০৬. আকাশে পাখির মেলা

আকাশে পাখির মেলা, কিন্তু বর্ষাকাল মাত্র। বর্ষার পরে শরৎ, শরতের পরে হেমন্ত এবং তারও পরে বসন্ত। সে অনেক দিন প্রায় তিন যুগেরই সমান। হাতজোড় করে বললাম, একটু দয়া করুন, বৌদি। এত দেরি কেন। আগে হলে তো কোনো ক্ষতি নেই!

ক্ষতি নেই! শিল্পীর বিয়ে ফালগুন মাসেই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি!

কিন্তু বৌদি, এ যুগের শিল্পী তো সে-যুগের সভাসদ নয়, সে মূলত ট্র্যাজেডিরই কবি। তাই বর্ষাকালটাই তার বিবাহের উপযুক্ত সময় নয় কি?

যাই বল, বর্ষাকালটা বিরহেরই কাল! বৌদি হেসে বলল, পূর্বরাগটা একটু বেশি সময়ই চলুক না! এর মধ্যে সব গুছিয়ে নাও।

হাল্কাভাবে বললেও কথাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গতিহীন পাত্রের হাতে অভিভাবক মেয়ে তুলে দেবেন না, এ স্বাভাবিক এবং এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। গুছিয়ে নেবার চেষ্টায় আছি বৈ কি। কপাল ভালো, ব্যবস্থা হয়েও গেছে একটা। স্কুলের একজন। টিচার বৃত্তি নিয়ে জাপান যাচ্ছেন দু’বছরের জন্য, তার জায়গায় কাজ করব আমি। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা হয়ে গেছে। কাজটা অবশ্য অস্থায়ী, কিন্তু দু’বৎসর সময় তো নেহাৎ কম নয়? এর মধ্যে সুবিধে একটা হবে। এমনকি, স্কুলেও লেকচারারের পদ পেয়ে যেতে পারি। সিলেবাসের বিস্তৃতির সম্ভাবনা এবং সে-জন্য নতুন লোকের দরকার।

কিন্তু যার কারণে এত সাধনা, তার থেকে যে ক্রমেই দূরে সরে পড়ছি। দেখা হয়, তবু ব্যবধানটুকু বজায় থাকে। বৌদি কথা দিয়েছেন, দাদা মৌন, এখন ওর অভিমতটা জানতে পারলে মন্দ লাগত না।

সেদিন সুযোগ মিলল। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল, বাসার কাছে যেতেই ঝমঝম্ বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে উঠলাম বারান্দায়। বিকেল বেলা, অথচ ছোটদের সাড়াশব্দ নেই। বড় ঘরটা ফাঁকা। ওরা বাইরে বেরিয়েছেন নিশ্চয়ই! কিন্তু বাসা খালি রেখে তো যেতে পারেন না?

স্টুডিও ঘরটাও শূন্য। জামিল ভাই একটা কাজে হাত দিয়েছেন, ক্যানভাস ইজেলে সাঁটানো।

হঠাৎ শিশুর কান্না শুনতে পেয়ে রান্নাঘরের দিকে যাই। একধারে পেছন ফিরে পিড়িতে বসে আছে ছবি। তার কোলে, মনে হলো, একটি ছোট্ট ছেলে। ছোট্ট পা দুটো ছুঁড়ে ঊআঁ আঁ করছে।

পাশ ফিরে আমাকে দেখতেই ছবি লজ্জায় আরক্তিম হয়ে গেল। বলল, একি! তুমি!

হ্যাঁ, আমি। বাচ্চাদের দিকে তোমার বড় টান দেখছি।

পান্নার ছেলে! এতটুকুন, কিন্তু ভারি দুষ্টু! ছবি বলল, আচ্ছা, তুমি এলে কি করে? গেট বন্ধ ছিল না?

কই না তো?

কত যে ভুল হচ্ছে আমার! বৌদিরা বাইরে গেছেন! ছবি একটু ইতস্তত করে বলল, তুমি এখন চলে যাও না?

আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম, কেন? কেন একথা বলছ?

তুমি আর আমি এ-বাড়িতে একলা, লোকে কি ভাববে! তাছাড়া আমার বড় ভয় করে।

ভয়! ভয় কিসের? কাঁধের ওপর শুইয়ে বাঁহাতে ও ছেলেটাকে ধরে রেখেছে, শরীরে একটু দোলা জাগিয়ে ডানহাতে মাঝে মাঝে ওর পিঠে চাপড় মারছে, আমি সেই হাতটা এনে নিয়ে আলতোভাবে ধরে আদর করতে থাকি। আপনা থেকেই আমার কণ্ঠস্বর গাঢ় হয়ে এলো। বললাম, শুনেছ তো?

ছবি নিচু মুখটা তুলে আস্তে করে বলল, হ্যাঁ।

কিছু বললে না তুমি? কিছু শোনবার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে থাকি।

কি আর বলব! ছবি তেমনি নিচু স্নিগ্ধস্বরে বলল, বিয়ে না হলেই নয়?

আমি আকুল হয়ে উঠি। বললাম, নতুন করে একথা কেন বলছ তুমি, লক্ষ্মী! কিছুই তো তোমার অজানা নেই!

তা নেই। কিন্তু আমার বড় ভয় হয়, যদি ভুল বুঝ কোনদিন, আমাকে ভালোবাসতে না পার-তাহলে আমি বাঁচাবো না যে!

ভবিতব্য সম্পর্কে কিছু বলা যায় না, তোমাকে আঘাত দেওয়া যে হবে আমার নিজেকেই আঘাত করা!

ওর হাত ধরে কাছে আকর্ষণ করছিলাম, ছবি মধুর শাসনের ভঙ্গিতে চাইল, বলল, হেই! কি কথা হয়েছিল মনে নেই?

আছে। আমি গভীরভাবে বললাম, তবে আর কাঁহাতক–!

আওতার দরজার কাছে মেয়েলি স্বর শুনতে পেয়ে ছবি বলল, এই ছাড় পান্না আসছে!

আচ্ছা বিপদ, সিগারেট ধরাবার জন্য আমি উনুনের কাছে গিয়ে বসলাম। ছবি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।

যা ছেলে বাবা! বাপটা মনে হয় চাষা! কিছুতেই বাগ মানে না!

যা বলেছিস অন্যের কোলে থাকতে চায় না! তবু তো তোর কাছে অনেকক্ষণ রইল। ইস্ কি বিশ্রী বৃষ্টি!

দাঁড়িয়ে রইলে কেন? চলো বসি গে।

এবারে গিয়ে আত্মপ্রকাশ করা যেতে পারে। সিগারেট ধরিয়ে বেরিয়ে এলাম! ওরা স্টুডিও ঘরে বসেছিল, এমনভাবে গিয়ে উঠলাম যেন এইমাত্র এসেছি।

এই যে ছবি, দাদা কোথায়?

ওরা তো বাইরে গেছেন। পান্না ঘোমটা টেনে দাঁড়াতেই ছবি বলল, একি! এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? শিল্পী জাহেদ! আর এ হচ্ছে আমার বন্ধু পান্না।

ও আচ্ছা আদাব!

পান্নাও বলল, আদাব।

তাহলে আর কি করব, চলে যাই? ছবির দিকে চেয়েই বলে উঠলাম, বাঃ! চমৎকার তো!

ও খানিকটা অপ্রস্তুতের মতো উচ্চারণ করল, কী?

শিশুকোলে ওর বসার মধ্যে কুমারীমাতা ও ছেলের অপূর্ব ভঙ্গি ফুটে উঠেছিল। আমি ওর কথার সরাসরি জবাব দিলাম না। ব্যস্তভাবে কাগজ, তুলি টেনে নিয়ে বললাম, এভাবেই একটু প্লিজ!

পান্নার দিকে অর্থপূর্ণ সহাস্য মুখে একবার চেয়ে ছবি স্থির হয়ে বসে। ব্রাশ লাইনে ওয়াটারকালার করছি। যদি ভালো হয়ে যায় পরে তেলরঙে নেওয়া কঠিন হবে না। মডেলের প্রাণের রামধনু আমার মনের আকাশে সপ্তরঙের সমারোহ সৃষ্টি করেছে, কাজেই প্রতিটা রেখা একেবারে আমার আত্মার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে সূক্ষ্ম রাগিণীর মতো। ক্রমে আমি আত্মহারা হয়ে পড়েছি।

কিন্তু সব পণ্ড হয়ে গেল। ছেলেটা হঠাৎ এমন কান্না জুড়ে দিল, ওর মায়ের সক্রিয় হওয়া ছাড়া উপায় রইলো না।

যাঃ। কাজটা করতে পারলাম না।

একেবারে দস্যি ছেলে। পান্না ওকে দোলাতে দোলাতে বাইরে নিয়ে গেল।

ছবি তেমনিভাবে বসেছিল। সে যেন অতলান্ত ভাবনার গভীরে ডুবে গেছে। ওর তন্ময় চোখে কিসের স্বপ্ন?

আরও একদিন আমার মনে এই প্রশ্ন জাগল। ফালগুনে যেতে হয়নি, বহু পীড়াপীড়ির ফলে শরতেই তাকে পেয়েছি, গভীর নীল আকাশের মতোই কানায় কানায় ভরে আছে আমার মন। বিস্ময়ের পর বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে যাই, একি সত্যি?

ছবি আমার সহধর্মিণী? জীবন সঙ্গিনী শাদা কথায়, বৌ? ভাবতে অবাক লাগে। ছোটবেলা থেকেই একটা কঠিন সংকল্প ছিল বড় হবো। বিয়েশাদি ব্যাপারটার কথা কখনো চিন্তা করিনি। এমনকি বড় হয়েও ওসব পথের ত্রিসীমানাও মাড়াইনি। অথচ আশ্চর্য আমি প্রেমে পড়লাম এবং যাকে ভালোবেসেছি তাকে বিয়েও করলাম। এযে অবিশ্বাস্য, অলৌকিক।

বৌদিকে বেশ উদার মনে করেছিলাম, আসলে তা নয়। বিয়েরপর পোয়রা দিন ছবিকে নিজের কাছেই রেখে দিলেন।

কিন্তু বাসাটা সম্পূর্ণ গুছানো হয়ে গেলে প্রায় জোর করেই ওকে নিয়ে এলাম। বৌদি বললেন, দেখ ভাই এত উৎসাহ ভালো নয়।

বললাম, বৌদি, আপনিও ভুলে যাবেন না, পাকা লোকেরাই পাকামি করে বেশি।

বাসাটা ছোটো। তবু আমাদের দুজনের পক্ষে খুব ভালো। দুতালা বাড়ির নিচের দুটো কামরা। লাইট কল আছে। উপরন্তু দেয়ালের বাইরে একটা বড় পুকুর, তার পাড় ঘেঁষে নারকেল গাছের সারি, আকাশের অনেকখানি-এগুলো নিঃসন্দেহে বাড়তি পাওনা। ওপর তলা সস্ত্রীক একজন অধ্যাপক থাকেন।

একটি কামরায় আমার স্টুডিও ও বৈঠকখানা, অন্য কামরাটি শোবার। বাসাটা ছবি খুব পছন্দ করল, আমি বিশেষ খুশি হলাম সেজন্য।

অপূর্ব রাত আজ। রূপকথারই মতো। গভীর আকাশের হালকা শাদামেঘে পূর্ণিমার চাঁদ রুপোর কাঠির মায়া বুলিয়ে নিচের বসুন্ধরাকে করেছে সুন্দরী। নারকেল গাছের পাতাগুলো নড়ছে মৃদুমন্দ হাওয়ায়। পুকুরের জলে আলোর ঝিলিমিলি। আমাদের ঘরে ফুলদানিতে মরশুমি ফুল, মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে লাগছে। অনেক বিদ্রি আকাক্ষার রাত পেরিয়ে আজকে এলো জীবনের পরম লগ্ন।

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে আছে ছবি, কী দেখছে সে? কী দেখছে? কোমল কোরকের মধ্যে পদ্মের মতো ওর নিটোল দেহখানি নিবিড় সৌরভে ঘেরা। সামান্য আভরণ, তাই বেনারসী শাড়ির আড়ালে ঝিমি করছে।

আমিও বসে আমি বিছানার ধারে, একটা সিগারেট ফুঁকছি। পরিপূর্ণ অনুভূতির নিঃশব্দ গভীরতা এসে আমাকে পরতে পরতে ঘিরে ফেলেছে। এমনো যে হয় ত জানি না। শরীরের আক্ষেপের বদলে স্থৈর্য। চাঞ্চল্যের বদলে স্তব্ধতা।

সিগারেটের শেষাংশটুকু ছুঁড়ে ফেলে দিই জানালা দিয়ে। আস্তে আস্তে কাছে গেলাম ওর। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস্ করে ডাকি, ছবি!

ও খানিকক্ষণ নীরব থাকে এরপর কথা না-বলার মতো করে একটি ধ্বনি উচ্চারণ করে, কি-!

দুই হাত বুকের কাছে আলগোছে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুমি সুখী হয়েছ?

আমার মুখ ওর মুখের কাছে। সে চোখজোড়া বাইরে থেকে ফিরিয়ে এনে চাইল। আস্তে করে বলল, হ্যাঁ।

একি! তোমার চোখে পানি! দুইবিন্দু অশ্রু ওর দুই চোখের কোণে চিচিক করছে। আমার মাথার চুলে একটা হাত, ও বলল, তোমাকে পেয়েছি। কাঁদবো না?

এত সুখ। তবে কান্না কেন?

প্রকৃত সুখের নামই তো কান্না! ছবি এত সুন্দর করে কথা বলতে শিখেছে! আমি হাতের আঙুল দিয়ে চোখজোড়া মুছে দিই। সে বলল, প্রথম দিন প্রত্যেক মেয়েই একবার কাঁদে সে জানো? এ কান্না কান্না নয়।

আমি বললাম, সত্যি ছবি আমি আশ্চর্য হচ্ছি তোমাকে পেয়েছি একি সত্যি অথবা স্বপ্ন?

জনমে জনমে আমি যে তোমারই ছিলাম। আমাকে পাবে সে তো নতুন কিছু নয়।

তোমার কথাই বোধ হয় ঠিক। নইলে মেয়ে তো কম দেখিনি কিন্তু তোমাকে পাওয়ার জন্য পাগল হলাম কেন।

আমার চোখের পানি তুমি মুছিয়ে দিয়েছ, সারাজীবন তোমার এই আদর থেকে যেন বঞ্চিত না হই।

কী যে বলো তুমি!

অনেকক্ষণের জন্য আমাদের মুখে চাঁদের আলো নিভে গেল, বদলে সেখান থেকে সারাদেহে মধুর উত্তাপ শিশির করে সঞ্চারিত হতে থাকে।

এরপর বিছানার দিকে নিয়ে আসতে চাইলে ছবি মিনতি করে বলল, থাক না লক্ষ্মীটি। এখানেই ভালো লাগছে।

বললাম, সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে কাটাবে?

সারারাত কোথায় মাত্র দশটা বাজলো, একটু থেমে ছবি বলল, তা নাই বা হলো, একটি রাত কাটাতে পারব না?

সারারাত জেগেই তো কাটাবে। কিন্তু তাই বলে এখানে দাঁড়িয়ে নয়।

কোলপাঁজা করে তুললে ছবি দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো।

এতদিন এসব দুষ্টুমিই বুঝি শিখেছ?

হ্যাঁ শিখেছি এবং তা তোমারই জন্য।

একি তোমার চোখ লাল হয়ে গেছে দেখি, রাখো লক্ষ্মীটি! একটুখানি! ছবি উঠে দাঁড়িয়ে সুইচটার দিকে এগিয়ে গেল।

আমি বললাম, আলো থাক না!

ছবি ওখান থেকেই প্রায় তেড়ে উঠে বলল, না, না!

সুইচটা অফ করে দিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল ছবি। ভেবেছিল বোধ হয়, বাতি নিভিয়ে দিলে ঘরটা একেবারে অন্ধকার হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। বাইরে জোছনা ও জানালা খোলা থাকার দরুন আলোর আভাসটুকু আছে। ঘরটা সম্পূর্ণ মসীবর্ণ হয়ে গেলে হয়তো সে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে লুকোচুরি খেলার চেষ্টা করত। কিন্তু দেয়ালের কাছে ওর আবছা মূর্তিটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

দাঁড়িয়ে রইলে কেন। আমি কোমল স্বরে ডাকলাম, এসো।

ছবি কোনো কথা বললো না। কেবল ওর হাতের চুড়ির অস্পষ্ট রিনিঠিনি বোল শোনা গেল।

আমার ওঠা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সেও যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সামনা-সামনি এগুতে থাকলে একদিকে সরে গেল। বুঝলাম ওর মনে দুষ্টুমি বুদ্ধি। আমিই বা কম কিসে? চোখের পলকে ধরে ফেললাম। আর এখন যখন স্পষ্ট আলো নেই তখন সংকোচকে বিদায় দিতেও বাধা নেই।

প্রথম বাসর, ওর বাধাকে জয় করাই তো আজকে আমার কাজ।

চাঁদটা আরো একটু সরে গেছে আকাশের কোলে- গাছের পাতাগুলো লুকোচুরি খেলছে জোছনার সঙ্গে। ধীরে ধীরে একখণ্ড বেগুনিমেঘ এসে চাঁদকে গ্রাস করে ফেলে, চাঁদ ডুবে গেলে ঘরের ভেতরটাও আরো একটু অন্ধকার হয়ে এলো!

কিন্তু আমি তো অন্ধকার চাই না। আমি চাই আলো, আরো আলো। স্পষ্ট দিবালোকের মতো উজ্জ্বল। যে আলোতে আমার এতকালের স্বপ্নের স্বর্গ মোহন-মহিমায়। উন্মোচিত হবে। বিদ্যুতের শিখা অন্তত একবার সেই স্বর্গের শিখর বেদী অলিন্দ ফোয়ারা পুষ্পবন আমার দু’নয়নে মুদ্রিত করে দিয়ে যাক্, এরপরে তাকে ছায়ার স্বপ্ন দিয়েই রচনা করব। পাব তাকে ষড়ঋতুর বিচিত্র লীলায়, আলো আঁধারিতে প্রতিদিন প্রতিরাত।

আমি উঠে যেতে চাইলে ছবি তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল, না, না।

কি?

তুমি কিছুতেই আলো জ্বালাতে পারবে না।

ওর কণ্ঠস্বরের তীব্রতা বিস্মিত হওয়ার মতো। কিন্তু এখন কিছু হওয়ারই সময় নয়! ফেনিল ঢেউ আছড়ে পড়া সমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাজে ভাবনার অবসর কোথায়?

ছবি নেতিয়ে পড়েছিল। সে শ্রান্ত, পরিপুত। হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। বলল, শোনো!

আমিও চুপচাপ শুয়েছিলাম! বললাম, কি?

শিশুর কান্না না?

ওপরতলা থেকে সেই শব্দ শোনা গেল বটে, কিন্তু আমি বললাম, কাঁদছে তাতে কি? শিশু তো কাঁদবেই! শুয়ে থাকো।

কিন্তু ছবি খাট থেকে নেমে নিচে দাঁড়িয়ে গোছগাছ করতে থাকে। মৃদু রিনরিন করে বাজে ওর হাতের চুড়ি। এরপর ডাকল, এই শুনছ? আমি একটু বাইরে যাই?

বাইরে কেন? শুয়ে থাক না? অনেক রাত হয়েছে।

কোথায় অনেক রাত? বালিশের কাছে হাতঘড়িটা তুলে নিয়ে রেডিয়াম কাঁটা দেখবার পর বলল, মাত্র সাড়ে এগারটা।

মেঘের পাহাড় সরে গিয়েছিল হয়তো, জানালাটা আবার আলোকিত হয়েছে। ছবি একটা শিক ধরে দাঁড়াল। পিঠে খোলা চুলের ঝাকড়া।

শিশুর কান্না থেমে গেল বলেই কিনা জানি না, ছবি আর বারান্দায় যেতে পীড়াপীড়ি করল না। সে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে চেয়ে, প্রবল জোছনা-ধারায় হালকা শাদা মেঘগুলো ভেসে যাচ্ছে। ও চুপচাপ, জীবনের নতুর স্বাদই কি ওকে মূক করে দিয়েছে?

কিন্তু আমি ভাবছিলাম, শিশুর প্রতি ছবির এত টান কেন। মেয়েরা ছোটদের ভালোবাসে, তবু ওর ব্যবহারের মধ্যে একটুখানি আতিশয্য আছে নাকি? এবং সেটা শুধু নোট-শিউলি নয়, তাদের ছাড়িয়ে বাইরের দিকেও উনুখ। হয় এটা এক ধরনের খ্যাপামি; নয় অস্বাভাবিক। যাই হোক ওর কোলে একটা শিশু আসুক, এই মুহূর্তে এই আমার আন্তরিক কামনা। কিন্তু তা তো রাতারাতি সম্ভব নয়। আট দশটি মাস তো অন্তত দরকার। যেরকম ভাবসাব, এতদিন থাকবে কি করে? বৌদির ছেলেমেয়েদের কথা দু’একদিন পরে নিশ্চয়ই বলবে ও।

একটা সিগারেট ধরিয়ে উঠে গেলাম। ওর কাছে গিয়ে কানে কানে বলি, ছেলে তোমার চাই একটা, না?

ছবি কি ভাবছিল, চোখ তুলে চাইল আমার মুখের দিকে, অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করল, তা কি আমি বলেছি!

সব কথা বলতে হয় না ছবি। আমি বললাম, তাছাড়া প্রথমে দু’একটার দরকার তো বটেই। পরে না-হয় অন্য কিছু ভাবা যাবে।

জানালার একটি কপাটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ছবি। আমার বুকে ওর মাথাটা আস্তে করে এলিয়ে দিল। এ যেন নীরব সম্মতি।

রাত ক্রমে বেড়ে চলে। ঝিমিয়ে আসে গাছপালা, সারা প্রকৃতি। রুপালি চাঁদ নিস্তব্ধ পৃথিবীতে তার মায়া বিছিয়ে হাসে। ছবি এসে শুয়েছিল, এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে ঘুমোতে চায়নি, তাই এ-ঘুম যেন ওর নিজের নয়। আকাঙ্ক্ষার আবেশ বেয়ে যে সফলতা এলো, তারই সোনার কাঠির স্পর্শে যেন সে সুপ্তির অন্তরঙ্গ প্রবাহে নিমজ্জিত হয়ে গেছে।

ফিনফিনে জালের নতুন মশারিটা নড়ছে একটু-একটু, আমার চোখে ঘুম নেই। বাজে চিন্তার সূত্রটা কিছুতেই ছিন্ন করতে পারছিনে। বরং সে ফেনিয়ে ওঠে। এই রাত তো আর আসবে না কোনদিন ফিরে? ঘুম আসছে না সে ভালোই, আমি শিল্পী এই রাত, আমাকে অনেক দিয়েছে, আরও কিছু দেবে।

চাঁদ ঢলে পড়ল পশ্চিম আকাশে, নারকেল গাছের পাতার ফাঁকে সে উঁকি মারছে। সে কি দেখতে চায় দুটি প্রাণীর লীলাখেলা? তার আলো কিছুক্ষণ সরাসরিই পড়ে রইল মশারির ওপর এবং পরে আস্তে আস্তে সরে গেল।

আমার মনে একটা বিদঘুঁটে ভাব জেগেছে। আস্তে আস্তে উঠে ছোট্ট হারিকেনটা খুঁজে নিয়ে জ্বালাই।

সলতেটা যথাসম্ভব কমিয়ে রেখে শিয়রের দিকে এসে মনোযোগ দিয়ে দেখি ছবি গভীরভাবে শ্বাস ফেলছে। সহজে ওর ঘুম ভাঙবে না এ নিশ্চিত। সাবধানে বিছানায় উঠলাম। বাতিটা একধারে রেখে ওর সমস্ত আবরণ খুলে ফেলতে থাকি। আমি দেখব ওকে। এতদিন যাকে ঘিরে আকাশ-কুসুম রচনা করেছি, এত কাছে পেয়েও তাকে দু’চোখ ভরে একবার দেখতে পারবো না? অনেকদিন পরে এ ঔৎসুক্য থাকবে না হয়তো, থাকলেও এমন করে থাকবে না সুতরাং যতক্ষণ আছে ততক্ষণ উচিত মূল্য দিই।

একটা চাপা উত্তেজনায় হাতটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল, তবু বাতিটা তুলে আনলাম। সলতেটা বাড়িয়ে দিয়ে ধরি। পরিষ্কার আলোকের মধ্যে ছবি পড়ে আছে সত্যি বড় নিটোল ওর দেহখানি। অঙ্গের বাঁকে বাঁকে, ভাঁজে ভাঁজে কি সুন্দর সুষমা! বহু সাধনায় ছেনিয়ে তোলা মর্মরমূর্তির মতো।

কিন্তু একি! এ সব কিসের চিহ্ন! ভালোমতো দেখতে গিয়ে কপালের দু’পাশের রগ ছটফট করতে থাকে। বই পড়েছি, ভুল হতে পারে না, এযে স্পষ্ট মাতৃত্বের ছাপ! নুয়ে ওর শরীরটা কে শুঁকে দেখি এসেন্সের আড়ালে আরো একটি গন্ধ আছে, যা, কেবল মায়ের গায়েই থাকতে পারে; তা হলে ছবি কি এতদিন প্রাণপণে লুকিয়ে এসেছে কিছু?

ও একটু নড়ে উঠতেই তাড়াতাড়ি বাতিটা কমিয়ে খাটের নিচে রেখে দিলাম।

পাশ ফিরতে গিয়েও হঠাৎ ধড়ফড় করে জেগে উঠল। আমাকে স্পর্শ করে বলল, একি! তুমি এখনো ঘুমাওনি?

কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে একেবারে অনাবৃত দেখে ঝট্‌ করে উঠে বসে। আমি শুয়ে পড়েছিলাম। ঘুমজড়ানো স্বরে বললাম, কি হয়েছে!

ছিঃ ছিঃ, এ নিশ্চয়ই তোমার কাণ্ড; এতক্ষণ এসব পাগলামিই তুমি করেছ?

কই কিছু করিনি তো?

নাহ্ একেবারে সাধুপুরুষ। ছি ছি। লজ্জায় বাঁচিনে।

নিচে নেমে কাপড় পরবার পর ও জানালার কাছে গেলো চাঁদ হয় অস্ত গিয়েছিল নয় অনেক আড়ালে জানালাটা, তাই অন্ধকার। গাছপালায় ভোর হওয়ার আগেকার ঘোর লাগা ছায়া। শেষ রাতের হাওয়া বইছে। একদল পাখি কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে গেল। একটু পড়ে শোনা গেল বহুদূরের মিনারের প্রথম আজান।

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছবি মাথায় কাপড় দেয়। পরম রজনী শেষ হয়ে এলো, এখন সে পরিতৃপ্ত।

এবং আমিও যা পেয়েছি জগতের মাপকাঠি দিয়ে তার পরিমাপ অসম্ভব। সে গোপনচারী তাকে ধরা যায় না। কেবল দেহের প্রতি আনাচে কানাচে অস্থির অভ্যন্তরে শিরায় শিরায় প্লাবনের মতো এসে কিছুক্ষণের জন্য মৌন মূক করে রাখে, তারপর চলে যায় কিন্তু বর্ষার শেষে পলিমাটির মতই রেখে যায় অমৃতের স্বাদ! আমিও তাকে তেমন করেই পেয়েছি।

কিন্তু তবু কাঁপ ভরে অনেক ফুল তোলার পর আঙুলের একটি কাঁটা ফোঁটার মতো মনের অতলে একটুখানি সন্দেহ খচখচ্‌ করতে থাকে। ছবি আমার কাছে লুকিয়েছে কিছু?

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *