০৭. আমার নিজের ব্যাপারগুলো

বুধবার, ১ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আমার নিজের ব্যাপারগুলো এখন আড়ালে ঠেলে দিয়েছে–এক চুরির ঘটনা। চোর চোর। করে আমি ক্রমশ লোকের কানের পোকা বের করে ফেলছি। না করে উপায় কি, চোররা যেকালে পায়ের ধুলো দিয়ে কোলেন অ্যাণ্ড কোম্পানিকে ধন্য করতে এতটা আহাদ বোধ করে। ১৯৪৩-র জুলাইয়ের চেয়ে এই চুরির জট অনেক বেশি।

মিস্টার ফান ডান যখন সাড়ে সাতটায় রোজকার মতো ক্রালারের অফিসে যান, তখন দেখতে পান মাঝখানে কাঁচের দরজা আর অফিস ঘরের দরজা খোলা। সে কি কথা। ফান ডান এগিয়ে গিয়ে যখন দেখলেন ছোট্ট এঁদো ঘরটারও দরজা খোলা এবং সদর দপ্তরে। জিনিসপত্র সব ছড়ানো ছিটানো, তখন তার চক্ষু ছানাবড়া। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, ‘নিশ্চয় চোর ঢুকেছিল।’ নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্যে সামনের দরজাটা দেখতে তিনি সটান নিচের তলায় চলে গেলেন। ইয়েলের তালাটা নেড়েচেড়ে দেখলেন বন্ধ আছে, তখন উনি ঠাওরালেন, অর্থাৎ সন্ধ্যেবেলায় পেটার আর এলির ঢিলেমির জন্যেই এই কাণ্ড। ক্রালারের কামরায় কিছুক্ষণ থেকে, সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিয়ে ফান ডান ওপরে উঠে আসেন খোলা দরজা আর এলোমেলো অফিস ঘরের ব্যাপারটাকে তিনি আর তেমন আমল দেননি।

আজ সাতসকালে পেটার এসে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ল। বলল, সামনের দরজাটা হাট করে খোলা। খবরটা খুব সুবিধের নয়। সে এও বলল যে, আলমারিতে রাখা প্রোজেক্টের। আর ক্রালারের নতুন পোর্টফোলিওটা পাওয়া যাচ্ছে না। ফান ডান আগের দিন সন্ধেবেলায় তার অভিজ্ঞতার কথা বললেন। শুনে তো আমাদের মাথায় হাত।

আসলে ঘটেছিল নিশ্চয় এই ব্যাপার যে, চোরের কাছে ছিল চাপল, নইলে তালাটা একেবারে অক্ষত থাকে কেমন করে! চোর নিশ্চয় বাড়িতে সেঁধিয়েছিল অনেক আগে এবং তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। ঠিক সেই সময় হঠাৎ মিস্টার ফান ডান এসে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি সে লুকিয়ে পড়ে। তারপর ফান ডান চলে যেতেই সে মালপত্র নিয়ে তাড়াতাড়িতে দরজা বন্ধ না করেই সরে পড়ে। এ বাড়ির চাবি কার কাছে থাকা সম্ভব? চোর এল অথচ মালখানায় গেল না। কেন? মালখানায় যারা কাজ করে তাদের মধ্যে কেউ নয় তো? ফান। ডানের উপস্থিতি সে নিশ্চয়ই টের পেয়েছে এবং হয়ত দেখেও ফেলেছে। লোকটা আমাদের। ধরিয়ে দেবে না তো?

এসব ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। কেননা বলা তো যায় না, ঐ একই চোখ হয়ত এ বাড়িতে ফের হানা দেওয়ার মতলব করতে পারে। কিংবা কে জানে, এ বাড়িতে একজনকে ঘুরে বেড়াতে দেখে হয়ত তার একেবারে আক্কেল গুড়ুম?

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি, মারগট আর আমি, আমরা দুজনেই আজ ছাদের ঘরে উঠেছিলাম। আমি ধারণা করেছিলাম, দুজনে একসঙ্গে গেলে দুজনেরই ভালো লাগবে। সেটা ঘটেনি; তবু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মারগটের সঙ্গে আমার অনুভূতির মিল হয়।

বাসন ধোয়ার সময় মা-মণি আর মিসেস ফান ডানকে এলি বলেছিল যে, মাঝে মাঝেই তার খুব মন খারাপ লাগে। ওঁরা কি দাওয়াই বালালেন শুনবে? মা-মণি কী উপদেশ দিলেন, জানো? এলির উচিত তাবৎ লাঞ্ছিত-নিপীড়িত মানুষের কথা ভাবা! কেউ যখন এমনিতেই মনমরা হয়ে আছে, তখন তাকে দুঃখের কথা ভাবতে বলে কী লাভ? আমি তাও বলেছিলাম, কিন্তু তার জবাবে আমাকে বলা হল, এসব কথার মধ্যে তুমি নাক গলাতে এসো না।’

বুড়োধাড়িরা যেমনি আহাম্মক তেমনি বোকা, তাই না? পেটার, মারগট, এলি আর আমি–যেন আমাদের জ্ঞানগম্যিগুলো এঁদের মতো নয়; যেন একমাত্র মায়ের কিংবা অতিশয় ভালো কোনো বন্ধুর ভালবাসাই আমাদের সহায় হতে পারে। এখানকার এই মায়েরা আমাদের আদৌ বোঝে না। হয়ত মা-মণির তুলনায় মিসেস ফান ডান তবু একটু বোঝেন। ইস, এলি বেচারাকে আমি কিছু বলতে পারলে বড় ভালো হত; ওকে আমি বলতাম আমার অভিজ্ঞতালব্ধ কথা, তাতে ওর মন ভালো হত। কিন্তু বাপি এসে মাঝপড়া হয়ে আমাকে সরিয়ে দিলেন।

বোকা আর বলেছে কাকে। আমাদের নিজস্ব মতো থাকতে ওরা দেবেন না। লোকে আমাকে মুখে কুলুপ আঁটতে বলতে পারে, কিন্তু তাতে তো আর আমার নিজের মতো থাকা ঠেকানো যাবে না। বয়স কম হলেও তাদের মনের কথা অবাধে বলতে দেওয়া উচিত।

একমাত্র বিপুল ভালবাসা আর অনুরাগ এলি, মারগট, পেটার আর আমার পক্ষে হিতকর হতে পারে; আমরা কেউ তা পাচ্ছি না। আমাদের মনের ভাব কেউ বুঝতে পারে না। বিশেষ ভাবে, এখানকার যারা গবেট, সবজান্তার দল, তারা তো নয়ই, কেননা, এখানে কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারে না যে, তাদের চেয়ে আমরা ঢের বেশি স্পর্শকাতর এবং চিন্তার দিক দিয়ে অনেক বেশি এগিয়ে।

মা-মণি ইদানীং আবার গজগজ করছেন–আমি আজকাল মিসেস ফান ডানের সঙ্গেই কথাবার্তা বেশি বলছি বলে উনি ঈর্ষা করছেন সেটা বোঝাই যায়।

আজ সন্ধ্যেবেলায় পেটারকে কোনোক্রমে পাকড়াও করতে পেরেছিলাম; আবার কমপক্ষে তিন কোয়ার্টার সময় দুজনে বকর বকর করেছি। ও সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়েছিল নিজের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে; অনেকখানি সময় লেগেছিল ওকে দিয়ে কথা বের করতে। রাজনীতি, সিগারেট, এবং যাবতীয় জিনিস নিয়ে প্রায়ই ওর মা-বাবার মধ্যে যে খিটিমিট হয়, এটা পেটার আমাকে বলেছিল। ও বেজায় মুখচোরা।

এরপর আমার মা-বাবা সম্পর্কে আমি ওকে বলেছিলাম। পেটার বাপির স্বপক্ষে বলল; ওর মতে, আমার বাপি একজন দারুণ লোক। এরপর ‘ওপর তলা’ আর নিচের তলা’ নিয়ে আবার আমাদের কথা হল; ওর মা-বাবাকে আমাদের যে সবসময় পছন্দ হয় না, এটা শুনে ও হাঁ হয়ে গেল। আমি বললাম, ‘পেটার, তুমি জানো আমি সবসময় যা সত্যি তাই বলি; ওঁদের মধ্যে যেসব দোষ আমরা দেখতে পাই, কেন তোমাকে তা বলতে পারব না।’ অন্যান্য কথার পিঠে আবার বললাম, ‘তোমাকে সাহায্য করতে পেলে আমি যে কী খুশি হই, পেটার। পারি না করতে? তুমি খুবই ঝামেলার মধ্যে পড়েছ, অবশ্য মুখ ফুটে তুমি বলো না, তার মানে এ নয় যে–তুমি কিছু গায়ে মাখো না।’

‘তোমার সাহায্য পেতে আমি সবসময়ই উৎসুক।’

‘আমার মনে হয়, বাপির কাছে গেলে আরও ভালো ফল হবে। উনি সবকিছু সামলে দেবেন, এটা তোমাকে বলে দিচ্ছি। ওঁকে তুমি স্বচ্ছন্দে সব বলতে পারবে।’

‘সত্যি, উনি একেবারেই বন্ধুর মতো।’

‘বাপিকে তোমার খুব ভালো লাগে, তাই না? পেটার মাথা নেড়ে সায় দেয়। ‘তোমাকেও বাপির ভালো লাগে।’

পেটার তাড়াতাড়ি মুখ তোলে। মুখে ওর সলজ্জ আভা। আমার কথায় ওকে খুশী হতে দেখে কী ভালো যে লাগল।

পেটার জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি তাই মনে করো?’

আমি বললাম, ‘করি বৈকি। মাঝে মাঝে টুকরো-টাকরা কথা থেকে সহজেই তা ধরে ফেলা যায়।’

পেটার সোনার ছেলে। ঠিক বাপিরই মতন!

 তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ৩ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আজ সন্ধেয় মোমবাতির (স্যাবাথের প্রাক সন্ধ্যায় ইহুদীদের বাড়িতে মোমবাতি জ্বালানো হয়) দিকে তাকিয়ে থেকে মন জুড়িয়ে গেল এবং আনন্দ হল। মোমবাতিতে যেন ভর করে আছেন ওমা এবং এই ওমাই আমাকে আশ্রয় দেন আর রক্ষা করেন, আমাকে তিনিই সবসময় পুনরায় সুখী করেন। কিন্তু…তিনি ছাড়া আছেন আরও একজন যার হাতে আমার সমস্ত ভাব অনুভবের চাবিকাঠি এবং সেই একজন…পেটার। আজ যখন আলু আনতে ওপরে গিয়ে প্যান হাতে তখন ও সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখেই সে বলে উঠল, ‘দুপুরে খাওয়ার পর এতক্ষণ ছিলে কোথায়?’ আমি গিয়ে সিঁড়ির ধাপে বসে পড়লাম, তারপর শুরু হল দুজনের কথা। সোয়া পাঁচটায় (এক ঘণ্টা দেরিতে) মেঝের ওপর বসানো আলুগুলো শেষ পর্যন্ত তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছুল।

পেটার তার মা-বাবা সম্পর্কে একটি কথাও আর বলেনি; আমরা শুধু বই আর পুরনো প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলে গেলাম। ছেলেটার চোখে এমন একটা গদগদ ভাব; আমি প্রায় ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছি, এমনি একটা অবস্থা। পরে সন্ধ্যেবেলায় ও সেই প্রসঙ্গ তুলল। আলুর খোসা ছাড়ানোর পর্ব শেষ করে আমি ওর ঘরে গিয়ে বললাম, আমার খুব গরম লাগছে।

আমি বললাম, মারগট আর আমাকে দেখলেই তুমি তাপমাত্রার হদিস পেয়ে যাবে। ঠাণ্ডা থাকলে দেখবে আমাদের মুখগুলো সাদা আর গরম থাকলে লাল।’

ও জিজ্ঞেস করল, ‘প্রেমজ্বর?’

‘প্রেমে পড়তে যাব কেন?’ আমার উত্তরটা হল আকাট রকমের।

ও বলল ‘কেন নয়?’ তারপর আমাদের খেতে চলে যেতে হল।

এ প্রশ্নটার ভেতর দিয়ে পেটার কি কিছু বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল। শেষপর্যন্ত আজ আমি ওকে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, কাল আমি ওর বিরক্ত হওয়ার মতো কিছু বলেছি কিনা। শুনে ও শুধু বলল, ‘ঠিক বলেছ, ভালো বলেছ!’

এটা কতটা লজ্জায় পড়ে বলা, আমার পক্ষে তা বিচার করা সম্ভব নয়।

কিটি, কেউ যখন প্রেমে পড়ে আর সারাক্ষণ তার প্রেমিকের কথা বলে, আমার হয়েছে সেই অবস্থা। পেটারের মতো ছেলে হয় না। কবে আমি ওকে আমার মনের কথা বলতে পারব? তখনই, যখন জানব আমিও ওর মনের মানুষ সে তো বটেই। তবে আমি কারো সাহায্যের থোরাই পরোয়া করি, ও সেটা বিলক্ষণ জানে। আর ও ভালবাসে চুপচাপ থাকতে; ফলে, ও আমাকে কতটা পছন্দ করে আমি জানি না। সে যাই হোক, আমরা কতকটা পরস্পরকে জানতে পারছি। আমরা যদি সাহস করে পরস্পরের কাছে আরও খানিকটা নিজেদের মেলে ধরতাম তো ভালো হত। হয়ত সেই লগ্ন অপ্রত্যাশিতভাবে আগেই এসে যাবে। দিনে বার দুই বোঝাঁপড়ার ভাব নিয়ে আমার দিকে ও তাকায়, চার চোখের মিলন হয় আর আমরা দুজনেই আনন্দে ডগমগ হই।

ওর খুশী হওয়ার প্রসঙ্গে মুখে আমার খই ফোটে এবং সেই সঙ্গে আমি এটা নিশ্চিতভাবে জানি যে, পেটারও আমার সম্বন্ধে সেটাই ভাবে।

তোমার আনা।

.

নিবার, ৪ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি, মাসের পর মাস কেটে যাওয়ার পর এই প্রথম শনিবার। সেদিনটা একটুও একঘেয়ে, বিরক্তিকর এবং বিরস লাগেনি। এর কারণ পেটার। আজ সকালে আমি ছাদের ঘরে গিয়েছিলাম অ্যাপ্রন মেলে দিতে। বাপি বললেন ইচ্ছে হলে আমি যেন থেকে যাই এবং কিছুটা ফরাসীতে কথাবার্তা বলি। আমি থাকতে রাজী হলাম। গোড়ায় আমরা ফরাসীতে কথা বললাম এবং পেটারকে কিছুটা ব্যাখ্যা করে বোঝালাম; তারপর কিছুটা ইংরেজির চর্চা হল। বাপি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডিকন্স থেকে পড়ে শোনালেন; পেটারের খুব কাছাকাছি বাপির চেয়ারে আমি বলেছিলাম বলে আনন্দে আমার সে যেন এক তুরীয় অবস্থা।

এগারোটায় আমি নিচে নামি। পরে সাড়ে এগারোটায় আবার ওপরে উঠে দেখি সিঁড়িতে ও আগে এসে আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। পৌনে একটা পর্যন্ত আমরা বকর বকর করলাম। খাওয়ার পর আমি যদি ঘর ছেড়ে চলে যাই, ও করে কি, সুযোগ পেলেই এবং যদি কেউ শুনতে না পায়, তাহলে বলে ও আসি, আনা! শীগগিরই দেখা হবে।

ওঃ, আমার যে কী আনন্দ! ও কি আমার প্রেমে পড়বে! আমি অবাক হয়ে ভাবি। যাই বলো, চমৎকার মানুষটা। আর দেখ, কেউ জানে না, আমাদের কী প্রাণ মাতানো কথা হয়।

আমি যে ওর কাছে যাই, কথা বলি–মিসেস ফান ডান কোনো আপত্তি করেন না। তবে আজ আমাকে চটাবার জন্যে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমরা দুটিতে যে একা ওপরে থাকো, তোমাদের বিশ্বাস করা যায় তো?’

আমি আপত্তি করে বললাম, ‘নিশ্চয়। আপনি কিন্তু আমার আত্মসম্মানে ঘা দিচ্ছেন!

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমি পেটারের পথ চেয়ে বসে থাকি।

তোমার আনা।

.

সোমবার, ৬ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

পেটারের মুখ দেখে বলতে পারি ও সমানে আমারই মতন চিন্তা করে। মিসেস ফান ডান কাল সন্ধ্যেবেলায় যখন মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘ভাবুক মশাইকে, দেখ।’ আমার খুব রাগ হয়েছিল। পেটারের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল। আমি আরেকটু হলেই যা-তা বলে ফেলতাম।

এই লোকগুলো মুখ বুজে থাকলেই তো পারে!

ও কী অসম্ভব একা, অথচ কিছু করবারও ওর ক্ষমতা নেই–দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এ জিনিস দেখা যে কী সাংঘাতিক, তুমি ধারণা করতে পারবে না। ওর জায়গায় নিজেকে রেখে আমি ওর অবস্থাটা আঁচ করতে পারি, ঝগড়ায় আর ভালবাসায় মাঝে মাঝে ওর যে কী অসহায় অবস্থা হয় আমি বেশ ঠাহর করতে পারি। বেচারা পেটার, ভালবাসা ওর একান্তভাবে দরকার।

যখন ও বলেছিল ওর কোনো বন্ধু চাই না, ওর কথাগুলো আমার কানে এত রূঢ় হয়ে বেজেছিল। ইস্, কী করে ও এমন ভুল বুঝল! ও যে জেনে বুঝে বলেছে আমার তা বিশ্বাস

পেটার ওর নিঃসঙ্গতা, ওর লোক-দেখানো উদাসিনতা আর ওর বয়স্ক হাবভাব আঁকড়ে থাকে; কিন্তু ওটা ওর অভিনয় ছাড়া কিছু নয়, যাতে ওর আসল ভাব প্রকাশ হয়ে না পড়ে। বেচারা পেটার, আর কতদিন সে তার এই ভূমিকা চালিয়ে যেতে পারবে? এই অতিমানবিক প্রয়াস পরিনামে নিশ্চয়ই এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়ে দেখা দেবে?

ইস্, পেটার, শুধু যদি আমার সাধ্য থাকত তোমাকে সাহায্য করার, শুধু যদি আমাকে তুমি দিতে। আমরা দুজনে মিলে তাড়িয়ে দিতে পারতাম তোমার একাকিত্ব এবং আমারও!

আমার মনে অনেক কিছু হয়, কিন্তু বেশি বলি না। ওকে দেখতে পেলে আমার সুখ হয় এবং যখন কাছে থাকি তখন যদি আকাশে রোদ হাসে। কাল আমি দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম; যখন আমি মাথা ঘষছি, তখন পেটার আমাদের ঠিক পাশের ঘরেই বসে রয়েছে আমি জানতাম। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি; ভেতরে ভেতরে নিজেকে আমার যত শান্ত সৌম্য বলে বোধ হয়, বাইরে ততই আমার দাপাদাপি বাড়ে।

কে প্রথম দেখতে পাবে, কে ভেদ করবে এই বর্ম? ভাগ্যিস, ফান ভানদের মেয়ে নয় ছেলে–যদি আমার বিপরীত বর্গের কেউ কপালে জুটে না যেত, তাহলে আমায় এই পাওয়া কখনই এত কষ্টসাধ্য, এত সুন্দর, এত ভালো জিনিস হতে পারত না।

তোমার আনা।

পুনশ্চঃ তুমি জানো, তোমার কাছে আমি কিছু লুকাই না। সুতরাং তোমাকে আমার বলা দরকার, আবার কখন ওর দেখা পাব সেই আশায় আমি বেঁচে থাকি। পেটারও যে সারাক্ষণ আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে–এটা জানতে আমার খুব সাধ যায়। যদি ওর দিক থেকে কুষ্ঠিত হয়ে এগোনোর সামান্য ভাব চোখে পড়ে, তখুনি আমি রোমাঞ্চিত হই। আমার বিশ্বাস, আমারই মতন পেটারের মধ্যেও অনেক কথা হাঁকুপাঁকু করে; ওর অপটু ভাবটাই আকৃষ্ট করে, ও সেটা ছাই জানে।

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবার, ৭ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি, আমার ১৯৪২ সালের জীবনের কথা এখন ভাবলে সবটাই অলীক বলে মনে হয়। চার দেয়ালের মধ্যে জ্ঞানচক্ষু ফোঁটা এই আনা আর সেদিনকার সুখস্বর্গে থাকা আনা–এই দূয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক। সত্যি, সে ছিল এক স্বর্গীয় জীবন। যার মোড়ে মোড়ে ছেলে বন্ধু, যার। প্রায় জন-বিশেক সুহৃদ আর চেনাজানা সমবয়সী, যে প্রায় প্রত্যেক শিক্ষকেরই প্রিয় পাত্র, যে মা-মণি আর বাপির আদরে মাথা-খাওয়া মেয়ে, যার অফুরন্ত টফি-লজেঞ্চল, হাত খরচের পর্যাপ্ত টাকা তার আর কী চাই?

তুমি নিশ্চয় ভেবে অবাক হবে কিভাবে আমি এতগুলো লোককে পটিয়েছিলাম। পেটার বলে ‘আকর্ষণীয় শক্তি’–কথাটা ঠিক নয় আমার চোখা উত্তর, আমার সরস মন্তব্য, আমার হাসি-হাসি মুখ এবং আমার সপ্রশ্ন চাহনি সব শিক্ষকেরই মনে ধরত। থাকার মধ্যে আমার ছিল প্রচণ্ড ধিঙ্গিপনা, মক্ষীরানীমার্কা ভাব আর মজা করার ক্ষমতা। সুনজরে পড়ার কারণ ছিল এই যে, আমি দু-একটা ব্যাপারে আর সবাইকে টেক্কা দিতাম। আমি ছিলাম পরিশ্রমী, সৎ এবং অকপট। পরের দেখে নকল করার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারতাম না। আমার টফি-লজেন্ধু আমি মুক্ত হস্তে একে ওকে দিতাম এবং আমার মধ্যে কোনো গুমর ছিল না।

সবাই মিলে এভাবে মাথায় তোলায় আমার কি পায়াভারী হওয়ার ভয় ছিল না? এটা ভালো হয়েছে যে,এই রমরমা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই হঠাৎ আমাকে বাস্তবের মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়তে হল। বাহবা কুড়োবার দিন যে শেষ, এটা বুঝতেই অন্তত একটা বছর গড়িয়ে গেল।

ইস্কুলে আমি কেমন ছিলাম? লোকের চোখে আমি ছিলাম এমন একজন যার মাথা থেকে বেরোয় নিত্যনতুন রঙ্গরস, যে সব সময় গড়ের রাজা, কক্ষনো যার মেজাজ খারাপ হয় না, যে কখনই ছিচকাঁদুনে নয়। সুতরাং সবাই চাইত সাইকেলে রাস্তায় আমার সঙ্গী হতে এবং আমি তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতাম।

আজ যখন পেছনে চাই মনে হয় সেদিনের আনা আমুদে ছিল বটে, কিন্তু বড়ই হালকা স্বভাবের–আজকের আনার সঙ্গে তার কোনই মিল নেই। পেটার আমার সম্পর্কে ঠিক কথাই বলেছিল–’তোমাকে যখনই দেখেছি, দুটি কি তারও বেশি ছেলে এবং রাজ্যের মেয়ে তোমাকে সব সময় ঘিরে রয়েছে। সব সময়ই তুমি হো হো করে হাসছ এবং যা কিছু ব্যাপার সবই তোমাকে ঘিরে!’

আজ কোথায় সে মেয়ে? ঘাবড়িও না হে, কেমন করে হো হো করে হাসতে হয়, কথার পিঠে কিভাবে কথা বলতে হয়–কিছুই আমি ভুলিনি। মানুষের খুঁত কাড়তে তখনকার চেয়েও হয়ত এখন আমি আরও ভালো পারি; এখনও মক্ষিরানী সাজতে পারি… যদি ইচ্ছে করি। তার মানে এই নয় যে একটা সন্ধ্যে, কয়েকটা দিন, কিংবা এমন কি একটি সপ্তাহের জন্যেও আমি ফিরে পেতে চাই তেমন একটা জীবন বাইরে থেকে যা খুব ভারমুক্ত আর মজাদার বলে মনে হয়। কিন্তু সপ্তাহটিও শেষ হবে আর আমিও একেবারে নেতিয়ে পড়ব; তখন যদি এমন কোনো জিনিস নিয়ে কেউ কিছু বলতে শুরু করে যার মানে হয়, তাহলে আমি কৃতজ্ঞচিত্তে তা কানে তুলব। আমি চেলাচামুণ্ডা চাই না; আমি চাই বন্ধু, চাই গুণগ্রাহী–যারা কাউকে ভালবাসবে তার খোসামুদে হাসির জন্যে নয়, তার কৃত কাজ এবং তার চরিত্রের জন্যে।

চারপাশে বন্ধুর ভিড় অনেক পাতলা হয়ে আসবে আমি তা বিলক্ষণ জানি। কিন্তু তাতে কি আসে যায় যদি গুটিকয় সাচ্চা বন্ধু থাকে?

তবু সবকিছু সত্ত্বেও ১৯৪২ সালে মনে আমার ষোলআনা সুখ ছিল না; প্রায়ই নিজেকে পরিত্যক্ত বলে মনে হত; কিন্তু সারা দিনমান পায়ের ওপর থাকতে হত বলে ও নিয়ে বড় একটা ভাবতাম না এবং যতটা পারি হেসে খেলে কাটিয়ে দিতাম। যে শূন্যতা বোধ করতাম, রঙ্গরসিকতা দিয়ে আমি সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে তা উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করতাম। জীবন সম্পর্কে এবং আমাকে কী করতে হবে সে বিষয়ে এখন আমি গালে হাত দিয়ে ভাবি। আমার জীবনের একটি পর্ব বরাবরের মতো শেষ হয়ে গেছে। ইস্কুল-জীবনের গায়ে ফু দিয়ে বেড়ানো দিনগুলো বিদায় নিয়েছে, আর কখনই ফিরবে না।

এখন আর আমি মনে মনে তার জন্যে হতাশ হই না; আমি সে স্তর পেরিয়ে এসেছি; আমার গুরুতর দিকটা সর্বক্ষণ বজায় থাকে বলে শুধুমাত্র নিজের আমোদ-আহ্লাদ নিয়ে মজে থাকতে পারি না।

যেন একটা জোরালো আতস কাঁচ দিয়ে নববর্ষ পর্যন্ত আমি আমার জীবনটা দেখি। নিজেদের বাড়িতে হাসি আনন্দে ভরা দিন, তারপর ১৯৪২ সালে এখানে চলে আসা, হঠাৎ কোথা থেকে কোথায়, চুলোচুলি, মন কষাকষি। ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢোকেনি, আমি কেমন যেন ‘থ’ হয়ে গিয়েছিলাম, নিজেকে কিছুটা খাড়া রাখার জন্যে ছ্যাটা হওয়াকেই একমাত্র পন্থা হিসেবে নিয়েছিলাম।

১৯৪৩-এর প্রথমার্ধ মাঝে মাঝে কান্নায় ভেঙে পড়া, নিঃসঙ্গতা, আস্তে আস্তে নিজের সমস্ত দোষত্রুটি আমার চোখে ধরা পড়তে লাগল; কোনাটাই ছোটখাটো নয়, তখন যেন। আরও বড় বলে মনে হল। দিনের বেলায় ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ধারণাবহির্ভূত যাবতীয়। বিষয়ে আমি কথা বলতাম, চেষ্টা করতাম পিকে টানতে; কিন্তু পারতাম না। আমাকে একা ঘাড়ে নিতে হত নিজেকে বদলানোর কঠিন কাজ, ঠেকাতে হত নিত্যকার সেই সব গালমন্দ, যা বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসত; ফলে, হতাশার মধ্যে আমি একেবারে ডুবে গিয়েছিলাম।

বছরের শেষার্ধে অবস্থার সামান্য উন্নতি হল; আমি পরিণত হলাম তরুণীতে এবং আমাকে অনেক বেশি সাবালিকা বলে ধরে নেওয়া হল। আমি চিন্তা করতে এবং গল্প লিখতে শুরু করে দিলাম; ক্রমশ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলাম যে, আমাকে বরাবরের বলের মত যথেচ্ছ ছোড়ার অধিকার আর অন্যদের নেই। আমি আমার আকাঙক্ষা অনুযায়ী নিজেকে বদলাতে চাইলাম। যখন এটা বুঝলাম যে, এমন কি বাপির কাছেও আমার মনের সব কথা খুলে বলা যাবে না। তখন সেই একটা জিনিসে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। এরপর নিজেকে ছাড়া। আর কাউকে আমি বিশ্বাস করতে চাইনি।

নববর্ষের সূচনায় দ্বিতীয় বড় রকমের বদল, আমার স্বপ্ন…। এবং সেই সঙ্গে ধরা পড়ল আমার তীব্র বাসনা, কোনো মেয়েবন্ধুর জন্যে নয়, ছেলেবন্ধুর জন্যে। আমি আবিষ্কার করলাম আমার অন্তর্নিহিত সুখ আর সেইসঙ্গে বাহার চালি দিয়ে গড়া আমার আত্মরক্ষার বর্ম। যথাসময়ে আমার অস্থিরতার অবসান হল এবং যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শুভ–তার জন্যে আমার সীমাহীন কামনা আমি অবিষ্কার করলাম।

আর সন্ধ্যে হলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই বলে আমি যখন আমার প্রার্থনা শেষ করি, ‘যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রিয়, যা কিছু সুন্দর–সেই সবকিছুর জন্যে, হে ঈশ্বর, আমার কৃতজ্ঞতা জেনো’, তখন আমি আনন্দে ভরে উঠি। তারপর অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার ‘সুফল’, আমার শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবতে বসি, আমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে ভাবি পেটারের ‘মধুরতার কথা; ভাবি সেই জিনিস–যা এখনও অপরিণত এবং ভাসা-ভাসা হয়ে আছে, দুজনের কেউই যাকে সাহস করে আমরা ধরতে ছুঁতে পারি না, যা কোনো একদিন আসবে; প্রেম, ভবিষ্যৎ, সুখশান্তি আর ভূলোকস্থিত সৌন্দর্যের কথা; ভূলোক, নিসর্গ, সৌন্দর্য আর যা অপরূপ, যা রমণীয়, সব কিছু।

যাবতীয় দুঃখ কষ্ট কিছুই তখন আমার মনে স্থান পায় না; বরং আজও যে সৌন্দর্য রয়ে গেছে তাই নিয়ে আমি ভাবি। যে-সব বিষয়ে মা-মণির সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ অমিল, এটা হল তার একটি। কেউ বিমর্ষ বোধ করলে মা-মনি তাকে উপদেশ দেন–’দুনিয়ার যাবতীয় দুঃখকষ্টের কথা মনে করো এবং তোমাকে যে তার ভাগ নিতে হচ্ছে না তার জন্যে ধন্যবাদ দাও।’ আমার উপদেশ—‘বাইরে বেরোও, মাঠে যাও, উপভোগ করো প্রকৃতি আর রোদ্দুর, ঘরের বাইরে গিয়ে আবার ফিরিয়ে আনো যে সুখ তোমার আপনাতে আর ঈশ্বরে। নিজের চারপাশে যতটা সৌন্দর্য এখনও আছে তার চিন্তা করো। তুমি সুখী হও।’

মা-মণির ধারণা ঠিক বলে আমার মনে হয় না, কারণ নিজে দুর্দশায় পড়লে সেক্ষেত্রে তোমার কী আচরণ হবে? তখন তো তুমি একেবারেই ডুবেছ। অন্যদিকে, আমি দেখেছি নিসর্গে, রোদের আলোয়, স্বাধীনতায়, নিজের সবসময় কিছু সৌন্দর্য থেকেই যায়; এসব তোমার সহায়সম্বল হতে পারে। চোখ চেয়ে এইসব দেখ, তাহলেই তুমি আবার খুঁজে পাবে তোমার আপনাকে, আর ঈশ্বরকে এবং তখন তুমি আবার ফিরে পাবে তোমার মানসিক স্থৈর্য।

যে নিজে সুখী, সে অন্যদেরও সুখী করবে। যার সাহস আর বিশ্বাস আছে সে কখনও দুঃখকষ্টে মারা পড়বে না।

তোমার আনা।

.

রবিবার, ১২ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

ইদানীং যেন স্থির হয়ে বসতে পারছি না। তড়বড় করে সিঁড়ি ভেঙে কেবল উঠছি আর নামছি। পেটারের সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগে, তবে ওকে পাছে জ্বালাতন করি আমার সারাক্ষণ সেই ভয়। ওর মা-বাবা আর ওর নিজের সম্বন্ধে পুরনো কথা একটুখানি বলেছে। পুরো অর্ধেকও নয়; বুঝতে পারি না কেন সব সময় আরও কথা শোনবার জন্যে আমি মরে যাই। আগে ও আমাকে অসহ্য বলে মনে করত; ওর সম্বন্ধে আমিও ওকে একই কথা বলেছিলাম। এখন আমি আমার মত বদলেছি; পেটারও কি বদলেছে তার মত?

আমার মনে হয় বদলেছে; তার মানে অবশ্যই এ নয় যে, আমরা হলায়-গলায় বন্ধ হয়ে উঠব, যদিও আমার দিক থেকে তাতে এখানে দিনগুলো ঢের সহনীয় হবে। কিন্তু তবু ও নিয়ে নিজেকে আমি বিচলিত হতে দেব না–ওর সঙ্গে আমার ঘন ঘন দেখা হয় এবং আমার অসম্ভব কষ্ট হয়, শুধু সেই কারণেই এ নিয়ে, কিটি, তোমার মন খারাপ করাতে আমি চাই না।’

শনিবার দুপুরের পর গুচ্ছের খারাপ খবর শুনে এমন আনচান লাগছিল যে, আমি গিয়ে। সটান শুয়ে পড়েছিলাম। শুধু মনটাকেও ফাঁকা করে দেবার জন্যে আমি চাইছিলাম ঘুমিয়ে পড়তে। চারটে অবধি ঘুমিয়ে তারপর বসবার ঘরে যেতে হল। মা-মণি এত কিছু জিজ্ঞেস করছেন যার উত্তর দেওয়া শক্ত, বাপির কাছে আমার লম্বা ঘুমের ব্যাখ্যা হিসেবে আমাকে একটা অজুহাত খাড়া করতে হল। আমি কারণ দেখালাম মাথাব্যথা; কথাটা মিথ্যে নয়, যেহেতু ব্যথা ছিল…তবে সেটা ভেতরকার।

সাধারণ লোকে, সাধারণ মেয়েরা, আমার মতো কুড়ির নিচে যাদের বয়স, তারা ভাববে আত্ম-দুঃখকাতরতায় আমি খানিকটা ভেঙে পড়েছি। হ্যাঁ, সেটা ঘটেছে, কিন্তু আমার হৃদয় মেলে ধরব আমি তোমার কাছে; দিনের বাদবাকি সময়টাতে আমি যথাসম্ভব চ্যাটা ফুর্তিবাজ এবং ডাকাবুকো হয়ে পড়ি–যাতে কেউ প্রশ্ন করতে বা পেছনে কাঠি দিতে না পারে।

মারগট মেয়েটা মিষ্টি, ও চায় আমি ওকে বিশ্বাস করি, কিন্তু তবু ওকে আমার সব কথা বলা সম্ভব নয়। সুন্দর ভালো মেয়ে সে, খুবই প্রিয়জন–কিন্তু গভীর আলোচনায় যেতে গেলে যে নিস্পৃহ ভাবের দরকার, সেটা তার নেই। মারগট আমার কথায় গুরুত্ব দেয়, যতটা দরকার তার চেয়েও বেশি; পরে অনেকক্ষণ ধরে সে তার অদ্ভুত ছোট বোনটির কথা ভাবে। আমার প্রত্যেকটি কথায় তন্ন তন্ন করে ও আমাকে দেখে আর ভাবতে থাকে, ‘এটা কি ওর নেহাত পরিহাস, না কি সত্যিই ওর মনের কথা?’ আমার ধারণা, এটা হয় আমরা সারাদিন একসঙ্গে থাকি বলে; কাউকে যদি আমি সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতাম, তাহলে আমি কখনই চাইতাম না তেমন লোক সর্বক্ষণ আমার সঙ্গে ঘুরঘুর করুক। কবে আমি শেষ পর্যন্ত আমার চিন্তার জট খুলে ফেলব, কবে নিজের মধ্যে আবার আমি শান্তি খুঁজে পাব?

তোমার আনা।

.

মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি, আমরা আজ কী খাব সেটা শুনতে তোমার হয়ত মজা লাগবে, কিন্তু আমার আদৌ নয়। নিচের তলায় ঝি এসে ঘর ঝাট দিচ্ছে। এই মুহূর্তে আমি বসে আছি ফান ডানদের টেবিলে। একটা রুমালে ভালো সেন্ট (এখানে আসার আগে কেনা) ঢেলে নিয়ে মুখের ওপর দিয়ে নাকের কাছে ধরে রেখেছি। এ থেকে তুমি বিশেষ কিছু অনুধাবন করতে পারবে না। সুতরাং ‘গোড়া থেকে শুরু করা যাক’।

যেসব লোকের কাছ থেকে আমরা খাবার জিনিসের কুপন সংগ্রহ করতাম, তারা ধরা পড়ে গেছে। এখন আমাদের হাতে আছে মাত্র পাঁচটি রেশন কার্ড; বাড়তি কোনো কুপন নেই, চর্বি নেই। মিপ আর কুপহুইস দুজনেই অসুস্থ; এলির বাজার করবার মতো সময় নেই। ফলে খুব বিষন্ন, মন-মরা আবহাওয়া; খাবারও দ্রুপ। কাল থেকে চর্বি, মাখন বা মারগারিন এক ছিটেও থাকবে না। প্রাতরাশে আলুভাজা (রুটি বাচাতে) আর জুটবে না, তার বদলে খেতে হবে ডালিয়া; যেহেতু মিসেস ফান ডানের ধারণা আমরা না খেয়ে আছি, সেইজন্যে লুকিয়ে-চুরিয়ে কিনে আনা হয়েছে মাখন-না-তোলা দুধ। পিপের মধ্যে সংরক্ষিত বাধাকপি কুচনো–এই হল আজ আমাদের রাতের খাবার। আগে থেকে ঠেকানোর জন্যেই রুমালের প্রতিষেধক ব্যবস্থা। এক বছরের বাসী বাঁধাকপি যে কী গন্ধ ছাড়ে ভাবা যায় না। নষ্ট আলুবখরা, সংরক্ষণের কড়া ওষুধ আর পচা ডিম–এই সব মিলিয়ে মিশিয়ে ঘরের মধ্যে ভুরভুর কছে কটু গন্ধ। উহ, ঐ গন্ধওয়ালা জিনিসটা খেতে হবে ভাবলেই তো আমার পেট থেকে সবকিছু উঠে আসতে চাইছে। এর ওপর, আলুগুলোকে অদ্ভুত সব রোগে ধরেছে। দুই ঝুড়ির মধ্যে পুরো এক ঝুড়ি উনুনের আগুনে ফেলে দিতে হয়েছে। কোনটার কী রোগ হয়েছে দেখা, সেও হয়েছে একটা মজার ব্যাপার। শেষটায় দেখা গেল, ক্যানসার আর বসন্ত থেকে হাম পর্যন্ত, কিছু বাকি নেই। যুদ্ধের চতুর্থ বছরে অজ্ঞাতবাসে থাকা, না গো না, হাসির কথা নয়। এই জঘন্য ব্যাপারটা কেন যে শেষ হয় না।

সত্যি কথা বলতে গেলে, খাওয়ার ব্যাপারটা আমি কেয়ারই করতাম না। যদি অন্যান্য দিক দিয়ে এ জায়গাটা আরেকটু সুখকর হত। সেখানেই তো গণ্ডগোল; থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় করে এইভাবে বেঁচে থাকার ফলে আমাদের সবাই মেজাজ ক্রমশ তিরিক্ষে হয়ে যাচ্ছে।

বর্তমান অবস্থায় পাঁচজন প্রাপ্তবয়স্কের মনোভাব এখন এই—

মিসেস ফান ডান–রান্নাঘরের রানী হওয়ার মোহ অনেকদিন আগেই কেটে গেছে। কাহাতক চুপচাপ বসে থাকা যায়। সুতরাং আবার আমি রান্নার কাজে ফিরে গিয়েছি। তবু বলে পারছি না যে, বিনা তেল-ঘিতে রান্না করা কিছুতেই সম্ভব নয়; আর এইসব জঘন্য গন্ধ নাকে গিয়ে আমার শরীর খারাপ করে। এত খাঁটি, কিন্তু তার বদলে আমার কপালে জোটে অকৃতজ্ঞতা আর কটু কথা। সবসময় আমিই এ বাড়ির কুলাঙ্গার, যত দোষ নন্দ ঘোষ। তাছাড়া আমার মতে, লড়াই খানিকটা যথা পূর্বং তথা পরং। তাও শেষমেষ জার্মানরাই জিতবে। আমার ভয় হচ্ছে, আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। যখন আমার মেজাজ খারাপ হয়, একধার থেকে সবাইকে আমি বকি।’

মিস্টার ফান ডান–ধোয়া টেনে যাব, ধোয়া টেনে যাব, ধোয়া টেনে যাব, তারপর খাওয়া, রাজনৈতিক হালচাল, আর কেলির মেজাজটা তত খারপ নয়। কের্লি বড় আদরের বউ।

কিন্তু ধুমপানের জিনিস কিছু না জুটলে, তখন সবই বেঠিক, এবং তখন শোনা যাবে ‘আমি দিন দিন কাহিল হয়ে পড়ছি, আমরা তেমন ভালোভাবে থাকতে পারছি না। মাংস ছাড়া আমার চলবে না। আমার স্ত্রী কেলি আহাম্মকের একশেষ।’ এরপর শুরু হয়ে যাবে দুজনের তুমুল ঝগড়া।

মিসেস ফ্রাঙ্ক খাওয়াটা অতি জরুরি নয়, যার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে, এই সময় এক টুকরো বাইরের রুটি পেলে খাসা হয়। আমি ফান ডানের বউ হলে ওর ঐ সারাক্ষণ ভস্ ভস্ করে ধোয়া বের করা অনেককাল আগেই বন্ধ করে দিতাম। নিজেকে একটু চাঙ্গা করার জন্যে আমার কিন্তু এখন একটা সিগারেট বিশেষ দরকার। ইংরেজরা দাগাগুচ্ছের ভুল করা সত্ত্বেও লড়াই এগোচ্ছে। আমার দরকার, বসে একটু কথাবার্তা বলা; আমি যে পোল্যাণ্ডে নেই, তার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

মিস্টার ফ্রাঙ্ক–’সব ঠিক আছে। আমার কিছু চাই না। ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই; আমাদের হাতে যথেষ্ট সময়। আমার ভাগের আলু পেলেই আমার মুখ বন্ধ হবে। আমার রেশন থেকে কিছুটা এলির জন্যে সরিয়ে রাখো। রাজনৈতিক অবস্থা খুবই সম্ভাবনাময়। আমি হলাম একান্তভাবে আশাবাদী!

মিস্টার ডুসেল–আমাকে আজকের কাজ হাতে নিতে হবে, সব কাজ ঘড়ি ধরে শেষ করতে হবে। রাজনৈতিক অবস্থার দরুন, আমাদের ধরা পড়া অসম্ভব।

‘আমি, আমি, আমি…!

তোমার আনা।

বুধবার, ১৫ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

বাপ রে বাপ, বুক-চাপা দৃশ্যগুলো থেকে মুহূর্তের জন্যে ছাড়ান পেয়েছি। আজ শুধু কানে এসেছে–এই ঐ যদি ঘটে, তাহলে আমাদের মুশকিলে পড়তে হবে…যদি ইনি বা উনি অসুখে পড়েন, তাহলে আমরা একদম একা পড়ে যাব; এবং তখন যদি…।’ সংক্ষেপে এই। বাকি কথাগুলো কী আশা করি তুমি জানো–অন্তত এটা আমি ধরে নিতে পারি, গুপ্ত মহলবাসীদের এতদিনে তুমি এত ভালোভাবে জেনেছ যে, তাদের কথাবার্তার ধারাটা তুমি আঁচ করে নিতে পারবে।

এক যদি–যদির কারণ হল, মিস্টার ক্রালারকে মাটি খোড়ার জন্যে তলব করা হয়েছে। এলির প্রচণ্ড সর্দি, কাল বোধ হয় এলিকে বাড়িতেই থাকতে হবে। মি এখনও ফু থেকে সম্পূর্ণ সেরে ওঠেনি; কুপহুইসের পাকস্থলী থেকে এমন রক্তস্রাব হয় যে, উনি অজ্ঞান হয়ে যান। শুনে এত মন খারাপ লাগল।

মালখানায় যারা কাজ করে, কাল তাদের ছুটি; এলিকে আসতে হবে না। কাজেই কাল আর দরজার তালা খোলা হবে না; ইঁদুরের মতো নিঃশব্দে আমাদের চলাফেরা করতে হবে, যাতে পাড়াপড়শিরা না টের পায়। হেংক একটায় আসছেন পরিত্যক্ত মানুষগুলোকে দেখতে–তার যেন চিড়িয়াখানা-পালকের ভূমিকা। আজ বিকেলে কত যুগ পরে তিনি এই প্রথম আমাদের কিছুটা বাইরের দুনিয়ার কথা বললেন। আমরা আটটি প্রাণী যেভাবে তাকে ঘিরে ধরেছিলাম যদি তুমি দেখতে; ছবিতে যেরকম ঠানদিদি গল্প বলেন সেই রকম। কৃতজ্ঞ শ্রোতাদের কাছে অবশ্য তার ডজনে উনিশটাই ছিল খাবার-দাবারের কথা, এবং তারপর মিপের ডাক্তার, আর আমাদের সবরকম প্রশ্নের উত্তর। উনি বললেন, ডাক্তার? ডাক্তারের কথা আর বলবেন না। আজ সকালে ডাক্তারকে ফোন করতে ওঁর অ্যাসিস্টেন্ট এসে ধরলেন। ফুর জন্যে কী ওষুধ খাব জিজ্ঞেস করলাম। আমাকে বলা হল সকাল আটটা থেকে নটার মধ্যে গিয়ে আমি যেন ব্যবস্থাপত্র নিয়ে আসি। যদি একটু বাড়াবাড়ি রকমের ফু হয়, তাহলে ডাক্তার নিজে এসে ফোন ধরে বলেন, জিভ বের করুন তো, বলুন আ-আ-আ, ঠিক আছে। আমি শুনেই বুঝতে পারছি আপনার গলাটা টাটিয়ে উঠেছে। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি দোকান থেকে আনিয়ে নেবেন। আচ্ছা, আসি। ব্যস, হয়ে গেল। মজার প্র্যাকটিস তো, টেলিফোনেই কাজ ফতে।

আমি কিন্তু ডাক্তারদের নিন্দেমন্দ করতে চাই না; যত যাই হোক, তার তো দুটোর বেশি হাত নেই এবং আজকের দিনে ডাক্তার কয়টা যে এত রুগীকে সামাল দেবে। তবু হেংক এর মুখে টেলিফোন-ভাষ্যের পুনরাবৃত্তি শুনে আমরা না হেসে পারিনি।

এখনকার দিনে ডাক্তারের বসার ঘরে ছবি আমি মনে মনে কল্পনা করে নিতে পারি। এখন আর কেউ তালিকাভুক্ত রুগিদের দিকে তাকায় না; যাদের ছোটখাটো অসুখ, তাদের দঙ্গলের দিকে তাকায় আর ভাবে–’ওহে, তুমি ওখানে কী করছ, দয়া করে পেছন গিয়ে দাঁড়াও; জরুরি কেসগুলো আগে দেখা হবে।’

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি, আজকের আবহাওয়াটা কী সুন্দর, আমার বর্ণনার ভাষা নেই; ছাদের ঘরে আমি এলাম বলে।

পেটারের চেয়ে কেন আমি বেশি ছটফটে, এখন সেটা বুঝি। পেটারের নিজের ঘর আছে সেখানে কাজ করা, স্বপ্ন দেখা, ভাবনা-চিন্তা করা, ঘুমুনো–সবই সে করতে পারে। আমাকে ঝাটা খেয়ে একবার এ-কোণ একবার ও-কোণ করতে হয়। আমার ডবল-বেড় ঘরে আমি থাকি না বললেই হয়, অথচ থাকতে ভীষণ ইচ্ছে করে। সেই কারণেই আমি বার বার পালিয়ে চিলেকেঠোয় চলে যাই। সেখানে এবং তোমার কাছে, আমি কিছুক্ষণের জন্যে, খুবই কিছুক্ষণের জন্যে, নিজেকে ফিরে পাই। তবু আমি নিজেকে নিয়ে বুক চাপড়াতে চাই না, বরং উল্টো বুকের পাটা দেখাতে চাই। ভালো হয়েছে, অন্যেরা আমার মনের ভেতরে কী হয় বলতে পারে না। শুধু জানে, দিনকে দিন আমি মা-মণি সম্পর্কে নিস্পৃহ হয়ে পড়ছি, বাপির প্রতি আমার আর আগের মতো টান নেই এবং মারগটকে আমি কোনো কথাই আর বলি না। আমি এখন একেবারে চাপা। সবচেয়ে বড় কথা আমি আমার বাইরের গাম্ভীর্য বজায় রাখব, লোকে যাতে কিছুতেই না জানে যে, আমার মধ্যে নিরন্তর লড়াই চলেছে। কামনা-বাসনার সঙ্গে সহজ বাস্তববোধের লড়াই। পরেরটা এ যাবৎ জিতে এসেছে; তবু এই দুইয়ের মধ্যে আগেরটা কি কখন প্রবলতর হয়ে দেখা দেবে? দেখা দেবে বলে মাঝে মাঝে আমার ভয় হয় এবং কখনও কখনও আমি তারই জন্যে ব্যাকুল হই।

পেটারকে না বলে থাকা, এটা যে কী সাংঘাতিক কঠিন কাজ কী বলব! তবে আমি জানি, আমাকে প্রথম ওরই বলতে হবে। আমি কত কী যে বলতে আর করতে চাই! এর সবটাই আমার স্বপ্নে দেখা; যখন দেখি আরও একটা দিন চলে গেল, অথচ কিছুই ঘটল না তখন সহ্য করা শক্ত হয়। হ্যাঁ কিটি, আনা মেয়েটার মাথায় ছিট আছে। কিন্তু এক মতিচ্ছল সময়ে বাস করছি এবং যে পরিবেশে, তার তো আরো মাথার ঠিক নেই।

তবু ভালো যে, আমার ভাবনা আর অনুভূতিগুলো আমি অন্তত লিখে রেখে দিতে পারি, সেটা না হলে তো আমার একেবারে দম বন্ধ হয়ে যেত। আমার জানতে ইচ্ছে করে এসব ব্যাপারে পেটারের কী মনে হয়। আমার খুব আশা আছে, একদিন এ নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে পারব। পেটার নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে কিছু এটা আঁচ করেছে, কেননা এতদিন সে যাকে জেনেছে সে হল বাইরের আনা–তাকে ওর পক্ষে ভালবাসা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়।

যে শান্তিপ্রিয় এবং যে নিরিবিলিতে থাকা পছন্দ করে, তার পক্ষে আমার মতন হৈ হল্লাবাজ মেয়েকে ভালো লাগা কি সম্ভব? সেই কি হবে প্রথম এবং অদ্বিতীয়, যে আমার বজ্রকঠিন বর্ম ভেদ করতে পারবে? এটা করতে তার কি দীর্ঘ সময় লাগবে? একটা পুরনো কথা চালু আছে না প্রায়ই ভালবাসা আসে করুণা থেকে, কিংবা ভালবাসার হাত ধরে চলে করুণা? আমার বেলায়ও সেটা কি খাটে? কেননা প্রায়ই যেমন নিজের জন্যে, তেমনই ওর জন্যেও আমার দুঃখ হয়।

কী বলে শুরু করব, সত্যি বলছি, আমি ঠিক জানি না। আমি তো তাও ভালো, পেটারের তো মুখ দিয়ে কথাই সরে না–ও কি পারবে মুখ ফুটে বলতে? একমাত্র যদি লিখে ওকে জানাতে পারতাম, তাহলে অন্তত এটা জানি যে, ও আমার মনের কথা ধরতে পারবে, কারণ যা বলতে চাই সেটা ভাষায় প্রকাশ করা কী সাংঘাতিক কঠিন যে!

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

‘গুপ্ত মহল’ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। আদালতের হুকুমে ক্রালারের মাটি খোঁড়ার সাজা রদ হয়েছে। এলি ওর নাকটাকে বুঝিয়েছে সুজিয়েছে এবং খুব কড়কে দিয়েছে সে যেন এলিকে আজ ঝুটঝামেলায় না ফেলে। কাজেই আবার সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। ব্যতিক্রম বলতে শুধু এই যে, মা-বাবাকে নিয়ে আমি আর মারগট একটু নাকাল হয়ে পড়ছি। আমাকে ভুল বুঝো না তুমি জানো, ঠিক এই মুহূর্তে মা-মণির সঙ্গে আমি ঠিক মানিয়ে চলতে পারছি না। বাপিকে আমি আগের মতোই ভালবাসি এবং বাপি আর মা-মণি দুজনকেই ভালবাসে মারগট–কিন্তু যখন তুমি আর কচি খুকিটি নও, তখন তুমি চাইবে কিছু কিছু জিনিসে নিজের বিচার খাটাতে, কখনও কখনও চাইবে স্বাধীনভাবে চলতে।

ওপরে গেলে আমার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয় আমি সেখানে কী করতে যাচ্ছি, খেতে বসে লবণ নিতে পারব না, সন্ধ্যেবেলা রোজ সোয়া আটটা বাজলে অমনি মা-মণি জিজ্ঞেস করবেন এবার আমি জামাকাপড় ছাড়তে শুরু করব কিনা; আমি কোনো বই পড়লে সেটা উল্টেপাল্টে দেখে নেওয়া হবে। এটা স্বীকার করব যে, খুব একটা কড়াকড়ি করা হয়; প্রায় সবকিছুই আমি পড়তে পারি। এ সত্ত্বেও সারাদিন ধরে যেভাবে ফোড়ন কাটা হয় আর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাতে আমরা দুজনেই তিতিবিরক্ত।

অন্য একটা ব্যাপার, বিশেষত আমার ক্ষেত্রে, ওঁরা পছন্দ করছেন না। এখন আর গুচ্ছের চুমো দিতে আমার ভালো লাগে না এবং সখের ডাকনামগুলো ভীষণ বানানো-বানানো মনে হয়। মোদ্দা কথা, কিছুদিন ওঁদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাই। কাল সন্ধ্যেবেলা মারগট বলছিল, একবার জোরে নিঃশ্বাস পড়লে হয়, মাথায় হাত দিলে হয়–অমনই যেভাবে ওঁরা হাঁ-হাঁ করে উঠবেন মাথা ধরেছে কিনা কিংবা শরীর খারাপ হয়েছে কিনা তাতে আমার মেজাজ খিচিয়ে যায়।

নিজেদের বাড়িতে আগে আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাস আর সম্প্রীতি ছিল, হঠাৎ যখন হুশ হল যেসব প্রায় উঠে গেছে— আমরা দুজনেই তাতে প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম। এর একটা বড় কারণ, এখানে আমরা হলাম কুচো। তার মানে বাইরের বিচারে আমাদের মনে করা হয় ছেলেমানুষ; সেক্ষেত্রে সমবয়সী অন্য মেয়েদের চেয়ে আমাদের মন অনেক পরিণত।

যদিও আমার বয়স মোটে চোদ্দ, আমি দস্তুরমত জানি আমি কী চাই, আমি জানি কে ঠিক আর কে বেঠিক, আমার নিজস্ব মতামত আছে, আমার নিজের ভাবনাচিন্তা আর ন্যায়নীতি। বয়ঃসন্ধিতে এটা পাগলামির মতো শোনালেও আমি বলব–আমার অনুভূতিটা শিশুসুলভ নয়; বরং একজন ব্যক্তির; অন্যদের থেকে নিজেকে আমি রীতিমত পৃথক করে ভাবি। আমি জানি মা-মনির চেয়ে আমি নানা জিনিস ঢের ভালোভাবে আলোচনা করতে এবং যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারি, আমি জানি আগে থেকে আমার মন সিটিয়ে থাকে না, আমি অতটা তিলকে তাল করি না, আমি অনেক বেশি যথার্থ এবং চৌকস। সেইজন্যে–শুনে তুমি হাসতে পারো বহু দিক দিয়ে মা-মণির চেয়ে নিজেকে আমি বড় মনে করি। কাউকে যদি ভালবাসতে হয়, সর্বাগ্রে তার সম্বন্ধে আমার চাই অনুরাগ আর শ্রদ্ধা। সব ঠিক হয়ে যেত যদি পেটারকে পেতাম, কেন না অনেক দিক দিয়ে আমি তার অনুরাগী। এত ভালো, এত সুদর্শন ছেলে।

তোমার আনা।

.

রবিবার, ১৯ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

কাল আমার খুব সুদিন গেছে। আমি ঠিকই করে রেখেছিলাম পেটারের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলব। ও-বেলা খাওয়ার সময় ওকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজ সন্ধ্যেবেলা তোমার শর্টহ্যাণ্ড আছে?’ ও বলল, ‘না। আমি তাহলে পরে আসব, এই একটু গল্প করতে।‘ পেটার রাজী। থালাবাসন ধোয়া হয়ে গেলে আমি ওর মা-বাবার ঘরে ঢুকে জানলায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে চারপাশের অবস্থাটা দেখে নিলাম। তারপর দেরি না করে পেটারের কাছে চলে গেলাম। খোলা জানলার বামদিকে পেটার দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমি জানালার ডানদিকে দাঁড়িয়ে কথা শুরু করলাম। দেখলাম কড়া আলোর বদলে আধো-অন্ধকারে খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অনেক সহজে কথা বলা যায়। আমার ধারণা, পেটারও সেই রকম অনুভব করেছিল।

দুজনে দুজনকে আমরা এত কিছু বলেছিলাম, এত অজস্র কথা, তার পুনরাবৃত্তি অসম্ভব; কিন্তু মন ভরে গিয়েছিল। গুপ্ত মহলে জীবনের সে এক পরম রমণীয় সন্ধ্যা। আমাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল, সংক্ষেপে তোমাকে বলব। প্রথমে তুলেছিলাম ঝগড়াঝাটির কথা এবং বলেছিলাম কেন এখন আমি সেটা অন্য চোখে দেখি; তারপর বলেছিলাম বাপ-মাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্যের কথা।

মা-মণি আর বাপি, মারগট আর আমার প্রসঙ্গে ওকে বলেছিলাম।

একটা সময়ে ও জিজ্ঞেস করেছিল, আমার ধারণা, তোমরা প্রত্যেকে প্রত্যেককে একটি করে শুভরাত্রির চুমো খাও, তাই না?

‘একটি করে বলো কী, এক ডজন করে। তোমরা চুমো খাও না?’

‘না, কাউকে আমি কখনও চুমো খাইনি বললেই হয়।’

‘তোমার জন্মদিনেও নয়?’

‘হ্যাঁ, তখন খেয়েছি।’

আমরা দুজনের কেউই আমাদের মা-বাবার কাছে আমাদের গোপন কথা বলি না; ওর মা-বাবার কাছে মন খুললে ওঁরা খুশিই হন, কিন্তু ওর কি রকম ইচ্ছে করে না। আমরা এই সব নিয়ে কথা বললাম। আমি কি রকম বিছানায় শুয়ে কেঁদে ভাসাই আর পেটার কি রকম মটকায় উঠে গিয়ে ঈশ্বরের নামে কসম খায়। মারগট আর আমি এই কিছুদিন হল পরষ্পরকে ভালো করে জানছি, কিন্তু তাও আমরা কেউ কাউকে সব কথা কি রকম বলতে পারি না, তার কারণ আমরা সর্বক্ষণ একসঙ্গে থাকি। কল্পনীয় সব বিষয়েই দেখি–আমি ঠিক যা ভেবেছিলাম পেটার অবিকল তাই।

এরপর ১৯৪২ সাল নিয়ে কথা হল। আমরা তখন কত আলাদা ধরনের ছিলাম। আমরা যে সেই লোক, এখন আর তা মনেই হয় না। গোড়ায় আমরা দুজনে কেউ কাউকে মোটেই দেখতে পারতাম না। পেটার ভাবত আমি বড় বেশি কথা বলি এবং অবাধ্য; আর আমি দুদিনেই বুঝে গেলাম ওকে দেবার মতন আমার সময় নেই। তখন বুঝিনি কেন ও আমার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে না; কিন্তু এখন আমি খুশি। পেটার কতটা আমাদের সকলের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল সেটারও সে উল্লেখ করল। আমি বললাম আমার হৈ-হল্লা আর ওর চুপ করে থাকার মধ্যে খুব একটা ফারাক ছিল না। আমি শান্ত চুপচাপ ভাবও পছন্দ করি এবং আমার ডায়রি ছাড়া আর কিছুই আমার একার নয়। পেটার খুব খুশি যে আমার মা বাবার সন্তানেরাও এখানে আছে এবং পেটার এখানে থাকায় আমি খুশি। এখন বুঝেছি কেন ও কথা কম বলে এবং মা-বাবার সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক। ওকে সাহায্য করতে পারলে আমার খুবই ভালো লাগবে। এইসব ছিল আমাদের কথার প্রসঙ্গ।

পেটার বলল, ‘সব সময়ই তুমি আমাকে সাহায্য করো।’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি রকম?’ ‘তোমার হাসিখুশি ভাব দিয়ে।‘ ওর এই কথাটা আমার সবচেয়ে মিষ্টি লেগেছে। কী ভালো, কী ভালো! ও নিশ্চয় এতদিনে আমাকে বন্ধুর মতন ভালবাসতে পারছে; আমার পক্ষে আপাতত তাই যথেষ্ট। আমি যে কত কৃতজ্ঞ, কত সুখী কী বলব। তুমি যেন কিছু মনে করো না, কিটি–আজ আমি যেখানে যে কথা বসাচ্ছি তাতে লেখার ঠিক মান বজায় থাকছে না।

আমার মাথায় যখন যা এসেছে আমি ঠিক সেইটুকুই কলমের মুখে ধরে দিয়েছি। আমি এখন অনুভব করছি, পেটার আর আমি, আমার একটি রহস্যের অংশীদার। হাসিতে ফেটে পড়া চোখে ও যদি চোরা চাহনিতে আমার দিকে তাকায় তাহলে সেটা হবে আমার বুকের মধ্যে খানিকটা দতি চলে যাওয়ার মতন। আমি আশা করি, এ জিনিস এই ভাবেই থেকে যাবে এবং মিলিতভাবে আমাদের দুজনের জীবনে এমন অসামান্য লগ্ন অনেক, অনেকবার দেখা দেবে।

 তোমার আনা।

.

সোমবার, ২০ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আজ সকালে পেটার জিজ্ঞেস করেছিল আরেকদিন সন্ধ্যাবেলা আমি ওর কাছে যাব কিনা; বলেছিলাম আমি গেলে ওর কাজে কোনো ব্যাঘাত হবে কি না। বলেছিল, একজনের জায়গা হলে দুজনেরও ঠাঁই হবে। আমি বললাম, রোজ সন্ধ্যেয় আসতে পারব না, কেননা নিচের তুলার ওরা সেটা পছন্দ করবেন না। পেটারের কথা হল, ও নিয়ে আমি যেন মাথা না ঘামাই। তখন আমি বললাম একটা শনিবার দেখে আমি স্বচ্ছন্দে সন্ধ্যেবেলা আসতে পারি; আমি,  ওকে বিশেষভাবে বলে দিলাম আকাশে চাঁদ থাকলে ও যেন আগে থেকে আমাকে হুঁশিয়ার করে দেয়। পেটার বলল, ‘আমরা তখন নিচে চলে গিয়ে সেখান থেকে চাঁদ দেখব।’

ইতিমধ্যে আমার সুখে একটা ছোট কাটা বিধেছে। আমি বহুদিন ভেবেছি মারগটেরও পেটারকে খুব ভালো লাগে। ওকে সে কতটা ভালবাসে জানি না, তবে আমার মনে হয় তেমন কিছু নয়। পেটার আর আমি যখনই একত্র হই, ওর বুকে নিশ্চয় খুব বাজে। এর মধ্যে হাস্যকর ব্যাপার হল এই যে, ও সেটা প্রায়ই চেপে রাখে।

আমি হলে, এটা ঠিক, হিংসেয় মরে যেতাম, কিন্তু মারগট শুধু বলে আমার ওকে করুণা করার কোনো প্রয়োজন নেই।

আরও বললাম, ‘মাঝে থেকে তুমি বাদ পড়ে গেলে, এটা ভেবে খুব খারাপ লাগছে।’ খানিকটা তিক্ততার সঙ্গে মারগট বলল, ‘ওতে আমি অভ্যস্ত।‘

এখনও এই কথা পেটারকে বলতে আমার সাহস হয় না, হয়ত পরে বলব। তবে তার আগে বিস্তর জিনিস নিয়ে দুজনে কথা বলতে হবে।

কাল সন্ধ্যেবেলা মা-মনি উচিত মতই আমাকে কিছুটা ভেটেছেন; ওঁর প্রতি উদাসীনতা দেখাতে দিয়ে আমার অতটা বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। আমাকে আবার ভাঙা ভাব জোড়া লাগাবার চেষ্টা করতে হবে এবং যখন যা মনে হবে ফট করে তা বলা চলবে না।

এমন কি পিমও ইদানীং আর আগের মতো নেই। আমি কচি খুকি নই–আমার প্রতি উনি ব্যবহার করছেন সেইমত। ফলে, ওঁর মধ্যে একটা ছাড়া-ছাড়া ভাব। কোথাকার পানি কোথায় গড়ায় দেখা যাক।

অনেক হয়েছে, আজ এখানেই ইতি টানি। আমার মধ্যে কানায় কানায় ভরে আছে পেটার। ওর দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছি না।

মারগট কত ভালো, নিচে তার সাক্ষ্যপ্রমাণ; চিঠিটা আজকেই পেয়েছি–

২০ মার্চ, ১৯৪৪

আনা, কাল যখন বলেছিলাম তোকে ঈর্ষা করি না, তা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ছিল সত্যিকার মনের কথা। ব্যাপারটা এই রকম–তুই বা পেটার, কাউকেই আমি ঈর্ষা করি না। আমি এমন কাউকে এখনও পাইনি, আপাতত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই, যার কাছে আমি আমার ভাবনা আর আবেগ-অনুভূতিগুলো মেলে ধরতে পারি–সেইটুকুই যা আমার দুঃখ। কিন্তু তার জন্যে তোর প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। অন্যেরা যা না চাইতেই পায়, এখানে তেমন কত কিছু থেকেই তো আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।

অন্যদিকে, আমি জানি আমার সঙ্গে পেটারের ভাব কখনই অতদূর এগুতো না; কারণ, আমার কেন যেন মনে হয়, কারো সঙ্গে অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে আমি আশা করব সে আমার খুব কাছের মানুষ হবে। আমি যেন টের পাই যে, আমি অনেক না বললেও সে যেন আমাকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারে। কিন্তু তার জন্যে, তাকে হতে হবে এমন একজন, আমি বুঝব, যে বুদ্ধিবৃত্তিতে আমার চেয়ে বড়; পেটারের বেলায় সেটা খাটে না। কিন্তু তোর আর পেটারের সম্পর্কে সেটা খাপ খায় বলে আমি মনে করি।

এমন নয় যে, আমার প্রাপ্য জিনিস থেকে আমাকে তুই বঞ্চিত করেছিস; আমার কথা ভেবে নিজেকে তুই একটুও ভৎসনা করিস নে। তুই আর পেটার–তোদের বন্ধুত্বে লাভবানই হবি।

.

আমার উত্তর

আদরের মারগট,

তোর চিঠি আমার অসম্ভব মিষ্টি লেগেছে, কিন্তু এখনও এ ব্যাপারে আমি ঠিক স্বস্তি পাচ্ছি না, কখনও পাব বলে মনে হয় না।

পেটার আর আমার মধ্যে তোর মনে তুই যে ভরসা পেয়েছিস, সে প্রশ্ন আপাতত ওঠে, তবে খটখটে দিনের আলোর চেয়ে খোলা জানালার ধারে আলো-আঁধারিতে পরস্পরকে অনেক বেশি কথা বলা যায়। তাছাড়া ঢাক পিটিয়ে বলার চেয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলা অনেক সহজ। আমার বিশ্বাস, পেটার সম্পর্কে তুই এক রকম ভ্রাতৃস্নেহ বোধ করতে শুরু করেছি এবং আমি যতটা পারি ততটাই তুই ওকে সানন্দে সাহায্য করতে চাইবি। হয়ত এক সময়ে তোর পক্ষে সেটা সম্ভব হবে, যদিও এ ধরনের ভরসার কথা আমরা ভাবছি না। সেটা আসতে হবে দু’পক্ষ থেকেই। আমার বিশ্বাস, বাপি আর আমার মধ্যে সেই কারণেই কখনও সেটা ঘটেনি। এ নিয়ে আমাদের কথাবার্তা এখানেই শেষ হোক; এর পরও যদি তোর কিছু বলার থাকে, দয়া করে আমাকে লিখে জানাস; কারণ, আমি ঢের ভালো পারি মনের কথা লিখে বলতে। এ তুই জানিস না আমি তোর কতটা অনুরাগী; আমি কেবল চাই তোর আর বাপির যে সদ্গুণ, তার কিছুটা আমার মধ্যে যেন বর্তায়; কারণ, সেদিক থেকে তোর আর বাপির মধ্যে এখন আমি খুব একটা তফাত খুঁজে পাই না।

তোমার আনা।

.

বুধবার, ২২ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

কাল সন্ধ্যেয় মারগটের কাছ থেকে এই চিঠিটা পেয়েছি—

‘আদরের আনা,

কাল তোর চিঠি পেয়ে এই ভেবে আমার মনটা খচখচ করতে লাগল যে, পেটারের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তোর বিবেক বোধহয় খোঁচায়; কিন্তু সত্যি বলছি, এটা হওয়ার কোনো কারণ নেই। মনেপ্রাণে বুঝি, কারো সঙ্গে পারস্পরিক বিশ্বাস ভাগ করে নেওয়ার পূর্ণ অধিকার আমার আছে, কিন্তু আজও পেটারকে সে আসনে বসানো আমার বরদাস্ত হবে না।

যাই হোক, তোর কথামত আমিও অনুভব করি, পেটার খানিকটা ভাইয়ের মত, তবে-ছোট ভাই; আমরা পরস্পরকে জানান দিয়েছি, তাতে সাড়া মিললে ভাইবোনের স্নেহের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, হয়ত সেটা দুদিন পরে হবে–কিংবা কখনই হবে না; অবশ্য এখনও সে পর্যায়ে যে পৌঁছায়নি, তাতে সন্দেহ নেই। সুতরাং, আমার জন্যে দুঃখ বোধ করার সত্যিই কোনো কারণ নেই। এখন তুই যা পেয়েছিস, সেই সুখ-দুখ যতখানি পারিস ভোগ কর। ইতিমধ্যে এ জায়গাটা ক্রমেই আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠছে। আমার বিশ্বাস কিটি, ‘গুপ্ত মহলে’ আমরা হয়ত প্রকৃত মহৎ ভালবাসা পেতে পারি। ঘাবড়িও না, ওকে আমি বিয়ে করার কথা ভাবছি না। বড় হলে ও কেমন হবে জানি না; এও জানি না, আমরা কখনও বিয়ে করবার মতো পরস্পরকে যথেষ্ট ভালোবাসতে পারব কিনা। আমি এখন জানি যে, পেটার আমাকে ভালবাসে, কিন্তু কী করে, সেটা নিজেই এখনও আমি জানি না।

ও কি চায় একজন প্রাণের বন্ধু, নাকি ওর কাছে আমার আকর্ষণ একজন মেয়ে কিংবা একজন বোন হিসেবে এখনও আমি তা আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি।

ও যখন বলেছিল যে, ওর মা-বাবার ঝগড়ায় আমি সবসময় ওর সহায় হয়েছি তখন আমি দারুণ খুশি হয়েছিলাম; ওর বন্ধুত্বে আস্থাবান হওয়ার ব্যাপারে তাতে এক ধাপ এগোনো গিয়েছিল। কাল ওকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, এখানে যদি এক ডজন আনা থাকত এবং তারা যদি সবসময় ওর কাছে যেতে থাকত তাহলে ও কী করত? পেটার তার উত্তরে বলেছিল, তারা সবাই যদি তোমার মতো হত, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা মন্দ হত না।’ আমি গেলে ও অসম্ভব খাতির যত্ন করে এবং আমার ধারণা আমাকে দেখলে সত্যিই ও খুশি হয়। এর মধ্যে ফরাসী নিয়ে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে ও খাটছে–এমন কি বিছানায় শোয়ার পরেও সোয়া দশটা পর্যন্ত পেটার তার পড়াশুনো চালিয়ে যায়। যখন আমি শনিবার সন্ধ্যেটা স্মরণ করি, প্রত্যেকটা কথা এবং আগাগোড়া সব যখন আমার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে, তখন এই প্রথম অনুভব করি আমার মনে কোনো খেদ নেই; অর্থাৎ সাধারণত যা হয়, সেই মত একটুও না। বদলে, আমি যা বলেছিলাম সেই একই কথা আবারও বলব।

পেটার যখন হাসে, যখন সামনের দিকে তাকায় ওকে এত ভালো দেখায়। ছেলেটা এত মিষ্টি, এত ভালো। আমার মনে হয়, আমার ব্যাপারে যেটা ওকে সবচেয়ে অবাক করেছিল, সেটা হল–যখন ও দেখল, বাইরে থেকে আনাকে যতটা হালকা, ঘোর সাংসারিক বলে মনে হয় আসলে তো তা নয়; আনা বরং পেটারের মতোই স্বপ্ন-দেখা লোক এবং তারও আছে হাজার সমস্যা।

তোমার আনা।

.

আমার উত্তর

আদরের মারগট,

আমার মনে হয়, এখন আমাদের পক্ষে সবচেয়ে ভালো কাজ হল–কী হয়, অপেক্ষা করে দেখা। আগের মতো চলবে, না আমরা অন্য রকম হব–সে বিষয়ে পেটার আর আমার নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসতে খুব দেরি হবে না। কী পরিণতি হবে আমি নিজেই জানি না; যা নাকের সামনে, তার বাইরে চেয়ে দেখার ব্যাপারে আমি মাথা ঘামাই না। তবে আমি নিশ্চয়ই একটা জিনিস করব–পেটার আর আমি যদি বন্ধু হব সাব্যস্ত করি, তাহলে ওকে বলব তুই ওরও খুব অনুরক্ত; আর যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তুই ওকে সাহায্য করতে সব সময়েই রাজী। শেষেরটা তোর অভিপ্রেত না হতে পারে কিন্তু এখন আমি সেটা গ্রাহ্য করছি না; তোর সম্পর্কে পেটারের মনোভাব কী আমি জানি না; তবে সেটা তখন ওকে আমি জিজ্ঞেস করে নেব।

খারাপ নয়, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত–বরং উল্টোটা। আমরা ছাদের ঘরে বা যেখানেই থাকি, সবসময় তুই আমাদের স্বাগত জানবি। সত্যি বলছি, তুই এলে আমাদের কোনো ব্যাঘাত হবে না। কেননা আমাদের মধ্যে একটা মৌন বোঝাঁপড়া আছে যে, সন্ধ্যেটা অন্ধকার থাকলে তবেই আমরা কথাবার্তা বলব।

মনোবল বজায় রেখো। যেমন আমি রাখি। অবশ্য সব সময় সেটা সহজ নয়। তুমি যা ভাবছ তার আগেই হয়ত তোমার কপাল খুলে যাবে।

তোমার আনা।

.

বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

সব জিনিস কমবেশি আবার এখন স্বাভাবিক। যারা আমাদের কুপন যোগাত, ভাগ্য ভালো, আবার তারা জেলের বাইরে এসেছে।

মিপ কাল ফিরেছেন। এলি অনেক ভালো, তবে কাশি এখনও যায়নি। কুপহুইসকে এখনও বেশ কিছুদিন বাড়িতে থাকতে হবে।

কাল কাছাকাছি একটা জায়গায় প্লেন ভেঙে পড়েছে; ভেতরে যারা ছিল প্যারাসুট নিয়ে সময়মত লাফিয়ে পড়তে পেরেছে। বিমানযন্ত্রটা একটা ইস্কুলবাড়ির ওপর ভেঙে পড়ে, কিন্তু সে সময়ে ইস্কুলে বাচ্চারা ছিল না। এর ফলে, ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড হয় এবং তাতে দুজন লোক পুড়ে মরে। বৈমানিকরা নেমে আসবার সময় জার্মানরা সাংঘাতিকভাবে গুলিগোলা ছোড়ে। আমস্টার্ডামের যে সব লোক এটা দেখে, তারা ওদের এই কাপুরুষোচিত আচরণ দেখে রাগে আর বিরক্তিতে প্রায় ফেটে পড়ে। আমরা–আমি মেয়েদের কথা বলছি–আঁতকে উঠেছিলাম, গুলিগোলা আমার দুচক্ষের বিষ।

বেলাশেষে খাওয়ার পর আজকাল প্রায়ই আমি ওপরে যাই; গায়ে লাগাই ফুরফুরে সান্ধ্য হাওয়া। পেটারের পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে বেশ লাগে। আমি ওর ঘরে চলে গেলে ফান ডান আর ডুসেল খুব ক্ষীণ কণ্ঠে টিপ্পনি কাটেন; ওঁরা নাম দেন ‘আনার দোসরা মোকাম অথবা বলেন, ভদ্রঘরের ছেলেদের কি আধো-অন্ধকার ঘরে কমবয়সী মেয়েদের বসতে বলা উচিত?’ এই ধরনের তথাকথিত সরস আক্রমণের জবাবে পেটার অসাধারণ বাকপটুত্ব দেখায়। সেদিক থেকে মা-মণিও কিছুটা ছোঁকছোঁক করেন। পারলে জিজ্ঞেসই করে বসেন আমরা নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করি–পারেন না, কেননা মনে মনে ভয় পান পাছে থোতা মুখ ভোতা হয়। পেটার বলে, এটা বড়দের নিছক হিংসের ব্যাপার। কেননা আমাদের বয়স কম এবং ওদের গাত্রদাহ আমরা বিশেষ কেয়ার করি না। মাঝে মাঝে পেটার নিচে এসে আমাকে নিয়ে যায় এবং সমস্ত রকম সাবধানতা সত্ত্বেও লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে, তার মুখ দিয়ে কথা সরে না। ভাগ্যিস, আমি লজ্জায় লাল হই না, ওটা নিশ্চয় একটা খুব বিচ্ছিরি অনুভূতি। বাপি সব সময় যে বলেন আমি শুচিবায়ুগ্রস্ত এবং অভিমানী, সেটা কিন্তু ঠিক নয়। আমি শুধুই অভিমানী। আমাকে কেউ বড় একটা বলেনি যে, আমাকে দেখতে ভালো। কেবল ইস্কুলে একটি ছেলে আমাকে বলেছিল হাসলে আমাকে সুন্দর দেখায়। কাল পেটারের কাছ থেকে একটা অকৃত্রিম প্রশংসা পেয়েছি। শুধু মজা করার জন্যে বলব মোটামুটিভাবে আমাদের কি রকম কী কথা হয়েছিল

পেটার আমাকে প্রায় দেখলেই বলে, ‘আনা, একটু হাসো।’ ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকায় ওকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কেন বলো তো, সব সময় আমি হাসব?’

কারণ, আমার ভালো লাগে; হাসলে তোমার গালে টোল পড়ে; কেমন করে হয় বল

‘ওটা আমার জন্ম থেকে। আমার চিবুকেও একটা আছে। এটাই আমার একমাত্র সৌন্দর্য।’

‘মোটেই না, ওটা সত্যি নয়।’

‘হ্যাঁ, বলছি শোন। আমি ভালভাবেই জানি আমি সুন্দরী নই; কখনও ছিলাম না, কখনও হবোও না।

‘আমি মানছি না। আমি মনে করি তুমি সুন্দরী।

‘সেটা সত্যি নয়।’

‘আমি যদি বলি, তাহলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পার, সেটা তাই।‘

তখন স্বভাবতই আমি তার সম্পর্কেও একই কথা বললাম।

এই হঠাৎ বন্ধুত্ব নিয়ে চারদিক থেকে নানা কথা আমার কানে আসছে। ওদের মন্তব্যগুলো এত ফিকে যে, মা-বাবাদের এইসব বকবকানি আমরা তেমন গায়ে মাখি না। মা-বাবার দল দুটো কি নিজেদের যৌবনের কথা ভুলে গিয়েছে? মনে তো হয় তাই; অন্তত দেখতে পাই, আমরা হাসিঠাট্টা করলে ওঁরা মুখ গম্ভীর করেন আর আমরা গুরুগম্ভীর কিছু বললে ওঁরা হেসে উড়িয়ে দেন।

তোমার আনা।

.

সোমবার, ২৭ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

আমাদের লুকিয়ে থাকার ইতিহাসের বেশ একটা বড় অধ্যায় বস্তুত রাজনীতির প্রসঙ্গ নিয়ে হওয়া উচিত; কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতির প্রতি আমার তেমন টান না থাকায়, আমি তার মধ্যে যাইনি। সুতরাং আজ আমি একটিবারের জন্যে আমার পুরো চিঠিটাই রাজনীতি দিয়ে ভরে দেব। এই বিষয়টা নিয়ে যে নানা মুনির নানা মত, তা না বললেও চলে; এ রকম সংকটপূর্ণ সময়ে এটা আলোচনার এমন কি একটা মুখরোচক বিষয় হওয়াও খুবই যুক্তিসঙ্গত; কিন্তু এ নিয়ে এত রকমের ঝগড়াঝাটি থাকাটা স্রেফ বোকামি। ওরা অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ুক, হাসাহাসি করুক, গালাগালি দিক এবং গজগজ করুক; যতক্ষণ নিজের ল্যাজ নিজে পোড়াচ্ছে এবং ঝগড়া করছে না, ততক্ষণ তারা যা খুশি তাই করুক–কেননা সাধারণত পরিণতিগুলো হয় অপ্রীতিকর।

বাইরে থেকে লোকে এমন অনেক খবর নিয়ে আসে যা সত্যি নয়। অবশ্য আজ পর্যন্ত আমাদের রেডিও সেট কখনও মিথ্যে কথা বলেনি। হেংক, মিপ, কুপহুইস, এলি আর ক্রালার–এরা সবাই তাদের রাজনৈতিক মনমেজাজের চড়া-মন্দার পরিচয় দিয়েছে; সবচেয়ে কম হেংক।

‘গুপ্ত মহলে’র রাজনৈতিক সাড়া সবসময়ই প্রায় এক। উপকূলে সৈন্য নামানো, হাওয়াই হামলা, নেতাদের বক্তৃতা ইত্যাদি নিয়ে যখন কথার ঝড় ওঠে, সমানে তখন ‘অসম্ভব, ‘অসম্ভব’ বলে কত যে চিৎকার হয় তার ঠিক থাকে না; কিংবা শোনা যায় ‘ঈশ্বরের ইচ্ছায়, ওরা যদি এখন শুরু করে, তবে আরও কতদিন ধরে চলবে? ‘চলছে দারুণ, একের নম্বর, বহুৎ খুব।’ আশাবাদী আর নৈরাশ্যবাদী এবং সবার ওপরে সেই সব বাস্তববাদী, যারা অক্লান্ত উৎসাহে নিজেদের মতামত দিয়ে যায় এবং অন্যসব কিছুর মতোই, এ ব্যাপারেও তারা প্রত্যেকে নিজেকে অভ্রান্ত মনে করে। ব্রিটিশের ওপর অচলা ভক্তি দেখে ভদ্রমহিলাদের কেউ তার কর্তার ওপর বেজার হন এবং ভদ্রলোকদের কেউ নিজের প্রিয় স্বজাতি সম্পর্কে কটুকাটব্য করার দরুন তার ঘরনীকে ঠোকেন।

এ ব্যাপারে ওদের উৎসাহে যেন কখনও ভাটা পড়তে দেখা যায় না। আমি একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি–ফল প্রচণ্ড; কারো গায়ে পিন ফোঁটালে যেমন আশা করা যায় তড়াক করে লাফাবে, এও ঠিক তাই। আমার কায়দা হল এই–মুখপাত করো রাজনীতি দিয়ে। একটি প্রশ্ন, একটি কথা, একটি বাক্য ব্যস্, সঙ্গে সঙ্গে বোমা ফাটবে।

যেন জার্মান ভেমাখটু-এর সংবাদ বুলেটিন আর ইংরেজদের বি.বি.সি.-ও যথেষ্ট নয়, তার ওপর এমন ওঁরা জুটিয়েছেন বিশেষ হাওয়াই হামলার ঘোষণা। এক কথায়, রাজসিক; কিন্তু অন্য দিক থেকে আবার হতাশাব্যঞ্জকও বটে। ব্রিটিশ এখন জার্মানদের মিথ্যের কারবারের মতন সমান উৎসাহে হাওয়াই হামলাকে একটা বিরতিহীন কাজ-কারবারে পরিণত করেছে। সুতরাং রাত পোহাতেই রেডিও শুরু হয়ে যায় এবং সারাদিন ধরে শুনতে শুনতে শেষ হয় রাত নটা, দশটা এবং প্রায়ই এগারোটা নাগাদ।

বড়দের বলিহারি ধৈর্য; কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও বোঝায় যে, তাদের মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা বেশ কম; এর ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে–আমি কারো আঁতে ঘা দিতে চাই না। দিনে একটা কি দুটো সংবাদ বুলেটিনই যথেষ্ট। কিন্তু বোকা বাড়িগুলো, থুড়ি–আমার যা বলার ছিল বলে দিয়েছি।

আরাইটার-প্রোগ্রাম, রেডিও ‘ওরান্‌জে’, ফ্রাঙ্ক ফিলিপস্ কিংবা মহামান্য রানী ভিলহেলমিনা–প্রত্যেকে পালা করে আসে এবং তাদের কথা বরাবর একাগ্রচিত্তে শোনা হয়। যে সময়টা বা ঘুমোনো থাকে না, ওরা সারাক্ষণ রেডিওর চারপাশে গোল হয়ে বসে খাওয়া, ঘুমোনো আর রাজনীতি নিয়ে বকর বকর করে।

ইস! এত বিরক্তিকর লাগে। এর মধ্যে পড়ে ম্যাদামারা হওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোই শক্ত হয়। রাজনীতি মা-বাবাদের এর চেয়ে বেশি কী আর ক্ষতি করবে।

আমি এখানে একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রমের কথা উল্লেখ করব–আমাদের সবার প্রিয় উইনস্টন চার্চিলের বক্তৃতার সত্যি জবাব নেই।

রবিবার রাত নটা। টেবিলে রাখা টি-পটের গায়ে ঢাকা, অতিথিরা ঢুকছে। বাঁয়ে রেডিওর ঠিক পাশে ডুসেল। রেডিওর সামনাসামনি ফান ডান, তাঁর পাশে পেটার। মিস্টার ফান ডানের পাশে মা-মণি, পেছনে মিসেস ফান ডান। পিম বসেছেন টেবিলে, তার পাশে মারগট আর আমি। আমাদের বসার ধরনটা দেখছি আমি খুব পরিষ্কার ভাবে ফোঁটাতে পারিনি। ভদ্রলোকেরা পাইপের ধোয়া ছাড়ছেন, কষ্ট করে শোনবার চেষ্টা করতে গিয়ে পেটারের চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মা-মণির পরনে গাঢ় রঙের একটা লম্বা ঢিলেঢালা পিরান। মিসেস ফান ডান প্লেনের শব্দে কাঁপছেন; বক্তার তোয়াক্কা না করে প্লেনগুলো এসেনের দিকে পরমানন্দে ছুটে চলেছে। বাপি চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। মারগট আর আমি, আমরা দু-বোন একঠাই হয়ে বসে; আমাদের দুজনেরই কোল জুড়ে মুশ্চি ঘুমোচ্ছে। মারগটের মাথায় চুল-কোঁকড়ানোর কল আঁটা; আমি যে রাত্রিবাস পরে আছি সেটা যেমনি ছোট, তেমনি আঁটো এবং তেমনি খাটো।

সব মিলিয়ে বরাবরের মতোই খুব ঘনিষ্ঠতার, আরামের আর শান্তির ছবি; এ সত্বেও পরিণামের কথা ভেবে আমি বিভীষিকা দেখছি। বক্তৃতা শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা, আর অপেক্ষা করতে পারছে না, মেঝের ওপর পা টুকছে; কতক্ষণে তারা গজালি করতে থাকবে, সেই চিন্তাতেই তারা অধীর। তর্কের বিষয়গুলো যতক্ষণ না তাদের বিসম্বাদে আর ঝগড়ায় টেনে নিয়ে যায়, ততক্ষণ তারা ব্যাজর-ব্যাজর করে এ-ওকে সমানে তাতাতে থাকবে।

তোমার আনা।

.

ঙ্গলবার, ২৮ মার্চ, ১৯৪৪

প্রিয়তম কিটি, রাজনীতি নিয়ে আরও একগাদা লিখে ফেলতে পারতাম, কিন্তু আজ অন্য নানা বিষয়ে অনেক কিছু তোমাকে আমার বলার আছে। প্রথমত,–মণি আমাকে অত ঘন ঘন ওপর তলায় যেতে একরকম বারণই করে দিয়েছেন, কারণ তার মতে মিসেস ফান ডানের তাতে চোখ টাটায়। দ্বিতীয়ত, পেটার মারগটকে বলেছে আমরা ওপর তলায় থাকব, সে যেন আসে; জানি না, এটা মৌখিক ভদ্রতা–না সে মন থেকেই বলেছে। তৃতীয়ত, আমি গিয়ে বাপিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, মিসেস ফান ডানের হিংসুটেপনা আমি গায়ে মাখব কিনা। তার দরকার আছে বলে উনি মনে করেন না। এখন কী করা যায়? মা-মণি চটিতং; বোধ হয় ওঁর চোখও টাটাচ্ছে। ইদানীং আমরা মেলামেশা করলে বাপি কিছু মনে করেন না এবং আমাদের মধ্যে এত যে ভাব, সেটা খুব ভালো বলে ওর ধারণা। মারগটও পেটারের ভক্ত; তবে ওর ভাবটা হল, দুইয়ে নিবিড় আর তিনে ভিড়।

মা-মণির ধারণা, পেটার আমার প্রেমে পড়েছে; সেটা হলে, সত্যি বলতে, আমি খুশিই হতাম। তাহলে শোধবোধ হয়ে যেত এবং আমরা পরস্পরকে সত্যিই চিনতে পারতাম। মা মণি এও বলেন যে, পেটার আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন, আমি মনে করি সেটা সত্যি, কিন্তু ও যদি আমার টোল-খাওয়া গালের দিকে তাকায় এবং আমরা মাঝে মাঝে পরস্পরের দিক আড়চোখে চাই, তবে আমার কি করার আছে? করার কিছু আছে কি?

আমি আছি ভারি মুশকিল অবস্থায়। মা-মণি আমার বিরুদ্ধে, আমিও মা-মণির বিরুদ্ধে। বাপি চোখ বুজে থাকেন, যাতে আমাদের নিঃশব্দ লড়াই দেখতে না হয়। মা-মণির মন ভার হয়ে থাকে, কারণ আমাকে উনি প্রকৃতই ভালবাসেন; আমার কিন্তু একটুও মন খারাপ হয় না। কারণ আমি মনে করি না মা-মনি বোঝেন। আর পেটার–আমি পেটারকে ছেড়ে দিতে চাই না, ও আমার বড় আদরের। আমি ওকে অসম্ভব পছন্দ করি; ক্রমে আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারবে; কেন যে বুড়োগুলো সারাক্ষণ নাক গলায়? ভাগ্যি ভালো, আমার মনের ভাব আমি লুকোতে পারি; আমি পেটার বলতে পাগল, কিন্তু অতি চমৎকার ভাবে আমি সেটা লোকচক্ষের আড়াল করে রাখি। ও কি কোনোদিন কিছু বলবে? স্বপ্নে, যেমন পেটেলের গালে গাল রেখেছিলাম, সেই রকম কখনও কি আমার গালে পেটারের গাল রাখার অনুভূতি পাব? ও পেটার ও পেটেল–তোমরা এক, তোমরা অভিন্ন। ওরা আমাদের বোঝে না; দুজনে মুখোমুখি বলে, কোনো কথা না বলে আমরা সুখ পাই এটা কি কোনোদিনই ওদের মাথায় ঢুকবে না? ওরা বোঝে না কিসের তাড়নায় আমরা এভাবে একঠাই হয়েছি। ইস্, কবে যে এইসব মুশকিলের আসান হবে? এবং মুশকিলের আসান হওয়াই ভালো, তাহলে পরিণতিটা হবে আরও সুন্দর। পেটার যখন হাতের ওপর মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে থাকে, ও তখনও শিশুটি; বোখার সঙ্গে খেলা করার সময় ও স্নেহময়; ও যখন আলু বা ভারী কিছু বয়ে নিয়ে যায়, পেটার তখন বলবান; ও গিয়ে যখন গোলাগুলি চলতে দেখে, অথবা অন্ধকারে চোর ধরতে যায়, তখন ও সাহসী; আর ও যখন অসম্ভব এলোমেলো আর কাছাখোলা, তখন ওকে আদর করতে ইচ্ছে করে।

আমার অনেক ভালো লাগে আমি ওকে তালিম দেওয়ার চেয়ে ও যখন আমাকে কিছু ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়। প্রায় সব কিছুতেই ও আমার ওপরে হলে, আমি খুশি হই।

দুই মা-কে আমাদের কিসের পরোয়া? তবে এও ঠিক পেটার যদি, ইস, শুধু একটু মুখ ফুটে বলত।

তোমার আশা।

.

বুধবার, ২৯ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি, লণ্ডন থেকে ওলন্দাজ সংবাদ পরিক্রমায় একজন এমপি বলকেস্টাইন কথা প্রসঙ্গে বললেন, যুদ্ধের পর সমস্ত ডায়রি আর চিঠির একটা সংগ্রহ হওয়া উচিত। তার ফলে তক্ষুণি ওরা সবাই আমার ডায়রির জন্যে আমাকে হেঁকে ধরল। একবার ভেবে দেখ ‘গুপ্ত মহল’ নিয়ে রোমাঞ্চকাহিনী যদি ছাপাই কী মজাদার ব্যাপার হবে। বইয়ের নাম (এই ডায়রির গোড়ার নামকরণ ছিল ‘হেট আখৃটেয়ারহুইস’; ইংরেজিতে এর কোন সঠিক প্রতিশব্দ নেই। সবচেয়ে কাছাকাছি হল ‘দি সিক্রেট অফ আনেক্স’–গুপ্ত মহল) দেখেই লোকে ধরে নেবে এটা একটা গোয়েন্দা-গল্প।

কিন্তু, ঠাট্টা নয়, যুদ্ধের দশ বছর পর আমাদের ইহুদিদের যদি বলতে হয় আমরা এখানে কী ভাবে থেকেছি, কী খেয়েছি, কী নিয়ে কথাবার্তা বলেছি, তাহলে তখন, সেসব হাস্যকর শোনাবে। তোমাকে আমি অনেক কিছুই বলি বটে, তবু যত যাই হোক, তুমি আমাদের। জীবনের কণামাত্র জানো।

হাওয়াই হামলার সময় মহিলারা যে কী ভয় পেতেন। যেমন, রবিবারে যা হল; ৩৫০টা ব্রিটিশ প্লেন এসে ঈমুইডেনের ওপর পাঁচ লক্ষ কিলো ওজনের বোমা ফেলে গেল; বাড়িগুলো তখন একগুচ্ছ তৃণের মতো তির তির করে কাঁপছিল; কে জানে কত মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে এখন। তুমি এ সবের কোনোই খবর রাখো না। তোমাকে সবকিছু সবিস্তারে জানাতে হলে আমাকে এখন সারাটা দিন বসে, লিখে যেতে হবে। তবিতরকারি আর অন্য যাবতীয় জিনিসের জন্যে লোকজনদের লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে, ডাক্তাররা রুগী দেখতে যেতে পারছে না, কারণ রাস্তায় রেখে যেই পেছন ফিরবে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি হাওয়া হয়ে যাবে; চুরি চামারি এত বেড়ে গেছে যে, তুমি অবাক হয়ে ভাববে, ওলন্দাজদের ঘাড়ে কী এমন ভূত চাপল যে, রাতারাতি তারা চোর হয়ে গেল। পুঁচকে পুঁচকে ছেলে, বয়স কারো আট–কারো এগারো, লোকজনদের বাড়িঘরের জানালা ভেঙে ঢুকে যা পাচ্ছে তাই হাতিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট কেউ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারে না; তুমি গেলে তোমার জিনিসপত্রও চলে যাবে। খোয়া যাওয়া জিনিসপত্র, টাইপরাইটার, পারসোর গালচে, ইলেকট্রিক ঘড়ি ইত্যাদি ফেরত পেলে পুরস্কার দেওয়া হবে–এই মর্মে রোজ কাগজে বিজ্ঞপ্তি বেরোচ্ছে। রাস্তার ইলেকট্রিক ঘড়িগুলো লোপাট, পাবলিক টেলিফোনগুলো টান মেরে তারসুদ্ধ তুলে নিয়ে গেছে। লোকজনদের মনোবল ভালো থাকা সম্ভব নয়–সাপ্তাহিক যা রেশন, তাতে কফির অনুকল্প ছাড়া আর কিছুই দুদিনের বেশি যায় না। সৈন্য নামানোর ব্যাপার তো সেই কবে থেকে শুনে আসছি; এদিকে লোকজনদের জার্মানিতে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে। ছেলেপুলেরা হয় অসুখে পড়ছে, নয় পুষ্টিহীনতায় ভুগছে; প্রত্যেকেরই জামাকাপড় আর জুতোর জীর্ণ দশা। কালোবাজারে জুতোর একটা নতুন সোলের দাম সাড়ে সাত ফ্লোরিন; তার ওপর, মুচিরা কেউ জুতো সারাইয়ের কাজ হাতে নেবে না আর যদি নেয়ও, মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হবে তার মধ্যে অনেক সময় জুতো জোড়াই গায়েব হয়ে যাবে।

এর মধ্যে একটা ভালো জিনিস এই যে, খাবারদাবার যত নিকৃষ্ট এবং দমনপীড়ন যত জোরালো হচ্ছে, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত সমানে ততই বাড়ছে। খাদ্য দপ্তরগুলোতে যারা কাজ করে, পুলিস, রাজকর্মচারী, এরা সবাই হয় শহরের বাকি লোকদের সঙ্গে থেকে মেহনত করছে এবং তাদের সাহায্য করছে আর তা নয়তো মিথ্যে লাগানো-ভজানো করে তাদের শ্রীঘরে পাঠাচ্ছে। সৌভাগ্যের বিষয়, ওলন্দাজ জনসাধারণের খুব একটা নগণ্য অংশই বিপথে চালিত হয়েছে।

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ৩১ মার্চ, ১৯৪৪

আদরের কিটি,

ভাবো একবার, এখনও রীতিমত শীত, অথচ আজ প্রায় মাসখানেক হতে চলল বেশিরভাগ লোকেরই ঘরে কয়লা নেই–বড় আরাম, তাই না! রুশ রণাঙ্গনের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে লোকের আশাবাদ আবার চাগিয়ে উঠেছে, কেননা সেখানে দারুণ ব্যাপার ঘটছে। তুমি জানো, রাজনীতির বিষয়ে আমি বেশি কিছু লিখি না, কিন্তু তোমাকে এটুকু জানতেই হবে ওরা এখন কোথায় এসেছে; ওরা একদম পোল্যাণ্ডের সীমানায় এবং রুমানিয়ার কাছে থেকে পৌঁছে গেছে। একটু হাত বাড়ালেই ওডেসা। প্রতি সন্ধ্যায় এখানকার লোকেরা আশা করছে স্তালিনের কাছ থেকে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি এল বলে।

একটা করে জিৎ হয় আর মস্কোয় তোপ দেগে আনন্দধ্বনি করা হয়। এত বেশি তোপ দাগার ঘটনা ঘটছে যে, মস্কো শহর নিশ্চয় রোজ কড়াক্কড় কড়াকড় আওয়াজে কেপে সারা হচ্ছে। হয়ত ওরা ভাবছে যুদ্ধটা হাতের মধ্যে এসে গেছে, এই বলে মনকে চোখ ঠারতে কী মজা! কিংবা ওরা হয়ত আনন্দ প্রকাশের আর কোনো ভাষা জানে না। দুইয়ের কোনটা ঠিক আমি জানি না।

হাঙ্গেরি জার্মান সৈন্যদের দখলে। এখনও সেখানে লাখ দশেক ইহুদি আছে; সুতরাং ওরাও এবার টেরটি পাবে।

পেটার আর আমার বিষয় নিয়ে বকবকানি এখন খানিকটা কম। দুজনে এখন আমরা হলায়-গলায়, একসঙ্গে অনেকক্ষণ কাটে এবং দুনিয়ার হেন বিষয় নেই যা নিয়ে আমরা কথা বলি না। বিপদের জায়গায় এসে পড়লে অন্য ছেলেদের বেলায় যেটা হয়, পেটারের ক্ষেত্রে সেটা হয় না কখনই নিজের রাশ ধরে রাখার দরকার পড়ে না। এটা যে কী ভালো, কী। বলব। যেমন, আমরা রক্তের বিষয় নিয়ে কথা বলছিলাম, তাই থেকে আমরা ঋতুস্রাবের কথায় এসে গেলাম। পেটার মনে করে, আমরা মেয়েরা খুব শক্ত ধাতুতে গড়া। ব্যাপারখানা কী? এখানে এসে আমি ভালো আছি; অনেক ভালো। ঈশ্বর আমাকে একা ফেলে রেখে যাননি, একা ফেলে রেখে যাবেন না।

তোমার আনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *