০৭. আঁধারে আলো

যে সংবাদ লেস্ট্রেড জানাল সেটা এতই গুরুতর এবং অপ্রত্যাশিত যে আমরা তিনজনই প্রায় হতবাক হয়ে গেলাম। গ্রেগসন চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে অবশিষ্ট হুইস্কি ও জল ঢেলে ফেলল। তার ঠোঁট ঠোঁটের উপর চেপে বসেছে। দুই ভুরু চোখের উপর নেমে এসেছে।

‘স্ট্যাঙ্গারসনও!’ সে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘ষড়যন্ত্র ঘণীভুত হচ্ছে।’

একটা চেয়ার টেনে নিয়ে লেস্ট্রেড বলল, ‘আগেই যথেষ্ট ঘণ ছিল। আমার তো মনে হচ্ছে কোন সমর-পরিষদে ঢুকে পড়েছি।’

গ্রেগসন তো-তো করে বলে উঠল, ‘তুমি-তুমি নিশ্চিত জান খবরটা ঠিক?’

লেস্ট্রেড জবাব দিল, ‘এইমাত্র তার ঘর থেকে আমি আসছি। ঘটনাটা আমিই প্রথম আবিষ্কার করি।’

হোমস বলল, ‘এবিষয়ে গ্রেগসনের মত আমরা এতক্ষণ শুনছিলাম। তুমি কি দেখেছ বা করেছ, সেটা আমাদের জানাতে কোন আপত্তি আছে কি?’

চেয়ারে বসে লেস্ট্রেড জবাব দিল, ‘কোনই আপত্তি নেই। খোলাখুলিই স্বীকার করছি, আমি ভেবেছিলাম ড্রেবারের মৃত্যুর সঙ্গে স্ট্যাঙ্গারসন জড়িত। বর্তমান পরিণতি অবশ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে আমার সম্পূর্ণ ভুল হয়ে—ছিল। ঐ ধারণঅ নিয়েই আমি সচিবের খোঁজে বেরিয়ে ছিলাম। ওরা সন্ধ্যা সাড়ে আটটা নাগাদ তাদের দুজনকে ইউস্টন স্টেশনে দেখা গিয়েছিল। রাত দুটোয় ড্রেবারকে পাওয়া গেল ব্রিক্সটন রোডে। কাজেই আমার কাছে প্রশ্ন হল, ৮টা ৩০মিঃ থেকে ঘটনার সময় পর্যন্ত স্ট্যাঙ্গারসন কি করছিল  এবং তারপরেই বা সে কোথায় গেল—সেটা বের করা। লোকটির বিবরণ দিয়ে লিভারপুলে তার করে দিলাম।তাদের বলে দিলাম, মার্কিন নৌকাগুলোর উপর নজর রাখতে । তারপর ইউস্টনের কাছাকাছি সবগুলি হোটেলও লজিংহাউসে খোঁজ করলাম। দেখুন, আমি চিন্তা করলাম যে ড্রেবার এবং তার সঙ্গী যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, তাহলে তার সঙ্গী কাছাকাছি কোথাও রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে আবার স্টেশনে হাজির হবে—এটাই স্বাভাবিক।’

হোমস মন্তব্য করল, ‘আগে থেকেই একটা কোন সাক্ষাতের জায়গা হয়তো তারা স্থির করেছিল।’

‘তাই। গতকাল সারাটা সন্ধ্যা এই খোঁজেই কাটালাম। কিন্তু কোন ফল হল না। আজ খুব ভোরেই আবার আরম্ভ করলাম। আটটার সময় লিটল জর্জ স্ট্রীটের হ্যালিডেস প্রাইভেট হোটেলে পৌঁছলাম। মিঃ স্ট্যাঙ্গারসন সেখানে আছেন কিনা জানতে চাইলে তারা সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতিসূচক জবাব দিল।

তারা আরও বলল, নিশ্চয়ই আপনারই আসবার কথা ছিল। দুদিন যাবৎ তিনি একজন ভদ্রলোকের জন্য অপেক্ষা করে আছেন।’

‘তিনি কোথায় আছেন?’ আমি প্রশ্ন করলাম।

‘তিনি উপরতলায় শুয়ে আছেন। ন’টায় ডেকে দিতে বলেছেন।’

‘উপরে গিয়ে আমি এখনই তার সঙ্গে দেখা করব,’ আমি বললাম।

‘ভেবেছিলাম, আমি হঠাৎ উপস্থিত হলে তিনি ঘাবড়ে গিয়ে মুখ ফসকে কিছু বলে ফেলতেও পারেন। ঘর দেখিয়ে দেবার জন্য পরিচারক আমার সঙ্গে গেল। ঘরটা তিনতলায়, একটা ছোট করিডোর ধরে যেতে হয়। ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে পরিচারক নীচে নেমে যাচ্ছিল, ঠিক সেইসময়ে আমি কিছু দেখতে পেলাম যাতে বিশ বছরের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমার কেমন মাথা ঘুরে গেল। দরজার নীচ দিয়ে রক্তের একটা লাল ফিতা এঁকে বেঁকে এসে প্যাসেজটা পার হয়ে অপরদিকে দেওয়ালের নীচে বেশ খানিকটা জমে আছে। আমি চিৎকার করে উঠতে পরিচারকটি ফিরে এল। সব দেখে তারও মূর্চ্ছা যাবার উপক্রম। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। কিন্তু আমরাও কাঁধ লাগিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লাম। ঘরের জানালা খোলা, আর তারই নীচে নৈশ-পোশাক পরা একটি লোকের দেহ দলা পাকিয়ে পড়ে আছে। লোকটি মৃত। বেশ কিছুক্ষণ হল মারা গেছে, কারণ হাত-পাগুলো শক্ত এবং ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাকে উল্টে দিতেই পরিচারক চিনতে পারল, এই লোকটিই জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসন নামে ঘর ভাড়া নিয়েছেন। বাদিকে একটা গভীর ক্ষত হৃৎপিন্ড বিদীর্ণ করে ফেলেছে। তার ফলেই লোকটির মৃত্যু ঘটেছে। তারপরই আসছে এব্যাপারের সবচেয়ে বিস্ময়কর অংশ। নিহত লোকটির উপর কি ছিল আন্দাজ করুন তো।’

শার্লক হোমস উত্তর দেবার আগে আসন্ন বিভীষিকার কল্পনায় আমার শরীর শিরশির করে উঠল।

সে বলল, ‘রক্তের অক্ষরে লেখা ‘RACHE (রাসে) শব্দটি।’

আতংকগ্রস্ত গলায় লেস্ট্রেড বলল, ‘ঠিক তাই।’ কিছুক্ষণ সকলেই চুপ করে রইলাম।

এই অজ্ঞাত আততায়ীর ক্রিয়া-কলাপের মধ্যে এমন একটা শৃঙ্খলা অথচ দুর্বোধ্যতা আছে যাল ফলে তার অপরাধ আরও ভয়াবহ রুপ পরিগ্রহ করেছে। আমার যে স্নায়ু রণক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্ত ছিল, তাও যেন এই অপরাধের চিন্তায় শিরশির করতে লাগল।

লেস্ট্রেড বলতে লাগল ‘লোকটি চোখেও পড়েছিল। হোটেলের পিছনের আস্তাবল থেকে যে গলিটা চলে গেছে সেই পথ ধরে গোশালার দিকে যাচ্ছিল একটি গোয়ালা ছেলে। সে দেখতে পায়, ওখানে সাধারণত যে মইটা পড়ে থাকে সেটা তিনতলার একটা জানালার সঙ্গে লাগানো। জানালাটা খোলা। একটু এগিয়ে ফিরে তাকাতেই সে দেখতে পায় একটা মই বেয়ে নামছে। সে এত শান্তভাবে ও প্রকাশ্যে নেমে এল যে ছেলেটি ভাবল, লোকটি হয় তো ছুতোর বা হোটেলের কোন যোগানদার। সে আরও ভাবল, লোকটা এত সকালে কাজে এসেছে কেন। এ ছাড়া তার সম্পর্কে আর কিছুই তার মনে আসে নি। তার মোটামুটি মনে আছে যে লোকটি লম্বা, তার মুখ লালচে পরনে লম্বা বাদামী কোট। খুনের পরেও কিছুক্ষণ সে ওই ঘরে ছিল, কারণ বেসিনে রক্ত মেশানো জলের দাগ আমরা দেখতে পেয়েছি, সেখানে  সে নিশ্চয় হাত ধুয়েছে, আর চাদরে রক্তের দাগ, যাতে সে ইচ্ছা করে ছুরিটা মুছেছে।

খুনির বিবরণ শুনে আমি আড়-চোখে হোমসের দিকে তাকালাম, কারণ তার নিজের বিবরণের সঙ্গে এটা হুবুহু মিলে গেছে। তার মুখে কিন্তু উল্লাস বা সন্তুষ্টির চিহ্নমাত্র নেই।

সে প্রশ্ন করল ‘খুনিকে ধরবার সূত্র পাওয়া যায় এরুপ কোন কিছুই কি ঘরের মধ্যে দেখনি?’

‘কিচ্ছু না। ড্রেবারের টাকার থলিটা স্ট্যাঙ্গারসনের পকেটে ছিল। এটা তো খুবই স্বাভাবিক। কারণ দেনা-পাওনা সব সেই করত। তার মধ্যে আশি পাউন্ড ছিল, কিছুই খোয়া যায়নি। এইসব অসাধারণ অপরাধের উদ্দেশ্য আর যাই হোক ডাকাতি নয়। নিহত লোকটির পকেটে কোন কাগজপত্র বা স্মৃতি-লেখা ছিল না। শুধু ছিল একটা টেলিগ্রাম। ক্লিভল্যান্ডে এক মাস আগের তারিখ দেওয়া। তাতে লেখা, ‘জে, এইচ, ইওরোপে আছে।’নীচে কোন নাম লেখা নেই।’

‘আর কিছুই ছিল না?’ হোমস প্রশ্ন করল।

গুরুত্বপূর্ণ কিছুই না। লোকটি যে উপন্যাসখানা পড়তে পড়তে ঘুমিয়েছিল সেখানা বিছানার  উপর পড়েছিল । আর তার পাইপটা ছিল পাশেই চেয়ারের উপর। টেবিলের উপর এক গ্লাস জল ছিল, আর জানালার গোবরাটের উপর ছিল একটা টুকরো মলমের বাকস তাতে গোটা দু্ই বড়ি।’

আনন্দে চীৎকার করে শালক হোমস চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল।

‘শেষ সূত্র’,উল্লাসে চীৎকার করে সে বলল, এবার ‘আমার কেস সম্পূর্ণ হল।’

দুই গোয়েন্দা সবিস্ময়ে তারঁ ‍দিকে তাকিয়ে রইল। আমার সঙ্গী আত্ন-বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে লাগল,‘যে-সব সুতো মিলে এমন একটা জট পাকিয়েছিল, তার সবগুলোকে এখন  হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছি।যদিও কিছু কিছু টুকরো ঘটনা এখনও তার মধ্যে ঢোকাতে হবে, তথাপি স্টেশনে ড্রাইবার এবংস্ট্যাঙ্গারসন পরস্পর থেকে বিচ্চিন্ন হবার পর থেকে স্ট্যাঙ্গারসনের মৃতদেহ আবিষ্কার পযর্ন্ত সবগুলি প্রধার ঘটনা সম্পর্কে আমি এতই নিশ্চিত যেন সেগুলোকে আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার জ্ঞানের একটা প্রমাণ তোমাকে দিচ্ছি। সেই বড়িগুলো তোমার কাছে আছে কি?’

একটা ছোট সাদা বাক্স বের করে লেস্ট্রেড বলল,‘থানায় গিয়ে একটা নিরাপদ জায়গায় রাখবার জন্য মলমের বাক্স,টাকার থলি আর টেলিগ্রামখানা আমি নিয়ে এসেছি। কিছু না ভেবেই বড়িগুলো আমি নিয়ে এসেছি,কারণ সত্যি বলছি ওগুলোর উপর কোন গুরুত্বই আরোপ করছি না।

হোমস বলল, ‘ওগুলো আমাকে দাও দেখি।’তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ডাক্তার ,এগুলো কি সাধারণ বড়ি?’

সাধারণ মোটেই নয়। মুক্তোর মত রং, ছোট গোল, স্বচ্ছ। আমি বললাম,‘এগুলো এত হাল্কা এবং স্বচ্ছ যে জলে ফেললে গলে যাবে বলে মনে হয়।’

হোমস বলল, ঠিক তাই। দয়া করে নীচে গিয়ে টেরিয়ারটাকে নিয়ে আসবে কি?ওটা তো অনেকদিন থেকেই ভুগছে, আর গৃহকর্মীও তোমাকে কালই বলেছে ওটাকে সব যন্তণার হাত থেকে রেহাই দিতে।’

আমি নীচে গিয়ে কুকুরটাকে কোলে করে নিয়ে এলাম। তার শ্বাসকষ্ট আর ঝকঝকে চোখ দেখেই মনে হল, ওর শেষের দিন আর বেশী দেরী নেই। ওর বরফের মত সাদা নাকই ঘোষণা  করছে যে কুকুর –জীবনের আয়ুষ্কাল ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে। কম্বলের উপর একটা কুশনে ওটাকে রাখলাম।

‘এইবার একটা বড়িকে দুটুকরো করে কাটছি,’বলে হোমস একখানা কলমকাটা ছুরি বের করে কথামতকাজ করল। ‘ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য অর্ধেকটা বাক্রসেই রেকে দিলাম। বাকি অর্ধেকটা এক চামচ জল-ভরা এই মদের গ্লাসে ফেললাম। দেখ, আমার ডাক্তার বন্ধুটি ঠিকই বলেছ্। সঙ্গে সঙ্গে বড়িটা গলে গেল। ‘

কাউকে উপহাস করলে সে যেরকম আহত হয় সেই-রকম ক্ষূধ্ব গলায় লেস্ট্রেড বলল, ‘ব্যাপারটা দেখতে ভালই, কিন্তু জোসেফ স্ট্যাঙ্গারসনের মৃত্যুর সঙ্গে এর কি সর্ম্পক আমি তো বুঝতে পারছি না।’

‘র্ধৈয, বন্ধু, র্ধৈয! যথাসময়েই দেখতে পাবে সর্ম্পক খুবই ঘনিষ্ঠ। মিশ্রণটাকে স্বাদু করবার জন্য একটু দুধ মিশিয়ে কুকুরটার সামনে ধরলেই ও সবটা চেটে খেয়ে ফেলবে।’

বলতে বলতে সে মদের গ্লাসের মিশ্রণটা একটা পাত্রে ঢেলে টেরিয়ারটার সামনে ধরতেই সে চটপট সেটাকে খেয়ে ফেলল। র্শালক হোমসের এতাগ্রতা আমাদের ‍উপর এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে আমরা নিঃশব্দে বসে জন্তুটাকে দেখছিলাম আর বিস্ময়কর কোন ফলের প্রত্যাশা করছিলাম্। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটল না।কুকুরটা কুশনের উপর টান-টান হয়ে শ্বাস টানতে লাগল। কিন্তু ঐপানীয় পান করার ফলে তার মধ্যে ভাল বা মন্দ কোন লক্ষণই দেখা গেল না।

হোমস ঘড়ি বের করে দেখছে। মিনিটের পর মিনিট বিফলে কেটে যাচ্ছে। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ ও হতাশার ছায়া পড়ছে। সে ঠোঁট কামড়াচ্ছে, আঙুল দিয়ে টেবিলে টোকা দিচ্ছে, একে একে তীব্র অধৈর্যের সব লক্ষণই তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। সে এতই মুষড়ে পড়ছে। যে তার জন্য সত্যই আমার দুঃখ হচ্ছিল। কিন্তু সে যে শেষ পর্যন্ত একটা ধাক্কা খেয়েছে তাতে গোয়েন্দা-যুগল অখুশি তো নয়ই বরং মিটি-মিটি হাসছে।

অবশেষে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে ঘরময় দ্রুতবেগে পায়চারি করতে করতে সে বলে উঠল, ‘এটা আকস্মিক যোগাযোগ হতে পারে না। আকস্মিক যোগাযোগ হওয়া অসম্ভব। ড্রেবারের ক্ষেত্রে যে বাড়ির সন্দেহ আমি করে—ছিলাম, স্ট্যাঙ্গারসনের মৃত্যু পরে সেই একই বাড়ি পাওয়া গেছে। অথচ ওগুলো তো জড় পদার্থ। এর কি অর্থ হতে পারে। আমার যুক্তি-শৃঙ্খলটা আগাগোড়াই ভ্রান্ত হতে পারে না। অসম্ভব! অথচ এই হতভাগ্য কুকুরটার কিছুই ছিল হল না। ও হো, পেয়েছি! পেয়েছি! আনন্দে চীৎকার করে উঠে সে বাক্সটার কাছে ছুটে গেল, অন্য একটি বাড়ি কেটে জলে গুলে দুধে মেশাল। টেরিয়ারটার সামনে ধরতেই হতভাগ্য জন্তুটা সেই পানীয়ে ঠোঁট ভেজাতে না ভেজাতেই তার সারা দেহটা থরু থর করে কেঁপে উঠেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত নির্জ্জীব হয়ে গেল।

শার্লক হোমস একটা লম্বা নিঃস্বাস ফেলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ‘নিজের উপরে আরও বিশ্বাস রাখা  উচিত ছিল। একটা বিশেষ ঘটনা যদি একটা র্দীঘ অনুমান-শৃংখলের বিরোধী হয়, তাহলে সে ঘটনাটির অন্য কোন ব্যাখ্যা যে অবশ্যই পাওয়া যাবে—এতদিনেও সেটা অন্তত আমার জানা উচিত। ঐ বাক্সের দুটো বড়ির একটা ছিল মারাত্মক বিষ, অন্যটা ছিল সম্পূর্ণ অক্ষতিকর। বাক্সটা দেখবার আগেই এটা আমার বোঝা উচিত ছিল।’

এই সর্বশেষ বক্তব্যটি এতই চাঞ্চল্যকর যে তার বুদ্ধি-শুদ্ধি ঠিক আছে কিনা সেবিষয়ে সন্দেহ হতে লাগল। অবশ্য মৃত কুকুরটা প্রমাণ করছে যে তার অনুমানই যথার্থ, আমার মনের কুয়াসাও যেন ক্রমেই কেটে যাচ্ছে। আমি যেন সত্যের একটা অস্পষ্ট অনুভূতি লাভ করেছি।

হোমস বলতে লাগল, ‘এইসব তোমাদের কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে, কারণ তদন্তের একেবারে শুরুতেই যে একমাত্র প্রকৃত সূত্রটি তোমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছিল তার গুরুত্ব তোমরা বুঝতে পারনি। সৌভাগ্যবশত সেটাকে আমি ধরতে পেরেছিলাম, এবং তারপর থেকে যা কিছু ঘটেছে সবই আমার মূল ধারণাকে সমর্থন তো সে করেছেই, বরং সে সবই তার ন্যায়সঙ্গত পরিণতি। কাজেই যেসব ব্যাপার তোমাদের বিচলিত করেছে এবং কেসটাকে আরও জটিল করে তুলেছে, সেগুলিই আমাকে দেখিয়েছে আলো, আমার সিদ্ধান্তকে করেছে দৃঢ়তর। বিস্ময়করতাকে রহস্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা একটা মস্ত বড় ভুল। সবচাইতে সাধারণ অপরাধই প্রায়শঃ সবচাইতে রহস্যময় হয়ে থাকে, কারণ তাতে এমন কোন নতুন বা বিশেষ লক্ষণ থাকে না যার থেকে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এক্ষেত্রেও মৃতের দেহটা যদি রাস্তায় পাওয়া যেত, যে সমস্ত ভয়ংকর ও উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা-সমাবেশ সমস্ত ব্যাপারটাকে উল্লেখযোগ্য করে তুলেছে সেসব কিছুই যদি না থাকত, তাহলে এই খুনের রহস্যভেদ করা আরও অনেক বেশী কষ্টসাধ্য হত। এই সব বিস্ময়কর ঘটনার সমাবেশ কেসটাকে কষ্টসাধ্য করার বদলে বরং সহজসাধ্য করে তুলেছে।’

মিঃ গ্রেগসন যথেষ্ট ধৈর্যসহকারে এই ভাষণ শুনছিল। কিন্তু আর সে নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। বলে উঠল, ‘দেখুন মিঃ র্শালক হোমস, আমরা সকলেই স্বীকার করছি যে আপনি খুব চতুর লোক, আপনার কাজের একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। কিন্তু এখন আমরা শুধু থিওরি আর ভাষণের চাইতেও বেশী কিছু চাই। কথা হচ্ছে, আসল লোকটি কে। আমার কথা বলেছি। দেখছি, আমার ভুল হয়েছিল। যুবক চার্পেণ্টিয়ার দ্বিতীয় ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না। লেস্ট্রেড ছুটেছিল স্ট্যাঙ্গারসনের পিছনে। দেখা যাচ্ছে, তারও ভুল হয়েছিল। আপনি এখানে কিছু ইঙ্গিত করেছেন, ওখানে কিছু ইঙ্গিত করেছেন, মনে হচ্ছে, আমাদের চাইতে বেশিই আপনি জানেন। কিন্তু এখন আমরা সরাসরি জানতে চাই, এ বিষয়ে আপনি কতটা জানেন। এ কাজ কে করেছে তার নাম কি আপনি বলতে পারেন?’

লেস্ট্রেড বলল, ‘আমারও অভিমত যে গ্রেগসন ঠিকেই বলেছে স্যার।’ আমরা দুজনই চেষ্টা করে বিফল হয়েছি। আমি ঘরে ঢুকবার পরে আপনি একাধিকবার বলেছেন যে আপনি সেগুলি আর চেপে রাখবেন না’

আমি বললাম, ‘আততায়ীর গ্রেপ্তার বিলম্বিত হলে সে নতুন কোন দুষ্কর্মের সুযোগ পেতে পারে।’

এইভাবে সকলে চেপে ধরায় হোমস অস্থিরভাবে ঘরের এদিক-ওদিক হাঁটটে লাগল। মাথাটা বুকের উপর ঝুঁকে পড়েছে, ভুরু দুটো নেমে এসেছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেই তার এরকম হয়।

হঠাৎ থেমে আমাদের সামনে এসে সে বলে উঠল, ‘আর খুন হবে না। সে সম্ভাবনা একেবারেই বাতিল করে দিতে পার। তোমরা জানতে চেয়ছ, হত্যাকারীর নাম আমি জানি কি না। জানি। শুধু নাম জানাটা কিছু নয়, আসল কথা হচ্ছে তাকে পাকড়াও করা। আশা করছি অতি শীঘ্রেই সেটা পারব। যথেষ্ট আশা আছে যে আমার নিজের ব্যবস্থাপনায়ই সেটা সম্পন্ন হবে। কিন্তু খুব সর্তকতার সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে, কারণ একটি খুব সুচতুর ও বেপরোয়া লোকের সঙ্গে আমাদের যুঝতে হবে, এবং আমি প্রমাণ পেয়েছি যে তার এমন একজন সঙ্গী আছে যে তার মতই চতুর। কেউ তার খোঁজ পেয়েছে এটা যতক্ষণ সে না জানতে পারবে ততক্ষণই তাকে পাকড়াও করবার কিছুটা সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তিলমাত্র সন্দেহ বোধ করলেই সে নাম পাল্টে এই মহানগরীর চল্লিশ লক্ষ লোকের মধ্যে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যাবে। আপনাদের মনে কোনরকম আঘাত দেবার ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু একথা বলতে আমি বাধ্য যে দুটি লোকের মহড়া নেবার সামর্ত্য সরকারী পুলিশ বাহিনীর নেই, আর সেইজন্যই আপনাদের সহায়তা আমি চাই নি। আমি বিফলকাম হলে অবশ্য আপনাদের বাদ দেওয়ার দায়ভাগ আমাকে বহন করতে হবে। আর সেজন্য আমি প্রস্তুতও আছি। বর্তমানে আমি এই প্রতিশ্রুতি ‍দিচ্ছি যে আমার ব্যবস্থাকে বিপন্ন না করে যখনই আপনাদের সব কথা জানান সম্ভব হবে সেই মূহুর্তেই তা জানিয়ে দেব।’

এই প্রতিশ্রুতিতে বা গোয়েন্দা পুলিশ সম্পর্কে নিন্দাসূচক উল্লেখে গ্রেগসন বা লেস্ট্রেড কাউকেই সন্তুষ্ট মনে হল না। গ্রেগসনের মুখ, তার হলদে চুলের গোড়া পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল, আর লেস্ট্রেডের ক্ষুদে চোখ দুটি কৌতুহলে ও ক্ষোভে চকচক করতে লাগল। কেউ কোন কথা বলবার আগেই দরজায় একটা  টোকা পড়ল এবং বাউন্ডুলে ছেলেদের দলপতি উইগিন্স ঘরে ঢুকল।

মাথার সামনেকার চুলে হাত রেখে সে বলল, ‘স্যার, নীচে গাড়িখানা রেখেছি।’

হোমস বলল, ‘লক্ষ্মী ছেলে।’ টেবিলের টানা থেকে একজোড়া স্টীলের হাত-কড়া বের করে সে আর বলল, ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে এই ব্যবস্থাটা চালু কর না কেন? দেখ না, এর স্প্রিংটা কী সুন্দর কাজ করবে। মুহূর্তের মধ্যে আটকে ধরবে।’

লেস্ট্রেড মন্তব্য করল, ‘হাত-কড়া’ পরাবার লোকটিকে খুঁজে বের করতে পারলে পুরনো ব্যবস্থাও মন্দ কাজ করবে না।”

হোমস হেসে বলল, ‘খুব ভাল, খুব ভাল। গাড়োয়ান আমার বাক্সগুলো নামাতে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। উইগিন্স, তাকে উপরে আসতে বল।’

আমার সঙ্গী এমনভাবে কথা বলল যেন সে কোথাও ভ্রমণে বের হবে। এতে আমি বিস্মিত হলাম, কারণ এ সম্পর্কে সে তো আমাকে কিছুই বলে নি। ঘরের মধ্যে একটা ছোট পোর্টম্যান্টো ছিল। সেটাকে টেনে বের করে সে তাতে পটি আটকাতে লাগল। সেই সময় গাড়োয়ান ঘরে ঢুকল

সে তখন হাঁটু ভেঙে বসে পটি আঁটছিল। মুখ না ঘুরিয়ে বলল, ‘গাড়োয়ান, এই বকলসটা আটতে একটু সাহায্য কর তো।’

রুষ্ট, উদ্ধত ভঙ্গীতে এগিয়ে গিয়ে লোকটি কাজে হাত লাগাল। ঠিক সেই মুহূর্তে ক্লিক করে একটা শব্দ হল, ধাতুর কর্কশ আওয়াজ শোনা গেল এবং শার্লক হোমস লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

‘ভদ্রমহোদয়গণ’ ঝকঝকে চোখ মেলে সে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ‘মিঃ জেফারসন হোপের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দি,–ইনিই এনক ড্রেবার এবং জোসেফ স্যাঙ্গারসনের হত্যাকারী।’

মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত ব্যাপারটা ঘটে গেল। এতদ্রুত ঘটল যে কোন কিছু বুঝবার সময়ই পেলাম না। সেই মুহূতের স্মৃতি এখনও আমার মনে স্পষ্ট হয়ে আছে। হোমসের সগৌরব ঘোষণা, তার কন্ঠস্বর, গাড়োয়ানের বিহ্বল বিকৃত মুখ, ইন্দ্রজালের মত তার কণ্ঠস্বর, গাড়োয়ারনের বিহ্বল বিকৃত মুখ, ইন্দ্রজালের মত তার কজ্বিতে আটকে থাকা চকচকে হাত-কড়ার প্রতি তার চোখের দৃষ্টি-সব। দু’এক সেকেন্ডের মত আমরা সবাই যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়েছিলাম। তারপরই একটা ক্রুদ্ধ দুর্বোধ্য গর্জন করে বন্দী হোমসের মুঠো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জানালার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। তার ধাক্কায় কাঠের ফ্রেম ও কাঁচ ভেঙে গেল। কিন্তু সে সম্পূর্ণ  বেরিয়ে যাবার আগেই গ্রেগসন, লেস্ট্রেড এবং হোমস শিকারী কুকুরের মত তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে টেনে আনা হল ঘরের মধ্যে। তারপর শুরু হল এক প্রচন্ড সংঘর্ষ। লোকটি এতই শক্তিশালী ও হিংস্র যে আমাদের চারজনকে সে বারবার ছিটকে ফেলে দিতে লাগল। মনে হচ্ছিল সে যেন মুগীরোগক্রান্ত রুগীর মত অমিত বলশালী । কাঁচের ভিতর দিয়ে বের হবার চেষ্টার তার মুখ এবং হাত ভয়ংকর ভাবে কেটে গেছে। কিন্তু সে রক্তক্ষয়ের ফলে তার প্রতিরোধশক্তি হ্রাস পায় নি। একসময়ে লেস্ট্রেড যখন তার গলা-বন্ধনীর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তার গলায় ফাঁস আটকাবার উদ্যেগ করে ফেলল, তখন সে বুঝতে পারল আর লড়াই করে কোন লাভ নেই। তৎসত্ত্বেও যতক্ষণ তার হাত আর পা কসে একসঙ্গে বাঁধা না হল ততক্ষণ আমরা নিরাপদ বোধ করছিলাম না। সেটা হয়ে গেলে আমরা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ালাম।

শার্লক হোমস বলল, ‘ওর গাড়িটা আছে। তাতে চড়িয়েই ওকে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া যাবে।’ তারপর স্মিত হেসে সে বলল, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের  এই ছোট্ট রহস্যের সমাপ্তি ঘটল। এইবার আপনাদের যদি কোন প্রশ্ন থাকে আমাকে জানান। এখন আর এমন কোন বিপদ নেই যার জন্য আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অস্বীকার করব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *