। তাহার মত বাহিরের লোকের সম্মুখে পুরাতন বন্ধুদের মধ্যে পাছে একটা অশোভন। কলহ বাধিয়া যায়, তাই সে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। উপায় থাকিলে একটা ছুতা করিয়া সে পৃষ্ঠপ্রদর্শন। করিতেও দ্বিধা করিত না। কিন্তু এ সময় বিদায় লইবার চেষ্টা করিলে সেটা যে নিতান্তই পলায়নের মত দেখাইবে, তাহা বুঝিয়া সে উঠিতে পারিল না।

নিজের উপস্থিতির জন্য কুষ্ঠিত হইয়া সে চুপি চুপি সুহাসিনীকে বলিল, অনুপমবাবু বোধ হয় অসন্তুষ্ট হচ্ছেন, আপনি একবার ও-ঘরে গেলে পারতেন।

অধর দংশন করিয়া সবেগে মাথা নাড়িয়া সুহাসিনী শক্ত হইয়া চেয়ারে বসিয়া রহিল, উঠিল না।

অনুপম অসীম বলে নিজেকে সংবরণ করিয়া বিনয়বাবুর দিকে ফিরিল, আপনিই চলুন তাহলে। আপনার সঙ্গেও কথা আছে।

ভিতরে ভিতরে কী একটা গোলমাল পাকাইয়া উঠিতেছে তাহা স্পষ্টভাবে না বুঝিলেও বিনয়বাবু উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিতেছিলেন।

পাশের ঘরটা বিনয়বাবুর লাইব্রেরি। সেখানে ঢুকিয়া দরজা ভেজাইয়া দিবার পর কিশোর ও সুহাসিনী আগের মতই মৌন হইয়া রহিল। খানিক পরে কিশোর নড়িয়া-চড়িয়া অনুতপ্ত স্বরে বলিল, আমার বোধ হয় উঠে যাওয়া উচিত ছিল। আমি বাইরের লোক—আমার সামনে কথা বলতে ওঁর অসুবিধা হচ্ছিল–

সুহাসিনী তীক্ষকণ্ঠে বলিল, আপনি যেমন বাইরের লোক, উনিও তো তাই।

তা হলেও কিশোর দুঃখিতভাবে ঘাড় নাড়িল।

আরও কিছুক্ষণ নির্বাকভাবে বসিয়া থাকিবার পর সুহাসিনীর হঠাৎ খেয়াল হইল যে, এ ঘরে তাহারা দুজন ছাড়া আর কেহ নাই এবং তাহারা পরস্পরের অত্যন্ত ঘেঁষাঘেঁষি হইয়া বসিয়া আছে। সুহাসিনীর শরীরের উপর দিয়া লজ্জার একটা ঢেউ বহিয়া গেল। সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল এবং ঘরময় এটা-ওটা নাড়িয়া ঘুরিয়া বেড়াইয়া শেষে দূরের একটা চেয়ারে গিয়া বসিল।

বিনয়বাবু ও অনুপম ফিরিয়া আসিতেই কিশোর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আজ তাহলে উঠি। রাতও অনেক হল, প্রায় সাড়ে নটা বাজে। বলিয়া একবার দুই করতল একত্র করিয়া ঘর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

সুহাসিনী বাপের দিকে তীক্ষ দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল তাঁহার মুখ গম্ভীর এবং তাহার উপর একটা বিষণ্ণতার ছায়া পড়িয়াছে। কিন্তু তিনি কোন কথা না বলিয়া আস্তে আস্তে নিজের কেদারায় গিয়া বসিলেন, অনুপমও বোধ করি আবার বসিবার উপক্রম করিতেছিল, কিন্তু সুহাসিনীকে অধীরভাবে ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করিতে দেখিয়া সে আর বসিতে পারিল না; অনিশ্চিতভাবে কিছুকাল দাঁড়াইয়া থাকিয়া অবশেষে হঠাৎ একটা শুভ নিশি জানাইয়া প্রস্থান করিল।

ইহারা চলিয়া যাইবার পর আরও খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া, গলাটা একবার সাফ করিয়া বিনয়বাবু বলিলেন, তোমার মা আজ বেঁচে থাকলে এ-সব ভাবনা কিছুই আমাকে ভাবতে হত না, তিনিই সব করতেন। কিন্তু তিনি যখন নেই তখন যেমন করে তোক আমাকে করতে হবে। অথচ সংসারের এ সমস্ত ব্যাপারে আমি একেবারেই–

কথাটা সমাপ্ত হইল না। বিনয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন।

অনুপম তাঁহার কাছে সুহাসিনীর সহিত বিবাহের প্রস্তাব করিয়াছিল। প্রস্তাবটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত না হইলেও, এমন খোলাখুলিভাবে স্বয়ং পাত্রের নিকট হইতে তিনি প্রত্যাশা করেন নাই। অভিনবপন্থী হইলেও বিনয়বাবু হিন্দুতাই বিবাহের প্রস্তাব কন্যাপক্ষের দিক হইতে আসাই তাঁহার কাছে শোভন ও সুষ্ঠু ঠেকে। অথচ কন্যাপক্ষের দিক হইতে কন্যার আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি যে বিন্দুমাত্র উদ্যোগ বা চেষ্টা করেন নাইপ্রমক্রমেও সৎপাত্রের অনুসন্ধান করেন নাই—এ আত্মগ্লানিও প্রচ্ছন্নভাবে তাঁহার অন্তরে বিদ্যমান ছিল। তাই অনুপমের প্রস্তাব নেহাত নির্লজ্জ বলিয়া প্রতিভাত হইলেও, তাঁহার নিজের দিক হইতে যখন কোন উদ্যোগই নাই, তখন অন্যের উদ্যোগে দোষ ধরিতে তিনি কুণ্ঠিত হইলেন। কিন্তু সহসা অনুপমকে কথা দিতেও পারিলেন না। অনুপমের চেয়ে সুপাত্র যে বঙ্গদেশে বিরল নহে, এ জ্ঞান বিনয়বাবুর মত ভাল মানুষেরও ছিল; তাই নিজের অক্ষমতার দোষে, যে ব্যক্তি প্রথম পাণিপ্রার্থনা করিল তাহারই হস্তে কন্যাসমর্পণের প্রতিশ্রুতি দিতে পারিলেন না। অনুপমকে বলিলেন, আচ্ছা, আমি সুহাসের মন বুঝে তোমাকে বলব। মনে মনে ভাবিলেন, সুহাস বড় হইয়াছে, সে যদি স্বেচ্ছায় পছন্দ করিয়া রাজী হয়, তবে তাঁহার আর, ক্ষোভ করিবার কিছু থাকিবে না।

কিন্তু তবু তাঁহার সঙ্গিহীন পিতৃহৃদয় কন্যার সহিত আসন্ন বিচ্ছেদের চিন্তায় ম্রিয়মাণ ও ব্যথাতুর হইয়া উঠিল।

সুহাসিনীও তাঁহার অসম্পূর্ণ ভূমিকার কোন অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিয়া আশঙ্কায় পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল, উৎকণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে, বাবা? অনুপমবাবু কী বলে গেলেন?

বিনয়বাবু কন্যার দিকে না তাকাইয়া চুলের মধ্যে অঙ্গুলি চালনা করিতে করিতে বলিলেন, অনুপম তোমার সঙ্গে তার বিবাহের প্রস্তাব করে গেল। তা—আমি তাকে বলেছি, এ বিষয়ে তোমার মতামত জেনে–

অজ্ঞাতে সাপের ঘাড়ে পা দিয়া মানুষ যেমন চমকাইয়া উঠে, সুহাসিনী তেমনই করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল। আজ এ বাড়িতে প্রবেশ করিয়া অবধি অনুপম অনেক ধৃষ্টতা করিয়াছে বটে, কিন্তু এই শেষ ধৃষ্টতা সুহাসিনীর কাছে যেন তাহার সকল স্পর্ধাকে লঙ্ঘন করিয়া গেল।

এ হতে পারে না। তুমি—তাঁকে বলে দিও-এ অসম্ভব। বলিয়া উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া সে ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *