০৭. ধর্ম-শাস্ত্ৰ

ধর্ম-শাস্ত্ৰ

পশ্চিমের পণ্ডিতেরা বলেন প্রাচীন হিন্দুর বুদ্ধিটা ছিল ঘোলাটে। যে-সব জিনিস পরস্পর থেকে অতি স্পষ্ট তফাত, এরা তাদেরও ঘুলিয়ে এক করে ফেলেছে। যেমন ধর্ম আর আইন। এর একের সঙ্গে অন্যের কিছু সম্পর্ক নেই। এর একটি হল ইহলোকের, অন্যটি পরকালের। একটির স্থান ধর্মমন্দির, অন্যটির আদালত। একটির কর্মকর্তা পুরোহিত, ধর্মযাজক, অন্যটির জজ কৌঁসুলি। অথচ প্রাচীন হিন্দু বলে, তার আইন তার ধর্মেরই অঙ্গ। তার আদালত হচ্ছে ধর্মাধিকরণ, তার জজ-জুরি হল ধর্মপ্রবক্তা। উত্তরে আমরা নব্যহিন্দুরা বলি–ওই তো ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের বিশেষত্ব। ওইখানেই হিন্দুর হিন্দুয়ানি। অন্য সব জাতির স্বৰ্গ ও মর্ত্য, ধর্ম ও সংসারের মধ্যে ভেদ আছে—কিন্তু হিন্দুর নেই। হিন্দুর যা ‘অমূত্র’ তাই ‘ইহ’। তার সংসারযাত্রার প্রতি খুঁটিনাটি ধর্মশাসিত। দাঁতমােজা থেকে ব্ৰহ্মধ্যান, সবই তাব ধৰ্মাচরণ। হিন্দু ধৰ্মৈকপ্ৰাণ, ধর্মসর্বস্ব।

গল্প আছে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস নবপ্রতিষ্ঠিত রয়্যাল সোসাইটির মুরুকিব হয়ে তার সভ্যদের প্রশ্ন করেছিলেন–বাঁচা মাছের চেয়ে মরা মাছ ওজনে ভারী কেন? সমিতির পণ্ডিতেরা ভেবে চিন্তে নানা জনে নানা কারণ দর্শালেন, কিন্তু কোনও ব্যাখ্যাই সকলের তেমন মনঃপূত হল না। শেষে একজন পণ্ডিত একটা বাঁচা মাছ এনে ওজন করে, মেরে তাকে আবার ওজন করলেন; ওজন বেশি দেখা গেল না। প্রাচীন হিন্দুকে নিয়ে পশ্চিমের পণ্ডিতের সঙ্গে নবাহিন্দুর যে বিচার বিতর্ক, সেও এই ধরনের। প্রাচীন হিন্দুসভ্যতা সম্বন্ধে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা যে-সব তথ্য প্রচার করেন, সেগুলি সত্য কি মিথ্যা, তা পরখ করে দেখা আমরা দরকার মনে করিনে। মনে মনে বিশ্বাস আছে, এ সম্বন্ধে তাদের বাক্য আপ্তবাক্য। আমরা বুদ্ধি খাটিয়ে সেই সব তথ্য থেকেই নানা তত্ত্ব বের করি, এবং তার বলে প্রমাণ করি, যে-সব কারণে তাঁরা হিন্দুসভ্যতাকে বলেন খাটো, ঠিক সেই কারণেই হিন্দুসভ্যতা সবচেয়ে উচু। তাঁরা বলেন প্রাচীন হিন্দু যে ধর্ম থেকে আইনকে তফাত করতে পারেনি, তাতেই প্রমাণ এ বিষয়ে তাদের সভ্যতা আদিম অবস্থা ছাড়িয়ে বড় বেশি দূর এগুতে পারেনি; কারণ সভ্যতার প্রথম অবস্থায় ও-দুই জিনিস একসঙ্গেই মিশে থাকে, সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে মানুষ ক্রমে তাদের পৃথক করে নেয়। আমরা বলি প্রাচীন হিন্দুরা যে ধর্ম থেকে আইনকে তফাত করেনি, তাতেই প্ৰমাণ এ বিষয়ে তাঁরা সভ্যতার একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছেছিলেন; কারণ সভ্যতার চরম অবস্থায় মানুষ আইনের ধারা মানবে ধর্মবুদ্ধিতে, ‘ল’ যাবে মর্যালিটিতে মিশে। এখন যদি প্রমাণ হয় যে, প্রাচীন হিন্দুরা ধর্ম ও আইন মোটেই মিশিয়ে ফেলেনি, ওদু’জিনিসকে খুবই তফাত করে দেখেছে, এমনকী, এত তফাত করে যে বিংশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের আইনেও ধর্ম ও আইনের তফাত তত বেশি নয়,(১) তবে মুশকিল হয় এই যে, তাতে কেবল পাশ্চাত্য পণ্ডিতের পাণ্ডিত্য আঘাত পায় না, নব্যহিন্দুর হিন্দুয়ানিতেও ঘা লাগে।

হিন্দুর আইন যে হিন্দুর ধর্ম থেকে পৃথক ছিল না, আর দন্তধাবন ও সত্যভাষণ দুই-ই যে তার ধর্ম— পাশ্চাত্য পণ্ডিত ও নব্যহিন্দুর এই বিশ্বাসের মূল একটি প্রত্যক্ষ-প্রমাণ। সে প্রমাণ হচ্ছে, প্রাচীন হিন্দু একই শাস্ত্ৰে আইন, দস্তধাবন ও সত্যভাষণের ব্যবস্থা দিয়েছে; এবং সে শাস্ত্রের নাম ধর্মশাস্ত্ৰ। হিন্দুর ধর্মশাস্ত্রে যা আছে তাই যে হিন্দুর ধর্ম, এতে আর কথা চলে না। এবং গর্ভাধান থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের এমন কোনও অবস্থা নেই, যার ব্যবস্থা ধর্মশাস্ত্রে নেই। সুতরাং হিন্দুর জীবনের প্রতি কাজ যে ধর্ম এতে আর সন্দেহ কী। তাই বঙ্কিমবাবু অনেক আগেই বলেছেন হিন্দুর ‘ধর্ম’ খ্রিস্টানের রিলিজিয়ন’ নয়। হিন্দুর ধর্ম বড় ব্যাপক জিনিস। এবং তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন ‘ধৰ্ম’ মানে কালচার’ অর্থাৎ হিন্দুধৰ্ম মানে ‘হিন্দু কালচার’। কিন্তু ‘ধর্ম’ কথাটা রিলিজিয়ন’-এর প্রতিশব্দ নয়, ‘কালচার’-এর প্রতিশব্দ, এই আভিধানিক তথ্য নিয়ে তো হিন্দু-সভ্যতার ভালমন্দ বিচারের কোনও তর্ক ওঠে না। তর্ক যে উঠেছে তার কারণ, এ কথার মধ্যে একটু ইঙ্গিত আছে; এর অভিধা ছাড়িয়ে একটা ব্যঞ্জনা রয়েছে। হিন্দুর ‘ধর্ম’ ‘রিলিজিয়ন’ নয়, ‘কালচার’; কিন্তু তার সমস্ত কালচারটািই তার ‘রিলিজিয়ন’। অর্থাৎ খ্রিস্টানের গির্জায় গিয়ে হাঁটুগাড়ার সঙ্গে যে মনোভাব রয়েছে, হিন্দুর শৌচাচারের সঙ্গে সেই মনোভাবেরই যোগ রয়েছে। হিন্দুর রিলিজিয়াস’ ও ‘সেকুলার’-এর মধ্যে ভেদ নেই, কারণ সমস্ত সাংসারিক কাজও তাকে করতে হবে ‘রিলিজিয়াস’ মনোভাব নিয়ে। হিন্দু-সভ্যতার যদি এই আদর্শ হয়, তবে সেটা ভাল কি মন্দ তা নিশ্চয়ই তর্কের বিষয়।

কিন্তু কথাটা একেবারেই মিথ্যা। প্রাচীন হিন্দু ‘সেকুলার’ ও রিলিজিয়াস’ ঐহিক ও পারিত্রিক–এর মধ্যে প্রভেদ করেনি, এ তথ্য সম্পূর্ণ অমূলক, টীকাকারদের ভাষায় শশবিষাণের মতো অলীক’ ও দুয়ের মধ্যে যে ভেদের গণ্ডি তাঁরা টেনেছেন তা গভীর, যে প্রাচীর তুলেছেন তা দুর্লঙ্ঘ্য। আমাদের নব্যহিন্দুদের যদি তা চোখে না পড়ে, সে আমরা চোখ বুজে আছি বলে। এবং চোখ চেয়ে দেখলে হয়তো বা মনঃক্ষুন্ন হব।

ধৰ্মশান্ত্রে ‘ধর্ম’ কথার অর্থ কী, এ আমাদের মাথা ঘামিয়ে বের করতে হবে না। ধর্মশাস্ত্রের প্রাচীন ভাষ্য ও টীকাকারেরা তা খোলাখুলিই বলে গেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘ধৰ্ম শব্দঃ কৰ্ত্তব্যতাবাচনঃ’(২), যা কর্তব্য, ‘ধর্ম’ শব্দ তারই বাচক। ‘ধর্ম শব্দঃ কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্যয়োবিধি প্ৰতিষেধয়োঃ…দুষ্টপ্রয়োগঃ’(৩) যা কর্তব্য এবং যা অকর্তব্য তার বিধি ও তার নিষেধ অর্থেই ‘ধর্ম’ শব্দের প্রয়োগ হয়। অর্থাৎ ধর্ম মানে কর্তব্য। মানুষের যত কিছু কর্তব্য— পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, ব্যক্তিগত ও রিলিজিয়াস’–এ সকলের সাধারণ নাম ‘ধৰ্ম’। এ সব বিভিন্ন কর্তব্যের যে এক নাম, এবং এক শাস্ত্ৰে যে তাদের ব্যবস্থা, তার কারণ, ভিন্ন হলেও একই মানুষের ব্যক্তিত্বের অদ্বয় যোগ-সূত্রে তাঁরা একসঙ্গে বাধা আছে। এ-সব কর্তব্যই একই মানুষের নানা সম্বন্ধ ও নানা সম্পর্কের কর্তব্য। কিন্তু যেমন তাদের ঐক্য আছে, তেমনি ভেদও আছে। সব কর্তব্যের মূল এক নয়, প্রমাণ এক নয়। সব কর্তব্যই রিলিজিয়াস’ নয়, কারণ ‘রিলিজিয়াস’ কর্তব্য নানারকম কর্তব্যের মধ্যে একরকমের কর্তব্য মাত্র।

এই ভেদ সম্বন্ধে ধর্মশাস্ত্রকারদের ‘থিয়োরি’ সংক্ষেপে এই— মানুষের যা সব কর্তব্য, তার দুটো ভাগ। একভাগ বেদমূল, অন্যভাগ ন্যায়মূল। যে কর্তব্যের মূল বেদ, তা অন্য কোনও প্রমাণে জানা যায় না। বেদের বাক্যই তা জানার একমাত্র উপায়। স্মৃতি বা সদাচার থেকে যে এরকম কর্তব্য জানা যায়, তারও মূল বেদ, কারণ স্মৃতির বচন থেকে বা সাধুদের আচার দেখে সেইরূপ বেদবাক্যের বা বিধির অনুমান করা যায়। কিন্তু মানুষের যে-সব কর্তব্য প্রত্যক্ষ বা অনুমান প্রভৃতি লৌকিক প্রমাণে জানা যায়, যে-সব কর্তব্য বেদমূল নয়, ন্যায়মূল। সেখানে বেদের প্রসার নেই, কারণ তাঁরা বেদের বিষয় নয়। মনুর ভাষ্যকার মেধাতিথি বলছেন—‘ধৰ্ম নামে মানুষের যে পুরুষাৰ্থ অন্য কোনও প্রমাণ থেকে জানা যায না, তাদের জানিয়ে দেয় বলেই বেদের নাম বেদ। এই ধর্ম শ্ৰেয়ঃসাধন করে বলেই মানুষের কর্তব্য, কিন্তু কেমন করে যে সে শ্ৰেয়ঃসাধন করে, তা প্রত্যক্ষ কি অনুমান কোনও লৌকিক প্রমাণেই জানা যায় না। আরও সব কাজ আছে যা শ্ৰেয়ঃসাধন করে বলে মানুষের কর্তব্য, যেমন কৃষি৷ কৃষি যে কেমন করে মানুষের শ্রেয়ঃসাধন করে, তা সাধারণ অন্বয়ব্যতিরেক প্রমাণেই (induction by agreement and difference) জানা যায়। এবং কেমন করে কৃষিসাধন করলে যে ফসল পাওয়া যাবে, তাও প্রত্যক্ষ ও অনুমানেই জানা যায়। কিন্তু যাগযজ্ঞ কেমন করে সাধন করতে হবে, এবং তার সাধনফলে পরকালে কী করে যজমানের সুখ কি স্বৰ্গলাভ হবে, সে জ্ঞান প্রত্যক্ষ কি অনুমান কোনও লৌকিক জ্ঞানের প্রণালী দিয়েই পাওয়া যায় না। এ ধর্ম কেবল জানা যায় বেদের ব্রাহ্মণ অংশের বিধিবাক্য থেকে, এবং কচিৎ মন্ত্র অংশ থেকে।(৪)

এই থিয়োরি’ অনুসারে ধর্মশাস্ত্রকারেরা বলেছেন, রাজধৰ্ম বা ‘পলিটিকস’ বেদমূল নয়, ন্যায়মূল।(৫)’ আইন বা ব্যবহার স্মৃতি, তাও বেদমূল নয়—ন্যায়মূল্য।(৫) পশ্চিমের পণ্ডিতেরা যদি অন্য কথা বলেন, এবং আমরা যদি সেই কথাকে আমাদের পূর্বপুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বলে চালাই, তার দায়ী প্রাচীন হিন্দু নয়।

প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রকারদের এই ‘থিয়োরিতে অনেক নবীন হিন্দু খুব সম্ভব বোজার হবেন। কারণ এ ‘থিয়োরিতে হিন্দুধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, এবং বিজ্ঞানের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা, এ দুয়েরই পথ বন্ধ। শাস্ত্রকারেরা বলেন, যা অলৌকিক তা লৌকিক যুক্তি ও বিচার দিয়ে বুঝবার চেষ্টা পণ্ডশ্ৰম; আর যা লৌকিক, তা লৌকিক যুক্তি বিচারেই বুঝতে হবে, তার মধ্যে অলৌকিককে টেনে আনা মূর্থিতা। কিন্তু হিন্দুধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল অলৌকিককে লৌকিক দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা; আর বিজ্ঞানের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা হল লৌকিকের মধ্যে অলৌকিককে এনে ফেলা। হিন্দুধর্মের কোনও অংশের যদি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে, তবে ধর্মশাস্ত্রকারদের ‘থিয়োরি’ মতে সে অংশটা বেদমূল ধৰ্ম অর্থাৎ ‘রিলিজিয়ন’ নয়, ন্যায়মূল লৌকিক কর্তব্য মাত্র। তার ভালমন্দ যুক্তি দিয়ে বিচার করতে হবে, কারণ শাস্ত্রবাক্যের সেখানে প্রসার নেই। অর্থাৎ প্রত্যুষে ফুলতোলা ও একাদশীতে উপবাস যদি স্বাস্থ্যের জন্য হয়, তবে তার ব্যবস্থা নিতে হবে ভট্টচায্যের কাছে নয়, কবিরাজের কাছে। এবং এতে যার স্বাস্থ্য ভাল না। থাকে, তার পক্ষে এ সব কর্তব্য নয়; এ নিয়ে শাস্ত্রের বচন তুলে ধর্মের দোহাই দেওয়া বৃথা। আর যাগযজ্ঞে মানুষের মঙ্গল হয়, শাস্ত্রের বচনে যদি এতে বিশ্বাস জন্মে— ভাল কথা। যদি না হয় তো ফুরিয়ে গেল। লৌকিক যুক্তি তর্ক দিয়ে তা আর প্রমাণ করা যাবে না।

যে মনোভাবের বশে ধর্মশাস্ত্রকারেরা অলৌকিককে লৌকিক থেকে একেবারে পৃথক করে দেখেছিলেন, সে ‘র্যাশন্যালিজম’ বা যুক্তিতন্ত্রতা প্রাচীন আৰ্যমনোভাবের একটা প্রধান লক্ষণ। যা চোখ মেললে স্পষ্ট দেখা যায়, চোখ অর্ধেক বুজে তাকে ঝাপসা করে দেখা তাদের স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। যেটা যুক্তি ও বিচারের ক্ষেত্র, তাকে আধ্যাত্মিকতার মোহ, কি হৃদয়াবেগের কুয়াশার মধ্য দিয়ে তাঁরা দেখতে রাজি ছিলেন না; বৃদ্ধির উজ্জ্বল সূৰ্যালোক সেখানে ছিল তাদের একমাত্ৰ কাম্য। ধর্মশাস্ত্রকার ও তার টীকাকারদের লেখার প্রতি পাতায় এই র্যাশনালিজম’-এর পরিচয় রয়েছে। যা বিচার ও যুক্তির ব্যাপার, সেখানে যুক্তি ও বিচার যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে পৌঁছতে তাদের বিন্দুমাত্র ভয় কি দ্বিধা ছিল না। বিচার-বিতর্ক আমরাও কিছু কম করিনে। কিন্তু তর্কে হেরে কে কবে নিজের ধর্ম ছেড়ে প্রতিবাদীর ধর্ম নিয়েছি, নিজের মতকে প্রকাশ্যে মিথ্যা স্বীকার করে প্রতিদ্বন্দ্বীর শিষ্য হয়েছি? বরং এ কাজ যে করে, তাকে বলি কাণ্ডজ্ঞানহীন। কিন্তু প্ৰাচীন হিন্দুর পণ্ডিতসমাজে এ ঘটনা যে নিত্য ঘটত, জনশ্রুতি তার সাক্ষী দিচ্ছে। প্রাচীন আর্যেরা যুক্তিকে কেবল মুখে নয়, জীবনে স্বীকার করতেন।

কিন্তু যুক্তিতন্ত্ৰতা ধর্মশাস্ত্রের প্রধান কথা নয়। আৰ্য-মন-যুক্তিতন্ত্রী বলে ধর্মশাস্ত্রেও তার ছাপ লেগেছে। ধর্মশাস্ত্র হচ্ছে গঠন ও শাসনের শাস্ত্র। এখানে যে মনোভাবের মুখ্য পরিচয়, সে হচ্ছে শিল্পী ও শাসকের, organiser ও administrator-এর মনোভাব। ধর্মশাস্ত্রকারদের চোখের সামনে ব্যক্তি ও সমাজের একটি স্পষ্ট ও পূর্ণ আদর্শমূর্তি ছিল। তঁহাদের বিধিব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তি ও সমাজকে ঠিক সেই আদর্শের মতো মূর্তি দিয়ে গড়ে তোলা। এবং এ কাজে তাদের সাহসের অন্ত ছিল না। মানুষের জীবনকে তাঁরা মনে করতেন শিল্পীর মূর্তিগড়ার উপাদান। সহস্ৰ বিধিনিষেধের অস্ত্ৰে কেটে যে একে মনের আদর্শমূর্তির সঙ্গে সূক্ষ্মানুসূক্ষ্মভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায়, তাতে তাদের সন্দেহ ছিল না। এবং ব্যক্তি ও সমাজের জীবনের কোনও অংশ অনিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ অগঠিত থাকবে, তাদের মন ছিল এ মনোভাবের বিরুদ্ধ। এ বিষয়ে প্রাচীন আৰ্য-মন ছিল যাকে এখন আমরা বলি। ‘বুরোক্র্যাটিক’ মন। ধর্মশাস্ত্রকারদের চেষ্টার ফলে প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার হিত হয়েছে বেশি, না অহিত হয়েছে বেশি, এ অবশ্য তর্কের কথা। মানুষের জীবনকে কতটা হাতে গড়ে তোলা যায়, আর প্রাণবন্ত বলে কতটা ছাড়া রাখলে তবে সে নিজে গড়ে ওঠে–এ বিচারের হয়তো কোনও চরম মীমাংসা নেই। বাঁধনের বাধায়, ক্লিষ্ট হয়ে একবার সে চাবে মুক্তি, আবার ছন্দহীন মুক্তিতে হাঁপিয়ে উঠে খুঁজবে নতুন বন্ধন। সে যাহোক, জীবনের প্রাণপন্থা ও শিল্পপস্থার বিচারে প্রাচীন অর্যেরা ছিলেন শিল্পপহী। যাঁরা সাধারণ মানুষের মধ্যে অসাধারণ, তাঁরা যে বিধিনিষেধের এত শাসন মানবে না, ধর্মশাস্ত্রকারদের তা অজ্ঞাত ছিল না। প্রাচীন আচাৰ্য গৌতম বলেছেন, ‘দৃষ্টো ধৰ্ম্ম-ব্যতিক্রমঃ সাহসঞ্চ মহতাম, যাঁরা মহৎ তাদের সাহস আছে, তাঁরা ধর্মবিধিকে অতিক্রম করে থাকেন। কিন্তু বুদ্ধি ও মনে যাঁরা মধ্যবিত্ত, বিধিনিষেধ অতিক্রম করে চলার অধিকার তাদের দিতে ধর্মশাস্ত্রকারদের সাহস ছিল না। প্রাচীন হিন্দুরা ব্যাকরণের জটিল বন্ধনে ভাষাকে বেঁধেছিলেন। ঋষিদের বাক্য এ জটিলতাকে মানবে না, মহাকবিরা যে এ বন্ধন ছাড়িয়ে যাবেন, তা তাঁরা জানতেন। কিন্তু যাঁরা ঋষিও নয়, কবিও নয়, তাদের স্বেচ্ছাচারকে তাঁরা অত্যাচার বলেই মনে করতেন।

কার্তিক ১৩৩২

—————-
(১) জুলাই মাসের The Visva Bharati Quarterly পত্রিকায় The Spirit of Hindu Law প্রবন্ধে এ কথা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি।
(২) মেধাতিথি, ৭/১
(৩) মেধাতিথি, ১/২
(৪) বিদন্ত্যনন্য প্রমাণবেদ্যং ধৰ্ম্মলক্ষণমৰ্থমস্মাদিতি বেদঃ। …যৎ পুরুষস্য কৰ্ত্তব্যং প্রত্যক্ষাদাবগম্য বিলক্ষণ স্বভাবেন। শ্ৰেয়ঃসাধনং কৃষিসেবাদি ভবতি পুরুষস্য কৰ্ত্তব্যত্বস্য চ তৎসাধনস্বভাবোহন্বয়ব্যতিরেকাভ্যামবগম্যতে। যাদৃশেন ব্যাপারেণ কৃষ্যাদেব্রীহ্যাদিসিদ্ধিঃ সাপি প্রত্যক্ষাদ্যবাগম্যৈব। যাগাদেন্তু সাধনাত্বং যেন চ রূপেণাপূৰ্ব্বোৎপত্তিব্যবধনাদিন তন্ন প্রত্যক্ষাদ্যাবগম্যম।… অয়ং ধৰ্ম্মে ব্ৰাহ্মণবাক্যোভ্যোহবিগম্যাতে লিঙাদিযুক্তেভ্যঃ, ক্বচিচ্চ মন্ত্রেভ্যোহপি। (মেধাতিথি–মনুভাষ্য, ২/৬
(৫) প্রমাণাস্তবমুলা হ্যত্র ধৰ্ম্মা উচ্চ্যন্তে ন সৰ্ব্বে বেদমুলাঃ।। (মেধাতিথি -মনুভাষ্য, ৭/১)
(৬) অন্যত্ৰাপি ব্যবহাবস্মৃত্যান্দেী যাত্র নায়মূলত তত্র যথাবসবং দর্শযিযামঃ। (মেধাতিথি, ২/৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *