প্রেমেন্দ্র মিত্রের শ্রেষ্ঠ গল্প
আগ্রা যখন টলমল
উপন্যাস
সংযোজন
পরিশিষ্ট

০৬. মোরালেস-এর ক্রীতদাস

১৫২৩-এর মে মাসের একদিন মোরালেস-এর ক্রীতদাস গানাদো নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।

সে-ঘটনার প্রায় দেড় বছর বাদে তারই গোপন চেষ্টায় যে উদ্যোগের সূত্রপাত হয় তা বহুদূর অগ্রসর হয়ে সত্যি সত্যি পানামার ছোট বন্দর থেকে একটি মাঝারি জাহাজ নিয়ে সূর্য কাঁদলে সোনা-র রাজ্য খুঁজতে পিজারোর অকূলে পাড়ি দেওয়া সম্ভব করে তোলে।

সময়টা ১৫২৪-এর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি।

ঘনরাম গোপনে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, পিজারো আর তাঁর দুই অংশীদার তা-ই অনুসরণ করেছেন।

দুটি জাহাজ এ-অভিযানের জন্যে দে লুকে-র হাত দিয়ে পাওয়া টাকায় কেনা হয়েছে। তার মধ্যে বড়টি হল বালবোয়া নিজের জন্যে যে জাহাজ তৈরি করিয়েও। আর ব্যবহার করতে পারেননি এবং খোলা অবস্থায় পানামার বন্দরে যা পচবার উপক্রম হয়েছিল, সেইটি।

সেটি নতুন করে জুড়ে খাড়া করে তাতে রসদ বোঝাই আর লোকজন অর্থাৎ মাঝি-মাল্লা আর সৈনিক নেবার ব্যবস্থা করেছেন আলমাগরো। লোকলশকর মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় একশো জন।

এই জাহাজ নিয়ে পিজারো প্রথমে রওনা হয়েছেন। ঠিক হয়েছে যে, পিজারোর বন্ধু ও অংশীদার আলমাগরো দ্বিতীয় ছোট জাহাজটির সব ব্যবস্থা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলে পিজারোকে কিছুদিন বাদেই অনুসরণ করবেন।

জাহাজ নিয়ে কিছুদূর অগ্রসর হবার পরই মোরালেস-এর বাড়িতে পরিকল্পনাটা কাগজে-কলমে তোলবার সময়কার সেই অদ্ভুত রহস্যময় সংশোধনটার কথা পিজারোর মনে পড়েছে।

তিনবন্ধু মিলে তখনই নভেম্বরে যাত্রা শুভ বলে ঠিক করেছিলেন, কিন্তু আশ্চর্য হয়েছিলেন পরের দিন সেই নভেম্বর কথাটা কাটা দেখে।

মোরালেস নিজে সে-কাটাকুটি করেছেন বলে মনে করতে পারেননি। তাঁর ওভাবে নিজের লেখা কাটবার কোনও কারণও ছিল না।

নভেম্বর মাস ওভাবে কেটে সংশোধন করবার চেষ্টাটা তাই অমীমাংসিত রহস্যই থেকে গেছে।

রহস্যটার মূল কে তা জানা না গেলেও তার মানেটা এতদিনে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে পিজারোর কাছে।

নভেম্বরটা এ-অঞ্চলের দারুণ ঝড়-তুফানের সময়। দক্ষিণের দিকে সমুদ্রযাত্রার পক্ষে সময়টা তাই একেবারেই অনুকূল নয়।

ঝড়বৃষ্টির বিরুদ্ধে যুঝতে যুঝতে প্রতি পদে বিপন্ন হয়ে অত্যন্ত মন্থরগতিতে অগ্রসর হতে হতে দৈববাণীর মতো নভেম্বরে যাত্রা নিষেধের সেই নির্দেশ তাঁকে দিন দিন অত্যন্ত বিস্ময়বিহ্বল করেছে।

এ-নির্দেশ কি সত্যিই দৈবিক? তা না হলে তাঁরা নিজেরা এত খোঁজখবর নিয়েও যা জানতে পারেননি, সে-সংবাদ জেনে তাঁদের সাবধান আর কে করতে পারে!

এর আগে একটিমাত্র অভিযানই এদিকে কিছুটা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল। সে বিফল অভিশপ্ত অভিযানের নায়ক ছিলেন আন্দাগোয়া। পুয়ের্তো দে পিনিয়াস নামে একটি অন্তরীপের বেশি শুধু যে তিনি অগ্রসর হতে পারেননি তা নয়, ফিরে যাবার পর মারাই পড়েছিলেন।

পিজারো সেই অন্তরীপ ঘুরে পার হয়ে এরপর যেখানে পৌঁছোলেন পৃথিবীর জানিত সভ্যদেশের কোনও মানুষ ইতিপূর্বে সেখানে আসেনি বলেই তাঁর ধারণা।

বীরু নদীর মোহনায় তখন তাঁর জাহাজ ঢুকতে চলেছে।

এই বীরু নদীর কথা এদেশের আদিম অধিবাসীদের কাছে নানাভাবে শুনে শুনে। পিজারো ও তাঁর বন্ধুদের তখন নিশ্চিত ধারণা হয়েছে, এই নদীই তাঁদের চরম সিদ্ধির কুলে পৌঁছে দেবে।

স্পেন থেকে এ পর্যন্ত এই নতুন মহাদেশে যত অভিযান হয়েছে, সেগুলির একটিও পশ্চিমের সমুদ্রকূলের এই অজানা জগতের কোনও সন্ধান পায়নি।

এখানকার যা কিছু পরিচয় সব আদিবাসীদের অসংলগ্ন ও বেশির ভাগ সময়ে আজগুবি অবাস্তব বিবরণ থেকে নেওয়া।

সে-বিবরণ অনেক সময় পরস্পরবিরোধী হলেও কয়েকটি বিষয়ে সেগুলির মিল উপেক্ষা করবার নয়।

তার একটি হল এই বীরু নদীর নাম। এ নাম নানাজনের বিবরণে নানাভাবে বহুবার শোনা গেছে। সকলের বর্ণনাতেই মনে হয়েছে, একটা রহস্যের আবরণে এনামটা যেন জড়ানো।

নদীটির বিস্তৃত মোহানায় ঘোলা তরঙ্গিত জল কোনও সুদূর গহন গোপন রহস্য-রাজ্য থেকেই বয়ে আসছে বলে পিজারোর মনে হয়েছে।

তাঁদের পরিকল্পনার খসড়ায় বীরু নদীর নামের আগে সেই হয়তো শব্দটা অদ্ভুতভাবে লেখা হবার কথা তখন পিজারো ভুলে গেছেন।

কথাটা বেশ একটু অবাক হয়ে এবং দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করতে হল কয়েকদিন বাদেই।

বীরু নদী বেয়ে মোহানা থেকে ক্রোশ চারেক ভেতরে ঢুকে পিজারো তখন নোঙর ফেলেছেন। জায়গাটা খুব উৎসাহ বাড়াবার মতো কিছু নয়। যত দূর দেখা যায়, শুধু বাদা আর জংলা জলা। মাটি সেখানে আছে কিন্তু তুমুল বর্ষার জলে তা এমন পিছল কাদা হয়ে গেছে যে তার ওপর দিয়ে চলাফেরা প্রায় অসম্ভব। এই বাদার ওপর দিয়ে বহুদূর গেলে কিছুটা উঁচু জমি আর জঙ্গল দেখা যায়। সে-জঙ্গল কিন্তু এমন ঘন, লতাপাতায় কাঁটা-ঝোপে তার তলা এমন দুর্ভেদ্য যে, তার ভেতর দিয়ে পথ করে ওদিকের পাথুরে ডাঙায় পৌঁছোতে পিজারো আর তার সেপাইদের প্রাণান্ত হয়েছে। খিদেয় তেষ্টায় ক্লান্তিতে তারা আধমরা, কাঁটায় ছড়ে আর ধারালো পাথরে কেটে হাত-পা তাদের ওরান।

কিন্তু সোনার চেয়ে বড় নেশা নেই। পিজারো তাঁর সৈনিকদের রেহাই দেননি। তাঁর হুকুমে ভারী বর্ম আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই সেপাইদের কখনও কাঠফাটা রোদে পুড়ে, কখনও অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে ভিজে কাদাজল ভেঙে ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। সেপাইদের নিজেদের মনেও সোনার লালসা না থাকলে শুধু পিজারোর হুকুমে তারা এত কষ্ট বোধহয় সহ্য করত না। সোনায় মোড়া সত্যিকার রূপকথার রাজ্য খুঁজে পাওয়ার যে-প্রলোভন পিজারো তাদের দেখিয়েছেন, তারা তা বিশ্বাস করেছে।

কিন্তু সোনার রাজ্য দূরে থাক, মেঠো গাঁয়ের একটা কুঁড়ের সন্ধানও পাওয়া যায়নি।

জনমানবহীন সেই বাদার মুল্লুক থেকে বাধ্য হয়েই পিজারোকে ফিরে আসতে হয়েছে নোঙর তুলে। জাহাজ আবার দক্ষিণমুখো চালান হয়েছে।

কিন্তু কোথায় সে সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ!

ভাগ্য যেন তাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর তামাশা করবার জন্যে দশদিন ধরে ভয়ংকর ঝড়-তুফানে তাদের জাহাজ তলিয়ে দেবার হুমকি দিয়েছে। ভরাড়ুবি থেকে যদি বা বেঁচেছে, খিদেয় তেষ্টায় সত্যিই তখন প্রাণ যাবার উপক্রম। নোনা মাংস সঙ্গে যা এনেছিল, সব তখন শেষ। মাথাপিছু দুটো করে ভুট্টার মাথা তখন প্রতিদিনের খাবার হিসেবে বরাদ্দ।

ভুট্টার মাথা! উদরদেশ যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত, ভোজনবিলাসী সেই রামশরণবাবু বাধা না দিয়ে বুঝি পারলেন না, ওখানে তারা ভুট্টা পেল কোথায়?

ভুট্টা ওই দেশেরই ফসল। এই প্রথম শ্রীঘনশ্যাম দাসকে নিজ থেকে সমর্থন করলেন মর্মরমসৃণ যাঁর মস্তক সেই ঐতিহাসিক শিবপদবাবু——এই আমেরিকা থেকেই আলু তামাক ইত্যাদির মতে ভুট্টাও পুরনো মহাদেশে আমদানি হয়েছে। কলম্বাসের আবিষ্কারের আগে সমস্ত আমেরিকায় ভুট্টাই প্রধান ফসল ছিল।

শিবপদবাবুর এ সমর্থন পাণ্ডিত্য প্রকাশের সঙ্গে মন কষাকষি মিটমাটের জন্যে হাত বাড়ানোরও শামিল। কিন্তু দাসমশাই হাত বাড়ানো নয়, আগেকার বেয়াদবির দরুন লম্বা কুর্নিশই বোধহয় চান। তাই শিবপদবাবুর সমর্থনও তিনি একটু টুকতে ছাড়লেন না।

বললেন, ভুট্টা বা মকাই-এর আদি জন্মভূমি কোথায় তা অত নিশ্চিত করে কিন্তু বলা যায় না। নতুনের বদলে পুরনো মহাদেশের ফসলও হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করেন। তাঁরা এ-শস্য আরবরা প্রথম স্পেনে নিয়ে যায় বলে প্রমাণ দেখান। প্রাচীন একটি চিনা পুঁথিতেও ভুট্টার ছবিসমেত উল্লেখ তাঁরা পেয়েছেন।

শিবপদবাবুর পাণ্ডিত্যের ওপর ঠোকরটুকু ভাল করে টের পেতে দেবার জন্যেই একটু থেমে দাসমশাই নিজেই অবশ্য শিবপদবাবুর পক্ষে শেষ রায় দিলেন, তবে কথা হচ্ছে এই যে, প্রাচীন চিনে পুঁথিটি কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের প্রায় ষাট বছর বাদে লেখা। তা ছাড়া এশিয়ার বা আফ্রিকা ইউরোপের কোথাও ধানের বা গমের যেমন, ভুট্টার তেমন বুনো জাতি আর পাওয়া যায়নি। মধ্য বা আগের যুগের কোনও পর্যটক ভুট্টা জাতীয় কোনও শস্যের দেখা পেয়েছেন বলে লিখে যাননি, আর মিশরের প্রাচীন পিরামিডে নানা রকম শস্যের মধ্যে ভুট্টার একটি দানাও কোথাও নেই। সুতরাং এ ফসল নতুন মহাদেশেরই দান বললে খুব ভুল হয় না।

হস্তীর মতো মেদভারে যিনি বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবুকে এই প্রথম। বুঝি একটু অসন্তুষ্ট হতে দেখা গেল! ঈষৎ ক্ষুণ্ণ স্বরে তিনি বললেন, ভাল এক ভুট্টার কুলজির কথা তুললেন শিবপদবাবু! ওসব থাক। পিজারো-র জাহাজ সূর্য কাঁদলে সোনার দেশে কখন পৌঁছোল তাই শুনি!

তা শুনতে হলে আরও অনেক সবুর করতে হবে, বললেন ঘনশ্যাম দাস, অন্তত ও যাত্রায় তাদের শুধু হয়রানি সার হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পিজারো মন্টেনেগরো নামে একজন সৈনিকের অধীনে তাঁর জাহাজ পানামায় ফেরত পাঠাতে বাধ্য হন। নিজে তিনি কয়েকজন বাছাই করা সঙ্গী নিয়ে সেই জলা-জঙ্গলের দেশেই থেকে গেলেন, মন্টেনেগরো মুক্তা-দ্বীপ থেকে রসদ নিয়ে ফিরবে এই আশায়। তাঁর সৈনিক ও মাঝিমাল্লারা তখন প্রায় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। শুধু আধবুড়ো পিজারোর অসীম কষ্টসহিষ্ণুতা আর উৎসাহের দৃষ্টান্ত তাদের সামনে ছিল বলে তারা একেবারে বেসামাল হয়ে যায়নি। সোনার লোভ তাদের সব কষ্ট সহ্য করতে কিছুটা সাহায্য করেছে বটে কিন্তু সে কষ্ট কী দুঃসহ যে হয়ে উঠবে তারাও কল্পনা করতে পারেনি।

দিনের পর দিন, হপ্তার পর হপ্তা কেটে গেছে। মন্টেনেগরো মুক্তা-দ্বীপ থেকে রসদ নিয়ে ফেরেনি। জলা-জঙ্গলের রাজ্যে পিজারো-র লোকদের তখন শামুক গুগলি আর বুনো ঝোপঝাড়ের ফল খেয়ে দিন কাটছে। খিদের জ্বালায় যে-সব ফল তারা খেয়েছে তার কিছু কিছু এমন বিষাক্ত যে তাদের শরীর ফুলে গিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা হয়েছে। কিছুকালের মধ্যে দলের কুড়িজন তো অখাদ্য খেয়ে আর অনাহারে মারাই গেল।

দলের অন্য সবাই বয়সে প্রায় তরুণ। শুধু পিজারোরই পঞ্চাশ পার হয়েছে! কিন্তু তিনি যেন অন্য ধাতুতে তৈরি। সকলের সঙ্গে সব দুঃখ-কষ্ট তিনি সমানভাবে ভাগ করে নিয়েছেন, কিন্তু কিছুতেই দমে যাননি।

সমুদ্রের দিকে হতাশ হয়ে মন্টেনেগরোর জাহাজের জন্যে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ যখন প্রায় ক্ষয়ে যাওয়ার উপক্রম তখন একদিন ডাঙার দিক থেকে উত্তেজিত হওয়ার মতো একটি খবর পাওয়া গেল। সেখানে দূরে নাকি একটি আলো দেখা গেছে।

আলো মানেই মানুষ, মানুষের বসতি, গ্রাম, হয়তো শহর, হয়তো সেই সোনার দেশ!

ছোট একটি দল নিয়ে পিজারো সেই আলোর উৎস সন্ধানে তখনই বার হলেন। ঘন-জঙ্গল ভেদ করে যেখানে তারা পৌঁছোলেন সেটি একটি উন্মুক্ত প্রান্তর। সত্যিই সেখানে ছোট একটি বসতি দেখা গেল। বাসিন্দারা কিন্তু নেহাত ভীরু নিরীহ ভাল মানুষ। পিজারোর দলবলকে দূর থেকে দেখেই তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। পিজারোর অনুচরেরা প্রথমেই অবশ্য গ্রাম লুঠ করে খাবার-দাবার যা পেল আত্মসাৎ করল। খাবার-দাবার সরেস কিছু নয়, ভুট্টা আর নারকেলই তার মধ্যে প্রধান। কিন্তু পিজারোর উপোসি সৈনিকদের কাছে তা অমৃত।

গাঁয়ের লোকেরা প্রথমে ভয়ে পালালেও পরে একটু ইতস্তত করে তখন ফিরে এসেছে। সম্পূর্ণ অজানা অঞ্চল হলেও সৌভাগ্যের কথা এই যে, তাদের ভাষা পানামা অঞ্চলের আদিবাসীদের থেকে খুব আলাদা নয়। তাদের সঙ্গে কিছুটা আলাপ-পরিচয় তাই সম্ভব হল। আলাপের বিষয় অবশ্য একটি। গাঁয়ের আদিবাসীরা ফিরে আসার পর যা দেখে পিজারো আর তার অনুচরদের চোখ ঝলসে গেছে তা হল আদিবাসীদের গায়ের সোনার সব গয়না। গয়নাগুলোতে সূক্ষ্ম কারুকাজ না থাকলেও সেগুলির ওজনই পিজারোর লোকেদের উত্তেজিত করে তুলেছে। সোনার দেশের যে কিংবদন্তি তারা শুনেছে, তাহলে একেবারে ভুয়ো নয়!

সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ সম্বন্ধে যা শুনে এসেছেন, এই আদিবাসীদের সঙ্গে আলাপ করে পিজারো তার সমর্থন পেয়েছেন। আরও প্রায় দশদিনের পথ দক্ষিণে পর্বতমালার ওপারে সত্যি এক বিরাট রাজ্য নাকি আছে। সেখানে সোনা নুড়ি-পাথরের মতো ছড়ানো। পিজারো এবং তার অনুচরেরা আদিবাসীদের কথার এই মানেই করেছে।

ভাগ্য কিছুটা অনুকুল এবার হয়েছে। মন্টেনেগরো রসদ ভরা.জাহাজ নিয়ে ফিরে। এসেছে এতদিনে। পিজারো নতুন উৎসাহে দক্ষিণ দিকে পাড়ি দিয়েছেন। এবার অজানা সমুদ্রের উপকূলে মাঝে মাঝে ছোট বড় মানুষের বসতি দেখা গেছে। অধিবাসীরা কোথাও নিরীহ, এসপানিওলদের লুঠপাটে বাধা দিতে সাহস করেনি, কোথাও বা তারা হিংস্রভাবে পালটা আক্রমণ করেছে। এক জায়গার পিজারোর তো প্রাণসংশয়ই হয়েছিল।

এত চেষ্টা এত দুঃখ-ভভাগের পর লুঠপাটের সোনা কিছু জমে উঠলেও সোনার দেশের যথার্থ হদিস কিন্তু মেলেনি। পিজারোর জাহাজের অবস্থা তখন কাহিল। ভালভাবে মেরামত না করে তা নিয়ে অজানা সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া বাতুলতা। লোকজনও তখন বেশির ভাগ আহত ও অসুস্থ।

অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে পিজারোকে তাই আবার পানামায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। কিন্তু সেখানে গভর্নরের কাছে মুখ দেখাবেন কী করে? পানামা থেকে কিছু দূরে পশ্চিম চিকামা বলে একটি জায়গায় তিনি দলের কয়েকজনকে নিয়ে নেমে গেছেন আর জাহাজের খাজাঞ্চি নিকোলাস ই রিবোলাকে লুঠ করা সমস্ত সোনা দিয়ে গর্ভনর পেড্রারিয়াসকে সন্তুষ্ট করবার জন্যে দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন।

সেই সোনার ভেট পেয়ে আর পিজারোর অভিযানে আংশিক সাফল্যের বিবরণ শুনে যদি গভর্নরের মন গলে তাহলে আর একবার নতুন করে সোনার দেশের সন্ধানে বেরোবার সুযোগ হয়তো পেতে পারেন এই ছিল পিজারোর আশা।

এ আশায় তাঁর ছাই-ই পড়ত যদি না চিকামায় হঠাৎ একদিন একটি বেকার নাবিক পিজারোকে নিজে থেকে না খুঁজে বার করত।

এই বেকার নাবিকের নাম বার্থালমিউ রুইজ। সাধারণ মানুষ তো বটেই, ইতিহাসও এ নাম ভুলে গেছে বললেই হয়।

কিন্তু যেমন আলমিগরো, লুকে কিংবা মোরালেস-এর সঙ্গে, তেমনই এই রুইজ-এর সঙ্গে যোগাযোগ হওয়াটাও সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ আবিষ্কৃত হওয়া সম্ভব করে তুলেছে। ১. অনেক বাধা-বিপত্তি জয় করে অর্থ লোকবল ও রাজানুমতি শেষ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারলেও পিজারো ও আলমাগরোর দ্বিতীয় অভিযান সফল হয়নি। কিন্তু যত ব্যর্থই হোক, বার্থালমিউ রুইজ যদি দ্বিতীয় নৌ অভিযানের পোতাধ্যক্ষ না হতেন এবং কূল ঘেঁষে জাহাজ না চালিয়ে দুঃসাহস ভরে খোলা দরিয়ায় না পাড়ি দিতেন তা হলে নবাবিষ্কৃত পশ্চিম সমুদ্রের প্রথম বিস্ময়, সমুদ্রগামী ভেলা বালসার সাক্ষাৎও মিলত না আর সূর্য কাঁদলে সোনার দেশের এ অকাট্য প্রমাণ অভিযাত্রীরা পেতেন না।

বেকার নাবিক বার্থালমিউ রুইজ চিকামার মতো জায়গায় হঠাৎ পিজারোকে খুঁজতে এলেন কেন? পিজারোর এ অদ্ভুত অস্থায়ী ঠিকানা তিনি জানলেন কোথা থেকে?

প্রথম আলাপের পর চিকামায় পিজারোই সে প্রশ্ন করেছিলেন। রুইজ যা বলেছিলেন তা প্রায় আজগুবি। রুইজ আন্দালুসিয়ার মোশুইয়ের-এর ধবাসী। সেখানকার মাটি জল হাওয়াতেই যেন নিপুণ নাবিক গড়বার মশলা আছে। কলম্বাসের অভিযানে সেখানকার নাবিকরাই প্রধান অংশ নিয়েছিল বলা যায়।

বিচক্ষণ নিপুণ নাবিক হলেও রুইজ বেকার হয়ে পানামাতে সাধারণ ফেরি পানসিতে তখন কাজ করছিলেন।

সেই ফেরি পানসিতে একদিন এক অদ্ভুত গণৎকারের সঙ্গে রুইজ-এর দেখা হয়। গণৎকার লোকটি কোন দেশের, চেহারা দেখে রুইজ ঠিক করতে পারেননি। পোশাক-আশাক ওখানকার আদিবাসীদের মতো হলেও এক মুখ দাড়ি-গোঁফের আড়ালে তাকে ভিনদেশি বলেই মনে হয়। সে নিজে সেধে রুইজ-এর ভাগ্য গণনা করতে চেয়েছিল। রুইজ-এর অতীত জীবনের দু-একটা খবর নির্ভুলভাবে বলে তার মনে বিশ্বাস জাগিয়ে শেষে যা বলেছিল সেইটেই অদ্ভুত। বলেছিল ফেরি পানসির চেয়ে অনেক বড় জাহাজ অজানা সমুদ্রে রুইজ-এর জন্যে অপেক্ষা করে আছে। পানামা ছেড়ে চিকামায় গিয়ে তিনি যদি পিজারো নামে কাউকে খুঁজে বার করতে পারেন তাহলেই তাঁর বরাত ফিরবে।

রুইজ এই অদ্ভুত গণৎকারের কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে না পারলেও মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারেননি। পিজারো নামটা তাঁর একেবারে অপরিচিত নয়। পানামা থেকে পিজারোর দুঃসাহসিক এক অভিযানে যাবার কথা তিনিও শুনেছেন। অভিযানের কোনও খবর পানামায় এসে অবশ্য পৌঁছয়নি। এ সমস্ত অবুঝ, গোঁয়ার্তুমির যে পরিণাম হয় এ অভিযানেরও তাই হয়েছে বলে সবাই ধরে নিয়েছে।

গণৎকারের মুখে পিজারোর নাম শুনে রুইজ বেশ একটু অবাক ও কৌতূহলী হয়েছেন। গণকারকে পরীক্ষা করবার জন্যেই জিজ্ঞাসা করেছেন, পিজারো আবার কে?

তা জানি না। গণৎকার যেন সরলভাবেই বলেছে, হাত গুনে ওই নাম পাচ্ছি।

হাত গুনে নামও পাওয়া যায়? এ তোমার কোন জ্যোতিষ? রুইজ জিজ্ঞাসা করেছেন।

তাতে আপনার কী দরকার? একটু উদ্ধতভাবেই বলেছে গণৎকার, যা বললাম বিশ্বাস করতে পারেন তো পিজারোর খোঁজে যাবেন, নইলে যাবেন না।

পিজারোকে ওই চিকামায়ই পাব? একটু সন্দিগ্ধভাবে বলেছেন রুইজ, তিনি তো অনেক দিন পানামা ছেড়ে গেছেন। তাঁর জাহাজ পশ্চিমের অজানা মহাসমুদ্রে কোথাও ড়ুবে গেছে বলেই সকলের ধারণা।

আমার গণনা তা বলে না। বেশ রুক্ষ স্বরে বলে গণকার চলে গিয়েছিল।

বিশ্বাস করুন বা না করুন রুইজ চিকামায় পিজারোর খোঁজে একবার না এসে পারেননি। সেখানে পিজারোর দেখা পেয়ে বিস্মিত বিমূঢ় হয়েছেন।

পিজারোও রুইজ-এর কথা শুনে অবাক হয়ে ভেবেছেন, কে এই গণকার!

গণৎকার যে-ই হোক, পিজারো আর রুইজ এই মিলনের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। নতুন স্বর্ণলঙ্কা আবিষ্কারের স্বপ্ন সফল হওয়ার সূচনা এই মিলন থেকেই হয়েছে। কিছুদিন বাদে পিজারোর সহায় ও সুহৃদ আলমাগরো চিকামায় এসে বন্ধুর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।

ইতিমধ্যে তিনিও বেশ কিছু কীর্তি করে এসেছেন। পূর্বেকার ব্যবস্থা মতো পিজারোর অল্পদিন পরেই আলমাগরো পাদরি লুকে-র কাছে টাকার সাহায্য নিয়ে আর-একটি ছোট ক্যারাভেল-এ পিজারোকে অনুসরণ করেন। অজানা মহাসমুদ্রে দক্ষিণ উপকূলে এক জায়গায় আদিবাসীদের সঙ্গে লড়াইয়ে একটি চোখ তাঁকে বাদ দিতে হয়েছে। বেশ কিছুদূর পর্যন্ত পাড়ি দিয়েও পিজারোর কোনও হদিস না পেয়ে আলমাগরো আবার পানামেতেই ফিরছিলেন। পথে মুক্তা-দ্বীপে নেমে প্রথম পিজারোর খবর তিনি পান। সেই খবর অনুসারেই তিনি চিকামায় এসেছেন।

পানামা যদি নরক হয় তাহলে চিকামা তারও অধম। যেমন সেখানে জলা-জঙ্গলার ভ্যাপসা গুমোট গরম তেমনই মশা মাছি বিষাক্ত পোকামাকড়ের উপদ্রব আর সেই সঙ্গে বদ্ধ নোনা জলা অঞ্চলের মারাত্মক সব জ্বর-জ্বালা!

তবু পিজারোর তখন চিকামা ছেড়ে কোথাও যাবার উপায় বা সংগতি নেই। ব্যর্থ অভিযানের দরুন অপমান লাঞ্ছনার সীমা থাকবে না তো বটেই, এই অবস্থায় পানামায় ফিরলে পাওনাদাররাও তাঁকে ছিঁড়ে খাবে। পিজারো, আলমিগরো ও রুইজ তিনজনের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত গভর্নর পেড্রারিয়াস-এর কাছে দরবার করবার জন্যে আলমাগরোকেই পাঠানো স্থির হয়েছে। তাঁদের অভিযান যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি আশ্চর্য এক সোনায় মোড়া দেশের বিশ্বাসযোগ্য কিছু হদিস পেয়েছেন পেড্রারিয়াসকে তা বোঝাতে পারলে দ্বিতীয় অভিযানের অনুমতি পাওয়া যেতে পারে। সে অনুমতি পেলে পাদরি লুকে-কে ধরাধরি করে অভিযানের খরচ জোগাড় হয়তো অসম্ভব হবে না।

দ্বিতীয় অভিযান শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছে, কিন্তু তার আগে বাধা-বিপত্তি যা পার হতে হয়েছে তা এক-এক সময় অলঙ্ঘ্য মনে করে হতাশ হয়ে পড়েছেন উদ্যোগীরা।

গভর্নর পেড্রারিয়াস তো খাপ্পা হয়ে উঠেছেন আলমিগরোর অনুরোধ শুনে। অনুমতি দেওয়ার বদলে আগের অভিযানে যে সব সৈনিক নাবিক মারা গিয়েছে তাদের মৃত্যুর জবাবদিহি চেয়েছেন গভর্নর। আল মাগরো-র উপহার দেওয়া সোনাদানা জিনিস তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। অভিযানের আরজি সরাসরি নাকচ করে দিয়ে তিনি নতুন উপনিবেশ নিকারাগুয়ার এক বিদ্রোহী রাজকর্মচারীকে শাস্তি দিতে চলে গেছেন।

চিকামায় পিজারো রুইজ-এর সঙ্গে দুর্ভোগের দিন গুনছেন আর পানামায়। আলমিগরো চরম হতাশায় তখন ড়ুবে আছেন। যে জন্যে একটা চোখ তিনি দিয়েছেন সে স্বপ্নও আর সফল হবার নয়। গভর্নর পেড্রারিয়াস তো বটেই, সাধারণ অন্য পরিচিত বন্ধু বান্ধবও তাঁদের অভিযান বুনোহাঁসের পেছনে ধাওয়া মনে করেছে। যে মোরালেস একদিন উৎসাহভরে তাঁদের অভিযানের পরিকল্পনায় যোগ দিয়েছিলেন তিনিও এবারে আলমাগরো-কে নিরস্ত করতে চেয়েছেন। সত্যিই আশ্চর্য কোনও সোনার দেশ আছে বলে তিনি আর বিশ্বাস করতে পারেননি। অনেকের মতো তাঁর কাছেও সমস্ত ব্যাপারটা একটা আজগুবি কল্পনা মাত্র। অজানা মহাসমুদ্রে এই আজগুবি রূপকথার দেশ খোঁজার জন্যে ধন-প্রাণ জলাঞ্জলি দেওয়া তাই মূর্খতা।

আলমাগরো হতাশ হয়ে হয়তো চিকামাতেই ফিরে যেতেন কিংবা বন্ধুদের কাছেও মুখ দেখাতে না পেরে পানামা যোজকের নতুন কোনও উপনিবেশে নিজেকে নির্বাসিত করতেন। কিন্তু যার কাছে যেতে তিনি সবচেয়ে দ্বিধা করেছেন সেই পাদরি লুকেই একদিন তাঁর খোঁজে মোরালেস-এর বাড়িতে এসে উপস্থিত।

পিজারো আলমাগোর ব্যর্থ অভিযান সম্পর্কে আর যে যাই শুনে থাক লুকে কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু শুনেছেন। সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ তাঁর কাছে আজগুবি কল্পনা নয়! সংকল্প সাহস থাকলে সে দেশ খুঁজে পাওয়া যাবেই এই দৃঢ় বিশ্বাসে শুধু গভর্নর পেড্রারিয়াসকেই অভিযানের অনুমতি দিতে তিনি রাজি করাননি, দ্বিতীয় অভিযানের জন্যে অনেক বেশি খরচের টাকাও সংগ্রহ করে দিয়েছেন!

সর্বসাধারণের ধারণার বিরুদ্ধে সোনায় মোড়া দেশের অস্তিত্ব সম্বন্ধে পাদরি লুকের এরকম দৃঢ় বিশ্বাসের ভিত্তি কী? ব্যর্থ অভিযানের বিবরণ সবাই যা শুনেছে, তিনি তার বেশি কী শুনেছেন! কার কাছে, কোথায়? কেউ তা জানে না।

বার্থালমিউ রুইজকে নাবিক-প্রধান করে পিজারো ও আলমাগলরা আগের চেয়ে আরও দুটি বড় জাহাজে অস্ত্রশস্ত্র এমনকী ঘোড়া পর্যন্ত নিয়ে পানামা বন্দর থেকে সত্যি একদিন দ্বিতীয় অভিযানে রওনা হয়েছেন।

সে অভিযানও ব্যর্থ। কিন্তু তার ব্যর্থতার ইতিহাসও বিস্ময়কর। সূর্য কাঁদলে সোনার দেশে সেবারেও পিজারো কি আলমিগরো পৌঁছোতে পারেননি। কিন্তু অজানা মহাসমুদ্রে দক্ষিণের দিকে যত এগিয়েছেন তত এমন কিছু সব দেখেছেন যা তাঁদের কল্পনারও বাইরে।

এ অভিযানের প্রথম অসামান্য বিস্ময় নাবিক-প্রধান রুইজকে প্রায় স্তম্ভিত করে দিয়েছে। সমুদ্রের উপকূলে নতুন নতুন বর্ধিষ্ণু গ্রাম-নগর, নতুন জাতের মানুষ ও পশুপাখি তাঁরা এ পর্যন্ত অনেক দেখেছেন। সসৈন্য তীরে নেমে কোথাও লুঠপাট করে, কোথাও ভদ্রভাবে বিনিময় করে সোনাদানার জিনিস ও অলংকার যা তাঁরা সংগ্রহ করেছেন তা চোখ ধাঁধাবার মতো। সূর্য কাঁদলে সোনার দেশের আশ্বাস এই সব সোনার জিনিসের মধ্যে ভালভাবেই পাওয়া গেছে। কিন্তু লুব্ধ ও মুগ্ধ করলেও এইসব ঐশ্বর্য তাঁদের কল্পনাতীত নয়।

কল্পনাতীত যে বস্তুটি নাবিক প্রধান রুইজ-এর চক্ষু বিস্ফারিত করে তুলেছে তা তিনি দেখেন উপকূল থেকে বহু দূরে মাঝদরিয়ায়।

প্রথমে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন। কারণ দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রের মাঝে যা তিনি দেখেছেন তা গোড়াতে পালতোলা ক্যারাভেল জাতীয় বেশ বড় জাহাজ বলেই মনে হয়েছে। এ অজানা সমুদ্রে তাঁদের আগে কোনও ইউরোপীয় জাহাজের পাড়ি দেওয়া তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ইউরোপীয় যদি না হয় তাহলে নিশ্চয়ই জাহাজটি এই দেশীয়দেরই। কিন্তু নৌ-বিদ্যায় এ সব দেশ তো একেবারে আদিম যুগে পড়ে আছে বললেই হয়। সভ্যতায় অতখানি অগ্রসর মেক্সিকোর মানুষও তো সমুদ্রে জাহাজ ভাসাবার কথা কল্পনাই করতে পারে না। এ পালতোলা জাহাজ তাহলে কাদের?

কাছাকাছি যাবার পর বিস্ময় আরও বাড়ে।

যা জাহাজ ভাবা গেছল তা জাহাজ নয়, অদ্ভুত বিরাট সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক রকম ভেলা যা ছোটখাটো জাহাজেরই শামিল।

প্রথমে যা শুধু দেখেই অবাক হতে হয়েছিল পরে খুঁটিয়ে তার পরিচয় পাবার পরও সে বিস্ময় বেড়েছে বই কমেনি। এই ভেলা-জাহাজ বড় বড় অত্যন্ত হালকা এক রকম গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি। গাছটির নাম বালসা তা থেকে এই ধরনের জাহাজগুলিও বালসা নামে পরিচিত। এই বালসা কাঠের ভেলায় লোহা তো নয়ই, তামার কোনও পেরেকও ব্যবহার করা হয় না। সমস্ত কাঠের গুঁড়িগুলো ওখানকার জঙ্গলের এক রকম শক্ত লতায় বাঁধা। ভেলার ওপর মোটা শরের পাটাতন। তার ভেতর থেকে দুটি শক্ত মাস্তুলের খুঁটি বেঁধে তোলা হয়েছে। সেই মাস্তুলে প্রকাণ্ড পাল ঝোলানো। এই বালসা বা ভেলা-জাহাজে দাঁড় বলে কিছু নেই। একটি বড় হাল আর বাঁকানো হেলানো যায় এমন ইরাক বা কীল-এর সাহায্যে সেটি চালাবার ব্যবস্থা। এ বালসা যারা চালায় তাদের নৈপুণ্য নিশ্চয়ই খুব উঁচুদরের, তা না হলে খোলা সমুদ্রে এই ধরনের ভেলা নিয়ে তারা চলাফেরা করতে সাহস করত না।

রুইজ তাঁর জাহাজটি বালসা-ভেলার কাছে ভেড়াবার পর উভয় পক্ষই কিছুক্ষণ অবাক হয়ে পরস্পরকে লক্ষ করেছে। তারপর পরস্পরের আলাপ পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে বালসার একজন আদিবাসী যাত্রীর সাহায্য।

রুইজ ও তাঁর এসপানিওল নাবিকেরা প্রথমত ভেলা-জাহাজ বালসা আর তারপর তার সওয়ারি নারী পুরুষের গায়ের সোদানা আর পোশাকের বৈচিত্র্য দেখে অত হতভম্ব ও মুগ্ধ না হলে এই সম্পূর্ণ অজানা অঞ্চলের আজব ভেলা-জাহাজে অমন আশাতীত ভাবে দোভাষী পাওয়াতে কৌতূহলী হয়ে তাকে একটু ভাল করে লক্ষ করতেন।

কিন্তু তাঁরা সবাই তখন বালসার যাত্রীদের সোনার গহনার ওজন ও কারুকাজ আর সেই সঙ্গে তাদের গায়ে পশমের মতো কী বস্তুতে চমৎকার নকশা তুলে বোনা পোশাকের খোঁজ নিতেই তন্ময়।

দোভাষীর কাছেই রুইজ জেনেছেন যে, পশমের মতো যা দেখতে সে পোশাক। ভেড়ার নোম থেকে তৈরি নয়, এ দেশের সম্পূর্ণ ভিন্নজাতের অদ্ভুত এক পশুই তা জোগায়।

সেই দোভাষীই তাঁকে আরও কিছু দক্ষিণের এক বন্দর-নগরের খবর দিয়েছে। সে নগরের নাম টম্‌বেজ। সেখানে গেলে এ দেশের পশম যারা জোগায় সেই অদ্ভুত প্রাণীর পাল মাঠে-ঘাটে দেখা যাবে আর যা দেখা যাবে তার বর্ণনা শুনেই রুইজ ও তাঁর সঙ্গীদের চোখ লোভে চকচক করে উঠেছে।

সেখানে সোনা আর রুপো নাকি কাঠ কাঠরার মতোই সস্তা জানিয়েছে দোভাষী। সোনা রুপো সম্বন্ধে এ ধরনের উচ্ছাস রুইজ বা অন্য এসপানিওলরা এর আগেও অনেক শুনেছে। যত অতিরঞ্জিতই হোক, এ সব বিবরণের মধ্যে কিছু সত্য আছে। বিশ্বাস করেই তারা সুখ-শান্তি এমনকী জীবনের মায়াও জলাঞ্জলি দিয়ে পাড়ি দিয়েছে এই অজানা বিপদের দেশে। কিন্তু ভেলা-জাহাজ বালসার দোভাষীর আশ্বাসের বেশ ভালো রকম প্রমাণ চাক্ষুষই দেখা গেছে। দেখা গেছে ওই বালসাতেই। ওই ভেলা-জাহাজে রুইজ আর তার নাবিকেরা কী দেখেছিল তার একটা তখনকার লেখা বিবরণ আছে একটা পুরনো পাণ্ডুলিপিতে। তাতে লিখছে এম্পোহোস গুয়ার নাসিদস দে লা দি চা প্লাটা। ঈ তাসাস ঈ ওট্রাস ভাসিহাস পারা বেবের—

শ্রীঘনশ্যাম দাসকে থামতে হয়েছে। উদরদেশ যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই রামশরণবাবুর গলা থেকে জলে কুম্ভ নিমজ্জনের মতোই একটা খাবি-খাওয়া গোছের আওয়াজ শোনা গেছে। ধ্বনিটা সত্যিই মারাত্মক কিছু নয়, দাসমশাইকে তাঁর কী যেন বলার চেষ্টা দ্বিধায় সংকোচে ওই ধ্বনিরূপ নিয়েছে।

দাসমশাই অস্ফুট বক্তব্যটা সঠিক অনুমান করে নিয়ে বলেছেন, ও আপনারা তো আবার স্প্যানিশ জানেন না। ও পাণ্ডুলিপিতে লেখা আছে—

দাসমশাইকে আবার থামতে হয়েছে। এবার বাধা দিয়েছেন মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু। দাসমশাই-এর উন্নাসিক কৃপাকটাক্ষটুকুই সহ্য করতে না পেরে শিবপদবাবু জিজ্ঞাসা করেছেন, পাণ্ডুলিপিটা কী জানতে পারি?

পারেন বইকী! দাসমশাই অনুকম্পাভরে চেয়ে বলেছেন, পাণ্ডুলিপির পরিচয় হল রিলেসইয়োর সাকাদা দে লা বিবলিওটেকা ইমপেরিয়াল দে ভিয়েনা।

শিবপদবাবু সামলে ওঠবার আগেই মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবু তাড়াতাড়ি বলেছেন, পাণ্ডুলিপির নাম জেনে কী হবে, মশাই! বালসা জাহাজে কী ছিল তাই বলুন!

দাসমশাই যেন ভোট অফ কনফিডেন্স পেয়ে আবার শুরু করলেন—ওই পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায় যে, ভেলা-জাহাজটিতে সোনা-রুপোর উঁচুদরের। কারুকাজ করা গহনাপত্র ও পশমি পোশাক ছাড়া বিচিত্র আকারের ধাতুর পাত্র আর পালিশ করা রুপোর যে আয়না ইত্যাদি জিনিস রুইজ দেখেন, তা উঁচুদরের সভ্যতারই পরিচয় দেয়। এ পর্যন্ত এ ধরনের সূক্ষ্ম ও উন্নত চারুশিল্পের নিদর্শন তাঁরা কোথাও দেখেননি।

দোভাষীর কাছে টম্‌বেজ নামে বন্দরনগরের কথা শুনে রুইজ সেখানেই যাবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। পথ দেখাবার জন্যে বালসা থেকে দোভাষীকে যে তিনি নিজের জাহাজে তুলে নেন, তা বলাই বাহুল্য। টম্‌বেজ-এ একা যাওয়া অবশ্য তাঁর। চলে না। এ অভিযানের নেতা পিজারোর অধীনেই সেখানে যাবার আয়োজন করতে হয়। তাই পিজারো আর তাঁর সঙ্গীদের রিও-দে-সান-জোয়ান নদীর তীরে যেখানে ছেড়ে এসেছিলেন, সেখানেই প্রথমে ফিরে গেছেন রুইজ।

পিজারো আর তাঁর দলবলের ইতিমধ্যে দুর্দশার একশেষ হয়েছে। রুইজ জাহাজ নিয়ে সে সময়ে না ফিরলে এ দলের অস্তিত্বই থাকত কি না সন্দেহ। পিজারোর দলের কিছু নাবিক সৈনিক মারা গেছে অসুখে-বিসুখে ও অনাহারে। সঙ্গের সামান্য খাবার ফুরিয়ে যাবার পর বুনো আলু, নোনা তীরভূমির নারকেল আর গরানগাছের তেতো ফল ছাড়া আর বিশেষ কোনও আহার তাঁদের জোটেনি। নদীতীরের বাদা-জঙ্গলে ওদের কুমির কেম্যান-এর পেটে গেছে কেউ কেউ, কারও জীবনান্ত হয়েছে ওখানকার অজগর আনাকোণ্ডার আলিঙ্গনে। আর কিছু মরেছে আদিবাসীদের গোপন আক্রমণে। ও অঞ্চলের যে আদিবাসীরা প্রথম দিকে স্পেনের অভিযাত্রীদের সূর্যের সন্তান—দেবতা–বলে ভক্তির চোখে দেখেছিল, তারা এসপানিওলদের সত্যকার স্বরূপ তখন জেনে ফেলেছে।

রুইজ একেবারে শেষ মুহূর্তে জাহাজ নিয়ে ফিরে পিজারো আর তাঁর অনুচরদের শোচনীয় পরিণাম থেকে বাঁচিয়েছেন। পিজারোর ভাগ্য এবার সবদিক দিয়েই অনুকূল মনে হয়েছে। শুধু রুইজ নয়, আলমাগরোও পানামা থেকে প্রচুর রসদ ও নতুন ভর্তি হওয়া নাবিক-সৈনিক নিয়ে এসে পৌঁছেছে সেই সময়।

রুইজ-এর কাছে পিজারো ও আলমাগলরা তাঁর অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ। শুনে উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন। টমবেজ বন্দর-নগরের খবর যার কাছে পাওয়া গেছে। ভেলা-জাহাজ বালসা থেকে তুলে নেওয়া সেই দোভাষীর সঙ্গে তাঁরা সরাসরি আলাপ করতে চেয়েছেন।

কিন্তু কোথায় সে দোভাষী! কোথাও তাঁর পাত্তা পাওয়া যায়নি। রিও-দে-সান-জোয়ান-এর তীরে পিজারোর আস্তানায় ফিরে আসার দিনও দোভাষীকে জাহাজে দেখেছেন বলে রুইজ-এর মনে আছে। অন্যান্য নাবিকরাও তাঁকে সমর্থন করে জানিয়েছে যে সেই দোভাষীকে তীরে নামতেও তারা দেখেছে। তারপর থেকে তার আর কোনও হদিস নেই।

নদীর মোহনায় বালুকাময় তীরভূমিতে পিজারো আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ অনুচরদের ছোট্ট একটা উপনিবেশ। তার চারদিকে দুস্তর বিপদসংকুল বাদা-জলা আর দুর্ভেদ্য জঙ্গল। নেহাত আহাম্মকের মতো জলা-বাদা পার হয়ে যদি না সে কুমির, অজগর কি জাগুয়ারের শিকার হবার ভয় তুচ্ছ করে পালিয়ে থাকে তাহলে তার এমনভাবে উধাও হওয়া তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। হঠাৎ অকারণে সে পালাতে যাবেই বা কেন?

দোভাষীর অন্তর্ধান-রহস্যের কোনও মীমাংসা শেষ পর্যন্ত হয়নি।

তার দেওয়া বিবরণের ওপর নির্ভর করে পিজারো দক্ষিণের বন্দর-নগর টম্‌বেজ খুঁজতে যাওয়ার সংকল্প কিন্তু ছাড়েননি। দলের সকলেরই মনে এখন নতুন আশা, নতুন উৎসাহ। বুনো আলু আর গরানগাছের ফল খেয়ে যাদের হাড়-চামড়া সার হয়েছিল, তাদের এখন আর রসদের অভাব নেই। আলমাগরোর চেষ্টায় লোকবলও। তাদের বেড়েছে। তুমুল উত্তেজনা ও উৎসাহের মধ্যে দুটি জাহাজ প্রায় একসঙ্গেই ছেড়েছে। লক্ষ্য, দূর দক্ষিণ সমুদ্রের বন্দরনগর টমবেজ, এ যুগের স্বর্ণলঙ্কার যা হয়তো প্রথম সোপান।

অভিযাত্রীদের এবারের স্বপ্নও কিন্তু বিফল হয়েছে। আশ্চর্য বন্দর-নগর টম্‌বেজ-এ পিজারো তাঁর দলবল নিয়ে পৌঁছেছেন। আশাতীত অভ্যর্থনাও সেখানে পেয়েছেন। বন্দর-নগর টম্‌বেজ যে অত্যন্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ এক অজানা রাজ্যের একটি সীমান্তঘাঁটি মাত্র তা বুঝতে তাঁর দেরি হয়নি। সর্বত্র রাস্তায় ঘাটে দেব-স্থানে সোনা-রুপোয় ছড়াছড়ি দেখেছেন, দেখেছেন সেই আশ্চর্য প্রাণী যার কোমল মসৃণ নোম ইউরোপের শ্রেষ্ঠ পশমকেও হার মানায়–অজানা সভ্যতায় ব্যবহৃত নতুন কয়েকটি শব্দ শিখেছেন যেমন কুরাকা, যেমন মিনি মায়েস, যেমন ইঙ্কা।

এই টমবেজ বন্দর-নগরেই পিজারো মহামহিম রাজ্যেশ্বর হুয়াইনা কাপাক-এর নাম শুনেছেন, সমুদ্রতীর থেকে অনতিদূরের অভ্রভেদী তুষারমৌলি পর্বতশ্রেণী পর্যন্ত যাঁর একছত্র রাজত্ব বিস্তৃত।

এ রাজ্যের শাসনশৃঙ্খলার পরিচয় টম্‌বেজ নগরীতে ভালভাবে পাওয়া গেছে। পূর্বতন এক রাজ্যেশ্বর মহামহিম টুপাক ইউপাঙ্কি নগরে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ স্থাপন করেছেন। এ নগরের সুবর্ণমণ্ডিত দেব-স্থান পিজারো ও তাঁর সহ-অভিযাত্রীদের বিস্ময় উৎপাদন করেছে। নগরের একটি আশ্চর্য আবাস-হর্ম তাঁরা দেখেছেন সূর্যকুমারীদের জন্যে যা নির্দিষ্ট। নগরময় অসংখ্য জলধারা বহন করবার কৃত্রিম প্রণালী তাঁদের চোখে পড়েছে। তাঁরা দেখেছেন সমুদ্র আর উর্বর মৃত্তিকার দাক্ষিণ্যে নগরবাসীদের কোনও কিছুরই অভাব নেই।

নমুনা স্বরূপ এ নগর দেখেই এ সোনার রাজ্য জয় করবার লালসা তীব্র হয়ে উঠেছে পিজারোর মনে। কিন্তু সেবারের মতো এ রাজ্যের বিশদ কিছু বিবরণ আর তার কল্পনাতীত ঐশ্বর্যের বিস্ময়কর কিছু নিদর্শন নিয়েই পিজারোকে সদলবলে পানামায় ফিরতে হয়েছে।

টম্‌বেজ থেকে আরও কিছু দক্ষিণ পর্যন্ত অবশ্য তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন। সে পথে সমুদ্র উপকূলে আরও বহু সমৃদ্ধ নগর তিনি দেখেন আর সর্বত্রই সেই অসামান্য রাজ্যেশ্বরের কথা শোনেন, আকাশছোঁয়া তুষারমৌলি গিরিশ্রেণীর এক গহন গোপন উপত্যকায় যাঁর পরমাশ্চর্য রাজধানী রূপকথার রহস্য-বিস্ময় দিয়ে ঘেরা।

সে স্বপ্নপুরীতে পৌঁছোবার সুগম পথ কি নেই? দক্ষিণ সমুদ্রে একটু করে পিজারো এগিয়ে গেছেন জাহাজ নিয়ে। তাঁর বাঁদিকে অজানা তটরেখা। অনতিদূরে আকাশপটে অভ্রংলিহ সব গিরিশিখরের একসঙ্গে নিষেধ ও নিমন্ত্রণ। সে সব গিরিশিখরের নাম তিনি শুনেছেন স্থানীয় অধিবাসীদের

কাছে।

চিম্বোরাজো, কোটোপাক্সি—সে সব নামগুলিই শঙ্কামেশানো সম্ভ্রম আর বিস্ময় জাগায়।

আর-একটু, আর-একটু করে পিজারো আর তাঁর সঙ্গীরা বিষুবরেখার দক্ষিণে প্রায় নবম অক্ষাংশের কাছে এসে পৌঁছেছেন। ইউরোপের কারও ইতিপূর্বে এতদূর পর্যন্ত

আসার সৌভাগ্য হয়নি।

সুন্দর বিশাল একটি নদীর মোহনায় ঢুকে পিজারো এক বন্দরনগরে জাহাজ ভিড়িয়েছেন এবার।

প্রশস্ত চওড়া নদী, তার ধারে সুন্দর ছোট্ট শহর। তবু এখানে পা দেবার পর থেকেই কেমন যেন একটা অস্বস্তিবোধ করেছে সবাই—কী একটা প্রায় গা ছমছম করা ভাব।

কী নাম এ শহরের নাম জানা গেছে সান্তা।

এখানে এ রকম অদ্ভুত অনুভূতি হবার কারণটা কী হতে পারে? শহরটা কি আলাদা ধরনের কিছু?

এমন কিছু নয়। হাওয়াটা শুধু বড় বেশি রকম যেন শুকনো। নিঃশ্বাস নিতে নাকের ভেতর পর্যন্ত শুকিয়ে দেয়।

আর, আর ওগুলো কী? জিজ্ঞাসা করেছে পিজারো আর তাঁর দলের লোকেরা, শহরে ঘুরতে বেরিয়ে।

ওগুলো গুয়াকাস!

গুয়াকাস! সে আবার কী? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন পিজারো।

নগরবাসীরা গুয়াকাস কী বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দলের কেউ তো নয়ই, পিজারো বা আলমাগলরাও স্পষ্ট করে কিছুই বুঝতে পারেননি।

বুঝবেন কী করে? আসলে দু-জনেই তো সরস্বতীর ত্যাজ্যপুত্র টিপসই দেওয়া মূখ। এ দেশের রাজ্যেশ্বরের পরিবার আর খানদানিরা যে মৃত্যুর পর আপনজনের মৃতদেহ মিশরিদের মতো মামি করে রাখে আর এখানকার আবহাওয়া অসম্ভব রকম শুকনো বলেই সান্তা বন্দর যে সমাধি-নগর হিসেবে নির্বাচিত, তা বোঝবার মতো জ্ঞানবিদ্যে দু-জনের কারওই নেই।

গুয়াকাস মানে সমাধিস্থান। এইটুকুই তাঁরা বুঝেছেন, আর যত রাজ্যের সেকাল একালের মড়া তার মধ্যে ওষুধে আরকে তাজা রাখবার ব্যবস্থা হয় এইটুকু জেনেই ও শহরে থাকবার উৎসাহ পাননি।

জীবিতের চেয়ে মৃতের মর্যাদাই যেখানে বেশি সে বন্দর-নগর ছাড়বার পর পিজারোর লোকজন আর অজানা দক্ষিণে পাড়ি দিতে চায়নি। পিজারোকেও তাদের মতে সায় দিতে হয়েছে।

সূর্য কাঁদলে সোনার কিংবদন্তির দেশ যে সত্যি আছে তার যথেষ্ট প্রমাণ তো তাঁরা এবার সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। ছোটখাটো একটা জনপদ তো নয়, এ বিশাল সমৃদ্ধ শক্তিমান রাজ্য জয় করা পিজারোর ওই সামান্য ক-জন সাঙ্গোপাঙ্গদের ক্ষমতার বাইরে। তার জন্যে পুরোপুরি তৈরি হয়ে আসতে হবে।

এবারের সার্থক অভিযানের বিবরণ শুনলে আর এ অজানা আশ্চর্য রাজ্যের। কল্পনাতীত ঐশ্বর্যের কিছু নিদর্শন চাক্ষুষ দেখলে শাসনকর্তা পেড্রারিয়াস যে কিছুতেই আগের মতো বিমুখ থাকতে পারবেন না, নতুন অভিযান সাজাবার জন্যে যা কিছু দরকার সাগ্রহেই তা দেবেন, এ-বিষয়ে পিজারোর কোনও সংশয় তখন আর নেই।

আশায় উৎফুল্ল হয়ে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রায় আঠারো মাস বাদে পিজারো তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ সমেত দুটি জাহাজ পানামা বন্দরে ভেড়ালেন।

পানামা বন্দরে সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সমস্ত শহরই যেন ভেঙে পড়েছে। পিজারো আর তাঁর সঙ্গীদের দেখতে আর অভ্যর্থনা জানাতে। তাঁরা যে এখনও প্রাণে বেঁচে আছেন পানামার কেউ তা-ই ভাবতে পারেনি। আঠারো মাস যাঁদের কোনও সংবাদ নেই, অজানা অসীম সমুদ্রে সম্পূর্ণ অনাবিষ্কৃত ভূভাগে বেপরোয়া হয়ে পাড়ি দিয়ে নিজেদের গোঁয়ার্তুমির চরম শাস্তিই তারা পেয়েছে বলে সবাই ধরে নিয়েছেন।

তার বদলে তাঁরা শুধু নিরাপদে ফিরেই আসেননি, কিংবদন্তির দেশ সত্যিই আবিষ্কার করে তার আশ্চর্য বিবরণ আর নিদর্শন সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, এ খবর চাউর হবার পর পানামার মতো বন্দরনগরে উৎসাহ-উত্তেজনার জোয়ার বওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

পানামা বন্দরে সেদিন গণমান্য থেকে অতিনগণ্যদেরও প্রায় সকলকেই উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।

দেখে গেছে মোরালেসকে, পাদরি হার্নান্দো লুকে-কে, আর তখনও পর্যন্ত পিজারোর অভিযানের আসল মহাজন হিসেবে যিনি আত্মপ্রকাশ করেননি সেই লাইসেনসিয়েট গ্যাসপার দে এসপিনোসাকেও।

দেখা যায়নি শুধু পানামার গভর্নর পেদ্রো দে লোস রিয়স ওরফে পেড্রারিয়াসকে। তাঁর সম্মানে বাধলেও তাঁর সরকারি-দপ্তরের কেউ তো তাঁর হয়ে পিজারোদের অভ্যর্থনা জানাতে আসতে পারত। সেরকম কেউও আসেনি।

পিজারো, আলমাগরো ও রুইজ-এর তখনই উদ্বিগ্ন হবার কথা। কিন্তু নাগরিকদের উচ্ছ্বসিত সমাদরে কিছুকাল মাথা ঠাণ্ডা রাখাই তাঁদের পক্ষে কঠিন হয়েছে।

মেঘলোক থেকে মাটিতে নামবার অবসর হবার পর তিনজনে যখন পেড্রারিয়াস-এর কাছে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে দরবার করতে গেছেন তখন যে আঘাত তাঁরা পেয়েছেন তা সত্যিই কল্পনাতীত।

সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ জয় করার স্বপ্ন একমুহূর্তে ধূলিসাৎ করে দিয়ে গভর্নর পেড্রারিয়াস বলেছেন, নো এনতেনদিয়া দে দেসপোবলার সু গবর্নেসিওন পারা কে আভিয়া মুয়েরতো—

নিজেকে যেন কড়া রাশ টেনে থামিয়ে দাসমশাই নিজের ত্রুটি স্বীকার করে বললেন, ভুলে পেড্রারিয়াস-এর আসল মুখের কথাই বলে ফেলছিলাম। মোদ্দা কথা হল পেড্রারিয়াস পিজারোদের আরজি সরাসরি নাকচ করে দিয়ে রূঢ়ভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, নিজের মুল্লুক ভাসিয়ে দিয়ে অন্যের মুল্লুক গড়ে দেবার বাসনা তাঁর নেই। সস্তা ক-টা সোনা-রুপোর খেলনা আর কিম্ভুত একজাতের ভেড়ার জন্যে যতজন প্রাণ খুইয়েছে তা-ই যথেষ্ট। তার বেশি প্রাণ অকারণে নষ্ট হতে তিনি দেবেন না।

পাহাড় টললেও পেড্রারিয়াস টলবেন না। হয় পিজারোদের অভিযানের অসীম সম্ভাবনা তিনি ধারণা করতে পারেননি কিংবা সে সম্ভাবনা অত বিরাট বলেই ভয় পেয়ে গেছেন।

 

কিন্তু পিজারো আর তাঁর সঙ্গীরা যে চোখে অন্ধকার দেখেছেন। তাঁদের এত দুর্ভোগ এত প্রাণের মায়া-ত্যাগ করা দুঃসাহস, সব নিষ্ফল? অন্যের কাছে যা সাহায্য পেয়েছেন তার ওপরে নিজেদের যথাসর্বস্ব তাঁরা এই অভিযানের পেছনে ঢেলেছেন। এখন তাঁরা পথের ভিখিরি বললেই হয়। পানামার গভর্নর বিরূপ হবার পর আর নতুন অভিযান সাজাবার কথা ভাবা বাতুলতা। সূর্য কাঁদলে সোনা-র দেশ অনাবিষ্কৃতই থেকে যাবে, কিংবা তাঁরা যে প্রথম ধাপ কেটে দিয়ে যাচ্ছেন তাই দিয়ে ভাগ্যের পরিহাসে আর-কেউ সাফল্যের শিখরে উঠবে এ দেশ আবিষ্কারের গৌরব আত্মসাৎ করতে।

পিজারো আর আলমাগরো একেবারে ভেঙে পড়ে নিজেদের বাসা থেকেই আর বার হন না।

রুইজ শুধু এত বড় আশাভঙ্গের দুঃখ ভুলতে শুড়িখানাতেই প্রায় দিনরাত পড়ে থাকেন। অনেক রাত্রে শুড়িখানার মালিক যখন একরকম জোর করে তাঁকে রাস্তায় ঠেলে বার করে দিয়ে দোকান বন্ধ করে, রুইজ তখন কোনওরকমে টলতে টলতে মোরালেস-এর বাড়িতেই গিয়ে ওঠেন। সে-ই তাঁর আস্তানা!

সেদিন অমনই টলতে টলতে মোরালেস-এর বাড়িতে যাবার পথে রুইজ নির্জন জলার রাস্তায় যেন ভূত দেখেছেন। নেশায় নিজেকে বেহুঁশ জেনে প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে না পেরে জেগে স্বপ্ন দেখছেন বলেই মনে করছেন। কিন্তু স্বপ্ন বা চোখের ভুল নয়। সত্যিই নির্জন রাস্তায় চাঁদের আলোয় মানুষটাকে স্পষ্ট দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। নির্জন রাস্তায় এমন একজন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকা কিছু আজগুবি ব্যাপার নয়। কিন্তু মানুষটা যে সেই দোভাষী, ভেলা-জাহাজ বালসা থেকে যাকে তুলে নিয়েছিলেন আর পিজারো-র তখনকার আস্তানা রিও-দে-সান জোয়ান-এর তীরে জাহাজ বাঁধবার পর যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল আশ্চর্যভাবে।

তুমি! তুমি এখানে? রুইজ-এর নেশায় জড়ানো জিভ যেন আরও অসাড় হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, একটা কথা শুধু বলবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি এখানে।

কী কথা? রুইজ মাথাটা পরিষ্কার করবার চেষ্টা করে জিজ্ঞাসা করেছেন।

ইদারায় জল না পেলে নদীতে যেতে হয়।

অ্যাঁ! মাথাটায় ঝাঁকানি দিয়ে ঝাপসা বুদ্ধি ও দৃষ্টি একটু স্পষ্ট করতে যাবার পর রুইজ সামনে আর কাউকে দেখতে পাননি। লোকটা যেন জ্যোৎস্নার আবছা আলোয় মিশে গেছে।

বালসা থেকে যাকে তুলেছিলেন সেই দোভাষীকেই সত্যি এইমাত্র দেখেছেন কি মনে সন্দেহ জেগেছে।

যা সে বলে গেল সে কথাটারও মাথামুণ্ডু কিছু খুঁজে পাননি।