০৬. ডায়মণ্ড কাহিনি ও বর্ণময় রবি রে

০৬. ডায়মণ্ড কাহিনি ও বর্ণময় রবি রে

দুর্দান্ত ভিলেন হলেও সিনেমায় হিরো হয়ে যেতে পারত রবি। কিন্তু ভাল মানুষের চরিত্র নিয়ে ভিড়ে গেছিল কল্পনা চিটনিসের সঙ্গে।

কিন্তু সেটা পরে। তার আগে…

 

তরতাজা যুবক রবি রে প্রথম থেকেই নজর কেড়েছিল বম্বের জহুরিদের। ওর চেহারা, ওর গলার আওয়াজ-সব কিছুই মার্কামারা। হীরক বাণিজ্যের অন্ধকার দিকটায় এমন একটা ক্যারেক্টারকে খলনায়ক হিসেবে নামিয়ে দেওয়া যায় কিনা, ভেবেছিল হিরে বাণিজ্যের জাদুকররা।

দুর্দান্ত অভিনেতা রবি রে সেই ভূমিকা নিয়েই ঢুকে গেছিল হিরের আড়ালের অন্ধকার জগতে। এটা ছিল একটা ইমেজ। সেটা ভাঙিয়েছে। বেঙ্গল ব্রেন তো। আবার অন্য ভূমিকায় কল্পনা চিটনিসের মনের জগতে তুফান রচনা করে গেছে। কখনও সে ব্যাড়ম্যান, কখনও গুডম্যান। বিশাল চেহারা, চোখের অদ্ভুত এক্সপ্রেশন, আর গম্ভীর গলার স্বর দিয়ে নাচিয়ে মজিয়ে ফিনিশ করে দিয়েছে হিমালয় কন্যাকে।

আর, ব্যক্তিত্বের এই চাবিকাঠি কাজে লাগিয়েই ঢুকে গেছিল ঝকমকে হীরক সাম্রাজ্যের তমসাময় নিতল আলয়ে…

 

হিরে, হিরে, হিরে! পাথর, কিন্তু নিরতিশয় ঘন। এত ঘন যে সবশক্তিমান সূর্যদেবের কিরণকেও অক্লেশে যেতে দেয় না নিজের ভিতর দিয়ে। আলোর গতিবেগ ব্যাহত করবার ক্ষমতা যদি কারও থাকে, তবে তা আছে এই হিরে নামক পাথরের। একটু রুখে দেয় আলোর স্পীডকে…সূর্যালোক তখন তিনভাগে একভাগ। গতিবেগ হারায়। তিন ভাগের দু’ভাগ স্পীড নিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে যায় অপর দিক দিয়ে এরই নাম হিরে। আশ্চর্য পাথর হিরে। পৃথ্বী-জঠরের নিরেট প্রস্তর—হিরে…চমকদার হিরে!

সুপ্রাচীন কাল থেকে এই হিরে সাম্রাজ্যকে গড়ে নিয়েছে মা পৃথিবী। মানুষ মায়ের গর্ভে যেমন তিল তিল করে বেড়ে ওঠে মানব শিশু, পৃথিবী জননী সেই প্রক্রিয়ায় না গিয়ে বিপুল চাপের মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি করেছে গর্ভের ঐশ্বর্যদের। টাইটানিক প্রেসার দিয়ে যায় কার্বনের ওপর। সেই সঙ্গে বিপুল তাপ। পৃথিবী যখন তরুণী, এই কাণ্ড করে গেছে তখনই। রচনা করেছে হিরে। এবং…

লুকিয়ে রেখেছিল গর্ভের গভীরতম স্তরে…করে কদরে…প্রায় দশ কোটি বছর আগে। তারপর উগরে দিয়েছে গলিত পাথরের সঙ্গে। যে পাথরের নাম কিমবারলাইট।

গাজর আকারের বিস্তর সরু সরু ফানেলের মধ্যে গর্ভজাত কিমবারলাইট শীতল হয়েছে একটু একটু করে। ভূ-স্তর থেকে ঠেলে বেরিয়ে থেকেছে গাজর-সদৃশ এই হীরক আধারদের স্থূল গোলাকৃতি দিকগুলো। লক্ষ লক্ষ বছরের বৃষ্টি আর ঝড়ের তাণ্ডব নৃত্য একটু একটু করে ক্ষইয়ে দিয়েছে কিমবারলাইট পাথরের ভূ-স্তরের দিক…

হিরে-প্রসব ঘটেছে তখনই। ধরণীর ওপরের স্তরে ছড়িয়ে গেছে হিরে…জলস্রোতে গড়িয়ে গড়িয়ে গিয়ে জমা হয়েছে নদীর তলায় অথবা নরম মাটিতে, যে মাটির নাম লুণ্ডাসুল…

চোখের হিরে নাচিয়ে নাচিয়ে হিরে সৃষ্টির কাহিনি শুনিয়ে গেছিল বাংলার বাঘ’ রবি রে। বলেছিল, লাকি হিরে সন্ধানীরা এই পাথরদেরই খুঁজে খুঁজে ঘরে তুলেছে, খদ্দের জুটিয়েছে। খনি থেকে তুলে এবড়ো-খেবড়ো শ্রীহীন এই পাথরদের জন্যেও হামলা চালিয়েছে হিরে ডাকাতরা। জলুস নেই যেসব পাথরের, হিরে-জহুরিরা সেইসব শ্রীহীন পাথর কজায় আনবার জন্যে অনেক অমানুষদের মোতায়েন করেছে। ইন্দ্র, হিরে তাই বুঝি একাধারে লক্ষ্মী আর অভিশাপ।

গলা কাঁপছিল রবির। আমি বাগড়া না দিয়ে শুনে যাচ্ছিলাম। কথা বলার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছিল—ওর সম্মোহনী কথার তোড়ে…

তারপর রেখেছিলাম ছোট্ট একটা প্রশ্ন-রবি, হিরের মধ্যে আছে রোমান্স, আছে শক্তি, আছে বিউটি, আছে সম্পদ। তাহলে কেন এই পৃথিবীর যে কোনও জিনিসের চেয়ে এই হিরে জিনিসটা মানুষের কল্পনায় এমন আগুন ধরিয়ে দেয়, নিচ স্পৃহাগুলোকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে দেয়?

রবি তখন যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। আমার প্রশ্নটা কানের মধ্যে দিয়ে মাথায় ঢুকে সঙ্গত বৈদ্যুতিক ছন্দ নির্মাণ করতে একটু সময় নিল। যা ঘটে নিমেষে, তা ঘটল একটু দেরিতে। হিরে এমনই জিনিস। চিন্তার গতিকেও মন্থর করে দেয়, যেমন করে আলোর গতিকে। তারপর শুনিয়ে গেছিল অনেক অনেক ব্যাখ্যা। অলৌকিক রহস্য থেকে শুরু করে মানুষের কদর্য লালসা—কিছুই বাদ দেয়নি। হিরে রয়েছে সব কিছুর মূলে। মানুষকে পিশাচ বানিয়ে দিচ্ছে হিরে-যার এক-এক

কণায় বিধৃত রয়েছে অসংখ্য সৌন্দর্য-কণা।

হিরে…অব্যাখ্যাত রহস্যের আধার হিরে।

কোনও জবাবই আমার মন ভরিয়ে দিতে পারেনি। রবি নিজেও আজও খুঁজে পায়নি-হিরে মানুষকে কেন এভাবে টানে। এ এক আশ্চর্য আকর্ষণ।

প্যারিস শহরে প্রদর্শনী হচ্ছিল। রবি ছিল সেখানে। রগড় দেখবার জন্যে নয়, মার্কেট যাচাই করার জন্যে। তুমুল বৃষ্টি তখন ধুইয়ে দিচ্ছিল গোটা শহরটাকে। বরুণদেবের বিষম নৃত্যকে উপেক্ষা করে মহিলারা দলে দলে কেন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিরে দেখবার জন্যে, সকৌতুকে এই প্রশ্ন করেছিল রবি।

চোখের হিরে নাচিয়ে নাচিয়ে সুন্দরীরা বলেছিল, নক্ষত্র। নক্ষত্র! হিরে যে আদতে নক্ষত্র!

রূপসীদের চোখে হিরে নিছক তারকা হতে পারে, হিরে কারবারিদের কাছে হিরে মানেই টাকা টাকার পাহাড়! মণি থেকে মুদ্রা—বিপুল পরিমাণে। নইলে বুলডোজার চালিয়ে লণ্ডনের মিলেনিয়াম ডোম তছনছ করতে যাবে কেন হিরে ডাকাতরা? দু’হাজার সালের নভেম্বরে ঘটেছিল পিলে চমকানো এই ডাকাতি। থ’ করে দিয়েছিল হিরে বণিকদের। রবি রে’র দর বেড়েছিল এই ঘটনার পর থেকেই। ওর ওই র্যামবো মার্কা ফিগারটার জন্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *