০৬. চাঁদের পাহাড় – ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

দিন পনেরো পরে শঙ্কর ও আলভারেজ উজিজি বন্দর থেকে স্টীমারে টাঙ্গানিয়াকা হ্রদে ভাসল। হ্রদ পার হয়ে আলবার্টভিল বলে একটা ছোট শহরে কিছু আবশ্যকীয় জিনিস কিনে নিল। এই শহর থেকে কাবালো পর্যন্ত বেলজিয়ান গভর্ণমেন্টের রেলপথ আছে। সেখান থেকে কঙ্গো নদীতে স্টীমারে চড়ে তিনদিনের পথ সানকিনি যেতে হবে, সানকিনিতে নেমে কঙ্গো নদীর পথ ছেড়ে, দক্ষিণ মুখে অজ্ঞাত বনজঙ্গল ও মরুভূমির দেশে প্রবেশ করতে হবে।
কাবালো অতি অপরিষ্কার স্থান, কতকগুলো বর্ণসঙ্কর পর্তুগিজ ও বেলজিয়ানের আড্ডা।
স্টেশনের বাইরে পা দিয়েছে এমন সময় একজন পর্তুগিজ ওর কাছে এসে বললে— হ্যালো, কোথায় যাবে? দেখছি নতুন লোক, আমায় চেনো না নিশ্চয়ই। আমার নাম আলবুকার্ক।
শঙ্কর চেয়ে দেখলে আলভারেজ তখনো স্টেশনের মধ্যে।
লোকটার চেহারা যেমন কর্কশ তেমনি কদাকার। কিন্তু সে ভীষণ জোয়ান, প্রায় সাত ফুটের কাছাকাছি লম্বা, শরীরের প্রত্যেকটি মাংসপেশী গুণে নেওয়া যায়, এমন সুদৃঢ় ও সুগঠিত।
শঙ্কর বললে— তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম।
লোকটা বললে— তুমি দেখছি কালা আদমি, বোধহয় ইস্ট ইন্ডিজের। আমার সঙ্গে পোকার খেলবে চল।
শঙ্কর ওর কথা শুনে চটেছিল, বললে— তোমার সঙ্গে পোকার খেলবার আমার আগ্রহ নেই। সঙ্গে সঙ্গে সে এটাও বুঝলে, লোকটা পোকার খেলবার ছলে তার সর্বস্ব অপহরণ করতে চায়। পোকার একরকম তাসের জুয়াখেলা, শঙ্কর নাম জানলেও সে খেলা জীবনে কখনো দেখেওনি, নাইরোবিতে সে জানতো বদমাইশ জুয়াড়িরা পোকার খেলবার ছল করে নতুন লোকের সর্বনাশ করে। এটা এক ধরনের ডাকাতি।
শঙ্করের উত্তর শুনে পর্তুগিজ বদমাইশটা রেগে লাল হয়ে উঠল। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুতে চাইল। সে আরও কাছে ঘেঁষে এসে, দাঁতে দাঁত চেপে, অতি বিকৃত সুরে বললে— কী? নিগার, কি বললি? ইস্ট ইন্ডিজের তুলনায় তুই অত্যন্ত ফাজিল দেখছি। তোর ভবিষ্যতের মঙ্গলের জন্যে তোকে জানিয়ে দিই যে, তোর মতো কালা আদমিকে আলবুকার্ক এই রিভলবারের গুলিতে কাদাখোঁচা পাখির মতো ডজনে ডজনে মেরেছে। আমার নিয়ম হচ্ছে এই শোন। কাবালোতে যারা নতুন লোক নামবে, তারা হয় আমার সঙ্গে পোকার খেলবে, নয়তো আমার সঙ্গে রিভলবারে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করবে।
শঙ্কর দেখলে এই বদমাইশ লোকটার সঙ্গে রিভলবারের লড়াইয়ে নামলে মৃত্যু অনিবার্য। বদমাইশটা হচ্ছে একজন ক্র্যাকশট গুন্ডা, আর সে কি? কাল পর্যন্ত রেলের নিরীহ কেরানি ছিল। কিন্তু যুদ্ধ না করে যদি পোকারই খেলে তবে সর্বস্ব যাবে।
হয়তো আধমিনিট কাল শঙ্করের দেরী হয়েছে উত্তর দিতে, লোকটা কোমরের চামড়ার হোলস্টার থেকে নিমেষের মধ্যে রিভলবার বার করে শঙ্করের পেটের কাছে উঁচিয়ে বললে— যুদ্ধ না পোকার?
শঙ্করের মাথায় রক্ত উঠে গেল। ভীতুর মতো সে পাশবিক শক্তির কাছে মাথা নিচু করবে না, হোক মৃত্যু।
সে বলতে যাচ্ছে— যুদ্ধ, এমন সময় পিছন থেকে ভয়ানক বাজখাঁই সুরে কে বললে— এই! সামলাও, গুলিতে মাথার চাঁদি উড়ল!
দু’জনেই চমকে উঠে পিছনে চাইলে। আলভারেজ তার উইনচেস্টার রিপিটারটা বাগিয়ে, উঁচিয়ে, পর্তুগিজ বদমাইশটার মাথা লক্ষ্য করে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে। শঙ্কর সুযোগ বুঝে চট করে পিস্তলের নলের উল্টোদিকে ঘুরে গেল। আলভারেজ বললে— বালকের সঙ্গে রিভলবার ডুয়েল? ছোঃ, তিন বলতে পিস্তল ফেলে দিবি— এক— দুই— তিন—
আলবুকার্কের শিথিল হাত থেকে পিস্তলটা মাটিতে পড়ে গেল।
আলভারেজ বললে— বালককে একা পেয়ে খুব বীরত্ব জাহির করছিলি, না?
শঙ্কর ততক্ষণে পিস্তলটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে। আলবুকার্ক একটু বিস্মিত হল, আলভারেজ যে শঙ্করের দলের লোক, তা সে ভাবেওনি। সে হেসে বললে— আচ্ছা, মেট, কিছু মনে কোরো না, আমারই হার। দাও, আমার পিস্তলটা দাও ছোকরা। কোনো ভয় নেই, দাও। এসো হাতে হাত দাও। তুমিও মেট। আলবুকার্ক রাগ পুষে রাখে না। এসো, কাছেই আমার কেবিন, এক এক গ্লাস বিয়ার খেয়ে যাও।
আলভারেজ নিজের জাতের লোকের রক্ত চেনে। ও নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে শঙ্করকে সঙ্গে নিয়ে আলবুকার্কের কেবিনে গেল। শঙ্কর বিয়ার খায় না শুনে তাকে কফি করে দিলে। প্রাণখোলা হাসি হেসে কত গল্প করলে, যেন কিছুই হয়নি।
শঙ্কর বাস্তবিকই লোকটার দিকে আকৃষ্ট হল। কিছুক্ষণ আগের অপমান ও শত্রুতা যে এমন বেমালুম ভুলে গিয়ে, যাদের হাতে অপমানিত হয়েছে, তাদেরই সঙ্গে এমনি ধারা দিলখোলা হেসে খোশগল্প করতে পারে, পৃথিবীতে এ ধরনের লোক বেশি নেই।
পরদিন ওরা কাবালো থেকে স্টীমারে উঠল কঙ্গো নদী বেয়ে দক্ষিণ মুখে যাবার জন্যে। নদীর দুই তীরের দৃশ্যে শঙ্করের মন আনন্দে উত্‍ফুল্ল হয়ে উঠল।
এ রকম অদ্ভুত বনজঙ্গলের দৃশ্য জীবনে কখনো সে দেখেনি। এতদিন সে যেখানে ছিল— আফ্রিকার সে অঞ্চলে এমন বন নেই, সে শুধু বিস্তীর্ণ প্রান্তর, প্রধানতঃ ঘাসের বন, মাঝে মাঝে বাবলা ও ইউকা গাছ। কিন্তু কঙ্গো নদী বেয়ে স্টীমার যত অগ্রসর হয়, দু’ধারে নিবিড় বনানী, কত ধরনের মোটা মোটা লতা, বনের ফুল। বন্যপ্রকৃতি এখানে আত্মহারা, লীলাময়ী। আপনার সৌন্দর্য ও নিবিড় প্রাচুর্যে আপনি মুগ্ধ।
শঙ্করের মধ্যে যে সৌন্দর্যপ্রিয় ভাবুক মনটি ছিল, (হাজার হোক সে বাঙলার মাটির ছেলে, ডিয়েগো আলভারেজের মতো শুধু কঠিন প্রাণ স্বর্ণান্বেষী প্রসপেক্টর নয়) এই রূপের মেলায় সে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে রাঙা অপরাহ্নে ও দুপুর রোদে আপন মনে কত কি স্বপ্নজাল রচনা করে।
অনেক রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, অচেনা তারাভরা বিদেশের আকাশের তলায় রহস্যময়ী বন্য প্রকৃতি তখন যেন জেগে উঠেছে— জঙ্গলের দিক থেকে কত বন্যজন্তুর ডাক কানে আসে। শঙ্করের চোখে ঘুম নেই, এই সৌন্দর্যস্বপ্নে বিভোর হয়ে, মধ্য-আফ্রিকার নৈশ শীতলতাকে তুচ্ছ করেও সে জেগে বসে থাকে।
ঐ জ্বলজ্বলে সপ্তর্ষিমন্ডল— আকাশের অনেকদূরে তার ছোট গ্রামের মাথায়ও আজ অমনি সপ্তর্ষিমন্ডল উঠেছে, ঐ রকম একফালি কৃষ্ণপক্ষের গভীর রাত্রির চাঁদও। সেসব পরিচিত আকাশ ছেড়ে কতদূরে এসে সে পড়েছে, আরও কতদূরে তাকে যেতে হবে, কী এর পরিণতি কে জানে!
দু’দিন পরে বোট এসে সানকিনি পৌঁছুল। সেখান থেকে ওরা আবার পদব্রজে রওনা হল। জঙ্গল এদিকে বেশি নেই, কিন্তু দিগন্তপ্রসারী জনমানবহীন প্রান্তর ও অসংখ্য ছোট বড় পাহাড়, অধিকাংশ পাহাড় রুক্ষ ও বৃক্ষশূন্য, কোনো কোনো পাহাড়ে ইউফোর্বিয়া জাতীয় গাছের ঝোপ। কিন্তু শঙ্করের মনে হল, আফ্রিকার এই অঞ্চলের দৃশ্য বড় অপরূপ। এতটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে মন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। সূর্যাস্তের রং, জোত্‍স্নারাত্রির মায়া, এই দেশকে রাত্রে অপরাহ্নে রূপকথার পরীরাজ্য করে তোলে।
আলভারেজ বললে— এই ভেল্ড অঞ্চলে সব জায়গা দেখতে এক রকম বলে পথ হারাবার সম্ভাবনা কিন্তু খুব বেশি।
কথাটা যেদিন বলা হল, সেদিনই এক কান্ড ঘটল। জনহীন ভেল্ডে সূর্য অস্ত গেলে ওরা একটা ছোট পাহাড়ের আড়ালে তাঁবু খাটিয়ে আগুন জ্বাললে— শঙ্কর জল খুঁজতে বেরুল। সঙ্গে আলভারেজের বন্দুকটা নিয়ে গেল, কিন্তু মাত্র দুটি টোটা। আধ ঘন্টা এদিক ওদিক ঘুরে বেলাটুকু গেল, পাতলা অন্ধকার সমস্ত প্রান্তরকে ধীরে ধীরে আবৃত করে দিলে। শঙ্কর শপথ করে বলতে পারে, সে আধঘন্টার বেশি হাঁটেনি। হঠাৎ চারধারে চেয়ে শঙ্করের কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হল, যেন কী একটা বিপদ আসছে, তাঁবুতে ফেরা ভালো। দূরে দূরে ছোট বড় পাহাড়, একই রকম দেখতে সবদিক, কোনো চিহ্ন নেই, সব একাকার।
মিনিট পাঁচ-ছয় হাঁটবার পরই শঙ্করের মনে হল সে পথ হারিয়েছে। তখন আলভারেজের কথা তার মনে পড়ল। কিন্তু তখনো সে অনভিজ্ঞতার দরুন বিপদের গুরুত্বটা বুঝতে পারলে না। হেঁটেই যাচ্ছে— হেঁটেই যাচ্ছে— একবার মনে হয় সামনে, একবার মনে হয় বাঁয়ে, একবার মনে হয় ডাইনে। তাঁবুর আগুনের কুন্ডটা দেখা যায় না কেন? কোথায় সেই ছোট পাহাড়টা?
দু’ঘন্টা হাঁটবার পরে শঙ্করের খুব ভয় হল। ততক্ষণে সে বুঝেছে যে সে সম্পূর্ণরূপে পথ হারিয়েছে এবং ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। একা তাকে রোডেসিয়ার এই জনমানবশূন্য, সিংহসঙ্কুল অজানা প্রান্তরে রাত কাটাতে হবে— অনাহারে এবং এই কনকনে শীতে বিনা কম্বলে ও বিনা আগুনে। সঙ্গে একটা দেশলাই পর্যন্ত নেই।
ব্যাপারটা সংক্ষেপে এই দাঁড়াল যে— পরদিন সন্ধ্যার পূর্বে অর্থাৎ পথ হারানোর চব্বিশ ঘন্টা পরে, উদ্ভ্রান্ত, তৃষ্ণায় মুমূর্ষু শঙ্করকে, ওদের তাঁবু থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে, একটা ইউফোর্বিয়া গাছের তলা থেকে আলভারেজ উদ্ধার করে তাঁবুতে নিয়ে এল।
আলভারেজ বললে— তুমি যে পথ ধরেছিলে শঙ্কর, তোমাকে আজ খুঁজে বার করতে না পারলে তুমি গভীর থেকে গভীরতর মরুপ্রান্তরের মধ্যে গিয়ে পড়ে, কাল দুপুর নাগাদ তৃষ্ণায় প্রাণ হারাতে। এর আগে তোমার মতো অনেকেই রোডেসিয়ার ভেল্ডে এ ভাবে মারা গিয়েছে। এ সব ভয়ানক জায়গা। তুমি আর কখনো তাঁবু থেকে ও রকম বেরিও না, কারণ তুমি আনাড়ি। মরুভূমিতে ভ্রমণের কৌশল তোমার জানা নেই, ডাহা মারা পড়বে।
শঙ্কর বললে— আলভারেজ, তুমি দু’বার আমার প্রাণ রক্ষা করলে, এ আমি ভুলব না।
আলভারেজ বললে— ইয়্যাংম্যান, ভুলে যাচ্ছ যে তার আগে তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। তুমি না থাকলে ইউগান্ডার তৃণভূমিতে আমার হাড়গুলো সাদা হয়ে আসতো এতদিনে।
মাস দুই ধরে রোডেসিয়া ও এঙ্গোলার মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ ভেল্ড অতিক্রম করে, অবশেষে দূরে মেঘের মতো পর্বতশ্রেণী দেখা গেল। আলভারেজ ম্যাপ মিলিয়ে বললে— ওই হচ্ছে আমাদের গন্তব্যস্থান, রিখটারসভেল্ড পর্বত, এখনো এখান থেকে চল্লিশ মাইল হবে। আফ্রিকার এইসব খোলা জায়গায় অনেক দূর থেকে জিনিস দেখা যায়।
এ অঞ্চলে অনেক বাওবাব গাছ। শঙ্করের এ গাছটা বড় ভালো লাগে— দূর থেকে যেন মনে হয় বট কি অশ্বত্থ গাছের মতো, কিন্তু কাছে গেলে দেখা যায় বাওবাব গাছ, ছায়াবিরল অথচ বিশাল, আঁকাবাঁকা সারা গায়ে যেন বড় বড় আঁচিল কি আব্‌ বেরিয়েছে, যেন আরব্য উপন্যাসের একটা বেঁটে, কুদর্শন, কুব্জ দৈত্য। বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এখানে ওখানে প্রায় সর্বত্রই দূরে নিকটে বড় বড় বাওবাব গাছ দাঁড়িয়ে।
একদিন সন্ধ্যাবেলার দুর্জয় শীতে তাঁবুর সামনে আগুন করে বসে আলভারেজ বললে— এই যে দেখছ রোডেসিয়ার ভেল্ড অঞ্চল, এখানে হীরে ছড়ানো আছে সর্বত্র, এটা হীরের খনির দেশ। কিম্বার্লি খনির নাম নিশ্চয়ই শুনেছ। আরও অনেক ছোটখাটো খনি আছে, এখানে ওখানে ছোট বড় হীরের টুকরো কত লোক পেয়েছে, এখনো পায়।
কথা শেষ করেই বলে উঠল— ও কারা?
শঙ্কর সামনে বসে ওর কথা শুনছিল। বললে— কোথায়? কে?
কিন্তু আলভারেজের তীক্ষ্ণদৃষ্টি তার হাতের বন্দুকের গুলির মতোই অব্যর্থ, একটু পরে তাঁবু থেকে দূরে অন্ধকারে কয়েকটি অস্পষ্ট মূর্তি এদিকে এগিয়ে আসছে, শঙ্করের চোখে পড়ল। আলভারেজ বললে— শঙ্কর, বন্দুক নিয়ে এসো, চট করে যাও, টোটা ভরে—
বন্দুক হাতে শঙ্কর বাইরে এসে দেখলে, আলভারেজ নিশ্চিন্ত মনে ধূমপান করছে, কিছুদূরে অজানা মূর্তি কয়টি এখনো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আসছে। একটু পরে তারা এসে তাঁবুর অগ্নিকুন্ডের বাইরে দাঁড়াল। শঙ্কর চেয়ে দেখলে আগন্তুক কয়েকটি কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘকায়— তাদের হাতে কিছু নেই, পরনে লেংটি, গলায় সিংহের লোম, মাথায় পালক— সুগঠিত চেহারা। তাঁবুর আলোয় মনে হচ্ছিল, যেন কয়েকটি ব্রোঞ্জের মূর্তি।
আলভারেজ জুলু ভাষায় বললে— কি চাও তোমরা?
ওদের মধ্যে কি কথাবার্তা চলল, তারপর ওরা সব মাটির ওপর বসে পড়ল। আলভারেজ বললে— শঙ্কর, ওদের খেতে দাও—
তারপর অনুচ্চস্বরে বললে— বড় বিপদ। খুব হুঁশিয়ার, শঙ্কর!
টিনের খাবার খোলা হল। সকলের সামনেই খাবার রাখলে শঙ্কর। আলভারেজও ওই সঙ্গে আবার খেতে বসল যদিও সে ও শঙ্কর সন্ধ্যার সময়েই তাদের নৈশ আহার শেষ করেছে। শঙ্কর বুঝলে আলভারেজের কোনো মতলব আছে, কিংবা এদেশের রীতি অতিথির সাথে খেতে হয়।
আলভারেজ খেতে খেতে জুলু ভাষায় আগন্তুকদের সঙ্গে গল্প করছে, অনেকক্ষণ পরে খাওয়া শেষে ওরা চলে গেল। যাবার আগে সবাইকে একটা করে সিগারেট দেওয়া হল।
ওরা চলে গেলে আলভারেজ বললে— ওরা মাটাবেল জাতির লোক। ভয়ানক দুর্দান্ত, ব্রিটিশ গভর্ণমেন্টের সঙ্গে অনেকবার লড়েছে। শয়তানকেও ভয় করে না। ওরা সন্দেহ করেছে আমরা ওদের দেশে এসেছি হীরের খনির সন্ধানে। আমরা যে জায়গাটায় আছি, এটা ওদের একজন সর্দারের রাজ্য। কোনো সভ্য গভর্ণমেন্টের আইন এখানে খাটবে না। ধরবে আর নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে মারবে। চল আমরা তাঁবু তুলে রওনা হই।
শঙ্কর বললে— তবে তুমি বন্দুক আনতে বললে কেন?
আলভারেজ হেসে বললে— দেখ, ভেবেছিলাম যদি ওরা খেয়েও না ভোলে, কিংবা কথাবার্তায় বুঝতে পারি যে, ওদের মতলব খারাপ, ভোজনরত অবস্থাতেই ওদের গুলি করবো। এই দ্যাখো রিভলবার পিছনে রেখে তবে খেতে বসেছিলাম, এ ক’টাকে সাবাড় করে দিতাম। আমার নাম আলভারেজ, আমিও এককালে শয়তানকে ভয় করতুম না, এখনো করিনে। ওদের হাতের মাছ মুখে পৌঁছবার আগেই আমার পিস্তলের গুলি ওদের মাথার খুলি উড়িয়ে দিত।
আরও পাঁচ-ছ’দিন পথ চলবার পরে একটা খুব বড় পর্বতের পাদমূলে নিবিড় ট্রপিক্যাল অরণ্যানীর মধ্যে ওরা প্রবেশ করলে। স্থানটি যেমন নির্জন, তেমনি বিশাল। সে বন দেখে শঙ্করের মনে হল, একবার যদি সে এর মধ্যে পথ হারায় সারাজীবন ঘুরলেও বার হয়ে আসবার সাধ্য তার হবে না। আলভারেজও তাকে সাবধান করে দিয়ে বললে— খুব হুঁশিয়ার শঙ্কর, বনে চলাফেরা যার অভ্যাস নেই, সে পদে পদে এইসব বনে পথ হারাবে। অনেক লোক বেঘোরে পড়ে বনের মধ্যে মারা পড়ে। মরুভূমির মধ্যে যেমন পথ হারিয়ে ঘুরেছিলে, এর মধ্যেও ঠিক তেমনিই পথ হারাতে পার। কারণ এখানে সবই একরকম, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গাকে পৃথক করে চিনে নেবার কোনো চিহ্ন নেই। ভালো বুশম্যান না হলে পদে পদে বিপদে পড়তে হবে। বন্দুক না নিয়ে এক পা কোথাও যাবে না, এটিও যেন মনে থাকে। মধ্য-আফ্রিকার বন শৌখিন ভ্রমণের পার্ক নয়।
শঙ্করকে তা না বললেও চলতো, কারণ এসব অঞ্চল যে শখের পার্ক নয়, তা এর চেহারা দেখেই সে বুঝতে পেরেছে। সে জিজ্ঞেস করলে— তোমার সেই হলদে হীরের খনি কতদূরে? এই তো রিখটারসভেল্ড পর্বতমালা, ম্যাপে যতদূর বোঝা যাচ্ছে।
আলভারেজ হেসে বললে— তোমার ধারণা নেই বললাম যে। আসল রিখটারসভেল্ডের এটা বাইরের থাক্‌। এরকম আরো অনেক থাক্‌ আছে। সমস্ত অঞ্চলটা এত বিশাল যে পুবে সত্তর মাইল ও পশ্চিম দিকে একশো থেকে দেড়শো মাইল পর্যন্ত গেলেও এ বন-পাহাড় শেষ হবে না। সর্বনিম্ন প্রস্থ চল্লিশ মাইল। সমস্ত জড়িয়ে আট-ন’হাজার বর্গমাইল সমস্ত রিখটারসভেল্ড পার্বত্য অঞ্চল ও অরণ্য। এই বিশাল অজানা অঞ্চলের কোনখানটাতে এসেছিলুম আজ সাত-আট বছর আগে, ঠিক সে জায়গাটা খুঁজে বার করা কি ছেলেখেলা ইয়্যাংম্যান?
শঙ্কর বললে— এদিকে খাবার ফুরিয়েছে, শিকারের ব্যবস্থা দেখতে হয়, নইলে কাল থেকে বায়ু ভক্ষণ করা ছাড়া উপায় নেই।
আলভারেজ বললে— কিচ্ছু ভেব না। দেখছ না গাছে গাছে বেবুনের মেলা। কিছু না মেলে, বেবুনের দাপনা ভাজা আর কফি দিয়ে দিব্যি ব্রেকফাস্ট খাব আজ থেকে। আজ আর নয়, তাঁবু ফেল, বিশ্রাম করা যাক।
একটা বড় গাছের নিচে তাঁবু খাটিয়ে ওরা আগুন জ্বাললে। শঙ্কর রান্না করলে, আহারাদি শেষ করে যখন দু’জনে আগুনের সামনে বসেছে, তখনো বেলা আছে।
আলভারেজ কড়া তামাকের পাইপ টানতে টানতে বললে— জানো শঙ্কর, আফ্রিকার এইসব অজানা অরণ্যে এখনো কত জানোয়ার আছে, যার খবর বিজ্ঞানশাস্ত্র রাখে না? খুব কম সভ্য মানুষ এখানে এসেছে। ওকাপি বলে যে জানোয়ার সে তো প্রথম দেখা গেল ১৯০০ সালে। এক ধরনের বুনো শুওর আছে, যা সাধারন বুনো শুওরের প্রায় তিনগুণ বড় আকারে। ১৮৮৮ সালে মোজেস কাউলে, পৃথিবী পর্যটক ও বড় শিকারী, সর্বপ্রথম ওই বুনো শুওরের সন্ধান পান বেলজিয়ান কঙ্গোর লুয়ালাবু অরণ্যের মধ্যে। তিনি বহু কষ্টে একটা শিকার করেন এবং নিউইয়র্ক প্রাণীবিদ্যা সংক্রান্ত মিউজিয়ামে উপহার দেন। বিখ্যাত রোডেসিয়ান মনস্টারের নাম শুনেছ?
শঙ্কর বললে— না, কী সেটা?
শোনো তবে। রোডেসিয়ার উত্তর সীমায় প্রকান্ড জলাভূমি আছে। ওদেশের অসভ্য জুলুদের মধ্যে অনেকেই এক অদ্ভুত ধরনের জানোয়ারকে এই জলাভূমিতে মাঝে মাঝে দেখেছে। ওরা বলে তার মাথা কুমিরের মতো, গন্ডারের মতো তার শিং আছে, গলাটা অজগর সাপের মতো লম্বা ও আঁশওয়ালা দেহটা জলহস্তীর মতো, লেজটা কুমিরের মতো। বিরাটদেহ এই জানোয়ারের প্রকৃতিও খুব হিংস্র। জল ছাড়া কখনো ডাঙায় এ জানোয়ারকে দেখা যায়নি। তবে এই সব অসভ্য দেশী লোকের অতিরঞ্জিত বিবরণ বিশ্বাস করা শক্ত।
কিন্তু ১৮৮০ সালে জেমস মার্টিন বলে একজন প্রসপেক্টর রোডেসিয়ার এই অঞ্চলে বহুদিন ঘুরেছিল সোনার সন্ধানে। মিস্টার মার্টিন আগে জেনারেল ম্যাথিউসের এডিকিং ছিলেন, নিজে একজন ভালো ভূতত্ত্ব ও প্রাণীতত্ত্ববিদও ছিলেন। ইনি তাঁর ডায়েরির মধ্যে রোডেসিয়ার এই অজ্ঞাত জানোয়ার দূর থেকে দেখেছেন বলে উল্লেখ করে গিয়েছেন। তিনিও বলেন জানোয়ারটা আকৃতিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগের ডাইনোসর জাতীয় সরীসৃপের মতো ও বেজায় বড়। কিন্তু তিনি জোর করে কিছু বলতে পারেননি, কারণ খুব ভোরের কুয়াশার মধ্যে কোভিরান্ডো হ্রদের সীমানায়, জলাভূমিতে আবছায়া ভাবে তিনি জানোয়ারটিকে দেখেছিলেন। জানোয়ারটার ঘোড়ার চিঁহিঁ ডাকের মতো ডাক শুনেই তাঁর সঙ্গের জুলু চাকরগুলো উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে পালাতে বললে— সাহেব পালাও, ডিঙ্গোনেক! ডিঙ্গোনেক! ডিঙ্গোনেক ঐ জানোয়ারটার জুলু নাম। দু-তিন বছরে এক আধবার দেখা দেয় কি না দেয়, কিন্তু সেটা এতই হিংস্র যে তার আবির্ভাব সে দেশের লোকের পক্ষে ভীষণ ভয়ের ব্যাপার। মিস্টার মার্টিন বলেন, তিনি তাঁর ৩০৩ টোটা গোটা দুই উপরি উপরি ছুঁড়েছিলেন জানোয়ারটার দিকে। অত দূর থেকে তাক হল হল না, রাইফেলের আওয়াজে সেটা সম্ভবত জলে ডুব দিলে।
শঙ্কর বললে— তুমি কি করে জানলে এ সব? মার্টিনের ডায়েরি ছাপানো হয়েছিল নাকি?
না, অনেকদিন আগে বুলাওয়েও ক্রনিকল কাগজে মিস্টার মার্টিনের এই ঘটনাটা বেরিয়েছিল। আমি তখন সবে এদেশে এসেছি। রোডেসিয়া অঞ্চলে আমিও প্রসপেক্টিং করে বেড়াতুম বলে জানোয়ারটার বিবরণ আমাকে খুব আকৃষ্ট করে। কাগজখানা অনেকদিন আমার কাছে রেখেও দিয়েছিলুম। তারপর কোথায় হারিয়ে গেল। ওরাই নাম দিয়েছিল জানোয়ারটার— ‘রোডেসিয়ান মনস্টার’।
শঙ্কর বললে— তুমি কোনো কিছু অদ্ভুত জানোয়ার দেখনি?
প্রশ্নটার সঙ্গে সঙ্গে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল।
তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে নেমে এসেছে। সেই আবছায়া আলো অন্ধকারের মধ্যে শঙ্করের মনে হল— হয়তো শঙ্করের ভুল হতে পারে— কিন্তু শঙ্করের মনে হল সে দেখলে আলভারেজ, দুর্ধর্ষ ও নির্ভীক আলভারেজ, দুঁদে ও অব্যর্থলক্ষ্য আলভারেজ, ওর প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল— এবং— এবং সেটাই সকলের চেয়ে আশ্চর্য— যেন পরক্ষণেই শিউরে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে আলভারেজ যেন নিজের অজ্ঞাতসারেই চারপাশের জনমানবহীন ঘন জঙ্গল ও রহস্যভরা দুরারোহ পর্বতমালার দিকে একবার চেয়ে দেখলে, কোনো কথা বললে না। যেন এই পর্বত-জঙ্গলে বহুকাল পরে এসে অতীতের কোনো বিভীষিকাময় পুরাতন ঘটনা ওর স্মৃতিতে ভেসে উঠেছে— যে স্মৃতিটা ওর পক্ষে খুব প্রীতিকর নয়।
আলভারেজ ভয় পেয়েছে!
অবাক! আলভারেজের ভয়! শঙ্কর ভাবতেও পারে না।
কিন্তু সেই ভয়টা অলক্ষিতে এসে শঙ্করের মনেও চেপে বসল। এই সম্পূর্ণ অজানা বিচিত্র রহস্যময় বনানী, এই বিরাট পর্বত প্রাচীর যেন এক গভীর রহস্যকে যুগ যুগ ধরে গোপন করে আসছে। যে বীর, যে নির্ভীক, এগিয়ে এসো সে— কিন্তু মৃত্যুপণে ক্রয় করতে হবে সেই গহন রহস্যের সন্ধান।
রিখটারসভেল্ড পর্বতমালা ভারতবর্ষের দেবাত্মা নগাধিরাজ হিমালয় নয়— এদেশের মাসাই, জুলু, মাটাবেল প্রভৃতি আদিম জাতির মতোই ওর আত্মা নিষ্ঠুর, বর্বর, নরমাংসলোলুপ। সে কাউকে রেহাই দেবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *