০৬-১০. কন্যা তোমার মতি বোঝন ভার

কন্যা তোমার মতি বোঝন ভার
তুমি এইকূল ভাঙিয়া ওইকূল সাজাও
ক্ষণেক হাসাও ক্ষণেক কাঁদাও
এমন করিয়া খুশি মিটাও কার
কন্যা, তোমার মতি বোঝন ভার।

গাঙের কূলে বাঁধলাম বাসনা
সেই সোহাগও যখন ভাঙেরে
কে কার তা তো আর শুধায় না
কন্যা, তুমি গাঙেরই লাহান বহো রে।
কন্যা, ধৈরযে ধৈরযে বহো
কন্যা, ধৈরযে ধৈরযে চলো রে ॥

হোসেন-এর বরাত ভালো, কেরায়ার জন্য বাহির হইবার পর একটা দিনও বেকার বসিয়া থাকিতে হয় নাই, হয় তাহার শক্ত সমর্থ জোয়ান শরীর দেখিয়াই চড়নদারেরা আগাইয়া আসিয়াছে, অথবা হয়তো বা নৌকার ছইয়ে শিকদারের কারুকাজই তাহাদের আকৃষ্ট করিয়া থাকিবে। নিজের জন্য সে কোনো বিশেষ কিছু করে না বটে, কিন্তু অন্যের জন্য যেন নিজেকে উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিতে চায়। নৌকাখানিকে আরও বাহারি করিয়া তুলিবার বিষয়ে হোসেনই বাধা দিয়াছিল, চুরি হইয়া যাইবার বাস্তব সম্ভাবনার দিকে। শিকদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল।

ইতিমধ্যে রোজগার জুটিতেছিল হাতে, আর চড়নদারদের কৃপায় বেশ দুইবেলা আহারও জুটিতেছিল উপরন্তু। দিনমানে গাঙে গাঙে স্রোত কিংবা ঢেউ-এর সঙ্গে যুদ্ধ, আর রাত্রিকালে যাত্রীদের ঠিকানায় বিশ্রামও জুটিতেছিল। প্রথমদিকে ক্রমাগত বৈঠা বাহিয়া সারা শরীর ব্যথায় ভরিয়া উঠিলেও সে আমলে নিতে চাহে নাই; কেবলই মনে হইয়াছে একবার ক্ষান্ত দিলেই তাহাকে আবার নিজ দুঃখ-কষ্টের বিবরে ঢুকিয়া পড়িতে হইবে। বরং নিত্য নতুন চড়নদারদের সাহায্যে সে জগৎ-জীবন সম্পর্কে অনেক প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সুযোগ পাইতেছিল। প্রত্যেককেই মনে হইত ভঁহা ডাহা চড়নদার, ভুবন। জুড়িয়া তাহাদের কত রকমের কায়-কারবার, কত বিচিত্র ঘর-সংসার।  ক্রমাগত ব্যস্ত থাকিয়াই তাহারা অসম্ভবকে সম্ভব করিয়া তুলিতেছে; হোসেনেরও মনে হইত সে একবার একটু ঢিলা দিলেই বিশ্ব সংসারের নানারকম সমস্যা আর ভাবনা চতুর্দিক হইতে তাহার উপর ঝাপাইয়া পড়িবে। এখনও গাঙে ভাসিয়া পড়িবার সময় এক আজলা জল মাথায় তুলিয়া সমীহ দেখায়, কোনো কিছু আহারের কালে কণামাত্রও আগে নিবেদন করে গাঙেয় উদ্দেশে, অথচ চক্ষু তুলিয়া চতুর্দিকে তাকাইয়া ভাব বিভোর হইবার কোনো উদ্যোগ দেখায় না; কেবল মনে হইয়াছে, গাঙের উথাল পাতাল ভাব, বাদলা হাওয়া আর নানারকম দুশ্চিন্তাকে একবার প্রশ্রয় দিলেই তাহাকেও পাইয়া বসিবে; যথাসম্ভব অন্যান্য কোনো বিষয় আমলে না আনিয়া সে ক্রমাগত এক ঘাট হইতে আর এক ঘাটে আসা যাওয়ায় ব্যস্ত রহিয়াছিল; কিন্তু একদিন হয়তো চারিদিকে ভালো করিয়া না দেখিয়াই গাঙে নামিয়াছিল।

গ্রামদেশের অভ্যন্তরে এক ক্ষেপ দিয়া সময়মতো সে গাঙে ভাসিয়া পড়িয়াছে; ইচ্ছা জোয়ারে ভর করিয়া কাছাকাছি ন্যামতীর ঘাটে গিয়া অন্য কোনো চড়নদারের আশায় নৌকা বাঁধিবে, কিন্তু অঝোর বৃষ্টির মধ্যে পড়িয়া গেল। কোনো রকমে একটা ছোটোখাটো ঘাটে গিয়া পৌঁছাইল বটে, কিন্তু সে ঠাঁই অপরিচিত এবং সেইখানে যে কোনো রকম ক্ষেপ জুটিবে তার কোনো লক্ষণই ছিল না। বৃষ্টিটা থামিয়া আসিবার পর যখন সবদিকের ঝাঁপসা ভাবটা মোটামুটি কাটিয়া গেল, সেই সময় এইদিক-সেইদিক দেখিতে দেখিতে হঠাৎ তাহার দৃষ্টি পড়িল কাছাকাছি একটি নৌকার উপর; কেমন পরিচিত বোধ হইল। সেটিও এক বৈঠার নৌকা, বাদলা বাতাসে পাড়ের কাছে অসহায়ভাবে দোল খাইতেছিল; আর নোঙরের লগিটা নরম কাদার মধ্যে একদিকে হেলিয়া পড়িয়াছে, মনে হইল কিছুক্ষণের মধ্যেই উনুল হইয়া যাইবে। নৌকার মধ্যে কাহাকেও চোখে পড়িল না। উঁকিঝুঁকি দিয়া মনে হইল ছইয়ের নীচে পাটাতনের উপর মাঝিই হয়তো বেখেয়ালে ঘুমাইয়া রহিয়াছে। কিন্তু কয়েকবার ডাকাডাকি করিয়াও কোনো সাড়া মিলিল না। হোসেন একটুক্ষণ ইতস্তত করিয়া নিজের কাজে মন দিতে চাহিল। ছই-এর একাংশ গলুইর উপর টানিয়া আহার্য প্রস্তুতের বিষয়ে মন দিবে, এমন সময় সেই নৌকাটির দিকে আবারও মুখ তুলিয়া তাকাইতে হইল; সম্ভবত সেইদিক হইতে একটা অস্ফুট আওয়াজও ভাসিয়া আসিতেছিল। হাতের কাজ ফেলিয়া হোসেন আস্তে আস্তে সেইদিকে আগাইয়া গেল।

: ও মাঝি?

মাঝিই সম্ভবত ছইয়ের মধ্যে কাঁথা মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছিল। এক ডাকে সাড়া মিলিল না। অথচ নৌকাটির পাড়া ঠিক না করিলেই নয়। লগিটাকে পাড়ে মজবুতভাবে পুঁতিয়া সে আগাইয়া গেল ছইয়ের তলায়। কাঁথার তলায় লম্বা হইয়া শোওয়া লোকটির সর্বাঙ্গ কাঁপিতেছিল; আরও কয়েকবার ডাকাডাকির পর মুখের উপর হইতে কাঁথা সরাইতেই গেল, লোকটি পরিচিতই বটে, এই যাত্রায় প্রথম গাঙে আসিয়া যাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছিল।

: ছবদার মাঝি!

জীর্ণ তাহার শরীর, কিন্তু চোখ-মুখ ফোলা, প্রচণ্ড জ্বরে সে প্রায় অচৈতন্যভাবে পড়িয়া রহিয়াছে; দুই চোখ লাল, তাহাতে কোনো দৃষ্টি নাই, ঠোঁট যদিও নড়ে, মুখে কোনো বোধগম্য ভাষা নাই। কী করিয়া সে তাহার তালাফি করিবে হোসেন ভাবিয়া পাইল না। পরিচিত কোনো ঘাট হইলে হয়তো সে এমন বিমূঢ় বোধ করিত না। এক সময় সে নিজেকেও নিজে শাসাইল, মিঞা, কতবার বলিয়াছিলাম, নিজের কাম ছাড়িয়া অন্যদিকে চাহিও না।

অথচ সেই ছবদার মাঝি প্রথমদিকে তাহার প্রতি বেশ কয়েকবার ঈর্ষার চোখে তাকাইলেও কিছুক্ষণের মধ্যে শুভাকাঙ্ক্ষী হইয়া উঠিয়াছিল। প্রথম কেরায়া লইয়া বাহির হইবার সময় সে হোসেনকে গাঙের বড়ো বড়ো ঘোলার কথা বলিয়া সাবধান করিয়া দিয়াছে, আর বলিয়াছে কোন গাঙে কোন সময় অকস্মাৎ ডাকাত দেখা দিতে পারে, কেবল নৌকা বাওয়া জানিলেই হয় না, অনেক বিচার বিবেচনা করিয়া গাঙে নামিতে হয়। এখন, তাহাকে এমন কাতর অবস্থায় দেখিয়া কোনো অবহেলা করাও সম্ভব হইল না। একটু শুশ্রূষার পর সে আবারও জানিতে চাহিল : এখন কেমন বোধ করতে আছেন মাঝি? কোনো ঔষধপত্রের ব্যবস্থা আছে? নাই? কবে থেকিয়া এমন করিয়া পড়িয়া রইছেন?

অনেক চেষ্টার পর হোসেন তার অর্ধস্ফুট কথা এবং নানারকম ইঙ্গিত অনুসরণ করিয়া জানিতে পারিল, কতদিন ধরিয়া সে এমন অসুস্থ হইয়া ভাসিয়া চলিয়াছে তা তাহার নিজেরও খেয়াল নাই, ঔষধ দূরের কথা, বেশ কয়েকদিন কোনো দানাপানিও তাহার পেটে পড়ে নাই, অবস্থা এমন যে তাহার পক্ষে যেন আর উঠিয়া বসিবার সামর্থ্যও নাই, নিশ্চয়ই তাহার অন্তিম ঘনাইয়া আসিয়াছে, আরও কিছু কথা যা হোসেন কিছুতেই বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। সে বাহিরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টি বুলাইয়া ছবদার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল : এইখানে এমন ব্যারামে পড়িয়া রইছেন, একটা লোজনও আসে নাই এইদিকে? ঘাট যখন আছে, ধারে কাছে মানুষ জনও তো থাকার কথা। আর যা-ই হউক, একটা দুইটা চড়নদারেরও কি উদ্দেশ পাওন যায় নাই?

ধীরে ধীরে ছবদার মাঝি আবারও জানাইল সৃষ্টিকর্তাই স্বয়ং হোসেনকে এমনকালে কাছে পাঠাইয়া থাকিবে। এক চড়নদারের পীড়াপীড়িতে এবং ডবল ভাড়ার লোভে সে অসুস্থ অবস্থাতেই গাঙে ভাসিয়া পড়িয়াছিল; কোনোরকম দায়-উদ্ধার করিয়া সে আবারও সেই বড়ড়া বন্দরের দিকে উঠিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছিল; কখন কি অবস্থায় সে যে কোনখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে, সেই খেয়ালেরও সুযোগ হয় নাই।

: আমি যাই একবার উদ্দেশ লইতে, দেখি, কবিরাজ ডাক্তার কেউরে পাই কিনা–হোসেন পাড়ে আসিয়া সেই ঘাটের লোকালয়ের দিকে আগাইয়া গেল। ছোটো ঘাট, তেমন নৌকার ভিড়ও নাই, না বড়ো জনপদ। হয়তোবা আবহাওয়ার প্রতিকূলতার জন্যই কিছু ব্যবসায়ীর নৌকা না হয় গহনার নৌকা সেইখানে সময়-অসময়ে আশ্রয় নেয়; ঘাটের উপরে দোকান-পশরা কিংবা লোকজনের ভিড়ও তেমন নাই। এইদিক-সেইদিক খোঁজাখুঁজি করিবার পর একটা খালের মুখে একজন দেহাতিকে তাহার গোরু টানাটানি করিয়া খালে নামাইতে দেখা গেল।

প্রথমদিকে হোসেন নিজের উপরেই একটু অপ্রসন্ন বোধ করিয়াছিল। শিকদার যখন যাহাই বলুক, যাহার নিজের ভুবন নাই, তাহার কাছে ভুবন সংসারও নাই, থাকিয়াও থাকে না। আবার ভুবন-সংসার দেখিতে গেলে নিজজীবনেই বিড়ম্বনার অবধি থাকে না, গাঙে নামিয়া আর দুইপাড়ের দিকেও তাকাইতে চায় না হোসেন, সময়-সুযোগও তেমন হয় না। তাকাইলে কী দেখিবে? দুইপাড়ের সার-বাধা গাছ-গাছালি যেন এক রকম ওত পাতিয়া নিথরভাবে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, তা-ও যেন তাহারই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া। হোসেন মুহূর্তমাত্র অমনোযোগ দেখাইলে তাহারা যেন লেজা-বল্লম লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িবে। স্রোতের ঢেউ-এর তুলনায় আরও বহুগুণ শক্তি লইয়া তাহাকে নিজ গৃহে ফিরিয়া যাইতে বাধ্য করিবে। সুতরাং হোসেন সাবধানে চলিয়াছে।

কিন্তু ছবদারকে সে উপেক্ষা করিতে পারিল না। একসময় তাহার নিজের বুড়ো বাপের মৃত্যুর কথাটা মনে পড়িয়া গিয়াছিল। বারংবারই মনে হইতেছিল বুড়া হইলে মানুষ কেমন অসহায় হইয়া পড়ে; সংসারের তাজা-তাগড়া মানুষেরা তাহাদের উপেক্ষা করে, তাচ্ছিল্য দেখায়, বিশেষ করিয়া যখন তাহারা রুগ্ন হইয়া পড়ে। বড়ো হইয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে সে লক্ষ করিয়াছে এই দক্ষিণের দেশে জীবন লইয়া বাঁচিয়া থাকাই একটা প্রতি মুহূর্তের যুদ্ধ। বিরূপ প্রকৃতি, বিরূপ যেন আসমান ও জমিনও, আর ততোধিক বাধা বিপত্তির ঢাল-বল্লম লইয়া হিংস্র মানুষ। সেই যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়া আহত-নিহত অথবা পঙ্গুদের দিকেও মনোযোগর অবসর মেলে না। সেই রকম সুযোগ করিতে পারে নাই বলিয়া হোসেন নিজের বাপেরও কোনো সহায়তা করিতে সক্ষম হয় নাই। ছবদার মাঝির অবস্থা দেখিবার পর তাহার নিজের মনই বারংবার বলিতেছিল, এর সহায় হও, এর বুকে বল দাও। সঙ্গে সঙ্গে, প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে মনে হইতেছিল, এমন সহজে জীবন লইয়া ছিনিমিনি করার সুযোগ কাহাকেও দেওয়া যায় না। এই জগৎ, কাজ, কর্তব্য হইতে কাহাকেও ফট করিয়া তুলিয়া লইয়া যাওয়া এতই সোজা? কে বা কী-ই সেই মৃত্যু নামক জিনিস? সে আসিয়া দাবি করিলেই আত্মসমর্পণ করিতে হইবে? সৃষ্টিকর্তার কী এই-ই ইচ্ছা যে ছবদার এমন করিয়া বিদেশ-বিভূই-এ শেষ হইয়া যাউক, আর তাহার গোষ্ঠীও উপায়হীনভাবে তাহার পরিণামের অনুসরণ করুক? কেন বানাইয়াছে সৃষ্টিকর্তা তাহা হইলে এই পৃথিবী? সব আশা ত্যাগ করিয়া মাথায় হাত দিয়া বসিয়া থাকার ইচ্ছা হোসেনের কখনও ছিল না।

অনেক তালাশ করিয়া এক কবিরাজের দেখা পাওয়া গেল; কিন্তু তাহার আবার কখনও বাদলা-বাতাসের, কখনও কাদা-পাকের ওজর-আপত্তি রোগীকে তাহার দুয়ার-দরবারে লইয়া যাইবার হুকুম-হাকাম; অনেক সাধ্য সাধনা আর লোভ দেখাইয়াও যদিও বা ছবদারকে দেখানো গেল কিন্তু সে কোনো ভরসা দিতে পারিল না। কিছু ঔষধ পটপটি দিয়া সে কেবল কহিল মরনের বুঝি সময় হইয়া আইছে। বুড়ারে আপন বাড়িতে লইয়া যাও।

তারপর হোসেন আবারও কাদা–পেড়া ভাঙিয়া ঔষধপত্র সংগ্রহে এবং তত্ত্ব-তালাফিতে ব্যস্ত রহিল : ছবদার মাঝি একটু কথা বলিবার মতো অবস্থায় আসামাত্র সে জানিতে চাহিল : কোনখানে, কোন গ্রামে আপনার বাড়ি মাঝি? কেমন করিয়া যাইতে হয়? এখন কাজকর্মের তেমন জোবা নাই, এইসময়ে আপনি বাড়ি গিয়া সুসময়ের ধৈর্য দেখানোই ঠিক হইবে। কোনো দুশ্চিন্তা নাই, আমিই সুসারমতো পৌঁছাইয়া দিতে চাই।

ছবদার মাঝি খুশি হইল; অনেক কষ্টে সে তাহার বাড়ির ঠিকানাটা বুঝাইয়া দিতে চাহিল : সেই গাঙের গোটা দুই ‘যোজা’ (বাক) পার হইয়া আরও একটু ‘নামা’-র সমুদ্রের দিকে অগ্রসর হইলেও চৌখে পড়িবে ‘রূপার ঝোর’; পরে তাহার পাশ কাটিয়া আরও কয়েকদণ্ডের বৈঠার পর অনেকগুলি তাল তমালের সারি দেখা যাইবে একধারে, পরে পাশের খালে ঢুকিয়া কিছুদূর গেলেই বৈশাখিয়া গ্রাম; একসময় হোসেন দেখিবে একগুচ্ছের নারিকেল গাছ যেন খালের হালটের উপর নুইয়া পড়িয়াছে; সেইখানে নৌকা বাঁধিয়া হক দিলেই বাড়ির লোকজনদের সাড়া পাওয়া যাইবে। তাহাদের মুখে সংবাদ দিতে হইবে পথ চাহিয়া থাকা বৌ-ঝিকে, ছবদার মাঝি আর পারে নাই, সে ‘আউগাইছে’; হোসেনকে আর অন্য কিছু ভাবিতে হইবে না। বৈকালের ভাঁটায় রওয়ানা দিলে, রাত্রির জোয়ারটা কাটাইতে হইবে কোনো ঘাটে কিংবা হাটে নৌকা বাঁধিয়া, সেইদিকে গাঙে শান্তি নাই, নানারকম আপদ-বিপদ লাগিয়াই রহিয়াছে। কষ্টে আরও অধিক কিছু বলিতে পারিল না ছবদার মাঝি মনে হইতে লাগিল সেইটুকু কথাবার্তা বলিতেই তাহার সমস্ত শক্তিই যেন নিঃশেষ হইয়া যাইতেছিল।

: থাউক মাঝি, এখন থাউক।-হোসেন তাহাকে নিবৃত্ত করিয়া বলিল : ঔষধপথ্য জোগাড় হইছে যখন, সামনের রাইতটাও পার হওন যাউক। তবে, মনে হয় একটু সবুর করণেই ভালো হইবে। না হয় শেষ রাইতের ভাটায় নামিয়া যাওন যাইবে।

ছবদার কি বলিল বোঝা গেল না। কণ্ঠস্বর আরও ক্ষীণ, অস্থিসার শরীরে কোনো উত্তাপ আছে কী নাই; কেবল হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনটাই বহুদূর হইতে ভাসিয়া আসা আবেদনের মতো ঠেলিয়া উঠিতেছিল। হোসেন কিছুকাল ইতস্তত করিয়া নিজের কাঁথাখানিও তাহার গায়ে জড়াইয়া দিল; তারপর কর্তব্য স্থির করার জন্য ছই-এর বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। তখনও ভাটার কাল। যতদূর দৃষ্টি যায় মেঘঢাকা আকাশের তলায় বিশ্বসংসার যেন মুখ ফিরাইয়া রহিয়াছে। উত্তর হইতে নামিয়া আসা গাঙের স্রোত প্রচণ্ডবেগে ছুটিয়া চলিয়াছে নীচের সমুদ্রের উদ্দেশে। কোন মাঝির পাড়া আলগা হইয়া গেল তাহার স্রোতের টানে, কোথায় কোন পাড় ধ্বসিয়া পড়িল তাহার ঢেউ এর খাবলে সেইদিকে বরাবরের মতোই তাহার কোনোই ভ্রূক্ষেপ নাই : বরং একটা মহা-কৌতুকের উলাস-বিলাস লইয়া সে ধাইয়া চলিতেছে। পাড়ের নরম কাদার উপর ছোটো ছোটো পাখিগুলিও তাহার নাগাল এড়াইবার জন্য সতর্ক। সত্য বটে গাঙের বুকে অঢেল ঐশ্বর্য, দুইধারেও ছড়াইয়া-ছিটাইয়া চলে তাহার ভাণ্ডার, কিন্তু সেই বিপুল সম্পদ যথা ইচ্ছা ভোগের সুযোগ যেন কাহারও হয় না।

কাজে-কর্মে ব্যস্ত ছিল বলিয়া বাস্তবিকপক্ষে কোনো দিকে ভালোভাবে তাকাইবার অবসরও হয় নাই হোসেনের। এখন গাঙের খোলা স্রোতের দিকে চাহিয়া বারংবারই তাহার মনে হইতে লাগিল গাঙই যেন সমস্ত জীব-জীবনের উত্থান-পতন ও জীবন-মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করিতেছে, তাহার ঢেউ-এর উপর সওয়ার হইবার সাধ্য যাহার নাই গাঙও তাহাকে পাড়ের উপর হইতে উপড়াইয়া পড়া গাছের মতো নিষ্ঠুরভাবে বিশাল সমুদ্রের দিকে টানিয়া লইয়া যায়। শ্রীহীন নৌকাটির মতো ছবদারেরও পাড় আঁকড়াইয়া থাকিবার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া যাইতে বসিয়াছে। হোসেন মনে মনে সংকল্প করিল সে কেবল নীরব দর্শকের মতো তাহা দাঁড়াইয়া দেখিবে না।

গাঙ দেয় সব কিছু, জীবন-ঐশ্বর্য, ভুবন গড়ে, আবার ভাঙে। যেইখানে তাহাদের নৌকা, তাহার কাছাকাছিই জাগিয়া উঠিতেছে নতুন চরভূমি। ইতিমধ্যেই তাহার উপর গজাইয়া উঠিয়াছে নলখাগড়া-হোগলা বন; হয়তো নানা ধরনের জীবজন্তুও নতুন আশ্রয় গড়িয়াছে সেইখানে, ডাঙার উপর হইতে মানুষও সেখানে আসিয়া পড়িল বলিয়া, হয়তো তাহার অধিকার লইয়া কলহ-বিবাদও শুরু হইয়া গিয়াছে ইতিমধ্যে। একদিন একদল মানুষ সেইখানে আপন অধিকার খাটাইয়া গড়িয়া তুলিবে ঘর-গৃহস্থালি, গোরু চরিবে এইদিক-সেইদিকের ঘাসবনে, ঝি-বউরা সযত্নে সাজাইয়া তুলিবে গৃহাঙ্গন, দেহে ছন্দের ঢেউ খেলাইয়া উঠানে ছড়াইয়া দিবে শ্রমের ফসল-যেমনটি সে একদিন সখিনাকে দেখিয়াছিল।

অথচ এই গাঙই হয়তো আবার একদিন তাহার খেয়াল-খুশি বদলাইয়া সব কিছু ভাঙিয়া টানিয়া লইয়া যাইবে আপন স্রোতের গহ্বরে। কেবল গাঙের উপরেই নয়, আকাশে-বাতাসেও যেন বিরাট বিপুল অশরীরী শক্তি প্রচণ্ড দম্ভ দণ্ড লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে : চতুর্দিকের নিস্তব্ধতার মধ্য হইতে তাহার একটি মাত্র রোষ-ভরা উক্তি নানাভাবে ছড়াইয়া পড়িতেছিল : এই গাঙের মতো ধাইয়া চলো, কোথাও বাঁধা পড়িও না, থামিয়া থাকিলে চলিবে না; আমার হুকুমে, আমার খুশিতে তোমার নিজকে সমর্পণ করিতে হইবে; আমি কখনও তোমাকে নীল আকাশের তলায় সবুজ-শ্যাম-হরিৎ-এর শোভা দেখাইব কখনও ঘূর্ণিতে ঘুরাইব, কখনও বা লক্ষ লক্ষ তরঙ্গের নৃত্য-সভায় তোমাকে লইয়া লোফালুফি খেলিব, আবার কখনও বা তোমাকে আমার গহন গর্ভের রহস্যে অবাক করিয়া রাখিব, যতদিন না তোমাকে সমুদ্রের অন্তহীন গভীরে বিলীন করিয়া দিতে পারি; শূন্য হইতে আসিয়াছ, তোমাকে শূন্যেই মিশাইয়া দিব, যদি মাটি হইতেই আসিয়া থাক, আবার তোমাকে দৃষ্টিরও অগোচরে রেণু রেণু করিয়া মাটিতে নিশ্চিহ্ন করিয়া দিব। হোসেনের অকস্মাৎ মনে হইল মুখ ফিরাইলে সে দেখিতে পাইবে শিকদারও কোথা হইতে তাহার কাছাকাছি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

চরের মাটিতে দরগি-মাছ খুঁজিয়া ফেরা ছোটো পাখিগুলিও গাঙকে সমীহ করে, হোসেনও করে বইকী, কিন্তু সমূহ কর্তব্য ফেলিয়া সে আর অধিক কোনো ভাব-ভাবনা গ্রাহ্যে আনিতে চাহিল না। সে সবরকমভাবে বিবেচনা করিয়া দেখিলে, গাঙের যেন তেজ, তাহাতে একই সঙ্গে দুই নৌকা লইয়া ভাসিয়া পড়া কোনো ক্রমেই সাধ্য হইবে না। কোনো উপায় আছে কিনা সেই বিষয়েই সে ব্যস্ত হইয়া পড়িল। কতদূরে তাহার বাড়ি সেই কথা ছবদারকে জিজ্ঞাসা করিয়া আর কোনো লাভ ছিল না, সাত-আটটা ঘেঁজা বা বাঁকের পরে অন্য আরেক গাঙে নামিতে হইবে, তারপর সে-ই দেখাইয়া দিবে।

.

০৭.

আমার তো নইরে আমি আমার না
কাছে কইরে আমি, আমার না
আমি তো নয়রে আমার, সকলি পর
আমার বলতে নাই এক জনা।
যদি আমি আমার হইতাম
কুপথে কি আর যাইতাম
কুপথে কি আর যাইতাম
দেখতাম আপন কল-কারখানা।

আমি এলাম পরে পরে
পরের নিয়ে বসত করে
এখন দেখি কেউই নাইরে
পরের সঙ্গে দেখা-শুনা।

পরে পরে কুটুমভালি
পরের সঙ্গে দিন কাটালি,
শুধু কয় ফকির লালন
ভাবিলাম পরের ভাবনা।

এখনও গাঙপাড় বরাবর গঞ্জের দিকে যাইবার কালে পিতামহ করমালীর কথা শিকদারের আরও বেশি করিয়া মনে পড়ে। শৈশবকালে এই পথে তাহার সঙ্গে বহুবার নানাদিকে যাতায়াত করিয়াছে। আরও মনে পড়িল পাড়ের কাছে তাজা জলের মধ্যে একটা ছোটো নৌকার ভগ্নাবশেষ দেখিয়া; কখনও কোনো প্রচণ্ড ঝড়ে সেইখানে আসিয়া মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়াছে, কিংবা নদী-জলের প্রচণ্ড স্রোতেই তাহাকে কোন দূর দেশ হইতে উলস-পালস করিয়া টানিয়া আনিয়া ফেলিয়াছে। পিতামহ সঙ্গে থাকিলে বলিত, ব্যস, শেষ হইল আর একজনের সংসার খেলা। ভাঙা হাড়গোেড় লইয়া এই নরম মাটির মধ্যে সেইভাবে আটকাইয়া পড়িয়াছে তাহা হইতে আর উদ্ধার নাই। মালিকও যদি প্রাণে বাঁচিয়া গিয়া থাকে তাহারও আর কোনো উদ্দেশ মিলিবে না। শিকদার সবসময়ই যে তাহার কথাবার্তা সব বুঝিয়া উঠিতে পারিত এমন বলা যায় না। বারংবারই সে বলিত গাঙই সমস্ত জীবন নিয়ন্ত্রিত করিতেছে, কখনও অণুর পর অণু পলি মিশাইয়া মাটি গড়িতেছে, আবার অন্য একদিনের খেয়াল-খুশি মতো তাহাকে খাবলে খাবলে নিশ্চিহ্ন করিয়া মাতিয়াছে অন্য খেলায়। সেইসঙ্গে ঝড়-ঝঞ্ঝা, বন্যা বর্ষা, ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ সমুদ্র যেন অনন্তকাল ধরিয়া চতুর্দিকে জীবনের নিয়ামক হইয়া রহিয়াছে। একদিন স্রোতের মধ্যে একটা বিশাল গাছকে উলটপালট খাইয়া ভাসিয়া যাইতে দেখিয়া সে বলিয়াছিল : হয়তো আমরা এইরকম ভাসিয়া আসিয়াছিলাম।

কিশোর শিকদার জানিতে চাহিয়াছিল; কোথা হইতে?

পিতামহ একটা অস্পষ্ট ইঙ্গিত করিয়াছে, উপরে হইতে। একদিক হইতে নামিয়া আসিয়াছে গঙ্গা, আরেক দিক হইতে ব্রহ্মপুত্র। কত যুগ ধরিয়া কত যে জনপদ ভাসাইয়া তাহারা নীচে নামাইয়া আনিতেছে তাহা কে বলিতে পারে! সব কিছু ভাসাইয়া সমুদ্রে নিঃশেষ করিয়া দেওয়া ছাড়া যেন অন্য কোনো উদ্দেশ্য নাই।

কিশোর শিকদার তবু পীড়াপীড়ি করিয়াছে, কিন্তু আমরাও যে ভাসিয়া আসিয়াছি তাহারই বা প্রমাণ কী আছে? এই মাটি, জলজঙ্গল, দেশ-গ্রাম কী সব সময়ই আছিল না?

সেইসব প্রশ্নের উত্তরে করমালী আবারও দুর্বোধ্য হইয়া উঠিত; নিচু হইয়া চরের পলিমাটি আঙুলে ঘষিয়া দেখাইত শিকদারকে, এই দেখ, কত মিহিন এমন মাটির অণু-পরমাণু। গঙ্গা ব্ৰহ্মপুত্র যে কোন কোন মুলুক হইতে নামাইয়া আনিয়াছে, সেই হিসাবের কী কেউর সাধ্য আছে! আমরাও এমনই মাটির কণার মতো, জীবন লইয়া যাহাদের খেলা তাহাদের হাতে কেবলই রূপ পালটাইয়া চলিয়াছি। এইটুকুন বাচ্চা হইতে একদিন বড়ো হই, নানারকম দম্ভ দেখাইয়া এইদিকে বাঁধ দিই, সেইদিকে বেড়া, চরের নরম কাদায় খুঁটি পুঁতিয়া নৌকা বাঁধার মতো, মাঝি হয়তো নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইতে গেল, কিন্তু কখন যে পাড়ের মাটি হইতে সেই খুঁটি আলগা হইয়া পড়িবে, নৌকাও তাহার মাঝির অজান্তে বিরাট বিশাল গাঙের মধ্যে ভাসিয়া পড়িবে কেউই বলিতে পারে না, এখন থাকুক এইসব কথা, তুই একটা গীত ধর।

কিশোর শিকদারের কণ্ঠে কোনো গীতই আসিত না। গাঙ পাড়ের এলোমেলো বাতাসের মধ্যে মুখের উপর হইতে লম্বা চুলগুলি বিন্যস্ত করিয়া, কিছুক্ষণ পাড়ের কাশবনের উপর রৌদ্রের ঝলক হইতে দৃষ্টি ফিরাইয়া সে কেবলই চাহিয়া দেখিত চতুর্দিক : আকাশে বকের সারি, গাঙে জেলে-নৌকার বহর, খেতে-মাঠে কর্মব্যস্ত চাষি, ঝোপে-ঝাড়ে পাখির-পঙ্খির বাসা-তৈরির তৎপরতা, এমনকী কীট পতঙ্গের জীবিকা জীবনও তাহার দৃষ্টি এড়াইত না। কখনও সে পিতামহকে কিছু বলিতে সাহস পায় নাই, কিন্তু যে-শক্তি, সকলের সমস্ত চেষ্টা নিষ্ফল করিয়া দিতে বদ্ধপরিকর, তাহার বিরুদ্ধে কেবল ভয়ই নয়, একটা বৈরী-মনোভাবও তাহার মধ্যে জাগিয়া উঠিতেছিল।

করমালী কিছুক্ষণ তাহার অপেক্ষায় থাকিয়া নিজেই গুন গুন করিয়া গান ধরিত : আকুল হইয়া কাঁদি আমি বসিয়া গাঙের পাড়েরে–

তাহার কথার মতো গানের ভাব-ভাষাও সব সময় বুঝিয়া উঠিতে পারিত না শিকদার, অথচ গাহিতে তাহারও কোনো অসুবিধা হইত না। সে নিজে বুঝুক, না-বুঝুক, দেখিত শ্রোতারা যেন উদ্বেল হইয়া ওঠে, কেউ প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কেউবা কাঁদিয়াও অস্থির হয়। কিশোর-বয়সে, প্রথম যৌবনে কিছু বুঝিয়া না-বুঝিয়া যে গীতগানগুলি সে আসরের পর আসরে গাহিয়া গিয়াছে, তাহার সঙ্গে আপন জীবন-ভাবনার মিল ছিল অতি সামান্য; ক্রমে যখন নিজে নিজেই গান বাঁধিতে মন দিল তখন যেন আর কথা খুঁজিয়া পাইতেছিল না।

অথচ এখনও বুক ঠেলিয়া কত গান উঠিয়া আসিতে চাহে কণ্ঠে। নিজ পরিচিত ভুবন, একের পর এক সমস্ত জনপদগুলি তাহার সমস্ত অন্তর মথিত করিয়া যেন গুণগানে প্রবৃত্ত করাইতে চায়। হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের আশায় সে ধীরস্থিরভাবে অনেকগুলি গ্রামের কখনও বা আশেপাশে, কখনও বা মধ্য দিয়া পথ করিয়া আসিয়াছে। কখনও বা তেমন কোনো প্রয়োজনও ছিল না, সে কেবল সেই জনপদগুলির সমস্ত সৌরভগন্ধ বুক ভরিয়া গ্রহণের জন্যই সেইসব ঠাঁই ঘুরিয়া আসিয়াছে। তখনও বারংবার মনে পড়িয়াছে পিতামহের কথা। সেইসব গ্রামে কাজে-অকাজেও ঘুরিয়া বেড়াইবার বাতিক ছিল তাহার; কখনও বা কোনোখানে নিথর হইয়া বসিয়া থাকিত; কেন, তাহার কোনো মীমাংসা শিকদার আজও পর্যন্ত খুঁজিয়া পায় নাই। সেইসব গ্রামের পাশ দিয়া বহা গাঙ কবে কোন যুগে মজিয়া গিয়াছে, চতুর্দিক কেবল খাল-বিল-জল, মধ্যে মধ্যে গাছ-গাছালি ঘেরা পুঞ্জ পুঞ্জ গ্রাম। কৈশোরকালে তাহার মধ্যকার অনেক ঘরবাড়ি বড়ো সুন্দর, বড় ভিন্ন রকমের মনে হইত : খড়ের চাল, মাটির দেয়াল, খিড়কি, কেওয়ার, এমনকী ভিতরে গঠনও ছিল অন্যরকম। কামদেবপুর, বৈশাখী, অভয়নীল, দেহলিদুয়ার, সুভিতপুর, নাচনমহল, রূপার ঝোর-প্রত্যেকটি গ্রামে বাহিরের সমস্ত ঔদ্ধত্যকে উপেক্ষা করিয়া যে জীবনযাত্রা চালু ছিল, তাহার মধ্যে করমালীকে অত্যন্ত আত্মস্থ মনে হইত। সকল গ্রামের মানুষ একসাথে যেভাবে বৈশাখী পূর্ণিমা অথবা চৈত্রসংক্রান্তির মেলায় মাতিয়া উঠিত, তাহার মধ্যে করমালীও নিদারুণভাবে জড়াইয়া পড়িত। সে সম্বন্ধে নিজে বড়ো হইয়া উঠিবার সঙ্গে সঙ্গে অনেক রকম কানাঘুষা শুনিয়াছে শিকদার, কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে কোনো কিছু জানিবার সুযোগ হয় নাই। যখন কিছু বুঝিবার সময় হইল, ইতিমধ্যে বাহিরের সেইসব ঔদ্ধত্যকে টিকাইয়া রাখার প্রয়াস করিতেছিল যাহারা, তাহারা এবং তাহাদের জীবন-যাপন ও সংস্কার আচারকেও অন্য এক যুগ প্রচণ্ড গাঙের স্রোতের মতো একেবারে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছে। এখন শিকদারের মনে হয়, পিতামহের সঙ্গ-সাহচর্য পাইলে সে অনেক প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজিয়া পাইত। সুভিতপুরকে সুবিদপুর আর ধবলার চরকে ‘দুবলার চর বলিয়া উল্লেখে করমালী একদিন মহা বাদানুবাদ সৃষ্টি করিয়াছিল। ক্রমে ক্রমে সমস্ত বিতর্ক পরিত্যাগ করিয়া সে একান্তভাবে আত্মমগ্ন হইয়া পড়িতেছিল গীত-গানের মধ্যে। কানা ঘুষাটা প্রধানত সেই উপলক্ষেই। মেলা বসিবার কালে বাহিরের অনেক ধরনের লোকও আসিত ডিঙি সাজাইয়া, তাহাদেরই কোনো কোনো আসরে করমালী ভাব-সংগীতে চৈতন্যও হারাইয়া ফেলিত। সংসার-জীবনে সে সুখী হয় নাই। কখনও তাহাকে বলিতে শুনিত, কানু, যে যতই চেষ্টা করি জীবনে কোনো বাঁধা ধরা সুখ নাই। আমরা মনে করি আছে, আর সেইসব ধ্যানই আমাদের দুঃখের কারণ হইয়া দাঁড়ায়। আমি তো চেষ্টা করিলাম পিতৃপুরুষের উত্তরাধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করিতে, এখন দেখ আমার নিজ পুত্রই কেমন করিয়া তাহা বিকাইতে বসিয়াছে।

শিকদার সেইসব বিষয়ও ভালো করিয়া বুঝিতে পারে নাই। তবু যতনা নৈকট্য বোধ করিয়াছে পিতামহের সঙ্গে, ততধিক দূরত্ব তাহার পিতার। পিতা জয়জামালী না দেখিত খেত-খামারের কাজকর্ম, না কোনো উৎসাহ বোধ করিত ঘর পরিবারের প্রতি। এক এক সময় বহুদিন পর্যন্ত কোথাও চলিয়া যাইত। সেইসব সময়ে মাঝে মাঝে গভীর রাত্রিকালে, হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া গেলে, শুনিতে পাইত তাহার মা কাঁদিতেছে। কেন সেই কান্না শিকদার তাহাও জানে নাই। পিতাকে যখন দেখি সে যেন অন্য কোনো জগতের মানুষ। বেশ, নাম, কথাবার্তা, চাল-চলন-সবই বদলাইয়া সে যেন প্রাণপণে অন্য কিছু হইবার চেষ্টা করিতেছিল। মনে হইত গাঁ-গ্রামের জীবনের প্রতি তাহার বিতৃষ্ণার অবধি নাই; নিজের নামটা পর্যন্ত সে বদলাইয়া লইবার জন্য উদগ্রীব হইয়া উঠিয়াছিল। ঘর-সংসারের সামান্য খুঁটিনাটি হইতে শুরু করিয়া চাষ-বাসের কাজকর্মেও তাহার নতুন নতুন প্রস্তাব প্রায়ই নানারকম অশান্তির কারণ হইয়া উঠিত। একদিন এমনও হইল যে শিকদারের পক্ষে দুইদিকেই সমান দূরত্ব রাখিয়া চলাই সঙ্গত বলিয়া ভাবিতে শিখিল। এখন, কালে কালে সেই দূরত্বটা কেবল তাহাদের সঙ্গেই নয়, বাহিরের পৃথিবী এবং তাহার মধ্যেও গড়িয়া উঠিয়াছে। অন্তত হোসেনের বিষয়েও সে আর নিজেকে অসম্পৃক্ত রাখিবার কথা ভাবিতে পারিতেছিল না।

অথচ যে-ঘাটে হোসেনের দেখা পাইবার আশা, সেইখানে তাহার কোনো উদ্দেশ মিলিল না।

গঞ্জের একধারে ঢালু চর পড়িয়াছে গাঙের গতি বদলাইবার সঙ্গে সঙ্গে। সেই ঘাটের স্টিমারও আসা-যাওয়া করে এখন পাড় হইতে অনেক দূরের স্রোতে। খাড়া পাড় হইতে বাঁশের কেঁচকির উপর পুল পাতা স্টিমার-ভিড়িবার ফ্লাট অবধি। সেই পুলের দুইধারে অজস্র নৌকার ভিড়-বজরা, পানসী, মুঠিয়ার নৌকা, আর এক-বৈঠার কেরায়া নৌকারও কোনো সংখ্যা শুমার নাই। অনেকবার এইধার সেইধার করিয়া শেষ পর্যন্ত আমজাদের দেখা পাইল, কিন্তু সে-ও হোসেনের কোনো সংবাদ দিতে পারিল না।

: এ যাত্রা আর আমার সঙ্গে দেখা হয় নাই। আমি কেবল এক ঘাট হইতে আর এক ঘাটে চড়নদার পৌঁছাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া রইছি। ক্যান, দেখা হইলে কিছু কইতে হইবে?

: নাহ্! তেমন কোনো বিশেষ কিছু না!

আমজাদ নিজের কাজের দিকে মন দিতে দিতে বলিল : তা ওই নলসিঁড়ির ঘাটের দিকেও দেখতে পারেন। এইদিকে এমন ভিড় দেখিয়াই হয়তো আর আউগাইয়া আসে নাই। দেখেন না, যত না চড়নদার, তারও শতাধিক নৌকা-ডিঙি। আমারও ঠাঁই হয় নাই।

সেইদিকটার চর পড়িলেও জোয়ারের সময় গাঙ যেন আবারও পাড় ধরিয়া উপরে উঠিয়া আসিতে উপক্রম করে। বাঁকের উপর বলিয়াই লোকজনের ভিড় আরও বেশি। কাজে-অকাজেও নৌকা ভিড়াইয়া সেইখানে দুইদণ্ড কাল ঘোরাফেরা একটা অন্য জগত দেখার সমান। কাছাকাছি কোনো খালের মধ্যে এক ধর্মগুরুর সমিতির উপলক্ষে সেই ভিড় আরও বাড়িয়াছে। হৈ-চৈ, ধাক্কাধাক্কি, ডাকাডাকি-কোলাহল-এর মধ্যে কোনো অন্তরঙ্গ আলাপনের সুযোগ হয় না। শিকদার নলসিঁড়ি ঘাটের দিকে যাইবার উদ্যোগ করিয়াছিল। এমন সময় হঠাৎ সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।

একধারে একখানি পেট-কাটা পানসি-নৌকা, আর তাহার ছই-এর মুখে একটা শাড়ি টাঙাইয়া পর্দা দেওয়া, সেই পর্দার আড়াল হইতে একখানি মুখ। অকস্মাৎ নজরে পড়ায় শিকদারের কাছে অন্য সব কিছু তুচ্ছ হইয়া গেল। যে-দুইটি ডাগর চোখ উৎসুক্যভাবে তাহাকে লক্ষ করিতেছিল, তাহা চিনিতে পারিয়াই সে চমকিয়া উঠিল।

পর্দার কাছে জোবেদার হাতখানি হয়তো একটু কাঁপিয়া উঠিল; স্লান দৃষ্টি মেলিয়া সে যেন কিছু বলিতেও চাহিল, তাহার ঈষৎ হাসির মধ্যে সম্ভাষণ কী আহ্বান তাহা বুঝিয়া উঠিবার আগেই ভিড়ের চাপে শিকদারকে সরিয়া দাঁড়াইতে হইল। পুলের উপর হইতে পাড় পর্যন্ত উঠিয়া আসিতে হইলেও, দৃষ্টি বারংবার ঘুরিয়া যাইতে লাগিল সেই পানসির দিকে, কিন্তু সেই দৃশ্যটি আর চোখে পড়িল না। অজস্র নৌকা তখন খালের পথ ধরিয়া ধর্ম-সভার দিকে চলিয়াছে, সেই ভিড়ের মধ্যে জোবেদার পানসি-নৌকাটিকে সে আর ঠাহর করিতে পারিল না। বুক দুমড়াইয়া একটা অভিমান ঠেলিয়া উঠিতে চাহিলেও সে নিজেকে সংযত রাখিল। সব দিকে নিত্যকালের জীবন বহিয়া চলিয়াছে। এই প্রচলিত নিয়মের মধ্যে অকস্মাৎ এককালের তরুণী জোবেদা এখন রমণীর বেশে তাহার উদ্দেশ্যেই একান্তে কিছু বলিতে চাহিবে, তাহা নেহাতই কোনো ভ্ৰম-কল্পনা। মুখের উপর এক ঝাঁপটা বাতাস বহিয়া যাইবার কালে আবারও যেন কানে ভাসিয়া আসিল পিতামহ করমালীর কণ্ঠস্বর : মনা, অনড়-অটল কিছু নাই। আমরাই মনে করি নিশ্চয় আছে, আর সেই গর্ব লইয়া কেবলই দুঃখ পাই। যা এই আছে, এই নাই, তাহার বড়ো আর দুঃখ নাই।

.

০৮.

বঁধু তোমার শরণ করলাম যার
তুমি বিনে কমবে না আর
এত দুঃখের ভার।

আমার মন মধুপ ভোমরার মতো
তোমার রূপে হইছে মাতোয়ারা।

যত দেখি এই রূপের মেলা
যত দেখি এই রঙের খেলা
যেন আরও দেখায় তারা রে,

এই রূপেতে কীট দেখিলে হই যে উদাস
তোমার শরণে এখন সে দুঃখেরও বিনাশ ॥

জলসিঁড়ির ঘাটেও হোসেন-এর কোনো উদ্দেশ্য পাওয়া গেল না। শিকদার একসময় আবারও বাড়ির দিকে পা বাড়াইয়াছিল, এমন সময় একজন লোক তাহাকে সমাদর করিয়া বসাইল। বন্দরের ঘাটের একধারে সে একটি দেশী ছোটো চা-এর দোকানে কাজ করে। এক বাটি চা, আর কয়েকটি বিস্কুট তাহার সামনে বাড়াইয়া দিয়া জানিতে চাহিল : তারপর বয়াতি-ভাই, গীত গান কি একেবারেই ছাড়িয়া দিয়াছেন?

চটপট কোনো কথা বলা শিকদারের স্বভাব নয়। একটু প্রীতবোধ করিলেও সে প্রসঙ্গটা এড়াইয়া যাইতে চাহিল; চা-এর বাটিটা ঠেলিয়া দিয়া বলিল : এইসবের দরকার নাই, এই বিস্কুটই যথেষ্ট। সাঁঝের আগে আগে বাড়ি পৌঁছাইবার তাড়া আছে।

সেই দেশী যুবক লতিফ যেমন কর্মচঞ্চল, তেমনই সবদিকে তার অসীম উৎসাহ; কাছে ঝুঁকিয়া ফিশফিশ করিয়া আবারও জানিতে চাহিল : একটা কথা রাখবেন বয়াতি ভাই।

হাতের বিস্কুটটা মুখ হইতে সরাইয়া শিকদার লতিফের মনোভাব আন্দাজ করিবার চেষ্টা করিল।

: কে না জানে, আপনার মতো গায়ক সবখানে নাই। তাড়াহুড়া করিয়া না ই বা রওয়ানা হইয়া গেলেন আইজ। আমি সাঁঝের বেলা এইখানেই একটা আসরের আয়োজন করি। এমনও হইতে পারে কাইল সকালে আপনার বন্ধুর দেখা পাইয়া যাইবেন।

সেই বন্দরে শিকদারের যে আরও কিছুক্ষণ কাটাইয়া যাইবার ইচ্ছা ছিল না, তাহা নয়। আশৈশব কাল হইতে দেখিয়া আসা বন্দরের চেহারা ক্রমাগত পরিবর্তিত হইয়া চলিয়াছে; গাঙ যতই তাহাকে ভাঙিয়া ছানিয়া চলিতে চাহিতেছে, ততই যেন প্রতিরোধ গড়িয়া উঠিতেছে চতুর্দিকে; যাত্রা স্থগিত রাখিলে শিকদারের পক্ষেও সবদিক ঘুরিয়া বেড়াইয়া দেখিবার সুযোগ হইত।

: সকল ব্যবস্থা আমার।-লতিফ আবারও বলিল : রোজই কিছু না কিছু মানুষ এই ঘাটে আটকা পড়িয়া যায়। বৈকালে স্টিমার চলিয়া যাওয়ার পর তেমন কিছু আর করারও থাকে না। রাত্রিটা এইখানেই কাটাইয়া যায়েন, কোনো অসুবিধার অবকাশ তক রাখিমু না।

শিকদার একটু ভাবিয়া বলিল : অনেকদিন চর্চা নাই।

: সেই জন্যই তো আর এখন কিছু দরকার। বয়াতিভাই, দুইটা পয়সা কামাই করার জন্য নিজ দেশ ঘর-বাড়ি ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসছি। যতই চেষ্টা করি না কেন, মাঝেমধ্যে বড়ো অস্থির লাগে। শুনছি তো আপনার গীত-গান, মনটা যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় ছাড়িয়া কোথায় উড়িয়া যায়, কেমন একটা শান্তি লাগে, শান্তি বোধ হয়, তারও উপর বড়ো কথা কী জানেন আপনে আমার দেশের মানুষ বলিয়া আমাগো বুকটাও এই এতো বড়ো হইয়া ওঠে। দেখলাম তো অনেকেরই, আপনে চর্চা রাখলে তুলনাও থাকত না। আপনে রাজি হইয়া যায়েন।-লতিফ একটু হাসিয়া আরও জানাইল; এইখানে সমঝদারও আছে।

শিকদার আর আপত্তি না উঠাইয়া তখনকার মতো সেই দোকান হইতে বাহির হইয়া আসিল। বৈকালে স্টিমারের ফিরতি সময়ের তখনও অনেক দেরি। নামা’য় কোথায় যে বরগুনা নামক অন্তিম ঘাট, তা কোনোদিন জানারও সুযোগ হয় নাই। গাঙের এইদিক সেইদিক চাহিয়া শিকদারের মনে হইল, ভুবনের অনেক কিছুই জানা-চেনা এবং বোধ-উপলব্ধির বাহিরে রহিয়া গিয়াছে; অথচ আপন ভুবন ছাড়িয়া নিরুদ্দিষ্ট হইলে সে-ও হয়তো পিতামহ করমালীর মতোই শেষ হইয়া যাইবে।

এই গঞ্জে বারংবার যাতায়াত ছিল তাহার। পূর্বদিকে একটা পল্লিতে আখড়া ছিল বাউল বৈষ্ণবদের, সেইদিকে সহজে কেউ যাইতে চাহিত না, পারিতও না। এই সমাজ, সেই সমাজের নীতি-বিধি তো বটেই, নানারকমভাবে কোণা ঠাসা হইয়া পড়িয়া তারাও যে খুব একটা স্বধর্মে অটল থাকিতে পারিয়াছে তা নয়, বরং একটা ঘোর দুর্নামের ভাগী হইয়াছে। একসময় তাহাদেরই কাছাকাছি বেবশ্যা পাল্লি গড়িয়া উঠিয়া তাহাদের অবশিষ্ট সুনামটুকুও শেষ করিয়া দিয়াছে। কখনও কখনও কানে আসিয়াছে করমালী শেষ বয়সে সেই বাউলদের খোঁজাখুঁজি শুরু করিয়া দিয়াছিল। তাহার পিতা এ জন্য উপহাস করিয়াছে; এমনকী তাহার পিতামহী পর্যন্ত সেইসব বিষয়ে নিদারুণ অসন্তোষ দেখাইয়াছে। কিশোর শিকদার সেইদিকে কখনও যায় নাই, তেমন কোনো উৎসাহও অনুভব করে নাই। হয়তো বা নানারকম বিধি-নিষেধও তাহাকে নিরস্ত করিয়া রাখিয়াছিল। এখন নানাদিক ঘুরিয়া সে সেই পল্লিটাও দেখিয়া লইতে চাহিল।

কিন্তু কোথায় সেই পল্লি! বহমান গাঙের আঘাতে আঘাতে ভাঙিয়া সবই সম্ভবত ভাসিয়া গিয়াছে স্রোতের সঙ্গে, যেমন গিয়াছে অন্যপাড়ের একটা বিশাল স্থূপ। কর্মকার পল্লির মানুষেরাও যেন ভাঙনে ভাঙনে তাহাদেরও ঘর সংসার লইয়া সরিয়া যাইবার ঠাঁই পায় নাই। একধারের খাড়াপাড়ের মধ্যে যুগ যুগ ধরিয়া স্থূপীকৃত মাটির বাসন-কোশনে খণ্ডগুলির এক একটি স্তর চোখে পড়িতে লাগিল। উপরে কয়েকঘর কর্মকার হয়তো এখনও রহিয়াছে, পথে নারিকেল সুপারি, পানের বর’ আর অউখের খেতের আশে-পাশে কয়েকটি টিনের বাড়ি। কোনো দিকে এমন কিছু চোখে পড়িল না, যাহার জন্য করমালী বিশেষভাবে সেইদিকে আকৃষ্ট হইয়া থাকিতে পারিবে। সে কান পাতিয়া শুনিতেও চাহিল কোথাও কোনো দিক হইতে গীত-গান উখিত হইয়া উঠিতেছে কিনা। এই রকম একসময়ে একটা বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে তাহার দৃষ্টি পড়িল।

অনেকগুলি ঘর যেন বাহিরের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া, অনেকরকম তাল তমাল বনরাজির মধ্যে কোনো নিজস্ব জীবন ধর্মে নিবিষ্ট। কিছু পাখপাখালির ডাকাডাকির শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো কোলাহল নাই। পাশে একটা নালা পার হইয়া নয়ানজুলির মতো সরু একটা পথ কয়েকটা ঘরের ভিতরের নিকট দিয়া উঠানের ঠাঁইতে পৌঁছিয়াছে। একধারে রৌদ্ৰে মেলিয়া দেওয়া কয়েকটি শাড়ি-বস্ত্র বাতাসের সঙ্গে দুলিতেছে। একটি শনের চাল দেওয়া ঘরের দাওয়ার উপর সামান্য রৌদ্র, একপাশে মাঝবয়সি একটি মেয়ে সম্ভবত কোনো রিপুকার্যে মগ্ন ছিল, শিকদারের উপস্থিতি লক্ষ করিয়া কপাটের দিকে মুখ ফিরাইয়া কাহাকে ডাকও দিল। সবদিক অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মনে হইলেও, সেই মহিলার দৃষ্টিতে এক রকম তাচ্ছিল্য লক্ষ করিয়া শিকদার বেশ একটু অপ্রতিভ বোধ করিল। কৌতূহলের বশে এমনভাবে কোনো অন্তঃপুরে উঁকি দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ হইয়াছে ভাবিয়া যখন সে ফিরিবার উপক্রম করিয়াছে, সেইসময় ঘরের কপাটের অন্যধার হইতে একটি তরুণী দাওয়ার উপর নামিয়া আসিল। রুণ মুখ, শীর্ণ শরীর, স্নানান্তে হয়তো সে মাথার দীর্ঘ কেশজালের পরিচর্যায় ব্যস্ত ছিল, শিকদারের দিকে একটু উঁকিঝুঁকি দিয়া দেখিয়া আবারও ঘরে উঠিয়া গেল। যে-মেয়েলোকটি দাওয়ার উপর সূচিকার্যে বসা, সে আবারও সপ্রশ্নভাবে শিকদারের দিকে তাকাইল। তাহার মাথার চুল পিঠের উপর ছড়াইয়া পড়া, একটা গামছা কাঁধের উপর আড়াআড়িভাবে বিন্যস্ত, আর দুই চোখে মনে হইল দুইরকম দৃষ্টি; তাহাকে মাথায় আঁচল টানিয়া দিতে দেখিয়া শিকদার আরও অপ্রতিভ বোধ করিল।

: কোথা হইতে আসা হইয়াছে?

শিকদারের উত্তরটা খুব স্পষ্ট হইল না; কোনোরকমে শেষ পর্যন্ত বলিতে পারিল : এইদিকে গীতবাদ্যের আসন বসে বলিয়া একটা কথা শুনছিলাম। মেয়েলোকটি একটুকাল অবাক হইয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে একটু হাসি ফুটিয়া উঠিল তাহার চোখেমুখে একটা হাত উঁচাইয়া সে গাঙের দিকটা দেখাইয়া দিল : কবে কোথায় তারা স্রোতের সঙ্গে ভাসিয়া গেছে। তাগো ঠাঁইও ভাঙিয়া পড়ছে, আর সেইসব চলও নাই। তবে হয় বই-কি এখনও কিছু কিছু তেমন কোনো একটা উপলক্ষ হইলে। কলের গান হয় বাইশকোপের গান হয়। তার জন্যও আগ-আগাম বায়না-বন্দোবস্ত লাগে, যার জন্য আসর, তারগো অবস্থা বুঝিয়াই ব্যবস্থা হয়।

শিকদার তখনও পর্যন্ত কলের গান অর্থাৎ গ্রামোফোন কিংবা বায়োস্কোপের গীত-গানের সঙ্গে তেমন পরিচিত হয় নাই : কৌতূহল বোধ করিয়াছে বটে নানাপ্রকার গান-গল্প শুনিয়া, কিন্তু নিজেকে কখনও বুঝাইয়া উঠিতে পারে নাই জলজ্যান্ত গায়ক-বাদকের উপস্থিতি ব্যতীত সেইসব অনুষ্ঠান কী করিয়া সম্ভব হইতে পারে।

ইতোমধ্যে সেই মেয়েলোকটি আবারও জানিতে চাহিল : কোথা হইতে আসা হইছে? কে পাঠাইছে?

শিকদার আবারও কোনো কিছু যেন স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারিল না : কেউ পাঠায় নাই। কেবল নিজের ইচ্ছায় একটু খোঁজখবর লইতে আসছি। মেয়েলোকটি আবার তাহার শেলাই-এর কাজ হাতে তুলিয়া লইল : যার যার জগৎ-সংসারেরও এক একটা ইচ্ছা আছে মিঞা এখন আর সুখে-দুঃখের ইচ্ছা লইয়াই গীত ধরে না কেউ, কড়ি ফেলিয়াই তার কড়ার হয়।

শিকদার আর কোনো কথা না তুলিয়া ফিরিয়া আসিল। গীত বাদ্যকে কেবল মাত্র জীবিকা-অর্জনের ব্যবসায়ে নিযুক্ত করিবার অভিজ্ঞতা তাহার অবশ্যই ছিল। যে বয়াতির কাছে তালিম নিতে গিয়াছিল, তাহার সঙ্গে কোনো কোনো ভুবনের ফরমাশি গানের আসরে সময় সময় তাহাকেও শামিল হইতে হইয়াছে। সেইসব সময় হইতেই খেয়াল করিয়াছে, যতবার তেমন কোনো আসরে বসিয়াছে মনের চাহিদা কখনও তৃপ্ত হইতে পারে নাই। তাহার কণ্ঠস্বর অথবা গীতের বিশেষ ভঙ্গির জন্য যে যতই সাধুবাদ দেউক, অন্য অন্য কেউর বাঁধা পদ কিংবা গৎ গাহিয়া সে আর সন্তুষ্ট থাকিতে পারিতেছিল না। ব্যস্তসমস্ত গঞ্জের ঘাটের দিকে ফিরিয়া যাইতে যাইতে তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল পিতামহ করমালীও সম্ভবত কোনো দিন তাহার অভীষ্ট সুখ-শান্তি অথবা আনন্দের লক্ষ্যে পৌঁছিতে পারে নাই, হয় বা শুধুমাত্র তাহার ইচ্ছাটাকেই উত্তরাধিকারের মতো সংক্রামিত করিয়া দিয়া গিয়াছে। কেবল অন্যেরই নয়, পিতামহের সমস্ত পথ যে তাহাকেও অতিক্রম করিতে হইবে সেই প্রবোধও সে নিজেকে দিতে পারিল না।

ঘুরিয়া-ফিরিয়া সে আবারও ঘাটের কাছাকাছি সেই বাকটার ধারে আসিয়া বসিল। কোন সুদূর হইতে নামিয়া আসা নদী প্রায় নিশ্চিহ্ন হইয়া পড়া কুমার পল্লির পাড় হইতে গরবিনীর মতো ভঙ্গি করিয়া বাঁক নিয়াছে। নিজ গ্রাম ছাড়িয়া এইসব নদনদী, তাহার উপরকার ঝিকমিক করা ঢেউ, পাড়ে পাড়ে কাশফুলের ব্যজন দেখিয়া সব সময়ই তাহার জোবেদার কথা মনে পড়িয়াছে; চতুর্দিকের সব কিছু দৃশ্য-অদৃশ্যের মধ্যে যে কীভাবে এমন রূপী-অরূপী হইয়া থাকিতে পারে, তা সে কল্পনাও করিতে পারে নাই। সেইসব ভাবনা আবারও যাহাতে মন জুড়িয়া না বসে তাহার জন্য সে যেন মুখ ফিরাইয়া বসিতে চাহিল। সে খেয়াল করিল যেইখানে বসিতে চাহিতেছে, সেই-ঠাঁইটাও একটা প্রাচীন বটগাছের মূল; শিকড়গুলি প্রবলশক্তিতে সমস্ত দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে; কিন্তু কয়েক বৎসরের মধ্যে গাঙ তাহাকেও উপড়াইয়া ভাসাইয়া লইয়া যাইবে। উপরের ডালপালার মধ্যে যে হরিয়াল পাখিগুলি তাহাদের আহার-বিহারে মগ্ন, তাহারাও উড়িয়া অন্য কোথাও গিয়া বসিবে। পিতামহ করমালী একদিক হইতে সম্ভবত ঠিকই বলিত, এই মুলুকের কখনও কিছু স্থির নাই। সম্ভবত সেই কারণেই সকলে গাঙের খামখেয়ালির কবল এড়াইয়া দূর দূর অভ্যন্তরে ঘর-সংসার সাজাইবার চেষ্টা করিয়াছে। অপেক্ষাকৃত একটা পরিচ্ছন্ন স্থান বাছিয়া লইতে শিকদার একরকম পাড়ের নীচেই নামিয়া আসিল। গাছটার কয়েকটা শিকড় যেন গাঙের উপরই পা বাড়াইয়া তাহার গতিবিধি অনুমানের চেষ্টা করিতেছিল। একটু স্বচ্ছন্দে বসিয়াও শিকদারের মনে হইল, সেই গাছটার সঙ্গে পিতামহ করমালীরও কোথায়ও একটা সাদৃশ্য রহিয়াছে। কেন সেই কথা মনে হইল ভাবিয়াও সে কিছুক্ষণ অবাক হইয়া রহিল।

অথচ যত দিন যাইতেছিল, পিতামহের মতো জীবন-যাপনেও সে কোনো তৃপ্তি বোধ করিতেছিল না। পিতামহের মন কেবলই বহির্মুখি দেখিয়া সে যখন নিজেকে স্থিত করিবার প্রয়োজন অনুভব করিয়াছে ঠিক সেই সময়েই তাহারও নৌকা যেন অকস্মাৎ একটা টান খাইয়া দিক-দিশা হারাইয়া ফেলিল। এখন কেবল উদ্ধারের আশাতেই তাহার সকল দিন রজনী কাটিয়া যাইতেছে।

এমন যে নদী সে-ও বাঁক ঘুরিয়াছে; কোন সুদূর উত্তর হইতে সে বহিয়া আসিয়াছে তাহার সর্বাঙ্গ ভরা যৌবনভার লইয়া প্রতি অঙ্গে কাল কাটাইতেছে যেন কোনো রাজরাজেন্দ্রানির রত্নভূষণ, বাস্তবিকই কোনো রমণীর মতো তাহার দেহভঙ্গি, কখনও বা কিছু কথা কলরব। বহুদিন আগে জোবেদার জন্যই সে গাঙের এই রূপ-বর্ণনার জন্য একটা গীত-রচনার উদ্যোগ করিয়াছিল :

কী না ঢঙে কী না রঙ্গে নিরবধিকাল
যমুনা রমণী হইয়া এমন উথাল-পাতাল
সুরয পুরুষ তার, নিত্য করে ঘর
তবু নদী কন্যা থাকে, সূর্য হয় নিত বর

কথাগুলো মনের মতো হয় নাই বলিয়া শিকদার সেই পদগুলি কখনও কোথায়ও উচ্চারণও করে নাই আর। সুর হয় নাই মনের মতো, কথাও খুঁজিয়া পায় নাই মনের সমস্ত ধ্যান বুঝাইবার মতো, শিকদার মনে মনে ঠিক করিয়াছিল, এমনিতেই মানুষের মনে অব্যক্ত কথার ব্যথা-বেদনার সীমা নাই, এখন কেবল তাহাকে আরও উদ্দীপ্ত করিয়া রাখার জন্য তাহার কবিয়াল বৃত্তিরও কোনো অর্থ নাই। লোকে, সমূহ যে-কারণটাকে উপস্থিত দেখিল, তাহা লইয়াই গাল-গল্পে মুখর হইয়াছে। শিকদার একসময় উঠিয়া বসিল হাতে জোড় বাঁধিয়া, সে কী এখনও পর্যন্ত বাস্তবিকই কোনো কবিয়াল হইবার মতো কিছু সামর্থ্য অর্জন করিতে পারিয়াছে? কড়ি লইয়া কড়ার পালনের বিষয়ে সে সচেতন থাকিয়াও কেন লতিফের প্রস্তাবে রাজি হইয়া গেল?

তখন সদরগামী বৈকালের স্টিমার সারা গাঁও ঝপঝপ করিয়া উত্তরের দিকে যাত্রা করিয়াছে। পাড়ে-ভাঙা ঢেউ-এর দৌরাত্মে শিকদারকেও উঠিয়া

.

০৯.

ও মঙ্গলের মাও
আগুন জ্বালাও দেখি
মশা মারি বড়ো পোন পোন করে।

আহা, মাছের মধ্যে মাছরে
ইলশা সে না মাছ
ও তোর রুইরে পোঁছে কে
দেখ দেখ তিত খলিসা চান্দা ধুরাইনা
মোরলগা সংসার রাখিয়াছি।

হ বাড়ির মধ্যে বাড়িরে, ঘরের মধ্যে ঘর
আহা, দালান সেনা বাড়ি
ও তোর ঢেউটিন পোঁছে কে
খড়ুয়া ঝাঁপড়া মাটির ঘরই নারে
মোরগো সংসার রাখিয়াছি।

নারীর মধ্যে নারী সে কুঁচবরণ নারী
ও তোর গৌরা পোঁছে কে
কুঁজা আর ভাঙাচূরা নারীই সে না
মোরগো সংসার রাখিয়াছে।।

বৈকালের স্টিমার আবারও সদরের দিকে দূর হইয়া যাইবার পর ঘাটের চাঞ্চল্য অনেক কমিয়া আসিয়াছিল। দিনের আলোও তখন প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে; বহুজনই ফিরিয়া গিয়াছে আপন আপন লোকালয়ের দিকে, ঘাটে বাঁধা নৌকাগুলির মাঝি-মাল্লারাও সব নিবিষ্ট করিয়াছে নিজ নিজ কর্মে। পাড়ে নামিয়া আরও একবার হোসেনের তালাস করিল শিকদার; তারপর সন্ধ্যা নামিবার সঙ্গে সঙ্গে পাড় হইতে পন্টুন অবধি পাতা বাঁশের কেঁচকির উপরকার তক্তার পুলটার উপর উঠিয়া আসিল। স্টিমার ভিড়াইবার জন্য সেই বিশাল লোহার পলটুনটা চতুর্দিকে মোটা মোটা লোহার শিকলে নোঙরের সঙ্গে বাঁধা গাঙের প্রবল স্রোত তাহার গায়ে লাগিয়াও লাগিতেছে না। আগের ঘাটে শিকদার বাঁধা দেখিয়াছে একটা বড়ো জাহাজের মতোই বিশাল ফ্লাট, আর এইখানে এমন ভোলামেলা পলটুন। মনে হইল, এই ঘাট হইতে তেমন মালপত্র চলাচল নাই বলিয়াই এমন ব্যবস্থা। তবু সেই ভোলামেলার মধ্যে যেন গাঙের মাঝবরাবর খাড়া হইবার সুযোগ পাওয়া গেল। সন্ধ্যার বাতাস যেন সবদিক হইতে ধাইয়া আসিয়া কোনো চপল কৌতুকের মধ্যে তাহাকেও নিবিষ্ট করিতে চাহিল।

: কেটা ওইখানে?

পলটুনের একধারে তেরপলের নীচে কিছু মালপত্র ঢাকা; সেইদিকে জন দুই লোক নিজেদের কোনো কথাবার্তায় মগ্ন ছিল, শিকদার প্রায় অন্ধকারের মধ্য হইতে তাহাদের একজনকে আগাইয়া আসিতে দেখিল।

এইখানে কী করছ মিঞা, এখন কেউর পলটুনে ওঠার নিয়ম নাই, যাও, যাও, পথ দেখো।

শিকদারের ইচ্ছা ছিল বটে সেই নিভৃতে বসিয়া কিছু গীত-গানের কথা আবারও স্মরণ করিয়া লয়, কিন্তু তেমন কোনো সুযোগ না পাইয়া সে ধীরে ধীরে পুল বাহিয়া লতিফের দোকানেই চলিয়া আসিল।

সাড়া পাইয়া লতিফ মহা সমাদরে অভ্যর্থনা করিল : আমি তো চিন্তায় পড়ছিলাম, আপনি বাড়ি ফিরিয়া গেলেন বুঝি! আসেন আসেন, আগে কিছু খাওয়া-দাওয়া হউক। যেমন সাধ্যে কুলায় তেমন কিছু তৈয়ার হইছে।

দোকানের একধারে ঢালাও হোগলা-পাটি বিছাইয়া দিয়াছে লতিফ; পরম উৎসাহে কোথা হইতে একটা দোতারও জোগাড় করিয়াছে, একধারে বসা কয়েকটি লোকও তাহাকে স্মিতমুখে সম্ভাষণ জানাইল।

: আরও অনেক লোজন আসিয়া পড়তে আছে বয়াতিভাই, এই ফাঁকে আসেন, আমরা খাওয়া-দাওয়াটা সারিয়া লই। লতিফ শিকদারকে পিছন দিকের একটা ছোটো ছাপড়া ঘরের মধ্যে লইয়া গেল : মালিক বাড়ি কাছেই, তাগো সেইখান হইতে একজন মাইয়া ছেইলা আসিয়া ব্লাধিয়া দিয়া গেছে। শিকদারের মনে হইল সেরকম অন্ন-ব্যঞ্জন আর বহুকাল চোখেও দেখে নাই; আহারে বসিয়া তবু সে বলিল : এ কী কাণ্ড করছ তুমি, এত সব আয়োজনের তো তেমন কোনো দরকার আছিল না।

লতিফ সস্মিতমুখে জানাইল : একদিকে নানারকমের মাছের কক্ষনো অভাব নাই। তার উপর ধারেই আছে এক জালিয়া পাড়া। আর যে মাইয়াটা রাধে, তারও বড়ো হাতের গুণ আছে। শিকদার কিছু জিজ্ঞাসার উপক্রম করিয়াও থামিয়া গেল; কেবলমাত্র আহারের দিকেই মনোযোগের ভান করিয়া বলিল : আমি তো দেখি তুমি এইখানেই ভালো আছ।

লতিফ স্বর নামাইয়া বলিল : তবু দোকানটা তো আমার নিজের না। আমি মালিকের হইয়া চালাই। তার শরিল-স্বাস্থ্য ভালো নাই বলিয়াই অনেক সময় আমার একলাই সকল কিছু দেখতে হয়। আছি মালিক যতদিন রাখে, মনে মনে ইচ্ছা একদিন ব্যবসা বাণিজ্যের কামে লাগিয়া যাই। এখন কেবল চতুর্দিক চৌখ খোলা রাখিয়া সকলরকম কাম কার্যের রীত-প্রকৃতটা বোঝনের চেষ্টায় আছি। দেশে তো তেমন কেউ আর নাই, তাই পিছুটানও বোধ করি না। আরও একটা কথা কী জানেন বয়াতিভাই, এইসব ঘাটে গঞ্জে থাকিয়াই হয়তো আমি কেবলই চঞ্চল, কেবলই কেমন হইয়া উঠিতে আছি। মাঝেমধ্যে ঘুমাইতে গিয়াও হঠাৎ এমন করিয়া উঠিয়া পড়ি যেন কেউরে চা-বিস্কুট আগাইয়া দিতে যাইতেছি।

শিকদার হাসিতে গিয়াও বিষম খাইল।

লতিফ তাহার দিকে এক বাটি পানীয় আগাইয়া দিয়া বলিল : আরও একটা বিষয় এই, মালিক আসিয়া বসে ক্যাশের কাছে। তখন আমারেও সুর করিয়া জানান দিতে হয় সমস্ত অর্ডার ছাপ্লাই। কোথায় কোনখান থেকিয়া তিনি সেইসব দেখিয়া শুনিয়া আনে। ছোট্ট দোকান হইলে কী হইবে, দেখেন নাই বাইরের চালার ধারে একটা সাইনবোটও লেখাইয়া আনছে সদর হইতে। তবে ওই যে কইলাম সুর করিয়া অর্ডার ছাপ্লাই আমার কাজ না। চিন্তা করিয়া দেখেন একটা মানুষ আচুক্কা ঘুমের মধ্য হইতে উঠিয়া সেইরকম ডাক-চিক্করই ছাড়লে কী অবস্থা হইতে পারে! তায় আবার আমায় গলায় তেমন কোনো সুরই নাই। নকল করিয়া কিছু করতে গেলে কেমন যে ভ্যাঙান ভ্যাঙান বলিয়া মনে হয়। নেন, নেন বয়াতিভাই, আরও কিছু নেন।

শিকদার এড়াইয়া গেল : না, না, যথেষ্ট হইছে। গীত-গানের আগে আমি কখনো আহারে বসি নাই।

লতিফ একটুকাল অবাক হইয়া রইল : আমি তো তা বুঝি নাই। ঠিক আছে আসনের পর আবারও না হয় কিছু মুখে দেওন যাইবে।

ইতিমধ্যে দোকানে বেশ কয়েকজন লোক আসিয়া লতিফকে ডাকাডাকি শুরু করিয়াছে। কেউ হয়তো সেই ঘাটের বাসিন্দা, কেউ কেউ বা মাঝি মাল্লা। শিকদার সকলের মুখের দিকে ভালো করিয়া তাকাইবারও সাহস পাইল না। লতিফ যখন দোতারাটা তাহার হাতে তুলিয়া দিল, তখন সে মুখ নামাইয়া তাহার সুর বাঁধতে ব্যস্ত হইল বটে, কিন্তু কেবলই মনে হইতে লাগিল হঠাৎ করিয়া সেইরকম গানের আসরে যোগ দেওয়া তাহার পক্ষেও সঙ্গত হয় নাই।

একবার বৈকালে দেখা সেই মেয়েলোকটির কথাও মনে পড়িয়া গেল : যখন তখন সুখ দুঃখে গীত ধরে না কেউ। যে ইচ্ছাটা গীত হইয়া ছড়াইয়া পড়িতে পারে তাহাকে কখনই বা সে নিজে ব্যক্ত করিতে পারিয়াছিল!

মুখ তুলিতেই চোখে পড়ল, আসরে আরও কিছু লোকজন আসিয়াছে, তাহাদের সঙ্গে একজনকে কোথায় দেখিয়াছে বলিয়া মনে হইল; দীর্ঘ-শ্যামল চেহারা সাধারণ বেশ-বাস পরিহিত হইলেও অন্যান্যদের তুলনায় অন্যরূপ। দুইচোখে উজ্জ্বল দৃষ্টি মেলিয়া তিনিও তাহার দিকে উৎসুকভাবে তাকাইয়া রহিয়াছিলেন। লতিফও সকলকে চা আগাইয়া কাছে আসিয়া বসিয়াছিল; শিকদারের দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া সে বলিল : হ, আমাদের ঘাট মাস্টার। বয়াতিভাই, উনিও আপনার গীত শুনতে চাইলেন।

: আমি থাকলে আপত্তি আছে? ঘাট-মাস্টার সরলভাবে জানিতে চাইল : আমার টিকেট ঘরের কাজকর্ম শেষ, এই সময় এইখানেই কিছু গল্প-সল্প করিয়া সময় কাটাই। এমন গীতের আসরের কথা জানিয়া আমিও বসিয়া গেলাম।

: ভালো, করছেন, খুউব ভালো করছেন।-লতিফ-ই মাঝে কাড়িয়া জবাব দিল : সেইসব কোনো কথা না, একসময় ছোটো-বড়ো কত আসরে গীত গাইছে বয়াতি ভাই। এখন কেবল অনেকদিন যাবৎ তেমন চর্চা নাই বলিয়াই একটু দোমনা হইয়া পড়ছেন।

: তুমি শুরু করো, শুরু করো, আমিও তোমার একজন গুণগ্রাহী। বড়ো আশা লইয়া বসছি।

শিকদার আবারও মুখ নামাইয়া মনোযোগ দিতে চাহিল দোতারার উপর আঙুলগুলির দিকে : বারংবারই মনে আনিতে চাহিল গাঙপাড়ে খলবল করা তরঙ্গগুলির কথা, সমস্ত জড়তা ভাঙাইয়া তাহাদের মনে সারশীলতার ধ্যান কখনও তাহার পক্ষে সহজ হয় নাই। অনেক জোয়ার ভাটার অনেক অনেক তীর-তট ছুঁইয়া পার হইয়া সে যেন ধীরে ধীরে কোনো স্রোতের মধ্যে ফিরিয়া গেল। এক সময় দৃষ্টির সম্মুখ হইতে সব কিছু মুছাইয়া সে ধীরে ধীরে গাহিতে শুরু করিল তাহার গুরুর কাছে শেখা একটি গান :

আকুল হইয়া কান্দি আমি বসিয়া নদীর কূলে রে
আমায় কে বা পার করে রে, কে বা পার করে।
পার হইতে আইলাম আমি খেয়া-নদীর পাড়ে রে
ঘাট-মাঝির যে নাম জানি না ডাক দিব কারে রে।
কালা পানির কালা কুম্ভীর উঠছে বালুর চরে
কোন সময়ে ধরিয়া খাইবে পরান কাঁপে ডরে রে
ছায়া নিতে গেলাম আমি এক বটবৃক্ষের তলে রে,
সেই না বৃক্ষ দেয় না লক্ষ্য কোন সে কর্মফলে রে।

ধীরে ধীরে গলা খুলিয়া আসতে লাগিল; একই পদ নানাভাবে গাহিয়া শিকদার যেন সমস্ত আকুতিকে আরও স্পষ্ট করিয়া তুলিতে চাহিল। কেবল সেই নয়, বাহিরের ঘাট গাঙ, নৌকার ভিড়ে, গঞ্জের গাছপালার মধ্যেও ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল স্তব্ধতা। আসরে আরও কিছু মাঝি-মাল্লাদের ভিড় বাড়িয়া গেল। লতিফ তাহাদের ঠাঁই দিবার এবং সমাদরেরও কোনো ত্রুটি রাখিতে চাহিল না।

প্রথম গানটি শেষ করিয়া কোনো অজ্ঞাত কারণে শিকদার যেন আর মুখ তুলিয়া তাকাইতে পারিতেছে না; কেবল একসময় বলিল : মনে কয় তোতাপঙ্খির নাহান আউড়াইয়া গেলাম। পরান-ছোওনের মতো গাহনের সাধ্য হইল না।

আসরের মধ্যে হইতে একজন বলিল : খুউব, খুউব। পরান ছুঁইতে পারলা বলিয়াই তো সকলে এমন তবধ হইয়া আছি। ধরো, ধরো তুমি আরেক খান, এই মৌজটা ভাঙিয়া দিও না। শিকদারও এতক্ষণে তাহার জড়তা কাটাইয়া উঠিতেছে। সে টের পাইতেছিল এখন সে যতই গাইবে ততই খুলিয়া যাইবে গলা, একে একে খুলিয়া যাইবে বহু বিস্মৃতির কপাট, কোনো গহন গভীরে ডুব দিয়া সে-ও সম্ভবত উঠাইয়া আনিতে পারিবে কোনো মনি মুক্তা; আর কিছু না হউক, কখনও একটা অজ্ঞাত জগতের রোমাঞ্চ হয়তো সে-ও অনুভব করিতে পারিবে। একমাত্র গানের আসর ছাড়া সেই রোমাঞ্চ যেন অন্য কোথায়ও বড়ো ঘটিয়া ওঠে না। আত্মমগ্নভাবে যদিও সে দৃষ্টি বুলাইয়া লইল সকলের প্রতি, উৎসুকমুখ ঘাট মাস্টারকেও সে দেখিল কি দেখিল না, আবারও সে শুরু করিল অন্য এক পদাবলী :

বিধি যার কর্মে যা লিখিয়াছে রে
দুঃখ কানে যায় না।
আমি দুঃখ লইয়া যাই বন্ধুর বাড়ি
বন্ধু ডাকলে সাড়া দেয় না ॥
সেই দুঃখের ডালি লইয়া মাথে
ঘুরিয়া বেড়াই ভবের পথে
হাটে দুঃখ বেচব বলে রে
সেই দুঃখ কেউ দর করে না যে,
দুঃখ সুখী জনে দর করে না
দর করে আরও দুঃখী জনা ॥
সুখী থাকে দালান-কোঠায়
দুঃখী থাকে বৃক্ষ-তলায়
সুখী প্রেম-সাগরে ডুবিয়া মরে
দুঃখী সাঁতরাইয়া কূল পায় না ।।

যদিও প্রতিটি পদের সুরের মধ্যে নিজেকে যেন সম্পূর্ণ উজাড় করিয়া দিতে চাহিল শিকদার, কিন্তু মনের অতৃপ্তি ঘুচিল না। স্মৃতির মধ্য হইতে জাগিয়া উঠিল আরও অজস্র পদাবলী। শ্রোতারা যতই মুগ্ধ থাকুক, এক সময় শিকদার দোতারাটা সম্মুখ নামাইয়া বসিল।

লতিফ তৎক্ষণাৎ আপত্তি দেখাইল : সে কী, বয়াতিভাই? বেশ তো চলতে আছিল, চলুক, চলুক।

শ্রোতাদের মধ্যে হইতে একজন বলিল : আহা, একটু জিরাইতে দেও মিঞ। গাওন বাদনের মধ্যেও একটা কষ্ট আছে।

আরও একজন বলিল : একটানা গাইতে গিয়া হাট-বাজারের বয়াতিদের কী দশা দেখোনা, মাঝে-মধ্যে সুরটাই কেবল মালুম হয়, গলা ফ্যাস-ফ্যাসত করে কি করে না, কোনো কথা আর পষ্ট বুঝন যায় না।

: হ, হ, মানুষ আর কলের গান না।

: রাখো তোমার কলের গান! তা দেখিয়া-শুনিয়া তাজ্জব হওন যায়, কিন্তুক। এমন করিয়া মন উতলা হয় না।

শিকদার অবসর খুঁজিয়া লতিফকে বলিয়া কিছুকালের জন্য বাহিরে নামিয়া আসিল। তখন ঘন-রাত্রির অন্ধকার যেন বাতাসও কোথায় হটাইয়া লইয়া গিয়াছে। ধীরপদে সে পলটুনের দিককার পুলের উপর গিয়া দাঁড়াইল।

এমন যে অথৈ নদী, তখন তাহাকেও যেন আর চোখে পড়ে না। অথৈ চতুর্দিকের অন্ধকারও কিন্তু ধীরে ধীরে উপরের আকাশে নজরে পড়িল কতকগুলি তারা, ঘাটের একপ্রান্তে কোনো নৌকার মধ্যে কয়েকজন লোকের সাড়াও যেন তাহাকে নিত্যদিনের জগতে ফিরাইয়া নিয়া আসিল।

সেইসময় আরও কানে আসিল লতিফের আসরে অন্য কে একজন কিছু গান ধরিয়াছে; সৌজন্যবশত সে ফিরিতে গিয়াও থামিয়া পড়িল। ঘাট মাস্টারকেও তাহারই দিকে আসিতে দেখিল।

: কী হইল কবি, হঠাৎ এমন উঠিয়া আসলা কেন?

শিকদার একটা সঙ্গত উত্তর দিতে চাহিয়াও পারিয়া উঠিল না, সসঙ্কোচে জানাইল : অনেকদিন অভ্যাস নাই, তাই একটু ডরও ধরিয়া গেল!

ঘাট-মাস্টার কিছুক্ষণ অবাক হইয়া রহিল।

: সব সময় না, মাঝে মধ্যে আগেও কয়েকবার তখন মনে হইয়াছে। শিকদার একটা ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা করিল : একটু জিরাইয়া না লইলে মনে হয় যেন কোন ভাবের জগতের মধ্যেই তলাইয়া যাইতে শুরু করছি।

সেই প্রসঙ্গে পিতামহ করমালীর বিষয়ে সে কিন্তু উল্লেখ করিতে গিয়াও থামিয়া গেল; মনে করিল হয়তো প্রগলভতা হইয়া যাইবে, ঘাট-মাস্টার শিক্ষিত ভদ্রমানুষ, হয়তো বা হাসিয়াও ফেলিবে। তাছাড়া, গানের মধ্যে ডুবিয়া গিয়া করমালী যেভাবে বাহ্যজ্ঞান বিস্তৃত হইয়া যাইত, তা গায়ক না হইলে হয়তো সে নিজেও কখনও বুঝিয়া উঠিতে পারিত না; সংসারের কেউ বোঝে নাই বলিয়াই আরও সংসার-বিরাগী হইয়া উঠিয়াছিল সে। শিকদারের বড়ো ভয় সেও হয়তো তাহার মতোই হইয়া পড়িতেছে।

: বড়ো ভালো লাগল তোমার গান কবি। সারা দিনমানের অনেক রকম তুচ্ছ ক্ষুদ্র বিষয়ের মধ্যে থাকিয়া মনটারে বড়ো উপরে রাখন যায় না। তোমার সব গীত-গান শুনতে শুনতে অনেক কথা মনে উদয় হইল, কবি।-ঘাট মাস্টার পলটুনের দিকে পা বাড়াইয়া বলিল : আসো এমন, খোলামেলায় বসিয়া দু-চাইরটা কথা হউক।

শিকদার একটু ইতস্তত করিয়া তাহাকে অনুসরণ করিল : আমার নাম কানু, কানু শিকদার। কেউ কেউ বয়াতি বলিয়া উল্লেখ করে। কিন্তু আমার আদত নামটাও এখন হারাইয়া যাইতে বসেছে।

ঘাট-মাস্টার একটা ঠাঁই বাছিয়া আসন লইতে বলিল : আমার দিকটা দেখো আমারও আসল নামটা যেন কোথাও নাই। জগৎ-সংসারে যে যা করে, সেই কর্মেই তার পরিচয়। তুমি জগৎ-জীবনের কথা গীতে-কবিতায় শোনাও বলিয়াই তো তোমারে কবি কইলাম।

শিকদার সসঙ্কোচে বলিল : কিন্তু আমি যে কেবল সেইসব গীত-গান করি যা দেশে দেশে মনে মনে ছড়াইয়া রইছে। কত চেষ্টা করলাম সুর আর মনের কথারে যেন কক্ষনোই ঠিকঠাক মিশ খাওয়াইতে পারি নাই। এই দেখি, সুরের আবেগটাই বেশি হইয়া উঠে, আবার এই দেখি যে কথাই বড়ো হইয়া যায়। এইদিক-সেইদিক হইতে সেইসব কথা আমি তুলিয়া-ছানিয়া গাইয়া যাই, তার জন্য তেমন কোনো কৃতিত্বের দাবি আমি করতে পারি না। ঘাট মাস্টার আর কোনো মন্তব্য করিল না। গাঙের স্রোত বহিয়া চলিতেছিল। পলটুনের গায়ে নানারকম ধ্বনি তুলিয়া রাত্রির বাতাসও যেন কিছু খুঁজিয়া ফিরিতেছিল সর্বত্র। শিকদার একটুকাল অপেক্ষা করিয়া জানিতে চাহিল : আপনারেও আমি নিরাশ করিয়া দিলাম।

ঘাট-মাস্টার হাসিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিল : নাহ্, বরং ভাবতে আছিলাম। তোমার কথা শুনছি কিছু-কিছু, এখন এইরকম চিনতে পারিয়া খুশি হইলাম। কবি, তোমার অনেক গুণ। এমন গীত-গান, এমন ক্ষমতারে যে পেশা করো নাই, তার জন্যই মনে হয় তোমার জন্য যেন কবির কর্তব্যটাই নির্দিষ্ট হইয়া রইছে।

শিকদার একটু যেন কাঁপিয়া উঠিল, ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই ঘাট মাস্টারের কথা; সম্ভ্রম করিয়া সে কোনো ব্যাখ্যাও চাহিতে পারিল না। একটু ইতস্তত করিয়া সে বলিল : লতিফ ছেলেটা ভালো। এত কষ্ট করিয়া আসর বসাইছে, এমন করিয়া উঠিয়া আসিয়াও স্বস্তি পাইতে আছি না!

ঘাট-মাস্টার মুখ ফিরাইয়া হাসিয়া উঠিল : কষ্টটা কি লতিফের একলার? আসরে যারা আসছে, তাগোও আছে। কান পাতিয়া শোনো, এখন আদিরসের বন্যা চলতে আছে! জানো তুমি তেমন কিছু গীত?

শিকদার একটু অপ্রতিভ হইয়া পড়িল। ঘাট-মাস্টারের কথা হয়তো কিছু বুঝিল, কিছু বুঝিল না। মনে পড়িয়া গেল গুরু কবিয়ালের নির্দেশে একসময় তাহাকে বড়ো বড়ো মানুষের ঘর উঠাইবার সময় ছাদ-পিটানোর কাম-কার্যেও উপস্থিত থাকিতে হইয়াছে; মূল বয়াতি কাজে উৎসাহ জোগাইবার জন্য একটার পর একটা সময় প্রসঙ্গ লইয়া ছড়া বাঁধিয়াছে বেহালাবাদকের তালে তালে; কোনো কিছুর পরোয়া না করিয়া সে বারংবারই ঘুরিয়া-ফিরিয়া ধুঁয়া তুলিতে চাহিয়াছে যে জীবনে নর ও নারীর সম্পর্ক ছাড়া অন্য কোনো রসের বস্তু নাই। শিকদার যে সেইরকম সংসর্গেও কোনোরকম স্বস্তিবোধ করে নাই।

ঘাট-মাস্টার একসময় তাহার দিকে ফিরিয়া জানিতে চাহিল তাহার সব কথা, কোথায় ঘর-বাড়ি, কেনই বা জীবনে এত বৈরাগ্য, কেনই বা শুধুমাত্র দুঃখের গীতটাই একমাত্র তাহার মনের আকুতি হইয়া উঠিয়াছে, এমনও হইতে পারে না যে লোকে আপন দুঃখটাকেই বড়ো করিয়া দেখে বলিয়াই জীবনের সবখানে দুঃখ ছাড়া অন্য কিছু নজরে পড়ে না? ঘাট-মাস্টারের তো মনে হয় একটা আনন্দের মধ্য দিয়াই সৃষ্টি হইয়াছে জগৎ-সংসার, সেই আনন্দ কেবল ওই আদিরসে আপ্লুত হইবার জন্যই নয়, আরও কিছু বড়ো এবং বৃহৎ? গীত কি কেবল হয় সুরে আর কথায় মিলাইয়া, এই এত বড়ো বিশাল ভুবনটার সঙ্গেও মিল রাখিতে হয় না? কত মানুষই তো কতো দুঃখ ব্যথা বুকে লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে ভুবনের পথে-ঘাটে। স্টিমারের টিকেট ঘরে বসিয়া সে দেখে কত মানুষ ছোটাছুটি করিতেছে পৃথিবীর সর্বত্র, এক এক ঘাটের টিকেট দিতে দিতে ঘাট-মাস্টারের বারংবারই মনে হইয়াছে তাহারা উদ্দিষ্ট-অভীষ্ট সম্বন্ধে বাস্তবিকই অভ্রান্ত কিনা; শিকদারের গান শুনিতে শুনিতে তাহারও মনে প্রশ্ন জাগিয়াছে দুঃখভরা পৃথিবীর অতৃপ্তি হইতে মানুষকে মুক্ত করিয়া শান্তি-স্বস্তির পথে উদ্বুদ্ধ করা যায় কি না। সুখ কোথায় তা নির্দিষ্ট করিয়া দিতে না পারিলে হয় অতৃপ্তিটাই বড়ো হইয়া থাকিবে, না হয় একমাত্র কতকগুলি আদিরসের দিকেই সকলে ঝুঁকিয়া পড়িবে।

: তোমার মতো কোনো গুণ আমার নাই কবি। দিনে দিনে কেবলই দেখতে আছি, আমার এই একলার দুঃখটাই বড়ো কথা না, কত দুঃখ এই সংসারে। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের মনে কত শত দুঃখ। তোমারই গানে শুনলাম কেউ বা ডুবিয়া মরে, কেউ বা সাঁতরাইয়া কূল পায় না। এই কথা তোমার মুখে শুনলাম বলিয়াই মনে হইল একবার আলাপ করি। এই দুঃখ পার হইবার কোনো নতুন উদ্দীপনা মানুষের মনে দেওন যায় না? শিকদার মনোযোগ দিয়া ঘাট-মাস্টারের কথাগুলি শুনিতে লাগিল; কোনোরকম মন্তব্য করিবার সাহস হইতেছিল না, কোনো কোনো কথা তাহার আপন ভাবনাগুলিকে আরও উদ্দীপিত করিয়া তুলিল।

দুঃখ কি কেবল কোনও কন্যার জন্য? দেখো নাই আকালের দিন? চৌখে পড়ে না সেই দুঃখ যখন মানুষ আহার পায় না জীবন রাখার, পোশাক পায় না শরম ঢাকার? কী দুঃখে মানুষ পথে নামিতে পারে দয়ার ভিক্ষার হাত পাতিয়া, সমস্ত ভালোবাসার স্বপ্ন নিবাইয়া দেয় ঝি-বউ আত্মহত্যা করিয়া, সকল দুঃখের অবসান করিতে চায় তোমার-আমার মতো কত শত মানুষ! সেই দুঃখে, আমার তো মনে হয়, যেন আসমানও ভাঙিয়া পড়িতে আছে।

এক সময় শিকদার কেবল বলিতে চাহিল : এই দুঃখ বিধির বিধান বলিয়াই তো মানিয়া লইছে সকলে। এই দুঃখই ভব-যন্ত্রণা সংসারের বেয়াধি। আমার নানার কাছে এমন কথাই বারংবার শুনছি। আউল-বাউলের গীত-গান কী তত্ত্বকথার মধ্যে তো দেখি এই বিষয়টাই মুখ্য হইয়া আছে।

: সেইখানেই তো আমার কথা। ঘাট-মাস্টার একটু নড়িয়া চড়িয়া বলিল : এইখানেই দেখি, একটা বড়ো ফাঁকির রাজত্ব চলতে আছে চতুর্দিকে। জগৎ সংসার যে সকলের জন্য আনন্দের হইতে পারে সেই কথা কেউর মুখে নাই, কোনো কবির গীত-কথাতেও শুনি নাই। কবি, আইজ সন্ধ্যায় তোমার মুখে সেইরকম কোনো গীত শুনতে পাইলে আমি আরও খুশি হইতাম।

শিকদার কিছুকাল সঙ্গত কথা খুঁজিবার চেষ্টা ছাড়িয়া বলিল : বিধির বিধানের বাইরের কোনো লবজোর দিকে আউগানের কি সাধ্য আছে মানুষের দুঃখ তো সৃষ্টিকর্তারই শাস্তি। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে কত পাপ করিয়া চলছে মানুষ, দিনে দিনে তার পাপ, তার শাস্তি ক্রমে ক্রমে আরও বেশি হইয়া উঠতে আছে, চতুর্দিকে কেবল এই কথাই তো শুনি।

ঘাট-মাস্টার হাসিয়া উঠিল, যেমন সে যখন-তখন হাসে, তারপর ধীরে ধীরে বলিল : এ জন্যই তো তোমার কাছে নতুন কিছু শুনতে চাই কবি। বিধিরই বিধান আছে জ্ঞানচর্চার। মিল কেবল সুর আর কথারই না, একটা বিশেষ জ্ঞানরেও দোসর করিয়া লইতে হয়। যারা বলিয়া আসছে জীব জগতের সব দুঃখ সৃষ্টির গজব, তারা চিরকালই অমন বলিয়া আসছে, আরও বলিয়া চলবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান আউগায় না বলিয়াই এইখানে একটা ফাঁকি আছে, ফাঁকি দেওনের সুযোগ আছে। আসলে সৃষ্টির গজব ওই আউল-বাউল আর ধর্মগুরুর দল। নিজ দুঃখ মোচনের শক্তি মানুষের নিজেরই আছে। তোমার এক গীতেই তো শুনলাম বিধি যার কর্মে যা লিখ্যাইছে। এইভাব এক উপলব্ধি। তার সঙ্গে যুক্ত হইছে ‘দুঃখ কাঁদলে যায় না। আমি মনে দিয়া শুনলাম। মনে অনেক কথার উদয় হইল। কেন জানি না বোধ করলাম আরও কিছু নতুন কথা শোনা যাইবে তোমার মুখে। কর্মের গান, একসঙ্গে সমস্ত জীবন দিয়া নতুন জীবনের গান। কবি কবে সেই কথা, সেই গীত-গান তোমার মুখে শোনার সুযোগ হইবে? আমার তো আশা, তোমার মতোই কেউ পারবে সব ভণ্ডামি সব কৌশলের ষড়-জাল ছিন্নভিন্ন করিয়া আসল আনন্দের সন্ধান দিতে। কবি, কবে সেই দিন হবে? শিকদারের মুখে কোনো উত্তর আসিল না। শৈশবকাল হইতে, বৃত্তি না হউক, একটা আনন্দ হিসাবে যে পথ সে বাছিয়া লইয়াছিল, তাহার উপরে চলিতে চলিতে অজস্র ভাবনা তাহারও মনে গুমরিয়া উঠিয়াছে, কিন্তু তেমন পরিস্থিতির মধ্যে সে কখনও পড়ে নাই। কেন যেন মনে হইতে লাগিল ঘাট-মাস্টার নয়, কোনো ঘাট-মাঝিই তাহাকে খেয়া-পাড় হইতেই মনস্থ করিবার জন্য ডাকাডাকি করিতেছে।

: অবসরে-আলস্যে না, কর্মে-ধর্মেও যখন তোমার গীত-গান মুখে মুখে গাওয়া হইবে, তখনই সার্থক হইবে তোমার কবি’ নাম। দেখিও, তোমার গীত শোনার জন্য আমি, আমার মতো আরও বহু জন প্রথম সারিতে বসিয়া আছে। আগামীদিনের কর্ম কার্যের উপযুক্ত বল-ভরসার জন্য কোনো দুঃখের রাত্রি পার হওন কিছু কঠিন হইবে না। কবিরাই তো যুগে যুগে মানুষের পথ দেখাইয়া আসছে।

গানের আসরে বসিয়া শিকদার কিছুটা ইচ্ছায়, কিছু অনিচ্ছায় এক ধরনের রোমাঞ্চকর প্রত্যাশা করিতেছিল। ঘাট-মাস্টারের প্রতিটি কথায় যেন অর্গল খুলিয়া গেল অন্য কোনো ভুবনের, বারংবারই তাহার মনে হইতে লাগিল সে যেন অবশ্যম্ভাবী কোনো সত্যের মুখোমুখি আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, যেইখান হইতে আর অন্য কোনো দিকে যাইবার উপায় নাই। অন্যের গীত-গান কথার ঐতিহ্য লইয়া যদি তাহাকে নিজ জীবন-যাপনের জন্যও অগ্রসর হইতে হয় তাহা হইলেও তেমন মুসলাধান হয়তো আর মিলিবে না। অনেকক্ষণ অবধি মুখ নিচু করিয়া নানাভাবে ঘাট-মাস্টারের কথাগুলি মনে মনে পর্যালোচনা করিল শিকদার, এক সময় মুখ তুলিয়া ধীরে ধীরে বলিল : হয়তো আমি সামান্য বলিয়াই কখনও কোনো বৃহতের কথা চিন্তাও করতে পারি নাই। আমাকে দিয়া জগৎ-সংসারের কোনো কাম হইলে আমারও জীবনধারণ সার্থক হইয়া যাইবে।

ঘাট-মাস্টার হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইল! চলো যাই, এতক্ষণে আদিরসের বিষয়েও সকলের ক্লান্তি ধরিয়া যাইবার কথা। দেখন যাউক, অন্যেরাও বা কতটা মিলমিশ করতে পারছে!

.

১০.

সুখেরে করিয়াছি বৈরী রে বঁধু
দুঃখেরে দোসর
আমি পরের পিরিতে মজিয়া
আপন করিয়াছি পর।
কুলেরে করিলাম বৈরীরে
আমি অবলা রমণী
বঁধুর পিরিতে ডাকিয়া
কলঙ্কেরে আনি।
ঘরেতে আগলেরে বঁধু
দুয়ারেতে কাঁটা
সাধ করিয়া খাইয়াছিরে
পিরিত গাছের গোটা।
যেজন খাইয়াছে রে বঁধু
পিরিতিরই ফল
তার কলঙ্কে মরণ বঁধু
জীবন সফল ॥

নৌকার পর্দার উপর হইতে হাত সরাইয়া জোবেদা বহুক্ষণ অবধি নতমুখে বসিয়া রহিয়াছিল। হয়তো অনেককিছুই বলিবার বা জানিবার ইচ্ছা হইয়াছিল, কিন্তু সম্ভব ছিল না। স্বামী তাহাকে কোনো পীর-সাহেবের দরগায় লইয়া যাইবার পথে কী উপলক্ষে উঠিয়া গিয়াছিল গঞ্জের ঘাটে, পিছনে শাশুড়ি কেবলই বকবক করিতেছিল। সে বেশ শক্তভাবেই শুনাইয়া দিতেছিল যে-মেয়েমানুষ বাহিরের দিকে উঁকিঝুঁকি দেয়, তাহার সংসারে অমঙ্গল অবশ্যম্ভাবী; আরও শুনাইতেছিল তাহাকে উপযুক্ত হেদায়াতের জন্য পীরসাহেবের কাছে সে আরও কী কী বলিবে। সেও শিকদারকে দেখিতে পাইলে, অথবা হঠাৎ আসগরউল্লাও কোনো কিছু টের পাইলে আরও অনর্থ ঘটিবে। জোবেদা গাঁ-গ্রামের অন্যান্য মেয়েদের মতোই বড়ো হইয়া উঠিয়াছে এবং একদিন যেমন হয়, আত্মীয়-স্বজনদের বন্দোবস্তে বিবাহে বসিয়াছে। বারংবার নানাদিক হইতে নানাকথা শুনিয়া শুনিয়া তাহারও মনে হইয়াছিল বিবাহের অর্থ বিত্ত, সম্পত্তি, স্বচ্ছন্দ্য। বাহিরের জগতের বিভিন্নরকম দুঃখ-দুর্দশা দেখিয়া-জানিয়া সে-ও কিছু স্বাধীনতার প্রত্যাশা করিয়াছিল। অথচ সংসার-সংসার খেলার মধ্যেও যে আনন্দ অনুভব করিয়াছে তাহাও কোথাও খুঁজিয়া পায় নাই। স্বামী আসগরউল্লা বেশ বয়সি এবং ব্যবসায়ী মানুষ। হাটে হাটে কাটা কাপড়ের কারবার করিয়া এখন নলসিঁড়ি গঞ্জে একটি ছোটো দোকান দিয়াছে। অধিকাংশ সময়ই সে কাটায় বাহিরে। বিবাহের কিছুদিনের মধ্যেই সে জোবেদাকে বুঝাইয়া দিয়াছে কতগুলো স্কুল কর্তব্য ছাড়া তাহার আর কোনো বিশেষ ভূমিকা নাই। তাহার প্রধান কর্তব্য শাশুড়ির সেবা-যত্ন, সে ব্যবসা উপলক্ষেই বাহিরে থাকে না অন্য কোননা ঠাঁই-সংসার আছে কী নাই সেইসব কৌতূহলও তাহার অধিকারের বাইরে। শাশুড়ি-ভাগ্যও এমন যে শত চেষ্টা করিয়াও তাহার মন জোগানো যায় না; সর্বক্ষণ গজগজ করিবার মতো একটা না একটা বিষয় সে খুঁজিয়া বাহির করিবেই। সন্তানবতী না হওয়ায় তাহার নানারকম কটুক্তি-উপহাস আরও বাড়িয়াছে। এমন অবস্থায় তাহার মতো মেয়েরা বাপের বাড়িতেই ফিরিয়া যাইবার জন্য ব্যাকুল হয়। জোবেদার পক্ষে সেইরকম কোনো সম্ভাবনা ছিল না। মা আর বাঁচিয়া নাই, পিতাও যেন কর্তব্য সমাধা করিয়া এড়াইয়া রহিয়াছে। আপন স্বাধীন সংসারের আগ্রহে তাহাকে যে এমন বন্দিনী হইয়া পড়িতে হইবে তা সে কোনোদিন কল্পনাও করিতে পারে নাই। সেই দুঃখ লাঘব করিবার মতো কোনো উপায় ছিল না। মনে হইয়াছে কয়েকবার শিকদারের কথা, যে তাহাকে দুঃখহরণ রাজপুত্রের কাহিনি শুনাইয়াছে, কখনও কখনও কিছু আশাও মনে উঁকি দিয়া গিয়াছে কিন্তু তাহারও মধ্যে কাম্য পৌরুষ সে খুঁজিয়া পায় নাই। সেদিনও মনে ক্ষোভ দেখা দিল শিকদারই বা কেন আগাইয়া আসিয়া দুইটা কথা বলিল না।

আসগরউল্লা গম্ভীর পুরুষ, কথাবার্তা বলে কম, হাসি-পরিহাসও তাহার ধাতে নাই, বরং উলটা বুঝিয়া বসে। সে যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, আরও সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িতে হয় জোবেদাকে। একদিকে তাহাকে খুশি রাখা, তাহার জন্তুর মতো সকল খেয়াল-খুশি এবং সাধ-আহ্লাদ মিটাইয়া চলা, অন্যদিকে সেই সব কালে শাশুড়ির মেজাজ আরও তীব্র হইয়া উঠিত। তাহার নানারকম বিদ্রূপও মন্তব্যের অশ্লীলতায় সে যেন পুকুরে ঝাঁপ দিয়া পড়িয়াও শান্তি পাইত না। মাঝে মধ্যে মনে হইত মেয়েমানুষ হইয়া জন্মগ্রহণের মতো অভিশাপ বুঝি আর নাই। কখনও কখনও সে বহু কষ্ট করিয়া একটু নিভৃতি খুঁজিত; কোনো আপনা বিষয় লইয়া মনে মনে নাড়া-চাড়া করিত নানা কথা, কখনও শৈশবদিনের নানা স্মৃতি মনে ভিড় করিয়া আসিত। কখনও মনে হইত সুযোগ পাইলে সে যেন আবার তাহার কৈশোরকালের মতো কুড়ায় মাতিয়া উঠিতে পারিবে কিন্তু শাশুড়ির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন বাজ-চিলকেও হার মানাইয়া দিত।

: কোথায় চাইয়া আছিলা অমন করিয়া? এ?

: কোথাও না।-জোবেদা তাহার সম্মুখ হইতে সরিয়া যাইবার চেষ্টা করিত।

শাশুড়ি ছাড়িত না : দেখো, দেখো, চৌখের উপর মিছা কথা! আমি সেই কখন থেকিয়া দেখতে আছি।

: বেশ তো, দেখেন আপনে যা-খুশি, কয়েন আপনে যা-খুশি।

শাশুড়ি আরও ফুঁশিয়া উঠিত : কী, এখন মুখের উপর কথা। চাপা সামলাও বউ। পোলারে যদি বলি ওই চোপা ছেইচ্চা দেবে কইলাম।

জোবেদা সংযম হারাইয়া ফেলিত, ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া কাঁদিয়া ফেলিত : ক্যান আপনে আমারে একটু শান্তিতে থাকতে দেখতে পারেন না? কোন দিকে চাইয়া কী দেখছিলাম, কী ভাবতে আছিলাম সবই কওন লাগবে আপনারে? আমার উপর এমন চৌখ রাখার কী দরকার পড়ছে?

শাশুড়ি দমিত না : নিশ্চয় দরকার আছে, তোমার মতি গতি ভালো না। আমার এমন ছাওয়ালটারেও ঘরে বাঁধিয়া রাখতে পারতে আছ না? এতদিন চলিয়া গেল তবু তার কোনো উদ্দেশ নাই?

: আপনিই জিজ্ঞেস করিয়েন তারে সেই সব। না হয় আপনেই ভালো করিয়া জানেন।

: আমি জানি? আঁ, কী জানি আমি?-শাশুড়ি তাহাকে কোনোক্রমেই রেহাই দিতে চাহিত না; কোনো কথার জবাব না পাইলে আরও ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিত; কেবল এক সময় শারীরিক শ্রান্তির জন্যই কোথাও বসিয়া হাঁপাইতে শুরু করিত : আসুক এইবার গ্যাদা বাড়ি, আমার উপর চোপা-চালানোর একটা বিচার চাই।

: আসুক, আমিও এর একটা বিহিত চাই। আসমানের মেঘও দেখা যায় না চৌখ তুলিয়া?

শাশুড়ি হাঁপাইতে হাঁপাইতে তবু বলিত : দেখছি, আসমানটা বুঝি পাছ-দুয়ারের পুকুর ধারে উবধ হইয়া খাড়াইয়া আছিল!

সেই শাশুড়ি এখন শিকদারকেও দেখিয়া ফেলিলে আর রক্ষা থাকিত না। ঘটনা কেবলই গড়াইয়া চলিত। আসগরউল্লা একদিন বাড়ি ফিরিলে সে শতগুণ করিয়া নালিশ উঠাইত; আহার-বিহার এমনকী স্বামী-স্ত্রীর নিভৃতির কালেও সে সমস্ত অভিযোগ স্মরণ করাইয়া দিতে চাহিত। আসগরউল্লাও এক এক সময় ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিত; আদর-সোহাগের ভান করিয়া সে ঝাঁপাইয়া পড়িত তাহার উপর : তোমারে বলি নাই আমি ‘মা’-এর সঙ্গে আদব-লেহাজ লইয়া চলবা, ঠেশ দিয়া কথা কইবা না? এ? কই নাই?

জোবেদা ভয়ে কাঠ হইয়া যাইত, পীড়াপীড়িতে কখনও বলিত : আমি তো চেষ্টার ত্রুটি রাখি না।

আসগর জানিতে চাহিত, সমস্ত শরীর দুমড়াইয়া : তবু কেন এমন হয়?

এক সময় জোবেদাকে কাঁদিয়া বলিতে হইতে : আমি জানি না, জানি না!

আসগরউল্লা আর কোনো প্রশ্ন করিত না; সমস্ত অভিযোগ-আক্রোশের প্রতিশোধস্পৃহা লইয়া সে জোবেদার দেহটাকে দলিত-মথিত করিতে শুরু করিত; সে শ্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত জোবেদা যেন নিশ্বাস লইবারও অবকাশ পাইত না; কেবল যখন টের পাইত শাশুড়ি ন্দ্রিাগ্রস্ত হইয়া পড়িয়াছে, সেই সময়ই সে নিজেকে গুছাইয়া সেইসব কালরাত্রি অবসানের প্রতীক্ষায় থাকিত। বাহিরের অন্ধকার যেন কঠিন-কঠোর দেওয়ালের মতো ঘিরিয়া ছিল সব দিকে, কোনো মুক্তির পথ দেখিতে পাইত না।

কোথায় গেল জোনাক-জ্বলা রাত্রি নিশুতির উমের মধ্য হইতে শোনা ডাহুকের ডাক? সে যেন এখনও নিজেকে স্পষ্ট দেখিতে পায়, উঠানের একধারে চুলাশালের কাছে সে কখনও ধাঁধার মীমাংসায় অস্থির হইয়া আছে, কখনও বা কোনো সওদাগর অথবা কোনো রাজপুত্রের কাহিনি শুনিতে শুনিতে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। বিরাট উঠানের মধ্যখানে ধান-মলা চলিতেছে সারা রাত্রিভর, একধারে পুথির আসর লইয়া সমস্ত শৈশবের সঙ্গী সেই শিকদার একটা দোতারা গলায় ঝুলাইয়া গীতের পর গীত গাহিয়া বর্ণনা করিতেছে জগৎ-সংসারের কথা, মাঝে মাঝে খুব বিরক্তি ধরিয়াছে শিকদারকে সেইরকম ভাব-বিহ্বল দেখিয়া, তাহার মুখে ভারী ভারী তত্ত্বকথা শুনিয়া। কতবার ইচ্ছা হইয়াছে তাহাকে জোর করিয়া সেই সব আসর হইতে উঠাইয়া লইয়া যায় ঘরের কাছে একটা পেঁপে গাছের তলায় তাহার মিছামিছা সংসার খেলার আসরে, মিছামিছা রান্না খাওয়াইয়া সে কেবলই জানিতে চায় : পোলার বাপ, রান্না কেমন হইল?

সবই শিখাইয়া দিতে হইত শিকদারকে, মুখে সব কঠিন কঠিন ভাবসাবের কথাবার্তা বলিলেও সেই একটা সময়ে সে যেন বলিবার মতো কোনো কথাই খুঁজিয়া পাইত না, জোবেদা যতই শিখাইয়া দেয়, ততই সে ভুল করে দেখিয়া তাহার খুশি আরও উখিত হইয়া উঠিত। একদিন অবশ্য সন্দেহ হইয়াছিল সেই সব ভুলগুলি স্বাভাবিক, না তাহাকে হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতে দেখিবার জন্যই সে ন্যাকা ন্যাকা ভালোমানুষের ভাব-সাব দেখাইতে শুরু করিয়াছিল? তাহা হইলে কেন সে জোবেদাকে পরের বাড়ি উঠাইয়া লইবার কালে বাধা দিতে দাঁড়াইল না?

কী করিত জোবেদা, নামিয়া পড়িত পয়সাবারদের পালকি হইতে? কোথায় যাইত শিকদারের হাত ধরিয়া? কেবল রাত্রির নয়, অসংখ্যরকম বাধা-নিষেধ আর নিয়ম-কানুনেরও অন্ধকার আছে চতুর্দিকে, জোবেদা যাহার কোনো দিনও কোনো কূল পায় নাই।

সেই শৈশব যে শিকদারের সঙ্গেই এমন একান্ত হইয়া আছে, তা কখনও মনে হয় নাই জোবেদার। পরের বাড়ি যাইয়া একদিন সমস্ত পরিচিত বিশ্বসংসারও এমন করিয়া মুছিয়া যাইবে জীবন হইতে, তা বিন্দুমাত্রও জানা থাকিলে সে বাস্তবিকই পালকি হইতে নামিয়া পড়িত, একে একে নববধূর সমস্ত বসন-ভূষণ ত্যাগ করিয়া তাহার মাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিত : মা, মা। গো, আমারে এমন করিয়া পর করিয়া দিও না। যে-কান্না বিবাহের কালেও জোবেদার চৌখে দেখা যায় নাই, এখন তাই সব সময়ের সঙ্গী হইয়া উঠিয়াছিল।

অথচ, একদিন বিদ্রোহ সে-ও দেখাইল।

শাশুড়ি ভড়কাইয়া গেল, আসগরউল্লাও তাহার সেই মূর্তি হয়তো কল্পনাও করিতে পারে নাই। জোবেদা এমন কঠিন হইল যে কাহারও ইচ্ছার কাছে সে আর নিজেকে সমর্পণ করিতে চাহিল না। কোনো কথা-কাটাকাটি কিংবা বাদ বিসম্বাদ নয়, একটা উপেক্ষা এবং ‘না’-এর ব্যুহ নিজের চতুর্দিকে খাড়া করিয়া যেন যুদ্ধে নামিয়া গেল।

শাশুড়ি কাঁথা জড়াইয়া গোঙাইতে লাগিল, আসগরউল্লাহও অবাক। এইভাবে দিন যায়, মাস যায় একদিন শাশুড়ি-স্বামী অনেক পরামর্শের পর স্থির করিল তাহাকে হেদায়েতের জন্য কোথায় কোনো মুলুকে লইয়া যাইতে হইবে। জোবেদা কোনো আপত্তি উঠায় নাই। সেই বাড়ি-বাড়িয়ালের বাহিরে কোনো অন্য কিছুর অস্তিত্ব তাহার কাছে আর স্পষ্ট ছিল না। সে মনে মনে ভাবিল হয়তো বা বাস্তবিকই একটা উদ্ধারের উপায় মিলিয়া যাইবে।

শাশুড়ি কেবলই শাসাইতেছিল কুলগুরু সেই পীর, তোর বাপে ও তার বাপেও তার কথা ঠেলতে পারে না।

জোবেদারও ইচ্ছা হইয়াছিল তাহাকে একবার মুখোমুখি দেখে, জানিয়া লইতে চায় সমস্ত গুনাহগারির উস, না মানুষেরই পক্ষে সমস্ত কিছু মানিয়া চলা ছাড়া অন্য উপায় নাই? এমন কোনো দোজখ বাস্তবিকই আছে কি যা তার এই সংসার হইতেও কঠোর? জোবেদা কঠোর হইয়াছিল সত্য, কিন্তু কঠিন তখনও হইতে পারে নাই। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে সে একটা উদ্ধরণের উপায় খুঁজিতেছিল।

সেই মুহূর্তে শিকদারের দেখা পাওয়া কল্পনারও অতীত বিষয়। জীর্ণশীর্ণ শরীর, বেশবাসও ততধিক ঔদার্যভরা; আবারও মনে হইল সে যেন এই জগৎ সংসারে থাকিয়াও নাই, কিন্তু তাহার দৃষ্টিতে আবারও যেন কোনো সুদূর শৈশবকাল কথা কহিয়া উঠিল, জোবেদা কাঁপিয়া উঠিল।

মনে পড়িল, শৈশবকালে সে একবার কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, বাড়ির উঠানে এক গাজিকে দেখিয়া। মুখে তাহার খুনখারাপি মাখা দাড়ি, মাথায় পাগড়ি, আর হাতে অর্ধচন্দ্র আকারের হাতল দেওয়া লাঠি, বারান্দার সামনে দাঁড়াইয়া সে সুর করিয়া জানিতে চাহিয়াছিল :

আপনেরা সব ভদ্দরলোকের ছেইলা পেইলা,
ভদ্দরলোকের ঝি
গাজি আইছে উদ্ধারণের বিষয় লইয়া
তারে বিদায় দেবেন কী?

গাজির সেই চেহারার মধ্যে কোনো ভিক্ষাবৃত্তির চিহ্ন ছিল না, কী একটা অজ্ঞাত ভয়েই বুক কাঁপিয়া উঠিয়াছিল। শিকদারের আবির্ভাবেও তেমন কোনো আবেদন-নিবেদন নাই, অথচ একটা দাবি, একটা অনুচ্চারিত ভর্ৎসনা চতুর্দিকের আকাশে-বাতাসে ছড়াইয়া রহিল, জোবেদা কাঁপিয়া উঠিল, অধোবদন হইল।

সেই সময় শাশুড়ির অবিশ্রান্তভাবে বিলাপ করিয়া যাইতেছিল : যৈবন কেউর চিরকাল থাকে না, না থাকে আছইট। পুরুষ ছাড়া মাইয়া-মানষের কোনো গতি নাই। তারে হেলায় ফেলিয়া জীবন চলে না। কোনো দিন চলে নাই। কোনোদিন তাহার বিলাপ-প্রলাপের কোনো অর্থই করিতে পারি নাই জোবেদা। নৌকার পর্দার নিকট হইতে সরিয়া আসিয়া সে তাহার কাছে আসিয়া বসিল। হঠাৎ মনে হইল এই বৃদ্ধাও হয়তো বা তাহার মতোই অনেক কিছু সহ্য করিতে করিতে সমস্ত বিশ্ব-সংসারের প্রতি কেবলই মুখ খিচাইতেছে, আপন ইচ্ছামতো কোনো সাধ-পূরণের সাধ্য তাহারও হয় নাই; ভালোবাসা চাহিয়াছে, কিন্তু পায় নাই, তাই ক্ষমতা-প্রয়োগের মধ্য দিয়া ভালোবাসার দাবিটাকেই একমাত্র সত্য করিয়া তুলিবার জন্য সারাক্ষণ ব্যস্ত হইয়া রহিয়াছে। একবার ইচ্ছা হইল সে তাহাকে আরও কঠোরভাবে বলে সময় আছে বলিয়াই সে এখনও বিদ্রোহ করিতে চায়, নৌকা হইতে নামিয়া যাইতে চায় যেইদিকে চলে দুই চোখ, বেলা থাকিতে থাকিতে হয়তো সে পৌঁছাইয়া যাইতে পারিবে কোনো লক্ষ্যে, শুধুমাত্র বিলাপ-প্রলাপের কোননা ভবিতব্যকে সে কখনও মানিয়া লইতে পারিবে না। কিন্তু কোনো কথাই তাহার মুখে জোগাইল না, নৌকার ছই-এর বাহিরে কয়েকটা গাঙচিল কী কাদাখোঁচা পাখিকে বারংবার উড়িয়া উড়িয়া ঘুরিতে-ফিরিতে দেখিয়া তাহারও মনে হইতে লাগিল, নিজ জীবন ধারণের জন্য তাহাকেও একটা উপায় বাছিয়া লইতে হইবে। ঘরের জননীকে বশ করিবার জন্য আসগরউল্লাকেও অন্যের শরণ লইবার জন্য ব্যস্ত দেখিয়া সে আরও কঠোর হইবার পণ করিল। শিকদারের চরিত্রে দৃঢ়তার অভাবের জন্য সে তাহার প্রতি বিমুখ হইয়াছে, কিন্তু নিজ জীবন লইয়াই বা সে কী করিতেছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *