০৫. ১৮ নম্বরের হানাবাড়ি

১৮ নম্বরের হানাবাড়ি

দ্বিপ্রহরের প্রখর রৌদ্রে সমস্ত শহরটা ঝাঁঝাঁ করছে। প্রচণ্ড তাপে রাস্তার পিচ নরম হয়ে উঠেছে। একটা অস্বাভাবিক উষ্ণতা অনুভূত হয়। ট্রাম-বাসগুলো খড়খড়ি এটে যে যার গন্তব্যপথে ছুটছে। রিক্সাগুলো ঠং ঠং আওয়াজ করে দ্বিপ্রহরের রৌদ্রদগ্ধ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করছে।

সুব্রত দরজা-জানালা এটে মেঝেয় একটা মাদুর পেতে তার উপর রেঙ্গুনের একটা ম্যাপ প্রসারিত করে ঝুঁকে পড়ে দেখছিল, এমন সময় বাইরে কড়ানাড়ার শব্দ পাওয়া গেল। রাজু পাশেই শুয়ে দিব্যি নাক ডাকছে। এত গ্রীষ্মেও তার ঘুমের কোন ব্যাঘাত হচ্ছে না।

সুব্রত চোখ ফিরিয়ে নিদ্রাভিভূত রাজুর দিকে একবার চাইল, তারপর উঠে দরজা খুলবার জন্য ঘর হতে বেরল।

তখনও সদর দুয়ারে কড়ানাড়ার শব্দ হচ্ছে খট-খট-খট। দরজা খুলতেই ও দেখলে সামনে দাঁড়িয়ে একজন এদেশীয় উৎকলবাসী।

কি চাই? সুব্রত লোকটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

দণ্ডবৎ। রাজেনবানুর গলি কৌটি পড়িব বাবু? মতে নতুন কটক হইতে আইছন্তি। কলকাতার শহর এমতি সে মু কিমিতি জানিব? অঃ, গোট্টা শহর কত্ত ঘুরিল; ঘুরিতে ঘুরিতে এক বাবু বলি দিলা, গুটে রাজেনবাবুর গলি এক রাস্তা অছি বটে; আমহার স্ট্রীটের ধারে।

সুব্রত একদৃষ্টে শ্রীমান উৎকলবাসীর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। লোকটা লম্বায় প্রায় সাড়ে ছয় ফুট। চোখ দুটো উজ্জল-ঝকঝক করছে অসাধারণ বুদ্ধির দীপ্তিতে, ছোট ছোট করে কদম-ছাঁট চল। জুলপিটাকে খুর দিয়ে কামিয়ে একেবারে রগ পর্যন্ত তোলা হয়েছে। একটা গোলাপী রংয়ের জাপানী সিল্কের জামা গায়ে, বহুদিনের ব্যবহারে তেলচিটচিটে হয়ে কেমনতর যেন হয়ে উঠেছে। পরনে একটা নতুন চওড়া লালপাড় কোরা ধুতি। গলায় একটা পাকানো চাদর গিট দেওয়া, কতকালের ময়লা যে তার ভাঁজে জমে উঠেছে, সঠিক নির্ণয় করাটা একান্তই দুষ্কর। মুখে একগাল পান; দুই কষের কোলে পানের রস ও সুপারির গুড়া আটকে রয়েছে। বগলে পুরাতন একখানি ছাতা ও বাঁ-হাতে বটুয়া।

তোর নাম কি? সুব্রত শুধাল।

শ্রীল শ্রী শ্রীমান জগরনাথ।

এই বাঁ-ধারের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলেই ডান দিকে যে সরু গলি সেটাই রাজেনবাবুর গলি।

দণ্ডবৎ! বলে জগন্নাথ চলে গেল।

সুব্রত লক্ষ্য করলে লোকটা একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। লোকটাকে যতক্ষণ দেখা যায় সুব্রত বেশ ভাল করেই দেখল। তারপর যখন সে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল, দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আস্তে আস্তে ওপারে চলে গেল।

মনে মনে কিন্তু জগন্নাথের কথাই ভাবছিল।

***

গত রাত্রের সরু গলিপথ ধরে সুব্রতর নির্দেশমত অবশেষে জগন্নাথ ১৮নং বাড়ির পিছন দিককার ভাঙা দরজাটার কাছে এসে দাঁড়াল। এইটাই সেই পোড়ো বাড়ি। দু-একবার শ্যেন দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে আস্তেআস্তে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ল চট করে।

আগেই বলেছি বাড়িটা বহুদিনকার। দেওয়ালে দেওয়ালে চুনবালি ঝরার সমারোহ। ইটগুলো দেওয়ালের গায়ে গায়ে বিশ্রীভাবে বেরিয়ে পড়েছে। জানালার কপাটগুলো খিলানের গায়ে কোথাও অর্ধভগ্ন, কোথাও বা জর্জরিত হয়ে ঝুলছে—মাঝে মাঝে বাতাসের ধাক্কায় এদিক-ওদিক নড়ে ওঠে। জগন্নাথ সামনের একটা দরদালান পার হয়ে একতলার উঠোনের সামনে এসে দাঁড়াল।

উঠোনের সিমেন্ট চটে এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে, তার মাঝে মাঝে শ্যাওলা জাতীয় আগাছাগুলো গজিয়ে উঠেছে। উঠোনের ওধারে একই ধরনের গোটা পাঁচ-ছয় ঘর সারিবদ্ধ ভাবে আছে। কোনটির কপাট বন্ধ, কোনটির কপাট হা-হা করছে—একেবারেই খোলা। জগন্নাথ এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। বারান্দায় দক্ষিণের কোণ ঘেষে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। সহসা দোতলার বারান্দায় কাদের পায়ের শব্দ শোনা গেল। শব্দটা ক্রমে জোরে শোনা যাচ্ছে।

কে যেন দম দম করে সিঁড়িপথেই নেমে আসছে।

জগন্নাথ চট করে সিঁড়ির পাশের একটা বড় থামের পেছনে সরে দাঁড়াল। কে যেন সিঁড়ি দিয়ে নামছে, তারই শব্দ। জগন্নাথ কান পেতে রইল। থামের আড়ালে থেকে সে দেখলে, আধবয়সী একজন বেটেমত লোক নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। লোকটার গায়ে একটা সাধারণ বার্মিজ কোট। মাথায় একটা ফেজ। লোকটির একটা পা কাঠের। বগলে তার একটা কাঠের ক্রাচ। সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে কাঠের পায়ে ঠক ঠক শব্দ করতে করতে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চলল এবং ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

আকাশে বোধ হয় মেঘ করেছে। মেঘের আড়ালে সর্য গেছে চেকে, তাই অবেলাতই নেমে এসেছে অন্ধকারের একটা ধসর ছায়া সর্বত্র। বাড়ির ভিতরটা হয়ে উঠেছে আরো অস্পষ্ট।

জগন্নাথ পা টিপে টিপে ওপরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। সিঁড়ির ধাপগুলো প্রশস্ত হলেও ভেঙ্গে ক্ষয়ে গিয়ে একেবারে ইট সব বের হয়ে পড়েছে। জগন্নাথ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল। সামনেই একটা প্রশস্ত টানা বারান্দা। এখানটাও আবছা মেঘে ঢাকা আলোয় অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মেঘলা আকাশে বোধ হয় বিদ্যুৎ চমকে গেল, মুহর্তের জন্য আবছা অন্ধকারের বুকে একটা হঠাৎ আলোর ঢেউ তুলে। জনহীন এই বাড়িটার সর্বাঙ্গে যেন একটা পুরু ধুলার আস্তরণ বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ধুলোবালির কেমন একটা তীব্র কটু গন্ধ নাসারন্ধ্রকে পীড়িত করে তোলে।

দোতলায় বারান্দার জমাট ধুলোর ওপরে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বহু পদচিহ্ন। পদচিহ্নগুলো অল্পদিনের বলেই মনে হয়। বর্তমানে যে এই জনহীন পোড়ো বাড়িতে অনেকের নিয়মিত আনাগোনা শুরু হয়েছে, সেটা বুঝতে কারুরই বিশেষ তেমন কষ্ট হবে না। জগন্নাথ তার তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে এদিক-ওদিক লক্ষ্য করে—একটু আগে কাঠের ক্রাচের সাহায্যে যে লোকটা নীচে নেমে গেল, কে ও? কি জন্যই বা এখানে এসেছিল?

লোকটা নিম্নশ্রেণীর—তার বেশভূষা চালচলন থেকেই বোঝা যায়।

বাইরে বোধ হয় টিপ টিপ করে বৃষ্টি নামল। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া চোখে মুখে এসে ঝাপটা দেয়।

সহসা একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ জগন্নাথের কানে এসে প্রবেশ করে।

অতি সতর্ক জগন্নাথের শ্রবণেন্দ্রিয় মুহূর্তে সজাগ হয়ে ওঠে।

মৃদু গোঙানির শব্দ না? হ্যাঁ, ঐ তো অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে!

বৃষ্টিটা কি এবারে জোরেই নামল ঐ সময়!

আবছা আলোছায়ার মধ্যে সেই গোঙানির শব্দটা যেন আরও সুস্পষ্ট হয়ে হানাবাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝি অশরীরীর বুক-ভাঙা একটা দীর্ঘশ্বাসের মতই মনে হয়। সহসা এমন সময় পাশ থেকেই ফিসফিস করে একটা অস্পষ্ট চাপা, কণ্ঠস্বর জগন্নাথের কানে এল। চট করে সিঁড়ির কপাটের আড়ালে সরে এল সে এবং সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনতে পেল কে যেন বলছেঃ না, কর্তার হকুম। আগামী শনিবারের পরের শনিবারের মধ্যে যেমন করেই হোক ও তিন বেটাকেই ওখানে হাজির করাতে হবে। শির জামিন দিয়ে এসেছি।

আরে বাবা, এ তো তোমার মগের মুলক নয় যে যা খুশি তাই করবে। এদিকে এক বেটা ফেউ জুটেছে কিরীটী রায়। বাছাধন শুনি নাকি আবার শখের টিকটিকি।

কিরীটী রায়? লোকটা কিন্তু খুব সুবিধের নয় বলেই শুনেছি। তা সে কথা থাক। দেখ একটা সন্দেহ আমার মনে জাগছে, কর্তাও যেন এখানে এসেছেন। তবে এ আমার অনুমান মাত্র।

অনুমান কেন? সত্যিও তো হতে পারে।

অসম্ভব কিছুই নেই। উনি যে কোথায় কি ভাবে যান তো বোঝাই দায়। উঃ, সেবার পাশাপাশি এক হোটেলে সারারাত কাটিয়েও টের পাইনি যে কর্তা আমার পাশেই আছেন। নিজেই যখন ধরা দিলেন, চমকে উঠলাম। সে কথা যাক, পরশুর জাহাজেই তো যাওয়া ঠিক?

এখন পর্যন্ত তো তাই ঠিক আছে, তবে শেষ পর্যন্ত কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, কে বলতে পারে বল?

এমন সময় আবার সেই করুণ গোঙানির শব্দটা শোনা গেল।

প্রথম ব্যক্তি বললে, নাঃ, বেটা জালালে দেখছি! আর ছাই বর্মা-মুলুকেই বা টেনে নিয়ে লাভ কি? এখানে শেষ করে দিলেই তো হয়, যত সব ঝামেলা! কণ্ঠে বেশ বিরক্তির ঝাঁজ।

জানিস তো, কর্তা খুনোখুনির ব্যাপারটা তেমন পছন্দ করেন না! জানিস তো!

কিন্তু পরে ঠেলা সামলাবে কে? আজ রাত্রি আটটায় আমাদের আড্ডায় যাবার কথা। সেখানে কাজের ফিরিস্তি সব ঠিক হবে। এখন চল, সেদিকেই যাওয়া যাক।

প্রথম ব্যক্তি জবাবে বললে, তুই এগিয়ে যা। সেই চীনাপট্টির-নং বাড়িটাতেই তো? আমি একটু পরে যাচ্ছি।

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

কথা শেষ হতেই লোকটা এগিয়ে আসে। জগন্নাথ যেখানে দাঁড়িয়েছিল লোকটা সেদিকেই আসছে দেখে জগন্নাথ একেবারে দেয়াল ঘেষে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়াল। পোড়ো বাড়িতে সাঁঝের আঁধারটা যেন থরে থরে চাপ বেধে উঠেছে তখন চারিদিকে।

বহুদিনকার বদ্ধ আবহাওয়ার বিশ্রী একটা ভ্যাপসা দুর্গন্ধ। জগন্নাথের যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।

জনহীন হানাবাড়ির কঠিন মৌনতা যেন সেই সন্ধ্যার আঁধারে এক অশরীরী বিভীষিকার মায়াজাল রচনা করেছে চারিদিকে। কাদের অশ্রুত চাপা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ যেন আঁধারের গায়ে গায়ে বেধে উঠেছে। বাতাস নেই। এমন কি চতুঃসীমায় নেই একবিন্দু আলো। অভিশপ্ত পুরী…

লোকটা যে শেষ পঈযন্ত কোন পথে গেল জগন্নাথ বুঝতে পারলে না। আরও কিছুক্ষণ পরে জগন্নাথ যেদিক হতে কথার আওয়াজ আসছিল, নিঃশব্দে পা টিপে টিপে সেইদিকেই এগিয়ে চলল। খানিক দূর এগোতেই দেখা গেল, অদূরে একটা ঘরের ভেজানো কপাটের ফাঁক দিয়ে একটুখানি অস্ফুট আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সন্তর্পণে জগন্নাথ এগিয়ে গিয়ে কপাটের ফাঁকে চোখ দিয়ে দাঁড়াল। আশেপাশে কেউ নেই। কপাটের ফাঁক দিয়ে জগন্নাথ দেখতে পেল ছোট একখানি ঘর। ভিতরে একটা মোমবাতির সামনে কে একটা লোক যেন ঝুকে পড়ে মোমবাতির আলোয় কি একটা পড়ছে।

লোকটার চোখ-মুখের রেখায় রেখায় গভীর একাগ্রতা ফুটে উঠেছে।

জগন্নাথ ধীরে অতি ধীরে ডান হাতের একটা আঙুল দরজার ভেজানো। কপাটের গায়ে ছোঁয়ালে, তারপর ঈষং একটু চাপ দিতেই আপনিই কপাটটা একটু সরে গেল। কিন্তু লোকটার সেদিকে খেয়াল নেই; সে আপন মনে কাগজটার ওপর ঝুকে পড়ে সেটা পড়ছে তখন।

আরও একটু ঠেলা দিতেই দরজার কপাট দুটো বেশ খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল। আরও একটু– ব্যস। এবার ধীরে অতি ধীরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে জগন্নাথ বিড়ালের মতই যেন নিঃশব্দে সেই ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল। লোকটা তখনও একমনে সেই কাগজখানির ওপর ঝুকে পড়ে কি দেখছে। সে কিছুই টের পেল না। নিঃশব্দে পা টিপে অতি সন্তর্পণে জগন্নাথ এগোতে লাগল। যখন আর মাত্র হাতখানেকের ব্যবধান উভয়ের মধ্যে, সহসা জগন্নাথ ঝপ করে একলাফে লোকটার পিঠের ওপর পড়ে দু হাতে তাকে দঢ়ভাবে জাপটে ধরল।…