০৬. চন্দ্রহীন রাত্রি

চন্দ্রহীন রাত্রি। নন্দার ঘরে ক্ষীণ নৈশ-দীপ জ্বলিতেছে। নন্দা এখনও শয়ন করে নাই, জানালায় দাঁড়াইয়া নক্ষত্রখচিত অন্ধকারের পানে চাহিয়া আছে। আজ সে নিজের মনের কথা জানিতে পারিয়াছে; দিবাকরের প্রতি তাহার মনের ভাব শুধুই করুণা বা সহানুভূতি নয়।

তাহার চোখদুটি তারায় তারায় সঞ্চরণ করিতেছে। তারপর তাহার কণ্ঠ হইতে মৃদু বিগলিত সঙ্গীত বাহির হইয়া আসিল

দুজনে কইব কথা কানে কানে কানে কানে
        যেন তা কেউ না জানে কেউ না জানে।
        যে কথা যায় না ধরা যায় না ছোঁয়া
        তাহারি বেদন রবে গোপন প্রাণে।
        দুজনে কইব কথা–।
        যদি রই দূরে দূরে– দূরে দূরে—
        তুমি রও পথের পাশে, আমি রই গৃহচূড়ে
        তবুও ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যালোকে
        দুজনে কইব কথা চোখে চোখে।
        দুজনে কইব কথা–।
        যদি বা দেখা না পাই হারাই দিশা
        নয়নে নেমে আসে অন্ধ নিশা
        তখনও ক্ষণে ক্ষণে–ক্ষণে ক্ষণে–
        দুজনে কইব কথা মনে মনে।
        দুজনে কইব কথা–।

কোনও অশরীরী যদি জানালার বাহিরে উপস্থিত থাকিত তাহা হইলে দেখিতে পাইত, নন্দার জানালার পাশে আর একটি জানালায় একজন বিনিদ্র শ্রোতা দাঁড়াইয়া আছে ও তন্ময় হইয়া গান শুনিতেছে।

.

রাত্রি আরও গভীর হইয়াছে। দিবাকর আপন শয্যায় শয়ন করিয়া নিষ্পলক নেত্রে শূন্যে চাহিয়া আছে। ভোগবতীর ন্যায় কোন্ অন্তর্গূঢ় পথে তাহার চিন্তার ধারা প্রবাহিত হইতেছে তাহা তাহার মুখ দেখিয়া অনুমান করা যায় না।

নীচে হল-ঘরে ঘড়িতে দুইটা বাজিল। রাত্রির স্তব্ধতায় তাহার আওয়াজ উপরে ভাসিয়া আসিল। দিবাকর বিছানায় উঠিয়া বসিল। বস্ত্রাদি সংবরণ করিয়া খাট হইতে নামিল এবং নিঃশব্দে ঘর হইতে বাহির হইল।

বারান্দা পার হইয়া সে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিতে লাগিল। এই সময় নন্দার ঘরের দ্বার অল্প একটু খুলিয়া গেল। নন্দা মুখ বাড়াইয়া ক্ষণেক সিঁড়ির দিকে চাহিয়া রহিল; তাহার মুখ আবার সংশয়ের ছায়ায় আচ্ছন্ন হইয়াছে।

নন্দা বাহির হইয়া পা টিপিয়া টিপিয়া সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত গেল, নীচে উঁকি মারিল; তারপর দ্রুত ফিরিয়া আসিয়া নিজের ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।

কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল দিবাকর ফিরিয়া আসিতেছে। তাহার হাতে কি একটা রহিয়াছে, অন্ধকারে ভাল দেখা গেল না।

দিবাকর লঘুপদে নন্দার দ্বারের সম্মুখ দিয়া নিজের ঘরের দিকে যাইবে এমন সময় নন্দার দ্বার সহসা খুলিয়া গেল। দিবাকর থতমত খাইয়া হাত পিছনে লুকাইল।

নন্দা ইশারা করিয়া তাহাকে কাছে ডাকিল, খাটো গলায় বলিল–কোথায় গিয়েছিলেন?

দিবাকর বলিল—নীচে। একটু দরকার ছিল।

এত রাত্রে কী দরকার?

দিবাকর চুপ করিয়া রহিল।

নন্দা তখন বলিল—আপনার হাতে ও কি? লুকোচ্ছেন কেন?

একখানা বই।

বই!! কী বই? দেখি—

একটু ইতস্তত করিয়া দিবাকর বইখানি নন্দার হাতে দিল। নন্দা বই চোখের কাছে আনিয়া শিরোনামা পড়িয়া অবাক হইয়া গেল। মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী, বাংলা অনুবাদ।

মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনী! এ বই–?

নন্দা উৎফুল্ল বিস্ময়ে দিবাকরের পানে চাহিল। দিবাকর একটু নীরব থাকিয়া ধরাধরা গলায় বলিল—পড়ব। মহাপুরুষদের জীবনী আমার মতো পথহারাকে পথ দেখাবার জন্যেই তো লেখা হয়েছে।

নন্দার হৃদয় যেন দ্রবীভূত হইয়া টলমল করিতে লাগিল। সে বইখানি দিবাকরের হাতে ফিরাইয়া দিল। মহাপুরুষের পূত জীবনচরিতের উপর তাহাদের হাতে হাত মিলিত হইল।

.

সোনালী রৌদ্রভরা প্রভাত।

বাড়ির পাশে গোলাপ বাগান; শিশিরে ঝলমল করিতেছে। নন্দা একটি গানের কলি মৃদুকণ্ঠে গুঞ্জন করিতে করিতে ফুল তুলিতেছিল। তাহার মুখখানি শিশির-খচিত অর্ধ-বিকচ গোলাপ ফুলের মতোই নবোন্মোষিত অনুরাগের বর্ণে রঞ্জিত।

কয়েকটি সবৃন্ত গোলাপ তুলিয়া নন্দা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল। ঠাকুরঘর হইতে ঠুং ঠুং ঘন্টির আওয়াজ আসিতেছে। যদুনাথ পূজায় বসিয়াছেন; যুক্ত করে মুদিত চক্ষে মন্ত্র পড়িতেছেন, আর মাঝে মাঝে ঘণ্টি নাড়িতেছেন। নন্দা আসিয়া দুইটি গোলাপ ফুল ঠাকুরের সিংহাসন প্রান্তে রাখিয়া প্রণাম করিল, তারপর নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল।

ড্রয়িংরুমে দিবাকর খোলা জানালায় পিঠ দিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছে, কাগজে তাহার মুখ ঢাকা পড়িয়াছে। নন্দা আসিয়া টেবিলের ফুলদানিতে ফুল রাখিল। দিবাকর কাগজে মগ্ন, নন্দার আগমন জানিতে পারিল না। না তখন একটু গলা ঝাড়া দিয়া নিজের অস্তিত্ব জানাইয়া দিল। দিবাকর তাড়াতাড়ি কাগজ নামাইয়া দেখিল, নন্দা ঘাড় বাঁকাইয়া মৃদু হাসিতে হাসিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইতেছে।

উপরে নিজের ঘরে গিয়া নন্দা বাকি ফুলগুলি ফুলদানিতে সাজাইয়া রাখিল। কিন্তু একটি ফুলের স্থানাভাব ঘটিল, ফুলদানিতে ধরিল না। নন্দা ফুলটি হাতে লইয়া এদিক ওদিক তাকাইল, কিন্তু কোথাও ফুলটি রাখিবার উপযুক্ত স্থান পাইল না। তখন সে মুখ টিপিয়া একটু হাসিয়া ঘর হইতে বাহির হইল।

দিবাকরের ঘরে চুপি চুপি প্রবেশ করিয়া নন্দা দেখিল সেখানেও ফুল রাখিবার কোনও পাত্র নাই। দিবাকরের সদ্যপরিষ্কৃত বিছানা পাতা রহিয়াছে। নন্দা গিয়া ফুলটি মাথার বালিশের উপর রাখিয়া দিল, তারপর লজ্জারুণ মুখে ঘর হইতে পলাইল আসিল।

নীচে ড্রয়িংরুমে দিবাকর তখনও সংবাদপত্র পাঠ শেষ করে নাই, যদুনাথ লাঠি ধরিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন; তাঁহার পশ্চাতে সেবক।

যদুনাথ বলিলেন—এই যে দিবাকর

দিবাকর তাড়াতাড়ি কাগজ মুড়িয়া আগাইয়া আসিল।

আজ্ঞে—

যদুনাথ চেয়ারে বসিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়া মনে হয় দিবাকরের প্রতি তাঁহার প্রীতির ভাব আরও গভীর হইয়াছে। তিনি প্রশ্ন করিলেন—তারপর, কাগজে নতুন খবর কিছু আছে কি?

দিবাকর বলিল—কিছু না। তবে জিনিসপত্তরের দাম বেড়েই চলেছে; একে লগনসা চলছে, তার ওপর দোলও এসে পড়ল—

যদুনাথ বলিলেন—ওঃ তাই তো, দোল এসে পড়ল; এখনও দোলের বাজার করা হয়নি। সেবক, নন্দাকে ডাক—

সেবক হাত ঘষিতে ঘষিতে বলিল—এবার কিন্তু বাবু আমার এক শিশি চামেলির তেল চাই, তা বলে দিচ্ছি।

তুই চামেলির তেল কি করবি?

বৌ চেয়েছে। বলিয়া সেবক সলজ্জভাবে নন্দাকে ডাকিতে গেল।

দিবাকর জিজ্ঞাসা করিল–কি কি বাজার করতে হবে?

যদুনাথ বলিলেন—আমি কি ছাই সব জানি! নন্দা জানে। পুজোর সময় আর দোলের সময় অনেক বাজার করতে হয়; নিজেদের জন্যে, চাকরবাকরদের জন্যে কাপড়-চোপড়, আরো কত কি। এই যে নন্দা।

সেবকের দ্বারা অনুসৃত হইয়া নন্দা প্রবেশ করিল। বলিল—

দাদু, আজ কি দোলের বাজার করতে যাওয়া হবে?

যদুনাথ বলিলেন-আজ! তা বেশ, আজই যা।

নন্দা বলিল—তুমি যাবে না?

আমি পারব না, আমার হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে। মন্মথ কোথায়?

দাদা ঘুমচ্ছে। দাদা কি নটার আগে কোনও দিন বিছানা ছেড়ে ওঠে!

হুঁ, লগ্নে কেতু কিনা, ও তো আলসেকুঁড়ে হবেই। তমোগুণ—তমোগুণ। তা দিবাকর যাক তোর সঙ্গে।

নন্দা মনে মনে খুশি হইল, কিন্তু বাহিরে তাহা প্রকাশ করিল না। বলিল—বেশ তো। কেউ একজন হলেই হল।

দিবাকর বলিল—কি কি কিনতে হবে তার একটা ফিরিস্তি—

নন্দা বলিল—ফিরিস্তি আমার তৈরি আছে।

সেবক বলিল—আমার চামেলি তেল কিন্তু ভুলো না দিদিমণি।

নন্দা বলিল—আচ্ছা আচ্ছা। তুই ড্রাইভারকে গাড়ি বার করতে বল্। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া ভাল, বারোটার আগে ফিরতে পারব।

সেবক বলিল-ডেলেভর কোথায়? ডেলেভর তো দুদিনের ছুটি নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছে।

যদুনাথ মুখ তুলিলেন—সত্যি তো, আমার মনে ছিল না। তা আজ না হয় থাক; কাল যাস নন্দা।

নন্দা ক্ষুণ্ণ হইল। বাজার করিতে যাইবার প্রস্তাবে বিঘ্ন ঘটিলে মেয়েরা স্বভাবতই মনঃপীড়া পান। দিবাকর তাহা দেখিয়া সঙ্কোচভরে বলিল—

তা যদি হুকুম করেন আমি মোটর চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব।

যদুনাথ ও নন্দা উভয়েরই চক্ষু বিস্ফারিত হইল।

যদুনাথ বলিলেন—অ্যা। তুমি মোটর চালাতেও জানো?

দিবাকর বলিল—আজ্ঞে কিছুদিন মোটর-ড্রাইভারের চাকরি করেছিলাম—

যদুনাথ খুশি হইলেন-বা বা। তুমি তো দেখছি ঝালে ঝোলে অম্বলে সব তাতেই আছ! বেশ বেশ। হবেই বা না কেন? হাজার হোক মেষ! তাহলে নন্দা, দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়—

হ্যাঁ দাদু, আমি পাঁচ মিনিটে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

নন্দা বস্ত্রাদি পরিবর্তনের জন্য দ্রুত চঞ্চল আনন্দে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

.

রাজপথ। যদুনাথের মিনার্ভা গাড়ি দিবাকরের দ্বারা চালিত হইয়া একটি বৃহৎ বস্ত্রালয়ের সামনে আসিয়া থামিল। নন্দা চালকের পাশের আসনে বসিয়াছিল, উভয়ে অবতরণ করিয়া দোকানে প্রবেশ করিল।

এইরূপে এক দোকান হইতে অন্য দোকানে, বস্ত্রালয় হইতে জুতার দোকানে, সেখান হইতে মনিহারীর দোকানে গিয়া বাজার করা যখন শেষ হইল তখন গাড়ির পিছনের আসনে পণ্যদ্রব্য স্তূপীকৃত হইয়াছে।

গাড়িতে বসিয়া ফিরিস্তি দেখিতে দেখিতে নন্দা বলিল—মনে তো হচ্ছে সবই কেনা হয়েছে।

দিবাকর প্রশ্ন করিল—সেবকের চামেলির তেল?

হ্যাঁ।

তাহলে এবার ফেরা যেতে পারে?

আপনি ফেরবার জন্যে ভারি ব্যস্ত যে!

ব্যস্ত নয়। তবে এখনও গোটা পঞ্চাশেক টাকা বাকি আছে, আর একটা দোকানে ঢুকলে কিছু থাকবে না।

নন্দা হাসিয়া উঠিল। দিবাকর গাড়িতে স্টার্ট দিল, গাড়ি চলিতে আরম্ভ করিল।

নন্দা বলিল—আপনি দেখছি ভারি হিসেবী।

দিবাকর বলিল—ভয়ঙ্কর। আপনিই তো শিখিয়েছেন।

একেই বলে গুরু-মারা চেলা!

এই সময় একটা মোড়ের কাছে আসিয়া দিবাকর মোটর ঘুরাইবার উপক্রম করিল; নন্দা অমনি স্টিয়ারিংয়ের উপর হাত রাখিয়া গাড়ির গতি সোজা পথে চালিত করিল। গাড়ি আঁকাবাঁকা টাল খাইয়া ঋজু পথে চলিল।

দিবাকর সবিস্ময়ে নন্দার পানে তাকাইল।

এ কি! আর একটু হলেই অ্যাসিডেন্ট হত।

নন্দা বলিল—হয়নি তো।

কিন্তু ব্যাপার কি? বাড়ির পথ যে ওদিকে!

সামনে কিন্তু সোজা পথ। বাঁকা পথের চেয়ে সোজা পথ কি ভাল নয়?

ভাল। তাহলে কি এখন সোজা পথেই যাওয়া হবে, বাড়ি ফেরা হবে না?

বাড়ি ফেরার এখনও ঢের সময় আছে, এই তো সবে সাড়ে দশটা। চলুন, শহরের বাইরে একটু ঘুরে আসা যাক। কত দিন যে ভোলা হাওয়ায় বেড়াইনি!

বেশ চলুন। এটা কিন্তু হিসেবের মধ্যে ছিল না।

নির্জন পথের উপর দিয়া মোটর ছুটিয়া চলিয়াছে। দুই পাশে অবারিত মাঠ, মাঝে মাঝে তরুগুল্ম; দূরে ভাগীরথীর রজতরেখা। নন্দা উৎফুল্ল চঞ্চল চোখে চারিদিকে চাহিতেছে, দিবাকর কিন্তু স্থির দৃষ্টিতে সম্মুখে তাকাইয়া অবিচলিত মুখে গাড়ি চালাইতেছে।

নন্দা বলিয়া উঠিল—কী চমৎকার! রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়ে যায়—

নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি
        গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।

দিবাকর বলিল—হুঁ।

নন্দা বলিল—কিন্তু আপনি তো কিছুই দেখছেন না। চুপটি করে বসে বসে কী ভাবছেন?

দিবাকর বলিল—ভাবছি

আছে শুধু পাখা, আছে মহানভ-অঙ্গন
          ঊষা দিশাহারা নিবিড় তিমির ঢাকা।
          ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
          এখনি অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

নন্দা চকিত চক্ষে দিবাকরের পানে চাহিল, যেন দিবাকরের মুখে সে রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রত্যাশা করে নাই।

কিছুক্ষণ কথা হইল না। গাড়ি ছুটিয়া চলিল। রাস্তা হইতে এক রশি দূরে ঢিপির উপর একটি ক্ষুদ্র মন্দির দেখা যাইতেছে; মন্দিরটি জীর্ণ এবং পুরাতন।

নন্দা বলিল—দেখুন দেখুন—মন্দির! বোধহয় শিব মন্দির।

দিবাকর বলিল—উহু। শিব মন্দির হলে মাথায় ত্রিশূল থাকত।

তবে কার মন্দির?

তা জানি না। হনুমানজীর হতে পারে।

কখনো না। আমি বলছি শিব মন্দির-দিবাকর মাথা নাড়িল বেশ, বাজি রাখুন।

দিবাকর বিবেচনা করিয়া বলিল—এক পয়সা বাজি রাখতে পারি। কিন্তু প্রমাণ হবে কি করে?

নন্দা বলিল—গাড়ি দাঁড় করান, চোখে দেখলেই সন্দেহ ভঞ্জন হবে।

দিবাকর গাড়ি থামাইল; নন্দা নামিয়া পড়িল।

দিবাকর বলিল—এক পয়সার জন্যে এত পরিশ্রম করতে হবে?

হ্যাঁ, নামুন। চলুন মন্দিরে। দিবাকর নামিয়া গাড়ি লক্ করিল।

দিবাকর বলিল—চলুন। কিন্তু মিছে ওঠা-নামা হবে। মন্দিরে হয়তো চামচিকে আর ইঁদুর ছাড়া কোনও দেবতাই নেই।

নন্দা উৎসাহ দেখাইয়া বলিল—-নিশ্চয় আছে। একটু কষ্ট না করলে কি দেবদর্শন হয়!

রাস্তা ছাড়িয়া দুজনে মাঠ ধরিল। ঢিপির পাদমূল হইতে ভগ্নপ্রায় এক প্রস্থ সিঁড়ি মন্দির পর্যন্ত উঠিয়া গিয়াছে।

সিঁড়ি দিয়া উঠিতে উঠিতে তাহারা শুনিতে পাইল, কেহ একতারা বাজাইয়া মৃদুকণ্ঠে ভজন গাহিতেছে। নন্দা উজ্জ্বল চক্ষে দিবাকরের পানে চাহিল।

শুনছেন?

দিবাকর কহিল—শুনছি। ছুঁচোর কীর্তন নয়, মানুষ বলেই মনে হচ্ছে।

তাহারা মন্দিরের সম্মুখে উপস্থিত হইলে, ভিতর হইতে এক পুরুষ বাহির হইয়া আসিলেন। বৃদ্ধ। ব্যক্তি; চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ; মাথার উপর পাকা চুল চূড়া করিয়া বাঁধা; মুখে প্রসন্ন হাসি। হাতে দুইটি ফুলের মালা লইয়া তিনি নন্দা ও দিবাকরের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন—এস মা! এস বাবা! এত দূরে কেউ আসে না। আজ তোমাদের দেখে বড় আনন্দ হল। এই নাও ঠাকুরের নির্মাল্য। চিরসুখী হও তোমরা, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লাভ কর।

বৃদ্ধ দুজনের গলায় মালা দুটি পরাইয়া দিলেন। বৃদ্ধের ভুল বুঝিতে পারিয়া দুজনে অতিশয় লজ্জিত হইয়া পড়িল। নন্দা তাড়াতাড়ি টাকা বাহির করিতে করিতে আরক্ত মুখে বলিল—

মন্দিরে কোন্ ঠাকুর আছেন?

পুরোহিত বলিলেন—মা, আমার ঠাকুরের নাম ননীচোরা। বৃন্দাবনে যিনি গোপিনীদের ননী চুরি করে খেতেন ইনি সেই বাল-গোপাল।

নন্দা মন্দিরের দ্বারে টাকা রাখিয়া প্রণাম করিল; দিবাকরও প্রণাম করিল। পুরোহিত আবার আশীর্বাদ করিলেন—

আমার প্রেমময় ঠাকুর তোমাদের মঙ্গল করুন। চিরায়ুষ্মতী হও মা, ফলে ফুলে তোমাদের সংসার ভরে উঠুক—

দিবাকর ও নন্দা তাড়াতাড়ি নামিয়া চলিল; পুরোহিত স্মিতমুখে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

অনেকগুলি ধাপ নামিয়া নন্দা একটি চত্বরের মতো স্থানে বসিল। মুখে লজ্জার সহিত চাপা কৌতুক খেলা করিতেছে। সে এপাশে ওপাশে চাহিয়া নিরীহভাবে বলিল—বেশ জায়গাটি। ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না।

দিবাকরের মুখ গম্ভীর, কিন্তু চোখে দুষ্টামি উকিঝুঁকি মারিতেছে।

হুঁ-কিন্তু আমি ভাবছি

কি ভাবছেন?

ভাবছি ঠাকুরেরও চুরি করা অভ্যেস ছিল।

ঠাকুর তো খালি ননী চুরি করতেন।

শুধু ননী নয়, শুনেছি আরও অনেক কিছু চুরি করেছিলেন।

যেমন–?

যেমন গোপিনীদের মন।

তা সত্যি। – নন্দা যেন চিন্তিত হইয়া গালে হাত দিল।

দিবাকর বলিল—কি ভাবছেন?

নন্দা বলিল—ভাবছি সব চোরেরই কি এক রকম স্বভাব!

দিবাকর চকিত হইয়া বলিল—তার মানে?

নন্দা বলিল—মানে সব চোরই কি মেয়েদের মন চুরি করে!

দিবাকর দৃঢ়স্বরে প্রতিবাদ করিল-না না, ও সব বাজে গুজব। চোরেদের স্বভাব মোটেই ওরকম নয়। দেখুন, আপনি চোরেদের নামে মিথ্যে দুর্নাম দেবেন না।

নন্দা বলিল–অর্থাৎ আপনি বলতে চান যে আপনি কখনও কোনও মেয়ের মন চুরি করেননি?

দিবাকর মাথা নাড়িল-না, কখখনো না। ও সব আমার ভালই লাগে না।

নন্দা মুখ টিপিয়া হাসিল। এই সময় মন্দির হইতে একতারা সহযোগে ভজনের সুর ভাসিয়া আসিল। দুজনে শান্ত হইয়া শুনিতে লাগিল।

নাচ নাচ মন-মোর—
        আওল নওল কিশোর।
        প্রেম-চন্দনে অঙ্গ রঙ্গই।
        নাচত মাখন-চোর
        নাচ নাচ মন-মোর।
        চূড়া-পর, মরি, পিঞ্ছ নাচত, নাচে গলে বনমাল
        মণি-মঞ্জীর চরণপর চঞ্চল, চপল করে করতাল।
        নাচ রে শ্যাম কিশোর, বৃন্দাবন চিত-চোর,
        গোপবধু মন প্রীতিরস-ঘন
        পুলকভরে তনু ভোরনাচ নাচ মন-মোর।

ঘণ্টাখানেক পরে।

যদুনাথের ফটক। দিবাকর গাড়ি চালাইয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।

এদিকে হল-ঘরের টেবিল ঘিরিয়া তিনজন বসিয়া ছিলেন : যদুনাথ, মন্মথ ও পুলিস ইন্সপেকটর। সেবক নিকটে দাঁড়াইয়া ছিল। ইন্সপেকটর গম্ভীর মুখে বলিতেছিলেন—

যখন চোরের জুতো জোড়া নিয়ে গিয়েছিলাম তখন ভাবিনি যে ও থেকে চোরের কোনও হদিস পাওয়া যাবে। রুটিন মতো জুতো জোড়া পরীক্ষার জন্য হেড় অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আজ হেড অফিস থেকে খবর পেয়েছি

যদুনাথ সাগ্রহে প্রশ্ন করিলেন—কী খবর পেয়েছেন?

ইন্সপেকটর বলিলেন—আমরা ভেবেছিলাম ছিচকে চোর। কিন্তু তা নয়। জুতো থেকে সনাক্ত হয়েছে যে চোর-কানামাছি!

এই সময় একটা আকস্মিক শব্দ শুনিয়া সকলে ফিরিয়া দেখিলেন নন্দা ও দিবাকর অদূরে দাঁড়াইয়া আছে। দিবাকরের হাতে একটা জুতার বাক্স ছিল, তাহা তাহার হাত হইতে খসিয়া মাটিতে পড়িয়াছে। নন্দা যেন পাথরে পরিণত হইয়াছে। দিবাকরের মুখ ভাবলেশহীন; সে নত হইয়া জুতার বাক্সটা তুলিয়া লইল।

যদুনাথ ইন্সপেকটরকে অধীর প্রশ্ন করিলেন—কানামাছি! সে আবার কে?

ইন্সপেকটর বলিলেন—কানামাছির নাম শোনেননি? একজন নামজাদা চোর। খবরের কাগজে তার কথা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়।

নন্দা নিঃশব্দে আসিয়া যদুনাথের পিছনে দাঁড়াইয়াছে। সে একবার দিবাকরের দিকে চোখ তুলিল; তাহার চোখে চাপা আগুন।

মন্মথ বলিল—হ্যাঁ হ্যাঁ, কাগজে পড়েছি বটে। আপনি বলতে চান সেই কানামাছি আমাদের বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিল? কিন্তু জুতো থেকে তা বুঝলেন কি করে?

ইন্সপেকটর বলিলেন-এর একটা ইতিহাস আছে। প্রায় তিন বছর ধরে এই চোর অনেক বড় মানুষের বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছে, অনেক টাকা চুরি করেছে। একলা আসে একলা যায়, তার সঙ্গী-সাথী নেই। কিন্তু একবার সে একজনের বাড়িতে চুরি করতে ঢুকেছিল, বাড়ির লোকেরা জেগে উঠে তাকে তাড়া করে। কানামাছি পালালো, কিন্তু তার পুরোনো জুতো জোড়া ফেলে গেল। সেই জুতো পুলিসের কাছে আছে। আপনার বাড়িতে যে-জুতো পাওয়া গেছে তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেল, অবিকল কানামাছির পায়ের ছাপ। সুতরাং

সেবক সানন্দে হাত ঘষিতে লাগিল; যদুনাথ কিন্তু বিচলিত হইয়া পড়িলেন—

এ তো বড় ভয়ানক কথা। সূর্যমণির ওপর যদি কানামাছির নজর পড়ে থাকে—অ্যাঁ–। ইন্সপেকটরবাবু, এ চোর তো আপনাদের ধরতেই হবে।

ইন্সপেকটর বলিলেন—ধরা কিন্তু সহজ নয়। কানামাছির চেহারা কেমন আমরা দেখিনি। দেখেছি কেবল তার পায়ের ছাপ। ভেবে দেখুন, কলকাতা শহরের লক্ষ লক্ষ লোকের সঙ্গে পায়ের ছাপ মিলিয়ে চোরকে ধরা কি সম্ভব? একমাত্র তাকে যদি হাতে হাতে ধরা যায় তবেই সে ধরা পড়বে। কিন্তু কানামাছি ভারি সেয়ানা চোর। আমার বিশ্বাস সে আমাদেরই মতো ভদ্রলোক সেজে বেড়ায়, তার বন্ধুবান্ধবও তাকে চোর বলে চেনে না। এরকম চতুর-চূড়ামণিকে ধরা কি সহজ, যদুনাথবাবু?

নন্দার অধরোষ্ঠ খুলিয়া গেল; সে যেন এখনি দিবাকরের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করিয়া দিবে। কিন্তু তাহার দৃষ্টি পড়িল দিবাকরের উপর। দিবাকর শান্তভাবে তাহার পানে চাহিয়া আছে, যেন সব কিছুর জন্যই সে প্রস্তুত। নন্দা অধর দংশন করিয়া উদগত বাক্য রোধ করিল।

যদুনাথ অত্যন্ত উদ্বিগ্নভাবে বলিলেন—কিন্তু—তাহলে—আমার সূর্যমণি!

ইন্সপেকটর বলিলেন—আপনার সূর্যমণি সম্বন্ধে খুবই সাবধান হওয়া দরকার। পুলিসের দিক থেকে কোনও ত্রুটি হবে না; আপনিও যাতে সাবধানে থাকেন তাই খবর দিয়ে গেলাম!–আচ্ছা, আজ তাহলে উঠি। যতদূর জানা আছে, কানামাছি রাত্রে ছাড়া চুরি করে না। আপনি রাত্রে বাড়ি পাহারা দেবার ব্যবস্থা করুন।

যদুনাথ উঠিলেন—হ্যাঁ হ্যাঁ, আজই আমি দুটো চৌকিদার রাখব। কানামাছি—কি সর্বনাশ—আঁ!

ইন্সপেকটর গমনোম্মুখ হইলেন—আচ্ছা নমস্কার!

নন্দা এতক্ষণে কথা কহিল—একটা কথা। চোরের নামই কি কানামাছি?

ইন্সপেকটর বলিলেন—চোরের নাম কেউ জানে না। কানামাছি নামটা খবরের কাগজের দেওয়া। আসল নামের অভাবে ঐ নামই চলে গেছে।

নন্দা কেবল বলিল-ও—

.

পূর্ব ঘটনার পর মিনিট পনেরো গত হইয়াছে।

দিবাকর নিজের ঘরের জানালায় দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে তাকাইয়া ছিল, দ্বার খোলার শব্দে ফিরিয়া দেখিল নন্দা প্রবেশ করিতেছে। নন্দার চোখ দুটি সূর্যমণির মতোই জ্বলজ্বল করিতেছে।

নন্দা দরজা ভেজাইয়া দিয়া দিবাকরের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, বিদ্রূপশাণিত কণ্ঠে বলিল—আপনি কি সুন্দর গল্প বলতে পারেন! কী অদ্ভুত আপনার উদ্ভাবনী শক্তি! ধন্য আপনি!

দিবাকর চক্ষু নত করিল।

নন্দা বলিয়া চলিল—কানামাছি। খবরের কাগজওয়ালাদের কি স্পর্ধা আপনাকে কানামাছি বলে! আপনি কানাও নয়, মাছিও নয়। আপনি পাকা চোরনামজাদা চোর—চতুর চুড়ামণি!!

দিবাকর অস্ফুটস্বরে বলিল—আমার একটা কথা শুনবেন?

নন্দা তীব্রস্বরে বলিল—আপনার কথা আমি ঢের শুনেছি, অভিনয়ও ঢের দেখেছি। কি অপূর্ব অভিনয়! গরীব-অসহায়—পেটের দায়ে চুরি করতে আরম্ভ করেছেন—

দিবাকর বলিল—অন্তত ও কথাটা মিথ্যে নয়। সত্যিই আমি পেটের দায়ে চুরি করতে আরম্ভ করেছিলাম।

নন্দা বলিল—চুপ করুন। আপনার একটা কথাও সত্যি নয়। সত্যি কথা বলতে আপনি জানেন। আজই আপনি বলেছেন যে মেয়েদের মন চুরি করতে আপনি জানেন না; কিন্তু মেয়েদের চোখে কি করে ধুলো দিতে হয় তা আপনি বেশ জানেন। মেয়েদের কাছে ন্যাকা সেজে কাজ আদায় করতে আপনার জোড়া নেই।

আমাকে দুটো কথা বলতে দেবেন?

কী বলবেন আপনি? আমাকে বোধহয় বোঝাবার চেষ্টা করবেন যে আপনি সূর্যমণি চুরি করতে আসেননি।

না, আমি সূর্যমণি চুরি করতেই এসেছিলাম।

নন্দার বিদ্যুৎ শিখার মতো আপাদমস্তক জ্বলিয়া উঠিল—

উঃ! অসহ্য! নির্লজ্জতারও একটা সীমা আছে।

সে ঝড়ের মতো ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, ক্ষণেক পরে তাহার ঘরের দরজা দমাস্ করিয়া বন্ধ হইল। দিবাকর তাহাকে অনুসরণ করিবার উপক্রম করিয়াছিল, শব্দ শুনিয়া আবার জানালায় ঠেস দিয়া দাঁড়াইল। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া সে একবার জানালা দিয়া বাহিরে উঁকি মারিল।

নন্দা নিজের ঘরে গিয়া দরজায় ছিটকিনি লাগাইয়া দিয়াছিল। রাগে ফুলিতে ফুলিতে ওয়ার্ডরোবের সামনে দিয়া যাইবার সময় সে আয়নায় দেখিল, পূজারী প্রদত্ত মালাটি এখনও তাহার গলায় দুলিতেছে। সে একটানে মালা ছিড়িয়া দূরে ফেলিয়া দিল। দেয়ালে নন্দার একটি ছবি টাঙানো ছিল, ছিন্ন মালা ছবির ফ্রেমে আটকাইয়া ঝুলিতে লাগিল। ঠাকুরের আশীর্বাদী মালাটা যেন কিছুতেই নন্দাকে ছাড়িবে না।

নন্দা গিয়া খাটের কিনারায় বসিল; ক্লান্তিভারাক্রান্ত একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া দুহাতে মুখ ঢাকিল। তাহার উত্তপ্ত ক্রোধ এতক্ষণ তাহাকে খাড়া করিয়া রাখিয়াছিল, এখন সে যেন ভাঙিয়া পড়িবার উপক্ৰম করিল।

ঘরের জানালা খোলা ছিল। এই সময় দিবাকরকে জানালার বাহিরে দেখা গেল। সে নিঃশব্দে জানালা ডিঙাইয়া ঘরের ভিতরে আসিল; একবার চকিত চক্ষে নন্দাকে দেখিয়া লইল।

জানালার কাছেই নন্দার পড়ার টেবিল। দিবাকর দেখিল টেবিলের উপর কয়েকটা ফটো পড়িয়া রহিয়াছে; তন্মধ্যে একটি নন্দার। দিবাকর ছবিটি পকেটে পুরিয়া ঠোঁটের উপর হাত রাখিয়া একটু কাশিল। নন্দা চমকিয়া চোখ তুলিল; দিবাকরকে দেখিয়া সুচীবিদ্ধবৎ উঠিয়া দাঁড়াইল।

এ কি! আমার ঘরে ঢুকলেন কি করে?

নন্দা তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। দিবাকর শুষ্কস্বরে বলিল—শুধু দরজা বন্ধ করে নামজাদা চোরকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না।

নন্দা বুঝিল, একদিন দিবাকর যেমন ঐ জানালা দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছিল, আজ তেমনি অবলীলাক্রমে প্রবেশ করিয়াছে। নন্দার মুখের ভাব তিক্ত হইয়া উঠিল। সে বলিল—দেখছি আমার জানালাও বন্ধ করা উচিত ছিল। কিন্তু আমাকে এমনভাবে উত্যক্ত করছেন কেন? আর কি চান আপনি?

দিবাকর জিজ্ঞাসা করিল—আমার সত্যিকার পরিচয় আপনি কাউকে বলেছেন কি?

নন্দা বলিল—না বলিনি এখনও। কিন্তু বলব, শিগগিরই বলব।

দিবাকর বলিল—বেশ, বলবেন। কিন্তু তার আগে আমার কথাও আপনাকে শুনতে হবে। ভয় নেই, আমি নিজের সাফাই গাইব না, চোখে ধূলো দেবার চেষ্টাও করব না। নিছক সত্যি কথা বলব। বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছে।

নন্দা কথা কহিল না, ওষ্ঠাধর চাপিয়া দিবাকরের পানে চাহিয়া রহিল। ইহাকেই অনুমতি বলিয়া গ্রহণ করিয়া দিবাকর ধীরে ধীরে বলিতে আরম্ভ করিল—

চুরি করবার যে একটা নেশা আছে তা বোধহয় আপনি জানেন না; জানবার কথাও নয়। প্রথম যখন আমি চুরি করতে আরম্ভ করি তখন আমার বয়স পনেরো-ষোল বছর। বাবা সামান্য চাকরি করতেন, কিছু সঞ্চয় করতে পারেননি। তিনি হঠাৎ মারা গেলেন; সংসারে রইলাম শুধু মা আর আমি। কেউ সাহায্য করল না, কেউ একবার ফিরে তাকাল না। আমার তখনও রোজগার করবার বয়স হয়নি—একদিন মরীয়া হয়ে চুরি করলাম। সেই আরম্ভ—কিন্তু মাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলাম না, তিনি একরকম অনাহারেই মারা গেলেন।

দিবাকর একটু চুপ করিল। নন্দা তীক্ষ্ণ অবিশ্বাস লইয়া শুনিতে আরম্ভ করিয়াছিল, কিন্তু শুনিতে শুনিতে তাহার মুখের ভাব একটু একটু করিয়া পরিবর্তিত হইতে লাগিল। দিবাকর নীরস আবেগহীন কণ্ঠে আবার আরম্ভ করিল

নিজের বলতে আমার আর কেউ রইল না। পৃথিবীতে আমি একা; কেউ আমাকে চায় না, আমার মরা বাঁচায় কারুর আসে যায় না। আমার মন কঠিন হয়ে উঠতে লাগল। আমার ওপর যখন কারুর মমতা নেই, তখন আমারই বা কারুর ওপর মমতা থাকবে কেন? সংসার যখন আমার শত্রু তখন আমিও সংসারের শত্রু। এইভাবে বড় হয়ে উঠলাম। আমি নির্বোধ নই; জানতাম, যদি একবার ধরা পড়ি তাহলে সমাজ আমাকে ছাড়বে না, দাগী করে ছেড়ে দেবে। খুব সাবধানে চুরি করতে শিখলাম। আর শিখলাম ধনীকে ঘৃণা করতে। যাদের টাকা আছে তারাই আমার শত্রু; তারা সম্পত্তি আগলে নিয়ে বসে আছে, যে সেদিকে হাত বাড়াবে তাকেই তারা পায়ের তলায় পিষে ফেলবে। তারা নিষ্ঠুর, তারা পরের সম্পত্তি ফাঁকি দিয়ে নিজেরা বড়মানুষ হয়ে বসেছে; তারাই আমার মুখের অন্ন কেড়ে খাচ্ছে–

নন্দা তপ্তকণ্ঠে বলিল—মিথ্যে কথা। বড়মানুষ মাত্রই গরীবের মুখের অন্ন কেড়ে খায় একথা সত্যি নয়।

দিবাকর বলিল—পুরোপুরি সত্যি না হলেও একেবারে মিথ্যেও নয়। যাক, আমি নিজের মনের অবস্থা বর্ণনা করছি। একটা কথা আপনাকে মিথ্যে বলেছিলাম, আমার শিক্ষা সম্বন্ধে। চুরির টাকায় আমি এম-এ পাস করেছি, অশিক্ষিত নই। আধুনিক মনীষীদের চিন্তাধারার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। Proudhon বলেছেন, Property is theft; যার সম্পত্তি আছে সেই চোর। মনে আছে কথাটা আমাকে খুব উৎসাহ দিয়েছিল। যারা বিত্তবান তারাই যদি চোর তবে আমার হতে লজ্জা কি?…ক্রমে আমি কঠিন অপরাধী হয়ে উঠলাম; চুরির নেশা আমাকে চেপে ধরল। সুবিধে পেলেই চুরি করতে আরম্ভ করলাম। এইভাবে গত তিন বছর কেটেছে। এখন আর আমার টাকার দরকার নেই, কিন্তু নেশা ছাড়তে পারি না।

দিবাকর আবার থামিল। নন্দা সম্মোহিত হইয়া শুনিতেছিল, নিজের অজ্ঞাতসারেই বলিয়া উঠিল–

তারপর?

দিবাকর নন্দার দিকে না চাহিয়া বলিতে লাগিল।

তারপর একটা বাড়িতে চুরি করতে গেলাম। আটঘাট বেঁধেই গিয়েছিলাম, কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম। ভেবেছিলাম তারা আমাকে পুলিসে ধরিয়ে দেবে, কিন্তু তারা ধরিয়ে দিলে না। দয়া মায়া আশা করিনি, দয়া মায়া পেলাম, সমবেদনা পেলাম; সৎপথে চলবার প্রেরণা পেলাম। যে বাড়িতে চোর হয়ে ঢুকেছিলাম সেই বাড়িতে আশ্রয় পেলাম–

সে কোন্ বাড়ি?

দিবাকর প্রশ্নের উত্তর না দিয়া বলিয়া চলিল—কিন্তু তবু আমার চুরির নেশা গেল না। একদিকে লোভ, অন্যদিকে কৃতজ্ঞতা—দুয়ের মধ্যে টানাটানি শুরু হল। এমনি ভাবে কিছুদিন চলল। তারপর সব ভেসে গেল।

ভেসে গেল!

আমার মনে স্নেহ মমতা ভালবাসার স্থান ছিল না, শ্রদ্ধা ভক্তি ছিল না; সব পাথর হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একদিন কোথা থেকে এক প্রবল বন্যা এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেল। শুধু রয়ে গেল ভালবাসা শ্রদ্ধা আর আত্মগ্লানি।

দিবাকরের কথা শুনিতে শুনিতে নন্দা এক পা এক পা করিয়া টেবিলের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল; তাহার মুখে সংশয়ভরা অবিশ্বাস আর ছিল না, চোখে এক নূতন দীপ্তি ফুটিয়া ছিল। দিবাকর পকেট হইতে চকচকে চাবিটি বাহির করিয়া অন্যমনস্কভাবে নাড়াচাড়া করিতে লাগিল

যতদিন আমার প্রাণে ভালবাসা ছিল না, ততদিন আত্মগ্লানিও ছিল না। কিন্তু এখন মনে হল আমি নরকের কীট, আমার সর্বাঙ্গে পাঁক লেগে আছে, যাকে ভালবাসি তার পানে চোখ তুলে চাইবার অধিকার আমার নেই—

নন্দা টেবিলের দিকে দৃষ্টি নত করিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল-কাকে আপনি ভালবাসেন তা তো বললেন না।

দিবাকর নিবন্ত স্বরে বলিল—সে কথা বলবার নয়। —এই চাবি তৈরি করেছিলাম চুরি করব বলে, যা চুরি করতে এসেছিলাম, ইচ্ছে করলেই তা চুরি করতে পারতাম। কিন্তু আর সে ইচ্ছে নেই। এখন আমাকে কেটে ফেললেও আর চুরি করতে পারব না।

চাবিটি টেবিলে রাখিয়া দিয়া সে ক্লান্তচক্ষে নন্দার পানে চাহিল।

আমার যা বলবার ছিল শেষ হয়েছে। এখন আপনি পুলিসে খবর দিতে পারেন। আমি পাশের ঘরে থাকব।

দিবাকর দ্বার খুলিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।

.

হল-ঘরের ঘড়িতে তিনটা বাজিতে কয়েক মিনিট বাকি আছে। মন্মথ টেবিলের সম্মুখে বসিয়া অলসভাবে একটা মাসিক পত্রিকার পাতা উল্টাইতেছিল। ঘরে আর কেহ নাই। যদুনাথ এখনও তাঁহার চিরাভ্যস্ত দিবানিদ্রা শেষ করিয়া ঘর হইতে বাহির হন নাই।

টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। মন্মথ নিরুৎসুকভাবে যন্ত্র তুলিয়া কানে দিল

হ্যালো

তারের অপর প্রান্ত হইতে যে কণ্ঠস্বরটি ভাসিয়া আসিল তাহাতে মন্মথ তড়িৎপৃষ্টের ন্যায় খাড়া হইয়া বসিল, তাহার ব্যাজার-ভরা মুখ মুহূর্তে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। সে একবার সচকিতে চারিদিকে চাহিল।

তারপর বলিল—অ্যাঁ—লিলি! হুঁ হুঁ, আমি মন্মথ। কি বললে—তুমি একলা আছ?

লিলি নিজের বাসা হইতে টেলিফোন করিতেছে। দাশু ও ফটিক তাহার কাছে দাঁড়াইয়া আছে। লিলি কণ্ঠস্বরে মধু ঢালিয়া ফোনের মধ্যে বলিল—হ্যাঁ, কেউ নেই। আমি একলা।

মন্মথ সন্দিগ্ধভাবে বলিল—দাশুবাবু? ফটিকবাবু?

লিলি মুখের একটা ভঙ্গি করিয়া দাশু ও ফটিকের পানে কটাক্ষপাত করিল—

তাঁরা আর আসবেন না। তাঁদের আমি—। তাঁদের কথা দেখা হলে বলব; কিন্তু আপনিও কি আমাকে ভুলে গেছেন, মন্মথবাবু?

ভুলে গেছি! কি বলছ তুমি? আমি এখনি তোমার কাছে যাচ্ছি

শুনুন, এখন আসবেন না। আজ রাত্রে আমার সঙ্গে ডিনার খাবেন, কেমন? শুধু আমি আর আপনি, আর কেউ নয়।

আচ্ছা, সেই ভাল। তোমাকে যে কত কথা বলবার আছে, লিলি—হেঁ হেঁ—আচ্ছা—আচ্ছা—নিশ্চয়।

মন্মথ টেলিফোন রাখিয়া আহ্লাদে প্রায় লাফাইতে লাফাইতে উপরে চলিয়া গেল।

ওদিকে লিলি টেলিফোন বন্ধ করিয়া সপ্রশ্ন নেত্রে দাশু এবং ফটিকের পানে চাহিল। দাশু উত্তরে সন্তোষসূচক ঘাড় নাড়িল-হা, আজই একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলা চাই, আর দেরি নয়। চল ফটিক, আমাদেরও তৈরি থাকতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *