প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৬. গণেশ যখন রক্তকলুষ বিঘ্নরাজ

গণেশ যখন রক্তকলুষ বিঘ্নরাজ

অতুলচন্দ্র গুপ্ত(৩১) বলছেন, “আদিতে গণেশ ছিলেন কর্মসিদ্ধির দেবতা নয়, কর্মবিঘ্নের দেবতা”। দেবতা কিনা, কিংবা, আধুনিক অর্থে দেবতা কিনা, তা কিছুটা পরেই দেখা যাবে। আপাতত দেখা যাক একটি বিশেষ যুগের আইন-কর্তাদের চোখে গণেশের সঙ্গে কর্মবিঘ্নের যোগাযোগ কতোটা ঘনিষ্ঠ।

প্রথমেই মনে রাখা দরকার, গণেশ এক নয়, বহু। মহাভারতে(৩২) গণেশ বা গণপতি প্রসঙ্গে বহুবচনের প্রয়োগ দেখা যায় এবং স্যর ভাণ্ডারকর(৩৩) মনে করিয়ে দিচ্ছেন শতরুদ্রীয়-তে যেরকম বহু ক্ষেত্রে বিদ্যমান বহু রুদ্রের কথা রয়েছে মহাভারতেও তেমনি বহু ক্ষেত্রে বিদ্যমান বহু গণপতির কথাই বলা হয়েছে। এবং, শুধুই যে গণেশ বহু তাই নয়, তাঁর নামও বহু। আধুনিকপন্থী বা প্রাচীনপন্থী কোনো পণ্ডিতই অস্বীকার করবেন না যে, অথর্বশিরস-উপনিষদ(৩৪), মানবগৃহ্যসূত্র(৩৫), যাজ্ঞবল্ক্য-সংহিতা(৩৬) প্রভৃতি বইতে বিনায়ক বলে যাঁদের উল্লেখ করা হয়েছে তাঁরা ওই গণপতি ছাড়া আর কেউই নন। প্রশ্ন হলো, ওই পুঁথিপত্রগুলিতে এই গণপতিদের প্রতি কী রকম মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে?

মানবগৃহ্যসূত্র(৩৭) থেকেই শুরু করা যাক। আধুনিক পণ্ডিতদের হিসেবে(৩৮) যীশুখ্রীষ্ট জন্মাবার অন্তত চার শ’ বছর আগে এই পুঁথি রচিত হয়েছিলো। এবং, এই পুঁথিতে গ্রন্থকার গণেশদের এক অতি আতঙ্কজনক ছবি এঁকেছেন। গণেশদের বা বিনায়কদের দৃষ্টি পড়লে যে কতোরকম ভয়াবহ মানসিক অবস্থা সৃষ্ট হয় তারই ফর্দ দিয়ে তিনি আলোচনা শুরু করছেন। এই ফর্দের মধ্যে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন থেকে কঠিন উন্মাদরোগ পর্যন্ত কিছুই বাদ পড়েনি। কিন্তু শুধু ওই রকম মনোবিকার সৃষ্টি করেই গণেশরা ক্ষান্ত নন। তাঁদেরই প্রভাবে রাজার ছেলে রাজ্যলাভে উপযুক্ত হলেও রাজ্য পায় না, কুমারী বিবাহযোগ্যা হলেও তার বর জোটে না, সন্তানবতী হবার উপযুক্ত হলেও নারীর সন্তান হয় না, কিংবা, যার সন্তান আছে তার সন্তান-বিয়োগ ঘটে। বিদ্বান আচার্যের শিষ্য জোটে না, শিষ্যদের বিদ্যালাভ হয় না। কৃষি ও বানিজ্য উচ্ছন্নে যায়।

তখনকার কালের মানুষদের সুখসম্ভোগের সম্বাবনা যে-রকম সংকীর্ণ তার অনুপাতে সর্বনাশের তালিকাটা নিশ্চয়ই এর চেয়ে বড়ো হতে পারতো না। এবং, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, তখনকার কালে যাঁদের হাতে শাসনক্ষমতা তাঁদেরই মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে এই গৃহ্যসূত্রগুলির(৩৯) মধ্যে। তার মানে, গণেশদের প্রতি উপরোক্ত মনোভাবকে সে-যুগের শাসকশ্রেণীর মনোভাবই বলতে হবে। এবং, এ-মনোভাব যে খুবই সাময়িক ছিলো না তারও প্রমাণ আছে। কেননা, মানবগৃহ্যসূত্রের বেশ কয়েক শ’ বছর পরে যাজ্ঞবল্ক্য আইনের যে-বই লিখলেন(৪০) তার মধ্যেও গণেশদের প্রতি হুবহু একই মনোভাবে :

বিনায়কঃ কর্মবিঘ্নসিদ্ধ্যররথং বিনিযোজিতঃ।
গণানামাধিপত্যে চ রুদ্রেণ ব্রহ্মণা তথা।।
তেনোপসৃষ্টো যন্তস্য লক্ষণানি নিবোধত।
স্বপ্নে ইবগাহতে ইত্যর্থং জলং মুণ্ডাংশ্চ পশ্যতি।।
কাষায়বাসসশ্চৈব ক্রব্যাদাংশ্চাধিরোহতি।
অন্ত্যজৈর্গর্দ্দভৈরুষ্ট্রৈঃ সহৈকত্রাবতিষ্ঠতে।।
ব্রজন্তঞ্চ তথাত্মানং মন্যতেহনুগতং পরৈঃ।
বিমনা বিফলারম্ভঃ সংসাদত্যনিমিত্ততঃ।।
তেনোপসৃষ্টৌ লভতে ন রাজ্যং রাজনন্দনঃ।
কুমারী ন চ ভর্ত্তারমপত্যং ন চ গর্ভিনী।।
আচার্যত্বং শ্রোত্রিয়শ্চ ন শিষ্যোহ-ধ্যয়নং তথা।
বণিগ্লাভং চাপ্নোতি কৃষিঞ্চৈব কৃষীবলঃ।।

পঞ্চানন তর্করত্ন মহাশয়(৪১) তর্জমা করছেন : ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ্বর, বিনায়ককে কর্মবিঘ্নের জন্য এবং গণদিগের আধিপত্যে নিযুক্ত করিয়াছেন। তিনি যাহার উপর উপসর্গ করেন তাহার লক্ষণ বলিতেছি, শ্রবণ কর। যে ব্যক্তি যেন জলে অবগাহণ করিতেছে, কাষায়বাস মুণ্ডিতমুণ্ড ব্যক্তিগণকে দেখিতেছে, আমমাংসাশী মৃগাদিতে আরোহণ করিতেছে, এবং চণ্ডালাদি অন্তজজাতি গর্দভ ও উষ্ট্রের সহিত একত্র অবস্থান করিতেছে, দৌড়িতে চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু ইচ্ছামতো দৌড়িতে না পারায় পশ্চাদনুগামী শত্রুর করকবলিত হইতেছে, এইসকল স্বপ্ন দেখিতে পায়। আর সর্বদাই অন্যমনস্ক থাকে, আরদ্ধ কোনো কার্যই সিদ্ধ হয় না এবং বিনা কারণে বিষন্ন হয়। তাঁহার (বিনায়কের) উপসর্গ হইলে রাজকুমার রাজ্যলাভ করিতে পারে না; কুমারী অভিলষিত স্বামী প্রাপ্ত হয় না; গর্ভবতী স্ত্রী অপত্যলাভে বঞ্চিত থাকে; ঋতুমতী স্ত্রীর গর্ভ হয় না। শ্রোত্রিয় আচার্যতা, শিষ্য অধ্যয়ন, বণিক লাভ এবং কর্ষক কৃষিফল প্রাপ্ত হয় না।

ভয়াবহ চিত্র, সন্দেহ নেই। “এবং”, অতুলচন্দ্র গুপ্ত(৪২) মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “গণেশের যে-পূজা তা ছিলো এই ভয়ঙ্কর দেবতাটিকে শান্ত রাখার জন্য; তিনি কাজকর্মের উপর দৃষ্টি না দেন, সে-জন্য ঘুষের ব্যবস্থা”। এই ঘুষের ব্যবস্থাটি যে কতোখানি ফলাও তার পরিচয় যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতি(৪৩) থেকেই পাওয়া যায়।

প্রাচীনকালের আইনের বইতে গণেশের প্রতি এই যে-মনোভাবটি প্রকাশ পেয়েছে তার কথা মনে না রাখলে গণেশের কয়েকটি পুরোনো নামের তাৎপর্য বুঝতে পারাই সম্ভব নয়। নানা রকম পুঁথিপত্রে(৪৪) এই নামগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়। নমুনা : বিঘ্নেশ, বিঘ্নকৃৎ, বিঘ্নেশ্বর, বিঘ্নরাজ, ইত্যাদি। চলতি কথায়, ‘যতো নষ্টের গোড়া’—ট্রাবল-মেকার। দুর্বৃত্তদের পাণ্ডাও বলতে পারেন। অবশ্যই, পরের যুগের পরিবর্তিত আবহাওয়ায় গণেশ সম্বন্ধে অন্য রকম ধারণা দেখা দিলো। এবং, এই পরবর্তী ধারণার বশবর্তী হয়ে আধুনিক পণ্ডিতেরা ওই প্রাচীন নামগুলির ভুল ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করলেন। তাঁরা বলতে চাইলেন, বিঘ্ন দূর করবার ক্ষমতা গণেশের, বাধাবিঘ্নের শক্তি গণেশের কাছে নতজানু—তাই তিনি বিঘ্নের অধিপতি, বিঘ্নেশ। দুর্বৃত্ত বলে বিঘ্নরাজ নন, দুর্বৃত্তদের দমন করেন বলেই বিঘ্নরাজ। এই জাতীয় ব্যাখ্যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মনিয়ার-উইলিয়ামস-এর(৪৫) রচনায় : বিঘ্ন দূর করতে পারেন বলেই গণেশের ওই রকম নাম আর তাইজন্যেই সমস্তরকম ক্রিয়াকর্মের শুরুতে নমো গণেশায় বিঘ্নেশ্বরায় বলে প্রণাম করবার প্রথা রয়েছে। কিন্তু মনিয়ার-উইলিয়ামস-এর এই ব্যাখ্যা যে মনগড় তার প্রমাণ আছে। বিঘ্নকৃত বলে নামটির তাৎপর্য বিঘ্ন দূর করা নয়, বিঘ্ন সৃষ্টি করাই। বৌধায়ন-ধর্মসূত্রে(৪৬) গণেশের কয়েকটি চিত্তাকর্ষক নামের মধ্যে একটি হলো বিঘ্ন এবং শুধু বিঘ্ন। এবং, আমরা একটু আগেই দেখেছি, যাজ্ঞবল্ক সরাসরি বলছেন যে, বিঘ্নসাধন করবার জন্যেই বিনায়কেরা নিযুক্ত আছেন। তাই মানতেই হবে যে, এককালে গণেশকে শুধু দুর্বৃত্ত বলেই দেখবার চেষ্টা করা হয়েছিলো, দুর্বৃত্ত-দলনের কথাটি অর্বাচীন।

আর, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, গণেশকে তখন শুধুমাত্র দুর্বৃত্ত বলেই কল্পনা করা হয়নি,–তার বদলে রীতিমত রক্তকলুষ দুর্বৃত্তই। কেননা, গণেশের ওই যে হাতির মাথা জীববিজ্ঞানমতে তো তাতে দুটি গজদন্ত থাকবার কথা। শাস্ত্রমতে কিন্তু তা নয়। গণেশের দাঁত বলতে মাত্র একটি। গণেশের নামই হলো একদন্ত। এবং, এই যে মাত্র একটি দাঁত—এর রংটাও স্বাভাবিক হাতির দাঁতের মতো নয়। শাস্ত্রমতে একেবারে টকটকে লাল। ওরকম টকটকে লাল কেন? শাস্ত্রমতে, গণেশ ওই দাঁতের আঘাত বহু শত্রু  বিনাশ করেছেন আর তাদেরই রক্তে স্নাত হয়ে দাঁতটার ওই চেহারা হয়েছে : দন্তাঘাতবিদারিতারিরুধিরৈঃ সিন্দুরশোভাকরং(৪৭)। কিন্তু, প্রশ্ন হলো, গণেশের অরি বা শত্রু  বলতে ঠিক কে বা কারা? পুরাণে এ-প্রশ্নের রকমারি জবাব আছে। তার মধ্যে একটা জবাব আন্দাজ করা যায় গণেশের অপর দাঁতটি কী করে হারালো তারই কাহিনী থেকে। ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে(৪৮) এক রোমহর্ষক যুদ্ধের কাহিনী পাওয়া যায়—পরশুরামের সঙ্গে গণেশের যুদ্ধ। লড়াই করতে করতে পরশুরাম তাঁর হাতের কুঠারটা ছুঁড়ে মারলেন গণেশের দিকে। তারই আঘাতে গণেশের একটা দাঁত উড়ে গেলো। অবশ্যই, তাই বলে গণেশকে পরশুরামের তুলনায় দুর্বল মনে করা চলবে না। কেননা, ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে(৪৯) বলা হয়েছে, ইচ্ছে করলে গণেশ ওই কুঠারাঘাতকে প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন। কিন্তু গণেশ দেখলেন, কুঠারটি তাঁর পিতার হাতের তৈরি, তাই কুঠারকে নিষ্ফল করলে পিতাকে অমর্যাদা দেখানো হয়। তাই পিতার মর্যাদা রক্ষা করবার জন্যেই গণেশ একটি দাঁত এগিয়ে দিয়ে কুঠারের আঘাতটা গ্রহণ করে নিলেন। অবশ্যই, এই হারজিতের কাহিনীই এখানে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক নয়। আমাদের কাছে তার চেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো এই পৌরাণিক কাহিনী থেকে গণেশের শত্রুকে চেনবার চেষ্টা। কার সঙ্গে গণেশের লড়াই? কে তাঁর ওই শত্রু ? পরশুরাম। পৌরাণিক কাহিনীর সঙ্গে সামান্যমাত্র পরিচয় থাকলেই এই পরশুরামকে সনাক্ত করা সম্ভব। হিংসার ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের এমন জঙ্গী প্রবর্তকের কথা শাস্ত্রগ্রন্থে নিশ্চয়ই অদ্বিতীয়। এই প্রসঙ্গে ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের(৫০) গ্রন্থে পরশুরামের পৌরাণিক কাহিনীর সামাজিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা স্মরণীয়।

তার মানে কি এই যে, একটা বিশেষ যুগে গণেশের শত্রু  বলতে ওই পুরোহিত-শ্রেণীকেই বুঝতে হবে? সে-যুগে রচিত পুরোহিত-শ্রেণীর সাহিত্যে গণেশের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারও একই ইঙ্গিত দিতে চায়। কিন্তু খুব তাড়াহুড়ো করে কোনো একটা সিদ্ধন্তে পৌঁছবার তাগিদ নেই। কেননা, প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির আদালতে বিস্তর সাক্ষী-সাবুদ ভিড় করে আছে। ঐতিহাসিকেরা সবসময় তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন না, কেননা, তাহলে অপ্রিয় সিদ্ধান্তে পৌঁছবার ভয়। সে-আতঙ্ক উত্তীর্ণ হতে পারলে গণেশের পদচিহ্ন অনুসরণ করেই নানারকম আশ্চর্য সওয়াল আমরা শুনে আসতে পারবো।

আপাতত গণেশের বিরুদ্ধে সেকালের এই প্রকট ঘৃণার মনোভাবের আরো কিছুকিছু নমুনা দেখা যায়। অতুলচন্দ্র গুপ্ত(৫১) মহাশয় বলছেন, “এইজন্যেই গণেশের অনেক প্রাচীন পাথরের মূর্তিতে দেখা যায় যে, শিল্পী তাঁকে অতি ভয়ানক চেহারা দিয়ে গড়েছে”। আলফ্রেড ফুসে-ও(৫২) গণেশের কদাকার মূর্তির উল্লেখ করে শিল্পীদের মনে গণেশের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব অনুমান করতে চাইছেন। কিন্তু এমনও হতে পারে যে, গণেশের ওইসব বীভৎস চেহারার আসল তাৎপর্য অন্য। তবু এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, ভারতীয় দেব-শিল্পের ইতিহাসের কোনো এক পর্যায়ে গণেশের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিলো—প্রতিমা-পরিকল্পনাতেই তার প্রকট প্রমাণ রয়েছে। কেননা, অনেক মূর্তিতেই দেখতে পাওয়া যায় গণেশ কোনো-না-কোনো আভিজাতিক দেবদেবীর পায়ের তলায় অবদলিত হয়েছেন।

বাংলা দেশেই(৫৩) পাথরের মূর্তি পাওয়া গিয়েছে যেখানে দেখা যায় গণেশ অবদলিত হয়েছেন ভ্রুকুটিতারা বা পর্ণশবরীর পায়ের তলায়। তবু তাঁর হাতে ঢাল-তলোয়ার দেখে অনায়াসেই অনুমান করা যায় বিনা যুদ্ধে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। বিশেষ করে লক্ষ্য করা দরকার, এই মূর্তিতে গণেশের গজানন নেই—মুখটা কদাকার, কিন্তু মানুষেরই মুখ। তিব্বতে পাওয়া(৫৪) ব্রোঞ্জ-এর মূর্তিতে দেখি দেবতা মহাকাল গণেশকে পায়ের তলায় দলছে। মঞ্জুশ্রীর পায়ের তলায় অবদলিত অবস্থায় গণেশের মূর্তিও একান্ত দুর্লভ নয়। তার চেয়েও চিত্তাকর্ষক হলো আর এক রকম মূর্তি(৫৫) যেখানে গণেশকে দেখানো হয়েছে বিঘ্নহন্তা বলে এক দেবতার পায়ের তলায়।  নামেই প্রমাণ, বিঘ্নকে জয় করবার কল্পনা থেকেই বিঘ্নহন্তার জন্ম—এই মূর্তিতে বিজিত গণেশ তাই সাক্ষাৎ বিঘ্নই। নেপালের উপকথায়(৫৬) এই বিঘ্নহন্তার যে বৃত্তান্ত পাওয়া যায় তা থেকেও প্রমাণিত হয় বিঘ্ন বলতে এখানে গণেশই।

আপত্তি উঠবে, উল্লেখিত দেবদেবীরা জাতে বৌদ্ধ। তাই মূর্তিগুলির সাক্ষ্য এই কথাই প্রমাণ করে যে, বৌদ্ধ ধর্মের কর্তারা এককালে বিষনজরে দেখেছিলেন। এবং, গণেশের প্রতি বৌদ্ধ দেবদেবীদের এই আচরণ হিন্দু-বৌদ্ধ সংঘাতের ইঙ্গিত হয়তো দিতে পারে, কিন্তু সাধারণভাবে গণেশের বিরুদ্ধে শাসক-সম্প্রদায়ের প্রতিবন্ধ কী করে প্রমাণ করবে?

উত্তরে বলবো, ভাস্কর্যের ভাষায় এই যে গণেশ-দলন কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে তার নায়ক-নায়িকারা হিন্দুস্বর্গের বাসিন্দাই হোন আর বৌদ্ধস্বর্গের বাসিন্দা হোন, আমাদের মূল যুক্তির পক্ষে তাতে খুব বড়ো তফাত হয় না। কেননা, মর্তের প্রতিবিম্ব হিসেবে এঁদের সকলের জাত একই। অর্থাৎ, হিন্দু দেবতাদের মতো এঁরাও হলেন মানবসমাজের আভিজাতিক-শ্রেণীর প্রতিনিধি। মহাকালের কথাটাই ভেবে দেখা যাক। দেবলোকের বাসিন্দা হলেও মরলোকের আভিজাতিক-শ্রেণীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে এতোটুকুও সন্দেহের অবকাশ নেই। শান্তি আর শৃঙ্খলার রক্ষক হিসেবেই তাঁর পরিচয়(৫৭)। তাছাড়া, নজর করলেই দেখা যায় তাঁর হাতে একটি মোহরের থলি রয়েছে : চৈনিক পর্যটক ঈ-সীন(৫৮) বলছেন, ভারতবর্ষে অধিকাংশ মঠের দোরগোড়ায় তিনি এক দেবমূর্তি দেখে গিয়েছেন, তাঁর হাতে স্বর্ণমুদ্রার থলি আর তাঁরই নাম হলো মহাকাল। ভারতবর্ষের বাইরেও আভিজাতিক-শ্রেণীর সঙ্গে মহাকালের সম্পর্কটা অস্পষ্ট নয় : মঙ্গোলিয়ার শাসক আল্টন খাঁ হুকুম জারি করেছিলেন, মহাকালই হবেন দেশের এক এবং অদ্বিতীয় দেবতা, তাঁরই খাতিরে বাকি সব দেবমূর্তি পুড়িয়ে ফেলতে হবে(৫৯)। তাই বৌদ্ধস্বর্গের বাসিন্দা এই মহাকাল যখন গণেশকে পদদলন করছেন তখন তাঁর সঙ্গে হিন্দুসমাজের আইনকর্তা যাজ্ঞবল্ক্যের দৃষ্টিভঙ্গির খুব বেশি তফাত খুঁজতে যাওয়াটা ভুল হবে। আইনকর্তাদের কথাটা যখন উঠলোই তখন তা শেষ করে নেওয়াই ভালো। মনু নাকি বলেছেন, গণেশ ব্রাহ্মণদের দেবতা নন, ক্ষত্রিয়দের দেবতা নন, এমনকি বৈশ্যদেরও দেবতা নন—তার বদলে শুধুমাত্র শূদ্রদের দেবতাই :
বিপ্রাণাং দৈবতং শম্ভুঃ ক্ষত্রিয়াণাং তু মাধবঃ।
বৈশ্যানাং তু ভবেৎ ব্রহ্মা শূদ্রানাং গণনায়কঃ।।
–অর্থাৎ, ব্রাহ্মণদের দেবতা হলেন শম্ভু, ক্ষত্রিয়দের মাধব, বৈশ্যদের ব্রহ্মা আর শূদ্রদের গণনায়ক। অবশ্যই এই শ্লোকটি মনুস্মৃতিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু উইলসন থেকে অক্ষয়কুমার দত্ত(৬০) পর্যন্ত দেশ-বিদেশের পণ্ডিতেরা একবাক্যে বললেন, দেশের ঐতিহ্য অনুসারে শ্লোকটি মনুরই রচনা।

প্রশ্ন হলো, শূদ্র মানে কী? যাদের চোখে জল(৬১), শ্রমের দায়িত্ব যাদের উপর,—অর্থাৎ, শঙ্করাচার্যের ভাষায় যারা হলো ওই প্রাকৃতজনাঃ বা পণ্ডিত জবাহরলাল নেহেরুর ভাষায় যারা হলো কিনা ‘unthinking masses’—তারাই শূদ্র। এরা এলো কোথা থেকে—সে প্রশ্ন নিয়ে ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত(৬২) সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন। কিন্তু আমাদের যুক্তির বর্তমান পর্যায়ে বিশেষভাবে জরুরী প্রশ্ন হলো, মনু ওই গণনায়ককে যাদের দেবতা বলেছেন তাদের প্রতি শাসকসমাজের মনোভাবটা কী রকম? অতুলচন্দ্র গুপ্ত(৬৩) বলছেন :

‘বাংলা ছিলো সোনার বাংলা, তা তো বটেই। কিন্তু বলে ছিলো? কলকারখানা ম্যাঞ্চেস্টারের কাপড় আসবার পূর্ব পর্যন্ত কি? সেই সময়েই তো ছিয়াত্তুরের মন্বন্তর। তাতে নাকি সোনার বাংলার একপোয়া লোকের উপর না খেয়ে মরেছিলো! মোগল পাঠানের আমলে বোধ হয়? বিদেশীদের বর্ণনা, আবুল ফজলের গেজেটিয়ার, মুকুন্দরামের কবিতা রয়েছে। গোলায় ধান, গোয়ালে গরু, অবশ্যই ছিলো—এখনও আছে। কিন্তু এখনকার মতো তখনো সে গোলা আর গোয়ালের মালিক অল্প ক’জনাই ছিলো।…তবে হিন্দুযুগে নিশ্চয়। কিন্তু সে যুগেও কি এখনকার মতো দেশে শূদ্রই ছিলো বেশি? তাদের standard of living তো মনু বেঁধে দিয়েছেন :

উচ্ছিষ্টমন্নং দাতব্য জীর্ণানি বসনানি চ।
পুলাকাশ্চৈব ধান্যানাং জীর্ণাশ্চৈব পরিচ্ছদাঃ।।

ঋষি গৌতমেরও ঐ ব্যবস্থা : জীর্ণান্যুপানচ্ছত্রবাসাঃ—কূর্চ্চান্যুচ্ছিষ্টাশনং। পুরোনো জুতো, ভাঙা ছাতা, জীর্ণ কাপড় তাদের পোষাক পরিচ্ছদ, ছেঁড়া মাদুর তাদের আসন, উচ্ছিষ্ট অন্ন তাদের আহার। ‘পুলাক’ কথাটার অর্থ ধানের আগড়া; টীকাকারদের ভাষায় ‘অসার ধান’। দেশে গোলাভরা ধান থাকলেও দেশবাসীর বেশির ভাগের কপালে খুদকূঁড়ো জুটতে কোনও আটক নেই।

মনে রাখা দরকার, মনুর মতে এ-হেন শূদ্রদের সঙ্গেই গণেশের সম্পর্ক। ঐহিত্যনির্ণীত মনুর ওই উক্তিটি মনে না রাখলে মনুস্মৃতিরই অন্য উক্তি বুঝতে অসুবিধে হবে। মনুস্মৃতিতে(৬৪) লেখা আছ, যারা গণযাগ করে শ্রাদ্ধবাড়িতে তাদের প্রবেশ নিষেধ :

স্বক্রীড়ী শ্যেনজীবী চ কন্যাদূষক এব চ।
হিংস্রো বৃষলবৃত্তিশ্চ গণাগাংশ্চৈব যাজকঃ।।

আধুনিক পণ্ডিতেরা এই ‘গণানাংশ্চৈব যাজকঃ’ কথাটা নিয়ে রীতিমতো অসুবিধেয় পড়েন। অসুবিধের কারণ এই নয় যে, টীকাকারেরা ও-কথার তাৎপর্য নির্ণয়ে সত্যিই ঔদাসীন্যের পরিচয় দিয়েছেন। মেধাতিথি বলছেন, গণানাং দেবানাঞ্চ যাজকঃ—গণযাজাঃ প্রসিদ্ধাঃ। কুল্লুকভট্ট আরো পরিষ্কার করে বলছেন, বিনায়কাদি-গনযাগকৃৎ। সোজা কথায়, গাণপত্য বা গণেশ-সম্প্রদায়ের লোক। অথচ, আজকের আবহাওয়ায় সমস্ত রকম পূজা-পার্বণের বেলায় গণেশকেই সর্বপ্রথম পূজো পেতে দেখে মনুর এই সহজ কথাটিকে সহজ অর্থে গ্রহণ করা কঠিন। অথচ মনুস্মৃতি থেকেই প্রমাণ যে, এককালে গণযাজকদের স্বক্রীড়ী, শ্যেনজীবী আর কন্যাদূষকদের সমান নিন্দনীয় মনে করা হতো।

——————
৩১. শিক্ষা ও সভ্যতা ১৪৪।
৩২. R. G. Bhandakar VS 147.
৩৩. Ibid.
৩৪. Ibid.
৩৫. মানবগৃহ্য সূত্র ২.১৪।
৩৬. cf. R. G. Bhandakar VS 145.
৩৭. মানবগৃহ্য সূত্র ২.১৪।
৩৮. P. V. Kane HD 2:xi.
৩৯. P. V. Kane প্রভৃতি গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।
৪০. যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি ১.২৭১-৬।
৪১. পঞ্চানন তর্করত্ন : ঊনবিংশসংহিতা ১৫৭।
৪২. শিক্ষা ও সভ্যতা ১৪৪।
৪৩. যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি ১.২৯৩ ইত্যাদি।
৪৪. বিশ্বকোষ ৫:২০২।
৪৫. M. Monier-Williams op. cit. 343.
৪৬. বৌধায়ন ২.৫.৮৩-৯০ ।। SBE 14:254. cf. P. V. Kane op. cit 2:213.
৪৭. বিশ্বকোষ ৫:২০২।
৪৮. ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ : গণেশখণ্ড।।
৪৯. T. A. G. Rao EHI 1:60.
৫০. B. N. Datta SISP 13.
৫১. শিক্ষা ও সভ্যতা ১৪৪।
৫২. Introduction to A. Getty G xv.
৫৩. A Getty G Plates xix & xxiii (a) & (b).
৫৪. Ibid 43.
৫৫. Ibid Plates xviii (a) & (d).
৫৬. Ibid 43.
৫৭. A. Getty GNB 160-1.
৫৮. Ibid.
৫৯. Ibid.
৬০. H. H. Wilson RSH.
৬১. B. N. Datta SISP 28. “It is said that the words Sudra means ‘one who grieves’”…
৬২. Ibid 28ff.
৬৩. শিক্ষা ও সভ্যতা ১৪০।-১।
৬৪. মনু ৩.১৬৪।