০৬. পরদিন হাটখোলার বাড়িটির সামনে

পরদিন হাটখোলার বাড়িটির সামনে পরদেশী এসে দাঁড়ালে আকমল হোসেনই ওকে প্রথমে দেখতে পান। প্রথমে চমকে ওঠেন তিনি। ভাবেন, নিশ্চয় কোনো খবর নিয়ে এসেছে পরদেশী। নাকি যুদ্ধে যাবে বলে ঠিক করেছে? তিনি দ্বিধায় পড়ে যান। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। গেটটা অর্ধেক ফাঁক করে আলতাফ বেরিয়ে গেছে। ও বাজারে গেছে। ওর দেরি হচ্ছে কেন চিন্তা করে তিনি এখানে এসে দাঁড়িয়েছেন মাত্র। ইদানীং আলতাফকে তার ভয় হয়। মনে হয়, যেকোনো সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যাবে। ওর মতিগতি তেমনই লাগে। আলতাফকে হারানোর কথা মনে হলেই তিনি অস্থির হয়ে যান। তাকে ছাড়া তাঁর পক্ষে একা এই অস্ত্রাগার পাহারা দেওয়া কঠিন। অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণও সহজ হবে না।

পরদেশী কাছে এসে বলে, সেলাম হুজুর। কেমন আছেন, হুজুর? আমি আপনার কাছে আবার এসেছি।

আকমল হোসেন গেট ফাঁক করে বলেন, ভেতরে চলে এসো, পরদেশী। তুমি কেমন আছ?

আমরা ভালোই আছি। যুদ্ধ করছি। যুদ্ধ করা সহজ কাজ না। খুবই কঠিন। এই আপনি যেমন যুদ্ধ করছেন তেমন। আপনার স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে। চুল সাদা হয়ে গেছে অনেক।

পরদেশী গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলে। আজ ও এখান থেকেই চলে যাবে।

পরদেশীকে দেখে এগিয়ে আসেন আয়শা খাতুন আর মেরিনা। পরদেশী বারান্দার সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে বলে, একটা চিঠি এনেছি। দাও। আকমল হোসেন হাত বাড়িয়ে চিঠি নেন। কার চিঠি?

যে মা-ঠাকরুন চিঠিটি লিখেছেন, তিনি আপনাদের ঠিকানা দেননি। আমি আর রাবেয়া সুইপার ঠিক করেছি, এমন যত চিঠি পাব, সব আপনাদের কাছে দিয়ে যাব। পুলিশ লাইনে যারা মারা গেছেন, তাদের তালিকাও দিয়েছে রাবেয়া সুইপার।

পরদেশী ছোট্ট খাতাটিও এগিয়ে দেয়। তারপর বলে, আমি আসছি, হুজুর। আমি দাঁড়াতে পারব না।

না, তা হবে না। তুমি বসো, পরদেশী। চা খাবে।

না মাইজি, আজ থাক। একজন মা-ঠাকরুন মরে গেলে আমার মন খুব খারাপ হয়। কয়েকজন নতুন মা-ঠাকরুনকে আনা হয়েছে। আমার মন খুব খারাপ। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

পরদেশী দুহাতে চোখ মোছে। তার কাঁচা-পাকা চুল কপালের ওপর এসে পড়ে। মেরিনা কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বলে, পরদেশী দাদা, আপনি একটু বসেন। এক গ্লাস জল খান।

হ্যাঁ, জল খাব, দিদিমণি। বুকে বড় জ্বালা। জ্বালা সইতে পারি না।

পরদেশী সিঁড়ির কাছে রাখা মোড়ার ওপর বসে। দুহাত কোলের ওপর জড়ো করে রাখে। মেরিনা নিজেই এক গ্লাস পানি আর দুটো সন্দেশ নিয়ে আসে ওর জন্য। পরদেশী হাত বাড়িয়ে পিরিচটা নেয়। আগ্রহ করে খায়। মেরিনা বুঝতে পারে, খেতে ওর ভালো লেগেছে। ওর হাত থেকে পিরিচটা নিয়ে পানির গ্লাসটা ওকে দেয়। ও গ্লাস শেষ করে বলে, আরও এক গ্লাস।

আয়শা খাতুন পেছন থেকে বলেন, তুই দাঁড়া, মেরিনা। আমি জগ ভরে পানি আনছি। ওর যে কয় গ্লাস ইচ্ছা, সে কয় গ্লাস খাবে। বুঝতে পারছি, অনেকটা পথ ও বোধ হয় হেঁটে এসেছে।

হ্যাঁ মাইজি, ঠিক। বাসে উঠতেও ভয় পেয়েছি। ভেবেছি, যদি ভিড়ের মধ্যে চিঠিটা হারিয়ে যায়। কেউ যদি বলে, তোর বুকের মধ্যে কী লুকিয়ে রেখেছিস। বের কর। তাহলে আমি মা-ঠাকরুনদের কাছে কী জবাব দেব?

আয়শা খাতুন একমুহূর্ত পরদেশীকে দেখেন। তাঁকে পানি আনতে যেতে হয় না। মন্টুর মা ততক্ষণে এক গ্লাস পানি এনে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গ্লাসটা নিয়ে পরদেশীকে দেন। পরদেশী মাথা নুইয়ে গ্লাস নেয়। মাথা নিচু করে গ্লাসের পানি শেষ করে।

যাই, মাইজি।

আপনি কি যুদ্ধে যাবেন, পরদেশী দাদা?

না। পরদেশী মোড়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মেরিনার প্রশ্নের উত্তর দেয়। তারপর পা বাড়াতে গিয়েও ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, পুলিশ লাইনের ব্যারাকের ঘরে ঘরে আটকে রাখা মেয়েদের সুইপার আর ডোমরাই তো দেখছে। ওদের তো দেখার আর কেউ নেই। আমরা না থাকলে যেটুকু ছায়া আছে, তা-ও থাকবে না।

ও চোখ মোছে। ওর কাঁচা-পাকা চুলের ওপর এসে বসে পোকা। আয়শার মনে হয়, ওর কথা শুনে পোকাটি এসে ওর সহমর্মী হয়েছে। যখন কারও জন্য কেউ থাকে না, তখন তার সঙ্গে মানুষ আর পোকা এক জায়গায় জড়ো হয়। এটাই বোধ হয় যুদ্ধের নিয়তি।

পরদেশী চুলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলে, যাই দিদিমণি।

সেলাম, মাইজি।

তুমি বেঁচে থাকো, পরদেশী, এই আশীর্বাদ করি।

এতক্ষণ আকমল হোসেন কোনো কথা বলেননি। পরদেশীকে দেখেছেন, সময়ের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন, সামনে কী কাজ করবেন, তা ভেবেছেন। ঘুরেফিরে পরদেশী তার সবটুকু বোধ নিয়ে তাঁর সামনে একজন বড় মানুষের অবয়বে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। যাবার সময় আকমল হোসেন ওর ঘাড়ে হাত রাখেন।

সাবধানে থেকো। বিপদ যেন তোমাকে ছুঁতে না পারে। রাবেয়াকে বলল, এখন থেকে ওকে আমরা জয় বাংলা ডাকব।

আমি আবার আসব, হুজুর। আপনাদের এখানে এলে অনেক শান্তি পাই। আজ ভেবেছিলাম, এই বাড়িতে দাঁড়াতেই পারব না। দেখলাম, কেমন করে যেন আমার থাকা কেমন হয়ে গেল। যাই, হুজুর।

আমি জানি, তুমি বারবার আসবে। তুমি আমাদের কাছে শহীদের তালিকা নিয়ে আসবে।

ও প্রবলভাবে ঘাড় নাড়ায়। তারপর নত হয়ে বলে, সেলাম, হুজুর।

আকমল হোসেন ওকে গেট খুলে দেন। ও যতক্ষণ ফুটপাত ধরে হেঁটে যায় তাকিয়ে থাকেন তিনি। দেখেন, ওর পায়ের গতিতে তীব্রতা আছে। ও একমুহূর্তে দৌড়ে আসতে পারে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। সারা দেশে যুদ্ধ।

গেট বন্ধ করে প্রাঙ্গণে দাঁড়ালে বুঝতে পারেন বাড়িটা মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে। তিনিও ঘরে যেতে পারছেন না। দাঁড়িয়ে থাকেন। বারান্দার ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন আয়শা খাতুন। সিঁড়ির রেলিংয়ের মাথায় বসে আছে মেরিনা। মন্টুর মা নিচে নেমে এসেছে। আলতাফের ঘরের কাছাকাছি আতাগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আলতাফ বাড়ির বাইরে। এক্ষুনি চলে আসবে।

কারও মুখে কথা নেই। কথা আসে না। পরদেশী এখনো এ বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে যেন, আর তারা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখছে এ বাড়ির গেরিলাযোদ্ধাদের মতো আরেকজন যোদ্ধাকে। তার উচ্চারণ স্পষ্ট। তার কাজের ক্ষেত্র নির্বাচন একরৈখিক। বুঝে গেছে, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের কত মাত্রা তৈরি হয়। কীভাবে সেখানে নিজেকে সংযুক্ত করতে হয়। কোনটা করলে যুদ্ধের সময়কে মূল্যায়ন করা হবে। সময়কে ঠিকমতো ধরা হবে এবং সময়ের অগ্রগতিতে নিজের হাত মেলানো হবে।

স্তব্ধতা ভাঙে মেরিনা।

ও সিঁড়ির শেষ ধাপের মাথায় বসে ছিল। উঠে আকমল হোসেনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

আব্বা। আব্বা–

মেয়ের ডাকে চমকে তাকান তিনি। তাকিয়েই থাকেন। ভাবেন, বন্দী করে রাখা কোনো মেয়ে তাকে খুঁজে ফিরছে। শয়তানগুলো যখন তাকে তুলে নিয়ে যায়, তখন তো বাবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া হয়নি। ও এখন বাবাকে ডাকছে। বাবার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে তো যাওয়া যায় না।

কিছু বলবি, মা? মন খারাপ লাগছে?

ঘরে চলেন। বাইরে আর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।

সন্ধ্যা হোক। বাইরের আলোটা খুব ভালো লাগছে রে।

আলো? আললা কোথায়, আব্বা? সন্ধ্যা হয়ে গেছে।

আলোই তো দেখছি আমি। পরদেশী যে আলো রেখে গেল আমাদের জন্য, সে আলোর কথা বলছি।

আয়শা খাতুন নিচে নেমে আসেন। গেট খুলে আলতাফ ঢোকে। মন্টুর মা দুপা এগিয়ে এলে ঘরের মানুষদের একটি দল হয়ে যায়। আকমল হোসেন আবার বলেন, পরদেশী এখনো আমাদেরকে ছেড়ে যায়নি, মা। আমি যেদিকে তাকাচ্ছি, সেদিকেই ওকে দেখতে পাচ্ছি।

আয়শা খাতুনের মনে হয়, আকমল হোসেন এখনো ঘোরের মধ্যে আছেন। তিনি দ্রুত কণ্ঠে বলেন, শোনো, পরদেশী ঠিকই চলে গেছে। এখন আমাদের অনেক কাজ।

কাজ? হ্যাঁ, অনেক কাজ। প্রথম কাজ শহীদদের জন্য মিলাদ করতে হবে। ফকির খাওয়াতে হবে। কাল একটি কুলখানির আয়োজন হবে এই বাড়িতে। আমাকে নিয়ে তোমার ভয় নেই, আশা। আমি ঠিকই আছি। চলো, ঘরে চলো।

তিনি আয়শা ও মেরিনার হাত ধরে সিঁড়িতে পা রেখে পেছনে তাকান। দেখতে পান আলতাফের হাতের দুটো বাজারের ব্যাগের একটি মন্টুর মা নিয়েছে। ওরা ঠিক তার পেছনেই আছে।

আয়শা খাতুন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলেন, আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি। তোমরা ড্রয়িংরুমে বসো।

আকমল হোসেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আলতাফকে বলেন, পুরো বাড়ির বাতিগুলো জ্বালিয়ে দে তো রে। ঘরের কোথাও কোনো অন্ধকার যেন না থাকে।

মেরিনা হেসে বলে, তাহলে মোমবাতি জ্বালাতে হবে, আব্বা। ঘরের কোনা-ঘুপচিতে মোমবাতি দিতে হবে।

হ্যাঁ, দিতে হবে। হাজার হাজার মোমবাতি–

বলতে বলতে আকমল হোসেন ড্রয়িংরুমে ঢোকেন। ফোন বাজে। তিনি দ্রুত হেঁটে গিয়ে ফোন ধরেন। মারুফের ফোন।

আব্বা, আমি কিছুক্ষণ আগে ঢাকায় এসেছি। সামনে একটি অপারেশন আছে। ধানমন্ডির ২৮ নম্বরে আছি। আগামীকাল বাড়িতে আসব। আম্মাকে সালাম দেবেন।

মেরিনা কাছে এসে দাঁড়ায়।

ভাইয়ার ফোন?

হ্যাঁ রে। ও ঢাকায় এসেছে। সামনে ওর অপারেশন আছে।

এবারও কি বাড়িতে আসবে না?

কাল আসবে বলেছে। বলেছে তো, শেষ পর্যন্ত আসতে পারবে কি না কে জানে!

ভাইয়াকে মাত্র দেড় মাস দেখিনি। অথচ মনে হয়, ভাইয়া গত দশ বছর ধরে বাড়িতে নেই।

তোর মা কী করছে? এখন তো বেশি রান্নার দরকার নেই। টেবিলে একটা কিছু দিলেই হয়। ডাল-ভাতেও আমার আপত্তি নেই।

দেখি, মা কী করছেন। রান্নাঘর নিয়ে মায়ের নানা চিন্তা থাকে।

মেরিনা চলে গেলে আকমল হোসেন সোফায় বসেন। আবার পরদেশী তাঁর মাথায় ঢোকে। পুলিশ লাইনের সুইপারদের একজন সরাসরি বলেনি, কিন্তু জানিয়ে গেল, শহীদদের তালিকা করতে হবে। স্বাধীনতার জন্য প্রাণদানকারী মেয়েরা—ওদের ইতিহাস লিখতে হবে। ওদের নামের তালিকা সংরক্ষণ করতে হবে। পরদেশী ইতিহাসের উপাদান নিয়ে এসেছে তার কাছে। স্বাধীনতার পর লিখতে হবে এই সব মেয়ের আত্মত্যাগের কথা। আকমল হোসেনের বুক চেপে আসে। তিনি সেন্টার টেবিলের ওপর যত্ন করে কাগজগুলো রাখেন। এই ঘরে সবাই এলে মেরিনাকে বলবেন জেনিফারের চিঠিটা পড়তে।

একটু পর আয়শা খাতুন সবাইকে নিয়ে প্রজ্বলিত মোম হাতে ঘরে আসেন। পুরো বাড়ির বিভিন্ন জায়গা খুঁজে পঁচিশটি মোম পাওয়া গেছে। আলতাফ দোকান থেকে নতুন মোম আনতে চেয়েছিল। আয়শা রাজি হননি। বলেছেন, আজকে ঘরের সবটুকু থেকে। এরপর ওদের স্মরণে আবার এই বাড়িতে মোম জ্বলবে। সবাই এসো আমার সঙ্গে। আজ ঘরের মোমবাতি দিয়ে স্মরণসভা।

আকমল হোসেন ওদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন। আয়শা খাতুন এমনই। রান্নার জন্য নয়, মোম জ্বালানোর জন্য রান্নাঘরে গিয়েছিলেন। কতকাল ধরে দুজনে সংসার করছেন। এভাবে আয়শা খাতুন প্রায়শ নতুন করে তোলেন সময়ের পরিধি। যে পরিধি স্মৃতির কোঠায় সঞ্চিত হয়।

তিনি মেরিনার হাত থেকে তিন-চারটে মোম নিয়ে সেন্টার টেবিলে রাখেন। সবাই তার চারপাশে গোল হয়ে বসে। মাঝখানে পরদেশীর দিয়ে যাওয়া চিঠি ও রাবেয়ার দেওয়া ছোট খাতা মোমের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে থাকে।

কিছুক্ষণ পর জেনিফারের চিঠিটা মেরিনাকে পড়তে বলেন আকমল হোসেন। ও থেমে থেমে চিঠিটা পড়ে। পড়া শেষ হলে আকমল হোসেন বলেন, আবার পড়।

মেরিনার কণ্ঠস্বর থমথম করে। কখনো ওর গলা আটকে যায়। আয়শা খাতুন গুনগুন ধ্বনিতে ভরাতে থাকেন ঘর–

শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান
সব দুর্বল সংশয় হোক অবসান

আকমল হোসেন চমকে আয়শার দিকে তাকান। বলতে চান, তুমি কি মৃত্যুর পথকে শুভ কর্মপথ বলছ? কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয় না। সুর ও বাণী এক হয়ে তীব্র হয়ে ওঠে–

চির-শক্তির নিঝর নিত্য ঝরে
লহ সে অভিষেক ললাট পরে।
তব জাগ্রত নির্মল নূতন প্রাণ
ত্যাগব্রতে নিক দীক্ষা,
বিঘ্ন হতে নিক শিক্ষা–
নিষ্ঠুর সংকট দিক সম্মান।
দুঃখই হোক তব বিত্ত মহান।“
চল যাত্রী, চল দিনরাত্রি–
কর অমৃতলোকপথ অনুসন্ধান।
জড়তাতামস হও উত্তীর্ণ,
ক্লান্তিজাল কর দীৰ্ণ বিদীর্ণ–
দিন-অন্তে অপরাজিত চিত্তে
মৃত্যুতরণ তীর্থে কর স্নান॥

মেরিনার চিঠি আর শেষ করা হয় না। ও কান পেতে গানের বাণী শোনে। আয়শা খাতুন শেষের দুটো লাইন বারবার গাইতে থাকেন–

দিন-অন্তে অপরাজিত চিত্তে
মৃত্যুতরণ তীর্থে কর স্নান॥

একসময় গুনগুন ধ্বনি থামে। আয়শা সোফায় চোখ বুজে মাথা হেলিয়ে রাখেন। মেরিনা কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আম্মা, চিঠির শেষ আপনি এভাবে বড় করে দিলেন যে, আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। আমার কাছে জেনিফারদের মৃত্যু নাই।

মেরিনা কেঁদেকেটে নিজের ঘরে চলে যায়। ও চলে গেলেও আকমল হোসেন ও আয়শা খাতুনের মনে হয়, ঘর খালি হয়নি। মেরিনা জেনিফারদের মৃত্যু নেই বলার পরপরই ঘরে একজন ঢুকছে ও বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘরের যেদিকে তাকায় তাদের মনে হয় সব জায়গায় কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কোনো শূন্যতা নেই।

আকমল হোসেন আয়শার হাত ধরে বলেন, এসো। নিজেদের ঘরে যাই।

চলো। আয়শা আকমল হোসেনের হাত ধরেন। ধরেই থাকেন। ছাড়েন না। যেন গভীর উষ্ণতা ছড়িয়ে দিতে চান আকমল হোসেনের শরীরের সর্বত্র। যৌবনের উষ্ণতা নয়। এক অন্য রকম উষ্ণতা এই পঞ্চাশোর্ধ্ব জীবনের, যে উষ্ণতার তল খুঁজে পাওয়া কঠিন। আকমল হোসেন সেই উষ্ণতায় অভিভূত হয়ে নিজের হাতটি তার ডান হাতের ওপর রাখেন, যে হাত আয়শা ধরে আছেন। গভীর কণ্ঠস্বরে বলেন, আয়শা, আমাদের শেষ জীবনটুকু এভাবেই পার হবে। পরস্পরের এমন নিবিড় মগ্নতায়।

হ্যাঁ, তাই। এখনই তার যাত্রা শুরু।

আয়শা টেবিলের মাঝখান থেকে চিঠি আর ছোট খাতা উঠিয়ে নিয়ে বলেন, লেখার কাজ কি এখনই গোছাবে? এখনই গোছাতে শুরু করো। সময় নষ্ট করা উচিত নয়। আমরা নিজেরাই বা কয়দিন বাঁচব।

ইতিহাস অনেক কঠিন, আয়শা। এখনই ধরব না। এখন আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে রেখে এই গানটি আবার শুনব। শেষ দুই লাইন তোমার সঙ্গে আমি গাইব।

আয়শা খাতুন একসঙ্গে হাত ধরে শোবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে গাইতে শুরু করেন শেষ থেকে–

দিন-অন্তে অপরাজিত চিত্তে
মৃত্যুতরণ তীর্থে কর স্নান॥

আকমল হোসেন সুরের কথা মনে রাখেন না। আয়শার সঙ্গে গাইতে থাকেন। তিনি জানেন, তিনি গায়ক নন। তিনি ওস্তাদের কাছে গান শেখেননি। কিন্তু তাঁর কাছে এক অলৌকিক আবেগ। এই একই আবেগ দিয়ে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনেন। বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসা যুদ্ধের খবর সুরের মতো পূর্ণ করে তার ভেতরের সবটুকু। একসময় তিনি টের পান, আয়শা থেমে গেছেন। গাইছেন তিনি একা। তার বুকের ভেতর মুখ গুঁজে রাখা আয়শার মাথার ওপর নিজের থুতনি ঠেকিয়ে তার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে শব্দরাজি–

নিষ্ঠুর সংকট দিক সম্মান।
দুঃখই হোক তব বিত্ত মহান…কর অমৃতলোকপথ অনুসন্ধান…
মৃত্যুতরণ তীর্থে কর স্নান॥

আকমল হোসেনের গান থামলে আয়শা মৃদুস্বরে বলেন, আমাদেরই বুকের ভেতরের গান। আমাদের সময়। আমাদের জীবন। আমি চিৎকার করে বলতে চাই, এই গান রবীন্দ্রনাথ লেখেননি। হাজার বছর ধরে এই গান আমাদের বুকের ভেতরেই ছিল। এখন সময় হয়েছে বুক উজাড় করে গাইবার।

আকমল হোসেন দুহাতে আয়শাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, এই গানে শহীদদের স্মরণ করলে। তোমাকে আমার বুকভরা ভালোবাসা। আমরা চিরকাল আমাদের শহীদদের স্মরণ করব।

আয়শা কথা বলতে পারেন না। চোখের জল মোছেন না। গাল বেয়ে গড়াতে দেন। সেই জল মুছে যায় আকমল হোসেনের গায়ের জামায়। তারপর সেটা ঢুকে যায় বুকের ভেতরে। দুজনেই অনুভব করে যে বড় কঠিন এই বেঁচে থাকা। আর কতটা পথ একসঙ্গে যাবেন, কেউ তা বলতে পারে না।

 

টানা বৃষ্টিতে বাড়ির সামনে পানি জমে গেছে। ভোর থেকে একটানা ঝরছে। এমন বৃষ্টি কখন শুরু হয়েছে, তা টের পাননি আকমল হোসেন। আয়শা খাতুনও। বোঝা যায়, শেষ রাতের দিকে দুজনেরই গাঢ় ঘুম হয়েছিল।

এখন তাঁরা বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছেন। দুজনই প্রবল বৃষ্টি উপভোগ করেন। আকমল হোসেন বলেন, এ বছরের বৃষ্টি আমাদের পক্ষে। আজ যে বৃষ্টি দেখছি, এটা শুধু বৃষ্টি দেখার আনন্দ না, যুদ্ধে জেতার আনন্দও। পাকিস্তানি সৈনিকেরা পাহাড় আর শুকনো মাটির দেশের লোক। ওদের মরুভূমিও আছে। বৃষ্টি ওদের আতঙ্ক, আয়শা। আমাদের মতো বৃষ্টিপাগল লোক না ওরা।

ঠিক বলেছ। পাকিস্তানি সেনারা তো বৃষ্টির মেজাজ বোঝে না। বৃষ্টিকে আপন করতেও জানে না। বৃষ্টি ওদের জন্য বাধা। আমাদের জন্য সহায়ক। এই বৃষ্টির সহায়তায় আমরা এগিয়ে যেতে পারব।

দুজন হঠাৎ করেই চুপ করে যায়। ঘুম ভাঙার পর থেকেই দুজন বারান্দায়। বাড়িটা এ মুহূর্তে সুনসান।

এ বাড়ির আরও চারজন বাসিন্দা এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। গত রাতে মারুফ বাড়িতে এসেছে। ঢাকায় ঢুকেছে এক দিন আগে। বিভিন্ন হাইডে ছিল। এটি গেরিলাযুদ্ধের কৌশল। এভাবে যুদ্ধের সময়কে মানতে হয়। নিয়মমাফিক যেটুকু ঘটবে, সেটুকুকেই মানতে হবে। বাড়াবাড়ি চলবে না। কম করাও চলবে না।

আয়শা খাতুন উঠতে উঠতে বলেন, দেখি, ছেলেটা ঘুম থেকে উঠল কি। ও তো এক দিনের বেশি থাকবে না।

আকমল হোসেন আয়শা খাতুনকে বাধা দিয়ে বলেন, ওকে ঘুমাতে দাও। এই বৃষ্টিভেজা সকালে ঘুমের আলাদা মজা আছে।

ঘুমের মধ্যে কি মজা উপভোগ হয়?

হয়, আশা। ঘুম ভাঙলে ও গাঢ় ঘুমের আনন্দ টের পাবে। তা ছাড়া ওর বোধ হয় ঘুম দরকার ছিল। দেখলে না, কালকে বাড়িতে এসেই ঘুমোতে চাইল। আমাদের সঙ্গে খুব একটা কথা না বলে সোজা চলে গেল নিজের ঘরে। কোনো কারণে ও হয়তো টায়ার্ড ছিল।

আয়শা শ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, কত দিন পরে ফিরল, কিন্তু আমাদের সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলল না।

তুমি মন খারাপ করেছ?

একটু তো মন খারাপ হয়েছেই।

ছেলেমানুষি। ভুলে যাও কেন যে আমরা যুদ্ধের সময়ে আছি! তুমি মন খারাপ করতে পারো না, আশা। তুমি মন খারাপ করলে আমারও মন খারাপ হবে।

বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসের বড় ঝাপটা আসে। দুজনের গায়েই বৃষ্টি লাগে। আয়শা খাতুন হাত উঠিয়ে মুখ মোছেন। আর আকমল হোসেন মাথা ঘুরিয়ে ঘাড়ের কাছে জামার কলারে মুখ ঘষে নেন।

গত রাত ১০টার দিকে বাড়ি ফিরে মারুফ সোজাসুজি আকমল হোসেনের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, আব্বা, কাল সকালে কথা বলব। মাকে বলল, আমি ঘুমাব, আম্মা। কেউ ডাকবে না আমাকে।

খাবি না? খিদে পায়নি? এক গ্লাস পানি তো খাবি?

না আম্মা, এখন কিছু খাব না। পানিও না। পেটে যা আছে, তাতে রাত চলে যাবে।

আয়শা খাতুন ছেলের কথা আর না ভাবার জন্য আকমল হোসেনকে বললেন, তুমি চা খাবে?

না। দরকার নেই। একবারে নাশতা খাব। তোমার সঙ্গে একটা বিষয় আমার আলাপ করা দরকার, আশা। কাল আমি বিষয়টি তোমাদের বলিনি। আমার খুব মন খারাপ ছিল।

কী ব্যাপার, বলো তো?

আয়শা খাতুন ভুরু কুঁচকে তাকান। পঁচিশের রাতের পর থেকে আকমল হোসেন নিজে নিজে মনে রেখেছেন এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। সব ঘটনাই তো দুজনের জানা আছে। এখন কী হলো? নতুন কিছু? তাই হবে হয়তো।

তিনি সামনে তাকিয়ে বললেন, পরদেশী যে মেয়েটির চিঠি দিয়ে গেছে, ওকে আমি দেখিনি। কিন্তু ওর ভাই শাকেরকে মারুফ চেনে! এমন একটি সূত্র আমার মনে হচ্ছে। চিঠির বর্ণনা থেকে এটা আমার মনে হয়েছে।

মারুফের বন্ধু? তুমি কি ওকে দেখেছ?

না, আমি ওকে দেখিনি। ও মারুফের ঠিক বন্ধু নয়, ওর পরিচিত। একসঙ্গে রাজপথে ছিল। মিছিলে ছিল। ২৭ তারিখে কারফিউ ভাঙলে আমি আর মারুফ ওই বাসায় গিয়েছিলাম। মারুফ বলেছিল, শাকেরের কাছে ওর কী একটা দরকার আছে। গিয়ে যা দেখেছিলাম, তা তোমাকে বলেছিলাম, আশা। তোমার বোধ হয় মনে আছে, আশা। জেনিফারের চিঠিটা পড়ে আমি বুঝতে পারছি, ও ওই পরিবারের মেয়ে হতে পারে। বর্ণনায় তেমন আভাস পাচ্ছি। মারুফকে জিজ্ঞেস করলে ও বলতে পারবে। মেয়েটিও মিছিলমিটিংয়ে যেত। নিশ্চয় মারুফের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এই খবরটি কি মারুফকে দেওয়া ঠিক হবে?

না, এই মুহূর্তে একদমই না। সামনে ওরা অপারেশন করবে। ওদের এখন পিসফুল থাকা খুব দরকার।

আমিও ভাবছি যে জেবুন্নেসার চিঠিও ওকে এখন দেওয়ার দরকার নেই।

না, দরকার নেই। সময় বুঝে বিষয়টি ওকে জানাতে হবে।

 

দুজন হঠাৎ করে চুপ করে যান। মনে হয়, এখন আর তাঁদের জন্য কোনো কথা নেই। থেমে গেছে কোলাহল। জেনিফার নতুন করে উঠে এসেছে ওদের সামনে। বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। জেনিফার আর ইহজগতের কথার মধ্যে নেই। ওকে অনুভব করার জন্য এখন নীরবতাই শ্রেষ্ঠ সময়।

 

বৃষ্টি ধরে এসেছে।

আলতাফ উঠেছে। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে ছাতা নিয়ে জমে থাকা পানির মধ্যে হাঁটাহাঁটি করছে। বাতাসে উড়ে আসা পাতা কুড়িয়ে জড়ো করছে। বৃষ্টি ও জমে থাকা পানির মধ্যে কাজ করছে এমন একটি লোককে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় আকমল হোসেনের। ভাবে, ও বুঝি জেনিফারের অন্য আদল। নিঃশব্দ কর্মরত মানুষেরা এখন জেনিফারের অনুভবে ভাসিয়ে দেবে প্রান্তর। শহীদের আত্মা মুক্তিযুদ্ধের সময় যোদ্ধাদের কাছেই থাকবে। যেকোনো আদলে হোক না কেন, হবেই। একের মধ্যে বহুর প্রবেশ ঘটতে থাকবে অনবরত। একই রকম কাছাকাছি ভাবনা আয়শার ভেতরও ঘুরপাক খায়। মন্টুর মা উঠেছে। সামনে এসে একবার দেখা দিয়ে চলে গেছে। রান্নাঘরে রুটি বানানোর তোড়জোড় করছে। একসময় মেরিনা পেছনে দাঁড়িয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।

আপনারা বুঝি অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টি দেখছেন, আম্মা? আমাকে ডাকলেন না কেন? আমি এমন সুন্দর বৃষ্টি মিস করলাম।

আবার দেখতে পাবি। মনে হচ্ছে, এবারের বর্ষা আমাদের ঢেলে বৃষ্টি দেবে।

ঠিক আছে, বৃষ্টি পাইনি, কিন্তু বৃষ্টির জমানো পানি তো পেলাম। যাই, হেঁটে আসি।

মেরিনা স্যান্ডেল খুলে রেখে প্রাঙ্গণে নেমে যায়। দুই পায়ে পানি ছিটায়। ছোটাছুটি করে। কাপড় ভেজে, চোখমুখ চুল ভেজে কিন্তু ভ্রুক্ষেপ করে না। ওকে এই অবস্থায় দেখে আকমল হোসেন এবং আয়শা খাতুন একসঙ্গে ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠেন। ভাবেন, মেরিনা নয়, ওখানে জেনিফার দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু পরস্পর কাউকে কিছু বলে না। ভাবে, বুকের ভেতরের কথা ভেতরেই থাক। ওখান থেকে চেঁচিয়ে মেরিনা জিজ্ঞেস করে, আম্মা, ভাইয়া উঠেছে?

ওঠেনি। জেগে শুয়ে আছে কি না, তা তো জানি না।

কাল রাতে ভাইয়া আমার সঙ্গে কথা বলেনি। ভাবখানা এমন করেছে, যেন আমার সঙ্গে আড়ি আছে। এমন ব্যবহার করলে আমিও নিজের ঘরের দরজা আটকে বসে থাকব। কেউ কারও চেহারা দেখব না।

বারান্দা থেকে ওর এ কথায় মা-বাবা কেউই সাড়া দেয় না। মেরিনা আবার বলে, আমি বুঝলাম না যে ভাইয়ার কী হয়েছে। বাড়িতে এসেই নিজের ঘরে ঢুকতে চাইল কেন। জেবুন্নেসার কোনো খবর ওর কানে পৌঁছায়নি তো? কে জানে! মেরিনা হাত উল্টে আবার পানি ছিটাতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পানিতে খেলে বারান্দায় উঠে আকমল হোসেনকে জিজ্ঞেস করে, আব্বা, জেবুন্নেসার কথা কি ভাইয়াকে বলব?

না, মা। ওকে এখন মানসিকভাবে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না। আমিও তা-ই ভাবছি। ঠিক আছে, পরের বার এলে কথাটা বলা যায় কি না, তা-ও আমাদের ভেবে দেখতে হবে।

আমি দেখি তো ছেলেটি উঠল কি না। আয়শা খাতুন বারান্দা ছেড়ে করিডর পার হয়ে নিঃশব্দে মারুফের ঘরে ঢুকলেন। দেখলেন, মারুফ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মায়ের পায়ের শব্দ ওর ঘুম ভাঙাতে পারেনি। সে জন্য তিনি আর ওকে ডাকলেন না। বেরিয়ে এসে মেরিনাকে বললেন, ও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমি ডাকিনি।

আকমল হোসেন মেরিনার দিকে তাকিয়ে বললেন, না ডেকে ভালোই করেছে রে তোর মা। তুই ভিজে আছিস। কাপড় বদলে ফেল। ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।

 

ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁই-ছুঁই। মারুফ এখনো ডাইনিং টেবিলে আসেনি। হয়তো গোসল করছে কিংবা ঘুমিয়েই আছে। কে জানে!

আয়শা খাতুন নাশতার টেবিলে গালে হাত দিয়ে বসে থাকেন! ফ্রিজ থেকে নানা খাবার বের করে টেবিলে দিয়েছেন। শুধু পরোটা বানিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি ভাঁজতে নিষেধ করেছেন। এখন ছেলের জন্য অপেক্ষার পালা। ভালোই লাগছে অপেক্ষা করতে। যেমন অপেক্ষা করেছিলেন ওর জন্মের। গর্ভের নয় মাস অপেক্ষার প্রহর গোনা। এখন একটি নতুন জন্মের অপেক্ষা তাঁর সামনে। স্বাধীন দেশ। সেই ছেলেটি সেই মেয়েটি একই জন্মের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে। জীবন বাজি রেখে যুক্ত করা। আহ্, কী আনন্দ! আয়শা খাতুন শুনতে পান বুকের ভেতর গুনগুন ধ্বনি। তবে সেটা এই মুহূর্তে মুখে আসে না।

আকমল হোসেন নিজের ঘরের টেবিলে কাজ করছেন। পরদেশীর দিয়ে যাওয়া খাতা থেকে নিজের ডায়েরিতে মেয়েদের নামের তালিকা লিখে রাখছেন। বেশ সময় নিয়ে নামগুলো লেখেন তিনি। একটি নাম লিখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন নামটির দিকে। তারপর আরেকটি লেখেন। এভাবে অনেকটা সময় কেটে যায় তার। নিজের সময়ের পেছন দিকে তাকান, পরমুহূর্তে সামনের দিকে। হিসাব মেলান। দেখতে পান সময়ের যোগফল মিলে যাচ্ছে। দুয়ে-দুয়ে চার হচ্ছে। একসময় শেষ হয় নাম লেখা। তিনি জেনিফারের চিঠিটা ডায়েরির এক পৃষ্ঠায় পিন দিয়ে গেঁথে রাখেন। কিন্তু চিঠিটা দ্বিতীয়বার পড়ার সাহস হয় না তার। কেমন করে পড়বেন? তছনছ হয়ে যাওয়া ঘরে দুটো শিশুসহ দুজন মানুষের লাশ তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সেটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে প্রথম একটি রক্তাক্ত দুর্গবাড়ি দেখার অভিজ্ঞতা। আকমল হোসেন চেয়ারে মাথা হেলিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকেন।

তারপর নতুন একটা কাগজ টেনে উলন-বাড্ডা আর গুলবাগের ম্যাপ আঁকেন। যুদ্ধের পর থেকে এলাকার মানচিত্র আঁকা তার প্রিয় অভ্যাস হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহরে তাঁর জন্ম। এই শহরে বেড়ে ওঠা। শহরটা দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন। তিনি বলেন, এই শহরের হেন এলাকা নেই, যেখানে আমি যাইনি। শহরটা যতটুকু তার সবটুকুতে আমার পায়ের চিহ্ন আছে। ছোটবেলায় যেতেন বাবার সঙ্গে। বড় হয়ে খুঁজে দেখেছেন ছোট ছোট এলাকা। যেখানে অনেকেই যেত না। তিনি কখনো গেছেন বন্ধুদের নিয়ে, কখনো ঘুরেছেন একা একা। ফুল, পাখি, পোকামাকড়, গাছগাছালিও দেখেছেন অনেক। নাম জানতেন না। দেখাটাই আনন্দ ছিল। এখন দেখাটা প্রয়োজন। জীবনযুদ্ধের পথচলার জন্য চারপাশ দেখা। গতকাল ইঞ্জিনিয়ার নজরুল এসেছিল। ভগবতী চ্যাটার্জি লেনে থাকে। এবাড়ি-ওবাড়ি পায়ে হাঁটার দূরত্ব। নজরুল বলেছে, পরবর্তী অপারেশন পাওয়ার স্টেশন। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে আক্রমণ চালাবে। একই সঙ্গে। তিনি রাস্তা, গাছ, ব্রিজ ইত্যাদির মধ্যে পাওয়ার স্টেশন দুটোর অবস্থান তৈরি করেন। উলন-বাজ্ঞার কাছাকাছি রামপুরা টেলিভিশন সেন্টার। ওখানে বড় রকমের পুলিশি পাহারা আছে। এই জায়গাটা ছেলেদের জন্য খানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সে রকম বিপদ দেখলে ওরা বিল সাঁতরে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিতে পারবে। এটাই বড় ধরনের ভরসার জায়গা। অনায়াসে সরে যাওয়ার পথ। তিনি বেশ স্বস্তি বোধ করেন। পুরো লোকেশন এঁকে আকমল হোসেন খুশি হয়ে যান। গেরিলারা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটানোর পরে বিদেশি পত্রিকায় এ ঘটনার খবর ছাপা হয়েছিল। ওরা লিখেছিল, ইট শোজ দ্যাট দ্য গেরিলাস ক্যান মুভ অ্যাট ঢাকা সিটি অ্যাট দেয়ার উইল।

তিনি চেয়ারে মাথা হেলিয়ে আবার চোখ বোজেন। এই ভঙ্গিতে তিনি শুধু নিজেকে শান্তই করেন না, ভবিষ্যতের চিন্তাও করতে পারেন। মাথা হেলিয়ে দিলে মাথার মধ্যে নানা ভাবনা কাজ করে। দেখতে পান, সময় কত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। পঁচিশের রাতে গণহত্যা শুরুর পরে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে লুকিয়ে থাকা সাংবাদিক সাইমন ড্রিং তার রিপোর্টে লিখেছিলেন, ভোরের কিছু আগে গুলিবর্ষণ থেমে গেল এবং সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এক ভীতিজনক নিঃশব্দতা শহরের ওপর চেপে বসল। ফিরে আসা দু-তিনটি ট্যাঙ্কের শব্দ, মাঝেমধ্যে কনভয়ের শব্দ ও কাকের চিৎকার ছাড়া সম্পূর্ণ শহর মনে হচ্ছিল পরিত্যক্ত এবং মৃত।

আকমল হোসেন শব্দ করে হাসলেন। নিজেকেই বললেন, এখন এই শহর কোলাহলে মুখর। গেরিলাদের পদচারণে জীবন পূর্ণ। এই শহরের অনেক বাড়ি দুর্গের ভূমিকা পালন করছে। যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করছে মানুষ। মানুষের হাতে অস্ত্র উঠেছে, পাশাপাশি মানুষের সাহস আছে, শরীর আছে, ত্যাগের মনোবল আছে। এ শহরে এখন কোনো কিছুরই অভাব নেই। শহর তার নতুন জীবন নিয়ে পূর্ণ শক্তিতে জেগে উঠেছে। একদিন এই শহরের বুনো ঝোপে লজ্জাবতী লতা পায়ে লেগে ফুলগুলো বুজে গেলে তিনি অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কৈশোরের সেই দিনে বুনো ঝোপের সামনে বসে থেকে তিনি অপেক্ষা করেছিলেন ফুলের জেগে ওঠা দেখার জন্য। দুঃখ হয়েছিল এই ভেবে যে কেন তাঁর পা ওখানে গিয়ে লাগল। কিন্তু সেদিন ওখানে অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও ফুলের জেগে ওঠা দেখতে পাননি। মন খারাপ করে ফিরে এসেছিলেন। মাকে ঘটনাটা বলার পর মা বলেছিলেন, বোকা ছেলে, মন খারাপ করবি না। এভাবে শিখতে হয়। শিখতে শিখতে বড় হতে হয়। যা, পুকুরে সাঁতার দিয়ে গোসল করে আয়। দেখবি সবকিছু ভালো লাগছে।

কৈশোরের পর পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। মায়ের কথা মনে হয়, দেখতে দেখতে শিখবি। হ্যাঁ, এখনো তার শেখার বয়স পার হয়নি। এখনো তিনি শিখছেন। এখন তাকে শেখাচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। কেমন করে ছেলেরা মেয়েরা এক হয়ে লড়ছে।

তখন মারুফ ও মেরিনার কণ্ঠস্বর শুনতে পান তিনি। বুঝতে পারেন, মারুফের ঘুম ভেঙেছে। মেরিনা ঠিকই ভাইয়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। ভাবলেন, মেরিনা যতই রাগ ঝাড়ুক, ভাইবোনের এই মধুর সম্পর্ক থেকে কেউ কাউকে আড়ালে রাখতে পারবে না। তিনি আবার নিজের কাজে মনোযোগী হলেন।

তখন মারুফের ঘরে দরজায় দাঁড়িয়ে মেরিনা দেখতে পায়, মারুফ বিছানায় বসে আড়মোড়া ভাঙছে। ওকে দেখে বলে, আয়।

মেরিনা হইচই করে কথা বলে, বাড়িতে এসে সবাইকে কষ্ট দিয়েছ। নাক ডেকে ঘুমিয়েছ। আবার হাসছ? নাহ্, তোমার এই আচরণের সঙ্গে গেরিলাযোদ্ধার আচরণ মেলাতে পারছি না। তুমি আমার অলস ভাইয়া। কী, ঠিক বলেছি?

একদম ঠিক। এক শ ভাগ ঠিক। তোর সঙ্গে আমি কথার যুদ্ধ চালাতে চাই। আম্মা কী করছে রে?

ডাইনিং টেবিলে বসে তোমার নাশতা পাহারা দিচ্ছেন। আর একমাত্র ছেলেটিকে নিয়ে ব্যাকুল হয়ে ভাবছেন। আকাশ-পাতাল ভাবনা যাকে বলে, তা-ই।

আহা রে, আমার সোনার মা—

মারুফ এক লাফে বাথরুমে যায়। দরজা বন্ধ করতে করতে বলে, তুই আম্মার কাছে যা। আমি আসছি। আব্বাকেও ডাকিস।

দেরি করবি না কিন্তু। মুখ ধুবি আর বের হবি।

নাশতার টেবিলে বসে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাধীর ভঙ্গিতে হাসে মারুফ। একটু করে পরোটা আর ডিম মুখে পুরতে পুরতে বলে, কাল আমাদের উলন আর গুলবাগের পাওয়ার স্টেশন রেকি করার সময় প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে। রোদে-গরমে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। কাল তো এমন বৃষ্টি ছিল না। শহরজুড়ে ভাপসা গরম ছিল। রোদের তাপও খুব বেশি ছিল।

আকমল হোসেন মৃদু হেসে বলেন, তুই কাকে কৈফিয়ত দিচ্ছিস? আমরা কি তোকে জিজ্ঞেস করেছি? নাকি তোর কৈফিয়তের অপেক্ষায় আছি। তুই বাড়িতে এসেছিস, এতেই আমরা খুশি।

অপরাধ নিজের মনের মধ্যে, আব্বা। মারুফ মুখ নিচু করে বলে, কাল আসলে আমি ঠিক আচরণ করিনি। আমার আরেকটু ধৈর্য দেখানো দরকার ছিল। বিশেষ করে মেরিনার সঙ্গে তো বটেই।

তারপর ঘাড় নিচু করে গ্লাসের জুস শেষ করে। মৃদু স্বরে বলে, বাড়ির যত্নে আমার শুধু ঘুম পায়।

হাসির রোল ওঠে টেবিলে। আয়শা খাতুন হাসতে হাসতে বলেন, আমরা কি তোকে আদর দিয়ে বোকা বানিয়ে ফেলেছি? তুই আজ কেমন করে যেন কথা বলছিস, তা আমি বুঝতে পারছি না রে।

মেরিনা হাসতে হাসতে বলে, বোকা না, আম্মা, আদুরে বানিয়েছেন। বেশ কিছুদিন পরে বাড়ি ফিরে ও ঢংঢং করছে, যেন একটা বাচ্চা শালিক পাখি। ভাবখানা এমন, যেন কতকাল মায়ের আদর পায়নি।

মারুফ থমকে গিয়ে সবার মুখের দিকে তাকায়। সবার দৃষ্টি ওর মুখের ওপর। ও গম্ভীর স্বরে বলে, কাল যখন বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ালাম, আমার মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন কী ভেঙে পড়েছে। অথচ কোনো কিছু দেখতে পাচ্ছি না আমি। ভয়ে-আতঙ্কে আমি চারদিকে তাকাই। অনুভব করি, সেই ধ্বংসস্থূপে আটকা পড়েছি আমি। আমার ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করে। আমার শরীর ভেঙে আসে। অন্য সময় সারা দিন কত কাজ করেও আমার এমন খারাপ লাগেনি। আমি বলতে পারব না, আমার কী হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, আমার আশ্রয় দরকার। ঘুম আমার সেই আশ্রয় ছিল। কখন ঘুম ভাঙল, আমি টেরও পাইনি। কেবলই মনে হচ্ছিল, সকাল হয় না কেন। সময় এমন আটকে আছে কেন!

ও আবার মুখ নিচু করে বাটির ফিরনি খায়। একটানে খেয়ে সবটুকু ফিরনি শেষ করে।

আকমল হোসেন অন্যদের সঙ্গে চোখাচোখি করেন। মেরিনা বুঝতে পারে, ওর গলার কাছে কিছু একটা আটকে গেল। ও জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। আয়শা খাতুন নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ঠিকমতো ঘুমোতে পেরেছিলি তো?

হ্যাঁ, আম্মা। বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমে তলিয়ে গেলাম। আর কিছু বলতে পারব না। কোনো স্বপ্নও দেখিনি। ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আপনার কথা মনে হয়েছিল। ভেবেছিলাম, মায়ের দোয়ায় আমি একটা বিপদ কাটিয়েছি। কী ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছিলাম, তা আমি জানি না। ঘুম ভাঙার পরে নিজে নিজেই খুব আশ্চর্য হয়েছি।

ঠিক আছে, এসব কথা থাক। ঢাকায় এসে কোথায় ছিলি, বল তো? দুৰ্গটা তো আমার চিনতে হবে। দরকারমতো যাওয়া-আসা করতে হবে। খোঁজখবর রাখতে হবে।

আমরা একটু পরে বের হয়ে এলাকাটা ঘুরে আসতে পারি, আব্বা?

না, আমি বের হয়ে উলন-গুলবাগ ওই দিকে যাব। আলতাফ যাবে আমার সঙ্গে। ইঞ্জিনিয়ার নজরুল আসবে। তুই ওর সঙ্গে কথা বলবি। এখন বল, তোর দুর্গের কথা। আমি নিজে নিজেই এলাকাটা ঘুরে আসব।

দুদিন আমি ছিলাম ধানমন্ডি ২৮ নম্বরে। ওটা বেশ বড় একটা বাড়ি। আপাতত খালি পড়ে আছে। দুজন দারোয়ান আছে বাড়ির পাহারায়।

আকমল হোসেন ভুরু কুঁচকে বলেন, মনে হচ্ছে, বাড়িটা আমি চিনি। তোরা যখন সাংকেতিক ভাষায় বলিস আটাশে, সেটা শুনে আমি গিয়েছিলাম রাস্তা দেখতে। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, বাড়িটা খালি আছে। আটাশে ঢুকে হাতের ডানের ৩ নম্বর বাড়িটা তো?

হ্যাঁ, আব্বা। ওই বাড়িটাই। ওটা একটা ওষুধ কোম্পানির কাছে ভাড়া দেওয়া ছিল। কোম্পানির ফিল্ড ম্যানেজার আমাদের গেরিলা বন্ধু। ওই বড় বাড়িটাকে গেরিলাদের আশ্রয়স্থল বানানো হয়। অবশ্য বাড়িটার চেহারা আড়াল করার জন্য ওই ওষুধ কোম্পানির একটা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বেশ করেছিস তোরা। আকমল হোসেন ঘন ঘন মাথা নাড়েন। আয়শা ভুরু কুঁচকে বলেন, ওই বাড়িতে খাওয়াদাওয়া নেই, বুঝতে পারছি। তুই যে খেলি না রাতে?

আমার খাওয়ার কথা মনে ছিল না, আম্মা। এই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমি সবকিছু ভুলে যাচ্ছিলাম।

আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। তুই আটাশের কথা বল।

আকমল হোসেন প্রসঙ্গ ঘোরানোর চেষ্টা করেন। মারুফ বাবার দিকে একমুহূর্ত তাকায়। হঠাৎ মনে হয়, এই বাড়ির সঙ্গে আজ থেকে বোধ হয় একটি মিসিং লিংক তৈরি হয়েছে। ও যা ধরতে পারছে না, তার সূত্র এই পরিবারের সবার কাছে একটি গোপন কৌটায় আছে। কেউ তা প্রকাশ করছে না।

মেরিনা তাগাদা দিয়ে বলে, হাঁ করে আছ কেন? তোমাদের দুর্গের কথা বলো।

বাড়িটি বেশ বড়। সামনে একটা বাগান আছে। বাগানের গাছগুলো বেশ বড় বলে একতলা বাড়িটা খুব ছায়াচ্ছন্ন। বলা যায়, বাড়িটার একটা স্নিগ্ধ জলে ভাব আছে। গেরিলারা অনবরত এই বাড়িতে যাতায়াত করে বলে ওই গাছের আড়াল বেশ সুবিধাজনক। তা ছাড়া বাড়িটার আরেকটা দিক হলো, গাড়ি নিয়ে চট করে ঢোকা যায়, চট করে বের হওয়া যায়। সবচেয়ে বড় দিক হলো, বাড়িটার মেঝে মাটি থেকে এক ফুট উঁচুতে। সে জন্য অস্ত্র লুকিয়ে রাখা খুব সুবিধাজনক। যে কেউ অনায়াসে বুঝতে পারবে না যে এই মেঝের নিচে অস্ত্র লুকিয়ে রাখা আছে।

শাকেরের সঙ্গে তোর কি আগরতলা বা মেলাঘরে দেখা হয়েছে?

একদিন দেখা হয়েছিল, আব্বা। ও সরাসরি যুদ্ধ করার জন্য ৩ নম্বর সেক্টরে যোগ দিয়েছিল। ও ত্রিপুরার উষাবাজার শরণার্থী ক্যাম্পে প্রথমে ছিল। পরে শিমলাতে যায়। শিমলা ৩ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। এর পরে ওর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। আপনার ওর কথা মনে হলো কেন, আব্বা?

খুব সাহসী ছেলে ছিল। কোনো কারণ নেই। এমনিই মনে হয়েছে।

বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মারুফের মনে হয়, আবার একটা মিসিং লিংক ও অনুভব করছে। এবার বাড়িতে আসার পর এমনই মনে হচ্ছে বারবার। আগে কখনো এমন হয়নি। তাহলে কি ওর অবর্তমানে এ বাড়িতে একটা কিছু ঘটেছে, যার সূত্র ওর সামনে কেউ বলতে চাইছে না। ও বিষয়টা নিয়ে নিশ্চিত হয়ে যায়।

ও ড্রয়িংরুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েও যায় না। টেবিলের কোনায় হাত রেখে বলে, আব্বা, শাকেরের বাড়িতে সেদিন আমরা ওর বাবা-মা ও ভাইদের লাশ দেখেছিলাম। জেনিফারের লাশ দেখিনি। তাহলে কি আর্মি জেনিফারকে নিয়ে গিয়েছিল?

এসব আমরা অনুমান করতে পারি, কিন্তু নিশ্চিত হতে পারি না।

তা ঠিক। তবে জেনিফার হয়তো শাকেরের সঙ্গে অন্য কোথাও সরে যেতে পারে। সন্ধ্যারাতেই।

আকমল হোসেন কথা বলেন না। আয়শা আগেই রান্নাঘরে গিয়েছিলেন। কী রান্না হবে, খোঁজখবর করছেন। মেরিনা কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে যায়। একটু পর মারুফ ওর ঘরে গিয়ে ঢোকে।

সরাসরি মেরিনাকে জিজ্ঞেস করে, যখন আমি ছিলাম না, তখন কি বাড়িতে কিছু ঘটেছিল, মেরিনা?

কী ঘটতে পারে, সেটা তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো। অন্য কিছু না?

বাব্বা, দারোগাগিরি দেখাচ্ছিস নাকি? তোকে দেখে মনে হচ্ছে তোর বয়স বেড়েছে। গম্ভীর হয়ে গেছিস।

তখন আলতাফ এসে খবর দেয় যে ফয়সল আর মানিক এসেছে।

চলো, ভাইয়া। ওরা নিশ্চয় পত্রিকাটা এনেছে। পত্রিকা?

গেরিলা নামে ওরা একটা পত্রিকা সাইক্লোস্টাইল করে বের করছে। চলো দেখি।

দুজনে ড্রয়িংরুমে আসে। আকমল হোসেন ওদের সঙ্গে কথা বলছেন।

বাহ্, সুন্দর হয়েছে। কাজে লাগবে। জায়গামতো ডিস্ট্রিবিউট করতে হবে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়।

মেরিনা আপার জন্য পঁচিশ কপি এনেছি।

মারুফ পত্রিকা হাতে নিয়ে পাতা উল্টে দেখে বলে, এটার খুব দরকার ছিল। আমি কয়েকটা কপি নিয়ে যাব। আগরতলায় বিলি করব।

মেরিনা খুশি হয়ে বলে, পত্রিকা বিলির কাজটা পেয়ে আমার ভালো লাগছে। পঁচিশ কপি বিলি করতে আমার তিন দিন লাগবে।

কাগজ বিলি করার সময় রেশমাকে তোর সঙ্গে নিস। ও বেশ চটপটে মেয়ে। কাজও করতে চায়।

তা নিতে পারি। ও বলেছে, যেকোনো কাজ পেলে করবে। ওকে যেন আমি সঙ্গে রাখি। আমি আজই ওদের বাড়িতে যাব।

আয়শা খাতুন ছেলেদের জন্য চা-পুডিং পাঠান। বাড়িতে কোনো যোদ্ধা ছেলে এলেই তার যত্ন থেকে কেউ বাদ পড়ে না। বলেন, ওদের কিছু না খাওয়ালে আমি শান্তি পাই না। ওরা মাথার ওপর মৃত্যু নিয়ে ঘোরে।

আকমল হোসেন ওদের চা-খাওয়ার কথা বলেন। ওদের বসিয়ে রেখে নিজে বের হন। যাবেন রামপুরা, গুলবাগ, উলন এলাকায়। যুদ্ধের আগে তিনি রামপুরা-উলন এলাকায় যেতেন। ব্রিজের কাছে গাড়ি রেখে নৌকা নিয়ে ঘুরতে যেতেন বিলে। বিলের লতাগুল্ম, সাদা-গোলাপি রঙের শাপলা, স্বচ্ছ পানিতে মাছেদের ঘোরাফেরা, নির্মল বাতাস, দূরের গাছপালা-ঘরবাড়ি ইত্যাদির স্মৃতি এখন মৃত্যু এবং বারুদের মাখামাখিতে পূর্ণ। আজ তিনি যাচ্ছেন ভিন্ন অবলোকনে। দেখবেন যুদ্ধ কতটা পূর্ণ হবে এই প্রাকৃতিক পরিবেশে। একজন ইঞ্জিনিয়ার এই অপারেশনের পরিকল্পনা করেছেন। যোদ্ধাদের মনে হয়েছে, কাজটি করা দরকার। যদি একটি পাওয়ার স্টেশন উড়ে যায়, শহরের মানুষ ঘুরে তাকাবে। বলবে, আমাদের ধমনিতে পরাধীনতার গ্লানি নেই। আমরা নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করছি।

এই ঘোষণার কথা স্বীকার করছে যুদ্ধের বিরোধিতা যারা করছে তারা। তবে সরাসরি নয়, খানিকটা ঘুরিয়ে। তাতে অবশ্য সত্য আড়াল থাকে না। পূর্ব পাকিস্তানের দুষ্কৃতিকারীদের শায়েস্তা করার জন্য জামায়াত নেতা গোলাম আযম ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেছেন। বলেছেন, দুষ্কৃতিকারীরা পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বংস করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। তারা যে ধরনের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে, তা এ মুহূর্তে দমন করা দরকার। সে জন্য আলাদা বাহিনী গড়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে অটল। দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

পত্রিকার পৃষ্ঠায় এমনই খবর ছাপা হয়। আকমল হোসেন খুঁটিয়ে পড়েন সেই খবর। শত্রুপক্ষের প্রতিটি বিষয় নখদর্পণে রাখা জরুরি। প্রয়োজনে নোট করেন, পাছে যদি ভুলে যান কিছু। বয়স তো হয়েছে!

বয়স! শব্দটা উচ্চারণ করে হাসলেন নিজের মনে।

আকমল হোসেন গাড়ি স্টার্ট দিয়েছেন। তাঁর গাড়ি এখন কাকরাইলে। তিনি সিদ্ধেশ্বরী হয়ে মালিবাগের মোড়ে বের হবেন। প্রথমে গুলবাগের দিকে যাবেন। উলন-বাজ্ঞা।

আবারও ভাবলেন, বয়স! বয়স থাকলে তিনি তো ওদের মতো অপারেশনে যেতেন। অন্তত সিটি টেররাইজিং অপারেশন করতে পারতেন। বয়স এখন বাধা। বয়স কখনো এমনই আচরণ করে। তার বুকের ভেতর এখন বয়স বেড়ে যাওয়ার অনুতাপ! নিজের জন্য তাঁর ভীষণ মায়া হয়।

তিনি ভেবে দেখলেন, গত মাসে রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছে। গভর্নর টিক্কা খান এই অর্ডিন্যান্স জারি করেন। পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স ১৯৭১। এই অর্ডিন্যান্সের বলে ১৯৫৮ সালের আনসার অ্যাক্ট বাতিল ঘোষিত হয়।

যেদিন এই অর্ডিন্যান্স জারি হয়, সেদিন তিনি আয়শাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন খবরটি।

আয়শা বলেছিলেন, বাঙালির বিরুদ্ধে বাঙালিদের মুখোমুখি করানো হলো।

তিনি খবরের শেষটুকু না পড়েই বলেছিলেন, গোলাম আযমের মতো লোকেরা আছে না! তারা নিজেরাই দাঁড়িয়েছে। তাদের কেউ দাঁড় করায়নি, আশা। এখন অনেকেই পরিস্থিতির শিকার হবে।

আয়শা মাথা নাড়েন। বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য।

দেখো, এই অ্যাক্টে আনসার বাহিনীর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মূলধন ও দায় এবং রেকর্ডপত্র রাজাকার বাহিনীর কাছে অর্পিত হবে।

আমরা তো শুনেছি, দেশের আনসার বাহিনীর অনেক সদস্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে সীমান্ত পার হয়েছে। আমাদের গেরিলাদের সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছে।

সবই ঠিক আছে, এটুকু আমাদের পক্ষে গেছে, কিন্তু যারা যেতে পারেনি, তাদের কী হলো? এই দেখো, লিখেছে আনসার অ্যাডজুট্যান্টদের রাজাকার অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে।

আয়শা খাতুন চুপ করে থাকেন। ভাবেন, শত্রুপক্ষ এভাবেই নিজেদের অলিগলি তৈরি করে। সেই সব পথ ধরে এগোতে চায়। কিন্তু প্রতিরোধের মুখে এগোতে পারে না। এটা ইতিহাসের সত্য। এই সব রাজাকারের দেশের মাটিতে বিচার হবে। হতেই হবে।

দুহাত মুষ্টিবদ্ধ হয় আয়শা খাতুনের।

আকমল হোসেন আবার বলেন, এই অর্ডিন্যান্সে বলা হয়, প্রাদেশিক সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশের সব মানুষকে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করা হবে। তাদের ট্রেনিং দিয়ে অস্ত্র দেওয়া হবে। তারা নির্ধারিত ক্ষমতাবলে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবে।

সবই বুঝলাম। ক্ষমতার অপব্যবহারেরও হুকুম দেওয়া থাকবে। অপব্যবহারের জন্যই তো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া।

সেদিন আকমল হোসেন কাগজ হাতে নিয়ে চুপ করে বসে ছিলেন। ভাবছিলেন, যুদ্ধ এখন নানামুখী হবে। রাজাকাররা ছদ্মবেশে প্রতিবেশী হয়ে থাকবে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারেও রাজাকাররা ঢুকবে কি না, কে জানে! সুযোগের সন্ধানে ঘুরবে লোভী মানুষেরা। তারা স্বাধীনতা বোঝে না। বোঝে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ। এই সব মানুষকে চোখে চোখে রাখা যুদ্ধ সময়ের আরেকটি কাজ।

আকমল হোসেনের গাড়ি এখন মালিবাগ হয়ে গুলবাগের রাস্তায় ঢুকেছে। পেছন থেকে আলতাফ ডাকে, স্যার।

কিছু বলবে? ডাকছ কেন?

আমাকে দুই দিনের ছুটি দেবেন। গ্রামে যাব। জরুরি দরকার আছে, স্যার। আমাদের বাড়িতে সর্বনাশ হয়েছে।

কীভাবে জানলে? কে খবর দিল? হঠাৎ গ্রামে যাওয়ার তাড়া হলো কেন?

কালকে বাজারে গায়ের একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে। ও বলেছে, আমার ছোট ভাই মোসলেম রাজাকার বাহিনীতে ঢুকেছে। আব্বা-আম্মার কথা শুনছে না। উল্টা আমার আব্বাকে শাসায়।

তুমি গিয়ে কী করবে? যে ছেলে বাবাকে মানতে চায় না, সে কি ভাইকে মানবে?

আমি প্রথমে ওকে বোঝাব। তারপর মাইর দেব। এর পরও কথা না শুনলে আব্বাকে বলব, ওকে ত্যাজ্যপুত্র করতে।

ঠিক বলেছ। লড়াইটা শুরু হয়ে যাওয়াই ভালো। আমাদের জন্য নতুন উৎপাত শুরু হলো। অপেক্ষা করলে সময় নষ্ট হবে।

কবে যাব, স্যার?

তুমি যেদিন যেতে চাও, সেদিন।

ভাইয়াদের অপারেশন হয়ে যাক, তার পরে। অপারেশনের দিন তো আমাকে অস্ত্র বের করতে হবে।

তা তো হবেই। তুমি আমার সহযোদ্ধা। আমার বয়স হয়েছে না। তোমার মতো কঠিন কাজ তো করতে পারি না।

আপনি যা করছেন, তা এ দেশের শত লোকও পারে না।

তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো, আলতাফ।

গাড়ি পাওয়ার স্টেশনের খানিকটুকু দূরে থামান আকমল হোসেন। তারপর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ডাব কেনেন। দুজনে ডাব খান। পাওয়ার স্টেশনের সামনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করেন। পাশের বাড়ি দেখেন। অকারণে মানুষ গোনেন, রাস্তায় হেঁটে যাওয়া এবং আশপাশের মানুষ। এলাকা মোটামুটি নিরিবিলি। সন্ধ্যার পর আরও ফাঁকা হয়ে যাবে। কাজ শেষে ওদের বেরিয়ে যেতে অসুবিধা হবে না।

আকমল হোসেন বেশ নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে গাড়িতে ওঠেন। আলতাফও খুশি। বলে, স্যার, গেরিলা ভাইদের খুব ঝামেলা হবে, না?

চুপ থাক। আর কথা না। কোন কথা কার কানে যাবে কে জানে!

তিনি গাড়ি স্টার্ট দেন। রামপুরার রাস্তায় উঠে গাড়ি উলন-বাচ্ছার দিকে ছুটতে থাকে। পেরিয়ে যায় রেললাইন। বস্তি। আশপাশের বাড়িঘর। কাঁচা বাজার। সামনে টেলিভিশন সেন্টার। টেলিভিশনের টাওয়ার। আকাশসমান উঁচু হয়ে আছে। আলতাফ টাওয়ারের মাথার দিকে তাকিয়ে থাকে। পার হয়ে যায় গাড়ি। ব্রিজের কাছে এসে থামে। দুজনে বিলের ধারে দাঁড়ান। দূরত্ব হিসাব করেন। যদি এই পথে যেতে হয় ওদের? কতগুলো দোকান আছে, কয়টা বাড়ি আছে, তা হিসাব করেন। কোন বাড়ির সামনেটা রাস্তার দিকে, কোনটা উল্টো দিকে, তা-ও দেখেন। দোকানিদের চেহারা দেখেন। বিভিন্ন দোকানে দাঁড়িয়ে এটা-ওটা কেনেন। সবকিছুই ওদের জানিয়ে দেবেন। তারপর আবার গাড়িতে ওঠেন। উলন পাওয়ার স্টেশন পার হয়ে গাড়ি থামান। পুলিশ ও দারোয়ান গেটের পাহারায় আছে। তিনি বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরি না করে ফিরে আসতে থাকেন বাড়ির দিকে। বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরি করলে ওরা তাকে সন্দেহ করতে পারে। গাড়িতে স্টার্ট দেন। পরক্ষণে ভাবলেন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে যাবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন এলাকার পাশের মাঠে রাজাকারদের ট্রেনিং হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে। গাড়ি চালালেন সেদিকে। একটি চক্কর দিয়ে বাড়িমুখো হলেন। তিনি জানেন, এই ট্রেনিং দেড় থেকে দুই সপ্তাহ হয়। মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের মাঠেও ট্রেনিং হচ্ছে।

আলতাফ জোরে জোরেই বলে, একটা অস্ত্র পেলে ওদের ফিনিশ করে দিতাম। বাঙালি কুত্তার বাচ্চা। নিজের দেশের বিরুদ্ধে যেতে লজ্জা করে না। আলতাফের ক্ষোভ প্রকাশে আকমল হোসেন মৃদু হাসেন। এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে কি না, তা-ও ভাবেন। আশপাশের লোকেরা এই বাড়িকে কতটা নজরদারিতে রেখেছে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। প্রতিবেশীরা এখন পর্যন্ত অনাবশ্যক কৌতূহল দেখায়নি। এসব ছেলে কারা আসা-যাওয়া করে, এ প্রশ্ন কাউকে করেনি। আলতাফকেও না। গাড়ি গেটের সামনে এসে দাঁড়ালে আলতাফ দরজা খুলে নামে। গেট দিয়ে ঢোকার সময় ভাবেন, মারুফের কাছে বাড়িটি অন্য রকম হয়ে গেছে। এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে পরদেশী তাকে কোথায় খুঁজে পাবে। ও তো শহীদদের তালিকা দিতে আসবে, এমনই তো কথা বলে গেছে ও। তাহলে?

তিনি গ্যারেজে গাড়ি রেখে ঘরে ঢুকলেন। মেরিনা এগিয়ে এল।

আব্বা, আপনি ভীষণ ঘেমে গেছেন। শরবত দেব? নাকি ফ্রিজ থেকে এক গ্লাস পানি দেব?

কিসের শরবত, মা?

বেলের, আব্বা।

দাও, মা। বেশি ইচ্ছে করলে দুগ্লাসও খেতে পারি।

তিনি ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। মারুফের সঙ্গে আরও কয়েকজন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য আছে। ছেলেরা দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। নজরুল বলে, কেমন দেখলেন, আঙ্কেল?

অপারেশন সাকসেসফুল হবে। এলাকা এখনো নিরিবিলি। যে কজন পুলিশ আছে, ওরা তোমাদের সঙ্গে পারবে না। উলন এলাকা আমার কাছে খুবই নিরাপদ মনে হয়েছে। বাড্ডার ঝুঁকি একটু বেশি। পাশেই রামপুরা টেলিভিশন সেন্টারে কড়া পাহারা আছে তো, এ জন্য। তবে তোমরা পারবে। এ আমার গভীর বিশ্বাস। বিল সাঁতরে সরে যেতে পারবে।

আশার কথা। আমাদের ভরসার জায়গা আপনি যেভাবে বললেন তাদের মনের জোর দ্বিগুণ হয়ে গেল।

আশাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তোমরা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ছ ছেলেরা।

মেরিনা শরবত দিলে তিনি এক চুমুকে শেষ করেন। বললেন, আরেক গ্লাস দাও, মা।

বাইরে কি খুব রোদ? গরম কি বেশি, আঙ্কেল?

বেশি তেতেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে রাজাকারদের ট্রেনিং দেখে। অস্ত্র দিয়ে ওদের দাম্ভিক বানানো হচ্ছে। ওদের সামনে কোনো আদর্শ নেই বলে ওরা অস্ত্রের যত্রতত্র ব্যবহার করবে।

এই শয়তানদের আমরা গ্রাহ্য করি না। আমাদের লড়াই ওদের বসদের সঙ্গে।

দেখা যাক। মনে রেখো, এই শয়তানগুলো স্বাধীন দেশে থাকবে। ওদের বসরা যখন দেশ ছেড়ে পালাবে, তখন এদের দিকে ফিরেও তাকাবে না।

ছেলেরা এই কথা শুনে চুপ করে থাকে। একজন বলে, তাহলে এদের বোঝা কি আমাদের টানতে হবে? ওরা কি দেশটার বিরুদ্ধে আরও ষড়যন্ত্র করবে? নাকি লেজ গুটিয়ে গর্তে ঢুকে থাকবে?

দ্রুত এদের বিচার না হলে কী হয়, বলা যায় না।

আকমল হোসেন গম্ভীর কণ্ঠে আরও বলেন, তবে আমি বিশ্বাস করি, স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে দেশ কলঙ্কমুক্ত হয় না।

ঠিক আঙ্কেল। স্বাধীন দেশে এই বিষয়ে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে।

আজ আমরা উঠি। কাল বিকেলে এখান থেকে অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে যাব আমরা।

ওরা চলে গেলে আকমল হোসেন বাথরুমে ঢোকেন। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হয়, বিলের পানির নিচে তিনি ড়ুবে আছেন। মাথার ওপর সাদা শাপলা। হাজার হাজার সাদা শাপলায় ভরে আছে বিল। ওপর থেকে পানি দেখা যায় না। তিনি যখন মাথা তুলবেন, তাঁর মাথার ওপরও সাদা শাপলা পতাকার মতো উড়বে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *