০৬-১০. শূন্যের ভেতর দিয়ে পড়ছি

০৬.

শূন্যের ভেতর দিয়ে পড়ছি। এখনও সম্পূর্ণ সচেতন আমি। যে কোনো মুহূর্তে কঠিন কিছুর ওপর আছড়ে পড়বে আমার দেহ। তারপর সব শেষ!

ঝপাং! কেন ঝপাং কেন? শব্দ তো হওয়ার কথা ধপ্ বা ধুপ! কি আশ্চর্য! আমি এখনও বেঁচে আছি! কি করে তা সম্ভব?

একটাই উত্তর, পানিতে পড়েছি।

হ্যাঁ, তাই। পানিতে পড়েছি আমি। বরফের মতো ঠাণ্ডা পানি চারপাশ থেকে পেঁচিয়ে ধরেছে। আর আমি ক্রমশ নিচে চলে যাচ্ছি। আরও নিচে, আরও নিচে। মনে হলো আর কখনোই বোধহয় উঠতে পারবো না এই অতল পানির তল থেকে। কিন্তু না, পারলাম শেষ পর্যন্ত। বাতাসের অভাবে ফুসফুস যখন ফেটে যাবে ঠিক তার আগের মুহূর্তে পানির ওপর ভেসে উঠলো আমার মাথা।

ওহ! সে মুহূর্তের আনন্দ আমি কি করে প্রকাশ করবো? নিশ্চিত মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এলে মানুষের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? কিন্তু-কিন্তু, লিও কোথায়? আমি যেমন বেঁচে গেছি ওর-ও তো তেমনি বেঁচে যাওয়ার কথা! পা দিয়ে পানি কাটতে কাটতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম চারদিকে।

মাত্র দশ গজ দূরে দেখতে পেলাম লিওকে। ওর সোনালি চুল আর দাড়ি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বেঁচে আছে লিও! কি অপার স্বস্তি যে অনুভব করলাম বুকের ভেতর! ও-ও আমাকে দেখেছে। হাঁ হয়ে গেছে ধূসর চোখ দুটো। এক্ষুণি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে যেন।

দুজনই তাহলে বেঁচে আছি এখনও! উৎফুল্ল কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো ও। খাদ উধাও! বলেছিলাম না, অদৃশ্য শক্তি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের।

হ্যাঁ, কিন্তু কোথায়? বললাম আমি। তারপরেই সচেতন হলাম, আমরা একা নই। নদীর পাড়ে, আমাদের গজ তিরিশেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে দুটো মূর্তি একজন পুরুষ, লম্বা একটা লাঠিতে ভর দিয়ে ঝুঁকে আছে সামনের দিকে, আর এক রমণী। লোকটা বৃদ্ধ, অত্যন্ত বৃদ্ধ, তুষারের মতো সাদা চুল দাড়ি নেমে এসেছে কাঁধ আর বুকের ওপর। ছোট খাটো কুঁজো দেহটা মোমের মতো হলুদ। সন্ন্যাসীদের মতো দীর্ঘ আলখাল্লা পরনে। লাঠিতে ভর দিয়ে মূর্তির মত অনড় দাঁড়িয়ে আছে সে। আমাদের দেখছে। রমণী দীর্ঘদেহী। হাত উঁচিয়ে ইশারা করছে আমাদের দিকে।

এখন আমরা যেখানে আছি সেখানে নদী মোটামুটি শান্ত। অথচ তীরের কাছাকাছি মনে হচ্ছে স্রোত খুব বেশি। আন্দাজ করলাম নদী তলের অস্বাভাবিক গঠনের কারণে এমনটা হচ্ছে। দুজনে খুব কাছাকাছি থেকে পাড়ের দিকে সাঁতরাতে শুরু করলাম আমরা, যেন প্রয়োজন হলে একে অপরকে সাহায্য করতে পারি। সামান্য কয়েক গজ যাওয়ার পরই বুঝতে পারলাম প্রয়োজনটা কি প্রচণ্ড। তীরের কাছাকাছি স্রোত বেশি বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু এতটা যে, কল্পনা করিনি। বন্যার তোড়ের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো আমাদের।

লিও চিৎকার করে উঠলো, রশিটা ধরো, আমি ডুব দিচ্ছি।

ওর কোমরে বাঁধা দড়িটা খপ করে ধরলাম আমি। প্রাণপণ চেষ্টায় ডুব সাঁতার দিয়ে তীরের দিকে যেতে লাগলো লিও। আমিও ডুব দিয়েছি। এক হাতে যতটা সম্ভব জল কেটে এগোনোর চেষ্টা করছি। কিন্তু বেশিক্ষণ সুবিধা করতে পারলাম না। আমাদের গায়ের কাপড় ভিজে ভারি হয়ে উঠেছে। সীসার মতো টানছে নিচের দিকে। সেই সাথে ভয়ানক বেগে ভেসে চলেছি স্রোতের টানে।

দম শেষ হয়ে যেতেই ভেঙে উঠতে বাধ্য হলাম আমরা। একেবারে হতাশাজনক মনে হলো না পরিস্থিতি। বেশ খানিকটা চলে এসেছি তীরের দিকে। এমন সময় অবাক হয়ে দেখলাম সেই থুত্থুরে বুড়ো আশ্চর্য দ্রুত ছুটে এলো পাড়ের একেবারে কিনারে। তার দীর্ঘ লাঠিটা বাড়িয়ে ধরলো আমাদের দিকে।

সর্বশক্তিতে চেষ্টা চালালো লিও। ধরে ফেলতে পারলো লাঠির এক প্রান্ত। মুহূর্তে মন্দীভূত হয়ে এলো আমাদের গতি। শ্বাস নিলাম লম্বা করে। এক হাতে লাঠি, অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে বৃদ্ধ আমার দিকে। এমন সময় আবার দুর্ভাগ্য। মট করে ভেঙে গেল লাঠিটা। স্রোতের প্রবল টান অনুভব করলাম শরীরে। বৃদ্ধের হাত ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি। ধরতে পারলাম না। মুহূর্তের জন্যে দুটো হাত ছোঁয়াছুঁয়ি হলো শুধু। এই সময় অদ্ভুত এক কাজ করলো রমণী। ইতিমধ্যে সে-ও এসে দাঁড়িয়েছে বৃদ্ধের পাশে। লাঠিটা ভেঙে যেতেই ঝাঁপিয়ে পানিতে নেমে এলো সে। বিদ্যুৎগতিতে হাত বাড়িয়ে এক হাতে ধরে ফেললো লিওর চুল, অন্য হাতে আঁকড়ে ধরলো বৃদ্ধের একটা বাহুঁ। এই সময় ক্ষণিকের জন্যে পায়ের নিচে মাটি পেলো লিও। সঙ্গে সঙ্গে ও হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললো মেয়েটার ক্ষীণ কটি, অন্য হাতে আমাকে। তারপর কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি। অবশেষে তীরে উঠলাম আমরা। মাটিতে শুয়ে পড়ে হাপাতে লাগলাম হাপরের মতো।

শ্বাস-প্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হতে মুখ তুলে তাকালাম আমি। দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। কাপড় থেকে পানি ঝরে পড়ছে টপ টপ করে। লিওর দিকে তাকিয়ে আছে সে। চোখে স্বপ্নাচ্ছন্নের দৃষ্টি। কপালের কোনায় একটা কাটা দাগ, একটু আগে ধস্তাধস্তির সময় হয়েছে। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে তা থেকে। তবু তার সৌন্দর্য আমার চোখ কাড়লো। সংবিৎ ফিরলো মেয়েটার। চকিতে একবার তাকাল তার ভরাট শরীরের সাথে সেঁটে থাকা পোশাকের দিকে। সঙ্গীকে কি যেন বলে দ্রুত ছুটে চলে গেল একটা পাহাড়ের আড়ালে।

আমরা শুয়ে আছি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। পাশে বসে আছে বৃদ্ধ। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো সে। ভাষাহীন দৃষ্টি আমাদের ওপর নিবদ্ধ। মৃদু স্বরে কিছু বললো। ভাষাটা বুঝতে পারলাম না আমরা। এরপর অন্য একটা ভাষায় কথা বললো সে। এবারও তা দুর্বোধ্য শোনালো আমাদের কানে। তৃতীয়বার চেষ্টা করলো বৃদ্ধ। সাথে সাথে কান খাড়া হয়ে উঠল আমাদের। গ্রীক! হ্যাঁ, মধ্য এশিয়ার এক অজ এলাকায় গ্রীক-এ কথা বলছে অশীতিপর এক বৃদ্ধ! খুব বিশুদ্ধ নয় যদিও, তবু গ্রীক।

তোমরা কি যাদুকর? বললো সে, জ্যান্ত পৌঁছেছে এদেশে!

না, জবাব দিলাম আমি, একই ভাষায়। তা-ই যদি হতো তাহলে অন্য রাস্তায় আসতাম।

প্রাচীন ভাষাটা জানে ওরা! পাহাড়ের ওপর থেকে যা বলে দেয়া হয়েছে তার সাথে মিলে যাচ্ছে! নিজের মনে বিড়বিড় করলো বৃদ্ধ। তারপর জিজ্ঞেস করলো–

কি চাও তোমরা, বিদেশী?

সাথে সাথে কোনো জবাব দিলাম না আমি। ভাবছি কি বলবো সত্যি কথা বললে যদি আবার ঠেলে ফেলে দেয় ঐ ভয়ঙ্কর নদীতে! কিন্তু লিও অত ভাবনা চিন্তার ধার ধারলো না।

আমরা খুঁজছি, সরাসরি বললো ও। আমরা খুঁজছি অগ্নি-পর্বত, যার চূড়া জীবনের প্রতীক দিয়ে শোভিত।

নিষ্পলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো লোকটা। তার মানে তোমরা জানো! কাকে চাও ওখানে?

উঠে বসলো লিও। ঝাঁঝের সঙ্গে জবাব দিলো, রানীকে। 

আমার ধারণা পূজারিণী বা দেবী বোঝাতে চেয়েছে লিও, কিন্তু গ্রীক-এ রানী ছাড়া আর কোনো শব্দ আসেনি ওর মাথায়।

ও! তোমরা একজন রানীকে খুঁজছে…তারমানে তোমাদের ওপর নজর রাখার জন্যেই আমাদের পাঠানো হয়েছে! না,..কি করে আমি নিশ্চিত হবো?

এটা একটা জিজ্ঞাসাবাদের সময় হলো? রেগে গেলাম আমি। আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন: আপনি কে?

আমি? শোনো বিদেশীরা, আমার পদবী হলো তোরণের অভিভাবক, আর আমার সাথে যে মহিলাকে দেখলে সে হচ্ছে কালুন-এর খানিয়া।

এই সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠল লিওর। টলে উঠে পড়ে যেতে লাগলো। লাফিয়ে উঠে ধরলাম আমি ওকে।

লোকটা দেখি অসুস্থ! ব্যস্ত কণ্ঠে বলল বৃদ্ধ। চলো চলো, এক্ষুণি আশ্রয় দরকার তোমাদের।

দুপাশ থেকে দুজন ধরে আস্তে আস্তে হাঁটিয়ে নিয়ে চললাম লিওকে। নদীর পাড়ে সামান্য একটু ফাঁকা জায়গা। তারপর পাহাড়ী এলাকা। সরু আঁকাবাঁকা একটা গিরিপথ চলে গেছে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। সেই পথে চলতে লাগলাম আমরা।

গিরিপথ যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই এক বনের শুরু। বন পেরিয়ে দেখতে পেলাম তোরণটা। খুব দুর্বল লাগছে বলে ভালো করে খেয়াল করতে পারলাম না ওটা। শুধু মনে আছে, দুদিকে বিস্তৃত বিরাট এক পাথুরে দেয়ালের মাঝখানে একটা গর্ত। তার ভেতর দিয়ে চলে গেছে পথ। এই গর্তের এক পাশে একটা সিঁড়ি। প্রায় অচেতন লিওকে নিয়ে অতিকষ্টে সিঁড়ির প্রথম ধাপটা উঠলাম। তারপর পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে একটা পুটুলির মতো বসে পড়লো লিও।

কি করা যায় ভাবছি এমন সময় পদশব্দ শুনে ওপর দিকে তাকালাম। দেখলাম সেই রমণী সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। তার পেছনে ঢিলে ঢালা পোশাক পরা দুজন মানুষ। আকর্ষণীয় কিন্তু ভাবলেশহীন চেহারা তাদের। হলদেটে ত্বক, ছোট ছোট চোখ। আমাদের দেখে বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হলো না তারা, যেন জানাই ছিলো আমরা আসবো। ওদের দিকে তাকিয়ে কিছু বললো মহিলা। লিওর ভারি দেহটা তুলে নিলো তারা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল ওপরে।

অনুসরণ করে একটা কামরায় পৌঁছুলাম আমরা। তোরণের ওপরে পাথর খোদাই করে তৈরি ঘরটা। এখানে আমাদের রেখে চলে গেল খানিয়া নামের সেই রমণী। এই কামরা থেকে আরও কয়েকটা ঘরের ভেতর দিয়ে গিয়ে অন্য একটা কক্ষে পৌঁছুলাম। দেখে মনে হলো শোয়ার ঘর। দুটো কাঠের খাট পাতা। ওপরে জাজিম, কম্বল, বালিশ। একটা খাটে শুইয়ে দেয়া হল লিওকে। বৃদ্ধ অভিভাবক ভৃত্যদের একজনের সহযোগিতায় ওর সব কাপড়-চোপড় খুলে ফেললো, আমাকেও ইশারায় বললো আমারগুলো খুলে ফেলতে। তারপর শিস বাজালো একবার।

অন্য এক ভৃত্য পাত্রভর্তি গরম পানি নিয়ে এলো। ভালো করে রগড়ে গা ধুয়ে ফেললাম আমি। লিওকে ধুইয়ে দিলো বৃদ্ধ নিজে। তারপর এক ধরনের মলম লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিলো আমাদের ক্ষতগুলোয়। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। লিওকেও কম্বল চাপা দেয়া হল। এরপর খাওয়ার জন্যে সুরুয়া মতো এক ধরনের জিনিস এলো। বৃদ্ধ ওষুধ মেশালো তাতে। অর্ধেক একটা বাটিতে ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে দিলো, বাকিটা লিওর মাথা হাঁটুর ওপর নিয়ে ওর গলায় ঢেলে দিলো সে। মুহূর্তে অদ্ভুত এক উষ্ণতা বয়ে গেল আমার শরীর বেয়ে। যন্ত্রণাকাতর মস্তিষ্কটা হালকা হয়ে যেতে লাগলো। তারপর আর কিছু মনে নেই।

একটানা কয়েক সপ্তাহ কাটলো কখনও অচেতন, কখনও অর্ধচেতন ভাবে। সম্পূর্ণ সচেতন একবারও হইনি এই সময়ে। যে সময়গুলোয় অর্ধচেতন ছিলাম তখনকার স্মৃতি কিছু কিছু মনে আছে। এছাড়া আর সব শূন্য, অন্ধকার।

একদিনের কথা একটু একটু মনে পড়ে। হলদে মুখো সেই বুড়ো বুকে আছে আমার ওপর, জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার মুখে। সাদা চুল দাড়িতে অশরীরী আত্মার মতো লাগছে তাকে। তীক্ষ্ণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে, আমার মনে যত গোপন কথা সবুয়েন জেনে নেবে।

এরাই সেই লোক, বিড়বিড় করে বললো সে। কোনো সন্দেহ নেই, এরাই। তারপর জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আকুল নয়নে তাকিয়ে রইলো। আকাশের দিকে।

আরেক দিনের কথা মনে আছে, নারীকণ্ঠের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল আমার—সেই আগের মতো ঘুম ভাঙা, তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব, যেন স্বপ্ন দেখছি। চোখ মেলে দেখলাম আমাদের বাঁচিয়েছিলো যে, সেই রমণী। ভারি একটা আলখাল্লা পরনে, দাঁড়িয়ে আছে আমার পাশে। আমার মুখের দিকে তাকালো। বিতৃষ্ণায় কুঁচকে উঠলো তার ভুরু। মুখ ফিরিয়ে অভিভাবককে কি যেন বললো। সম্ভবত আমার কুৎসিত চেহারার কথা। তারপর লঘু পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো লিওর বিছানার পাশে। খটখটে একটা কাঠের টুল টেনে বসলো। ভয়ঙ্কর একাগ্রতায় তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।

অনেক, অনেকক্ষণ দেখলো সে লিওকে। তারপর উঠে পায়চারি করতে লাগল কামরার এমাথা ওমাথা। হাত দুটো ভাজ করে রাখা বুকের ওপর, কুঁচকে আছে ভূদুটো, মুখে তীব্র এক আকুতি; যেন কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছে, পারছে না।

কোথায়, কখন? নিজের মনে ফিসফিস করলো সে। ওহ! কোথায়, কবে?

এই দৃশ্যের শেষে কি ঘটেছিলো জানে না। কারণ আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি।

আবার, কঘণ্টা বা কত দিন পরে জানি না, একটু সজাগ হলাম আমি। তখন রাত। শুধু মাত্র চাঁদের আলোয় সামান্য আলোকিত ঘরটা। লিওর বিছানায় সরাসরি পড়েছে আলো। সেই আলোয় দেখলাম, বিছানার পাশে বসে আছে মেয়েটা। তাকিয়ে আছে লিওর মুখের দিকে।

অনেকক্ষণ কেটে গেল এভাবে। ও দেখছে লিওকে, আমি দেখছি ওকে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি আমার বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো মেয়েটা। ঘুমের ভান করে চোখ বুজে ফেললাম আমি।

সম্পূর্ণ সজ্ঞান না হলেও কৌতূহল জেগেছে আমার মনে। কে এই নারী, তোরণের অভিভাবক যাকে বলেছে কালুন-এর খানিয়া? আমরা যাকে খুঁজছি এ-কি সে-ই? কেন নয়? কিন্তু…আয়শাকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তো চিনতে পারার কথা ছিলো আমাদের। ওর সেই মুখ কি ভোলা যায়?

আবার লিওর বিছানার কাছে চলে গেল সে। হাঁটু গেড়ে বসলো। আগের মতোই অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো ওর মুখের দিকে। নিঃশব্দে কেটে গেল কিছুক্ষণ। তারপর সে কথা বলতে শুরু করলো। খুব নিচু স্বরে, মঙ্গোলিয়ানের মিশেল দেয়া গ্রীকে।

আমার স্বপ্নের পুরুষ, ফিসফিস করে বললো সে। কোত্থেকে এসেছো? কে তুমি? হেসা কেন আমাকে আদেশ দিলো তোমার সাথে দেখা করার? এর পরের কয়েকটা বাক্য আমি বুঝতে পারলাম না। তারপর আবার, তুমি ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের ভেতর তোমার চোখ খুলে গেছে। আমার কথার জবাব দাও, আমি জানতে চাইছি, তোমার আর আমার মাঝে কিসের বন্ধন? কেন আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি? কেন তোমাকে আমার চেনা চেনা মনে হয়। কেন? মিষ্টি কণ্ঠস্বরটা মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে।

ঝুঁকে পড়ল সে লিওর ওপর। এক গুচ্ছ চুল মূল্যবান মণিখচিত ফিতের বাঁধনচ্যুত হয়ে পড়ল ওর মুখে। জেগে উঠলো লিও। আমি যেমন জেগে, আধো ঘুম আধো জাগরণ, তেমন। ও হাত বাড়িয়ে ছুঁলো চুলের গোছাটা। তারপর ইংরেজিতে বললো–কোথায় আমি? ও, মনে পড়েছে, ওঠার চেষ্টা করতেই রমণীর চোখে চোখ পড়লো ওর। তখন আবার গ্রীকে বললো, তুমিই তো আমাকে খরস্রোতা নদী থেকে বাঁচিয়েছিলে। বলো, তুমিই কি সেই রানী যাকে আমি এদিন ধরে খুঁজছি?

জানি না, কাঁপা কাঁপা মৃদু মিষ্টি স্বরে জবাব দিল রমণী। এটুকু জানি, আমিও রানী-অবশ্য খানিয়াকে যদি রানী বলা যায়।

তাহলে বলো, রানী, আমাকে মনে আছে তোমার?

স্বপ্নে আমাদের দেখা হয়েছিলো, সে বললো, আমার মনে হয় দূর অতীতে কোনো এক সময় আমাদের দেখা হয়েছিলো। হা, নদীর কূলে যখন প্রথম তোমাকে দেখি, তখনই জেনেছিলাম-বিদেশী, অপরিচিত কিন্তু মুখটা চেনা চেনা লাগছিলো। বলো, তোমার নাম কি?

লিও ভিসি।

মাথা নাড়ল রমণী। না, এ নাম তো আমার পরিচিত নয়, তবু আমি তোমাকে চিনি।

তুমি আমাকে চেনো? কেমন করে? ভারি, জড়িত গলায় বলেই আবার ঘুমিয়ে গেল লিও।

গভীর মনোযোগের সাথে আবার কিছুক্ষণ দেখলো ওকে খানিয়া। তারপর হঠাৎ আস্তে আস্তে নেমে যেতে লাগলো তার মুখ। লিওর ঠোঁটের সাথে ঠোঁট লাগলো। হাত দুটো উঠে এলো আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে। পরমুহূর্তে ছিটকে সরে এলো সে। চুল পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে লজ্জায়।

এবার আমার দিকে চোখ পড়লো তার।

কখন যে সম্মোহিতের মতো উঠে বসেছি আমি নিজেও টের পাইনি। এস্ত পায়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো সে।

তোমার এত সাহস? তীব্র বিদ্বেষ ভরা ফিসফিসে গলায় বললো রমণী। দ্রুত হাতে কোমরের কাছ থেকে টান দিলো কি যেন। পরক্ষণে দেখলাম, তার হাতে চক চক করছে একটা ছোরা। যে-কোনো মুহূর্তে ছুটে আসবে আমার হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। বিপদ বুঝতে বিলম্ব হলো না আমার। ওকে এগোতে দেখেই কম্পিত হাত বাড়িয়ে দিলাম সামনে।

ও! দয়া করো, দয়া করো। হাতের মতো গলাটাও কাঁপালাম নিখুঁত ভাবে। আমাকে একটু পানি দাও! জ্বর! জ্বলে যাচ্ছে ভেতরটা! উদভ্রান্তের মত চাইলাম চারপাশে। একটু চড়লো আমার গলা। কই, একটু পানি দাও! অভিভাবক, কই তুমি, একটু পানি দাও, পানি। তারপর ধপাস করে পড়ে গেলাম চিৎ হয়ে।

থেমে দাঁড়ালো খানিয়া। ছোরাটা খাপে পুরলো। পাশের একটা টেবিল থেকে এক বাটি দুধ নিয়ে এসে দাঁড়ালো আমার বিছানার পাশে। ঝুঁকে আমার ঠোঁটের কাছে ধরলো বাটিটা। ঘাড়টা সামান্য তুলে বুভুক্ষের মতো খেয়ে নিলাম দুধটুকু। দুধের স্বাদ এর চেয়ে খারাপ আর কোনোদিন লাগেনি আমার কাছে।

তুমি দেখি কাপছে! বললো সে। দুঃস্বপ্ন দেখেছো?

হ্যাঁ, বন্ধু। দেখলাম, ঐ ভয়ানক অন্ধকার খাদের ভেতর পড়ে যাচ্ছি আমি।

আর কিছু?

আর কি দেখব? নদীতে পড়ার আগেই ঘুম ভেঙে গেল।

সত্যি বলছো, আর কিছু দেখনি?

শপথ করে বলছি, রানী।

তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জ্ঞান হারানোর ভান করলাম।

সত্যিই আমি আবার অচেতন হয়ে গেছি মনে করে জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করলো বানিয়া।

ওহ কি শান্তি, বললো সে, লোকটা অন্য কোনো স্বপ্ন দেখেনি। না হলে মুশকিলই হতো-ওর জন্যেও, আমার জন্যেও। অত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে বেচারা, মরণ-শ্যপদের হাতে তুলে দিতে খারাপই লাগতো আমার। বুড়ো আর কুশ্রী হলেও মনে হয় জ্ঞানী লোকটা।

মরণ-শ্বাপদ জিনিসটা কি বুঝলাম না, তবু কথাটা শুনে কেমন একটা শিরশিরানি অনুভূতি হলো আমার শরীরে। ভয়ে শক্ত হয়ে রইলাম। এমন সময় সিঁড়িতে অভিভাবকের পদশব্দ শুনে স্বস্তি ফিরে এলো মনে। চোখ সামান্য ফাঁক করে দেখলাম, ঘরে ঢুকে রমণীকে কুর্নিশ করলো সে।

অসুস্থ দুজনের অবস্থা এখন কেমন, ভাতিঝি? শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ।

এখনও অচেতন। দুজনই।

তাই নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম ওরা বুঝি জেগে উঠেছে।

কি শুনেছো তুমি, শামান (অর্থাৎ যাদুকর)? আচমকা প্রশ্ন করে বসলো খানিয়া, গলার স্বর কঠোর।

আমি? কি আবার শুন্বো। খাপের ভেতর ছুরি ঢোকানোর শব্দ শুনলাম একবার, তারপর দূরে মরণ-শ্বাপদের ডাক।

আর, কি দেখেছো তোমার ঐ তোরণের ভেতর দিয়ে?

আশ্চর্য দৃশ্য, খানিয়া, ভাইঝি। অচেতন অবস্থায় উঠে বসে মানুষ!

হ্যাঁ। সুতরাং ঘুমিয়ে থাকতে থাকতেই এটাকে অন্য কামরায় নিয়ে যাও। অন্যজনের একটু বিশুদ্ধ বাতাস দরকার।

চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, অদ্ভুত এক অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে অভিভাবকের মুখে। একটু আগে ওর উপস্থিতিতে যে স্বস্তিটুকু পেয়েছিলাম তা উবে গেল।

কোন্ কামরায়, খানিয়া? অর্থপূর্ণ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো সে।

আমার মনে হয় স্বাস্থ্যকর কোনো একটায়; যেখানে ও দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। লোকটা বুদ্ধিমান। তাছাড়া পাহাড়ের নির্দেশ, ওর কোনো ক্ষতি হলে বিপদ হবে।

দরজার কাছে গিয়ে শিস বাজালো অভিভাবক। তক্ষুণি ভৃত্যদের পদশব্দ শোনা গেল সিঁড়িতে। বৃদ্ধ কিছু একটা নির্দেশ দিলো তাদের। আলগোছে আমাকে সুদ্ধ জাজিমটা তুলে নিলো ওরা। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে, নেমে, আবার হেঁটে অবশেষে আরেকটা বিছানায় নামিয়ে রাখলো আমাকে। বৃদ্ধ শামান আমার নাড়ী দেখলো। তারপর সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে গেলাম আমি।

ঘুম যখন ভাঙলো তখন পুরো দিন। যথেষ্ট ভালো বোধ করছি। মাথা পরিষ্কার, শরীর ঝরঝরে। বহু দিন এত ভালো বোধ করিনি। আগের রাতের সব কথা মনে পড়ে গেল। সাবধানে মনে মনে যাচাই করলাম সেগুলো। সব শেষে সিদ্ধান্তে এলাম, আমার বিপদ এখনও কাটেনি। হয়তো শুরু হয়েছে মাত্র।

.

অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব পেলাম না। মরণ-শ্বাপদের ডাক মানে কি? আমাদের উদ্দেশ্য কি সিদ্ধির পথে? এই মহিলা-মানে খানিয়া-ই কি আয়শা? কেন ও আলিঙ্গন করলো লিওকে? নিঃসন্দেহে মেয়েটা দুশ্চরিত্রা নয়, তাছাড়া দুশ্চরিত্রা হলেও জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থান করছে এমন এক অপরিচিত লোককে আলিঙ্গন করা বোধহয় কোনো মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। যা ও করেছে, সত্যি সত্যি অবদমিত আবেগের উচ্ছাসেই করেছে। তাহলে?

নাকি খুবিলগান কোউ-এন-এর কথাই ঠিক? আইসিসের পূজারী ক্যালিক্রেটিস যার সঙ্গে পালিয়েছিলো সেই মিসরীয় রাজকন্যা আমেনার্তাস পুনর্জন্ম নিয়ে এসেছে? আমেনার্তাস আর এই নিয়া যদি একই নারী হয় তাহলে কি এবার অশুভের খেলা শুরু হবে? জানি না। কিছুই বুঝতে পারছি না। সত্য জানতে হবে আমাকে। কিন্তু কি ভাবে।

দরজা খুলে গেল। বৃদ্ধ যাদুকর ঢুকলো ঘরে কৃত্রিম একটা হাসি লেগে আছে ঠোঁটে। আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।

.

০৭.

কেমন আছো, বিদেশী? জিজ্ঞেস করলো শামান।

ভালো, জবাব দিলাম। অনেক ভালো—কিন্তু আপনার নামটা তো এখনও জানা হলো না।

সিমব্রি। আর আমার পদবী তো আগেই বলেছি, তোরণের অভিভাবক। বংশানুক্রমে আমরা এই পদবীর অধিকারী। পেশায় চিকিৎসক।

চিকিৎসক! আমি তো মনে করেছিলাম আপনি যাদুকর।

অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো সিমব্রি। না, যাদুকর না, চিকিৎসক। তোমাদের ভাগ্য ভালো, এ বিষয়ে আমার কিছু পারদর্শিতা আছে, না হলে আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে না। যাক, তোমার নামটা এবার বলো।

হলি।

আহ, হলি!

আপনি কি আগেই টের পেয়েছিলেন আমরা আসবো, তাই খানিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন ঐ ভয়ঙ্কর নদীর পাড়ে? এ ছাড়া তো আর কোনো কারণ দেখছি না। সে জন্যেই মনে হলো আপনি হয়তো যাদুকর, গণাপড়া করে আগেই ভবিষ্যৎ। জেনে যান। অবশ্য নিছক মাছ ধরার জন্যেও গিয়ে থাকতে পারেন, ঠিক জানি না।

নিশ্চয়ই ধরার জন্যে গিয়েছিলাম—তবে মাছ নয় মানুষ। দুটো ধরেছিও।

আগে থাকতেই জানতেন আমরা আসবো?

অনেকটা। অতি সম্প্রতি আমাকে জানানো হয়েছে তোমরা আসছে। দিনক্ষণ অবশ্য বলা হয়নি। তোমাদের অপেক্ষাতেই আমরা ছিলাম ওখানে। এখন বলো তো, ঐ দুর্গম পথ পেরিয়ে এলে কি করে?

ধরুন আমরা যাদু জানি।

জানি না। জানতেও পারো। কিন্তু কি খুঁজছে তোমরা? তোমার সঙ্গী এক রানীর কথা বলছিলো…।

সত্যিই? ও বলছিলো? আশ্চর্য! এক রানীর খোঁজ তো ও পেয়েই গেছে। আমাদের যে বাঁচিয়েছে সে নিশ্চই রানী, ন।

হ্যাঁ। খুব বড় রানী। আমাদের দেশে খানিয়া মানেই রানী। কিন্তু, বন্ধু হলি, অচেতন একজন মানুষ একথা জানলো কি করে বুঝতে পারছি না। আর আমাদের ভাষা-ই বা তোমরা শিখলে কোথায়?

খুব সোজা, ভাষাটা প্রাচীন। আমাদের দেশে এখনও এর চর্চা হয়। গ্রীসের মানুষ এখনও এ ভাষায় কথা বলে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, এই দুর্গম এলাকায় এ ভাষা এলো কি করে?

বলছি শোনো, শুরু করলো বৃদ্ধ। অনেক অনেক পুরুষ আগে এ-ভাষায় কথা বলে এমন এক জাতির মাঝে মহান এক দিগ্বিজয়ীর জন্ম হয়েছিলো। দেশ জয় করতে করতে আমাদের দেশের দক্ষিণ অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। এর পর ভাগ্যদেবী বিমুখ হলেন। স্থানীয় এক জাতির কাছে পরাজিত হলেন তিনি। কিন্তু তার-ই এক সেনাপতি—এই সেনাপতি অবশ্য অন্য এক গোত্রের লোক, অন্যপথে এসে জয় করে নিলেন দেশটা। সেই সাথে তার প্রভুর ভাষাও এলো। এদেশে এক নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। মরুভূমি আর দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা বলে বাইরের দুনিয়ার সাথে কোনো যোগাযোগ রইলো না দেশটার। এখনও নেই।

হ্যাঁ, এ গল্প আমি জানি। দিগ্বিজয়ীর নাম আলেকজাণ্ডার তাই না?

হ্যাঁ। আর সেই সেনাপতির নাম র‍্যাসেন, মিশর নামের এক দেশের লোক তিনি। তারই বংশধররা এখনও শাসন করছে এ দেশ।

এই সেনাপতি, যার নাম বলছেন র‍্যাসেন, তিনি আইসিস নামের এক দেবীর উপাসক ছিলেন না?

না, জবাব দিলো বৃদ্ধ শামান সিমব্রি। সেই দেবীর নাম হেস।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আইসিসেরই আরেক নাম হেস। একটা কথা বলুন তো, এখনও কি তার উপাসনা হয় এদেশে? জানতে চাইছি, কারণ, আইসিসের নিজের দেশ মিশরেই এখন তাঁর পূজা বন্ধ হয়ে গেছে।

ওদিকের ঐ নিঃসঙ্গ পাহাড়ে একটা মন্দির আছে। ঐ মন্দিরের পূজারী পূজারিণীরা কিছু প্রাচীন অনুশাসনের চর্চা করে। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রকৃত দেবতা র‍্যাসেনের বিজয়ের আগে যা ছিলো এখনও তা-ই আছে—ঐ পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা আগুন।

ওখানে এক দেবী আছেন না?

শীতল চোখে আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বৃদ্ধ। তারপর জবাব দিলো, কোনো দেবীর কথা আমি জানি না। ওটা পবিত্র পাহাড়। ওর রহস্য জানতে চাওয়া মানে মৃত্যু। এসব কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?

প্রাচীন ধর্মমতগুলোর ব্যাপারে আমার একটু কৌতূহল আছে তাই।

ভালো কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে তোমাকে পরামর্শ দেবো, কৌতূহল দমন করো। নইলে অহেতুক মরণ-শ্বাপদ বা জংলীদের বল্লমের মুখে প্রাণ হারাবে।

মরণ-শ্বাপদটা আবার কি?

এক ধরনের কুকুর। যারা খানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যায় আমাদের সনাতন প্রথা অনুযায়ী তাদের ছেড়ে দেয়া হয় ঐ কুকুরের মুখে।

খান! আপনাদের এই খানিয়ার স্বামী আছে তাহলে?

হ্যাঁ। ওরই চাচাতো ভাই। দেশের অর্ধেকের শাসক ছিলো ও। এখন ওরা এক, ওদের রাজ্যও এক। কিন্তু যথেষ্ট কথা বলে ফেলেছো, আর না। তোমার খাবার তৈরি। চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালো বৃদ্ধ।

আর একটা প্রশ্ন, বন্ধু সিমব্রি। আমি এঘরে এলাম কি করে? আর আমার সঙ্গী-ই বা কোথায়?

যখন ঘুমিয়ে ছিলে তখন তোমাকে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। দেখতেই পাচ্ছো তাতে তোমার উপকার হয়েছে। কিছু মনে নেই তোমার?

একেবারেই না। আমার বন্ধু কোথায় বললেন না?

ভালোই আছে। খানিয়া আতেন ওর সেবা-শুশ্রুষা করছে।

আতেন! এ নাম তো প্রাচীন মিশরে প্রচলিত ছিলো। এ নামের এক মহিলার কথা পড়েছি, হাজার হাজার বছর আগে সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত ছিলো।

আমার ভাইঝি আতেন কি সুন্দরী নয়?

কি করে বলবো? কয়েক মুহূর্তের জন্যে মাত্র দেখেছি। তা-ও কি অবস্থায় তা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে? আমার এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল শামান সিমব্রি। ভৃত্যরা আমার খাবার নিয়ে এলো। একটু পরে আবার দরজা খুলে গেল। খানিয়া আতেন ঢুকলো ঘরে। সঙ্গে কোনো রক্ষী নেই। ওকে দেখেই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম আমি। মনে পড়ে গেল কাল রাতের কথা। আমার মনের ভাব যেন বুঝতে পারলো সে। বললো-শুয়ে থাকো, ভয়ের কিছু নেই। অন্তত এই মুহূর্তে আমি তোমার কোনো অনিষ্ট করবো না। এখন বলো, ঐ লোকটা, লিও, তোমার কে? ছেলে? উঁহু,বলতে হচ্ছে বলে দুঃখিত, অন্ধকার থেকে আলোর জন্ম হতে পারে না।

আমি অবশ্য তা-ই ভেবে এসেছি সারাজীবন। যা হোক, আপনার ধারণাই ঠিক, খানিয়া। ও আমার পালিত পুত্র।

এখানে কি জন্যে, কি খুঁজতে এসেছো? জিজ্ঞেস করলো খানিয়া।

আমরা খুঁজছি–আঁ.., ঐ পাহাড়ে ভাগ্য আমাদের যা পাইয়ে দেয়।

একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল আতেনের মুখ। তবু শান্তগলায় বললো, ওখানে শাস্তি ছাড়া কিছু পাবে না, অবশ্য যদি ও পর্যন্ত পৌঁছুতে পারো। আমার ধারণা তার আগেই জংলীদের হাতে মারা পড়বে। জংলীরা ঐ পাহাড়ের ঢাল পাহারা দেয়। হেস-এর মঠ ওখানে। ঐ মঠের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করার একমাত্র শাস্তি মৃত্যু, অনন্ত আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হবে।

ঐ মঠের প্রধান কে, খানিয়া? এক পূজারিণী?

হ্যাঁ, এক পূজারিণী, তার মুখ আমি কখনও দেখিনি। ও এত বুড়ি যে সব সময় ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকে রাখে।

আঁ! ঘোমটা টেনে রাখে! অনুভব করছি শিরায় শিরায় রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে উঠছে আমার। বেশ ঘোমটা টানুক আর না-ই টানুক, আমরা যাবো ওঁর কাছে। আশাকরি উনি আমাদের স্বাগত জানাবেন।

না, তোমরা যাবে না, কাটা কাটা গলায় বললো আতেন। সেটা বেআইনী। তাছাড়া, আমি তোমাদের রক্তে হাত রাঙাতে চাই না।

কে বেশি ক্ষমতাবান? ওর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি খানিয়া, না ঐ পাহাড়ের পূজারিণী?

আমিই বেশি ক্ষমতাবান, হলি-তা-ই তো তোমার নাম না কি? প্রয়োজনের মুহূর্তে আমি ষাট হাজার যোদ্ধাকে জড়ো করতে পারি, কিন্তু ওর কিছু জংলী আর সন্ন্যাসী ছাড়া কিছু নেই।

তলোয়ারই পৃথিবীর একমাত্র শক্তি নয়, খানিয়া। এখন বলুন, এই পূজারিণী কখনও আপনাদের কালুন-এ এসেছেন?

না। বহু শতাব্দী আগে মঠ আর সমভূমির মানুষদের ভেতর এক যুদ্ধ হয়েছিলো। একটা চুক্তির মধ্য দিয়ে সে যুদ্ধের শেষ হয়। চুক্তিতে বলা হয়েছিলো ও কখনও নদীর এপারে আসবে না, কোনো খান বা খানিয়াও ওর পাহাড়ে উঠবে না। যে কোনো পক্ষ চুক্তি ভঙ্গ করার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে আমাদের ভেতর।

তাহলে কে আসল প্রভু? কালুনের খান, না ঐ মঠের প্রধান? আবার জিজ্ঞেস করলাম আমি।

ধর্মীয় বা ঐশী ব্যাপার-স্যাপারে হেস-এর পূজারিণী, আর জাগতিক ব্যাপারে কালুনের খান।

খান। তার মানে আপনি বিবাহিত?

হ্যাঁ! তীব্র রোষে জ্বলে উঠলো আতেনের চোখ! এবং এর মধ্যে নিশ্চয়ই জেনে ফেলেছে ও একটা পাগল। ওকে আমি ঘৃণা করি।

আঁ,…শেষেরটা একটু আন্দাজ করেখানিয়া।

অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো আতেন।

কে? আমার চাচা শামান বলেছে? না, আমি ঠিকই ভেবেছিলাম, তুমি দেখেছো। তোমাকে হত্যা করাই উচিত ছিলো। ওহ! আমার সম্পর্কে কি ভেবেছে তুমি?

কি জবাব দেবো ভেবে পেলাম না।

নিশ্চয়ই তুমি বিশ্বাস করে বসেছে আমি পুরুষ দেখলেই লালায়িত হই, বলে চললো সে। কিন্তু না আমি-আমি পুরুষদের ঘৃণা করি। আমি কালুনের খানিয়া, ওরা নাম দিয়েছে বরফ-হৃদয়, হ্যাঁ, বলতে লজ্জা নেই, আমি তা-ই। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো আতেন।

না, আমি বললাম, অমন কিছু আমি ভাবিনি। সত্যিই যদি আপনি তেমন কিছু করে থাকেন, আমার ধারণা তার পেছনে যথার্থ কারণ আছে।

একটু শান্ত হলো খানিয়া। হ্যাঁ, বিদেশী, কারণ আছে। অনেক কিছু তুমি জেনে ফেলেছো, এটুকুই বা বাকি থাকবে কেন? শোনন, আমার ঐ স্বামীর মতো আমিও পাগল হয়ে গেছি। তোমার সঙ্গীকে যখন প্রথম দেখি তখনই পাগলামি ঢুকে পড়েছে আমার ভেতরে। এবং আমি—আমি—

ওকে ভালোবেসে ফেলেছেন, এই তো? এটা কোনো পাগলামি নয়। যে কোনো সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক আচরণ হলো ভালোবাসা।

না না, তুমি বুঝতে পারছে না, এ নিছক ভালোবাসা নয়, আরও বেশি কিছু। কি করে তোমাকে বোঝাবো? নিয়তি আমাকে বাধ্য করেছে–আমি ওর, একমাত্র ওর। হ্যাঁ, আমি ওর, এবং শপথ করে বলছি, ও আমার হবে।

বলেই দ্রুত পায়ে ঘর থেকে চলে গেল খানিয়া আতেন। আর আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, কে এই খানিয়া? এর সাথে লিওর আচরণ কি হবে?

.

তিন দিন পেরিয়ে গেছে। এর ভেতরে খানিয়াকে আর দেখিনি। শামান সিমব্রির কাছে শুনেছি, সে নাকি রাজধানীতে গেছে, রাজকীয় অতিথি হিসেবে বরণ করবে আমাদের। লিওর সাথে দেখা করিয়ে দেয়ার অনুরোধ করেছিলাম বৃদ্ধকে। মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে সে জানিয়ে দিয়েছে, আমাকে ছাড়াই ভালো আছে আমার পালিত পুত্র। শেষে পকেট হাতড়ে এক টুকরো কাগজ পেয়ে তাতে একটা চিরকুট লিখে লিওর কাছে পাঠানোর চেষ্টা করেছি। ভৃত্যদের কেউ সেটা স্পর্শ করতেও রাজি হয়নি। অবশেষে তৃতীয় রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম, যা থাকে কপালে, দেখা করার চেষ্টা করবো ওর সাথে।

ইতিমধ্যে আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছি। মাঝরাতে, চাঁদ যখন মাথার ওপর উঠে এসেছে, পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নেমে কাপড়-চোপড় পরে নিলাম। আমার কাপড়ের ভেতর ছুরিটা এখনও আছে দেখে বেশ স্বস্তি পেলাম মনে। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলাম দরজা খুলে।

লিও আর আমাকে প্রথমে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে যখন বয়ে আনা হয় তখন চোখ বুজে আমি পথের নিশানা মনে গেঁথে নিয়েছিলাম। মনে আছে, আমার এখানকার ঘর থেকে বেরিয়ে তিরিশ পা (বাহকদের পদক্ষেপ গুনেছিলাম) যাওয়ার পর বাঁ দিকে মোড় নিতে হয়। তারপর আরও দশ পা গিয়ে একটা সিঁড়ির পাশ দিয়ে ডান দিকে মোড় নিলেই আমাদের পুরনো ঘর।

দীর্ঘ বারান্দা ধরে হেঁটে চললাম আমি। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, তবু বায়ের মোড়টা খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। গুণে গুণে দশ পা গিয়ে ডানে মোড় নিলাম। পর মুহূর্তে ছিটকে পিছিয়ে আসতে হলো আমাকে। লিওর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খানিয়া নিজে। এক হাতে প্রদীপ, অন্য হাতে তালা লাগাচ্ছে দরজায়।

প্রথমেই আমার চিন্তা হলো, ছুটে চলে যাই নিজের ঘরে। পরমুহূর্তে বুঝতে পারলাম, লাভ হবে না। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও ধরা পড়ে যাবে। তার চেয়ে পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া ভালো। সত্যি কথাই বলবো, কেমন আছে জানার জন্যে লিওর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।

দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। এগিয়ে আসছে খানিয়া। পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি! এবং তারপর-হ্যাঁ, এদিকে না এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলো সে।

এখন কি করবো? লিওর কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা বৃথা। ফিরে যাবো? না, খানিয়াকে অনুসরণ করবে। ধরা পড়লে একই অজুহাত দেখাবো। কিছু হয়তো জানা যাবে, অথবা—অথবা, বুকে গেঁথে বসবে ছোরা।

কয়েক সেকেণ্ড পর মোড় নিয়ে আমি উঠতে শুরু করলাম সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে এক পাশে একটা দরজা দেখলাম। বন্ধ। অত্যন্ত প্রাচীন। জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে। ফাটল দিয়ে আলো এসে পড়েছে বাইরে। দরজায় কান লাগাতেই শুনতে পেলাম সিমব্রির কণ্ঠস্বর: কিছু জানতে পারলে, ভাইঝি?

সামান্য। খানিয়া আতেনের জবাব। খুব সামান্য।

হঠাৎ করেই সাহস বেড়ে গেল আমার। ঝুঁকে চোখ রাখলাম দরজার এক ফাটলে। ছাদ থেকে ঝোলানো একটা বড় লণ্ঠনে আলোকিত ঘরটা। টেবিলের সামনে বসে আছে সিমব্রি। খানিয়া দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে ভর দিয়েছে টেবিলের কোনায়। গোলাপী রঙের রাজকীয় আলখাল্লায় সত্যিই অপরূপা লাগছে তাকে। ভুরুর একটু উপরে ছোট্ট একটা সোনার মুকুট। তার নিচ থেকে কোঁকড়া চুলগুলো ঢেউয়ের মতো নেমে এসেছে কাঁধে বুকে, পিঠে। তার দিকে তাকিয়ে আছে শামান সিমব্রি; চোখে ভয়, সন্দেহ।

কি আলাপ হলো তোমাদের? জিজ্ঞেস করলো বৃদ্ধ।

ওরা কেন এসেছে জিজ্ঞেস করলাম, ও জবাবে বললো, খুব সুন্দরী এক মহিলার খোঁজে এসেছে–আর কিছু বললো না। সেই মহিলা আমার চেয়ে সুন্দরী কিনা জানতে চাইলাম, তখন ওঁ জবাব দিলো, তা বলা শক্ত, তবে সে নাকি অন্য রকম। নিশ্চয়ই ভদ্রতা করে এই জবাব দিয়েছে ও। যা হোক, তারপর আমি, বললাম আমার চেয়ে সুন্দরী কোনো নারী কালুনে নেই, তাছাড়া আমি এদেশের রানী এবং আমিই ওকে বাঁচিয়েছি পানি থেকে। আমি আরও বলেছি, সে যাকে খুঁজছে আমিই সে।

বেশ বেশ, অস্থির ভাবে বললো সিমব্রি। তারপর?

তারপর ও বললো, তুমি কখনও আগুনের ভেতর দিয়ে এসেছো?

আমি বললাম,যা, আত্মার আগুনে আমি স্নান করেছি।

ও তখন বললো, তোমার চুল দেখাও তো আমাকে।

আমি আমার একগুচ্ছ চুল তুলে দিলাম ওর হাতে। সঙ্গে সঙ্গে ও ফেলে দিল ওগুলো। গলার সঙ্গে ঝোলানো ছোট একটা চামড়ার থলে থেকে আরেক গুচ্ছ চুল বের করলো—ওহ! সিমব্রি, কাকা, অমন সুন্দর চুল আমি আর কখনও দেখিনি। রেশমের মতো কোমল, মসৃণ; লম্বায় আমার এই মুকুট থেকে পা পর্যন্ত হবে।

তোমার চুল সুন্দর, ও বললো, কিন্তু দেখ, এগুলোর মতো নয়।

আমি বললাম, এমনও তো হতে পারে, এ চুল কোনো নারীর নয়।

ও জবাব দিলো, ঠিক বলেছো, আমি যাকে খুঁজছি সে নারীর চেয়েও বেশি।

তারপর—তারপর, আমি নানা ভাবে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ও আর একটা কথাও বললো না। এদিকে ঐ অজানা মেয়ে মানুষটাকে এমন ঘৃণা করতে শুরু করেছি যে শেষে কি বলতে কি বলে ফেলি ঠিক নেই, তাই ভয় পেয়ে চলে এসেছি। এখন তোমার ওপর আমার নির্দেশ, খুঁজে বের করো এই মহিলাকে। শামান সিমব্রি, দরকার হলে তোমার সকল জ্ঞান দিয়ে খুঁজবে। তারপর জানাবে আমাকে। যদি পারি, আমি খুন করবো তাকে!

আচ্ছা, সে দেখা যাবে, জবাব দিলো শামান। এখন, এই চিঠিটার ব্যাপারে কি করবে? টেবিলের ওপর পার্চমেন্টের ছোটখাটো একটা স্কুপ থেকে বিশেষ একটা বেছে নিলো বৃদ্ধ। কদিন আগে অরোস-এর কাছ থেকে যেটা এসেছে?

আরেকবার পড়ো তো, বললো আতেন। আবার শুনতে চাই, কি লিখেছে।

পড়তে শুরু করলো সিমব্রি : কালুনের খানিয়ার কাছে অগ্নিগৃহের হেসা।

বোন–এই মর্মে আমার কাছে সতর্কসংকেত পৌঁছেছে যে, পশ্চিমা বর্ণের দুই আগন্তুক আমার আশীর্বাণী লাভের আশায় তোমার দেশে আসছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি নির্দেশ দিচ্ছি, পরবর্তী চাঁদের প্রথম দিনে তুমি আর তোমার জ্ঞানী চাচা তোরণের অভিভাবক শামান সিমব্রি গিরিখাতের যে জায়গায় প্রাচীন সড়ক শেষ হয়েছে তার নিচে নদীর তীরে গিয়ে অপেক্ষা করবে। ঐ পথেই আসবে আগন্তুকরা। তুমি ওদের সর্বতোভাবে সাহায্য করবে, এবং পথ দেখিয়ে নিরাপদে আমার পাহাড়ে নিয়ে আসবে। ওরা যদি ঠিক মতো এখানে না পৌঁছায় তাহলে তার সকল দায়-দায়িত্ব বহন করতে হবে তোমাদের দুজনকে। আমি নিজেই ওদের আনতে যেতে পারতাম, কিন্তু তা অতীতে সম্পাদিত চুক্তির পরিপন্থী। তাই তোমাদের ওপর দায়িত্ব দিতে হচ্ছে। আশাকরি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালিত হবে।

হেসা অপেক্ষা করছে! পার্চমেন্টটা নামিয়ে রাখতে রাখতে সিমব্রি বললো। তারমানে নিছক ঘুরতে ঘুরতে আসেনি ওরা।

হ্যাঁ, নিছক ঘুরতে ঘুরতে আসেনি ওরা, আমার হৃদয়ও অপেক্ষা করছে ওদের এক জনের জন্যে। ও যে নারীর কথা বলছে সে হেসা নয়।

অনেক নারী আছে ঐ পাহাড়ে, তাদের কারও কথাও বলে থাকতে পারে।

যার কথাই বলুক না কেন, ও-পাহাড়ে যাচ্ছে না।

যা ভাবছো তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ক্ষমতা রাখে হেসা। এই নরম কথাগুলোর আড়ালে ভয়ানক এক হুমকি রয়েছে, বুঝতে পারছো না?

হুমকি থাক আর না থাক ও যাচ্ছে না। অন্যজন ইচ্ছে হলে যেতে পারে।

আতেন, স্পষ্ট করে বলো তো, তোমার ইচ্ছা কি? প্রেমিক হিসেবে চাও লিও নামের লোকটাকে?

বৃদ্ধ শামানের চোখে চোখে তাকালো খানিয়া। দৃঢ় গলায় জবাব দিলো—

না, আমি চাই ও আমার স্বামী হবে।

সেক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো, ওকেও তোমাকে স্ত্রী হিসেবে চাইতে হবে। ওর ভেতর তো তেমন কোনো ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। আর—আর, একজন স্ত্রীলোকের দুটো স্বামী থাকে কি করে?

বৃদ্ধের কাঁধে হাত রাখলো আতেন। তুমি ভালো করেই জানো, সিমব্রি, আমার কোনো স্বামী নেই। নামমাত্র যেটা আছে সেটা-ও থাকবে না, যদি তুমি আমার সহায় হও।

মানে! খুন করতে চাও ওকে? না, আতেন, এবার আর আমি তোমার সহায় হবো না। তোমার সহায় হতে গিয়ে বহু পাপের বোঝা চেপেছে আমার কাঁধে, আর না। যা করার তোমাকেই করতে হবে। যদি না পারো লোকটাকে চলে যেতে দাও পাহাড়ে।

অসম্ভব! কিছুতেই তা আমি হতে দেবো না। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো আতেন। অবশেষে বললো, তুমি না কি বিরাট শামান, যাদুকর, ভবিষ্যৎ বক্তা। গণা-পড়া করে বললো আমাদের ভবিষ্যৎ।

তুমি বলার আগেই অনেকখানি সময় আমি ব্যয় করেছি একাজে, ফলাফল শুভ নয়, আতেন। এটা ঠিক, তোমার আর ঐ লোকটার নিয়তি একসূত্রে গাঁথা, কিন্তু বিশাল এক দেয়াল মাথা তুলেছে দুজনের মাঝে। যতদিন এই পৃথিবীতে আছো সে দেয়াল সরবে না তোমাদের মাঝ থেকে। তবে আমি আর যেটুকু জানতে পেরেছি, মৃত্যুর মাঝ দিয়ে আবার তোমরা খুব কাছাকাছি আসবে একে অন্যের।

মৃত্যুই আসুক তাহলে, গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে বললো খানিয়া। সেখানে তো আর কেউ আমার ইচ্ছায় বাধা দিতে পারবে না।

অত নিশ্চিন্ত হয়ো না, জবাব দিলো সিমব্রি। আমার ধারণা, মৃত্যু-সাগরের ওপারেও তোমাদের অনুসরণ করবে সেই অদৃশ্য শক্তি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, হেস-এর নিধুম চোখ ছুরির ফলার মতো চিরে চিরে দেখছে আমাদের গোপন আত্মাগুলোকে।

তাহলে মায়ার ধুলো দিয়ে অন্ধ করে দাও সে চোখ। কালই হেসার কাছে চিঠি দিয়ে দূত পাঠাও যে, দুজন বৃদ্ধ আগন্তুক এসেছে—খেয়াল কোরো, বৃদ্ধ–তারা এখন খুবই অসুস্থ, খাদের ওপর থেকে পড়ে হাত-পা ভেঙে গেছে, তিন মাসের আগে সুস্থ হবে না। বেটি হয়তো তোমার কথা বিশ্বাস করবে।…এবার আমি ঘুমোবো। সেই ওষুধটা দাও, সিমব্রি, যেটা খেলে স্বপ্নহীন ঘুমে রাত শেষ হয়ে যায়।

দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পায়ে আমি সরে এলাম সেখান থেকে। সিঁড়ির কোনায় অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়ালাম।

.

০৮.

পরদিন সকাল দশটা কি আরও পরে শামান সিমব্রি এলো আমার ঘরে। জিজ্ঞেস করলো, কেমন ঘুমিয়েছি রাতে।

মরার মতো, আমি জবাব দিলাম। ঘুমের ওষুধ খেয়েও মানুষ এমন নিচ্ছিদ্র ঘুম ঘুমাতে পারে না।

তবু, বন্ধু হলি, বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।

তাহলে বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখেছি। মাঝে মাঝে অমন হয় আমার। কিন্তু, বন্ধু সিমবি, আপনার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে, সারারাতে একটুও ঘুমাতে পারেননি।

হ্যাঁ, সারারাত আমাকে তোরণ পাহারা দিতে হয়েছে।

কোন্ তোরণ? আমরা যেটা দিয়ে ঢুকেছি আপনাদের রাজ্যে?

না, অতীত আর ভবিষ্যতের তোরণ। যেখান দিয়ে…থাক, অত কথায় দরকার নেই; আমি যা বলতে এসেছি, এক ঘণ্টার ভেতর রাজধানীর পথে রওনা হতে হবে তোমাকে। তোমাদের স্বাগত জানানোর জন্য ওখানে অপেক্ষা করছেন। খানিয়া আতেন।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু আমার পালিত পুত্রের কি অবস্থা?

ও-ও সুস্থ হয়ে উঠেছে। সময় হলেই ওর দেখা পাবে। খানিয়ার ইচ্ছে তাই। এই যে, ক্রীতদাসরা তোমার কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছে। তৈরি হয়ে নাও।

বেরিয়ে গেল সিমব্রি। ভৃত্যদের সহায়তায় কাপড় পরতে শুরু করলাম। প্রথমে চমৎকার পরিষ্কার লিনেনের অন্তর্বাস, তারপর পশমের মোটা ট্রাউজার্স ও গেঞ্জি এবং সব শেষে ফারের কিনারা লাগানো কালো রং করা উটের পশমের আলখাল্লা, দেখতে অনেকটা লম্বা ঝুল কোটের মতো। কাঁচা চামড়ার একটা টুপি আর এক জোড়া বুটের মাধ্যমে শেষ হলো আমার বেশ বিন্যাস।

পোশাক পরা শেষ হতে না হতেই হাজির হলো হলদেমুখো ভৃত্যরা। আমার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেডে, বারান্দা পেরিয়ে নিয়ে চললো তোরণ গৃহের দরজার দিকে। সেখানে পৌঁছে সবি আঁয়ে দেখলাম সিমব্রির সাথে দাঁড়িয়ে আছে লিও। মুখটা একটু ফ্যাকাসে। না হলে বলতে পারতাম সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। ওকে। আমার মতোই পোশাক পরেছে। পার্থক্য একটাই, ওর স্কুল কোটটা সাদা। আমাকে দেখে এক লাফে এগিয়ে এলো ও। আনন্দে চকচক করে উঠেছে দুচোখ। কেমন আছি, এই কদিন কোথায় ছিলাম এসব নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে চললো।

সিমব্রির সামনে যেগুলোর জবাব দিলে অসুবিধা নেই সেই প্রশ্নগুলোরই জবাব দিলাম শুধু। বাকিগুলো পরে কোনো এক ফাঁকে দিতে পারবো। আপাতত কিছুক্ষণ অন্তত এক সাথে থাকছি আমরা।

এর পর অদ্ভুত এক ধরনের পালকি নিয়ে এলো ওরা। মানুষের বদলে ঘোড়ায় বহন করে ওগুলো। সামনে পেছনে দুটো লম্বা দণ্ডের সাথে জুড়ে দেয়া হয় একটা করে দুটো টাটু ঘোড়া। আমরা উঠে বসতেই সিমব্রি ইশারা করলো। সামনের টাটুর লাগাম ধরে টেনে নিয়ে চললো দাসরা। পেছনে পড়ে রইলো বিষণ্ণ প্রাচীন তোরণগৃহ।

পথের প্রথম মাইলখানেক গেছে আঁকাবাকা এক গিরিখাতের মাঝ দিয়ে। তারপর আচমকা একটা মোড় নিলো গিরিপথ। সামনে ভেসে উঠলো কালুনের বিস্তৃত সমভূমি। কয়েক মাইল দূরে একটা নদী। সেদিকেই যাচ্ছি আমরা। নদীটা সরু কিন্তু খরস্রোতা। ওপাশেজাবার সমভূমি। যতদূর চোখ যায় ফাঁকা আর ফাঁকা। একটাই মাত্র ব্যতিক্রম এই একঘেয়ে বিস্তারের মাঝে—সেই পাহাড়টা, স্থানীয়রা যার নাম দিয়েছে অগ্নি-গৃহ। এখান থেকে অনেক দূরে সেটা। একশো মাইলেরও বেশি হবে। এতদূর থেকেও পাহাড়টার গাম্ভীর্যপূর্ণ অবয়ব টের পেতে অসুবিধা হয় না। চূড়াটা কমপক্ষে বিশ হাজার ফুট উঁচু। উজ্জ্বল সাদা।

হ্যাঁ, সেই চূড়ার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা স্তম্ভ, তার ওপরে তেমনি প্রকাণ্ড একটা পাথুরে আংটা। এক দৃষ্টিতে আমরা তাকিয়ে আছি ওটার দিকে। যেন আমাদের সব আশা আকাক্ষা মূর্ত হয়ে উঠেছে ওটার চেহারায়। খেয়াল করলাম, আমাদের সঙ্গীরা সবাই পাহাড়টা দেখা মাত্র মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো, সেই সাথে ডান হাতের তর্জনী বাঁ হাতের তর্জনীর ওপর আড়াআড়িভাবে রেখে একটা ভঙ্গি করলো। (পরে জেনেছিলাম, পাহাড়টার অশুভ প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এ ভঙ্গি করে ওরা)। শামান সিমব্রিও বাদ গেল না।

আপনি কখনও গেছেন ওই পাহাড়ে? বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলো লিও।

মাথা নাড়লো সিমব্রি। সমভূমির মানুষরা ওখানে যায় না। প্রথম কারণ হিংস্র জংলীরা। ওদের সাথে লড়াই না করে ওখানে যাওয়ার উপায় নেই। দ্বিতীয়ত, পাহাড়টার যখন প্রসববেদনা ওঠে গলিত পাথরের লাল স্রোত নেমে আসে ঢাল বেয়ে। গরম ছাই ছিটকে পড়ে চূড়া থেকে। কে যাবে ঐ ভয়ঙ্কর জায়গায়?

আপনাদের এলাকায় কখনও ছাই পড়ে না?

কখনও দেখিনি পড়তে, তবে শুনেছি পাহাড়ের আত্মা যখন ক্রুদ্ধ থাকে তখন পড়ে, সেজন্যেই আমরা ভয় করি ওটাকে।

কে এই আত্মা? উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করল লিও।

আমি জানি না, অস্থিরভাবে বলল সিমব্রি। মানুষ কি আত্মা দেখতে পারে?

সবাই না পারুক আপনি যে পারেন তা আপনার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি।

সত্যিই তাই, বুড়োর দৃষ্টি এখন আর আগের মতো স্থির, নির্লিপ্ত নয়। কিছু একটা যেন ভেতরে ভেতরে খেচাচ্ছে তাকে।

তুমি আমাকে সম্মান করো তাই একথা বলছো, জবাব দিলো সিমব্রি। আসলে আমার ক্ষমতা অত দূরগামী নয়। যাকগে, আমরা ঘাটে পৌঁছে গেছি, বাকি পথ নৌকায় যেতে হবে।

বেশ বড়সড় আরামদায়ক নৌকাগুলো। পাল খাটানোর ব্যবস্থা আছে তবে মূলত গুণ টেনে চালানোর উপযোগী করেই তৈরি। লিও আর আমি উঠলাম বড়টায়। আনন্দের সাথে লক্ষ করলাম হালের লোকটা ছাড়া আর কেউ উঠলো না। এ নৌকায়। সিমব্রি আর বাকি লোকজন উঠলো পেছনেরটায়। পালকিটাও ভাঁজ করে উঠিয়ে দেয়া হলো পেছনের নৌকায়। লম্বা চামড়ার দড়ি বেঁধে টাট্টু দুটোকে জুড়ে দেয়া হলো দুই নৌকার সঙ্গে। এতক্ষণ পালকি বয়েছে, এবার নৌকা টেনে নিয়ে যাবে ওরা। নদীর তীর ঘেঁষে সুন্দর বাঁধানো পথ, খালগুলোর ওপরে কাঠের সেতু। সুতরাং নৌকা টানতে অসুবিধে হবে না ওদের।

ওহ! অবশেষে আবার আমরা একসাথে হয়েছি, বললো লিও। মনে আছে, হোরেস, ঠিক এমনি নৌকায় করে আমরা পৌঁছেছিলাম কোর-এর সমভূমিতে? সেই একই ঘটনা আবার ঘটতে চলেছে।

হ্যাঁ, সেই একই ঘটনা আবার ঘটতে চলেছে। কিন্তু, লিও, বলো তো এখানে আসার পর যা ঘটেছে তার কতটুকু মনে আছে তোমার?

আঁ…, সেই মহিলা আর বুড়ো আমাদের নদী থেকে টেনে তুললো। তারপর…তারপর যা মনে আছে তা হলো ঘুম। জাগি, ঘুমাই, কিন্তু কতক্ষণ ঘুমের পর কতক্ষণ জেগেছি কিছুই মনে নেই। তারপর একবার, ঘুম ভাঙতেই দেখলাম অপূর্ব সুন্দরী এক মহিলা ঝুঁকে আছে আমার ওপর। প্রথমে আমি ভাবলাম বুঝি– কার কথা বলছি বুঝতে পারছো তো? ঝুঁকে আমাকে চুমো খেলো সে। লাল হয়ে উঠলো লিওর মুখ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললো, ব্যাপারটা স্বপ্নও হতে পারে।

না স্বপ্ন নয়, আমি দেখেছি। তারপর?

তারপর আর কি? পরে আরও অনেকবার ওকে দেখেছি—ঐ খানিয়াকে, আলাপ করেছি গ্রীকে। কিন্তু, সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের ব্যাপারে ও এমন উৎসাহী হয়ে উঠলো কেন বুঝতে পারছি না। কে ও, হোরেস?

কি আলাপ করেছে আগে বলো, তারপর আমি বলবো কে ও।

বেশ, বলছি শোনো-আগের আলাপগুলো এমন টুকরো টুকরো আর বিচ্ছিন্ন, প্রায় কিছুই মনে নেই—কাল রাতের ঘটনাটা স্পষ্ট মনে আছে, সেটাই বলি। রাতের খাওয়া শেষ করেছি সবেমাত্র। এটো বাসন পেয়ালা নিয়ে চলে গেছে বুড়ো যাদুকর। শুয়ে পড়ার কথা ভাবছি। এমন সময় ঘরে ঢুকলো খানিয়া। একা। রানীর মতো সাজ পোশাক। সত্যি বলছি, রূপকথার রাজকন্যার মতো লাগছিল ওকে। মাথায় মুকুট, কালো চুলের ঢল নেমেছে ঘাড় ছাড়িয়ে।

তারপর, হোরেস, ও সরাসরি প্রেম নিবেদন করলো আমাকে। আমার চোখে চোখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমরা নাকি দূর অতীতে একে অপরকে চিনতাম। তারপর বললো, ও চায় আমাদের পুরনো পরিচয় নূতন করে ঝালিয়ে নিতে। নানাভাবে ওকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তা সম্ভব নয়। কিন্তু ও কি শোনে?

শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলাম আমি আমার হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীকে খুঁজছি। যা-ই হোক, আয়শা আমার স্ত্রী, তাই না, হোরেস? ও মৃদু হেসে কি বললো জানো? আমার সেই হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া গেছে, ও-ই সে, এবং সেজন্যেই ও নদী থেকে বাঁচিয়েছিলো আমাকে। এমন ভাবে ও বলছিলো যে শেষ দিকে আমি প্রায় বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম কথাগুলো। এমনও তো হতে পারে, আয়শার চেহারা বদলে গেছে।

হঠাৎ মনে পড়লো সেই চুলের গোছাটার কথা, বুকের কাছে চামড়ার থলেটা স্পর্শ করলো লিও। ওটা বের করে খানিয়ার চুলের সাথে মেলালাম। চুলগুলো দেখার সাথে সাথে কেমন হিংসুটের মতো হয়ে গেল ওর চেহারা। ভয় দেখাতে লাগলো আমাকে। ওগুলো ওর চুলের চেয়ে লম্বা তাই কি?

ওর এই চেহারা দেখে আমি বুঝে ফেললাম ও আয়শা হতে পারে না। চুপ করে শুয়ে রইলাম আমি। ও অনেক কথা বলে গেল। ভয় দেখালো। শেষে দুপদাপ পা ফেলে চলে গেল ঘর থেকে। বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়ার আওয়াজ শুনলাম। ব্যস, এটুকুই আমার গল্প।

বেশ, আমি বললাম, এবার চুপ করে বোসো। চমকে উঠো না বা জোরে কথা বলে ফেলো না, হালের লোকটা গুপ্তচর হতে পারে, হয়তো তোমার আমার আচরণ সব পরে জানাবে সিমব্রিকে।

এরপর গিরিখাতের মাঝামাঝি বাঁক থেকে ওর পড়ে যাওয়ার পর এ-পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব বললাম। হাঁ করে শুনলো লিও।

কী বিস্ময়কর কাহিনি! অবশেষে স্বর বেরোলো ওর গলা দিয়ে। কে এই। হেসা, আর খানিয়াই বা কে?

তোমার কি মনে হয়? কে হতে পারে?

আমেনার্তাস? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো ও। আমার-মানে ক্যালিক্রেটিসের স্ত্রী? মিসরীয় রাজকন্যা আমেনার্তাস পুনর্জন্ম নিয়ে এসেছে?

মাথা ঝাকালাম আমি। আমার তা-ই মনে হয়। বুড়ো বুদ্ধ সন্ন্যাসী কেউ এন যদি হাজার বছর আগের স্মৃতি মনে করতে পারে, যাদুকর চাচা সিমব্রির সাহায্য নিয়ে খানিয়া কেন পারবে না? প্রথম দর্শনে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক লোকের প্রেমে পড়ে যাওয়ার এ ছাড়া আর কোনো কারণ তো দেখি না।

তোমার কথায় যুক্তি আছে, হোরেস। আর তা যদি হয়, খানিয়ার জন্যে সত্যিই আমি দুঃখিত। বেচারা ইচ্ছে থাক না থাক জড়িয়ে গেছে এতে।

হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যে আবার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছো সে খেয়াল আছে? নিজেকে সামলাও, লিও, নিজেকে সামলাও। আমার বিশ্বাস, এটা একটা পরীক্ষা তোমার জন্যে। হয়তো সামনে এমন আরও পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে তোমাকে।

জানি, বললো লিও, ভালো করেই জানি। তোমার ভয় না পেলেও চলবে। এই খানিয়া অতীতে আমার কি ছিলো না ছিলো তাতে কিছু আসে যায় না। এখন আমি আয়শাকে খুঁজছি, এবং একমাত্র আয়শাকে, স্বয়ং ভেনাসও যদি চেষ্টা করে, আমাকে প্রলোভিত করতে পারবে না।

.

কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ আমাদের নৌকা পাড়ের সাথে মৃদু একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। পেছনের নৌকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওটাও তীরে ভিড়েছে। সিমব্রি নেমে আসছে। একটু পরেই আমাদের নৌকায় উঠে এলো সে। গম্ভীর মুখে আমাদের সামনে একটা আসনে বসলো।

তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব রয়েছে আমার ওপর, বললো বৃদ্ধ। রাত হয়ে আসছে, আর দূরে থাকা সমীচীন মনে করলাম না। তাছাড়া এখন একটু সঙ্গও দিতে পারবো তোমাদের।

আর পাহারাও দিতে পারবে, আমরা পালানোর চেষ্টা করি যদি, বিড়বিড় করে ইংরেজিতে বললো লিও।

আবার চলতে শুরু করলো ঘোড়াগুলো। সেই সাথে নৌকাগুলোও।

ঐ যে আমাদের রাজধানী, একটু পরে সিমব্রি বললো। ওখানেই আজ রাতে ঘুমাবে তোমরা।

সিমব্রির ইশারা অনুসরণ করে তাকালাম আমরা। মাইল দশেক দূরে শহরটা। বিশাল বলবো না, তবে বেশ বড়। সমভূমি থেকে প্রায় নয়শো ফুট উঁচু একটা মাটির স্কুপের ওপর গড়ে উঠেছে। শহরটাকে মাঝখানে রেখে দুভাগে ভাগ হয়ে এগিয়ে গেছে নদী।

কি নাম শহরটার? জিজ্ঞেস করলো লিও।

কালুন, জবাব দিলো সিমব্রি। আমার পূর্ব পুরুষরা যখন জয় করে এদেশ, দুহাজার বছর আগে, তখনও এই নাম ছিলো। প্রাচীন নামটা বদলানো হয়নি। তবে সেনাপতির ইচ্ছায় ঐ পাহাড় আর সংলগ্ন এলাকার নতুন নামকরণ করা হয়। কারণ ওটার চূড়ায় যে স্তম্ভ আর আংটা আছে তা ওদের সেনাপতির উপাস্য দেবীর প্রতীকের মতো দেখতে। সেই দেবীর নামানুসারে ঐ এলাকার নাম দেয়া হয় হেস।

এখনও নিশ্চয়ই পূজারিণীরা আছে ওখানে, বুড়োর পেট থেকে কিছু কথা বের করা যায় যদি, এই আশায় বললো লিও।

হ্যাঁ, পূজারীও আছে। বিজয়ীরা প্রতিষ্ঠা করেছিলো ঐ মঠ। স্থানীয় দেবতা পার্বত্য-অগ্নির মন্দির ছিলো ওখানে। সেই মন্দিরকেই হেস-এর মঠে রূপান্তরিত করা হয়।

এখন ওখানে কার পূজা হয়?

দেবী হেস-এর। সে রকমই ধারণা সবার। এ সম্পর্কে বেশি কিছু জানি না আমরা। আমাদের সাথে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শক্রতা পাহাড়ের ওদের। সুযোগ পেলেই আমরা বা ওরা একে অপরকে আক্রমণ করার চেষ্টা করি। তবে চেষ্টাটা ওদের তরফ থেকেই বেশি হয়। আমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা করি কেবল। এমনিতে আমরা শান্তিপ্রিয় জাতি। আক্রান্ত না হলে কখনও আক্রমণ করি না। চারদিকে তাকিয়ে দেখ, শান্তির দেশ মনে হয় না?

সত্যিই তাই, নদীর দুপারে শুয়ে আছে বিস্তীর্ণ সবুজ সম্ভাবনা। চারণভূমিতে চরছে গবাদি পশুর পাল, অথবা ঘোড়া খচ্চরের দল। গাছের সারি বা লাইল দিয়ে পৃথক করা চৌকোনা ফসলের খেত। গ্রামের মানুষরা মাঠের কাজ শেষে বাড়ির পথে চলেছে। ধূসর রঙের ঢোলা আলখাল্লা তাদের পরনে। অনেকে দিয়ে নিয়ে চলেছে নিজের নিজের পশুর পাল। দূরে অস্পষ্টভাবে দেখা যায়, গাছপালায় ছাওয়া ঘরবাড়ি, গ্রাম। দেখে মনে হয় সত্যিই শান্তির দেশ কালুন।

মিসরীয় সেনাপতি আর তার অধীনস্থ গ্রীক সৈনিকরা কেন এ-দেশ জয়ের পর নিছক লুটতরাজ চালিয়ে ফিরে যায়নি তা অনুমান করতে অসুবিধা হলো না। বিশাল বিস্তৃত তুষার ছাওয়া মরুভূমি আর পাহাড়ী এলাকা পেরিয়ে এসে এমন সবুজ সুন্দর দেশ দেখে ওরা বোধহয় এক স্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো, আর যুদ্ধ নয়, আমরা এখানেই থেকে যাবো, এখানেই মরবো। এবং স্থানীয় মহিলাদের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে সত্যিই থেকে গিয়েছিলো এদেশে।…

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হঠাৎ দূরে অগ্নি-পাহাড়ের ওপরে ধোয়ার স্তর উজ্জ্বল কমলা রঙ ধারণ করলো। কমলা আভা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে হতে এক সময় প্রায় সাদা হয়ে উঠলো। আগ্নেয়গিরির গর্ভ থেকে লকলক করে বেরিয়ে এলো আগুনের শিখা। স্তম্ভের ওপরে আংটার ভেতর দিয়ে দূরে প্রক্ষিপ্ত হলো উজ্জ্বল আলো। কালুন নগরী, নদী, ফসলের মাঠ, বনভূমি পেরিয়ে সোজা ছুটে গেল– হ্যাঁ, আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। পর পর তিনবার এমন হলো। তারপর ধীরে ধীরে আবার স্তিমিত হয়ে এলো অগ্নি-পাহাড়ের আগুন। মাঝিরা এবং অন্য সবাই ভীতরে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বিড় বিড় করে কি যেন আউড়ে চলেছে।

কি বলছে ওরা? জিজ্ঞেস করলো লিও।

প্রার্থনা করছে, ওই আলো—যার নাম হেস-এর পথ—ওদের কোনো ক্ষতি যেন না করে। ওদের বিশ্বাস এই আলো দেখা দেয়ার অর্থ অমঙ্গল নেমে আসবে দেশের ওপর।

মানে, সব সময় এই আলো দেখা যায় না?

না, খুব কম। তিন মাস আগে একবার দেখা গিয়েছিলো, আর এখন। এর আগে বেশ কয়েক বছর আর দেখা যায়নি।

একটু পরে চাঁদ উঠলো, উজ্জ্বল সাদা একটা গোলক। জ্যোৎস্নায় দেখলাম, ক্রমেই নগরের কাছাকাছি হচ্ছি আমরা। নিঃশব্দে বসে আছি। আকাশের চাঁদ আর নদীর পানিতে তার প্রতিবিম্ব দেখছি। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছি দূরে আলোকিত শহরটার দিকে। জল কেটে নৌকা এগোনোর মৃদু ছলাৎ ছল ছাড়া। আর কোনো শব্দ নেই। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো, একটা চিৎকার। অস্পষ্ট হলেও বুঝতে অসুবিধা হলো না, কেউ প্রাণের ভয়েই অমন চিৎকার করছে।

ক্রমে এগিয়ে আসছে চিৎকারের শব্দ। প্রতি মুহূর্তে স্পষ্ট এবং তীব্র হয়ে উঠছে। হঠাৎ দেখলাম মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে আসছে অস্পষ্ট কয়েকটা মূর্তি। নদীর যে পাশ দিয়ে আমাদের টাটুগুলো দৌড়ে চলেছে তার উল্টো পাশে। একটু পরেই চমৎকার তেজী একটা সাদা ঘোড়া উঠে এলো ওপাশের বাঁধানো পথের। ওপর। তার পিঠে একজন মানুষ। চিৎকারটা সে-ই করছে। সোজা হয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো লোকটা। চাঁদের আলোয় চকিতের জন্যে তার মুখ দেখতে পেলাম। স্পষ্ট আতঙ্ক আর মৃত্যুভয় যেন আঁকা রয়েছে সে মুখে।

ঝড়ের বেগে আমাদের পেরিয়ে গেল সে। তারপর, যেমন আচমকা ঘোড়াটা বেরিয়ে এসেছিলো তেমনি অকস্মাৎ বিশাল এক লাল কুকুর উঠে এলো পাড়ের নিচের অন্ধকার থেকে। ভয়ঙ্কর বেগে ছুটছে সেটা ঘোড়সওয়ারের পেছন পেছন। এক সেকেণ্ড পর আরেকটা কুকুর উঠে এলো বাঁধানো পথের ওপর। তারপর আরও একটা, তারপর অনেকগুলো।

মরণ-শ্বাপদ! লিওর হাত আঁকড়ে ধরে বিড় বিড় করে বললাম আমি।

হ্যাঁ! বললো ও। হতভাগা লোকটাকে তাড়া করছে। এই যে, শিকারী এসে গেছে।

বলতে না বলতেই দ্বিতীয় অশ্বারোহী উঠে এলো রাস্তায়। রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। কাঁধ থেকে ঝুলে পড়া আলখাল্লাটা বাতাসে উড়ছে। বাদুড়ের ডানার মতো। লম্বা একটা চাবুক লোকটার হাতে। আমাদের পাশ দিয়ে। যখন ছুটে যাচ্ছে এ-ও তাকালো ঘাড় ঘুরিয়ে। আমরা দেখলাম উন্মাদের দৃষ্টি তার চোখে। কোনো সন্দেহ নেই এ লোক পাগল!

খান! খান! বলে উঠলো সিমব্রি, সেই সাথে মাথা নোয়ালো কুর্নিশের ভঙ্গিতে।

কয়েক সেকেণ্ড পর দেখতে পেলাম খানের রক্ষীদের। সংখ্যায় আটজন। এদের হাতেও চাবুক। একটু পরপরই তাদের ঘোড়াগুলোর পিঠে সপাং করে বাড়ি পড়ছে।

শব্দগুলো ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এ সবের অর্থ কি, বন্ধু সিমব্রি?

খান তার নিজের রীতিতে বিচার করছেন, জবাব দিলো সে। যে তাঁর ক্রোধ জাগিয়েছে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে ইঁদুরের মতো তাড়া করে অবশেষে হত্যা করবেন।

ও কে? অপরাধই বা কি?

লোকটা জমিদার। এদেশে এত বড় জমিদার খুব কমই আছে। ওর অপরাধ, ও খানিয়ার কাছে প্রেম নিবেদন করেছিলো। খানিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছিলো, ওকে যদি বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলে ও খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাকে হত্যা করবে। আতেন রাজি হয়নি ওর প্রস্তাবে, বরং খানকে জানিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা। এই হলো ঘটনা।

এমন একজন বিশ্বস্ত স্ত্রী যার তাকে ভাগ্যবান না বলে উপায় নেই! কথাটা আমি না বলে পারলাম না। বৃদ্ধ ঝট করে ফিরলো আমার দিকে, তারপর যেন কিছু শোনেনি এমন ভঙ্গিতে হাত বুলাতে লাগলো তার শ্বেতশুভ্র দাড়িতে।

একটু পরেই আবার শোনা গেল মরণ-শ্বাপদের চিৎকার। হ্যাঁ, আবার এগিয়ে আসছে তারা। এবারও মাঠের ভেতর দিয়ে প্রথমে সাদা ঘোড়াটা, তারপর শ্বাপদগুলো। দূরত্ব অনেক কমে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পরিশ্রান্ত সাদা ঘোড়াটা। আগের মতো দ্রুত ছুটতে পারছে না। কোনোমতে বাঁধানো পাড়ের ওপর উঠলো সেটা। পরমুহূর্তে দেখলাম বিশাল লাল কুকুরগুলোর একটা লাফ দিলো। হাঁ হয়ে আছে মুখ। চাঁদের আলোয় তার শ্বদন্তগুলো ঝিকিয়ে উঠলো। নিমেষে মাঝের দূরত্বটুকু অতিক্রম করে কামড় বসালো সাদা ঘোড়ার পেছনের পায়ে। তীব্র আতঙ্কে তীক্ষ্ণ্ণ চিৎকার করে দুপায়ের ওপর খাড়া হয়ে গেল। ঘোড়াটা। ছিটকে পড়ে গেল আরোহী। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়ার চেষ্টা করলো সে। কিন্তু তার আগেই পৌঁছে গেছে পেছনের শ্বাপদগুলো। মুহূর্তে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো হতভাগ্য জমিদারকে। লাগাম টেনে ঘোড়া দাঁড় করালো খান। তাকিয়ে আছে উন্মত্ত জানোয়ারগুলোর দিকে। ধীরে ধীরে পরিতৃপ্তির পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে।

.

০৯.

একটু পরে আমরা পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে দ্বীপের যেখানটায় নদী দুভাগ হয়েছে সেই বিন্দুতে। পাথরের একটা জেটিতে নৌকা ভিড়লো। আমরা নেমে এলাম। একদল রক্ষী আমাদের স্বাগত জানানোর জন্যে অপেক্ষা করছিলো। তাদের পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম নগর-তোরণের দিকে।

আর দশটা প্রাচীন মধ্য এশীয় নগরের মতো দেখতে কালুন শহর। উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। স্থাপত্যশৈলীতে সৌন্দর্যের ছাপ বিশেষ নেই। খুব একটা বড়ও নয় নগরটা। সরু সরু পাথর বাঁধানো রাস্তা, আর সমতল ছাদওয়ালা বাড়িঘর-ব্যস।

তোরণ পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা। একটু পরে দ্বিতীয় একটা ফটকের সামনে পৌঁছুলাম। ভেতর থেকে বন্ধ। সিমব্রি এগিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিলো দরজায়। ওপাশ থেকে দুর্বোধ্য ভাষায় সাড়া দিলো কেউ। একই ভাষায় কিছু একটা জবাব দিলো সিমব্রি। প্রায় সাথে সাথে খুলে গেল ফটকের ভারি কপাট। ভেতরে ঢুকলাম আমরা। দুপাশে বাগান, মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে পথ।

বাগান পেরিয়ে বিরাট একটা দালান বা প্রাসাদের সামনে পৌঁছলাম। দালানটার এখানে সেখানে এলোমেলোভাবে মাথা তুলে আছে নিরেট পাথরের উঁচু উঁচু চূড়া। দেখলেই বোঝা যায় প্রাচীন মিশরীয় রীতিতে তৈরির চেষ্টা হয়েছিলো, কিন্তু কারিগরদের সাধ্যে কুলায়নি।

প্রাসাদের দরজা পেরিয়ে একটা বারান্দা ঘেরা উঠান। এই উঠান থেকে অনেকগুলো ছোট ছোট গলিপথ চলে গেছে বিভিন্ন কামরায়। এগুলোরই একটা ধরে অবশেষে পৌঁছুলাম আমাদের জন্যে নির্ধারিত বাসস্থানে। একটা বসার আর দুটো শোবার ঘর নিয়ে গড়ে উঠেছে ওটা। তিনটে ঘরই জমকালো আসবাবপত্রে ঠাসা, সবই প্রাচীন ঢংয়ের। তেলের লণ্ঠন জ্বলছে ঘরগুলোয়।

আমাদের রেখে বিদায় নিল সিমব্রি। যাওয়ার আগে বলে গেল, রক্ষীদলের প্রধান বাইরের ঘরে অপেক্ষা করবে। আমরা তৈরি হয়ে বেরোলেই সে আমাদের খাওয়ার ঘরে নিয়ে যাবে।

শোয়ার ঘরে ঢুকে দেখি কয়েকজন ভৃত্য, সম্ভবত ক্রীতদাস, অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে। আচার ব্যবহারে কেতাদুরস্ত। এদের সহায়তায় ভ্রমণের পোশাক ছেড়ে সাদা স্কারের নতুন ফ্রক কোট গায়ে চাপালাম। অন্য পোশাকগুলোও বদলে নিতে হলো। অবশেষে ভৃত্যরা মাথা নুইয়ে জানালো, আমাদের বেশ বিন্যাস সমাপ্ত।

বাইরের ঘরে এলাম। রক্ষীপ্রধান বিনীত ভঙ্গিতে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। অনেকগুলো ছোট বড় ঘর পেরিয়ে, বাক নিয়ে অবশেষে পৌঁছুলাম খাওয়ার ঘরে। বিশাল একটা হলকামরা। অনেকগুলো লণ্ঠনের আলোয় উজ্জ্বল আলোকিত। দেয়ালে দেয়ালে কারুকাজ করা পর্দা। ঘর গরম রাখার জন্যে এক ধারে বড় একটা চুল্লীতে পিট কয়লা পুড়ছে। 

কামরার এক প্রান্তে একটা বেদীমতো। তার ওপরে সরু, লম্বা একটা কাপড়ঢাকা টেবিল। টেবিলে রুপোর ঝকঝকে বাসন পেয়ালা সাজানো। কোনো মানুষ নেই এ-ঘরে। রক্ষী-প্রধানের সাথে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। একটু পরে এক ধারের পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকলো খানসামারা। তাদের পেছনে রূপার ঘণ্টায় বাড়ি দিতে দিতে একজন লোক; তারপর দশ বারোজন সভাসদের একটা দল, প্রত্যেকে আমাদের মতো সাদা পোশাক পরা। তাদের পেছন পেছন এলো সমসংখ্যক রমণী। বেশিরভাগই যুবী, সুন্দরী। আমাদের সামনে এসে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো তারা। আমরা জবাব দিলাম, একই ভঙ্গিতে।

নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ওরাও। পরস্পরকে পরীক্ষা করছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। অবশেষে তীক্ষ্ণ্ণস্বরে শিঙা বেজে উঠলো কোথাও। নকীব এসে ঘোষণা করলো–কালুনের মহামান্য খান ও খানিয়া আসছে! পর্দার ওপাশে একটা আলোকিত সরু পথে দুটো মূর্তি দেখা গেল—খান এবং খানিয়া। তাদের পেছনে শামান সিমব্রি ও কয়েকজন রাজপুরুষ।

হলঘরে প্রবেশ করলো খান। কেউ মুখ তুলে তাকালো না। সবার চেহারায় কেমন একটা অস্বস্তির ভাব চেপে বসেছে। খানের পরনেও সাদা পোশাক। পার্থক্য একটাই, আমরা বা পারিষদরা যেগুলো পরে আছি তার চেয়ে ওগুলো অনেক মূল্যবান, কাটছাটেও অন্যরকম। প্রথমেই আমার চোখ পড়লো ওর সেই উন্মত্ত চোখ দুটোর ওপর। এখনও তেমনি ভয়ঙ্কর পৈশাচিক দৃষ্টি তাতে। এমনিতে লোকটা দেখতে খারাপ না। চমৎকার স্বাস্থ্য। কেবল ঐ চোখ দুটো-ভয়ঙ্কর ক্রোধে জ্বলছে যেন সবসময়। আর খানিয়া-তোরণ-গৃহে যেমন দেখেছিলাম এখনও তেমন। সুন্দর। কেবল একটু দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে চেহারায়। আমাদের দেখা মাত্র একটু লাল আভা ধারণ করলো তার গাল। তবে মুহূর্তের জন্যে। তারপরই আমাদের এগোনোর ইশারা করে স্বামীকে বললো-প্রভু, এরা সেই আগন্তুক, এদের কথাই বলেছিলাম তোমাকে।

আমার ওপরেই প্রথমে পড়লো খানের চোখ। একটু যেন মজা পেলো আমার চেহারা দেখে। অভদ্রের মতো হেসে উঠলো জোরে। তারপর স্থানীয় ভাষার মিশেল দেয়া জঘন্য গ্রীকে বললো

কি অদ্ভুত একটা বুড়ো জন্তু! আগে কখনও দেখিনি তোমাকে, তাই না?

না, মহানুভব খান, আমি জবাব দিলাম, তবে আমি আপনাকে দেখেছি। আজ সন্ধ্যায়ই। আপনি শিকারে বেরিয়েছিলেন। পেলেন কিছু?

সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হলো সে। হাত ঘষতে ঘষতে জবাব দিলোপেয়েছি মানে? দারুণ জিনিস। দৌড়ে পালালেঞ্জিচেষ্টা করেছিলো, কিন্তু আমার কুকুরগুলো শেষ পর্যন্ত ওকে ধরে ফেলতে পেয়েছিলো। তারপর–

তোমার এসব নিষ্ঠুর কথাবার্তা থামাও তো! চিৎকার করলো খানিয়া।

আতেনের কাছ থেকে একটু সরে এলো খান। লিওর দিকে তাকালো।

সোনালি দাড়িওয়ালা বিশালদেহী লিওকে এই প্রথম ভালো করে লক্ষ করলো সে। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

তুমি নিশ্চয়ই খানিয়ার অপর বন্ধু? অবশেষে কথা ফুটলো তার মুখে। এতক্ষণে বুঝতে পারছি, কেন অত কষ্ট স্বীকার করে ও পার্বত্য-তোরণের কাছে গিয়েছিলো! ভালো কথা, তুমি কিন্তু সতর্ক থেকো, না হলে তোমাকেও শিকার হতে হবে।

শুনেই রেগে গেল লিও। জবাব দেয়ার জন্য মুখ খুলতে যাবে, বাধা দিলাম আমি। ইংরেজিতে বললাম, উহুঁ, কিছু বোলো না, লোকটা পাগল।

পাগল হোক আর যা-ই হোক, গরগরিয়ে উঠলো লিও, আমার ওপর ওই অভিশপ্ত কুত্তাগুলোকে লেলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে আমি ওর ঘাড় ভেঙে ফেলবো।

আমি আর কিছু বলার আগেই খানিয়া ইশারায় তার পাশে বসতে বললো ওকে। অন্যপাশে বসালো আমাকে, ও আর ওর চাচা অভিভাবকের মাঝখানে। আর খান বসলো কয়েকটা চেয়ার পরে সুন্দরী দুই রমণীর মাঝখানে।

খাবার পরিবেশন করা হলো। মাছ, ভেড়ার মাংস, মিষ্টি। সবই অত্যন্ত সুস্বাদু। তারপর দেয়া হলো কড়া পানীয়। পথে কষ্ট হয়েছে কিনা—এই ধরনের দু’একটা প্রশ্ন করলো খানিয়া আমাকে। বাকি সময়টুকু লিওর সাথে গল্প করে গেল সে। আর আমি আলাপ জমালাম বৃদ্ধ শামান সিমব্রির সাথে। তার কাছ থেকে যা যা জানতে পারলাম তা হলো—

বাণিজ্য ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অপরিচিত কালুনের মানুষদের কাছে। এর প্রধান কারণ বাইরের দুনিয়ার সাথে ওদের কোনো যোগাযোগ নেই। দেশটা বড় এবং ঘনবসতিপূর্ণ হলেও চারদিক দিয়ে দুর্গম পাহাড় ঘেরা বলে বাইরে থেকে কেউ আসতে পারে না, এখান থেকেও কেউ যায় না বাইরে। যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করে না। নিজেরা যা উৎপাদন করে তা নিয়েই খুশি সবাই। প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস নিজেরাই তৈরি করে নেয়। ধাতুশিল্পেও মোটামুটি উন্নত কালুন। টাকা পয়সার কোনো অস্তিত্ব নেই। বিনিময়ই ব্যবসার একমাত্র মাধ্যম। রাজস্বের মাধ্যমও তাই।

প্রাচীনকালে যে বিদেশী জাতি স্থানীয়দের পদানত করেছিলো সংখ্যায় খুব কম হলেও এখনও তারাই শাসন করছে দেশটা। শাসক শাসিত বা বিজয়ী বিজিত কোনো পক্ষই রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার ব্যাপারে মনোযোগী নয়-কোনো কালেই ছিলো না। ফলে একটা প্রায় অসভ্য আর একটা সুসভ্য জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই জাতি। তবে শাসন ক্ষমতা শেষ পর্যন্ত রয়ে গেছে বিদেশ থেকে আসা লোকদের হাতেই।

সংখ্যায় যখন ওরা এত অল্প, সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানীয়রা ওদের শাসন মেনে নিচ্ছে কেন? জিজ্ঞেস করলাম আমি।

কাঁধ ঝাঁকালো সিমব্রি। স্থানীয়রা মোটেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, তাই ব্যাপারটা। সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান খানিয়াকে দুপক্ষই পছন্দ করে। বিশেষ করে দরিদ্ররা। আর দরিদ্রের সংখ্যাই এদেশে বেশি। অবশ্য খানিয়াকে সবাই যেমন পছন্দ করে খানকে তেমন করে অপছন্দ। জনসাধারণ তো মাঝে-মধ্যে। খোলাখুলিই বলে, অত্যাচারী খান মরলে তারা খুশি হয়, সেক্ষেত্রে খানিয়া নতুন একজন স্বামী বেছে নিতে পারবে। পাগল হলেও খান এসব কথা জানে। সেজন্যে দেশের প্রতিটা গণ্যমান্য লোককে ও সন্দেহ করে, ঈর্ষা করে।

ঈর্ষা কেন বলছেন, আমি বললাম, সত্যি সত্যি ও হয়তো স্ত্রীকে ভালোবাসে।

হয়তো। কিন্তু আতেন তো ওকে ভালোবাসে না। ওর সভাসদ, মানে এখানে যারা আছে তাদেরও কাউকে না।

সত্যিই তাই, এসব লোককে পছন্দ করা প্রায় অসম্ভব। ঘণ্টাখানেকও হয়নি খেতে এসেছে, এর ভেতরে সবাই পুরোপুরি মাতাল হয়ে গেছে। মেয়েরাও বাদ যায়নি। খানের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। চেয়ারে হেলান দিয়ে হেঁড়ে গলায় চিৎকার করছে। এক হাতে জড়িয়ে ধরেছে সুন্দরী এক সঙ্গিনীর গলা। অন্য এক সুন্দরী সোনার পেয়ালায় করে মদ ঢেলে দিচ্ছে তার গলায়।

দেখ, লিওকে বললো খানিয়া, বিরক্তিতে কুঁচকে উঠেছে চোখ-মুখ, দেখ আমার সঙ্গীদের অবস্থা দেখ। কালুনের খানিয়া মানে কি তা বোঝো!।

রাজসভা থেকে এদের বিদায় করে দেন না কেন? জিজ্ঞেস করলো লিও।

বিদায় করলে রাজসভা বলেই কিছু থাকবে না যে। এদের চেয়ে ভালো স্বভাবের মানুষ এদেশে কই? নিরীহ গরীব মানুষের কঠোর শ্রমে উপার্জিত সম্পদে ফুর্তি করে এরা। ছি! হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরল খানিয়ার। যাকগে, তোমরা নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত? যাও বিশ্রাম করোগে। কাল আমরা একসাথে ঘোড়ায় চড়তে বেরোবো। একজন রাজপুরুষকে ডেকে আমাদের পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দিলো সে।

মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলাম আমরা। সিমব্রি-ও যাচ্ছে আমাদের পৌঁছে দেয়ার জন্যে। বিশাল হলঘরটার দরজার কাছে পৌঁছে গেছি, এমন সময় পেছন থেকে শোনা গেল খানের কণ্ঠস্বর–

আমাদের খুব ফুর্তিবাজ মনে হলো, না? কেন হবে না? কদিন বাঁচবো কেউ বলতে পারে? কিন্তু তুমি, এই হলদে-চুলো ব্যাটা, আতেনকে অমন করে তাকাতে দিয়ো না তোমার দিকে। ও আমার বউ। আর কখনও যদি দেখি ও অমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে তোমার দিকে, তাহলে, বলে দিচ্ছি, নির্ঘাৎ তোমাকে শিকার করবো আমি।

হো-হো করে উঠলো অন্য মাতালগুলো। ঘুরে দাঁড়াতে গেল লিও। কিন্তু তার আগেই সিমব্রি ওর হাত ধরে বের করে নিয়ে গেল ঘর থেকে।

বাইরে বেরিয়েই লিও সিমব্রিকে বললো, বন্ধু, তোমাদের খান আমাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।

ভয় পাওয়ার কিছু নেই, জবাব দিলো অভিভাবক। খানিয়া যতক্ষণ হুমকি দিচ্ছে না ততক্ষণ ভয়ের কিছু নেই। আসলে তো দেশের শাসনকর্তা আতেন, আমি ওকে সহায়তা করি।

তাহলে আপনাকেই বলছি, বললো লিও, ঐ মাতাল লোকটার কাছ থেকে দূরে রাখবেন আমাকে। আমি যদি আক্রান্ত হই তাহলে কিন্তু আত্মরক্ষার চেষ্টা করবো।

সেক্ষেত্রে কে তোমাকে দোষ দেবে? সূক্ষ্ম, রহস্যময় একটা হাসি হেসে বললো সিমব্রি।

ইতিমধ্যে আমরা পৌঁছে গেছি আমাদের থাকার জায়গায়। বিদায় নিলো বৃদ্ধ শামান। দুটো বিছানাই এক ঘরে এনে শুয়ে পড়লাম আমি আর লিও। এক ঘুমেই রাত শেষ। ভোরে মরণ-শ্বাপদের চিৎকারে ঘুম ভাঙলো আমাদের।

.

দুপুরের একটু পরে খানিয়া আতেনের সাথে বেড়াতে বের হলাম। পেছন পেছন আসছে খানিয়ার দেহরক্ষী বাহিনীর একদল সৈনিক। প্রথমেই সে আমাদের নিয়ে গেল মরণ-শ্বাপদদের যেখানে রাখা হয় সেখানে। লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা প্রশস্ত একটা উঠানে দুধরনের কুকুর দেখলাম। লাল আর কালো। কাল রাতেরগুলোর মতোই বিরাট একেকটা। আমাদের দেখামাত্র চঞ্চল হয়ে উঠলো তারা। রক্ত হিম করা স্বরে চেঁচাচ্ছে আর লাফাচ্ছে, পারলে এক্ষুণি বেরিয়ে এসে টুটি টিপে ধরে আমাদের। ভাগ্য ভালো, বেড়া যথেষ্ট মজবুত, তেমন কিছু করতে পারলো না ওরা।

এরপর খানিয়া নগর দেখাতে নিয়ে গেল। কাল রাজপ্রাসাদে ঢোকার আগে যেটুকু দেখেছিলাম তার চেয়ে বেশি কিছু দেখার ছিলো না। সুতরাং একটু পরে যখন আতেন নদীর ওপর উঁচু একটা সেতু পেরিয়ে আমাদের ফসলের মাঠে নিয়ে গেল তখন মোটেই দুঃখ পেলাম না। কৃষকদের দেখলাম, মাঠে কাজ করছে। খানিয়াকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এরা সবাই স্থানীয় বাসিন্দাদের বংশধর। কৃষিকাজই এদের একমাত্র জীবিকা। জমির তুলনায় মানুষ বেশি বলে চাষবাস ছাড়া অন্য কাজে এক ইঞ্চি মাটিও এরা নষ্ট করে না। অদ্ভুত এক সেচের পদ্ধতি গড়ে তুলেছে দেশজুড়ে। সরু সরু খাল কেটে পানি নিয়ে আসা হয়েছে নদী থেকে মাঠের গভীর পর্যন্ত। অনেক স্ত্রীলোককেও দেখলাম খেতে কাজ করতে।

কোনো বছর যদি খরা বা অতিবৃষ্টি হয় তাহলে কি ঘটে আপনাদের এখানে? জিজ্ঞেস করলো লিও।

দুর্ভিক্ষ, গম্ভীর মুখে জবাব দিলো খানিয়া। হাজার হাজার মানুষ তখন না খেয়ে মরে।

এ বছরটা কেমন? ভালো না মন্দ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

খুব সম্ভব মন্দ। এখনও নদীর পানি যথেষ্ট বাড়েনি। বৃষ্টিও হয়নি খুব বেশি। এ-অবস্থা চললে কদিন পরে সেচের পানি পাওয়া যাবে না। কাল সন্ধ্যায় আবার অগ্নি-পর্বতের চূড়ায় আগুন দেখা গেছে। ওটা অশুভ সংকেত। যে বছর ঐ চূড়ায় আগুন দেখা দেয় সে বছর খরা হয়।

সেক্ষেত্রে এখনই ঐ পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়া উচিত আমাদের, একটু হেসে লিও বললো।

মানে? তোমরা মৃত্যুর মাঝে আশ্রয় চাও? মুখ কালো করে বললো খানিয়া। বিদেশী অতিথি, শুনে রাখো, আমি বেঁচে থাকতে ওখানে যেতে পারবে না তুমি।

কেন নয়, খানিয়া?

আমার ইচ্ছা, প্রভু লিও। এদেশে আমার ইচ্ছাই আইন। চলো ফেরা যাক।

.

১০.

এরপর দীর্ঘ তিনটে মাস আমাদের কাটাতে হলো কালুন নগরীতে। ভয়ঙ্কর, জঘন্য, ঘৃণিত তিনটে মাস। জীবনে আর কখনও এত বাজে সময় কাটেনি আমাদের। একদিকে খানের হুমকি, অন্যদিকে খানিয়ার। খানিয়া শুধু হুমকি নয়, মাঝে মাঝে অস্বাভাবিক ভালো ব্যবহার করে, সেটা আরও অসহ্য লাগে আমার কাছে। লিওর কাছেও। দেশের জনসাধারণ মোটেই ভাল দৃষ্টিতে দেখছে না। আমাদের। খানিয়ার কথাই সত্যি হয়েছে ভয়ঙ্কর খরা এবং অনাবৃষ্টি শুরু হয়েছে কালুনে। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার জনগণ সেজন্যে দুই বিদেশী আগন্তুককেই দায়ী করছে। আমরা বাইরে বেরোলে ওরা দল বেঁধে দেখতে আসে। দু’একজন বলাবলিও করে, ওদের এই দুরবস্থার জন্যে আমরাই দায়ী। শেষে এমন . হলো, বাইরে বেরোনোই বন্ধ হয়ে গেল আমাদের। মাঝে মাঝে দু’একবার যা বেরোই তা খানিয়ার সঙ্গে। ব্যাপারটা আরও ব্রিতকর। খানিয়ার উদ্দেশ্য আমরা জানি তাই চেষ্টা করি ওকে এড়িয়ে চলার। তবু ওর ইচ্ছায় ওর সাথে যখন বেরোতে হয়, আমাদের, বিশেষ করে লিওর মনের অবস্থা কেমন হয়, সহজেই অনুমেয়।

এক রাতে সিমব্রি তার প্রাসাদচূড়ার ঘরে আমাদের খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো। খাওয়া-দাওয়ার পর দেখলাম, গম্ভীর হয়ে গেছে লিও। কি যেন ভাবছে।

বন্ধু সিমব্রি, হঠাৎ বলে উঠলো সে, আপনার কাছে একটা অনুগ্রহ চাইবো–খানিয়াকে একটু বলবেন, দয়া করে যেন আমাদের পথে চলে যেতে দেয়। আমাদের।

বুড়ো শামানের চতুর মুখটা মুহূর্তে যেন পাথরে গড়া হয়ে গেল।

তুমি নিজেই তো একথা বলতে পারো খানিয়াকে। আমার মনে হয় না ও অস্বীকার করবে।

বলেও যে লাভ হয়নি তা বোধহয় আমার চেয়ে আপনি ভালো জানেন। ফালতু কথা বাদ দিয়ে আসুন বাস্তব অবস্থাটা বিশ্লেষণ করে দেখা যাক-আমার মনে হয়েছে খানিয়া আতেন তার স্বামীকে নিয়ে সুখী নয়।

তোমার দৃষ্টি খুব প্রখর।

আমার আরও মনে হয়েছে, বলতে বলতে একটু লাল হলো লিওর মুখ, আমার প্রতি, সত্যি কথা বলতে কি, অযাচিত ভাবেই একটু বেশি সৌজন্য দেখাচ্ছে খানিয়া।

তোরণ-গৃহের সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলছো তো?

না, শুধু তোরণ-গৃহে না, এখানে আসার পরও কিছু স্মৃতির জন্ম হয়েছে।

দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে শামান বললো, তারপর?

তারপর আর বিশেষ কিছু না। সিমব্রি, আমি চাই না আপনার দেশের প্রথম রমণীর নামে কলঙ্ক রটুক।

কিছু এসে যায় না, কিছু এসে যায় না। তুমি যাকে কলঙ্ক বলছে তা নিয়ে এদেশের মানুষ খুব একটা মাথা ঘামায় না। যাহোক, কলঙ্ক ছাড়াই যদি সব ব্যাপার গুছিয়ে নেয়া যায়? যদি, ধরো, খানিয়া নতুন একটা স্বামী পছন্দ করে?

তা কি করে সম্ভব? এক স্বামী জীবিও আঁকতে আর এক স্বামী কি করে গ্রহণ করবে ও!

এখনকার স্বামী যদি আর বেঁচে থাকে? মরতে কতক্ষণ? খান র‍্যাসেন যে হারে মদ গিলছে আজকাল!

মানে লোকটাকে খুন করা হবে! ভয়ানক হয়ে উঠেছে লিওর চেহারা। না, শামান সিমব্রি, এ ধরনের কাজ আমার দ্বারা হবে না।

এমন সময় পেছনে একটা খসখস আওয়াজ শুনে আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। ঘরটার আয়তন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমার একটু পেছনেই একটা পর্দা ঝুলছিলো। ভেবেছিলাম, ওটা বুঝি দেয়ালে ঝুলছে। এখন বুঝলাম, না, ঐ পর্দা দিয়ে ঘরটাকে দুভাগ করা হয়েছিলো। পর্দার ওপাশের অংশে শামানের শোয়ার জায়গা। মেঝেতে, বিছানায় পড়ে আছে তার যাদুবিদ্যার যন্ত্রপাতি, রাশিচক্র ইত্যাদি। আর পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো খানিয়া আতেন।

অপরাধের কথা বললো কে? শীতল গলায় প্রশ্ন করলো সে। তুমি, প্রভু লিও?

চেয়ার থেকে উঠে খানিয়ার মুখোমুখি হলো লিও।

হয়তো আপনি আহত হয়েছেন, খানিয়া, কিন্তু আমি খুশি, আপনি আমার কথা শুনে ফেলেছেন।

কেন, আহত হবো কেন? অন্তত একজন সৎ সত্যবাদী লোকের দেখা পেলাম জীবনে। না, আমি তোমার কথায় মোটেই দুঃখ পাইনি। কিন্তু, লিও ভিনসি, নিয়তির লিখন খণ্ডানো কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। যা একবার লেখা হয়ে গেছে তা, মোছা সম্ভব নয়।

নিঃসন্দেহে, খানিয়া; কিন্তু কি লেখা হয়ে গেছে?

ওকে বলো, শামান।

পর্দার ওপাশে চলে গেল সিমব্রি। একটা তুলোট কাগজের টুকরো নিয়ে এসে পড়তে লাগলো: স্বর্গ তার অনির্বাণ সংকেতের মাধ্যমে ঘোষণা করছে যে, পরবর্তী নতুন চাঁদের আগেই খান র‍্যাসেন মারা যাবে। দুর্গম পাহাড় পেরিয়ে যে আগন্তুক প্রভু এসেছে তার হাতে সে নিহত হবে।

স্বর্গ তাহলে মিথ্যা ঘোষণা করেছে, বললো লিও।

তা তোমার মনে হতে পারে, জবাব দিলো আতেন, কিন্তু যা পূর্ব নির্ধারিত তা ঘটবেই। আমার হাতে নয়, আমার কোনো ভৃত্যের হাতে নয়, তোমার হাতেই মরবে ও।

কিন্তু, আমার হাতে কেন? কেন হলির হাতে নয়? তবু, অমন কিছু যদি ঘটেই, খানের শোকাতুর স্ত্রী নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নেবেন?

ঠাট্টা করছো, লিও ভিসি, আমার এই স্বামীকে আমি কি চোখে দেখি তা জানার পরও?

বুঝতে পারছি প্রকৃত সংকটের মুহূর্ত উপস্থিত। লিও-ও বুঝতে পেরেছে। ও বললো-আপনার উদ্দেশ্য কি পরিষ্কার করে বলুন, খানিয়া। আমাদের দুজনের জন্যেই তা মঙ্গলজনক হবে।

হ্যাঁ, বলবো, প্রভু। এই নিয়তি নির্ধারিত ব্যাপারের শুরু কোথায় আমি জানি না। যেখান থেকে জানতে শুরু করেছি সেখান থেকেই বলছি। শোনো, লিও ভিনসি, আমি যখন শিশু তখন থেকেই তুমি হানা দিয়ে চলেছে আমার মনে। প্রথম যখন তোমাকে নদীর পাড়ে দেখি, তোমার মুখ আমার অপরিচিত মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে, যেন কতদিনের চেনা। স্বপ্নের ভেতর তোমার সাথে আমার এই পরিচয়। আমি তখন খুব ছোট, নদীর তীরে ফুলের ভেতর শুয়ে ছিলাম একদিন, তুমি সেদিন প্রথম এলে আমার স্বপ্নে—বিশ্বাস না হয় আমার চাচাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, সত্যি বলছি কিনা। তুমিও তখন খুব ছোট। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর তুমি এসেছো আমার ঘুমের ভেতর। অবশেষে আমি বুঝতে শিখেছি তুমি আমার। আমার হৃদয়ের যাদুই আমাকে এ জ্ঞান দিয়েছে।

তারপর অনেক বছর কেটে গেছে, তুমি আরও কাছাকাছি হয়েছে আমার; ধীরে, খুব ধীরে কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই কাছে এসেছে। অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত দিনটি এলো। পাহাড় পেরিয়ে, মরুভূমি তুষার পেরিয়ে সশরীরে তুমি এলে আমার সামনে (তিন চাঁদ আগে এক রাতে চাচা শামানের সঙ্গে বসে ছিলাম আমি এই ঘরে, যাদুবিদ্যার পাঠ নিচ্ছিলাম। সেই সময় হঠাৎ অলৌকিক এক দৃশ্য ভেসে, উঠলো আমার মনের পর্দায়।

তোমাকে দেখলাম-হা, স্বপ্নে নয়, জেগে জেগে। দেখলাম, তুমি আর তোমার সঙ্গী কোনোমতে ঝুলে আছে সেই গিরিখাতের মাঝামাঝি এক ভাঙা বরফের কানায়। দেরি না করে চাচাকে নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। বুকের ভেতর দুরু দুরু করছিলো, হয়তো এরমধ্যে ঐ ভয়ানক জায়গা থেকে পড়ে মরে গেছে তোমরা।

তারপর, যখন আমরা অপেক্ষা করছি, হঠাৎ দেখতে পেলাম ছোট দুটো মূর্তি, অনেক উপরে, বিপজ্জনকভাবে নেমে আসছে বরফের থাম বেয়ে। বাকিটুকু তোমরা জানো। রুদ্ধশ্বাসে আমরা দেখলাম, তুমি পড়ে গিয়ে ঝুলতে লাগলে রশি বাঁধা অবস্থায়। হ্যাঁ, তারপর তোমার সাহসী সঙ্গীকে দেখলাম, তোমার পেছন পেছন ঝাঁপ দিলো।

কিন্তু, শেষ পর্যন্ত কে উদ্ধার করলো তোমাকে? চাচা লাঠি এগিয়ে দিয়েছিলো। কোনো লাভ হয়েছিলো তাজে আসলে সব নিয়তির বিধান, তুমি আমি চাইলেই কি খণ্ডাতে পারবো?

শেষ করলো আতেন। একটু ঝুঁকে বসলো টেবিলে। লিওর দিকে চোখ।

আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, লিও বললো, সেজন্যে আবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। কিন্তু যা বললেন তা যদি সত্যি হয় আরেকজনকে বিয়ে করলেন কেন?

এবার যেন কুঁকড়ে গেল খানিয়া।

ওহ! সেজন্যে আমাকে দোষ দিও না। দেশের স্বার্থে পাগলটাকে বিয়ে করতে হয়েছে। সবাই এমনভাবে ধরেছিলো। হ্যাঁ, তুমিও, চাচা সিমব্রি। কেন? জনগণের স্বার্থে র‍্যাসেন আর আমার রাজ্যের ভেতর যুদ্ধ বন্ধ করা দরকার। ওকে বিয়ে করলেই তা নাকি সবচেয়ে সহজে সম্ভব। হায়রে জনগণ! হায়রে আমার দেশ!

বুঝলাম আপনার দোষ নেই, বললো লিও। কিন্তু ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক ঐ লোকটাকে বিয়ে করে যে গেরো আপনি দিয়েছেন, ওর প্রাণ হরণ করে আমি কেন তা কাটতে যাবো? তাছাড়া স্বর্গের ঘোষণা আর অলৌকিক দর্শনের যে কথা আপনি বলছেন তা আমি এক বিন্দু বিশ্বাস করিনি। আপনি আমাদের উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন, কারণ মহাশক্তিমতি হেসা, অগ্নিপর্বতের আত্মা আপনাকে  সেরকমই নির্দেশ দিয়েছিলেন।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো আতেন। তুমি কি করে জানলে একথা?

যেমন করে আরও অনেক কিছু জেনেছি। দেখুন, আমার মনে হয় আপনি সত্যি বললেই ভালো করবেন।

কালো হয়ে গেল আতেনের মুখ। থুতনি ডুবে গেল বুকে। তীব্র ক্রোধে ফিসফিস করে উঠলো, কে বললো এ কথা? শামান, তুমি? ছোবল দিতে উদ্যত ফনিনীর মতো চাচার দিকে তাকালো সে।

আতেন, আতেন! মিনতি ভরা কণ্ঠস্বর সিমব্রির। শান্ত হও! তুমি ভালো। করেই জানো, আমি বলিনি।

তাহলে তুই, বানরমুখো ভবঘুরে, শয়তানের তল্পিবাহক, তুই-ই বলেছিস! ওহ! কেন তোকে প্রথমেই খুন করলাম না? ঠিক আছে, ভুলটা শুধরে নেবার সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি।

এই যে, ভদ্রমহিলা, অত্যন্ত মসৃণ গলায় আমি জবাব দিলাম, তোমার চাচার মতো আমাকেও কি যাদুকর ভেবেছো?

আচমকা আমার মুখে তুমি সম্বোধন শুনে একটু থমকালো খানিয়া। কিন্তু মুহূর্তের জন্যে। তারপর বললো, হ্যাঁ, আমবিশ্বাস তুই-ও যাদুকর। আর ঐ পাহাড়ের আগুনের ভেতর থাকে তোর জর্নিবানি, যে তোকে শিখিয়েছে এই বিদ্যা।

ছি ছি, খানিয়া, তোমার মতো একজন মহিলার মুখে এমন কুৎসিত ভাষা! যাকগে, এখন বলো, আমরা আসার পর যে সংবাদ পাঠিয়েছে তার জবাবে হেসা কি বলেছেন?

শোনো, ও জবাব দেয়ার আগেই লিও বলে উঠলো, ও-ও এখন তুমি করে সম্বোধন করছে খানিয়াকে। আমি একটা দৈব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্যে ঐ পাহাড়ে যাবো, তারপর তোমরা মীমাংসা কোরো কে বেশি ক্ষমতাবান, কালুনের খানিয়া না অগ্নি-গৃহের হেসা।

শুনলো আতেন। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর একটু হেসে বললো-এ-ই তোমার ইচ্ছা? কিন্তু, আমার মনে হয় না ওখানে এমন কেউ আছে যাকে তুমি বিয়ে করতে চাইতে পারো। ওখানে আগুন আর নির্লজ্জ অশুভ আত্মা ছাড়া তো কিছু নেই, গভীর দুঃখে উচ্চারণ করছে এমন ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে বললো খানিয়া।

আমার দেশের কিছু গোপন ব্যাপার আছে, একই রকম শীতল গলায় বলে চললো সে, কোনো বিদেশীকেই সেসব জানতে দেয়া হবে না। আমি আবার তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আমি বেঁচে থাকতে ওই পাহাড়ে যেতে তুমি পারবে না। আরও শুনে রাখো, লিও ভিনসি, আমি তোমার সামনে আমার হৃদয় মেলে দিয়েছি, জবাবে কি শুনেছি?-আমার খোঁজে তুমি আসোনি। এসেছো এক ডাইনীর খোঁজে। শুনে রাখো, লিও ভিনসি, ওকে তুমি কখনোই পাবে না। আমি তোমাকে আর কিছু বলবো না। তবে তুমি খুব বেশি জেনে ফেলেছে। আর সময় দেয়া যায় না, কাল সূর্যাস্তের ভেতর তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আতেনের প্রতিশোধ স্পৃহার শিকার হবে, না তার প্রেমের মর্যাদা দেবে। আমি চাই না। আমার দেশের মানুষ বলাবলি করার সুযোগ পাক, তাদের খানিয়া এক বিদেশীকে প্রেম-নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

ধীরে ধীরে, গাঢ় অথচ অনুচ্চ স্বরে ও বলে গেল কথাগুলো। প্রতিটা শব্দ যেন বিন্দু বিন্দু রক্ত হয়ে ঝরে পড়লো ওর ঠোঁট থেকে। দৃশ্যটা কখনও ভুলবো না আমি। নিশাচর পাখির মতো মিটমিটে চোখে তাকিয়ে আছে বৃদ্ধ যাদুকর, পাশে রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়ানো কালুনের দীর্ঘদেহী তন্বী রানী আতেন। দুজনেরই দৃষ্টি লিওর বিরাট অবয়বটার দিকে। একজনের চোখে ভয় মেশানো প্রশ্ন, অন্যজনের দৃষ্টিতে জিঘাংসা। বুঝতে পারছি এখন কিছু একটা বলা দরকার, কিন্তু কি, ভেবে পাচ্ছি না। আমিও ওদের মতোই নির্বাক তাকিয়ে আছি ওদের দিকে।

হঠাৎ খসখস একটা শব্দ হলো পেছনে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম আমি। অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘ এক ছায়া মূর্তি। আমার সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্র সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো সে। আলোর ভেতর চলে এলো। তারপর তীব্র শব্দে ফেটে পড়লো বুনো অট্টহাসিতে।

ছায়ামূর্তি আর কেউ নয়, খান।

মুখ তুলতেই আতেনও দেখতে পেলো তাকে। ভয়ানক ক্রোধে জ্বলে উঠলো খানিয়ার চোখ।

এখানে কি করছো, র‍্যাসেন? গর্জে উঠলো সে। আমার পেছনে উঁকি মারতে এসেছো? যাও, তোমার রাজসভার মদ আর মেয়েমানুষের কাছে ফিরে যাও!

এখনও হেসে চলেছে লোকটা, হায়েনা যেমন হাসে।

কি শুনেছো তুমি? জিজ্ঞেস করলো আতেন, যে এত খুশি হয়ে উঠেছো?

কি শুনেছি? ওহহ! আমি শুনেছি, খানিয়া, আমার স্ত্রী, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, আমার সভার মেয়েমানুষদের দেখলে ঘেন্নায় যার নাক কুঁচকে ওঠে, আমার সেই স্ত্রী আমাকে কেন বিয়ে করেছিল। আমি শুনেছি, আমার সেই প্রিয়তমা স্ত্রী এক হলদে দাড়িওয়ালা বিদেশীর কাছে প্রেম নিবেদন করেছে, আর সেই বিদেশী তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে হা-হা-হি-হি-হি… তীব্র তীক্ষ্ণ্ণ হয়ে উঠলো তার হাসির শব্দ। এমনভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, আমি আমার প্রাসাদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মেয়েটাকেও অমনভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারতাম না।

আমি আরও শুনেছি একটা জানা কথা—আমি পাগল। বিদেশীরা, শোনো, আমি পাগল, কারণ জানো? ঐ—ঐ নরকের কীট, ইদুরের বাচ্চা, হাত তুলে সিমব্রির দিকে ইশারা করলো সে, বিয়ের ভোজে আমার মদের সাথে ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলো। ভালোই কাজ করেছে ওর ওষুধ। সত্যি কথা বলছি, খানিয়া আতেনের চেয়ে বেশি ঘৃণা আমি কাউকে করি না। ওর স্পর্শে আমার গা গুলিয়ে ওঠে, বাতাস বিষিয়ে যায় ওর উপস্থিতিতে।

হলদে-দাড়ি, তোমারও নিশ্চয়ই তেমন হয়েছে? ঐ বুড়ো ইঁদুরের কাছে প্রেম জাগানিয়া ওষুধ, চাও, পারবে দিতে, দেখবে কত সুন্দর, মিষ্টি-মোহনীয় লাগছে ওকে। কয়েকটা মাস পরম আনন্দে কাটিয়ে যেতে পারবে। আবার সেই তীক্ষ্ণ্ণ তীব্র হাসি হেসে উঠলো র‍্যাসেন।

নিঃশব্দে, পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনলো আতেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে কুর্নিশ করলো আমাদের।

অতিথিরা, বললো সে, আমার সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় ঘটে যাওয়া এই ঘটনার জন্যে আমি ক্ষমা চাইছি। কি করবে বলো দুর্নীতির পঙ্কে নিমজ্জিত অশুভ এক দেশে তোমরা এসেছে। খান র‍্যাসেন, তোমার নিয়তি নির্ধারিত হয়ে গেছে, আমি তাকে ত্বরান্বিত করতে চাই না। কারণ, সামান্য সময়ের জন্যে হলেও অন্তত একবার আমরা সত্যিই কাছাকাছি এসেছিলাম। চাচা সিমব্রি, আমার সাথে চলো। আমার এখন অবলম্বন দরকার, তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার?

উঠে দাঁড়িয়ে পায়ে পায়ে এগোলো বৃদ্ধ শামান। খানের সামনে পৌঁছে থামলো একটু। স্থির চোখে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দৃষ্টি বুলালো। তারপর বললো-আমার চোখের সামনে তোমার জন্ম, র‍্যাসেন, অশুভ এক মেয়েমানুষের গর্ভে, আমি ছাড়া আর কেউ জানে না তোমার বাপের পরিচয়। সে রাতে অগ্নি পর্বতের চূড়ায় আগুন লকলকিয়ে উঠেছিলো, তারারা মুখ লুকিয়েছিলো লজ্জায়। তোমাকে বড় হয়ে উঠতে দেখেছি আমি, র‍্যাসেন, তোমার লাম্পট্যও দেখেছি, তোমারই বিয়ের ভোজ থেকে তুমি উঠে গিয়েছিলে এক স্বৈরিণীর গলা জড়িয়ে ধরে। চাষীদের উর্বরা চাষের জমি কেড়ে নিয়ে তুমি বাগান বানিয়েছে। যাদেরটা নিলে তারা বাঁচলো কি মরলো দেখারও প্রয়োজন বোধ করেনি। ভেবেছো এসবের প্রতিফল তুমি পাবে না? অবশ্যই পাবে, খান র‍্যাসেন, কি ভয়ঙ্কর প্রতিফল তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। শিগগিরই তুমি মরবে, র‍্যাসেন, যন্ত্রণাদায়ক রক্তাক্ত মৃত্যু তোমাকে গ্রাস করবে। তোমার চেয়ে যোগ্য কেউ তখন তোমার জায়গা দখল করবে। দেশে স্বস্তি ফিরে আসবে।

ভয়ে কাঁটা হয়ে শুনছি আমি। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এই বোধহয় খান তলোয়ার বের করে দুটুকরো করে ফেললো বৃদ্ধকে। কিন্তু আশ্চর্য, তেমন কিছু করলো না র‍্যাসেন, বরং কুঁকড়ে গেল যেন। পা পা করে পিছিয়ে গেল তার সেই কোনায়। দৃষ্টি নেমে এসেছে মাটিতে, থুতনি ঠেকেছে গলায়।

আতেনের পাশে গিয়ে তার হাত ধরলো সিমব্রি। দরজার কাছে পৌঁছে ঘুরে দাঁড়ালো আবার। একই রকম নিরুদ্বেগ, নিষ্কম্প গলায় বললো, খান র‍্যাসেন, আমি তোমাকে তুলেছি, আমিই তোমাকে নামিয়ে আনবো। রক্তাক্ত অবস্থায় যখন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে তখন স্মরণ কোরো আমার কথা।

ওদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। কোনা থেকে বেরিয়ে এলো রাসেন।

গেছে ওরা? হাত দিয়ে ঘেমে ওঠা ভুরু মুছতে মুছতে সে জিজ্ঞেস করলো।

হ্যাঁ, জবাব দিলাম আমি।

আমাকে কাপুরুষ ভাবছো? কাঁপা কাঁপা গলায় বললো সে। সত্যি বলছি, আমি ওদের ভয় পাই, হলুদ-দাড়ি, সময় হলে তোমাকেও পেতে হবে। উহ! কি ভয়ানক মেয়েমানুষ। স্বামী হিসেবে ওর শোয়ার ঘরে ঢোকার চেয়ে রাঁধুনী হিসেবে রান্নাঘরে ঢুকলেই ভালো করতাম। প্রথম থেকেই আমাকে ঘৃণা করে। এবং যতই আমি গভীরভাবে ভালোবাসতে চেয়েছি ততই ও ঘৃণা করেছে আমাকে। এখন আমি বুঝতে পারছি, কেন, ভুরু কুঁচকে লিওর দিকে তাকালো র‍্যাসেন। বুঝতে পারছি কেন ও সব সময় অমন শীতল থেকেছে—কারণ, একজন মানুষ। এমন একজন মানুষ যার মনের বরফ গলানোর জন্যে ও তুলে রেখেছিলো ওর হৃদয়ের উষ্ণতা, আমাকে বা কাউকে বিতরণ করেনি একবিন্দু।

এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলো লিও। এবার এগিয়ে এলো দুপা। জিজ্ঞেস করলো, একটু আগের কথাবার্তায় আপনার কি মনে হয়েছে, খান? বরফ গলতে শুরু করেছে?

না—অবশ্য আমার ধারণা, তার কারণ আগুন এখনও ভালো করে জ্বলে ওঠেনি। আতেনকে আমি চিনি, এত সহজে ও শান্ত হবে না।

এবং বরফ যদি আগুনের ওপর গিয়ে পড়তে চায়? শুনুন, খান, ওরা বলছে আমি নাকি আপনাকে হত্যা করবো, কিন্তু আমার তেমন কোনো ইচ্ছে নেই। আপনি হয়তো ভাবছেন, আপনার স্ত্রীকে আমি ভাগিয়ে নিয়ে যাবো, সত্যি বলছি তেমন কোনো ইচ্ছেও আমার নেই। আমি আর আমার এই সঙ্গী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে চাই আপনাদের এই শহর ছেড়ে। দিন রাত যেভাবে আমাদের পাহারা দিয়ে রাখা হয়েছে, একমাত্র আপনিই পারেন আমাদের মুক্ত করে দিতে। তাতে আপনিও বাঁচবেন আমরাও বাঁচবো।

ধূর্ত চোখে তাকালো ওর দিকে খান। ধরো আমি দিলাম মুক্ত করে, তখন তোমরা কোথায় যাবে? যে পথে এসেছে সে পথে যেতে পারবে না, একমাত্র পাখিদের পক্ষেই সম্ভব ঐ গিরিখাদের ওপরে ওঠা। তাহলে?

আমরা যাবো অগ্নি-পর্বতে। ওখানে কাজ আছে আমাদের।

স্থির চোখে ধান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো লিওর দিকে। পাগল আমি না তোমরা? অগ্নি-পর্বতে যেতে চাও! আমি তোমাদের বিশ্বাস করি না। কিন্তু… একটু যেন ভাবনায় পড়ে গেল সে, কিন্তু যদি তোমরা যাও, নিশ্চয়ই ফিরেও আসবে একদিন। তখন যে ওখান থেকে দলবল নিয়ে আসবে না তার নিশ্চয়তা কি? আমার বউকে তো নেবেই দেশটাও নেবে।

না, না, ব্যগ্রভাবে বললো লিও। সত্যিই বলছি অমন কোনো উদ্দেশ্য আমাদের নেই। আপনার স্ত্রীর এক বিন্দু হাসি বা আপনার দেশের এক কণা জমিও আমরা চাই না। ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করুন, তা যদি চাইতাম, প্রথম দিনই খানিয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতাম। আমাদের চলে যেতে দিন, আপনি নির্বিঘ্নে রাজত্ব করুন, স্ত্রীকে বশ মানান।

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো খান। একটা হাত আনমনা ভঙ্গিতে দুলছে শরীরের পাশে। হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে। আমি ভাবছি, হাসি থামিয়ে বললো, আতেন যখন জানবে পাখি পালিয়েছে, তখন কি করবে? আমার ওপর খেপে উঠবে, তোমার খোঁজে তোলপাড় করে ছাড়বে সারা দেশ।

উহুঁ, আমার মনে হয় না যতটুকু রেগেছে তার চেয়ে বেশি রাগার কিছু আছে, আমি বললাম। আপনি সামাদের একটা রাত সময় দেবেন শুধু, আর দেখবেন খোঁজ শুরু করতে যেন একটু দেরি হয়। ব্যস আর চিন্তা নেই, আমাদের খুঁজে পাবে না।

তুমি ভুলে গেছো, ঐ বুড়ো ইদুর যাদু জানে। কোন পথে তোমরা আসবে তা যখন জানতে পেরেছে, কোথায় খুঁজতে হবে তা-ও জানতে পারবে। তবু, তবু ওর চেহারা কেমন হয় দেখার লোভ আমি সামলাতে পারছি না, ও, হলদে-দাড়ি, তুমি কোথায়, হলদে-দাড়ি? ফিরে এসো, হলদে-দাড়ি, তোমার বরফ গলাতে দাও। শেষের কথাগুলো আতেনের স্বর নকল করে বলে গেল সে। তারপর আবার হেসে উঠলো হা-হা করে। আচমকা হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কতক্ষণের ভেতর তৈরি হতে পারবে তোমরা?

আধ ঘণ্টা, আমি জবাব দিলাম। 

বেশ, তোমাদের ঘরে চলে যাও। তৈরি হতে লাগো, আমি এক্ষুণি আসছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *