০৬. দ্রষ্টব্য বটে ভুখনা

ভুখনাকে ডেকে নিয়ে এল অবিনাশ।

দ্রষ্টব্য বটে ভুখনা। যেমনি লম্বা তেমনি ঢ্যাঙা। দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয় ফুট ছয় ইঞ্চির কাছাকাছি হবে। দেহের অতিরিক্ত দৈর্ঘ্যের জন্যই বোধ হয় লোকটা একটু কোলকুজো হয়ে হাঁটে। বড় বড় ভাসা ভাসা দুটো চোখের তারায় কেমন একপ্রকার বোবা নির্বোধ দৃষ্টি। ছড়ানো চৌকো চোয়াল। মাথার চুলগুলো ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া, অন্ধকারে আচমকা লোকটাকে দেখলে আঁতকে ওঠাও কিছু অসম্ভব নয়।

লোকটা তো বলছিলেন বোবা আর কালা, তা ওকে দিয়ে কাজ চালান কেমন করে শতদলবাবু? প্রশ্ন করল কিরীটী।

অনেকদিন আমার কাছে থেকে থেকে এখন আমার মুখ নাড়া দেখলেই ও বুঝতে পারে কী আমি বলতে চাই। তাই কাজকর্মের কোন অসুবিধা হয় না। তা ছাড়া একমাত্র রান্না করানো ছাড়া ওকে দিয়ে তো আর অন্য কোন কাজই করানো হয় না। শতদল জবাব দেয়।

এখানে আসবার পূর্বে তো আপনি কলকাতাতেই ছিলেন—তাই না শতদলবাবু?

হ্যাঁ, কলকাতার একটা বেসরকারী কলেজের আমি ইংরেজীর অধ্যাপক।

কিরীটী আবার অবিনাশের দিকে ফিরে তাকিয়ে তাকেই প্রশ্ন করল, ভুখনা একেবারেই শুনতে পায় না অবিনাশ, না?

তাই তো মনে হয় বাবু, একেবারে বেহদ্দ কালা!

এমন সময় সহসা গতরাত্রের সীতার সেই ভয়ঙ্কর আলসেসিয়ান কুকুরটার ডাক শুনতে পেলাম।

ঘেউ ঘেউ করে টাইগার ডাকছে।

আমরা সকলেই কুকুরের ডাকে চমকে বোধ হয় ক্ষণেকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ কিরীটীর দিকে তাকিয়ে দেখি, নিপলক দৃষ্টিতে সে ভুখনার দিকেই তাকিয়ে আছে।

ভুখনার চোখে কিন্তু সেই বোবা নির্বোধ দৃষ্টি। নিষ্প্রাণ, স্থির।

চলুন মিঃ ঘোষাল! কিরীটীই আবার সর্বাগ্রে দরজার দিকে এগিয়ে গেল!

আমরাও সকলে তাকে অনুসরণ করলাম।

শতদল গেট পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিয়ে ফিরে গিয়েছে।

নিঃশব্দে সর্বাগ্রে কিরীটী ও মিঃ ঘোষাল পাশাপাশি এবং আমি ও রাণু দেবী পাশাপাশি পাহাড়ের ঢালুপথটা দিয়ে এগিয়ে চলেছি হোটেলের দিকেই।

সকালের শীতের রৌদ্রে নীল সমুদ্র যেন চূর্ণ ঢেউয়ের মাথায় মাথায় গুচ্ছ গুচ্ছ জুঁই ফুল ছড়িয়ে আপন মনে খেলে চলেছে। আমার মনের মধ্যে তখন নিরালা ও তার অধিবাসীদের কথাই ঘোরাফেরা করছে।

শতদলবাবুর জীবন বিপন্ন সন্দেহ নেই, কিন্তু কেন? কোন গোপন রহস্য। কি ঐ নিরালার মধ্যে লুকিয়ে আছে? কিংবা কোন গুপ্তধন? শতদলই শিল্পী রণধীর চৌধুরীর যাবতীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হল কি করে? আইনের দিক থেকে সীতা বা তার মা হিরাণ্ময়ী দেবীর কি কোন স্বত্বই নেই মত শিল্পীর সম্পত্তিতে? এবং শতদল সীতা ও হিরণ্ময়ী দেবী ব্যতীত আর কোন উত্তরাধিকারীই কি নেই? আর শতদলবাবুই বা বলেন কি করে তিনিই তাঁর মত দাদুর যাবতীয় সম্পত্তির একমেবাদ্বিতীয়ম উত্তরাধিকারী? কোন উইল বা ঐ জাতীয় কোন লেখাপড়া আছে কি? মৃত শিল্পী রণধীর চৌধুরীর কি কোন আইন-উপদেষ্টা সলিসিটার বা অ্যাটিনী ছিল না? না আছে? বৎসরাধিককাল হরবিলাসু তাঁর স্ত্রী হিরাণ্ময়ী ও তাঁদের কন্যা সীতা ঐ নিরালাতে আছেন এবং রণধীর চৌধুরীর জীবিতকালে তাঁরই আমন্ত্রণে রুগ্ন হিরণ্ময়ী ওখানে আসেন তাঁরা বাইরের মহলে থাকেন কেন? ব্যবস্থাটা কি রণধীর চৌধুরীরই? তাই যদি হয়, তাহলে নিজের রুগ্না ভগিনীর প্রতি এ ব্যবহার কেন? কোন কারণবশতঃই কি তিনি রণধীর চৌধুরী তাঁর রগ্ন বোনকে বাইরের মহলেই এনে স্থান দিয়েছিলেন? ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে, তথাপি হিরাণ্ময়ী দেবীরা এখনো এখান হতে অন্যত্র যাননি কেন? হরবিলাসদের কী ভাবেই বা সংসারযাত্রা নির্বাহ হয়? পূর্বেই বা কী করতেন, এখনই বা কী করেন! পেনশন পান, না কোন জমিদারী বা সঞ্চিত অর্থ আছে! তাই যদি থাকে, তাহলে এভাবে হতাদরে বহির্মহলে পড়ে থাকবারই বা কী কারণ থাকতে পারে! বাড়ির প্রত্যেকটি প্রাণীই যেন আমার মনের মধ্যে আনাগোনা করে ফিরতে থাকে। একান্তভাবে পত্নীর শরণাপন্ন ও মুখাপেক্ষী হরবিলাসু তাঁর স্ত্রী—পক্ষাঘাতগ্রস্ত চলচ্ছক্তিহীন প্রৌঢ়া স্ত্রী হিরণ্ময়ী; তাঁর চক্ষুর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। তাঁদের একমাত্র তরুণী কন্যা সীতা যেন একটি নির্বাক দ্রষ্টা। সদা-সঙ্গী তার ভীষণাকৃতি আলসেসিয়ান কুকুর-টাইগার। বৃদ্ধ পুরাতন ভৃত্য অবিনাশ। পুরাতন মালী রঘু। শতদলের বোবা ও কালা ছত্রী অনুচর ভুখনা। সহজ সরল অধ্যাপক মানুষ শতদল ক্রোড়পতির একমাত্র কন্যা অনন্যাসুন্দরী তরুণী রাণু দেবীর অনুরক্ত।

নিঃশব্দেই আমরা সকলে দীর্ঘ পথটা অতিক্রম করে হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঘোষাল কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তাহলে এবারে আমাকে বিদায় দিন মিঃ রায়!

তা কি হয়, এক কাপ চা অন্তত না খেয়ে—আসুন? রাণু দেবী, আপনি? কিরীটী রাণুর মুখের দিকে তাকাল।

আমাকে ক্ষমা করতে হবে মিঃ রায় কয়েকটা জরুরী চিঠি সকালেই আমাকে শেষ করতে হব। তা ছাড়া অনেকক্ষণ বের হয়েছি, মা হয়তো ব্যস্ত হয়ে আছেন।

রাণু বিদায় নিয়ে উপরে চলে গেল।

আমরা তিনজনে হোটেলের বারান্দায় এসে বসলাম তিনটে চেয়ার টেনে নিয়ে। আমার মাথার মধ্যে তখনও পূর্বের চিন্তাগুলোই নিঃশব্দে পাক খেয়ে খেয়ে ফিরছে। সম্মুখের রৌদ্রালোকিত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বসে রইলাম আমি।

কিরীটী ও ঘোষাল নিম্নস্বরে কী সব আলাপ করতে লাগল।

মধ্যে মধ্যে কেবল তাদের দু-একটা কথার অস্পষ্ট টুকরো শ্রুতিপথে আমার ভেসে আসছিল। বুঝলাম সম্পূর্ণ অন্য সাধারণ কথাবার্তা। নিরালা সম্পর্কে বা শতদল-ঘটিত কোন আলোচনাই নয়।

দিন দুই এর পর যেন কতকটা নির্বিবাদেই কেটে গেল। দুটো দিন কিরীটীও বিশেষ হোটেল থেকে কোথাও একটা বের হয়নি। বেশীর ভাগ সময়ই বারান্দায় ডেকচেয়ারে শুয়ে নিঃশব্দে একটার পর একটা সিগার ধংস করেছে। মনে হয়েছে, সে যেন চারিদিক হতে হঠাৎ নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বিশেষ কোন একটা চিতায় সমাধিস্থ হয়ে পড়েছে। তৃতীয় দিন হঠাৎ বিকালের দিকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, চল সুব্রত, সমুদ্রের ধার দিয়ে একটু ঘুরে আসা যাক।

দুজনে নিঃশব্দে সমুদ্রের বালুবেলার উপর দিয়ে পাহাড়টার দিকে হেঁটে চলেছি, হঠাৎ দূরে মনে হল যেন কে একটি তরুণী আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। অস্তমুখী ম্লান সূর্যালোকে দূর হতে সীতাকে দেখে আমার চিনতে কষ্ট হলেও কিরীটীর কিন্তু চিনতে কষ্ট হয়নি।

সে বলে ওঠে, আশ্চর্য! সীতা দেবী একাকী আসছেন? সঙ্গে তাঁর সেই চিরানুগত সাথী দুরন্ত ব্যাঘ্র-সদৃশ ভয়ঙ্কর আলসেসিয়ান কুকুর টাইগারকে কই দেখছি না যে!

সত্যি সীতাই আসছে।

কাছাকাছি আসতে কিরীটীই প্রথমে হাত তুলে সম্ভাষণ নমস্কার জানাল, শুভ সন্ধ্যা। এই যে সীতা দেবী, একা যে, আপনার অনুগত সাথীটি কই? তাকে দেখছি না যে?

নমস্কার। সীতাও হাত তুলে প্রতিনমস্কার জানিয়ে বললে, আমার অনুগত সাথী?

হ্যাঁ, আপনার সেই টাইগার?

সহসা লক্ষ্য করলাম কিরীটীর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই সীতার চোখের তারা দুটি যেন কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠল, কাল রাত্রে হঠাৎ গুলি লেগে বেচারার একটা পা জখম হয়েছে, মিঃ রায়। কাতর কন্ঠেই সীতা বললে।

বলেন কী, টাইগার গুলিতে জখম হয়েছে! হাসতে হাসতে কিরীটী শেষের কথা কয়টি উচ্চারণ করে, তারপর সহসা সীতার মুখের দিকে তাকিয়েই বলে, কিন্তু ব্যাপার কি বলুন তো? এ যে বাঘের ঘরে ঘোঘের ব্যাপার!

সত্যিই আশ্চর্য ব্যাপার, মিঃ রায়! আমি আপনার সঙ্গেই হোটেলে দেখা করতে যাচ্ছিলাম।

আমার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন?

হ্যাঁ। আপনি তো জানেন, সেদিনই আমাদের অন্দরমহলে থাকবার জন্য শতদল-ভাগ্নে অনুরোধ জানান। আপনারা চলে আসবার পর কতকটা যেন নিজে উৎসাহ দেখিয়েই একপ্রকার আমাদের অন্দরমহলের দক্ষিণ দিককার যে দুটো ঘর খালি পড়ে ছিল, তাতে নিয়ে গিয়ে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করে দেন। একটা দিন ও একটা রাত ভালোই লাগছিল। কিন্তু, কথাগুলো বলে সীতা যেন একটু দম নেয়।

কিরীটী ও আমি দুজনই উদগ্রীব হয়ে সীতার কথা শুনছি।

সীতা আবার বলতে শুরু করে কাল রাত তখন বোধ হয় গোটা দুই হবে। অন্যান্য দিনের মতই টাইগার আমার ঘরের বাইরে শুয়ে ছিল। হঠাৎ তার ক্রুদ্ধ একটা চাপা গোঁ-গোঁ শব্দে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হল কোন কারণে টাইগার যেন হঠাৎ ভীষণ খাপ্পা হয়ে উঠেছে। তারপরই পর পর দুটো গুলির শব্দ!

গুলির শব্দ?

হ্যাঁ। প্রথমটায় তো সত্যি কথা বলতে কি মিঃ রায়, ভয়ে আতঙ্কে আমি একেবারে কাঠ হয়েই গিয়েছিলাম ঘটনার আকস্মিকতায়। কিন্তু চিরদিনই ভয় বস্তুটা আমার একটু কম। নিজেকে সামলে নিতে তাই আমার খুব বেশী সময় লাগেনি। তাড়াতাড়ি বিছানা হতে উঠে দরজাটা খুলে একেবারে বাইরে চলে এলাম। মাঝরাতে কাল বোধ হয় চাঁদ উঠেছিল। ম্লান চাঁদের আলো বারান্দার উপরে এসে পড়েছে। দেখলাম টাইগার তখনও আমার ঘরের দরজার অল্প দূরে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে গোঁ গোঁ করে গজরাচ্ছে যন্ত্রণায়। ইতিমধ্যে পাশের ঘরে মা-বাবার এবং উপরের তলায় শতদল-ভাগ্নেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তারাও যে যার ঘর থেকে টাইগারের গর্জন শুনে বের হয়ে এসেছে। শতদলভাগ্নের ডাকাডাকিতে অবিনাশও ঘুম ভেঙে উঠে এল। আমি টাইগারকে ডাকতেই সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, তার ডান পা-টা বেশ গুরতর ভাবেই জখম হয়েছে। রক্ত ঝরছে তখনও। বারান্দাতেও রক্ত। আর—আর বারান্দায় দেখলাম, অনেকগুলো কেডস জুতোর সোলের ছাপ। ছাপগুলো জুতোর সোলে বোধ হয় ভিজে কাদা লেগেছিল তারই। এবং জুতোর ছাপ লক্ষ্য করে দেখলাম, বরাবর বারান্দার দক্ষিণ প্রান্তের শেষ পর্যন্ত যেখানে প্রাচীর শুরু হয়েছে এবং প্রাচীরের গায়ে যে দরজাটা সেই পর্যন্ত চলে গেছে। দরজাটা কিন্তু বন্ধ। দরজাটা বাইরের থেকে শিকল তুলে বন্ধ করে দিয়েছে। এদিককার খিল খোলা। দরজাটা ভিতর থেকেই খিল এঁটে বন্ধ করা ছিল।

সীতা চুপ করল। কিরীটী আগাগোড়া সীতার বর্ণিত কাহিনী গভীর মনোযোগ সহকারে শুনছিল। এতক্ষণে কথা বলল, আচ্ছা সীতা দেবী, ইতিপূর্বে আর কখনো ঐ বাড়িতে থাকাকালীন সময়ের মধ্যে আপনার টাইগারের উপর কোন প্রকার attempt হয়েছিল কি?

এখন মনে হচ্ছে, দিন দশেক আগে একবার বোধ হয় টাইগারের উপর কোন attempt হয়েছিল।

কী রকম?

সে-রাত্রেও ঠিক অমনি কালকের রাতের মতই টাইগারের চাপা গর্জন শুনে ঘর থেকে আমি বের হয়ে আসি কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না।

কোন firing-এর শব্দ শুনেছিলেন সে-রাত্রে?

না।

হুঁ। কিরীটী মুহূর্ত কাল কি যেন ভাবে, পরে প্রশ্ন করে, শতদলবাবু কোথায়? এখন বাড়িতে আছেন নাকি?

তিনি ঘণ্টাখানেক আগেই বের হয়ে এসেছেন; জানি না ঠিক কোথায় গিয়েছেন।

আচ্ছা সীতা দেবী, জুতোর সেই ছাপগুলো বারান্দায় এখনো আছে কি? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

বোধ হয় আছে। কারণ সকালেই তো থানা-অফিসার মিঃ ঘোষালকে সংবাদ দেওয়া হয়েছিল।

মিঃ ঘোষাল গিয়েছিলেন ওখানে?

হ্যাঁ। তিনি দুপুরেই এসেছিলেন। বললেন, আপনার সঙ্গে তিনি দেখা করবেন। বুঝতে পারছি তিনি দেখা করেন নি।

সন্ধ্যার ঘূসর অস্পষ্টতা ক্রমে যেন চারিদিকে চাপ বেধে উঠছে। একটু একটু করে চারিদিককার পটচ্ছায়া লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যাকাশে দেখা দিতে শুরু করেছে একটি-দুটি করে তারা। অল্পদূরে ডানদিকে সমুদ্র সন্ধ্যার তরল অন্ধকারে একটানা গর্জনে জানাচ্ছে তার অস্তিত্ব।

ক্ষণকালের জন্য কিরীটী বোধ হয় কী চিন্তা করে সহসা ঘুরে দাঁড়িয়ে সীতা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে, সীতা দেবী, আপনার বাবা মিস্টার ঘোষ এখন বাড়িতেই তো আছেন, না?

হ্যাঁ। বাড়ি থেকে বড় একটা তিনি তো কোথাও বের হন না। মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয় সীতা।

চলুন। একবার না হয় আপনাদের ওখান থেকেই ঘুরে আসা যাক। শতদলবাবু এর মধ্যে ফিরে এলে তাঁর সঙ্গেও হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে, কী বলেন?

চলুন। হতেও পারে। কতকটা সোৎসাহেই সীতা যেন কিরীটীর প্রস্তাবটা অনুমোদন করে।

কিরীটী ও সীতা পাশাপাশি এগিয়ে চলে, আমি ওদের অনুসরণ করতে লাগলাম।

মাথার উপরে শীতের কুয়াশাহীন প্রথম রাতের কালো আকাশে তারাগুলো বেশ উজ্জল মনে হয় এখন। সমুদ্রের ভাঙা ঢেউয়ের শীর্ষে শীর্ষে ফসফরাসের সোনালী ঝিলিক চিকচিক করে ওঠে। কালো জলে আলোর চুমকি ওগুলো যেন।

সহসা কিরীটীই আবার পাশাপাশি চলতে চলতে সীতাকে প্রশ্ন করে, আপনি আমার ওখানে যাচ্ছিলেন কেন মিস ঘোষ?

ভাবছিলাম আপনার সঙ্গে একটা পরামর্শ করব—

পরামর্শ! কিসের বলুন তো?

এখানে, মানে ঐ বাড়িতে থাকাটা আর ভালো হবে কি না তাই ভাবছি

কেন?

ভাবছিলাম মার বর্তমান অবস্থা ভেবেই। এমনিতে মার নার্ভ খুব স্ট্রং, কিন্তু গতরাত্রের ব্যাপার দেখেশুনে মা যেন বেশ একটু নার্ভাসই হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। জানেন তো, একে প্যারালেটিক রোগী—ডাক্তারের অ্যাডভাইস আছে যেন ওঁর পক্ষে কোন সময়েই কোনপ্রকার মানসিক উত্তেজনার কারণ না ঘটে। মাকে সর্বদাই তাই আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করি যাতে ওঁর মানসিক শান্তি অটুট থাকে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে ঐ বাড়িতে যা সব ঘটেছে সুস্থমস্তিষ্ক ব্যক্তির পক্ষেই উত্তেজনার কারণ হচ্ছে, তা মা তো রোগী

কথাটা অবশ্য ভাববার, মিস ঘোষ! কিন্তু আপনার বাবা কী বলেন? কিরীটী প্রশ্ন করে।

বাবা! এসব ব্যাপারে অত্যন্ত indifferent। জ্ঞান হওয়া অবধি দেখে আসছি তো, কোন ব্যাপারেই তিনি বড় একটা থাকতে চান না। নির্লিপ্ত। অসুস্থ হলেও মা-ই সব কিছু দেখাশোনা করেন। তাঁর পরামর্শমতই সব চলে। কিন্তু এক্ষেত্রে যে মাকে নিয়েই কথাটা।

সীতার কথার এবারে আর কিরীটী কোন জবাব দেয় না। নিঃশব্দে কেবল পথ অতিক্রম করতে থাকে।

সীতাই আবার কথা শুরু করে, মার আপনার উপরে একটা অসাধারণ শ্রদ্ধা আছে মিঃ রায়। আমার তো মনে হয়, এ অবস্থায় আমাদের আর ও বাড়িতে বেশী দিন থাকা উচিত হবে না। যে যাই বলুক, definitely some foul play is going over there! তা ছাড়া স্বাস্থ্যের জন্যই মার ঐ বাড়িতে থাকা স্বাস্থ্যের দিক দিয়েও মার বর্তমানে বিশেষ যে কোন progress হচ্ছে বলেও আমার মনে হয় না।

কিন্তু কোন প্রকার foul play-ই যে বর্তমানে ঐ বাড়িতে চলেছে তাই বা আপনার ধারণা হল কেন মিস ঘোষ?

নইলে গত কয়েক দিন ধরে যে সব ব্যাপার ঘটছে, এ-সবের আর কি explanation হতে পারে, আপনিই বলুন! একটা হানাবাড়ি

ভূত-প্রেতে আপনার বিশ্বাস আছে নাকি সীতা দেবী?

না, না—ঠিক সেভাবে কথাটা আমি অবশ্যই বলিনি, মিঃ রায়। বলছিলাম, যা ও বাড়িতে ঘটছে, যুক্তি-তর্ক দিয়েও যে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি না!

আমার কি মনে হয় জানেন সীতা দেবী?

কী?

এখনি ও-বাড়ি ছেড়ে হয়তো আপনার মা অন্যত্র কোথাও যেতে রাজী হবেন না।

বিস্ময়-ভরা দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল সীতা, এ কথা বলছেন কেন?

সীতার প্রশ্নের জবাবটা কিরীটী বোধ হয় একটু ঘুরিয়েই দিল, আপনার মামা স্বর্গীয় রণধীর চৌধুরীর সম্পত্তিতে আপনাদের কি কোন অংশই নেই, মিস ঘোষ?

তা তো জানি না!

রণধীর চৌধুরী গত হয়েছেন কতদিন?

মাস দুই হল।

তাঁর কোন উইল বা ঐজাতীয় কোন নির্দেশনামা নেই?

বলতে পারি না।

আপনার মার মুখেও কিছু শোনেননি?

কিরীটীর শেষ প্রশ্নে সীতা কেমন যেন একটু ইতস্তত করতে থাকে। কিরীটীর তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসাতে সেটুকু এড়ায় না। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গেই আবার প্রশ্ন করে, সাধারণ ভাবে বিচার করে দেখতে গেলে আপনার মারও তাঁর ভাইয়ের সম্পত্তিতে কিছু দাবী থাকাটা তো বিচিত্র নয়। তবে অবশ্য যদি তিনি তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি উইল করে তাঁর একমাত্র মেয়ের ছেলে-নাতিকেই দিয়ে গিয়ে থাকেন তো আলাদা কথা। আপনার মার সঙ্গে শতদলবাবুকেও ও-সম্পর্কে কোন দিন বলতে শোনেননি?

শতদল-ভাগ্নে এখানে আসবার কয়েক দিন পরে মার সঙ্গে তাঁর ঐ ধরনের কি সব কথাবার্তা হচ্ছিল, আমি বিশেষ কান দিইনি। মৃদুকণ্ঠে সীতা জবাব দেয়।

ইতিমধ্যে আমরা প্রায় নিরালার গেটের কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম। অন্ধকারে কালো আকাশপটের নীচে নিরালা যেন কেমন একটা ভয়াবহ ছায়ার মতই মনে হয়। যেন কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগের বিরাটকায় রক্তলোলুপ জানোয়ার ঘাপটি মেরে বসে আছে। নিজের অজ্ঞাতেই গা-টা অকারণেই কেমন যেন ছমছম করে ওঠে।

গেটটা খোলাই ছিল। সর্বাগ্রে সীতা, পশ্চাতে কিরীটী, তারও পশ্চাতে আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম।

অস্পষ্ট তারকার আলোয় চারিদিককার গাছপালা কেমন ধোঁয়াটে, অস্পষ্ট। হঠাৎ তিনজনেই আমরা থমকে দাঁড়ালাম।

দোতলার একটা জানালা খুলে গেল আর সেই জানালাপথে একটা শক্তিশালী টর্চের অনুসন্ধানী আলো নীচের অন্ধকারে এসে উর্ধ্বদিকে উৎক্ষিপ্ত হল। শূন্য আকাশপথে অন্ধকারে আলোর রেখাটা কয়েক মুহূর্তে ঘরে-ফিরে দপ করে একসময় নিবে গেল। আলোটা দেখা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটী দ্রুত বলিষ্ঠ হাতে আকর্ষণ করে আমাকে ও সীতাকে নিয়ে একটা মোটা ঝাউগাছের আড়ালেই আত্মগোপন করেছিল। আলোটা নিভে যাওয়া সত্ত্বেও আমরা তিনজনেই গাছের আড়ালেই দাঁড়িয়েছিলাম আত্মগোপন করে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে। কিরীটীর দুহাত দিয়ে তখনও আমাদের দুজনের হাত ধরা। তিনজনেই নির্নিমেষে আমরা উপরের খোলা জানালাটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি একটা মানুষের ছায়া।

ছায়াটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রার্পিতের মত।

সহসা চাপা গলায় কিরীটী প্রশ্ন করে, কোন ঘরের জানালা ওটা বলতে পারেন মিস ঘোষ?

মনে হচ্ছে শতদল-ভাগ্নের ঘরের জানালা! চাপা উত্তেজিত কণ্ঠেই জবাব দেয় সীতা।

আমারও তাই ধারণা। কতকটা যেন স্বগতোক্তিই করে কিরীটী।

একটু পরেই জানালাটা বন্ধ হয়ে গেল।

আরো কিছুক্ষণ পরে আমরা গাছের আড়াল হতে বের হয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজাটা ভিতর হতে বন্ধই ছিল। কিরীটী দরজা খোলার সংকেত-ঘণ্টার দড়ির প্রান্তটা ধরে টেনে দরজাটা খোলবার জন্য দড়ির সঙ্গে সংযুক্ত ভিতরের ঘণ্টাটা বাজাতে যাবে, হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। খোলা দরজার সামনে হ্যারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে অবিনাশ।

অবিনাশই কথা বললে, বুড়োবাবু তো ঠিকই বলেছেন, আপনারা এসেছেন, দরজাটা খুলে দিতে!

বুড়োবাবু তিনি জানলেন কী করে যে আমরা এসেছি? প্রশ্ন করল কিরীটীই।

তা তো জানি না। তিনি দরজাটা এসে খুলে দিতে বললেন, তাই তো খুলতে এলাম। মৃদু হাসির সঙ্গে কথাটা বললে অবিনাশ।