০৬. কাঞ্চনের মুখ ভার

পরদিন সকালে দেখা গেল কাঞ্চনের মুখ ভার। সে বার বার লখাইকে বলল তাকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসার জন্য।

লখাই বলল, বেশ তো, সাতদিনের মধ্যে যদি কালীবোঠান না আসে তবে রেখে আসব।

সে কথা কাঞ্চন শুনল না। কেঁদে বলল সে, না এখেনে আমি আর এক দণ্ডও টিকতে পারছি না। দিদি নেই, মধু নেই, গরুগুলোকে খড়বিচুলি খাওয়াতে গেলে কী ফোঁস ফোঁস করে উঠছে। ভাসুর যে ওদের বাপের মতো। তুমি একবার বোদাই যাও, ওদের নিয়ে এসোগে। নইলে নোকেও তোমাকে দুষবে।

লখাই বলল, পুবে তো আমি কোনও দিন যাইনি। অচেনা পথ। পরে আবার ফিরে আসতে হবে তো আমাকে। কতখানি পথ তা কে জানে?

কাঞ্চন ছাড়বার পাত্রী নিয়ে। বলল, ভারী তত পথ। মাত্তর চার কোশ হবে বা। আর অচেনা তো কী, জিজ্ঞেস করলে নোকেই বলে দেবে।

লখাই একমুহূর্ত কাঞ্চনের দিকে তাকিয়ে বুঝল যেতে তাকে হবেই। এমনিতেই কালীবউ, শ্যাম গিয়ে অবধি মুখে অন্নজল তোলেনি.সে। সাতদিন অপেক্ষা করতে গেলে কাঞ্চন হয়তো উপোস করে প্রাণ দেবে। সে বলল, আচ্ছা দেখি, একবার খিরপাড়ার ছিরিশদাদার সঙ্গে কথা বলে। আগে এটু নেয়ে আসি পদ্মপুকুর থেকে। বলে গামছাটি টেনে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল।

গ্রীষ্মকাল। বেলা মস্ত। রাত না পোহাতেই সূর্য যেন আকাশে উঠে বসে আছে। এর মধ্যেই তাত ফুটতে আরম্ভ করেছে। তবু খানিক মোলায়েম হাওয়া আছে বলে বাঁচোয়া। নইলে বোধ করি সিদ্ধ হয়ে মরতে হত।

পদ্মপুকুর গ্রামের শেষে। এ চাকলার মধ্যে এটাই বোধ হয় সবচেয়ে বড় পুকুর। পুকুর না বলে দিঘি বলাই বোধ হয় ঠিক ছিল। মস্ত উঁচু পাড়। চারদিকে বড় বড় গাছ, লতাজঙ্গলের বুপসি ঝড়ে ছাওয়া। দিনের বেলাও এত নির্জন যে, কেমন যেন গা ছমছম করে? রাত্রে নাকি এখানে চোর ডাকাতেরা তাদের নৈশ-অভিযান শেষে বসে হিসেব-নিকেশ করে। এত যে গাছপালা, প্রাণ জুড়ানো ঠাণ্ডা, তবু একটা পাখিও এখানে ডাকে না। এখানকার ও নীরবতার মধ্যে যেন অশরীরী আত্মার অবস্থিতি অনুভর করা যায়।

পুকুরের কাছাকাছি এসেই লখাই থেমে পড়ল। তার যেন মনে হল, তার পেছনে কিম্বা পাশে পাশে আরও কেউ আসছে। সে চারিদিকে একবার ভাল করে দেখে নিল। কিন্তু কেউ তো নেই। অথচ ধীরে চলা পায়ের শব্দ এখনও শোনা যাচ্ছে, অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হচ্ছে। সে পিছন ফিরে দেখল। না, কেউ নেই।

এতটুকুন ভাবতে ভাবতেই সে দেখল তার খানিক দূরের ঝাঁকড়া পিপুল গাছটার তলায় নারান তার দিকেই এতো দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ছোট করে ছাঁটা চুল, গোল মুখ নারানের ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। লাল চকচকে চোখ দুটো যেন জ্বলছে দুখণ্ড অজারের মতো, তার বেঁটে কালো লোমশ শরীরের সমস্ত পেশিগুলো শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে। দুটো সুপুরির মতো তার চোয়ালের হাড় রয়েছে ফুটে। সামনের দিকে তার খাটো শক্ত শরীর এমনভাবে ঝুঁকে আছে যেন বন্য হিংস্র জানোয়ার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ওত পেতে আছে।

লখাই নারানের মনোভাব সঠিক বুঝতে না পেরে ডাকল, নারান ভাই, তুমি এখেনে?

দাঁতে দাঁত ঘষে চিবিয়ে বলল নারান, শালা, ভাই লয়, নারান তোর যম। যার ধন তার ধন নয়, নেপোয় মারে দই। শালা, কালসাপ! ভেবেছিস আমাদের বাপ-পিতামোর ভিটে আর মাগী নিয়ে ঘর করবি তুই?

লখাই দু পা এগিয়ে বলল, ছি লারান ভাই, তোমার ভিটেয় তুমি এস, যখন খুশি তাড়িয়ে দেও আমাকে, আমি চলে যাব। কাঞ্চী বউয়ের ব্যাপারের জন্য তুমি আমাকে শাস্তি দেও নারানভাই, আমি যে পানটা দমাতে পারিনি।

পারিসনি তো সামনা, ওই পান তোর রেখে যা এখেনে। বলে আচমকা পায়ের কাছ থেকে মস্ত একটা মাটির ঢেলা দুহাতে তুলে সে ছুড়ে মারল লখাইয়ের বুক লক্ষ করে।

লখাই চকিতে একবার লারান ভাই বলেই ডান দিকে সরে গেল। মাটির ঢেলাটা চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল তার পায়ের কাছে পড়ে। পুনবার চোখচোখি হওয়ার পূর্বেই চোখের পলকে এক লাফে নারান লখাইয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুহাতে গলা টিপে পুকুরের খাড়া ধারের অল্প-পরিসর জমির উপর আছড়ে পড়ল। পড়ার সে কী শব্দ, যেন দুটো মত্ত হাতি আছড়ে পড়ল।

লখাই শক্ত হাতে নারানের হাত দুটো ছাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টায় ঠেলা দিয়ে নারানকে ফেলে দিতে চাইল। কিন্তু নারাণ মৃত্যুপণ করে গলা টিপেছে, নিজের শক্ত মাথা দিয়ে লখাইয়ের নাক এবং চোখ চুঁ দিয়ে গুতিয়ে ভাঙতে লাগল। চাপা গলায় হিসিয়ে উঠল, শালা, আমার পেরমায়ুর জন্য মোনর ছেলে এলি তুই, আজ তোর পেরমায়ু কে রাখে একবার দেখি।

লখাইয়ের শক্তিও বড় কম নয়। সে এত জোরে নারানের দুই কবজি চেপে ধরেছে যে, ক্রমশ যেন নারানের থাবা শিথিল হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে তার মাথার তোয় লখাইয়ের নাক মুখ দিতে রক্ত বেরুতে শুরু করেছে। লখাই ডাকবার চেষ্টা করল, নারানভাই।…

নারান লখাইয়ের মাথাটা আলগা করে তুলে আবার ঠুকে দিল মাটিতে। শালা ভাই লয়, নারান তোর যম। লখাই পায়ের চাড় দিয়ে কাত হওয়ার চেষ্টা করতেই নারান হাঁটু দিয়ে প্রচণ্ডভাবে তার তলপেটে আঘাত করল। গাঁক করে একটা শব্দ উঠল লখাইয়ের প্রায় দমবন্ধ গলা থেকে।

শব্দ উঠতেই হঠাৎ দেখা গেল নারানের একটা হাত লখাই গলা থেকে তুলে সরিয়ে দিয়েছে। আবার সেই হাতটা গলায় এসে পড়বার পুর্বেই লখাই ঘাড় কাত করে এক প্রচণ্ড ঘুষি কষালেনারানের গদানে। ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে নারান কাত হয়ে পড়তেই লখাই ছাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু নারান ছাড়ল না। একটা ক্রুদ্ধ আর্তনাদ করে লখাইয়ের কোমর জড়িয়ে ধরল সে। লখাই চিৎকার করে উঠল, সাবধান নারান, সাবধান!

আগে তুই সাবধান! বলে নারান একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে দুজনেই পুকুরের গড়ানো জমিতে জাপটা-জাপটি করে গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু জলে পড়ল না, কাছাকাছি এসে থেমে পড়তেই সুযোগ বুঝে এক লাফে লখাই নিজেকে মুক্ত করে সরে দাঁড়াল। নারানও দাঁড়াল।  

যেন দুটো মাটিমাখা ক্রুদ্ধ মোষ রক্তাক্ত চোখে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আক্রমণের ছল খুঁজছে। নারান বলল, যদি শুয়োরের বাচ্চা না হোস্, যদি কুকুরের মতো ওই মাগীর সঙ্গে ঘর না করতে চা, তবে লড়।

এই আচমকা আক্রমণ ও নিজের রক্তদর্শনে লখাইও তখন দুর্দান্ত হয়ে উঠেছে। তবু বলল, এ ভাল লয় লারান, কথা বলে মীমাংসা করো। লোক হাসিও না, সরে যাও।

নারান শুনল না সে কথা। মুহূর্ত সময় না দিয়ে আবার সে লাফিয়ে পড়ল লখাইয়ের উপর। লখাইও তখন নারানের চকিত আক্রমণ বুঝে নিয়েছে। সে চকিতে সরে যেতে নারান হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ল। তার এই পশ্চাদগমনে নারান আরও খেপে উঠল। সে আবার ঝাপিয়ে পড়ে লখাইয়ের চুলের মুঠি চেপে ধরল। লখাই বুঝল নারান ছাড়বে না। এবার পরস্পরে সত্যি লড়াই শুরু হল। একবার এ ওর নীচে যায়, আবার ও এর নীচে যায়।

লম্বা লম্বা ঘাস জঙ্গল মইয়ে অনেকখানি জায়গা আলোড়িত হয়ে উঠল তাদের লড়ায়ে। ঘন নিশ্বাস ও বিচিত্র শব্দ উঠতে লাগল ওদের গলা দিয়ে। ওদের ঘন ঘন পতনে মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠল। বোধ করি সর্বচরাচর স্তব্ধ হয়ে এ দ্বন্দ্বযুদ্ধের ফলাফল দেখবার প্রতীক্ষা করছিল।

দুজনেরই ঘামে শরীর ভিজে উঠেছে, জাপটা-জাপটি করতে গিয়ে পিছলে যাচ্ছে। তাতে নারানের খাটো শরীরে কিছুটা অসুবিধা ঘটল। তা ছাড়া, তার ক্রোধের প্রেরণাটাই বড় বড় ছিল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে লখাইয়ের শক্তি নারানের চেয়ে বেশি। তাই একবার সুযোগ বুঝে নারান লখাইকে নীচে ফেলেই তার চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। তা বুঝতে পেরেই লখাই নারানের দুহাত ধরে পা তুলে আচমকা নারানের গর্দানটা আটকে উলটে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর একলাফে উঠেই নারানের দুই পা ধরে শুনে তুলে ছুড়ে ফেলল খানিকটা দূরে। লখাইয়ের মূর্তি তখন নারানের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মৃত্যু পণ করে বুনো শুয়োরের গোঁয়ের মতো সে অবস্থাতেই আবার নারানকে তুলে আছড়ে ফেলল মাটিতে। নারান আর্তনাদ করে উঠল, আঃ!

কিন্তু লখাই ছাড়ল না। সে অবস্থাতেই নারানের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তার একটা ঠ্যাং পা দিয়ে চেপে আর একটা ঠ্যাং ধরে উপরের দিকে টান মারল। নারান ভয় পেল। শক্তি যদিও বা ছিল, ভয়ে তা নিঃশেষ হয়ে গেল। মনে করল লখাই তাকে চিরে ফেলার চেষ্টা করছে বাগে পেয়ে। সে অস্ফুট গলায় ডেকে উঠল লখাই!

ডাকটা কানে ঢোকামাত্র লখাইয়ের দুরন্ত ক্রোধ যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। সে তাকাল নারানের দিকে এবং তার মৃত্যুভীত চোখে চোখ পড়তেই তার সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে এল। সে নারানের পা ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল।

নারান মুহূর্ত পড়ে থেকে মাটিতে ভর দিয়ে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে পুকুরের ঢালু পাড় দিয়ে টলতে টলতে উঠে গেল। একবারও ফিরে তাকাল না। একেবারে উপরে গিয়ে একবার সে থমকে দাঁড়াল, মনে হল যেন কিছু বলবে লখাইকে। কিন্তু কিছুই না বলে শুকনো পাতায় মসস করতে করতে ফিরে গেল সে।

এমন সময় হঠাৎ একটি জোয়ান মানুষ যেন পুকুরের ধারের জঙ্গল ফুড়ে হাসতে হাসতে উঠে এল লখাইয়ের কাছে। মানুষটা প্রায়-ফরসা, মস্ত বড় বড় গর্তে বসা চোখ লাল কিন্তু হাস্যময়। মস্ত বড় একজোড়া গোঁফ। কপালে সিঁদুরের দাগ। খালি গা, চওড়া শক্ত গড়ন। বুকে কালো লোম ভরা, মাথায় একরাশ চুল। তাতে এক চিলতে কাপড় জড়িয়ে বেঁকিয়ে গিঠ দিয়েছে। সে এসে লখাইয়ের বুক চাপড়ে দিয়ে বলল, বারে ব্যাটা বাঃ, কালী কালী বল। একে বলে বীরের ধন্মো। তোমার নাম তা হলে লখাই। চাঁদরাজার ব্যাটাই বটে! মোনর কোপে চাঁদের ছ পুতুর মল, লখায়ের কথা মনে করে আবার বুক বাঁধল। বসো বসো, হাঁপে পড়েছ। বড় রক্ত ঝরছে নাক থেকে, জল দে আমি, ধুইয়ে দিচ্ছি।

লখাই কিছু বুঝতে পারল না, লোকটা কে, কোত্থেকে এল। বিস্মিত মনে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে পড়ল সে। গায়ের অনেক জায়গা ছেড়ে গিয়ে তাতে নোনতা ঘামের দুরানি লেগে জ্বালা করতে লাগল তার। কিন্তু এ শরীরে তখুনি জলে নামল না সে।

লোকটা মাথার কাপড়টুকু খুলে জলে ভিজিয়ে ভাল করে লখাইয়ের মুখ নাক ধুইয়ে মুছিয়ে, সেটা দিয়েই হাওয়া করতে লাগল।

কিছুটা দম পেয়ে লখাই ভাল করে লোকটাকে এবং তার সিঁদুরের ফোঁটা ও চোখ দেখে হঠাৎ তার মনটা চমকে উঠল। কাপালিকদের কথা শুনেছে সে। তারা এমনি মানুষকে ভুলিয়ে নিয়ে গিয়ে অনেক সময় অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য বলি দেয়। সে জিজ্ঞেস করল, বাবাঠাকুরের ঘর কোথায়?

লোকটা ভাঙা গলায় হেসে উঠে বলল, বাবাঠাকুর কীহে, বাবাও লই, ঠাকুরও লই, নাম একটা আছে বটে।

তুমি কি এ স্যানপাড়ারই বাসিন্দে?

হ্যাঁ। তুমি?

মাদ্রালে আমার বাড়ি। মাদ্রাল চেনো?

চিনি না। শুনেছি। কোথা আসা হয়েছিল?

কোথাও না। ফেরার পথে বিশ্যেম হচ্ছিল।

এখেনে?

হ্যাঁ। বলে সে মিটমিট করে হাসতে লাগল লখাইয়ের দিকে তাকিয়ে। লখাইয়ের ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল।

সে জিজ্ঞেস করল, কী করা হয়?

কালী সেবা।

চমকে উঠল লখাই, সন্ত্রস্ত চোখে তাকাল সে। সন্দেহ তার দৃঢ় হয়ে উঠল। বলল, নাম?

এবার লোকটা হাওয়া থামিয়ে গোঁফে তা দিতে দিতে পিট পিট করে তাকিয়ে বলল, নামটা শুনবে? বলব তোমাকে, বলব? বীরপুরুষ তুমি, তোমাকে আমার ভাল লেগেছে। তবে কালীর দিব্যি করে বলতে হবে, কাউকে কোনও দিন আমার কথা কিছু বলবে না।

সন্দেহে মন দুলছে লখাইয়ের। সাত-পাঁচ না ভেবে সে দিব্যি করে বসল কালীর নামে।

লোকটা স্থির দৃষ্টিতে লখাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, নাম মনোহর বেদে।

মনোহর বেদে! আচমকা যেন বজ্রাঘাতে প্রাণহীন আড়ষ্ট হয়ে গেল লখাই। একবার কেঁপে উঠল তার সমস্ত শরীর, বোধ করি আতঙ্কে তারলোমকূপ খাড়া হয়ে উঠল। মনোহর বেদে যে দুর্দান্ত ডাকাত, তার নামে সারা পরগনা থরহরিকম্পমান! বুঝি হাওয়া স্তব্ধ হয়, পদ্মপুকুরের জলও বোধ করি গেল স্থির হয়ে। তার সামনে মনোহর বেদে? তাকে কেউ কোনও দিন দেখতে পায় না। দিনের বেলা যে থাকে মাটির তলায়, রাত করে আসে আকাশের ওপর দিয়ে!

মনোহর লখাইকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হেসে বলল, ভয় পেয়ে গেলে তুমি বীরপুরুষ হয়ে? কালী কালী বলল। তবে দেখো, তোমার কাদের খবরটা দিয়ে দিয়ো না। দেবে নাকি?

লখাইয়ের মনে হল ডাকাতও কি এমন করে কথা বলতে পারে? এ তো তার ছিনাথঠাকুরের বন্ধুর মতো, সদাশয়, অমায়িক, হাস্যময়। তাকে আদর যত্ন করেছে। ভয় কাটিয়ে সে বলল, কালীর নামে দিব্যি করেছি না? কিন্তু তুমি ডাকাত কেন?

মনোহর হেসে উঠল। বলল, ডাকাত কোথায় দেখলে? কোথায় আমার লেঠেল বরকন্দাজ ঘোড়সওয়ার যে লুঠ-ডাকাতি করব? ডাকাত হল তোমার ফরাসডাঙার বড়সাবে আর মানিকঠাকুর। ওদের দল আছে, তলোয়ার বন্দুক আছে, গণ্ডা গণ্ডা ছিপ লেটকো আছে। আমার কী আছে?

লখাই বলল, তবে যে শুনি—

বাধা দিয়ে বলল মনোহর, আহা, যা রটে তা কিছু তো বটেই। লইলে কোম্পানি আর বড় বড় বাবুরা এত খাপ্পা কেন, বলো? তা বলে কি ডাকসাইটে জমিদার আর কোম্পনির ফিরিঙ্গিদের মতো দিনেদুপুরে লুটতে পারি আমরা? এই তোমার ঘাঁত বুঝে ডাক, লয় তো খাজনা কোনও কোনও সময় রাতবিরেতে। আচ্ছা, এবার বলো তো তোমাদের লড়ায়ের বিত্তান্তটা কী? ওই লারান না কী নাম ওর, কী হয়েছে তোমার সঙ্গে ওর?  

লখাই সব কথা বলল মনোহরকে, শুধু নিজের আত্মপরিচয়টুকু বাদ দিয়ে।

মনোহর ঘাড় দুলিয়ে লখাইয়ের পিঠ চাপড়ে বলল, ও, তা হলে বেহুলা করে লিয়েছ। বেশ বেশ, এই তো বীরের ধম্মো, লড়াই করে জিতে নাও। আচ্ছা, এবার তা হলে চলি। দিনমানে আর বসব না।

লখাই তাড়াতাড়ি বলল, তা হলে দাদা—

দাদা? হঠাৎ যেন চমকে গম্ভীর হয়ে গেল মনোহর। বলল, তুমি দাদা বললে আমাকে? কালী কালী বলো। সাতকুলে যার কেউ নেই, সেই ডাকাতের তুমি ছোট ভাই?

লখাইয়ের হাত চেপে ধরে বলল, বেশ, তাই সই, তোমার কুল থেকেও নেই, মোনসার বরে মরা মানুষ পিথিমী দেখেছ তুমি আবার। তুমি আমার ছোট ভাই। তবে মনা বেদের ঘর নেই, পথে ঘাটেই ভায়ের সঙ্গে দেখা হবে। চললাম।

বলে তাড়াতাড়ি পুকুরের উত্তর ধার দিয়ে যেন সে চকিতে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *