০৫. সেদিন বৌদ্ধ-পূর্ণিমা

সেদিন বৌদ্ধ-পূর্ণিমা।

একটা দুঃস্বপ্ন দেখিয়া তপন জাগিয়া উঠিল! দক্ষিণ দিকের চওড়া বারান্দাসংলগ্ন পূর্বদিকের ঘরটায় তপন আর ঐ বারান্দারই পশ্চিমদিকের ঘরটায় থাকে তপতী। মাঝখানে বারান্দাটা যেন একটা দুরন্তনদী—কোন দিন পার হওয়া যাইবে না। প্রভাতের সূর্য আসিয়া তপনের কক্ষে সূর্য-কিরণ ছড়াইয়া দেয়—অস্তগামী সূর্য তপতীর ঘরের পশ্চিমের জানালাপথে উঁকি মারিয়া যায়। ইহারও মধ্যে হয়ত বিধাতার কোন সূক্ষ্ম ইঙ্গিত নিহিত রহিয়াছে।

মা বেশ শান্ত এবং নিশ্চিন্ত হইয়া গিয়াছেন। উহাদের এই কয়দিনের সংবাদ তিনি বেশী রাখেন না। বেশ বুঝিয়াছেন, বারান্দা পার হইয়া উহাদের মিলনগুঞ্জন ভালরূপেই চলিতেছে—ভাবিবার কিছু আবশ্যক নাই।

তপন বলিল,–কি ভাবছেন মা?

—কিছু না বাবা, খাও! তোমার মতো ছেলে পেয়েছি, ভাবার কি আছে?

তপনের অন্তর মুচড়াইয়া উঠিল। এই পরম স্নেহময়ী জননীকে সে প্রতারিত করিতেছে সজ্ঞানে। একবার তার ইচ্ছা হইল মাকে সব কথা বলিয়া জানায় যে তাহারা ভুল করিয়াছে। ডিগ্রীহীন আৰ্য্যধৰ্ম্মভক্ত তপনকে তাহার কন্যা গ্রহণ করিবেনা।কিন্তু তাহাতে ফল কি হইবে। অনর্থক একটা উৎপাত, তপতীর উপর শাসন এবং আরো কিছু কেলেঙ্কারী।না, থাক, তপন কৌশলে জানিয়া লইবে তপতী কাহাকে চায়, তাহারই হাতে তপতীকে ফিরাইয়া দিবার ব্যবস্থা করিয়া সে নীরবে চলিয়া যাইবে। এই যে এখানে ইহাদের প্রচুর স্নেহমমতা সে পাইতেছে, ইহারও ঋণ তপন শেষ করিয়া যাইতে চায়—তাহা সময়সাপেক্ষ। তাহারও একটা উপায় তপন ভাবিয়া রাখিয়াছে।

অম্লতা তপতী বাসি কাপড়েই আসিয়া ঘরের চৌকাট হইতে বলিল,–মা আমার লেকক্লাবে সুইমিং কমপিটিশন্ আছে। এখুনি যেতে হবে। নিজে গাড়ী চালিয়ে গেলে হাতের পরিশ্রম হবে মা, ড্রাইভারটা আসেনি—কি করি বলোতো?

মা হাসিমুখে বলিলেন-তপন যাক না গাড়ী চালিয়ে যাওতো বাবা। —আয় খুকী, খেয়ে নে।

-আচ্ছা মা, যাচ্ছি-বলিয়া তপন উঠিয়া চলিয়া গেল।

কিছুক্ষণ পরে তপতী আসিয়া গাড়ীর ভিতরের সীটে আসন গ্রহণ করিল। তপনের পাশে বসিল না। তপন নিরুদ্বেগে নির্বিকার চিত্তে গাড়ী চালাইয়া দিল। ক্লাবের জুনিয়র ও সিনিয়ার মেম্বারগণ একযোগে আসিয়া দাঁড়াইল গাড়ীর কাছে তপতীকে অভ্যর্থনা করিতে। সুন্দরী, সুবেশা, তরুণী তপতী! তাহাকে দেখিবার আকাঙক্ষা কার না হয়।

—আসুন, আসুন, আপনার জন্যই অপেক্ষা, সময় হয়ে গেছে।–

তপতী নামিয়া গেল। গাড়ীটা ঘুরাইয়া ষ্ট্যান্ডে লইয়া রাখিতে হইবে, তপন ঘুরাইতেছে, একজন ডাকিয়া কহিল, সুইমিং কষ্টিউমটা দিয়ে যাও তো হে।

তপতীউহা লইতে ভুলিয়া গিয়াছে, না ইচ্ছা করিয়াই ফেলিয়া গিয়াছে কে জানে!তপন, নির্বিকার চিত্তে নামিয়া কষ্টিউমটা ভদ্রলোকের হাতে দিয়া আসিল।

প্রায় দুই ঘণ্টা তপন গাড়ীতে বসিয়া আছে। অকস্মাৎ দেখিল, অসংখ্য নারীপুরুষ তপতীকে ঘিরিয়া ক্লাবঘরের বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। তপতীর জলসিক্ত সুদীর্ঘ বেণী সর্পের মতো দুলিতেছে। ভিজা কষ্টিউমটার উপরেই সে তাহার পাতলা শাড়িটা জড়াইতেছে, হাতে একটা রূপার কাপ, প্রাইজ পাইয়াছে বোধ হয়। তপন কোন দিন তপতীকে ভালোকরিয়া দেখে নাই, আজও তাহাকে দেখিবার ইচ্ছা তাহার হইল না। মুখ নামাইয়া সে গাড়ীটা চালাইয়া দিল!

তপতী ভিতরে বসিয়া ভাবিতেছে, ঐ নির্বোধটা দেখুক, তপতীর সম্মান প্রতিপত্তি। তপতীকে লাভ করিবার যোগ্যতা যে উহার কিছু মাত্র.নাই ইহা যেন সে অচিরে বুঝিতে পারে। কিন্তু তপন ফিরিয়া তাকাইল না। তপতী ভাবিল, এসব বাপারে মর্যাদা ঐ গ্রাম্য বর্বর কি বুঝিবে। তিলক কাটিতে যাহার দিন ফুরাইয়া যায় তাহাকে কান ধরিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবে, তপতীর মূল্য কতখানি।

বাড়ি ফিরিয়া তপতী তাহার বিজয়ের নিদর্শন কাপটা অন্যান্য প্রাপ্ত পুরস্কারগুলির সহিত সাজাইয়া রাখিল।

সারাদিন তপতীর মনটা আত্মপ্রসাদের আনন্দে ভরপুর রহিয়াছে। সাঁতারে সে আজ প্রথম পুরস্কার লাভ করিয়াছে। কত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, কত উত্তেজক কথা তাহার স্নায়ুকেন্দ্রগুলিকে দুর্দান্তআবেগে যেন ঝঙ্কত করিতেছিল! সন্ধ্যা হইতে বন্ধুদের লইয়া সে গানের মজলিশ বসাইয়াছে।

অন্যদিন তপন রাত্রি সাড়ে দশটার পূর্বে ফিরে না, আজ কিন্তু নয়টার সময় ফিরিয়া আসিল। তপতীদের সঙ্গীত-চর্চার ঘরটার পাশ দিয়াই দোতলায় উঠবার সিঁড়ি। তপন নিঃশব্দে উঠিয়া যাইতেছিল, ঘরের কয়েকজন তাহাকে দেখিতে পাইয়া বলিল,–এই যে মিস্টার গোঁসাই, কোথায় গিয়েছিলেন?

তপন সিঁড়ির প্রথম ধাপে দাঁড়াইয়া রহিল। প্রশ্নটা তাহাকেই করা হইতেছে বুঝিয়া শান্তস্বরে বলিল—বৌদ্ধ বিহারে গিয়েছিলাম।

-ওরে বাপ-বৌদ্ধ বিহারের কি বোঝেন আপনি। সেখানে যান কেন?—বিদ্রূপটা স্পষ্ট।

তপন এক মিনিট স্তব্ধ হইয়া রহিল, তারপর শান্ত স্বরেই জবাব দিল— মেয়েদের কাছে এক কণা প্রসাদ ভিক্ষা করার চাইতে সেটা ভালো, কিছু না বুঝলেও ভালো।

তপন চলিয়া গেল। একটি মেয়ে তপনের কথাটা শুনিয়াছিল, বলিল,—ঠিক বলেছেন উনি, আপনারা তো মেয়েদের প্রসাদ ভিক্ষাই করেন।

মিঃ ব্যানার্জি কহিলেন,করি, ভিক্ষা পাবার যোগ্যতা আছে বলে।ওকে কে ভিক্ষা দেবে শুনি?

মেয়েটি বলিল,–ভিক্ষা উনি করেন না, কোন দিন আসেননি এখানে।

—আসেননি কেন? আসার কোন্ মোগ্যতাটা আছে? বৌদ্ধ বিহারে যাওয়ার কথাটা একটা চাল। ভাবলল, ঐ শুনে আমরা ওকে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ভেবে নেব। ওসব আমরা ঢের বুঝি।

মিঃ অধিকারী কহিলেন,—হাঁ হাঁ, করবে কি আর, এখানে তো এসে মিশতে পারে না, তাই ঐ সব ভণ্ডামী দেখাইয়া পণ্ডিতি জাহির করিতে চায়।

তপতী উঠিল; ভালোলাগিতেছেনা তাহার। কি যেন কোথায় কাঁটার মতো বিধিতেছে, তপন কি সত্যিই কোন নারীর কাছে প্রসাদ ভিক্ষা করে না?সত্যিই কি বৌদ্ধ বিহারে যায় সে?

শিখার কথাটা মনে পড়িয়া গেল—আৰ্য্যনারী হয়ে তুই স্বামীকে গ্রহণ করিলি না-তপতী উঠিয়া উপরে আসিল!

তপন তখনো খাইতে আসে নাই! রাত্রি মাত্র দশটা বাজিতেছে। অন্যদিন সে সাথে দশটার পূর্বে ফিরে না। তপতী চাহিয়া দেখিল, মা খাবার ঘরে টেবিলের উপর রাখিয় কি একটা সেলাই করিতেছে। ঘরে না ঢুকিয়া তপতী বাহিরের একটা সোফায় শুইয় অপেক্ষা করিতে লাগিল, কোটপ্যান্ট ছাড়িয়া ধুতি ফতুয়া পরিহিত তপন খড়ম পায়ে দিয় আসিয়া ঢুকিল খাবার ঘরে, হাতে শ্বেতপদ্ম। তপতী চাহিয়া দেখিল, মুখ তাহার পূর্বব ফিরানো রহিয়াছে। মুখ না দেখিয়া তপতী পায়ের দিকে চাহিল। সুন্দর সুগঠিত পা দুখানি খড়মের কালোর ঊপর কাঞ্চনবর্ণ বিকীর্ণ হইতেছে। রংটা এত সুন্দর নাকি!

–এসো বাবা, হাতে ও ফুলটি কিসের?—মা সাদর আহ্বান জানাইলেন। তপতী কা পাতিয়া রহিল তপনের উত্তর শুনিবার জন্য।

তপন বলিল, আজ বুদ্ধদেবের জন্মতিথি মা, গিয়েছিলাম দেখতে, ফুলটি নির্মাল সেখানকার।

মা হাসিয়া বলিলেন,–তোমাকে দেখলেই আমার বুদ্ধদেবের মুখ মনে পড়ে বাবা তুমিই আমার বুদ্ধদেব।

তপন ত্বরিতকণ্ঠে বলিল,–না মা, ও কথা বলবেন না। তিনি মানব-দেবতা আমি তা দাসানুদাস হবার যোগ্য নই!

মা চকিত হইয়া বলিলেন,–বুদ্ধদেবকে তুমি তো খুব বেশী শ্রদ্ধা করো তপন!

করা কি উচিত নয় মা? শ্রদ্ধেয়কে শ্রদ্ধা করার মধ্যে তো আমরা নিজেদেরকে শ্রদ্ধাভাজন করে তুলি-শ্রদ্ধা-না করলে বুদ্ধদেবের কিছু ক্ষতি হবে না মা, আমাদের মনুষ্যত্বের অপমান হবে।

মাতা মুগ্ধ হইয়া গেলেন, তপতী বিস্মিত বিহ্বল হইয়া গেল। এই লোকটা ইডিয়ট!ইহা অপেক্ষা মানবতায় অধিকতর গৌরব-বহনকারী মানুষ তপতী তাহার জীবনে দেখে নাই চঞ্চল পদে সে ঘরে আসিয়া ড়ুকিল।

–আয়, খেয়ে নে খুকী—মা ডাকিলেন।

তপনের আনিত পদ্মটা লইয়া খোঁপায় খুঁজিতে খুঁজিতে তপতী কহিল–আমি এখনে কাপড় ছাড়িনি মা।

-যা, ছেড়ে আয় চট করে।

তপতী তথাপি দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার আজ ইচ্ছা করিতেছে, তাহার সন্ধ্যাকে পরিহিত সুচারু তনিমার দিকে তপন একবার চাহিয়া দেখুক। তপন কিন্তু মুখ তুলিল না পাঁচ-সাত মিনিট অপেক্ষার পর নিরাশ হইয়া তপতী চলিয়া গেল।

গভীর রাত্রে একাকী শুইয়া তপতী ভাবিতেছে, ঐ তো ওপাশের ঘরটায় সে ঘুমাইতেছে ঐ নিরহঙ্কার মানুষটি, কম খায়, কম কথা বলে, নিজেকে জাহির করে অত্যন্ত কম। খুজিয় ফিরিলেও উহার সাড়া প্রায় পাওয়া যায় না! যাকিছু কথা উহার মার সঙ্গে। তপতী তো এতদিন উহার খবর লয় নাই, বরং নির্মম ভাবে উহাকে নির্যাতিত করিয়াছে। তার প্রাপ্য সম্মান হইতে উহাকে সে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করিয়াছে তথাপি সে রহিয়া গেল তপতীকে। নির্বিকারে। ভাবিতে ভাবিতে তপতী কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, ঘুম ভাঙিতে সর্পের মতেবেলাহইয়া গিয়াছে; উঠিতে গিয়াশরীরটা অত্যন্ত অসুস্থ বোধহইল, কিন্তু শরীরের গ্লানিকে মনের জোরে ঝাড়িয়া ফেলিয়া সে স্নানের ঘরে ঢুকিল। পরিপাটি করিয়া স্নান সারিয়া ফিকে নীল শাড়ী পরিয়া সে বাইরে আসিয়া দাঁড়াইল এক পিঠ খোলা চুল মেলিয়া, আশা জাগিতেছিল অন্তরে, তপনের সহিত যদি একবার দেখা হইয়া যায়। তপনের রুদ্ধদ্বার কক্ষের পানে চাহিয়া দেখিল সে বাহির হইয়া গিয়াছে। ধীরে ধীরে খাবার ঘরের দরজায় আসিয়া শুনিল, মা বলিতেছে দুলাখ টাকা! অত টাকা করবে কি ও?

কি জানি! যা খুশী করুকগে! টাকার তো আমার অভাব নাই নীলা! বাবা উঠিয়া যাইতেছিলেন, মাবলিলেন, ভালোই হয়েছে, ছেলেটার যা নিস্পৃহ মন?টাকাকড়ি নিলে বাঁচি। পিতা হাসিয়া বলিলেন,–নেবে, নেবে, ভাবছো কেন! শিলং-এ তাহলে পাঠাচ্ছ না।

–থাক। ছেলে মানুষ দুজনেই! কোথায় একলা পাঠাবো বাপু, তার চেয়ে আমার চোখের উপর দুটিতে থাক; পূজার সময় সবাই যাব শিলং।

কথাটা তপনের সম্বন্ধে। মুহূর্তে তপতীর অন্তর স্তব্ধ হইয়া গেল। দুই লক্ষ টাকা সে বাবার কাছ হইতে লইয়াছে। এত টাকা দিয়া কি করিবে সে! তবে কি টাকার জন্য সেতপতীর অত্যাচার নীরবে সহিয়া যায়। লোকটা তো আচ্ছা ধড়িবাজ। এজন্যই বুঝি তপতীর ব্যবহারের কথা বাবা মাকে একদিনও বলে নাই। দিব্যি অভিনয় করিয়া চলিয়াছে তো!—আচ্ছা, দেখা যাইবে।

তপতী আসিয়া চা খাইতে বসিল! মা সস্নেহে বলিলেন,রান্নাবান্না যে ছেড়ে দিলি যুকি, ভালোলাগে না?–মাতার ইঙ্গিত অত্যন্ত স্পষ্ট।

তপতী ক্রোধ দমন করিয়াকহিল,–নিরামিষ রাঁধার জন্যে আমার হাত কামড়াচ্ছে না।

মা একটু বিষণ্ণ হইলেন, বলিলেন—কি করবো বাছা, মাছ-মাংস খেতে ও ভালবাসে না–তবে একেবারে যে খায় না তা তো নয়। তুই বলিস না কেন খেতে?

–আমার দায় পড়েনি—যার যা খুশী খাবে আমার কি?

তপতী চলিয়া গেল। মা বুঝিলেন,ইহা জামাতার উপর কন্যার অভিমান। মধুর হাসিতে তাহার মুখ ভরিয়া গেল। ভাবিলেন তপনকে মাংস খাইবার জন্য তিনি নিজেই অনুরোধ করিবেন। তপন তাহার কথা নিশ্চয় রাখিবে।

তপতী আপন ঘরে গিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া কত কি ভাবিল। বাবার কাছে টাকা আদায় রিবার বেশ চমৎকার ফন্দি আবিষ্কার করিয়াছে লোকটা তো বেশ, নিক সে, টাকা লইয়া যন সরিয়া পড়ে। তপতী উহার মুখ দেখে নাই—দেখিবে না।

তপতীর অন্তরে বিদ্রোহের বহ্নি জ্বলিয়া উঠিল! মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্য মিঃ ঘাষালের মতো সুপাত্রের সহিত তপতীর বিবাহ হয় নাই, আজ তাহারই স্থান অধিকার চরিয়া ঐ বর্বর লোকটা দুই লক্ষ টাকা আদায় করিয়া লইল! টাকার উপর তপতীর কছুমাত্র মায়ামমতা নাই। কিন্তু লোকটা ধুত্তামী তপতীর অসহ্য বোধ হইতেছে। সে নিঃসংশয়ে বাবা আর মাকে বুঝাইয়াছে যে তপতীর সহিত আমার প্রেম নিবিড় হইয়া ঠিয়াছে, অতএব লক্ষ টাকা সে এখন পাইতে পারে। তপতীর নির্বোধ স্নেহময় বাবা-মা দুশ্চিন্ত মনে উহার পোস-খেয়াল মিটাইবার জন্য নগদ দুই লক্ষ টাকা উহার হাতে তুলিয়া দিলেন। আচ্ছা, তপতীও দেখিয়া লইবে সে কতবড় ধূৰ্ত্ত।

কিন্তু লোকটা মোটেই মুখ নয়। লেখাপড়া ভালো না জানিলেও সে নিশ্চয় বুদ্ধিমান। অভিনয় করিয়া কতগুলি পাকাপাকা কথা শিখিয়া রাখিয়াছে, যথাস্থানে যথোপযুক্ত ক্ষেত্রে তাহা সে প্রয়োগ করে। মা নিতান্তই মা, তাই উহার মা ডাক শুনিয়া গলিয়া গিয়াছে। মা আবার বলে, বুদ্ধদেবের মতো সুন্দর সুন্দর নয় বলিয়াই হয়ত বাড়াবাড়ি করিয়া বলে ঐ সব। যাক—সুন্দর হোক আর কুৎসিত হোক, তপতীর আসে যায় না!

তপতী গিয়া গম্ভীরমুখে খাইতে বসিল।

 

শিখা কারুণ্য-কোমলকণ্ঠে ঘরে ঢুকিল—জানো মা, অমন দাদা কারোর হয় না মা! দাদা আশ্চৰ্য্য, দাদা অদ্ভুত। মানুষকে অমন করে ভালোবাসতে আর কাউকে দেখিনি! কিন্তু মা আমায় এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে।

-কেন? কার অসুখ?-মা উদ্বিগ্নকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন।

অসুখ একটা কেরাণীর, তার গায়ে রক্ত নাই, দাদা তাই তাকে নিজের রক্ত দিয়ে বাঁচাবে। কারুর কথা শুনলো না মা, আমরা এতত বারণ করলাম,বললাম, অন্য একটা লোককে তো কিছুটাকা দিলেই সে রক্ত দিতে পারে। তা বলে, তার রক্তটাও তার বোনদের কাছে এমনি দামী বুঝেছিস কি বলবো আর!

মা শুনিয়া শিহরিয়া উঠিলেন। তপন কোন একটা অজ্ঞাত কেরাণীর জন্য নিজের দেহের রক্ত দান করবে। ব্যগ্রভাবে বলিলেন,নানা শিখা, ওকে বারণ কর তোরা।

ও শুনবেনা মা, কারুর কথা শুনবে না। আর যুক্তি দিয়ে ওকে হারাতে পারবেনা কেউ। ওর বন্ধু বিনুবাবু সকাল থেকে সে চেষ্টা করছেন। আমায় খানিকটা দুধ আর কিছু লেবুর রস করে দাও শিগগীর।

নিরুপায় মাতা লেবুর রস তৈরী করিতে করিতে বলিলেন,—ওর শ্বশুরবাড়ির কেউ জানে না?

ওঁদের জানাবে না—তুমি জানিয়ে দিও না যেন। বেলা এগারোটার সময় শিখা ও বিনায়ক তপনকে লইয়া ফিরিল। শিখা তাহার নিজের শয়নকক্ষে তপনকে শোয়াইয়া দিল; বিনায়ক তপতীর মাকে ফোনকরিয়া জানাইয়া দিল, তপনবাবু আজ দুপুরে অন্যত্র খাইবেন—তাহার যেন অপেক্ষা না করেন।

শিক্ষার মা আসিয়া অনুযোগ করিলেন—একি বাবা, নিজের রক্ত কেন তুমি দিতে গেলে?

—দিলাম তো কি হলো মা, আমি তো আপনার সুস্থ সবল ছেলে।

কিন্তু বাবা, তোমার জীবন আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।

—সে লোকটির জীবন কিছু কম মূল্যবান নয় মা, তারও মা, ভাই বোন, স্ত্রী, সব ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, সেই একমাত্র উপার্জনকারী তাদের।

মা চুপ করিয়াই রহিলেন! তপন আর একটু দুধ খাইয়া বলিল,–কিছু ভয় নেই বোনটি, ওবেলাই সেরে উঠবো; ঘুমুই একটু। শিখা বসিয়া বসিয়া হাওয়া করিতেছে। চোখ দুটি জলে ছলছল করিতেছে, তাহার মুখের দিকে চাহিয়াতপন বলিল,—কি হোলরে? কাঁদছিস?

–ভালো লাগছে না দাদা, তুমি রক্ত দিয়ে বেড়াবে নাকি?

–একা আমার রক্তে কি হবে শিখা, তবে এই আত্মসুখ সর্বকীব, পশুর জাতটাকে রক্ত দিয়ে বাঁচাতে হবে নইলে আৰ্য্যগৌরব বুঝিবা ড়ুবলো।

তপন পাশ ফিরিয়া শুইল। বিনায়ক ইসারায় শিখাকে নিষেধ করিল আর কথা না। বলিতে।

স্নেহের যে সামান্য সূত্রটুকু ধরিয়া তপনের অন্তরে তপতী প্রবেশ করিতে পারিত, তপতীর মনস্তত্ব-বিশ্লেষক মনের উষ্ণ চিন্তাধারায় তাহা পুড়িয়া গেল। তপনকে সে একটা অর্থশোষণকারী পরভৃতিক ছাড়া আর কিছু ভাবিতে পারিতেছে না। এক একবার মনে হইতেছে, হয়ত উহার মধ্যে এমন কোন গুণ আছে যাহাতে তার মা-বাবা এতটা মুগ্ধ হইতেছেন, আবার মনে হইতেছে, ইহা ঐ সুচতুর লোকটির সু-অভিনয়ের গুণ। তপতী উহাকে কঠোর পরীক্ষা করিতে মনস্থ করিল।

 

সেদিন টকটকে লাল শাড়ীখানা পড়িয়া তপতী বাহির হইয়া আসিল, যেন অগ্নিশিখা। মা তাহার দিকে চাহিয়া হাসিয়া বলিলেন,—বেড়াতে যাবি নাকি!

–না, মিঃ অভিনব বোস ব্যারিস্টার হয়ে এসেছেন তাকে নিমন্ত্রণ করেছি চায়ে। কিন্তু মা, ফুল আনা হয়নি। দাও না ফোন করে তোমার জামাইকে, ফুল কিনে আনবে।

মা, তাঁহার খুকীর দুরভিসন্ধি কিছুমাত্র অবগত নহেন।হাসিয়া বলিলেন,—নিজে বলতে পার না? লাজুক মেয়ে!

–নিজের জন্য তো নয় মা, একজন অতিথির জন্য তাই লজ্জা করছে।

মা বিশেষ কিছু বুঝিলেন না, ফোন করিয়া দিলেন তপনকে। বিজয়িনীর আনন্দে তপতী ভাবিতে লাগিল, বোকা মা কিছুই বুঝিলেন না যে তাহাকে দিয়াই তাহার মেহপাত্রকে কেমন করিয়া তপতী অপমান করিল। ফুলগুলি লইয়া যখন সে আসিবে, তখন তাহার সম্মুখেই মিঃ বোসকে তপতী তাহারই আনা ফুল উপহার দিবে। তপতী সাজিয়া-গুজিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল।

মিঃ বোস আসিয়া পৌঁছিলেন অথচ ফুল এখনো আসিল না, তপতী অত্যন্ত চটিয়া বিরক্ত মুখে মিঃ বোসকে চা পরিবেশন করিতেছে দোতলার বারান্দায়। ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় তপন কাগজে মোড়া একগোছ ফুল লইয়া সিঁড়ি দিয়া উঠিতেছে, দেখিয়া তপতী হরিতে নিকটবর্তী হইয়া বলিল,বড্ড দেরী হোল,—দিন,—সে হাত বাড়াইল ফুলগুলি ইবার জন্য। কাছেই একটা ছোট টিপয় ছিল, তপন নীরবে ফুলের গোছাটা সেই টিপয়ের পর রাখিয়া দিয়া চলিয়া যাইতেছে, রাগে তপতীর আপাদ-মস্তক জ্বলিয়া উঠিল, সরোষে গর্জ্জন করিয়া সে কহিল—হাতে দিতে পারেন না! একে তো আনলেন দেরী করে!

তপন ফিরে তাকাইল না, ধীরে ধীরে যাইতেছে, মিঃ বোস জিজ্ঞাসা করিলেন,–কে লোকটি?

—আমার মার পুষ্যি—তপতী সক্রোধে জবাব দিল। তপন কথাটা শুনিল তথাপি মুখ ফিরাইল না, চলিয়া গেল। তপতীর সর্বাঙ্গ ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিতেছে। ফুলের তোড়াটা তুলিয়া লইয়া সে কাগজটা ছিঁড়িয়া ফিলিয়া সবেগে আসিয়া ঢুকিল খাইবার ঘরে, যেখানে তপনকে খাবার দিতেছেন। তোমার জামাই ফুল কিনে এনেছে দেখো, কতকগুলো খুচরো ফুল, বাসি পচা-একটা বোকে বাঁধিয়ে আনতে পারেনি।

মা তাকাইয়া দেখিলেন, সুন্দর ফুলগুলি তপতীর হাতের আছাড় খাইয়া মান হইয়া যাইতেছে। রাগিয়া বলিলেন, বোকে আনতে তো তুই বলিসনি খুকী, আর ফুল তো খুবই টাটকা।

–তোমার মাথা–এই ফুলনাকি বিলেত ফেরত লোককে দেওয়া যায়। বলিয়া তপতী সরোষে প্রস্থান করিল।

মা বিহ্বল দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন—মেয়েটা বড্ড রাগী বাবা, তুমি দুঃখ করো না কিছু! ফুলগুলো তোমার ঘরেই দিয়ে আসছি।

জলতরঙ্গের মতো সুমিষ্ট হাসিতে ঘর ভরাইয়া দিয়া তপন বলিল—ঐ ফুলগুলো আপনার পায়ে দিই মা, আমার বয়ে আনা সার্থক হবে।

মা কি বলে শুনিবার জন্য তপতী বাহিরে অপেক্ষা করিতেছিল, তপনের কাণ্ড দেখিয়া সে শুধু বিস্মিত নয়, বিমূঢ় হইয়া গেল। এতবড় অপমানটা ও গায়েই মাখিল না। উহারই সামনে অন্য একজন পুরুষকে অন্যত্র বসাইয়া তপতী পরম যত্নে খাওয়াইতেছে, মা যার জন্য কত কিলেন। বিলাত ফেরত লোকের টেবিলে তপন বসিবে না বলিয়া তপতী রক্ষা পাইয়াছে। সেই অন্য পুরুষের জন্য নির্বিকার চিত্তে তপন ফুল আনিয়া দেয়, সে-ফুল না লইয়া অপমান করিলে সেই ফুল দিয়াই অপমানকারীর মার পূজা করে। এতবড় বিস্ময় তপতীর জীবনে আর ঘটে নাই। লোকটা হয় সাংঘাতিক ধূর্ত নয়তো সবসহিষ্ণু সন্ন্যাসী

ঠাকুরদার কথাটা তপতীর অকস্মাৎ মনে পড়িয়া গেল, তোর যে বর হবে দিদি তার আর জোড়া মিলবে না সত্যই, উহার জোড়া মিলিবে না। কিন্তু টাকা তাহা হইলে সে লইয়াছে কেন। দুই লক্ষ টাকা লইয়া সে কি করিবে? গরীবের ছেলে, দুলাখ টাকা কৌশলে আদায় করিয়া লইল। আরো কিছু আদায়ের ফন্দীতে আছে, তাই এমন করিয়া অপমান সহ্য করে। ইহার পর আমরা তাড়াইয়া দিলেও যাহাকে ও সুখে থাকিতে পারে তাহারই জোগাড়ে ফিরিতেছে।

তপতীর ক্ৰোধ কমিতে গিয়া পরবর্তী চিন্তায় অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিল। কত অপমান সহ্য করিতে পারে তপতী তাহা দেখিয়া লইবে, শেষ অবধি প্রহারেণ ধনঞ্জন করিয়া ঐ বেহায় ইতর লোকটাকে তপতী তাড়াইয়া দিবে—স্থির করিল।

মিঃ বোসের সহিত চা খাইয়া তপতী বেড়াইতে চলিয়া গেল মিঃ বোসের মোটরেই তপন কোনদিনই তপতীর সহিত বেড়াইতে যায় না, বৈকালিক জলযোগের পর সে আবার বাড়ি তৈরীর কাজ দেখিতে যায় বা একাই বেড়াইতে যায়। তপতী নিত্যই তাহার বন্ধুদের সহিত টেনিস খেলে কিম্বা বেড়াইতে যায়। কিন্তু মিঃ বোসের সহিত আজ একা বেড়াইতে যাওয়াটা মা পছন্দ করিলেন না। মিঃ বোস বা তপনের সাক্ষাতে তিনি কিছু না বলিলেও ঠিক করিয়া রাখিলেন, ফিরিলে তপতীকে তিনি ভৎসনা করিবেন এবং যাহাতে আর না যায় তাহার ব্যবস্থা করিবেন।

মিঃ বোসের পাশে বসিয়া গাড়ীতে বায়ু সেবন করিতে করিতে তপতী ওদিকে ভাবিতেছে, ঐ লোকটাকে অপমান করিবার কতরকম ফন্দি বাহির করা যাইতে পারে।

মিঃ বোস বলিলেন,—কি ভাবছেন মিস্ চাটার্জি?

তপতী বলিল—হুঁ!

–হুঁ কি? এতো বেশী ভাবছেন যে কথাই শুনতে পাচ্ছেন না।

লজ্জিত হইয়া তপতী বলিল,–হাঁ ভাবছিলাম একটা কথা। চলুন, সিনেমা যাওয়া যাক!

তৎক্ষণাৎ গাড়ী আসিয়া একটা বড় রকম সিনেমা হাউসের গেটে ঢুকিল। উভয়ে নামিয়া টিকিট কিনিয়া ঢুকিল ভিতরে। অন্ধকার ঘরে বসিয়া ফন্দি আঁটিতে বেশ সুবিধা হইবে। তপতী নিঃশব্দে চেয়ারে বসিয়া আছে। মিঃ বোস কিন্তু সিনেমা দেখার চেয়ে তপতীর নয়নানন্দকর রূপ দেখার ও শ্রবনানন্দকর কথা শোনার বেশী পক্ষপাতী, কহিলেন, সিনেমা বিস্তর দেখে এলাম। ছায়া, কায়া, দুই-ই, ছায়া আর দেখতে ইচ্ছা করে না।

কায়াও তো বিস্তর দেখেছেন—সাদা, তুষার শুভ্র, তার প্রতি অরুচি জন্মালো না যে?

–জন্মেছে। তাই কাঞ্চনকান্তি দেখতে এলাম।

—এখানে তো সব তথীশ্যামা : কাঞ্চনকান্তি চান তো কান্যকুব্জে যান।

–সে আবার কোন্ দেশ? মিঃ বোস প্রশ্নের সঙ্গে হাসিয়া উঠিলেন।

—জিওগ্রাফি দেখতে হবে, কারণ আমিও জানিনে।

—জেনে দরকার নেই—এখানেই-পেয়েছি কাঞ্চনকান্তি!

—পাশেই বুঝি?

তপতী নিজের দিকেই ইঙ্গিত করিল। মিঃ বোসের স্বপ্ন কি তবে সত্য হইবে! তপতী, তপস্যার ধন তপতী! মিঃ বোস তপতীর একখানা হাত নিজের হাতে ধরিয়া বলিলেন,—রিয়েলি আই হ্যাভ নো হোয়ার সিন সাচ এ বিউটিফুল গার্ল লাইক ইউ।

তপতী আপন ঠোঁটের সহিত ঠোঁট মিলাইয়া একটা মিষ্টি শব্দ করিয়া বলিল,—ও কথা অনেকের কাছেই শুনেছি।

—চির পুরাতনটাই চিরদিন সুন্দর মিস্ চ্যাটার্জি!

-তা নয়, চিরসুন্দরটাই চিরদিন পুরাতন। কারণ পুরাতন হলেও তা সুন্দর না হতে পারে কিন্তু সুন্দর হলেই তা আর পুরানো হয় না। যেমন এই পৃথিবী, ঐ আকাশ, ঐ সব গ্রহ-নক্ষত্র! ওরা পুরানো বলেই সুন্দর নয়, সুন্দর বলেই চির নূতন।

মিঃ বোস তাহার বিলাতি বিদ্যায় সুবিধা করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিলেন,–প্রেমের বাণী কি পুরাননা নয়?

–প্রেমের বাণী সুন্দর বলেই পুরানো নয়—পুরানো হয় না।

–তাহলে আমার কথাটাকে আপনি পুরানো বলবেন কেন?

—ওটা আপনার প্রেমের বাণী নাকি? ওতো রূপমুগ্ধ পুরুষচিত্তের একটা স্তাবকতা! প্রেমের বাণী অমন হয় না।

-কি রকম হয় তাহলে?

–তা জানিনে, আজো শুনিনি কারো কাছে।

—সিনেমা শেষ হইয়া গিয়াছে। তপতী পূনরায় বলিল—সময়টা গল্পেই কাটলো, কিছুই দেখলাম না।

–কাল আবার আসবেন?

—দেখা যাবে বলিয়া তপতী আসিয়া গাড়ীতে উঠিল।

বাড়ি ফিরিতেই মা তাহার পূর্ব সঙ্কল্পমতো তপতীকে বকিতে গিয়া দেখিলেন, কাপড় ছাড়িয়া তপতী বিছানায় বসিয়া আছে, দুটি চোখে তাহার জল টলমল করিতেছে।

মা ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি হলো মা, খুকু?

–জানিনে—যাও–বলিয়া তপতী শয্যায় লুটাইয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল।

বিস্মিত বেদনাহত মা অনেকক্ষণ তপতীর মাথায় হাত বুলাইয়া আবার ডাকিলেন, হয়েছে খুকী—আমায় বলতে তোর লজ্জা কিরে?

—কিছু না মা, ঠাকুরদার কথা মনে পড়ছিল। বুড়ো আমায় বড্ডো ঠকিয়ে গেছে।

–ছিঃ মনি স্বগত মহাপুরুষের নামে ও কথা বলতে নেই। কি হলো কি?

তপতী খানিকটা সামলাইয়া লইয়াছে। উঠিতে উঠিতে বলিল—তোমার শ্বশুর তোম কাছে মহাপুরুষ, আমার ঠাকুরদা, যা খুশী বলবো ওকে।

উঠিয়া তপতী কাপড় ছাড়িতে চলিয়া গেল। মা বলিয়া আসিলেন কাপড় ছেড়ে খেতে আয় রাত হয়ে গেছে মা!

তপতী কাপড় ছাড়িতে ছাড়িতে ভাবিতে লাগিল-ঠাকুরদা বলিতেন তপতীর স্বা হইবে অদ্বিতীয় প্রেমিক, অদ্বিতীয় মানুষ, যাহার জন্য তপতী সহস্র প্রলোভনের মা আজও নিজেকে অনাঘ্রাতা রাখিয়াছে। সে কি ঐ ধূর্ত অর্থলোভীটার জন্য! জ্যোতি কোনদিন সত্য হয় না!

 

মানুষের মন এমনভাবে গঠিত যে নিজের সম্বন্ধে সমালোচনা করিতে সে ভয় পায়! মনে অজ্ঞাতসারে সে এড়াইয়া যায় তাহার দুষ্কর্মগুলির অপরাধ অথবা আপনার দুর্বলতা দিয়ে সে সমর্থন করে তার কৃতকর্মকে। তপতী যদি তপনের প্রতি তাহার কৃত ব্যবহারের কথা একবারও ভাবিত তাহা হইলে হয়ত বুঝিতে পারিত, দোষটা সবই তপনের নয়; অত্যাধুনিক হইতে গিয়া সে তাহার পূর্ব সংস্কৃতি তাহার চেতনা হইতে হারাই ফেলিয়াছে; আর তাহার অবচেতন মনে জাগিয়া রহিয়াছে বংশপরম্পরায় লব্ধ সংস্কার এই দুই পরস্পরবিরোধী সংস্কারের সংঘাতে তপতী নিজের অজ্ঞাতসারেই হইয়া উঠিত উদ্দাম, উচ্ছঙ্খল। তপনের মধ্যেও যে কিছুমাত্র ভাল থাকিতে পারে, ইহা যেন সে ভাবিতে চাহে না। ভাল কিছু না থাকিলেই সে যেন খুশি হয়। মা-বাবা উহাকে এত ভালবাসে তপতী যেন ঈর্ষায় জ্বলিয়া যায়। উহাকে ভালবাসিবার কোন কারণ নাই। বার কতক মা বলিয়া ডাকিলে আর যাত্রাদলের মার্কা দেওয়া বাহবা পাওয়া বুলি আওড়াইলেই কাহারও ভালবাসা পাইবার যোগ্যতা জন্মে না। উহার আলাপ করিবার সঙ্গী একমাত্র মা—তা মার সহিত কিই বা কথা ও কয়? কথা কহিবার আছেই বা কি? যদি বা থাকে বাড়িতে তো সে সব মিলাইয়া আধ ঘন্টার বেশী থাকে না, এমন কি রবিবারেও না। তার মধ্যে ছয় ঘণ্টা ঘুম।

টাকাটা লইয়া কি যে করিল, কেহ জানিতে পর্যন্ত পারিল না! ব্যাঙ্কে জমা রাখিয়াছে আর কি! কাল বাবা মাকে বলিলেন—টাকা নিয়ে কি করছে জানতে চেও না, মদও তো ও খায় না। মদ-ভাং না খাওয়া ছাড়া টাকা খরচ করিবার যেন আর পন্থা নাই? আর খরচই বা করিবে কেন? ভবিষ্যতের জন্য করিতেছে। ও তো নিঃসন্দেহে বুঝিয়াছে, তপতী উহাকে তাড়াইয়া দিবে। তাই যতদূর সম্ভব সাবধানে কাজ গুছাইতেছে।

তপতী ক্লান্তি অনুভব করিতেছে। এই বিরক্তিকর পরিস্থিতি সে আর কতদিন ভে করিবে। উহাকে তাড়াইয়া দিলেই তো সব লেঠা চুকিয়া যায় কিন্তু তাড়াইবার উপায় বাহির করা সহজ নহে।

তপন খাইতে বসিয়াছে। কি কথা কহিতেছে, শুনিবার জন্য তপতীও গিয়া খাইতে বসিল। তপন মুখ নত করিয়া বসিয়াছে। মা জানেন, এখনো তপনের লজ্জা ভাঙে নাই, বলিলেন—তুই একটু পরে খাবি খুকী।

—কেন। আমি তোমার ছেলের কেড়ে খেতে যাব না। খিদে পেয়েছে আমার।

সন্তান ক্ষুধা পাইতেছে বলিলে কোন মাতা আর স্থির থাকিতে পারেন না, তথাপি মা ইতস্তত করিতেছিলেন। তপতী চাপিয়া বসিল–না খাইয়া যাবে না। অগত্যা তাহাকে খাবার দিলেন।

তপন খাইতে খাইতে বলিল—ও বেলা জল খেতে আসবো না মা।

কেন বাবা? কোথায় যাবে?—মা প্রশ্ন করিলেন!

আমার সেই ছোট বোনটির বাড়ি—তাকে নিয়ে আজ সিনেমা যেতে হবে। মা এক মিনিট চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন,–খুকীকেও নিয়ে যাবে বাবা;-খুকী প্রতিবাদ না করিয়া বসিয়া রহিল।

তপন বলিল, তা কি করে হবে মা? আমার বোনের বাড়ি আপনার খুকী কি করে যাবে! কুটুম্বের বাড়ি তো কিনা নিমন্ত্রণে যায় না কেউ!

মাতা আপনার ভুল বুঝিতে পারিয়া বলিলেন,–হ্যাঁ বাবা, ও কথা আমার মনে হয়নি। কোন সিনেমায় যাবে? যাবার পথে হলে তুলে নিও ওকে!

—আমি ট্রামে যাবো মা, আর যাবো ও পাড়ার দিকে; এ পথে মোটেই পড়বে না!

তপন চলিয়া গেল। তপতী খাইয়া উঠিয়া খবরের কাগজ খুলিয়া দেখিল জ্যোতি গোস্বামী নামক জনৈক লেখকের লেখা একখানা বই ওখানে আজই প্রথম আরম্ভ হইবে। সেও স্থির করিল, ঐ সিনেমায় যাইবে।

বিকালে তিন চারজন বন্দু বান্ধবী লইয়া তপতী আসিয়া দেখিল হাউসফুল টিকিট পাইয়া তাহারা ফিরিয়া যাইতেছে, এমন সময় মিঃ ব্যানার্জি চ্যাঁচাইয়া উঠিলেন, তপনবাবু।

তপন মুখ তুলিয়া তাকাইল,–কিছু বলছেন?

তপতী সবিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, তপনের পাশে একটি সুন্দরী মেয়ে! তপতীর সর্বাঙ্গ জ্বলিয়া উঠিল, ঈর্ষায় বা ইতরতায়!

মিঃ ব্যানার্জি কহিলেন,—আমরা টিকিট পাচ্ছি না; আপনার কেনা হয়েছে?

তপন জিজ্ঞাসা করিল,কজন আছেন আপনারা?

–পাঁচজন–বলিয়া মিঃ ব্যানার্জি ফিরিয়া যাইতেছিলেন, তপন বলিল—এক মিনিট দাঁড়ান, দেখছি।

সকলেই উহারা অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, তপন সেই মেয়েটির হাত ধরিয়া চলিয়া গেল। মিনিট দুই পরে একজন সুদর্শন যুবক আসিয়া বলিল—আসুন আপনারা।

—টিকিট পেয়েছেন?

—হ্যাঁ।

তাহাদের সকলকে লইয়া গিয়া বক্সে বসাইয়া দিল বিনায়ক।

তপতীদের আশ্চৰ্য্যবোধ হইতেছে। তপন কেমন করিয়া টিকিট কিনিতে পারিল? বোধ হয় ঘুষ দিয়া তপতীর সম্মান রক্ষা করিয়া থাকিবে। টাকা তো তাহারই বাবার; কিন্তু সে নিজে বসিল কোথায়? নিজেদের টিকিটগুলিই উহাদিগকে দিয়াছে নাকি চতুর্দিকে চাহিয়া অন্বেষণ করিয়াও তপন কিংবা সেই মেয়েটির কোন সন্ধান মিলল না। তপতীর ভযে মেয়েটাকে লইয়া পলাইয়া গেল নাকি!

মিঃ ব্যানার্জি তপতীকে বলিলেন,–তপনবাবুকে দেখছি না। পালিয়েছে নিশ্চয়।

তপতী শুধু বলিল হুঁ!

সিনেমা আরম্ভ হইল। একটি নারী-জীবনের বেদনার ইতিহাস স্বামী বঞ্চিতা ঐ দুর্ভাগিনী নারী স্বামী আসিবে ভাবিয়া নিত্য ফুলশয্যা রচনা করে অঙ্গনে আলপনা দেয়, পথের দুৰ্ব্বাকে চুম্বন করিয়া বলে,আমার প্রিয়তম যেদিন আসিবে তোমার কোমল বুকে চরণ ফেলিয়া, সেদিন হে শ্যামল দুর্বাদল, তোমায় আমি শত চুম্বন দান করিব। তথাপি তাহার প্রিয় আসিল না, আসিল তাহার বাণী : প্রিয়া, তোমার আমার মাঝখানে চোখের জলের নদীটি যুক্ত হল। তোমার আমার মাথায় একই আকাশ সেই জলে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে তুমি এসেছো, শুধু চোখের জলটুকুর ব্যবধান। ঐটুকু থাক—তোমায় পরিপূর্ণ করে পেয়ে ফুরাতে চাইনে—তুমি থাকো না পাওয়ার আলোকে অফুরন্ত আশা হয়ে আমার মনের গহন গভীরে।

তপতী বিমুগ্ধ চিত্তে দেখিল। তাহার রসগ্রাহী মন স্তব্ধ বিস্ময়ে প্রশ্ন করিল কে এই রূপদক্ষ কবি?

প্রশ্নটার কেহই উত্তর দিতে পারিল না, কারণ চিত্রলিপিতে লেখকের কোন পরিচয় নাই। কেন যে এই অদ্ভুত নাট্যকার নিজেকে এমনভাবে প্রচ্ছন্ন করিলেন; তপতী ভাবিয়া পাইল না।

বাড়ি ফিরিয়াই সে তপনের ঘরের দিকে চাহিল, তপন তখনো ফেরে নাই। কোথায় গিয়াছে সেই মেয়েটাকে লইয়া? খাইতে খাইতে সে, ভাবিতে লাগিল সিনেমার কথা।

তপন আসিয়া বাহির হইতে বলিল—খেয়ে এসেছি মা, আর কিছু খাব না।

তপতীর রাগ আরও বাড়িয়া গেল। ওখানে রাত্রির খাওয়া পর্যন্ত খাওয়া হয়! তপন চলিয়া গেলে তপতী জিজ্ঞাসা করিল—ওর কি রকম বোন মা, মার পেটের না পাতানো!

–নারে খুড়তুতো। মেয়েটা নাকি ছেলেবেলা থেকে ওর খুব নেওটা।

ওঃ! তপতী ঠোঁটের আগায় একটা বিদ্রূপধ্বনি তুলিয়া চলিয়া গেল আপনার ঘরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *