০৭. তোমার নাম মোতি

তোমার নাম মোতি?

জী—

তুমি তো কাল রাত্রে জলসাঘরের বাইরেই ছিলে?

জী—

নবাব সাহেবকে বাজনা বাজিয়ে শোনাচ্ছিলেন ছোট বেগম সাহেবা, তাই না?

জী–

নবাব সাহেব কাল রাত্রে কখন জলসাঘর থেকে চলে যান জান তুমি?

জানি আমার সামনে দিয়েই তো রাত্রে এক সময় বের হয়ে গেলেন।

রাত কটা হবে?

তা রাত বারোটার পরে।

কি করে বুঝলে?

দালানের ঘড়িতে রাত বারোটা তার আগে ঢং ঢং করে বেজে গিয়েছিল।

হুঁ—আচ্ছা, নবাব সাহেব চলে যাবার পর তো একাই বেগম সাহেবা জলসাঘরে ছিলেন?

জী—আর কে থাকবে! একা-একাই বেগম সাহেবা বাজাচ্ছিলেন।

ঘরে আর কেউ ঢোকে নি তুমি ঠিক জানো?

জানি—আর কে ঢুকবে!

অত রাত হয়ে গিয়েছিল, তুমি তো ঘুমিয়েও পড়তে পার সেই সময়—

ঘুমিয়ে—

হ্যাঁ–তুমি ঘুমিয়ে পড়নি? একটু ঘুমিয়েছিলে, তাই না?

বোধ হয় একটু ঘুমিয়েছিলাম।

একটু নয়—মনে হচ্ছে বেশ ঘুমিয়েছিলে কিছুক্ষণ—অনেক রাত বাদলা—ঠাণ্ডাও পড়েছিল, তাই না?

মোতি মাথা নীচু করে থাকে।

কিরীটী বলে চলে মোতির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

সেই সময় জলসাঘরে কেউ যেতেও পারে বের হয়েও আসতে পারে—তাছাড়া তুমি যে কেবল ঘুমিয়েছিলে তাই নয় খুব গভীর ঘুম ঘুমিয়েছ।

না না—

হ্যাঁ-নচেৎ তুমি তোমার বেগম সাহেবার মৃত্যু-চিৎকারটা ঘরের দরজায় বসে নিশ্চয়ই শুনতে পারতে—খুব ঘুমিয়েছিলে তুমি।

মোতি চুপ।

বল, জবাব দাও।

জী– কিছু পিয়েছিলে কাল সন্ধ্যায়?

জী—মোতি ভয়ে ভয়ে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

কিরীটী প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করে। জিজ্ঞাসা করে, কাল সন্ধ্যার সময় বা তারপর মানে প্রথম রাত্রের দিকে কিছু খেয়েছিলে?

জী—

কি জিজ্ঞাসা করছি বুঝতে পারছনা মোতি?

জী—

কিছু খেয়েছিলে বা কেউ কিছু—এই ধর সরবৎ বা ঐ জাতীয় কিছু তোমাকে খাইয়েছিল বা তুমিই ইচ্ছা করে খেয়েছিলে?

না।

খাওনি?

নেহি—

ভাল করে মনে করে দেখ মোতিনচেৎ অমন গভীর ঘুম তুমি ঘুমোতে পারতে না।

মোতি চুপ করে থাকে–

শোন মোতি, তুমি তো বুঝতে পারছ তোমার মনিবান বেগম সাহেবাকে কাল রাত্রে কেউ ছোরা মেরে নৃশংসভাবে খুন করেছে এবং তুমি তাকে খুব ভালবাসতে এবং সেও তোমাকে

বাসত।

জী—

তুমি কি চাও না হত্যাকরী ধরা পড়ুক?

জী—

আচ্ছা মোতি—

বলুন।

নবাব সাহেব সুরা পান করেন—তাই না?

জী–

বেগম সাহেবা পান করলে না?

আমার মনিবানও পান করতেন মধ্যে মধ্যে—

আর অন্যান্য বেগমরা?

বড় বেগম সাহেবা রোজ সিদ্ধি খান সিদ্ধি?

জী—

কে তৈরী করে দিত?

কুলসম—

কেবল বড় বেগম সাহেবাই খান, আর কেউ এ বাড়িতে সিদ্ধি খায় না? কুলসমও নিশ্চয়ই খায়—তাই না?

জী—

তুমিও মধ্যে মধ্যে খাও–তাই না?

জী—

কথাটা হঠাৎ বলেই সঙ্গে সঙ্গে মোতি যেন নিজকে সামলে নেবার চেষ্টা করে, না, না-আমি—

কিরীটীতাকে সামলাবার সময় দেয় না—প্রায় সঙ্গে সহেতীকণ্ঠে বলেওঠে, হ্যাঁমধ্যে মধ্যে তুমিও খাও আর কাল সন্ধ্যায় তুমি একটু বেশীই সিদ্ধি খেয়েছিলে।

মোতি যেন কেমন থতমত খেয়ে চুপ করে থাকে।

খেয়েছিলে কি না বল?

জী—খুব মৃদু কণ্ঠে সাড়া এলো।

অনেকটা?

না—এক গ্লাস—

জলসাঘরের বাইরে থাকতে থাকতে বাদলার ঠাণ্ডায় সিদ্ধির নেশায় ঘুম ধরেছিল তোমার—তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। এখন ঠিক করে বল, কখন তোমার ঘুম ভেঙ্গেছিল—কখন প্রথম তুমি তোমার মনিবকে ডাকতে জলসাঘরে ঢুকেছিলে?

রাত তখন—

বল–কত রাত তখন?

রাত দুটো হবে।

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেল?

জী—একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গিয়েছিল।

কি রকম শব্দ শুনেছিলে?

একটা কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ–কেউ যেন পড়ে গেল।

তারপর?

চেয়ে দেখি কেউ কোথাও নেই বারান্দাটা খালি—তবু মনে কেমন সন্দেহ হল, উঠে সিঁড়ির দিকে যাই–

বল থামলে কেন—তারপর?

সিঁড়ির কাছাকাছি যেতে আমার নজরে পড়ে কয়েকটা ভাজা কাঁচের চুড়ি—

কাঁচের চুড়ি?

জী—আমি সেগুলি রেখে দিয়েছি।

তারপর?

আমি তারপর জলসাঘরে এসে ঢুকি।

কেন—জলসাঘরে ঢুকলে কেন?

কেমন যেন চারিদিক একেবারে চুপচাপ, কোন শব্দ নেই—আগে দুবার ঘুম ভেঙ্গেছে সেতার বাজানোর শব্দ কানে এসেছে-ভাবলাম তাই, বেগম সাহেবা চলে গেছেন হয়ত শোবার ঘরে—

বল—তারপর?

ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি বেগম সাহেবা—

বল কি?

মুখে একটা রেশমী রুমাল বাঁধা—আর বুকে তার একটা ছোরা বিঁধানো–তিনি যন্ত্রণায় গোঁ গোঁ করছেন—

তাহলে তখন তোমার বেগম সাহেবা বেঁচে ছিলেন—

জী—

সঙ্গে সঙ্গে তুমি লোক ডাকলে না কেন?

কেমন যেন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম প্রথমটায়, তারপর তাড়াতাড়ি বেগম সাহেবার মুখের রুমালটা কোনমতে খুলে ফেলে দিতেই–

কি?

সেই মুহূর্তেই বেগম সাহেবার শরীরটা দুবার কেঁপে উঠলমুখ হাঁ করে কি যেন বলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না—মাথাটা কাত হয়ে পড়লোবুঝলাম বেগম সাহেবা মারা গেছেন—হঠাৎ ঐ সময় চোখে পড়ল—আমার জামাকাপড়ে রক্ত

রক্ত!

হ্যাঁ, বেগম সাহেবার রক্ত।

আচ্ছা মোতি, তখন তুমি সকলকে ডাকলে না কেন?

না বাবুজী ডাকিনি–ভয়ে—

ভয় কিসের।

যদি আমার জামাকাপড়ে রক্ত দেখে সবাই আমাকে সন্দেহ করে।

হুঁ, তারপর তুমি কি করলে?

তাড়াতাড়ি ঘর হতে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে যাই। বুকটার মধ্যে তখনো আমার ধড়াস ধড়াস করছে—গলা শুকিয়ে গিয়েছে–

আর সেই রক্তমাখা জামা কাপড়গুলো কি করলে?

সেই রাত্রেই খুলে পরিষ্কার করে–সোজা নীচে বাবুর্চিখানায় চলে যাই, চুল্লির আগুনে সেঁকে সেঁকে সেগুলো শুকিয়ে উপরে চলে আসি–তারপর আরো খানিকক্ষণ বাদে সকলকে ডাকি।

তাহলে সকলকে তুমি ডাক রাত তিনটার পর নিশ্চয়ই কোন এক সময়!

ঐ রকমই হবে বাবুজী।