০৫. রাজারবাগ পুলিশ লাইন

রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ব্যারাকের বারান্দায় বসে রাবেয়া রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে মুখটা উঁচু করে রাখে। যেন সার্বিক দিকে তাকানোর ইচ্ছা ওর আর নেই। পৃথিবীকে ও আর দেখতে চায় না। ওর দৃষ্টি আকাশের দিকে নিবদ্ধ থাকবে শুধু। রাবেয়ার চোখ জল দিয়ে ভরে উঠতে চায় না।

কিছুক্ষণ আগে ঝুলিয়ে রাখা মেয়েদের পেশাব-পায়খানা পরিষ্কার করার কাজ শেষ করেছে। তখনি টের পেয়েছে ঝুলন্ত অবস্থায় মরে আছে সাফিনা। মাত্র গতকাল বিকেলে ওই অবস্থায় ওর চুল আঁচড়ে বিনুনি করে দিয়েছিল রাবেয়া। মাথার চারদিকে উল্টে থাকা চুলের গোছায় ওর মুখ আড়াল হয়ে থাকা রাবেয়ার পছন্দ ছিল না। মাত্র দুদিন আগে ওকে এখানে এনে ঝোলানো হয়েছে। ঝুলন্ত অবস্থায় বেত দিয়ে মারাও হয়েছে। তার পর থেকে ওর কথা বন্ধ ছিল। মৃত্যুর পর শীতল হয়ে যাওয়া শরীরটি ওর পুরো শরীরে শীতের প্রবাহ ছড়িয়ে দিয়েছিল। ও প্রথমে ওকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। তারপর হাউমাউ করে কেঁদেছিল। কিন্তু না, ও বেশিক্ষণ কাঁদেনি। শুধু স্তব্ধ হয়ে ভেবেছিল, মমতার জায়গাটি এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তা ও ভাবেনি। পরক্ষণে মনে হয়েছিল, মরে গিয়ে ভালো হয়েছে। ওর যন্ত্রণা শেষ হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়ে গেল! লোকে ওর ত্যাগের কথা মনে রাখবে তো?

রাবেয়া ওর দুপা বারান্দায় ছড়িয়ে দেয়।

যে পাঞ্জাবি সেনারা এই সব ঘরের পাহারায় থাকে, তারা এখন কেউ নেই। ক্যানটিনে গেছে চা খাবে বলে। রাবেয়া ওদের কাছে শুনেছে, সাফিনা অফিসারের সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। তার মুখে খামচি দিয়েছে। সে জন্য এই শাস্তি।

রাবেয়া পা গুটিয়ে নেয়। হাঁটুর ওপর মাথা রাখে। আবার মাথা তোলে। ভাবে, ওরা মেয়েদের ওপর দিয়ে যুদ্ধের শোধ ওঠাচ্ছে। বাঙালিকে স্বাধীনতার সাধ বোঝাচ্ছে। ও আবার পা মেলে দেয়। ইচ্ছে হয়, এই পা দিয়ে সেনাদের কাউকে কষে লাথি দিতে।

ঘরের ভেতর থেকে কান্নার ধ্বনি আসে। কিন্তু যে ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছে, সে ঘরে তালা দিয়ে রেখেছে সেনারা। ওরা জানে, এই সব মেয়ে এখান থেকে পালাতে পারবে না। তার পরও।

ও দরজার গায়ে মুখ লাগিয়ে বলে, কাঁদবেন না। আপনাদের কিছু লাগলে আমাকে বলেন। আমি সুইপার। তারপর কণ্ঠস্বর নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, আমি আপনাদেরই একজন। আমাকে বিশ্বাস করেন।

আমি মায়ের কাছে যেতে চাই। আপনি আমাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দিন।

ঘরের ভেতর থেকে ভেঙে ভেঙে শব্দ আসে। কিছু শব্দ স্পষ্ট, কিছু অস্পষ্ট। সব মিলিয়ে রাবেয়া বুঝে নেয়। আসলে বোঝার কিছু নেই। ও তো অনবরত এই একই কথা শুনে আসছে। সেই পঁচিশের রাত থেকে। মেয়েরা মায়ের কাছেই যেতে চায়। প্রথমে এই কথাটি বলে, একটা কিছু অস্ত্র পেলে এদের একটাকে শেষ করতে চাই। আমি কোথায় একটি অস্ত্র পাব?

ওদের কাছে এমন কথা শুনলে নিজের দিকে তাকায় রাবেয়া। ওর যুদ্ধ তো এদের নিয়ে। ও দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখতে পায়, লালু ডোমকে নিয়ে সেনা দুজন ফিরে আসছে। ওরা সাফিনার লাশ ফেলে দেওয়ার জন্য পায়ে রশি বেঁধে টেনে নিয়ে যাবে। এর আগেও এভাবে লাশ সরানো হয়েছে। খুব কাছ থেকে দেখা দৃশ্য। সেনাদের একজন প্রথমেই বন্ধ ঘরের তালা খোলার জন্য দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। রাবেয়া দ্রুত সরে যায় দরজার কাছ থেকে। দরজা খোলা হচ্ছে দেখে খুশিও হয়। মেয়েগুলোর সঙ্গে কথা হবে। দরজা খুলে দিয়ে সেনাসদস্য রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে হুকুম দেয় মেয়েগুলোকে বারান্দায় সারি করে দাঁড় করাতে। রাবেয়া বুঝে যায়, মরে যাওয়া মেয়েটিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য এদের দেখাবে। বোঝাতে চায়, বেয়াদবির শাস্তি এমন। বাঁচতে চাইলে আর এমন করবে না।

লাশ নামানোর জন্য লালু ডোমকে হুকুম দেয় সেনা। লালুর সঙ্গে পরদেশী আছে। দুজনে মিলে লাশ নামায়। পায়ে দড়ি বাধে। তারপর টেনে নিয়ে যায়। মেয়েরা দুহাতে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের সারা শরীরে যন্ত্রণা। নির্যাতনের যন্ত্রণা। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ধপ করে বসে পড়ে। কান্নার রোল ওঠে। চাবুক হাতে ছুটে আসে সেনা। রাবেয়া ওর পা জড়িয়ে ধরে বলে, মেরো না। ওদের মেরো না। আমাকে মাররা। সেনা ওর পা ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য কষে লাথি দেয়। রাবেয়া দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের পায়ের কাছে ছিটকে পড়ে।

সাফিনার পায়ে দড়ি বেঁধে লাশ নিয়ে বের হয় লালু ডোম। দেখতে পায় রাবেয়াকে, তখনো কাত হয়ে পড়ে আছে। ওঠার চেষ্টা করছে না। ও ইচ্ছে। করেই টানার সময় সাফিনার হাত ওর মাথায় ঠেকায়। মাথা তোলে রাবেয়া।

অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলে, ও যেন আমাকে কী বলে গেল রে?

তোমাকে উঠতে বলেছে। বলেছে, পড়ে থাকলে চলবে না।

আমি তো ওর জন্য কিছু করতে পারিনি।

ওকে যত্ন করেছ। ওর শরীর সাফ করেছ। ওর চুল বেঁধে দিয়েছ।

তোরা মন খুলে কথা বল, মেয়েরা। এখানে এখন আর কেউ নেই।

ওরা থাকলেই বা আমাদের কী? মারবে? মারুক।

মেয়েরা রাবেয়ার চারপাশে গোল হয়ে বসে।

যুদ্ধ বাধলে মেয়েদের এভাবে ধরে এনে শাস্তি দিতে হয়, খালা?

আমরা ওদের কী ক্ষতি করেছি, খালা?

তুমি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না কেন, খালা? তুমি চুপ করে আছ। কেন?

ওদের কাছে আমাদের একটাই অপরাধ।

কী? কী? কী? কী? কী? কী?

ওদের সবার মুখ থেকে কী ধ্বনি বের হতে থাকে।

বলো, আমাদের অপরাধ কী?

আমরা স্বাধীন দেশ চাই। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছি।

যুদ্ধ! যুদ্ধ!

কারও কারও পা বেয়ে তখন রক্ত গড়ায়। ভিজে যায় পায়জামা। স্যানিটারি ন্যাপকিন নেই ওদের জন্য।

একটা মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার খুব কষ্ট। আমি আর পারি না। আমি মরে যেতে চাই।

তোকে পুরোনো কাপড় দেই? আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।

না না, তোমার যেতে হবে না। ওগুলো দেখলে ওরা আমাকে মারবে। নীলুকে মেরে আধা মরা করেছিল।

রাবেয়া ঘাড় নাড়ে। ও জানে বিষয়টা। ও এটাও জানে যে ওর কিছু করার নেই। নীলু নিজেকে টেনে এনে রাবেয়ার মুখখামুখি হয়। খালা, তোমাকে বলেছিলাম আমাকে একটা ছুরি দিয়ে।

দেব। রাবেয়ার কঠিন স্বর মেয়েদের কানে বাজে।

দেবে? কবে? দেবে দেবে বলছ, আনছ না। তোমার কাছে ছুরি কেনার পয়সা নাই?

কালই দেব। শুধু তোকে একা না। সবাইকে একটা করে ছুরি দেব।

তাহলে আমি একটাকে শেষ করব। তারপর নিজে মরব। তাহলেই। আমার শান্তি হবে। আর কষ্ট থাকবে না।

তুমি আমার মাকে বলবে, নীলু আপনাকে খুবই ভালোবাসে। মরার আগে ও আপনার মুখ স্মরণ করেছে। বলবে তো, খালা? আরও বলবে, ও বলেছে যে আপনি যেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত মনে করেন যে আপনার মেয়েটি যুদ্ধে জীবন দিয়েছে। ও কোনো অন্যায় করেনি। তুমি যাবে তো আমার মায়ের কাছে?

না। রাবেয়া অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়।

নীলু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।

না কেন বললে? তুমি কি খুবই নিষ্ঠুর?

তুই যদি আমাকে নিষ্ঠুর মনে করিস, তাহলে আমি নিষ্ঠুর। আমি তোর মায়ের কাছে যাব না। মা জানুক যে একদিন মেয়েটা বাড়ি থেকে হারিয়ে গেছে। মায়ের মনে এই হারানোর ছবিটাই থাকুক। যুদ্ধের সময় এমন অনেক কিছুই ঘটে। মেয়েটি নির্যাতিত হয়েছে, খুন হয়েছে—এত কিছু তাকে আর জানানোর দরকার নাই। তাঁর বুকের বোঝা বাড়িয়ে লাভ কী?

প্রথমে সব মেয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে। তারপর একে একে ওরা বলে, আমাদের মায়েরা শান্তিতে থাকুক। আমাদের মায়েরা শান্তিতে থাকুক।

কয়েকটি কথামাত্র, কিন্তু গানের মতো ছড়ায়।

পরক্ষণে সেটা আর গানের মতো থাকে না। আর্তচিঙ্কার হয়ে ধ্বনিত হয়—মায়েদের ধোকা দেওয়া যাবে না। মায়েদের বুকের মধ্যে যন্ত্রণা পাথর হয়ে গেছে। বিশাল পাথর। ওই পাথর কেউ নাড়াতে পারবে না। দেশ স্বাধীন হলে পাথরটা একটু নড়বে মাত্র। কিন্তু থাকবে সারা জীবন। মৃত্যু পর্যন্ত।

গমগম করে পুলিশ লাইনের ব্যারাকের বারান্দা। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা মেয়েদের বুকের ভেতরও দম আটকানো পাথরখণ্ড পৃথিবীর যাবতীয় অনুভব আড়াল করে রেখেছে। মৃত্যু ছাড়া আর কোনো চিত্র ওদের সামনে নেই।

তখন ওদের জন্য খাবার আসে। বালতিভর্তি ভাত আর ডাল। ক্যানটিনের লোকেরা খাবার রেখে চলে যাবে। ওদেরকে ভাত খাওয়াতে হবে রাবেয়ার। এখানে আসার পর থেকে ওরা শুধু ভাত আর ডাল খাচ্ছে। মাঝেমধ্যে মাছ বা মাংস আসে। কখনো তরকারি। তার পরও ওরা হাপুস-হাপুস খায়। যদি বেঁচে থাকতে হয়, তাহলে তো ওদের খেতেই হবে।

ভাত-ডালের বালতি দেখে ওরা চোখ বড় করে বলে, খালা, ভাত এসেছে। আমরা এখানে বসেই ভাত খাব। খুব খিদে পেয়েছে।

ক্যানটিনের মকবুল আর জয়নালের দিকে তাকিয়ে রাবেয়া আবার বারান্দার রেলিংয়ে মাথা ঠেকায়। মাথা উঁচু করে রাখে। ওদের দেখবে না বলে ওর এই ভঙ্গি।

মকবুল দাঁত কিড়মিড় করে বলে, কী হলো তোমার, এমন করে বসে আছ যে? ওদেরকে ভাত দাও।

ভাতের যা ছিরি। এগুলো মানুষে খায়?

মানুষ খায় না। বেশ্যারা খায়। তুমিও একটা বেশ্যা।

শুয়োরের বাচ্চা, তোর মাথা আমি ফাটিয়ে ফেলব। বেশি বাড় বেড়েছে তোর!

বেশি কথা বললে অফিসারের কাছে তোর নামে নালিশ দেব। তখন বুঝবি ঠেলা।

তুই এখান থেকে যা, মকবুল। আমাকে রাগাস না। তুই ওদেরকে বেশ্যা বলেছিস। এর শোধ আমি উঠাব।

ছাতু করবি। ওদেরকে ভাত-ডাল দে। ওদের জন্য আমাদেরও বুক ভেঙে যায়। কিন্তু কিছু করতে পারি না। একদিন যে ভাগব এখান থেকে, তা-ও পারি না। বুড়া মা যে বিছানায় পড়ে আছে। দেখার তো কেউ নাই। আমি আর বউ ছাড়া।

মকবুলের কথা শুনে ওদের হাত থেমে থাকে।

খুরশিদা মৃদুস্বরে বলে, মকবুল ভাই, আমরা আপনার দুঃখ বুঝি। খাবার নিয়ে আসলে আপনি আমাদের দিকে তাকান না।

মকবুল নিজের চোখ মুছে বলে, আমি যাই। ক্যানটিনের ম্যানেজারকে বলব, কালকে আপনাদেরকে মুরগির মাংস দিতে।

আপনি বললে বকা খাবেন। দরকার নাই বলার।

সব শুয়োরের বাচ্চা। কোনো কোনো বাঙালি কুত্তা আছে ওদের সঙ্গে। ওগুলোও কম শয়তান না। আমি যাই।

মকবুল আর জয়নাল বালতি হাতে ওঠায়। দুজনেই বাম হাতে চোখ মোছে। যাবার আগে মৃদুস্বরে মকবুল বলে, যাই রে রাবেয়া বেশ্যা। রাতে আবার দেখা হবে। রাতে চিচিঙ্গা ভাজি দেবে। আর ডাল। আর বস্তাপচা চালের ভাত। এই বোনেরাও ওদের কাছে আলু। পচবে তো ফেলবে। ফ্রেশ থাকবে তো রাঁধবে।

চলে যায় দুজনে। ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সবাই। কারও হাত নড়ে না। দেখতে পায়, সিঁড়ির মাথায় গিয়ে ওরা পেছন ফিরে তাকায়। এবং নেমে যায়।

ওরা আবার নিজেদের জগতে ফিরে আসে। থালার মধ্যে হাত ধুয়ে কাছে রাখা বড় গামলায় পানি ফেলে। বারান্দাজুড়ে মুখরিত হয় সময়। নানাজনে নানা কথা বলে, দেখ দেখ, কতগুলো কাঁচা মরিচ দিয়েছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে।

দেখ দেখ, লেবুর টুকরোও দিয়েছে আজ। ডালের সঙ্গে লেবু চিপে ভাত খেলে খুব মজা লাগবে। কাঁচা মরিচ তো এখানে চোখেই দেখিনি। আজ দারুণ হবে খাওয়াটা।

মেয়েরা ততক্ষণে নিজেদের থালা ধুয়ে ভাত নেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল।

রাবেয়া নীলুকে বলে, সবার থালায় তুই ভাত দে, নীলু। আজ আমি কিছু করতে পারব না।

নীলু হিহি করে হাসতে হাসতে বলে, মকবুল ভাই আমাদেরকে বেশ্যা বলেছে তো কী হয়েছে? আমরা কিছু মনে করি না। দেশের স্বাধীনতার জন্য বেশ্যা হতে আমার একটুও খারাপ লাগবে না, খালা। তুমি মন খারাপ করছ কেন? রোজকার মতো তুমিই সবার থালায় ভাত-ডাল দাও।

হিহি করে হাসে অন্য সবাই। মাথা দুলিয়ে বলে, আমরা কিছু মনে করি, আমরা কিছু মনে করি না। ভাত-ডাল চাই। ভাত-ডাল চাই। কাঁচা মরিচলেবু চাই।

ওদের দিকে তাকাতে পারে না রাবেয়া। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের প্রাঙ্গণজুড়ে অন্ধকার নেমে আসে ওর সামনে। পরক্ষণে ওর মাথায় টুং করে শব্দ হয়। বুঝতে পারে, মকবুল ওর রাগের কথা বলেছে। বেশ্যা বলে ও নিজের ওপর ক্ষোভ ঝেড়েছে। আজকের কাঁচা মরিচ আর লেবুর ব্যবস্থা ও করেছে। ক্যানটিন থেকে আনেনি। ক্যানটিন থেকে এসব দেওয়া হয় না মেয়েদের। ওর সামনে থেকে অন্ধকার কাটে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ব্যারাকের বারান্দা আলোয় ভরে যায়।

 

তখন সকলের অজান্তে ঝুলিয়ে রাখা আরেকটি মেয়ে মারা যায়। ও নিজের কথা নিজেই বলতে থাকে, আমি মরে গেছি। এই মৃত্যু আমার শান্তি। যে নির্যাতন আমার শরীরের ওপর দিয়ে গেছে, তা এই দেশের স্বাধীনতার জন্য থাকুক। যেদিন দেশ স্বাধীন হবে, সেদিনও আমি বলব, আজ আমার শান্তি। আমার মৃত্যু স্বাধীনতার জন্য। শান্তি শান্তি।

আমার বাবা-মাও স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। আমার বড় ভাই শাকেরকে ধরার জন্য সেদিন গভীর রাতে ওরা আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আমার বড় ভাই অসহযোগ আন্দোলনের সময় মিছিল-মিটিংয়ে থাকত। ও একজন ভালো বক্তাও ছিল। তার ভারী কণ্ঠস্বরে গমগম করত এলাকা। আমিও রাজপথে থেকেছি। স্লোগানে স্লোগানে মাতিয়ে মিছিলের সঙ্গে হেঁটেছি কতটা পথ। আমি জানি না, পথটা কী ছিল। আমি জানতাম, পথটা জয় করতে হাঁটতে হবে। আমাদের কারোরই সেই হাঁটায় ক্লান্তি ছিল না। আমাদের জীবনে সেই সময় অবিশ্বাস্য এক আশ্চর্য দিনের সমষ্টি ছিল।

যেদিন ওরা আমাদের বাড়িতে তাণ্ডব ঘটাল, সেদিন রাত দশটার দিকে আমার ভাই শাকের বাড়িতে এসে বলল, মা, ভাত দাও। এক্ষুনি। ভাত খেয়েই বেরিয়ে পড়ব। হাতে সময় খুব কম। ও কোথায় যাবে—মা ওকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করারও সুযোগ পাননি।

তারপর ছোট্ট একটা ব্যাগে দুটো কাপড় ঢুকিয়ে নিল। খেতে বসে বলল, আব্বা, ইয়াহিয়া খান চলে গেছে। মনে হয়, আজ ওরা একটা কিছু ঘটাবে। আমি বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছি। যদি পারতাম, জেনিফারকেও নিয়ে যেতাম। কিন্তু আমি যেখানে যাব, সেখানে ওকে নিতে পারব না। তা ছাড়া পরবর্তী পরিস্থিতি কী হবে, তা আমরা জানি না। ও আপনাদের সঙ্গেই থাকুক, আম্মা। ওকে নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু উপায় নেই।

ও আব্বাকে বলে, আপনারাও ঢাকায় থাকবেন না। প্রথমে কেরানীগঞ্জে চলে যাবেন। তারপরে অবস্থা বুঝে ইন্ডিয়ায়। কুমিল্লার বর্ডার দিয়ে যাবেন। আমিও এমন পরিকল্পনা করেছি। আমাদের সঙ্গের সব ছেলে তা-ই করবে। আমরা একদল একসঙ্গে সীমান্ত পার হব।

আম্মা প্রথমে বিষণ্ণ হয়ে পরে উৎসাহ নিয়ে বলেছিলেন, তাহলে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল?

বোধ হয় হয়েই গেল, আম্মা। বঙ্গবন্ধু কী বলেন আমরা সেই অপেক্ষায় থাকব।

আব্বা তখন বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু তো বলেই দিয়েছেন—ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে; আমার মনে হচ্ছে। আমি এই বাড়িটাকে দুর্গ বানাব। আমি কোথাও যাব না, শাকের।

আব্বার কথার দৃঢ়তায় ভাইয়া উজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে বলেছিল, আব্বা, আপনি আমার সাহস দ্বিগুণ করে দিলেন। বাড়িটা দুর্গ হলে জেনিফারও আপনাকে সাহায্য করবে।

তারপর দ্রুত ভাত খাওয়া শেষ করেছিল শাকের ভাই। রাত এগারোটার দিকে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলেছিল, আপনাদের সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে জানি না, আম্মা। আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন।

আম্মা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। চোখের পানিতে ভিজিয়েছিলেন ওর মাথা।

আব্বা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, সামনের দিকে যাও, বাবা। পেছন ফিরে তাকিয়ো না।

ও আব্বা-আম্মার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। ছোট ভাইদের মাথায় হাত দিয়ে আদর করে। আর আমাকে বলেছিল, সাহস নিয়ে থাকবি। মৃত্যুকেই বড় করে দেখবি। ভয়কে না।

আমি আমার ভাইকে বলেছিলাম, আমারও যুদ্ধ আছে, ভাইয়া। তুমি আমার জন্য ভেবো না। আমার যুদ্ধ আমি আমার মতো করে করব। ফিরে এসে বলবে, তুই এত কিছু পেরেছিস! আয়, তোকে স্যালুট করি।

তারপর মধ্যরাতে তাণ্ডব ঘটিয়েছিল ওরা।

তিনজন বাড়িতে ঢুকেছিল। দরজায় লাথি দিতে থাকলে দরজা খুলে দিয়েছিলেন আব্বা। আব্বার বুকের ওপর রাইফেল ধরে বলেছিল, গাদ্দার।

আম্মা আর আমি আব্বার পেছনেই ছিলাম। একজন এসে আমার হাত ধরে টেনে বলেছিল, বহুত আচ্ছা। খুব সুরত। তারপর ওদের দলের অন্যদের কাছে নিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। একজন শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরেছিল। তখন আব্বার বুকের ওপর রাইফেল ধরে রাখা সেপাই ট্রিগার টিপে দেয়। পড়ে যান আব্বা। আম্মা আব্বাকে ধরতে গেলে আম্মাকেও গুলি করে। আমার পাঁচ বছরের ভাইটিকে বুটের নিচে চেপে রাখে। আমি তাকিয়ে ওর যন্ত্রণা দেখি আর চিঙ্কার শুনি। হা-হা করে হাসতে থাকে সেপাইটি। ওর বুটের নিচে থেঁতলাতে থাকে ভাইটি। ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না ওর শরীর নিথর হয়ে যায়। বাকি থাকি আমি আর আমার দশ বছর বয়সী ভাইটি। ও হাত বাড়িয়ে আমার কাছে আসার জন্য কাঁদছিল। আমি সেপাইটির হাত ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি। তারপর মুখ ফিরিয়ে ওদের দিকে থুতু ছিটাই।

ওরা তিনজনে একসঙ্গে হা-হা হাসিতে ঘর ভরিয়ে দেয়। দেখতে পাই, তিনটি হাত একসঙ্গে আমার দিকে এগিয়ে আসে। একজন চুল ধরে। অন্য দুজন দুই হাত।

তিনজনে জোরে ধাক্কা দিয়ে আমাকে ছুড়ে মারে দরজার দিকে। আমি দরজার সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাই। চৌকাঠে লেগে আমার কপাল ফেটে রক্ত বের হয়। আমি জ্ঞান হারাইনি। শুনতে পাই, আমার ভাইয়ের আর্তচিৎকার। মুখ ফিরিয়ে দেখি আমার ভাইটিকে ধরে আছড়াচ্ছে। তিনজনে মিলে বুটের নিচে পিষছে। আমি ওদের একজনের পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলি, ওকে একটা গুলি দিন। মাত্র একটা গুলি। এভাবে ওকে মারবেন না।

ওরা আমাকে চুল ধরে টেনে তোলে। তার পরে গাড়িতে ওঠায়। এর পরের বর্ণনা করার সাধ্যি আমার নেই। তখন আমি মৃত্যুর মুখে। জানি, বাঁচব না। আমার ভাইয়ের জন্য একটা চিঠি লিখেছি। রাবেয়া খালাকে দিয়েছি। এই শহরের কোনো দুর্গবাড়ি যদি খালা চেনে, তবে সেখানে পৌঁছে দেবে। বিদায়, তোমাদের সবার কাছ থেকে বিদায়—এই পুলিশ লাইনের বন্দী খাচায় তোমরা যারা আছ, তোমাদের সবার কাছ থেকে বিদায়।

 

 

জেনিফারের লাশের দিকে তাকিয়ে লালু ডোম বলে, এই লাশ আমি নামাতে পারব না। তুই নামা, রাবেয়া।

আমি তো নামাতেই পারব। আমি সব পারি।

রাবেয়া দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আবার বলে, এত কিছু দেখেও চাকরি করছি। মাস গেলে মাইনে নিচ্ছি। মাইনের টাকা দিয়ে ভাত গিলছি। আমি কী না পারি? আমি তো সব পারি!

তারপর চোখে আঁচল চাপা দেয়। চোখ মুছে বলে, তুই ওকে নামা, লালু। পায়ে দড়ি আমি বেঁধে দেব। দড়ি ধরে টেনে ভ্যানেও তুলে দেব। ফেলবি কোথায়?

কোথায় আবার ফেলব? জানিস না, ভাগাড়ে। তোকে না এক শ বার বলি যে, লাশ ভাগাড়ে ফেলি। আবার জিজ্ঞেস করিস কেন? বারবার জিজ্ঞেস করে তোর সুখটা কী, বল তো?

মাটিচাপা দিতে পারিস না?

না, পারি না। হুকুম নাই।

তুই আমার সঙ্গে মেজাজ করবি না, লালু।

তুইও আমার সঙ্গে মেজাজ করছিস।

লালু দুহাতে চোখ মোছে।

কোথাও যেতে পারি না কি সাধে? আমরা না থাকলে ওদের দেখবে কে? এই জ্যান্ত এবং মরা মেয়েদের! ভগবান, আমার মরণ দাও।

কথা শেষে আবার চোখ মোছে লালু। এবার মুখ দিয়ে শব্দও বের হয়।

রাবেয়া বারান্দার মাথার দিকে তাকায়। না, সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা কাউকে দেখা যাচ্ছে না। লালুর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, কাঁদিস না, লালু। তোকে কাঁদতে দেখলে এসে লাথি মারবে। আমাকেও মারবে। তোর মতো আমিও বলি, লাথি খেয়ে মরে গেলে মেয়েগুলোকে দেখবে কে?

আমাকে মারুক। এদের জন্য কেঁদে আমি হাজার বার লাথি খেতে পারি। তুই আমাকে শয়তানদের লাথির হাত থেকে বাঁচাতে পারবি না, রাবেয়া। আমার হাড়ি শক্ত আছে। ওদের লাথিতে ভাঙবে না।

তখন দুজন বেদনায় আপ্লুত হয়ে কাঁদে। দুজনের মনে হয়, স্বাধীনতা অনেক বড় কাজ। লাভ করা খুব কষ্টের। ওরা বুঝতে পারে, এই কষ্টের মধ্যে গৌরব আছে। এই মেয়েগুলো শুধু শুধু কষ্ট সহ্য করছে না।

দুপুরের সময় পরদেশীর সঙ্গে রাবেয়ার দেখা হয়। পরদেশী তিন দিন কাজে আসেনি। ওর জ্বর হয়েছিল। ড্রেন পরিষ্কার করতে করতে ওদের যে কথা হয়, সেটুকুই কাজের ফাঁক। আজও রাবেয়া ড্রেনের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পরদেশী মাথা তুলে বলে, খোঁড়াচ্ছিস কেন? পায়ে কী হয়েছে?

লাত্থি।

আবার?

আবার তো হবেই, ধরে নিয়েছি। লাথি না দিলে ওদের পায়ের সুখ মেটে। যা দেখেছি তার সবকিছু তো বুকের ভেতর ধরে রাখতে পারি না। দুচার কথা বেরিয়ে যায়। কথা বের না হলে নিজেরই দম আটকে আসে।

ড্রেনে নামবি? নাকি ওপরে কাজ আছে?

ড্রেনে নামব। রাবেয়া বগলে ধরে রাখা ঝাড় মাটিতে নামিয়ে রাখে। পরদেশী হাত বাড়ালে ওর হাত ধরে নিচে নামে। কোমরে গোঁজা আছে জেনিফারের চিঠি। সেখানে হাত রেখে বলে, যে মেয়েটির লাশ গেল আজ, ওর একটা চিঠি আছে আমার কোমরে।

চিঠি! আবার চিঠি?

হ্যাঁ রে, ওরা চিঠি লেখে বলেই তো মনে হয় যুদ্ধের কথা লেখা হচ্ছে। নইলে এখানে ওদের জীবনে কী ঘটছে, তার কথা কে জানবে? বাইরের কেউ তো এই সব নির্যাতনের কথা জানতে পারবে না।

ঠিক বলেছিস। রাবেয়া, তুই ওপরে ওঠ।

ড্রেন সাফ করব না?

এই পবিত্র চিঠি নিয়ে তোকে ড্রেন সাফ করতে হবে না। তুই ওপরে উঠে ওই কোনায় গিয়ে বসে থাক। ড্রেন আমি একাই সাফ করব। ধর, আমার হাত ধর।

পরদেশীর হাত ধরে রাবেয়া আবার ওপরে ওঠে। বিল্ডিংয়ের আড়ালে গিয়ে বসে। খানিক স্বস্তি পায়। মনে হয়, পায়ের ব্যথা কমে গেছে। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোমরে গুঁজে রাখা চিঠির ভাষা উড়ে আসে ওর কাছে—পরদেশীর কাছে। লালু, রোহিত, প্রেমলাল এমন আরও কয়েকজন কর্মরত সুইপারের কাছে।

প্রিয় শাকের ভাইয়া, আমি জানি না এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছাবে কি। তবু লিখছি তোমাকে। স্বাধীনতার পরে তুমি যখন দেশে ফিরবে তখন দেখবে, যে বাড়ি থেকে তুমি যুদ্ধ করতে বের হয়ে গিয়েছিলে, সেই বাড়িতে তোমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। আমাদের আব্বা একটি দুর্গবাড়ি গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই তাকে স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে হয়েছে। আমার আম্মাও সেনাদের গুলিতে জীবন দিয়েছেন। আমাদের দুই ভাইও। তাদের যুদ্ধ শেষ হয়েছে।

আব্বা-আম্মা-ভাইদের মৃত্যু আমার চোখের সামনে হয়েছে, ভাইয়া। আমার বুকভাঙা কান্না আমি থামাতে পারিনি। ওরা যখন আমাকে নির্যাতন করেছে, তখনো আমি নিজের কথা মনে করিনি। আমার চোখের সামনে মৃত্যুর দৃশ্য স্থির হয়ে ছিল। দেখেছি গুলিবিদ্ধ আব্বার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সেই রক্তের স্রোত গড়িয়ে যাচ্ছে ঘরে। দেখেছি আম্মার বুলেটবিদ্ধ শরীর থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। দেখেছি ছোট দুই ভাইয়ের তেলানো শরীর। স্বাধীনতার জন্য যা কিছু করার, তার সবটুকু আমরা করেছি, ভাইয়া। এখন আমি মৃত্যুর মুখোমুখি। আর হয়তো কয়েক ঘণ্টা মাত্র বা এক-দুই দিন। তারপর চোখের পাতা বুজব।

যেদিন তুমি রাইফেল কাঁধে নিয়ে জয় বাংলা বলতে বলতে ঢাকায় আসবে, সেদিন আমরা অদৃশ্যে থেকে বলব—জয় বাংলা। আমাদের দুঃখ থাকবে না, কান্না থাকবে না। আমি জানি, আমাদের আব্বা বলবেন, আমাদের জীবনদান সার্থক হয়েছে। ছেলেরা বিজয়ের বেশে ঘরে ফিরেছে। আমি বলব, শান্তি শান্তি। আমার মৃত্যু স্বাধীনতার জন্য। আমার কোনো দুঃখ নাই। যুদ্ধের সময়ে আমার শরীর তো স্বাধীনতার জন্যই বরাদ্দ ছিল।

ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে রাবেয়া। মনে হয় একটুখানি ঝিম ধরেছিল। কে যেন ওকে কোথায় যাওয়ার জন্য ডেকেছিল। ও যেতে পারেনি। তাকিয়ে দেখে, পরদেশী তখনো ড্রেনের ভেতরে। ওর কাজ শেষ হয়নি। একবার মাথা তুলে চারদিকে তাকায়। আবার মাথা নিচু করে। আবার মাথা ওঠায়। ওকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে। ও যেন কোনো কিছু শোনার জন্য কান পাতছে, কিংবা শুনতে পাচ্ছে না বলে শোনার চেষ্টা করছে। ও বুঝি কাজের মাঝে স্বস্তি পাচ্ছে না। ওকে কোথাও যেতে হবে, এমন ভাবনা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। ওর মুখজুড়ে প্রবল ঘাম জমে আছে। ও হাত উঠিয়ে মোছর চেষ্টা করে না।

রাবেয়া দূর থেকে ওকে ডাকে। প্রথমে হাত ইশারায় ডাকে। পরে গলা উঁচু করে ডাকে।

পরদেশী, উঠে আয়।

পরদেশী রাবেয়ার ডাক শুনে চমকে ওঠে। কিছুক্ষণ থমকে থেকে চারদিকে তাকায়। তারপর দুহাতে মুখের ঘাম মুছে তারপর ঝাড় ফেলে উঠে আসে। কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, তুই কি আমাকে ডেকেছিলি? কয়বার ডেকেছিলি? একবার না অনেকবার?

এই তো, এখনই তো ডাকলাম। একবারই ডেকেছি। তুই তো এক ডাকেই আমার দিকে তাকালি।

আরও আগে ডাকিনি?

না, আমি ডাকিনি। ওই দিকে চেঁচামেচি করছে পুলিশ। হয়তো ওটাই তোর কানে গেছে।

ওদের চেঁচামেচি আমার বুকের ভেতর ঢুকবে না। ওদের খুচরো কথা আমার কানে বাড়ি খেয়ে ফিরে যাবে। কিন্তু কেউ ডেকেছে মনে হলে আমার মাথা, বুক নিঃসাড় হয়ে যায়। কোথায় যেন যেতে বলেছিল আমাকে, কিন্তু আমি যেতে পারলাম না। কী যে হলো আমার, কিছুই বুঝতে পারলাম না।

তুই বস। তোর জন্য আমি ডালপুরি নিয়ে আসি। একটু কিছু খেলে তোর ভালো লাগবে।

চিঠিটা আছে তো?

রাবেয়া কোমরে হাত রেখে বলে, আছে।

ও পা টানতে টানতে ক্যানটিনে যায়। চা-ডালপুরি নিয়ে ফিরে এলে দুজনে হাত-পা ছড়িয়ে চা খায়। ভাবে, এইটুকু সময়ের সঞ্চয়। শুধু ব্যক্তিগত। বাকি সময় ওদের একার থাকে না। পুরোটা সময় ওরা দিয়ে রাখে দেশের জন্য। ওরা মনে করে, এটুকু ওদের স্বাধীনতার জন্য দেওয়া। এটাই ওদের যুদ্ধ।

চা শেষ করে পরদেশী জিজ্ঞেস করে, ও চিঠিটা কখন লিখল, রাবেয়া?

যখন ওকে দুবার ঝুলিয়ে নামাল, তখন। ও বুঝেছিল, শরীর আর চলছে। আমাকে বলল, খালা, আমাকে কাগজ-পেনসিল জোগাড় করে দে। আমি একটা চিঠি লিখব।

তারপর দুদিন পরে অজ্ঞান হয়ে গেল। জ্ঞান ফিরল এক দিন পরে। ডাক্তারকে বললাম ওকে একটু দেখতে। হারামির বাচ্চা দেখল না। উল্টো আমাকে বলল, তুই আমাকে জ্বালাস না, রাবেয়া।

আমি বললাম, ওষুধ-বড়ি একটু দে। ওর যন্ত্রণা কমুক। উঠে বসতে পারুক। হারামির বাচ্চা বলল, উঠে বসে কী করবে? মরলেই তো পারে। ওদেরকে মরতে বল, হাজারে হাজারে মরুক। হারামির বাচ্চার কথা শুনে আমার শরীর জ্বলে যায়। আমি চিৎকার করে বলি, তুই কী বললি, ডাক্তার!

ডাক্তার তখন দুহাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। আমাকে আর কিছু বলল না। আমি আর কী করব! কাঁদতে কাঁদতে ওর কাছে ব্যারাকে ফিরে গেলাম। ওর চোখ-মুখ মুছে দিলাম। গামছা ভিজিয়ে শরীর মুছে দিলাম। ও চোখ খুলেই বলল, কাগজ-পেনসিল জোগাড় হয়েছে রে?

আমি বললাম, হয়েছে। ডাক্তারের টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। ডাক্তার কিছু বলেনি।

আমাকে দে, খালা। একটা চিঠি না লিখে আমি মরতে চাই না। একদিন আমার এই চিঠি হাজার চিঠি হয়ে আকাশে উড়বে।

ওর মুখ দেখে মনে হলো, ও বুঝি আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। এই মৃত্যুপুরীতে এটাই ছিল ওর খুশির ঝিলিক। পরদেশী, তুই যদি ওকে দেখতি, বুঝতি দুঃখের খুশি কেমন অন্য রকম। আহারে, সোনার ময়না পাখিরা রাবেয়ার কণ্ঠ ধরে আসে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। পরদেশীর মুখেও কথা নেই। ওদের মনে হয়, এই পুলিশ লাইনের দালান, প্রাঙ্গণ, গাছগাছালিও স্তব্ধ হয়ে আছে। এত অন্যায় সহ্য করতে পারছে না।

নীরবতা ভাঙে রাবেয়া। বলে, তুই আমাকে একটা কথা বল, পরদেশী।

বল, কী বলবি? ডাক্তারের কথা? রাবেয়া, আমার মনে হয় ডাক্তারের মনেও কষ্ট আছে। ওই বেটা বাঙালি না? নইলে মুখ ঢেকে বসে থাকবে কেন? তুই ওকে গালি দিস না, রাবেয়া। আমি একদিন জ্বরের ওষুধ আনতে গিয়ে ডাক্তারকে মেয়েদের কথা জিজ্ঞেস করব। দেখি, কী বলে। তবে তাকে আবার

একা পেতে হবে।

পরদেশীর কথায় মাথা নেড়ে চুপ করে থাকে রাবেয়া। তারপর আস্তে আস্তে বলে, আমি তোকে যা বলতে চেয়েছিলাম, তা কিন্তু ডাক্তারের কথা না রে।

তাহলে কী, বল?

জেনিফার আমাকে যে চিঠিটা দিল, এই চিঠি আমি কাকে পৌঁছাব? ও তো বলল ওর কেউ নাই।

কাকে? পরদেশী দুহাতে চুল চেপে ধরে।

ও আমাকে ঠিকানা দেয়নি। ও কার ঠিকানা দেবে? ও তো আমাকে সব কথা বলেছে।

আমাকে ভাবতে দে, রাবেয়া। ভেবে ঠিক করব যে কী করা যায়। তুই তোর মতো ভেবে দেখ। আমি কাজে গেলাম। বেশিক্ষণ এক জায়গায় বসে থাকতে দেখলে আবার ছুটে আসবে শয়তানগুলো। ছাড়বে না।

 

দ্বিতীয় দিনের মাথায় আবার একটি মৃত্যু ঘটে।

ওর নাম রুশনি।

এক দিনে চারজন ওকে ধর্ষণ করার পরে ও আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বাইশ দিন ধরে মেঝেতে পড়ে ছিল। ঠিকমতো খায়নি। চোখ খোলেনি। শুধু এপাশ-ওপাশ গড়িয়েছে। আর গুঙিয়েছে।

ও সবাইকে বলেছে, ও বস্তির মেয়ে। বাবুপুরা বস্তিতে ওদের বাড়ি ছিল। আগুনে পুড়ে যায়। আর গুলিতে মারা যায় বাবা-মা-ভাইবোন সবাই। শুধু ওকে ওরা আলাদা করে গাড়িতে উঠিয়ে এইখানে এনেছে।

কিন্তু ওর কথা শুনে রাবেয়ার মনে হয়েছে, ও বস্তির মেয়ে নয়। ও যেন অনেক কিছু লুকাচ্ছে।

একদিন ফিসফিসিয়ে রাবেয়াকে বলেছিল, খালা, আমার মৃত্যুর খবর কাউকে দিয়ো না। ওরা আমাকে ভাগাড়ে ফেলে দিলে শেয়াল-কুকুরে খাবে আমাকে। আমি এতেই খুশি। স্বাধীনতার জন্য এর চেয়ে বেশি আমার করার নেই, খালা।

তোমার বাড়ি কোন এলাকায়?

কেন জিজ্ঞেস করছ? বলেছি না বাবুপুরা বস্তি। আগুনে পুড়ে গেছে। আমাদের বাড়ি। সেদিন মধ্যরাতে দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠেছিল বস্তিতে। কী ভয়াবহ মাগো…।

বলতে বলতে ও কুঁকড়ে গিয়েছিল। তারপর জ্ঞান হারিয়েছিল। ওকে দেখে রাবেয়ার মনে হয়েছিল, ও রাবেয়ার ছোটবেলার কুড়ানো শিউলি ফুল। শরীর ওর ফুলের সাদা রঙের পাপড়ি। স্নিগ্ধ আর পবিত্র। মুখটা কমলা বোটার রং নিয়ে আশ্চর্য সুন্দর। কেবলই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।

এই বাইশ দিন ধরে মেয়েরা সবাই মিলে ওকে দেখেছে। এখন ওর চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। ওরা দেখেছে কীভাবে মৃত্যু হয়। দেখেছে চোখের পাতা বুজে যায়। ঠোঁটের কাঁপুনি থেমে যায়। হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা থেমে যায়। শ্বাস-প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। বুকের ধুকপুক শব্দ আর হয় না। এবং গায়ে হাত দিলে বোঝা যায়, শরীরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে যায়। মেয়েরা ভেবেছিল, ওড়না দিয়ে মুখটা ঢেকে দেবে, কিন্তু ঢাকেনি। শিউলি ফুলের মতো মুখটা ঢেকে রাখতে মন চায়নি, ওদের মৃত্যু ওর ফুলের সৌরভ মুছে দেয়নি।

রাবেয়াকে খবর দেওয়া হয়েছে। রাবেয়া এলে বলবে কী করা হবে। রাবেয়া জানে, মেয়েটি বলবে, আমার মৃত্যুর খবর দিয়ে আমি কাউকে কাঁদতে দিতে চাই না। যুদ্ধের জন্য শক্তি দরকার। কেঁদেকেটে শক্তি ক্ষয় করার দরকার নেই।

ও তো যখনই অজ্ঞান হয়েছে, তার পরে জ্ঞান ফিরলে এমন কথাই বলত। ও বলত, আমি একটা একা মেয়ে। একা পৃথিবীতে এসেছি। আমার সঙ্গে দু-চার পাঁচজন ছিল না। তাই একাই আমি হারিয়ে যেতে চাই। সবাই জানুক আমি হারিয়ে গিয়েছি। ব্যস, সব শেষ। তোমরা আমার জন্য চোখের পানি ফেললা না।

ওর এসব কথা শুনে রাবেয়া বুঝেছে, ও বস্তির মেয়ে না। ওর ভেতরে বুদ্ধির সাড়া আছে। ওর পড়ালেখার কথা জিজ্ঞেস করলে বলেছে, আমি তো স্কুলে যাইনি। মানুষের বাসায় কাজ করেছি। বাবা রিকশা চালাত। মা ইটভাটায় কাজ করত। অনেক ভাইবোনের সংসার ছিল। সব ভাইবোনই কোনো-না-কোনো কাজে ঢুকে গিয়েছিল। আমাদের কোনো দুঃখ ছিল না। আমরা হাসিমুখে ডাল-ভাত খেতাম। এখন মরতে আমার দুঃখ নাই।

কত অবলীলায় ও এসব কথা বলত। ওর মুখ দেখে মনে হতো না যে, ও মিথ্যা কথা বলছে। আশ্চর্য মেয়ে, সবকিছু থেকে নিজেকে আড়াল করে আজ

ওর বিদায়ের দিন।

রাবেয়া ঘরে ঢুকতেই পাশে বসে থাকা মেয়েরা কান্নার শব্দ করতেই রাবেয়া ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলে, চুপ। ও না মানা করেছে কাঁদতে।

ও মানা করলে আমাদের শুনতে হবে?

থমকে যায় রাবেয়া। তাই তো! ও বললেই তা শুনতে হবে? আর এই তিন মাস যে একসঙ্গে থাকা, একসঙ্গে নির্যাতিত হওয়া, একসঙ্গে মৃত্যু দেখা, একসঙ্গে একটা ছুরি হাতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা—এত কিছু ভাগাভাগি করার পরও ও ওদের কেউ না? তা হতে পারে না। ও আমাদের কেউ। আমাদের একজন। আমাদের স্বজন।

খালা।

একজনের কণ্ঠ। রাবেয়া তার ডাকে ঘুরে তাকায় না। যেখান থেকেই ডাকুক তার সবটুকু তো ও শুনতেই পায়। শুধু বলে, কী বলবি, বল। বেশি কথা বলবি না কিন্তু।

আমরা ওর জন্য দোয়া পড়ব না?

পড়বি। পড়। দোয়া পড়তে তো মানা নেই।

একজন ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে, কেমন করে দোয়া পড়ব? তুমি আমাদের নাপাক শরীর পাক করে দাও। আমাদের দম যে আটকে আসছে।

রাবেয়া কথা বলে না। রাবেয়া জানে, এখানে এসব কিছু হবে না। সেই সুযোগই এই মেয়েদের দেওয়া হবে না। বাথরুমে যথেষ্ট পানি নেই। একসঙ্গে ওদের গোসল হবে না। এসব চিন্তার সুযোগ নেই। রাবেয়া কথা বলতে পারে না।

খালা।

আর একজনের কণ্ঠস্বর।

বল।

আমরা চাই না ওর লাশ পায়ে দড়ি বেঁধে বারান্দা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হোক। আমরা সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে ভ্যানে তুলে দিয়ে আসব।

রাবেয়া জানে, এটা হবে না। তাই চুপ করে থাকে। মৃত্যুর খবর পৌঁছে দেওয়া হয়েছে অফিসে। একটু পরে ডোমরা আসবে লাশ বের করতে।

অন্যদের মতো ওকেও পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।

খালা।

আর একজনের কণ্ঠস্বর।

বল।

তুমি কি আমাদের ভোম দাদাদের একটা কথা বলবে?

কী কথা? ডোম দাদারা কি তোদের কথা রাখতে পারবে?

এটা তো একটা সহজ কথা। রাখতে পারবে না কেন? ডোম দাদারা যেন ওকে ভাগাড়ে না ফেলে কোথাও পুঁতে রেখে আসে।

ঠিক আছে, বলে দেখব। তবে আমি তো জানি, ওরা তোদের কথা রাখতে পারবে না।

আমরা সবাই ডোম দাদাদের পায়ে ধরব।

খবরদার, এমন কাজ করতে যাস না। খবরদার না। তাহলে ওরা মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

কেন? কেন মাথা ঘোরাবে দাদাদের?

ডোম দাদারা তোদেরকে দেবীর মতো সম্মান করে। তোদেরকে মাঠাকরুন বলে। মা-ঠাকরুন কি সন্তানের পায়ে হাত দেয়?

মেয়েরা চুপ করে থাকে। হঠাৎ বাইরে গোলাগুলির শব্দ হলে ওরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। মরদেহ সামনে নিয়ে বসে থাকা মেয়েরা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। রাবেয়া নিজেও জানে না, কেন গোলাগুলি হচ্ছে? মুক্তিযোদ্ধারা কি পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে? এমন সুদিন কি হয়েছে?

অল্পক্ষণে গোলাগুলি থেমেও যায়। আরও কিছুক্ষণ পর ডোম নিয়ে সেনারা আসে। মেয়েরা ঘরের কোণে জড়ো হয়ে গুটিসুটি হয়ে থাকে। লাশের পায়ে দড়ি বাঁধা হয়। টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। মেয়েরা স্তব্ধ হয়ে থাকে। ডোম দাদাদের বলা হয় না যে, ওকে একটু মাটির নিচে জায়গা দিয়ো। ওরা যদি ডোমদের মা-ঠাকরুন হয়, তাহলে সব কি সন্তানদের বলতে পারে না? পারে, হুকুম দিতেও পারে। নিজেদের বুকের যন্ত্রণা কাটাতে গিয়ে ওদের চোখ জলে ভরে থাকে।

বেলা বাড়লে রাবেয়ার মনে হয়, মেয়েটি চিঠি লেখেনি। ওর ঠিকানাও নেই। তাহলে ও কি হারানো মানুষের তালিকায় থাকবে? নাকি ওর জন্য আর কিছু ভাবতে হবে? ও গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। ভাবে, আর কত দিন ও এমন গালে হাত দিয়ে বসে ভাববে যে, কবে এই মেয়েদের আসা-যাওয়ার হিসাব শেষ হবে? কবে এদের মরদেহের হিসাব রাখা শেষ হবে? ঘরে গিয়ে রুশনির নাম আর মৃত্যুর তারিখ লিখবে নিজের ছোট খাতায়। রোহিত ডোমকে দিয়ে ছোট এই খাতাটা কিনে আনিয়েছিল এখানকার দশজনের মৃত্যুর পর। রুশনির নাম লিখলে তার সংখ্যা হবে তেতাল্লিশ।

জড়ো হয়ে থাকা মেয়েরা আলাদা হয়। ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। রাবেয়ার মুখখামুখি হয়ে তিন-চারজন একসঙ্গে ডাকে, খালা।

ও কারও দিকে না তাকিয়ে বলে, বল। তোদের মনে যত কথা আছে তার সব বলে ফেল।

আমরাও মরণ চাই। বিষ দাও। সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলে, আমরা বিষ খাব।

রাবেয়া চোখ গরম করে বলে, বিষ! তোদের জন্য তো আমি ছুরি এনে রেখেছি। প্রথমে ওদের পেটে ঢুকাবি। পরে নিজের পেটে। পারবি না?

পারব তো। তুমি তো ছুরি দাও না। এনে রেখেছ বলছ। কিন্তু আমাদেরকে দাও না।

পরদেশীকে দিয়ে ছুরি আনিয়েছি। ওটা ড্রেনের ভেতরে মাটিতে গেঁথে রেখেছি। তোরা একটি ছুরি দিয়ে একজনকে মারবি। ওরা ব্রাশফায়ার করে মারবে দুই শ জনকে। সুইপার-ডোমদেরও ছাড়বে না। বল, আমি কী করব?

আমাদেরকে ছুরি দাও। তোমাকে আমাদের একটাই কথা। ছুরি দাও। শুধু শুধু মরব কেন? মেরে মরব। জীবনের দাম অনেক। সেই জীবন বৃথা যাবে না।

ঘরের সব মেয়ে একসঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে। ঘন হয়ে বসে। পরস্পর হাত ধরে। কেউ কেউ রাবেয়ার গা ঘেঁষে বসে। রাবেয়া ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, তোরা এভাবে মরতে চাস?

চাই। এক শ বার চাই। হাজার বার চাই।

আমরা তো ইচ্ছা করে এখানে আসিনি। আমাদেরকে জোর করে আনা হয়েছে। জোর করে আনার প্রতিশোধ আমরা নেব।

আমাদের স্বাধীনতা চাওয়ার জন্য এটা আমাদের শাস্তি।

ওদের নির্যাতন সহ্য না করে আমরা স্বাধীনতার জন্য মরতে চাই।

মৃত্যুই যদি শেষ কথা হয়, তাহলে মরব না কেন?

তখন ব্যারাকের সামনে সশব্দে গাড়ি থামে। সিঁড়িতে বুটের দুপদাপ শব্দ শোনা যায়। সঙ্গে মেয়েদের আর্তচিৎকার। দশ-বারো জন মেয়েকে টেনেহিচড়ে হেডকোয়ার্টারের দোতলায় ওঠানো হচ্ছে। ওরা হাত-পা ছুড়ছে, চিষ্কার করছে। রাবেয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ালে দেখতে পায়, ওদেরকে পশ্চিম দিকের একটি ঘরে ঢোকানো হচ্ছে। ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিয়ে তালা দেওয়া হয় ঘরে।

তারপর ইশারায় রাবেয়াকে খেয়াল রাখার কথা বলে নেমে যায় ওরা। ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পায়, দূরে দাঁড়িয়ে আছে পরদেশী। অন্য একদিকে লালু ডোম। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে অন্যরা। তারা আবার অল্পক্ষণে সরে যায়। জানে, দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে পিটুনি খাবে। রাবেয়াও থামের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে রাখে। মাথা ঠেকিয়ে রাখে থামের গায়ে। দুহাত পেছনে মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাখে।

বিকেলে পরদেশী রাবেয়াকে বলে, আমি ঠিক করেছি, জেনিফারের চিঠিটা আমি হাটখোলার বাড়িতে পৌঁছে দেব। জেবুন্নেসার চিঠিটা যে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলাম, সেই বাড়িতে।

ওখানে কেন দিবি?

ভেবে দেখলাম, ওদের খবরগুলো এক জায়গায় একটা বাড়িতে জমা থাকুক।

ঠিক বলেছিস। তাহলে কালকে যা।

কাল কেন? আজই যাব।

কতজন এই পুলিশ লাইনে মারা গেছে, কতজনকে ধরে আনা হয়েছে, তার একটা খাতা আমার কাছে আছে না? আমি সেই খাতাও ওদের কাছে দিতে চাই। একদিন এসব কথা বলতে হবে না, পরদেশী?

দেশ স্বাধীন হলে তো বলতেই হবে। আমরা তো এই যুদ্ধের সাক্ষী। জেনিফারের চিঠিটা কই?

এইখানে। রাবেয়া হাত দিয়ে কোমরে গুঁজে রাখা চিঠির জায়গা দেখায়।

নিমেষে চমকে ওঠে দুজনেই। নতুন ধরে আনা মেয়েদের আর্তচিৎকার ছড়াতে থাকে চারদিকে। তখনো রোদ ফুরোয়নি। দিন শেষ হয়নি। আঁধার ঘনায়নি। তার পরও কেন মানুষের জীবনে অন্ধকার? কারণ, চারদিকে যুদ্ধ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *