০৭. দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী

শতদলবাবু বাড়িতে ফিরে এসেছেন, অবিনাশ? দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী অবিনাশের দিকে তাকিয়ে।

আজ্ঞে, কই না! দাদাবাবু তো এখনও ফেরেননি বাবু। মৃদুকণ্ঠে অবিনাশ জবাব দিল।

কখন ফিরবেন কিছু বলে গিয়েছেন? কিরীটী অবিনাশকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করে।

আজ্ঞে না। তা তো কিছুই বলে যাননি।

কোথায় গিয়েছেন তুমি জান?

না।

অতঃপর কিরীটী আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, চল সু ভিতরে গিয়ে বসা যাক। এখনি হয়তো শতদলবাবু এসে পড়বেন—চলুন সীতা দেবী।

সকলে আমরা অন্দরের দিকে অগ্রসর হলাম। অন্ধকার বারান্দাটা। আগে আগে হ্যারিকেন বাতিটা হাতে ঝুলিয়ে চলেছে অবিনাশ, পশ্চাতে অমিরা তিনজন। বেশী দূর অগ্রসর হইনি, একটা খসখস শব্দ শুনে সামনে দিকে তাকাতেই অস্বচ্ছ আলোকিত বারান্দাপথে নজর পড়ল ইনভ্যালিড চেয়ারটার উপরে উপবিষ্ট পক্ষাঘাতে চলচ্ছক্তিহীন হিরণ্ময়ী দেবী দুই হাতে মন্থর গতিতে উপবিষ্ট চেয়ারটার দুই পাশের চাকা দুটো দুপাশের হ্যান্ডেলের সাহায্যে ঘোরাতে ঘোরাতে ঐদিকেই এগিয়ে আসছেন।

সকলের আগে ছিল হ্যারিকেন হাতে অবিনাশ, তাকেই প্রশ্ন করলেন উদ্বেগাকুল কণ্ঠে হিরণ্ময়ী দেবী, অবিনাশ, সীতা এল?

অবিনাশ জবাব দেবার আগেই সীতা জবাব দেয়, এই যে মা, এসেছি আমি–বলতে বলতে সামনের দিকে সে এগিয়ে যায়।

অন্ধকারে পশ্চাতে বোধ হয় আমাকে ও কিরীটীকে দেখতে পাননি প্রথমটায় হিরণ্ময়ী দেবী। তাঁর রুক্ষ বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এত রাত করে কোথায় ছিলে শুনি? কিন্তু পরক্ষণেই কিরীটীকে সীতার পশ্চাতে দণ্ডায়মান দেখে হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠের ক্ষণপূর্বের সমস্ত বিরক্তি যেন নিমেষে অন্তর্হিত হয়ে গেল এবং এবারে আর কন্যাকে নয়, কিরীটীকেই সম্বোধন করে প্রশান্ত স্নিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, এ কি। কিরীটীবাবু নাকি? আসুন, আসুন। কোথায় দেখা হল আপনার সঙ্গে ওর?

 তুমি ওঁদের ভিতরে নিয়ে এস মা। আমি চায়ের জল চাপাচ্ছি। কথাগুলো বলে সীতা সহসা অন্ধকারে বেশ যেন দ্রুত পদবিক্ষেপেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

তীক্ষ্ণ একটা দৃষ্টি কন্যার গমনপথের দিকে মুহূর্তের জন্য নিক্ষেপ করে হিরণ্ময়ী দেবী আমাদের দিকে আবার ফিরে তাকালেন। ইনভ্যালিড চেয়ারটার হ্যাণ্ডেলের উপরে রক্ষিত দুই হাতের মুষ্টি দুটো মনে হল যেন মুহূর্তের জন্য কঠিন হয়ে আবার শ্লথ হয়ে গেল। এবং এবারে শান্তকণ্ঠে কিরীটীকেই লক্ষ্য করে বললেন, চলুন মিঃ রায়। শতদলের কাছেই বোধ হয় এসেছেন! সে বোধ হয় তো বাড়িতে নেই, ক্ষণপূর্বেই বিরক্তির লেশমাত্রও কণ্ঠস্বরে নেই।

সকলে আবার ভিতরের দিকে অগ্রসর হলাম। অবিনাশ আগে আগে আলো দেখিয়ে চলল। সকলের আগে হিরণ্ময়ী দেবীর চলমান ইনভ্যালিড চেয়ারটার পাশাপাশি হেঁটে চলেছে কিরীটী। পশ্চাতে আমি।

আপনাদের এদিকেই আসছিলাম। পথেই আপনার মেয়ের সঙ্গে দেখা হতে তাঁরই মুখে শুনলাম শতদলবাবু বাড়িতে নেই। কিরীটী এতক্ষণে কথা বললে।

গতরাত্রের ব্যাপার বোধ হয় তাহলে সীতার মুখেই সব শুনেছেন মিঃ রায়?

হ্যাঁ, শুনলাম। মৃদুস্বরে জবাব দেয় কিরীটী।

এর পর আর এ-বাড়িতে বাস করা খুব বিবেচনার কাজ হবে না—আপনি কি বলেন কিরীটীবাবু?

খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন নিশ্চয়ই?

কি বলছেন আপনি মিঃ রায়! এই সেদিন রাত্রে শতদলের ঘরে কে বন্দুক ছুঁড়ল এবং শতদলের মুখেই কালকের রাত্রের ঘটনার পর আজ সকালে শুনলাম ইতিপূর্বেও নাকি তার উপরে আক্রমণ হয়েছিল—

সে তো তাঁর জীবনের ওপরে attempt হয়েছিল! জবাব দিলাম আমি।

কিন্তু কাল রাত্রের ঘটনাটা? সীতার কুকুরটাকে গুলি করেছে! এক বাড়িতে যখন আছি, ওর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘাড়েও বা বিপদ আসতে কতক্ষণ? আমিও ওঁকে আজ স্পষ্টই বলে দিয়েছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ-বাড়ি ছেড়ে আমরা চলে যাব। সুখের চাইতে স্বোয়াস্তি ভালো—কি বলেন মিঃ রায়!

তা তো বটেই। কিরীটী জবাব দেয় মৃদুকণ্ঠে।

আমরা সকলে এসে হরবিলাসবাবুর ঘরেই ঢুকলাম। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই নজরে পড়ল হিরণ্ময়ী দেবীর পূর্বেকার ঘরের মত এ ঘরখানির মধ্যেও রুচিসম্মত পরিচ্ছন্নতা। দুদিনের মধ্যেই ঘরখানি তিনি সুন্দরভাবে সাজিয়ে নিয়েছেন, তবে এ ঘরেও লক্ষ্য করলাম জানালাগুলো প্রায় সবই ভিতর হতে বন্ধ। একটা বদ্ধ বায়ু যেন থমথম করছে।

বসুন, মিঃ রায়। বসুন সুব্রতবাবু।

হিরণ্ময়ী দেবীর আহ্বানে আমরা দুজনে দুখানা খালি চেয়ার টেনে নিয়ে উপবেশন করলম।

ঘরের সিলিং থেকে একটা প্রকাণ্ড গোলাকৃতি সাদা ড়ুমের মধ্যে চারটে মোমবাতি জ্বলছে। এবং তাতেই ঘরটা বেশ পরিষ্কার ভাবেই যেন আলোকিত হয়ে উঠেছে।

ঘরে প্রবেশ করতেই দেওয়ালে টাঙানো কয়েকখানা চিত্র দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে। তার মধ্যে গোটা দুই ল্যান্ডস্কেপ এবং বাকি দুটো অল্পবয়সী দুই নারীর অয়েল-পেন্টিং।

দুটি নারী-প্রতিকৃতি একটু নজর দিয়ে দেখলেই মনে হবে দুটি যেন যমজ বোন। মুখের চেহারাও হুবহু, বলতে গেলে প্রায় একই, এমন কি তাকাবার ভঙ্গিটা পর্যন্ত যেন এক। কিরীটীকে কথাটা বলব ভেবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি একদৃষ্টে ঐ ছবি দুখোনার দিকেই তাকিয়ে আছে। ছবি দুটো তাহলে কিরীটীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়ায়নি!

ট্রেতে করে টি-পট ও অন্যান্য চায়ের সরঞ্জাম হাতে এমন সময় সীতা এসে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল।

ঘরের মধ্যস্থিত টেবিলের ওপরে চায়ের সরঞ্জাম রেখে সীতা কাপে কাপে চা ঢালতে লাগল।

সহসা কিরীটী হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ঐ দেওয়ালের অয়েলপেনন্টিং দুটো কার মিসেস ঘোষ?

কিরীটীর প্রশ্নে যেন চমকে তাকালেন হিরণ্ময়ী দেবী দেওয়ালের গায়ে টাঙানো ছবি দুটোর দিকে।

দেখলে মনে হয় যেন একই জনের দুটি প্রতিকৃতি! কিরীটী আবার মন্তব্য করে।

জানি না ও কার ছবি! মৃদুকণ্ঠে হিরণ্ময়ী দেবী জবাব দিলেন। শতদলবাবুর মা তো আপনার ভাইঝি, তাই না?

কিরীটীর এবারকার প্রশ্নে কিরীটীর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই ইতিমধ্যে অর্ধসমাপ্ত যে উলের বুননটা কোলের মধ্যে ছিল সেটা তুলে নিয়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্রহস্তে বুনতে বুনতে মৃদুকণ্ঠে জবাব দিলেন হিরণ্ময়ী দেবী, হ্যাঁ।

তাঁকে, মানে শতদলবাবুর মাকে আপনি দেখেননি?

খুব ছোট যখন তার তিন বছর বয়স হবে সেই সময় তাকে দেখি, তার পর আর দেখিনি। তার বিবাহের সময়ও আসতে পারিনি—পরে আর দেখাসাক্ষাৎই হয়নি। শতদলের যখন বছর তিনেক বয়স তখনি তো সে মারা যায়। কথাগুলো যেন একটানা সুরে কতকটা বলে গেলেন হিরণ্ময়ী দেবী।

আপনার ভায়েরও ঐ একটিমাত্র মেয়েই ছিলেন, তাই না?

না, দাদার দুই মেয়ে ছিল। বনলতা আর সোমলতা। সোমলতা বনলতার ৪৫ বছরের ছোট, তাকে আমি কোনদিনও দেখিনি

তিনি, মানে বনলতা দেবী চৌধুরী মশায়ের ছোট মেয়ে বেঁচে আছেন কি?

না। সহসা হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বরটা যেন রুক্ষ শোনাল। হিরণ্ময়ী দেবীর আকস্মিক কর্কশ কণ্ঠে আমি চমকে ওঁর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না।

পূর্বের মতই হিরন্ময়ী দেবীর দৃষ্টি তাঁর হাতের বুননের উপরে নিবদ্ধ এবং তিনি ক্ষিপ্রহস্তে বুননকার্যে রত।

কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম কিন্তু কিছু বোঝা গেল না। সে-মুখে রাগ দ্বেষ বা বিরক্তি কোন কিছুর চিহ্ন পর্যন্ত নেই। শান্ত ও নির্বিকার। চায়ের কাপটা শেষ হয়ে গিয়েছিল, নিঃশেষিত চায়ের কাপটা সামনের টেবিলের ওপরে নামিয়ে রাখতেই সীতা এগিয়ে এসে কিরীটীকে প্রশ্ন করল, আর চা দেব মিঃ রায়?

চা? না থাক, ধন্যবাদ।

বাইরের দালানে জুতোর মসমস শব্দ শোনা গেল।

ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই বোধ হয় ঘরের বাইরে সেই জুতোর শব্দ শুনতে পেয়েছিল। সীতা নিম্নকণ্ঠে বললে, শতদল-ভাগ্নে এল বোধ হয়—

সীতা কথাগুলো বলবার আগেই কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে অগ্রসর হয়েছিল এবং খোলা দরজাপথে অদৃশ্য হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, এই যে শতদলবাবু কোথায় গিয়েছিলেন?

কে! কিরীটীবাবু নাকি? আপনি এখানে, আর আমি যে আপনার খোঁজেই হোটেলে গিয়েছিলাম!

কথা বলতে বলতে দুজনে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করে।

সীতা, চা সব শেষ, না এক কাপ মিলতে পারে? ঘরে প্রবেশ করেই শতদল সীতাকে লক্ষ্য করে কথাটা বলে।

না, আছে বৈকি, দিচ্ছি, বসো। সীতা জবাব দেয়।

হঠাৎ ঐসময় আমার দৃষ্টিটা হিরন্ময়ী দেবীর উপরে গিয়ে পড়তেই দেখি ইতিমধ্যে তাঁর ক্ষিপ্র বুননরত হস্ত দুটি কখন থেমে গিয়েছে এবং তিনি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে একবার শতদল ও একবার সীতার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, কিন্তু সীতা বা শতদল কারো সেদিকে দৃষ্টি নেই।

সীতা একটা কাপে ততক্ষণে চা ঢালতে শুরু করেছে।

কিরীটীর মুখের দিকে তাকালাম। পুরাতন একটা সংবাদপত্র টেবিলের উপর পড়েছিল, ইতিমধ্যে কখন একসময় টেবিলের উপর থেকে সংবাদপত্রটা টেনে নিয়ে সে গভীর মনোযোগ সহকারে কী যেন পড়ছে। ঘরের মধ্যে যে আমরা আরও চারটি প্রাণী উপস্থিত আছি, ঐ মুহূর্তে সে সম্পর্কে যেন সম্পূর্ণ অচেতন।

চিনি ও দুধ মিশিয়ে চায়ের কাপটা সীতা শতদলের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললে, এই যে

সবেমাত্র শতদল সীতার প্রসারিত করা হতে চায়ের কাপটি হাতে তুলে নিয়েছে, আচমকা কিরীটী কণ্ঠস্বরে আমি যেন চমকে উঠলাম, আপনি একটু বেশী চিনি খান চায়ে, না মিঃ বোস?

চায়ের কাপটা আর ওষ্ঠের নিকটে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হল না, শতদল বিস্মিত প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে এবং বললে, চিনি বেশী খাই চায়ে!

হ্যাঁ, দেখলাম যে সীতা দেবী তিন চামচ চিনি দিলেন চায়ে।

হাতে-ধরা সংবাদপত্রটা ভাঁজ করতে করতে হাস্যোদ্দীপ্ত কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দেয় কিরীটী, নিশ্চয় সীতা দেবীর ওটা deliberate mistake নয়, কী বলেন সীতা দেবী?

শতদলের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। কেমন একটা অসহায় অপ্রস্তুত ভাব শতদলের চোখে-মুখে। কিন্তু সীতার মুখে ঠিক যেন একটা বিপরীত ভাবের সুস্পষ্ট আভাস। সমস্ত মুখখানা যে তার লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠেছে, ঐ মুহূর্তটিতে ঘরের স্বল্পলোকেও সেটা দৃষ্টিতে এড়ায় না।

অবশ্য চিনি কেউ কেউ চায়ে একটু বেশীই খান এবং আস্বাদনের ব্যাপারটাও যখন বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন, এ বিষয় নিয়ে কোন কথাই চলে না, কি বলেন সীতা দেবী? কথাটা বলে নিজে সঙ্গে সঙ্গে হেসে ঘরের ঐ মূহর্তের আবহাওয়াটাকে যেন কিরীটী লঘু করে দেবার চেষ্টা করল।

হিরন্ময়ী দেবীর দিকে তাকিয়ে দেখি, অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে তাঁর বুননকার্য চলেছে।

শতদল নিজেকে ততক্ষণে সামলে নিয়েছে এবং ব্যাপারটাও যেন আগাগোড়াই একটা কৌতুক ছাড়া কিছু নয়, এইভাবে চায়ের কাপে একটা দীর্ঘ আরামসূচক চুমুক দিয়ে বললে, সত্যিই কি সীতা তুমি আমার চায়ে তিন চামচ চিনি দিয়েছ নাকি?

কেন? এখনো বুঝতে পারেননি নাকি সেটা? হাসতে হাসতে কিরীটী বলে।

হ্যাঁ, সত্যি বড্ড বেশী মিষ্টি হয়ে গেছে চা-টা সীতা, আর একটু লিকার এর মধ্যে ঢেলে দাও

বলতে বলতে শতদল চায়ের কাপটা সীতার দিকে এগিয়ে দিল।

সীতাও টি-পট থেকে আরও খানিকটা লিকার ঢেলে মিল্ক-পট থেকে একটু দুধ ঢেলে চা-টা চামচ দিয়ে নেড়ে দিল।

শুনলাম কাল রাত্রে নাকি আবার এ-বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, শতদলবাবু! কিরীটী আচমকা প্রশ্নটা করে যেন প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল।

হ্যাঁ, সেই জন্যই তো আপনার ওখানে গিয়েছিলাম। এও শুনেছেন বোধ হয়, এবারে সীতার কুকুরটার উপর দিয়েই ফাঁড়াটা আমার গেছে।

শুনলাম। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দিল, সীতা দেবীর মুখে অবিশ্যি ব্যাপারটা শুনেছি, তাহলেও আপনার মুখ থেকে ব্যাপারটা আর একবার শুনতে চাই, শতদলবাবু।

এবারেও ঘটনাটা অবিশ্যি extremely mysterious রাত তখন প্রায় গোটা বারো কি সাড়ে বারো হবে, সে রাত্রের ঐ ব্যাপারের পর থেকে সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, আমি যেন একটু নার্ভাসই হয়ে পড়েছি, রাত্রে ঠিক যেন আর sound sleep হয় না, বিছানায় শুয়েছিলাম বটে তবে ঠিক ঘুমোইনি, একটা তন্দ্রামত ভাব—হঠাৎ সীতার কুকুরের ঘন ঘন ডাকে চমকে উঠে পড়লাম। জামাটা গায়ে চাপিয়ে জুতোটা পায়ে গলিয়ে দরজা খুলে সিঁড়িতে পৌঁছবার আগেই দুড়ুম দুড়ুম দুটো গুলির আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম আর ঠিক সেই সঙ্গে সঙ্গেই যেন বিশ্রী করুণভাবে আর্তনাদ করে উঠলো সীতার কুকুরটা।

আপনি নিচে নেমে এলেন, না? প্রশ্নটা এবার শতদলকে করলাম।

হ্যাঁ, দু-চার মিনিটের জন্য বোধ হয় কেমন একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, তার পরই তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসি। জবাব দেয় শতদল।

আপনি তখন কোথায় ছিলেন? আচমকা কিরীটী প্রশ্ন করে সীতার মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি? আমিও তখন টাইগারের চেচানি শুনে ঘরের বাইরে বের হয়ে এসেছি। জবাব দিল সীতা।

আর আপনি মিসেস ঘোষ?

আমি? হিরন্ময়ী দেবী হাতের বুনন থামিয়ে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ, আপনি!

আমি আর আমার স্বামী দুজনেই প্রায় একসঙ্গে বের হয়ে আসি ঘর থেকে। কতকটা যেন ইতস্তত করেই কথাটা বললেন হিরন্ময়ী দেবী।

হুঁ। হরবিলাসবাবুকে দেখছি না, তিনি কোথায়?

আমাকে খুঁজছিলেন বুঝি, মিঃ রায়? কথাটা কেমন একটা ব্যঙ্গের সুরে উচ্চারণ করতে করতে ঠিক কিরীটীর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই কতটা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসবার মতই ঐ মুহূর্তে হরবিলাস ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন।

তাঁর আকস্মিক আবির্ভাব ও প্রশ্নের জবাবে মনে হল, কিরীটীর মুহূর্ত আগেকার প্রশ্নটির জন্যই বুঝি এতক্ষণ হরবিলাস ঠিক ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

গায়ে কালো রঙের সেই গরম গলাবন্ধ ঝুল-কোট, গলায় ও মাথায় একটা উলেন কম্ফর্টার জড়ানো, মুখ-ভর্তি কাঁচা-পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি—মনে হয় পাঁচ-ছদিন বুঝি ক্ষৌরকর্ম করেননি। হাতে একটা মোটা লাঠি।

ঘরের মধ্যে আমরা সকলেই নির্বাক। কেবল কিরীটী যেন অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে হরবিলাসের দিকে তাকিয়ে। আচমকা যেন ঘরের সমস্ত আবহাওয়াটা থমথমে হয়ে উঠেছে।

অতঃপর ঘরের মধ্যে উপস্থিত নির্বাক সকলের মুখের দিকে নিঃশব্দে বারেকের জন্য নিজের দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু যেন কর্কশ কণ্ঠেই তাকে সম্বোধন করে হঠাৎ হরবিলাস বলে উঠলেন, তোমার ঐ অবিনাশকে সাবধান করে দিও, শতদলবাবু!

কেন, অবিনাশ আবার তোমার কী করল শুনি? প্রশ্নটা করলে হিরন্ময়ী দেবী তাঁর স্বামীকে। এবং চেয়ে দেখি পূর্ববৎ তিনি আবার তাঁর বুননকার্যে মনোনিবেশ করেছেন।

ক্ষিপ্রগতিতে হাত দুটো বুনন করে চলেছে।

কি করল মানে? হরবিলাসের কণ্ঠস্বরে বেশ একটা সস্পষ্ট বিরক্তি his every movements is suspicious! তোমার দাদার এ বাড়ি তো নয়, যেন একটা কবরখানা, আর ঐ বেটা কখন আচমকা কোন পথে যে এসে সামনে হঠাৎ হাজির হয়! রোজ সন্ধ্যার পরে একা একা এ বাড়ির পিছনে ঐ ভাঙা গোল-ঘরটায় অন্ধকারে ও কি করে বল তো? দেখ শতদলবাবু I am definite he is after something! নিশ্চয় ওর

হরবিলাসের মুখের কথাটা শেষ হল না, হঠাৎ একটা ভারী কোন বস্তু পতনের দুম করে একটা শব্দ ও সেই সঙ্গে রাত্রির স্তব্দতাকে দীৰ্ণবিদীর্ণ করে একটা কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ যেন খানখান হয়ে চারিদিক সচকিত করে তুলল।