০৬. প্রজা-আন্দোলন দানা বাঁধিল

প্রজা-আন্দোলন দানা বাঁধিল
ছয়ই অধ্যায়

১. সিরাজগঞ্জ প্রজা-সম্মিলনী

ময়মনসিংহ জিলার সর্বত্র যখন প্রজা আন্দোলনের বিস্তৃতি সুনাম ও শক্তি ক্রমশঃ বাড়িতেছিল, এমন সময় আরেকটি ঘটনায় প্রজা-সমিতির আরও শক্তি বৃদ্ধি পাইল। মওলানা আবুল হামিদ খাঁ ভাসানী সাহেব এই সময় (১৯৩২ সালের ডিসেম্বরে) সিরাজগঞ্জে এক প্রজা সম্মিলনী ডাকিলেন। মিঃ শহীদ সুহরাওয়াদী সম্মিলনী উদ্বোধন করিলেন। খান বাহাদুর আবুদল মোমিন সভাপতি। এই সম্মিলনী নিখিল-বংগ প্রজা সমিতির উদ্যোগে হয় নাই। মওলানা ভাসানী নিজের দায়িত্বেই ডাকিয়াছিলেন। সুতরাং শেষ পর্যন্ত ইহা একটি জিলা প্রজা সম্মিলনীতেই পর্যবসিত হইত। কিন্তু একটি বিশেষ ঘটনায় এই সম্মিলনী সারা দেশীয় গুরুত্ব লাভ করিল। সিরাজগঞ্জের এস, ডি, ও. মওলানা ভাসানী ও সম্মিলিনীর অভ্যর্থনা সমিতির মেম্বারদের উপর ১৪৪ ধারা জারি করিলেন। শহীদ সাহেব ও মোমিন সাহেব এই লইয়া গবর্নরের সহিত দরবার করেন। শেষ পর্যন্ত গবর্নর এস.ডি.ওর আদেশ বাতিল রান। এই ঘটনা খবরের কাগযে প্রকাশিত হওয়ায় বাংলার প্রায় সকল জিলা হইতে প্রজা কর্মীরা বিনা-নিমন্ত্রণে এই সম্মিলনীতে ভাংগিয়া পড়েন। ময়মনসিংহ জিলার বহু কর্মী লইয়া আমিও এই সম্মিলনীতে যোগদান করি। গিয়া দেখি এলাহি কারখানা। সম্মিলনী ত নয়, একেবারে কুম্ভ মেলা। জনতাকে জনতা। লোকের মাথা লোকে খায়। হয়তবা লক্ষ লোকই হইবে। সদ্য-ধান-কাটা ধান ক্ষেতসমূহের সীমাহীন ব্যাপ্তি। যতদূর নযর যায় কেবল লোকের অরণ্য। এই বিশাল মাঠের মাঝখানে প্যাণ্ডেল করা হইয়াছে। প্যাণ্ডাল মানে একটা চারদিক খোলা মঞ্চ। উপরে একখানা শামিয়ানা। সেই বিশাল জনতার মাথায় সে শামিয়ানাটা যেন একটি টুপিও নয় টিকি মাত্র।

সম্মিলনীর কাজ শুরু হইবার অনেক দেরি ছিল। মনে হইল একবার ডেলিগেট ক্যাম্পটা ঘুরিয়া আসি। আমার জিলার সহকর্মী ডেলিগেটরা সেখানে ছিলেন। আমি নিজে আমার এক বন্ধুর অনুরোধে তাঁর শশুর বাড়িতে মেহমান হইয়াছিলাম। কাজেই সহকর্মীদের তত্ত্ব-তালাশ লওয়া কর্তব্য। ডেলিগেট ক্যাম্পে গিয়া দেখিলাম, স্বয়ং মওলানা সাহেবই ডেলিগেটদের খোঁজ-খবর করিতেছেন। মওলানা ভাসানী সাহেবের সহিত এই আমার প্রথম পরিচয়। মওলানাকে ভাবিয়াছিলাম ইয়া বড় বুড়া পীর। দেখা পাইলাম একটি উৎসাহী যুবকের। আমার সময়বয়স্কই হইবেন নিশ্চয়। দাড়ি-মোচে একটু বেশি বয়সের দেখায় আর কি? আলাপ করিয়া খুশী হইলাম। হাসিখুশী মেজ। কর্ম চঞ্চল অস্থিরতার মধ্যেও একটা বুদ্ধির দীপ্তি ও ব্যক্তিত্ব দেখিতে পাইলাম।

যথা সময়ে সম্মিলনী শুরু হইল। সমবেত জনতার এক-চতুর্থাংশ লোক প্যান্ডালের চারিপাশ থেরিয়া বসিল। মঞ্চোপরি বসিয়া চারিদিক চাহিয়া অবাক হইলাম। জনতার তিন-চতুর্থাংশ লোক কচুরিপানার মত ভাসিয়া বেড়াইতেছে। বাকী মাত্র এক-চতুর্থাংশ লোক সভায় বসিয়াছে। তবু সভার আকার এত বিশাল যে উহাদের সকলকে শুনাইয়া বক্তৃতা করিবার মত গলা অনেক নেতারই নাই। তখনও মাইকের প্রচলন হয় নাই। কাজেই তৎকালে সভার মাঝখানে প্যাণ্ডাল করিয়া যাত্রাগানের আসরের মত বক্তারা মঞ্চের উপরে চারিদিকে ঘুরিয়া-ঘুরিয়া বক্তৃতা করিতেন। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, তৎকালে মাইক ছাড়াই নেতারা বড়-বড় সভায় বক্তৃতা করিতেন এবং শ্রোতারা নীরবে কান পাতিয়া শুনিত। সুরেন্দ্র নাথ বানার্জী, বিপিন পাল, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, মহাত্মা গান্ধী, অধ্যাপক জে, এল, বানাজী, মৌলবী ফযলুল হক, মওলানা আযাদ, মওলানা আকরম খাঁ, মৌঃ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মওলানা আবদুল্লাহিল বাকী ও কাফী, আমার শস্ত্র মওলানা আহমদ আলী আকালুবী, আমার চাচা শশুর মওলানা বিলায়েত হোসেন প্রভৃতি নেতাদের গলা সানাইর মত স্পষ্ট ও বুলডগের গলার মত বুলন্দ ছিল। তরুণ নেতাদের মধ্যে শহীদ সাহেবের গলাও উপরোক্ত নেতাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিল। কিন্তু টাইপ রাইটার আবিষ্কারের ফলে যেমন লোকের হাতে লেখা খারাপ হইয়াছে, মাইক আবিষ্কৃত হওয়ায় বক্তাদের গলাও তেমনি ছোট হইয়া গিয়াছে বলিয়া মনে হয়।

যা হোক সম্মিলনীর কাজ সাফল্যের সহিত সমাধা হইল। খান বাহাদুর মোমনের ডিক্টেশনে আমার হাতের লেখা অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব সম্মিলনীতে গৃহীত হইয়াছিল। ঐ সব প্রস্তাবের মধ্যে জমিদারি উচ্ছেদ, খানার নিরিখ হ্রাস, ন্যর সেলামি বাতিল, জমিদারের প্রিয়েমশনাধিকার রদ, মহাজনের সুদের হার নির্ধারণ, চক্র বৃদ্ধি সুদ বে-আইনী ঘোষণা, ইত্যাদি কৃষক-খাতকদের স্বার্থের মামুলি দাবিসমূহ ত ছিলই। তার উপরে ছিল দুইটি নয়া প্রস্তাব। কয়েক মাস আগেই ম্যাকডোনান্ড এওয়ার্ড নামে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ বাহির হইয়াছিল। সকল দলের হিন্দুরা উহার প্রতিবাদ করিতেছিলেন। কাজেই মুসলিম নেতারা মনে করিলেন, আমাদের এটা সমর্থন করা দরকার। অতএব রোয়েদাদের সমর্থনে প্রস্তাব পাস হইল। অপরটি ছিল কৃষি খাতকদের ঋণ আদায়ের উপর মরেটরিয়ম এয়োগর দাবি। এটা ছিল মোমিন সাহেবের নিজস্ব কীর্তি। তাঁরই কাছে ‘মরেটরিয়াম’ শব্দটা প্রথম শিখি। তাঁরই উপদেশমত এই প্রস্তাবটিতে কৃষি-খাতক ঋণের উপর দস্তুরমত একটি থিসিস লিখিয়া ফেলিয়াছিলাম। প্রস্তাবে বলা হইয়াছিল বাংলার কৃষি-খাতকদের ঋণের বোঝার প্রায় সবটুকুই চক্রবৃদ্ধি, সুতরাং অন্যায়। উহা শোধ করার সাধ্য কৃষকদের মাই। মূলতঃ ইহারই উপর ভিত্তি করিয়া পরবর্তীকালে ১৯৩৬ সালে বংগীয় কৃষি-খাতক আইন পাস হইয়াছিল এবং ১৯৩৭ সালে সালিশী বোর্ড স্থাপিত হইয়াছিল। এই দিকে সিরাজগঞ্জের এই কনফারেন্সের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রহিয়াছে। এই সম্মিলনীর ফলে মওলানা ভাসানী, মোমন সাহেব ও শহীদ সাহেবের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা খুবই বাড়িয়া যায়।

২. সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ

ইতিমধ্যে ১৯৩২ আগস্ট মাসে ম্যাকডোনাল্ড এওয়ার্ড বা সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ বাহির হয়। দলের মুসলিম নেতারা এর অভিনন্দন করেন। পক্ষান্তরে সকল দলের হিন্দু নেতারা ইহার তীব্র নিন্দা করেন। কংগ্রেস তখন বে-আইনী। কাজেই প্রতিষ্ঠান হিসাবে কংগ্রেস কোনও মতামত দিতে না পারিলেও জেলের বাহিরে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই সাম্প্রদায়িক রায়েদাদের নিলায় বিবৃতি দিতে লাগিলেন। মহাত্মা গান্ধীও তখন জেলে। সাম্প্রদায়িক ব্লোয়েদাদে তফসিলী হিন্দুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হইয়াছিল। মহাত্মা গান্ধী জেলের মধ্য হইতেই ইহার প্রতিবাদে আমরণ অনশন শুরু করেন। মহাত্মা গান্ধীকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁর মধ্যস্থতায় সকল শ্রেণীর হিন্দু নেতারা তফসিলী হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ভিত্তিতে যুক্ত নির্বাচনে আপোস-রফা করেন। বৃটিশ সরকারও তৎক্ষণাৎ এই আপোস-রফা গ্রহণ করিয়া রোয়েদাদ সংশোধন করেন। এই ঘটনা হইতে আমরা ইহা আশা করিলাম যে মহাত্মাজী রোয়েদাদের মুসলিম অংশের তেমন তীব্র বিরোধিতা করিবেন না। এ আশায় আরও জোর বাঁধিল কয়েক দিনের মধ্যেই। পণ্ডিত নেহরুর অন্তরংগ বন্ধু কংগ্রেসের তরুণ নেতাদের ন্যতম মিঃ জয় প্রকাশ নারায়ণ কলিকাতার আলবাট হলের এক সভায় সাম্প্রদায়িক ব্রোয়েদাদ সমর্থন করিলেন এবংকংগ্রেসকে ব্লোয়েদাদ মানিয়া লইবার অনুরোধ করিলেন। ১৯৩৩ সালের মাঝামাঝি কথা উঠিল ১৯৩৪ সালে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের নির্বাচন হইবে। কংগ্রেসীরাও নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করিবেন কানাঘুষা শোনা গেল। কয়েক মাস আগে মহাত্মাজী হরিজন আন্দোলন শুরু করিলে তাঁকে গ্রেফতার করা হইল। তিনি আবার অনশনব্রত গ্রহণ করিলেন। সরকার এবারও মহাত্মাজীকে মুক্তি দিলেন।

৩. রাঁটি কংগ্রেস সম্মিলনী

মুক্তি পাইলেও মহাজী আইন অমান্য আন্দোলন বা কংগ্রেসের কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ করিলেন না। কারণ কংগ্রেস তখনও বে-আইনী। এ অবস্থায় জেলের বাইরের কংগ্রেস-নেতাদের মধ্যে পরামর্শের সুবিধার জন্য মহাত্মাজীর সমর্থনে ডাঃ আনসারী, মিঃ রাজাগোপালাচারিয়া ও ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে ১৯৩৩ সালের মাঝামাঝি রীচিতে একটি ইনফর্মাল এ. আই. সি. সি.-র সভা হয়, ময়মনসিংহের অন্যান্য কংগ্রেস কর্মীদের সাথে আমিও এই সভায় যোগদান করি। কারণ আমরা জানিতে পারিলাম, এই সভার উদ্যোক্তারা চান যে কংগ্রেসের মুসলিম মেম্বররা যেন দলে দলে এই সভায় যোগদান করেন। আমি এই ইশারার অর্থ বুঝিলাম। কাজেই শত কাজ ফেলিয়া এই সভায় যোগ দিলাম।

রাঁচিতে গিয়া বুঝিলাম প্রধানতঃ ডাঃ আনসারীর উৎসাহেই এই সঙ্গিনী সব হইয়াছে। ডাঃ আনসারী এই সম্মিলনীর সভাপতিত্ব করিবেন ইহা আগেই ঘোষিত হইয়াছিল। তাঁর মত খ্যাতনামা কংগ্রেস-নেতা রাঁচিতে মেহমান হইয়াছেন বিহারের শিক্ষাশ্রী সার সৈয়দ আবদুল আযিযের। মন্ত্রী মহোদয়ের উৎসাই শুধু ডাঃ আনসারীর মেহমানদারিতেই সীমাবদ্ধ থাকিল না। সভায় সমবেত সমস্ত মুসলিম ডেলিগেটদের খাওয়ার ব্যবস্থার আরও তিনিই নিয়াছেন। ফলে আমরা থাকিতাম যদিও কটিয়ার জমিদার জনাব ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চান মিয়া সাহেবের রাঁচি প্রাসাদে, কিন্তু আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হইলমী সাহেবের বাড়িতে। ইহার দুইটা মাত্র ব্যাখা সম্ভব ছিল। প্রথম, মন্ত্রী আবদুল আযিয সাহেব বাহিরে ধামাধরা খেতাবধারী ‘সার’ হইলেও ভিতরে ভিতরে তিনি কংগ্রেসের সমর্থক। দ্বিতীয়, ভারত সরকারের সম্মতিক্রমেই তিনি কংগ্রেস নেতাদের মেহমানদারি করিতেছেন। প্রথম ব্যাখ্যা সম্ভব মনে হইল না। কাজেই আমরা দ্বিতীয় ব্যাখ্যাই করিলাম। কংগ্রেস আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করিয়া আইন সভায়, বিশেষতঃ কেন্দ্রীয় আইন সভায়, আসিলে আইন অমান্য আন্দোলন কমজোর, এমনকি একেবারে পরিত্যক্ত হইবে। কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে ফিরিয়া আসিবে। এই আশাতেই ভারত সরকার রাঁচি সম্মিলনীর সাফল্য চাইতেছেন। আমরা এই ব্যাখ্যাই করিলাম।

বাংলার ডেলিগেট হিন্দু মুসলিম সবাই আমরা চান মিয়া সাহেবের প্রাসাদে এক সংগে থাকিতাম। কাজেই সম্মিলনীর সময়টুকু ছাড়া অন্য সব সময়েই আমরা সাম্প্রদায়িক রোয়দাদের উপর বাহাস করিতাম। এই আলোচনার ফলে আমরা বুঝিলাম যে বাংলার হিন্দু নেতারাই রোয়েদাদের বিরুদ্ধে বেশি খাপ্পা ছিলেন। বোম্বাইর মিঃ কে, এফ. নরিম্যান মাদ্রাজের মিঃ এম, আর, মাসানী, মিঃ সত্যমূর্তি ও অধ্যাপক রংগ। প্রভৃতি সকলের মধ্যেই একটু আপোস মনোভাব দেখিতে পাইলাম। কিন্তু বাংগালী হিন্দুদের প্রায় সকলেই ছিলেন অনড়। আমাদের সাথে তর্ক করিতে করিতে অনেকে উত্তেজিত হইয়া উঠিতেন। একাধিক দিন এতে অপ্রিয় ঘটনাও ঘটিয়া গিয়াছে। অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তীর সাথে একবার ত আমার হাতাহাতির উপক্রম। তিনি বলিয়াছিলেন যে, আমার মত সাম্প্রদায়িক মনোভাবের লোকের কংগ্রেস ছাড়িয়া মুসলিম লীগে যাওয়া উচিৎ। জবাবে আমি বলিয়াছিলাম, তাঁর মত সাম্প্রদায়িক হিন্দুর কংগ্রেস ছাড়িয়া হিন্দু সভায় যোগ দেওয়া উচিৎ।

কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে সম্মিলনী আরম্ভ হইলে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের দৃঢ়তায় বাংলার হিন্দু প্রতিনিধিরা বেশ নরম হইয়া গেলেন। মহাত্মাজী সশরীরে সম্মিলনে যোগ দিলেন না বটে, তবে সকল কাজ ও প্রস্তাবাদি রচনা তাঁর সাথে পরামর্শ করিয়াই করা হইল। রাজাজী সভায় উপস্থিত থাকিয়া এবং প্রধান অংশ গ্রহণ করিয়া মহাত্মাজীর প্রতিনিধিত্ব করিলেন। শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই সম্মিলনীর কাজ শেষ হইল। আমাদের দিক হইতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব যা গৃহীত হইল, তা সাম্প্রদায়িক রায়েদাদ সম্পর্কে। দুইদিন তুমুল বাদ-বিতণ্ডার পরে কংগ্রেসের বিখ্যাত ‘না গ্রহণ না বর্জন’ প্রস্তাবটি এই সম্মিলনীতে গৃহীত হইল। এই সভার কাৰ্য্য পরিচালনায় ডাঃ আনসারীর তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার বুদ্ধি দেখিয়া আমি মুগ্ধ ও বিস্মিত হইলাম। কংগ্রেস এই মধ্যপন্থী প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া দেশকে একটা আসন্ন বিপর্যয় হইতে রক্ষা করিল, এই সান্ত্বনা লইয়া আমি বাড়ি ফিরিলাম।

৪. নির্বাচনে প্রথম প্রয়াস

১৯৩৪ সালের কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে প্রজাসমিতির সভাপতি সার আবদুর রহিম কলিকাতা হইতে এবং সমিতির অন্যতম সহ-সভাপতি মৌঃ এ. কে. ফযলুল হক বরিশাল-ফরিদপুর নির্বাচনী এলাকা হইতে প্রার্থী হইলেন। ঢাকা ময়মনসিংহ নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী হইলেন সার আবদুল হালিম গযনব। আমাদের জিলার সর্বসাধারণ এবং বিশেষতঃ প্রজা-কর্মীরা সার গযনবীর রাজনীতি পছন্দ করিতাম না–প্রজার স্বার্থের দিক হইতেও না, দেশের স্বার্থের দিক হইতেও না। কাজেই আমরা তাঁর বিপক্ষে দাঁড় করাইবার যোগ্য লোক তালাশ করিতেছিলাম। এমন সময় আমি হক সাহেবের একটি পত্র পাইলাম। তাতে তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়াছেন, আমি যেন জিলার অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করিয়া গযনবীর বিরুদ্ধে একটি শক্ত ক্যানডিডেট দাঁড় করাই। ব্যাপারটার গুরুত্ব সম্পর্কে আমাকে অবহিত করিবার জন্য চিঠির উপসংহারে তিনি লিখিয়াছেন : ‘গযনবীকে কিছুতেই নির্বাচিত হইতে দেওয়া উচিৎ হইবে না। কারণ তিনি আসলে আহসান মনযিলের একটি শিখণ্ডীমাত্র। কখনও ভুলিও না যে আহসান মনযিলের সাথে আমার সংগ্রাম কোনও ব্যক্তিগত সংগ্রাম নয়। এটা আসলে আহসান মনযিলের বিরুদ্ধে মুসলিম-বাংলার লড়াই। আহসান মনযিলের কবল হইতে উদ্ধার না পাওয়া পর্যন্ত মুসলিম বাংলার রক্ষা নাই।‘

হক সাহেবের এই পত্র পাওয়ার পর আমাদের কর্তব্য বাড়িয়া গেল। আমরা আরও জোরে উপযুক্ত প্রার্থীর তালাশ করিতে লাগিলাম। দুই জিলা লইয়া নির্বাচনী এলাকা। যাকে-তাকে ত খাড়া করা যায় না। জিলার সর্বজনমান্য নেতা খান বাহাদুর মৌলবী মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেব প্রায় বছর খানেক ধরিয়া প্রজাসমিতির সমর্থক। কাজেই তাঁকেই ধরিলাম। হক সাহেবের পত্র লইয়া তাঁর সাথে দেখা করিলাম এবং দাঁড়াইতে অনুরোধ করিলাম। দুই জিলার বিশাল এলাকার দোহাই দিয়া তিনি অসম্মতি জানাইলেন। কিন্তু হক সাহেবের পত্ৰ তিনিও পাইয়াছেন বলিয়া এ ব্যাপারে তিনি চেষ্টা করিবেন আশ্বাস দিলেন।

এমনি সময়ে খান বাহাদূর সাহেবের বাড়িতে একদিন নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলীর সাথে আমার দেখা। খান বাহাদুর সাহেব হাসি মুখে বলিলেন : ‘এই নেও তোমার ক্যানডিডেট।‘ তিনি নবাবযাদার সাথে আমার পরিচয় করাইয়া দিলেন। নবাবদার চেহারা তাঁর বিনয়-নম্রতা ও ভদ্রতা দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইলাম। জমিদারদেরে সাধারণভাবে আমি ঘৃণা করিতাম। ধনবাড়ির নবাব সাহেবকে ব্যক্তিগতভাবে আমি শ্রদ্ধা করিতাম বটে কিন্তু জমিদার হিসাবে অপর সব জমিদারদের মতই তাঁর প্রতিও আমার বিরুদ্ধ মনোভাব ছিল। জনশ্রুতিমতে ধনবাড়ির জমিদার ছিলেন অত্যাচারী জমিদারদের অন্যতম। নবাবযাদার সহিত আলাপ করিয়া এবং একটু ঘনিষ্ঠ হইয়া বুঝিলাম জমিদারের ঘরেও জমিদারি-প্রথার বিরোধী প্রজাহিতৈষী ভাল-মানুষ হওয়া সম্ভব। প্রজাসমিতির ও কংগ্রেসের সহকর্মীদের সাথে নবাবযাদার পরিচয় করাইয়া দিলাম।

নবাবযাদা হাসান আলীকে আমার খুব ভাল লাগিল। প্রজা-সমিতিতেও তাঁকে গ্রহণ রাইতেই হইবে। সেই উদ্দেশ্যে প্রজা-সমিতির ও কংগ্রেসের বন্ধুদের সাথে। তাঁর পরিচয় করাইতে এবং প্রজা-কর্মীদের কাছে তাঁকে গ্রহণযোগ্য করিয়া চিত্রিত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। চেষ্টা আমার খুব বেশি করিতে হইল না। নবাবযাদা তাঁর স্বাভাবিক অমায়িক মিষ্টব্যবহারের দ্বারা ও জ্ঞান-বুদ্ধির গুণে নিজেই অধিকাংশের হৃদয় জয় ও প্রশংসা অর্জন করিলেন। কিন্তু অপেক্ষাকৃত প্রাচীন কড়া ও নিষ্ঠাবান নেতা-কর্মীদের কাছে আমার কিছু কিছু চেষ্টার দরকার হইল। তার কারণ নবাবদার মরহুম পিতা নবাব বাহাদুরের ঐতিহ্য ও স্মৃতি। কাজেই ঐ সব সহকর্মীর কাছে শুধু নবাবযাদার তারিফ করিলেই চলিত না। তাঁর মরহুম বাবার পক্ষে চূড়ান্ত কথা বলারও দরকার হইত। অত্যাচারী জমিদার হইয়াও ত মানুষ অন্যান্য গুণের অধিকারী হইতে পারেন। আমি নিজেই ব্যক্তিগত গুণের জন্য দু’চারজন জমিদারকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করিতাম এবং প্রজা-সহকর্মী বন্ধুদের সামনে অসংকোচে সে মনোভাব প্রকাশও করিতাম। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মুক্তাগাছার জমিদার রাজা জগৎ কিশোরকে তাঁর অসামান্য দানশীলতার জন্য, পাবনার জমিদার প্রমথ চৌধুরীকে তাঁর সাহিত্যিক নয়া-নীতির জন্য, সন্তোষের জমিদার প্রমথ নাথ রায় চৌধুরীকে তাঁর উদার অসাম্প্রদায়িক নাট্য-সাহিত্যের জন্য আমি ভক্তি-শ্রদ্ধা ও প্রশংসা করিতাম। বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথের কথা তুলিলাম না। কারণ জমিদারিটা তাঁর আসল পরিচয় নয়।

ধনবাড়ির জমিদার নবাব বাহাদুরকেও তেমনি দুইটি ঘটনায় আমি অনেক নেতা সাহিত্যিকের চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা-ভক্তি ও প্রশংসা করিতাম। অনেক সময় তাঁকে লইয়া গর্বও করিতাম। কিন্তু প্রজা-আন্দোলন শুরু করিয়া এই দুইটি ঘটনাই বেমালুম তুলিয়া গিয়াছিলাম। নবাবযাদার সাথে পরিচয় হওয়া এবং তার আনুসংগিক প্রয়োজন দেখা না দেওয়া পর্যন্ত তা ভুলিয়াই ছিলাম। আজ দুইটা ঘটনাই মনে পড়িয়া গেল। বন্ধুরা তাজ্জব হইলেন। আমিও কম হইলাম না।

এই দুইটি ঘটনার প্রথমটি বাংলা ভাষা সম্পর্কে। দ্বিতীয়টি খিলাফত আন্দোলন সম্পর্কে। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ দিকে মুসলিম-বাংলার সকল নাইট নবাব ও খেতাবধারীরা এবং উচ্চ স্তরের সরকারী কর্মচারীরা, এমনকি মফস্বলের অনেক খান বাহাদুর খান সাহেবরা পর্যন্ত, সরকারী ইংগিতে সমস্বরে রায় দিয়াছিলেন।

‘মুসলিম-বাংলার মাতৃভাষা বাংলা নয় উর্দু।‘ তখন গরিব আলেম-ওলামা ও সাহিত্যিকদের সাথে গলা মিলাইয়া যে একজন মাত্র নবাব বলিয়াছিলেন : “আমাদের মাতৃভাষা উর্দু নয় বাংলা।” তিনি ছিলেন ধনবাড়ির জমিদার নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। তাঁর আত্মীয়-স্বজন সহকর্মীদের মত ঠেলিয়াই তিনি এই বিবৃতি দিয়াছিলেন। এটা তাঁর মত সরকারপন্থী মডারেট রাজনীতিকের জন্য কত বড় দুঃসাহসিকতার কাজ ছিল, পঞ্চাশ বছর পরে আজ তা অনুমান করা সহজ নয়। কিন্তু মুসলিম-বাংলার জীবন-মরণ প্রশ্নে এই সাহস দেখান তিনি তাঁর কর্তব্য মনে করিয়াছিলেন।

দ্বিতীয় ঘটনাটিও তেমিন দুঃসাহসিক ও মনোবলের পরিচায়ক। খিলাফত আন্দোলনে তখন দেশ ছাইয়া গিয়াছে। বৃটিশ ও ভারত সরকার মুসলমানদের এই আন্দোলন দমন করিবার জন্য বিশেষ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার সংকল্প করিয়াছেন। সারা ভারতবর্ষে একজন মাত্র সরকারী লোক খিলাফত সম্পর্কে যুক্তি পূর্ণ সুলিখিত পুস্তিকা প্রচার করিয়া খিলাফত আন্দোলনের ন্যায্যতা প্রমাণ করিয়াছিলেন এবং বৃটিশ ও ভারত সরকারকে দমন-নীতি হইতে বিরত থাকিয়া মুসলিম ভারতের দাবি-মত খিলাফত প্রশ্ন মীমাংসার পরামর্শ দিয়াছিলেন। তিনি ছিলেন ধনবাড়ির নবাব সাহেব।

যদিও দুইটাই অবিস্মরণীয় ঘটনা, তবু তা আমার মনে পড়িল এতদিনে। আমি বলিতেও লাগিলাম বন্ধুদেরে বিস্তারিতভাবেই। তাঁরা বিশ্বাস করিলেন নিশ্চয়ই। কিন্তু এটাও তাঁরা বুঝিলেন, তথ্য যতই সত্য হোক, প্রয়োজন না হইলে তা কারও মনে পড়ে না আমারও না।

সকলে এক বাক্যে গযনবীর বিরুদ্ধে নবাব্যদাকে সমর্থন করিতে রাখী হইলেন। তিনি নমিনেশন পেপার ফাঁইল করিয়াছেন এবং খান বাহাদুর ইসমাইলসহ প্রজা সমিতির সকলে নবাবযাদাকে সমর্থন দিতেছেন শুনিয়া গ্যনবী সাহেব ঢাকার নবাব বাহাদুরসহ জমিদারদের এক বিরাট বাহিনী সইয়া ময়মনসিংহে আসিলেন। নবাবযাদাকে নমিনেশন প্রত্যাহার করিতে চাপ দিলেন। নবাবযাদা অল্পদিনেই আমার প্রতি এতটা আকৃষ্ট হইয়াছিলেন যে তিনি মনসুর সাব যা করেন, তাতেই আমি রাযী বলিয়া সমস্ত চাপ আমার ঘাড়ে ফেলিলেন।

মাত্র দুইদিনের পরিচয়ে অভিজাত বংশের একটি তরুণ যুবক তাঁর রাজনৈতিক ভাগ্য আমার উপর ছাড়িয়া দেওয়ায় আমি যেমন মুগ্ধ ও গর্বিত হইলাম, তেমনি আমার দায়িত্বের গুরুত্বে চিন্তাযুক্তও হইলাম। সাধ্যমত আমার দায়িত্ব পালনও করিলাম। সমবেত নেতা ও মুরুব্বিদের-দেওয়া সনাতন সব যুক্তি যথা : ইসলামের বিপদ, মুসলিম সংগতির আশু আবশ্যকতা, গয়নবী সাহেবের অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা, নবাবযাদার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ শুধু এইবার বাদে, ইত্যাদি সব যুক্তির চাপ কাটাইয়া উঠিতে পারিলাম। কিন্তু একটা বিষয় আমাকে খুব চিন্তিত করিল। স্বয়ং নবাব্যাদাও চিন্তামুক্ত ছিলেন না। সেটি এই যে ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট অনুসারে নবাবযাদার বয়স তখন পঁচিশ  হয় নাই। পঁচিশ  না হইলে আইন পরিষদের নির্বাচন-প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা হয় না। গয়নবী সাহেবের সমর্থকরা আমাদের পক্ষের এই গুপ্ত কথা জানিয়া ফেলিয়াছেন এটা কথা-বার্তায় স্পষ্ট বোঝা গেল। এই প্রশ্ন রিটার্নিং অফিসার ঢাকা বিভাগের কমিশনারের নিকট উঠিলে নবাবযাদার নমিনেশন পেপার স্কুটিনিতেই বাতিল হইয়া যাইতে পারে। আমাদের নেতা হক সাহেব স্বয়ং এই দরবারে উপস্থিত ছিলেন। তাঁকে পাশের কামরায় ডাকিয়া নিয়া নবাবযাদার উপস্থিতিতে এ বিষয়ে তাঁর লিগ্যাল অপিনিয়ন চাহিলাম। তিনিও সেই কথাই বলিলেন। নবাব্যাদার নমিনেশন প্রত্যাহার করিয়া অত-অত মুরুব্বির অনুরোধ-উপরোধ রক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ বিবেচিত হইল। একটা পুরা দিন ঘোরর বাকযুদ্ধ করিয়া তাই অবশেষে আমরা পরাজয় স্বীকার করিলাম। নবাবযাদাকে নমিনেশন প্রত্যাহারের উপদেশ দিলাম। যে হক সাহেবের বিশেষ নির্দেশে আমরা এই সংগ্রামে অবতীর্ণ হইয়াছিলাম, তাঁরই উপস্থিতিতে এবং সম্মতিক্রমে এটা হইল বলিয়া আমাদের বিবেকও পরিষ্কার থাকিয়া গেল।

এইভাবে এ জিলায় প্রজা-সমিতির নির্বাচন-যুদ্ধে নামিবার প্রথম প্রয়াস ব্যর্থ হইল। কিন্তু এতে দুইটা নেট লাভ হইল। এক, নবাবযাদার দৃঢ় চিত্ততা ও আমার উপর তাঁর নির্ভরশীলতা আমাকে মুগ্ধ করিল। অপরদিকে আমার সততা অধ্যবসায় নবাব্যদাকেও আমার প্রতি আরও আকৃষ্ট করিল। দুই, এই গয়নবী-বিরোধিতায় এ জিলার সকল মতের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে সংহতি স্থাপিত হইল পরবর্তী কয়েক বছর এই সংহতি প্রজা আন্দোলনকে এ জিলায় খুব জোরদার করিয়া তুলিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *