০৫. দলিল-দস্তাবেজ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

০১.

ঘটনা কী সে সম্বন্ধে ভিন্ন মত আছে। উপরন্তু যদি কেউ সে সময়ের দলিল-দস্তাবেজ উল্টে পাল্টে দেখে তবে তার হঠাৎ অনুমান হতে পারে তখনই তো এক নতুন জাতের সব ঘটনার সুচনা হচ্ছিলো গ্রামে। একটা উদাহরণ নাও। কাছারিতে তখন রানীমার জন্মোৎসবের কথাই প্রাধান্য পাচ্ছিলোতা ঠিকই, কিন্তু সেই একরকমের যুদ্ধ, যার অন্য নাম আধুনিকতাও বলা যায়, তার কথাও এসে পড়ছিলো।

মূলে সেই রাস্তা কাটার ব্যাপারটাই। সোজা সে কথা? নাক কেটে দেওয়ার চাইতে কম কিছু? তাও কার? ডানকানের? হতে পারে সে স্কচ, একেবারে যোলআনা ইংরেজ নয়, তা হলেও সে কি রাজার দেশের লোক নয়? জ্ঞাতকুটুম্বদের মধ্যে পড়ে না? অথচ মাথা ফাটলো না দু-পাঁচজনের, দু-চারজনের বুকে বল্লম বিধলো না, এক কথায় রক্তে মাটি ভিজলো না। এদিকে নায়েবমশায়ও যেন ব্যাপারটাকে নিজের মনের মধ্যে চেপে রেখেছেন। রাগ (নাকি ক্রোধই বলবে) ছাড়া কী? দারুণ ক্রোধ। নতুবা আলাপ-আলোচনা নেই, কথাবার্তা নেই, শাসানো নেই। লাঞ্চো খেলে তো একই সঙ্গে বসে (না-হয় নায়েব নিজে খাননি) আর সেই লাঞ্চো থেকে উঠে এঁটোমুখেই হুকুম গেলো সড়ক কাটার। এদিকে সব শুমশাম। যেন কিছুই নয়। কিছু না-ঘটাই তো একটা ঘটনা।

কারো কারো মতে এটাই ঘটনা যে ১৮৫৭ শেষবারের মতো ঘটেছে আর ঘটবে না, ঘটনা এটাই যে এখন থেকে নতুনভাবে ঘটবে। এসব লক্ষ্য করেই তারা বলতে পারে :হতে পারে তখনও স্যার বানেশ পীকক কলকাতার হাইকোর্টে জমকালো হয়ে বসেনি। কিন্তু এখানে যেন পরে যা হবে তার সূচনা সেবারই দেখা দিয়েছিলো। একটা বড়ো রকমের পরিবর্তনের সূচনা। তুমি তোমার ধর্মমত, আর্থিক সঙ্গতি এমনকী চামড়ার রং নিরপেক্ষ অন্য সকলের সমান। এ কি আগে কখনো ছিলো? তুমি বিধর্মী হলেই কোণঠাসা, তোমার চামড়ার রং কালো বলেই তোমার কথা মিথ্যা এইনা-এতদিন, পাঁচশ বছর ধরে, হয়ে এসেছে। এখন দ্যাখো সমান হচ্ছে। ন্যায়নীতির প্রতিষ্ঠা হবে। এই সমান কথাটা নিয়ে রসিকতা আছে। ফুটপাথে শুয়ে থাকা ধনী-নিধনের পক্ষে সমান অপরাধ। সত্যমিথ্যা নিয়েও কম গোলযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে সত্য কি তাই নয় যা প্রমাণিত হলো! আর প্রমাণ মানেই হলপ করে বলা কথা।

কথাটা ন্যায়নীতি নিয়ে। ন্যায়নীতির কথায় অবশ্যই কিছু কিন্তু আছে! এ বিষয়ে নায়েব মশাই ও হরদয়ালের আলাপই উদাহরণ হতে পারে। হরদয়াল বলেছিলো, দেখছি জমিটা মূলে ফরাসডাঙার, দখলদার কৃষক শামসুদ্দিন। নায়েব বলেছিলো, তাহলেও প্রমাণ হয় না জমিটাতে মনোহরের স্বত্ব অর্শাচ্ছে। হরদয়াল বলেছিলো, জমিটা হয়তো মনোহরের কাছে দায়বদ্ধ। নায়েব বলেছিলো, জমি দায়বদ্ধ হতে পারে, তাতে কিন্তু তার উপরে স্থায়ী রাস্তা করার অধিকার মনোহরের জন্মায় না। হরদয়াল হেসে বলেছিলো, তা বটে, কিন্তু আমরাই বা কোন পক্ষ? জমিটা ফরাসডাঙার যে বলবে তা কি প্রমাণসাপেক্ষ নয়? যদি অন্যরকম প্রমাণ হয় তা কি সত্য হয় না? সত্য কী? যা এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী তোমার বক্তব্যকে প্রমাণ করে। এটা কি হরদয়াল আর নায়েবমশায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হরদয়ালের মন কি এখনো রাজনীতিতে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করে? শেষ পর্যন্ত রাজনীতির দাবি তাকেও মানতে হয়, কিন্তু কিছুটা তা কি নিজের মনের সঙ্গে বিবাদ করে? অন্যদিকে নায়েবমশায় যেন ন্যায়-অন্যায় বিচারের অসারত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ।

নায়েবমশায়ের এই মনোভাবকে অথবা মাঝপথে মনোভাব বদলানো তাদের একটা বিশেষ আধুনিকতা বলেই মনে হয়েছিলো। মানুষ এখন থেকে ক্রোধ, হিংসা ঈর্ষা, থেকে সরে যাওয়ার এক নতুন পথ পাবে। এতদিন তো হাতাহাতি, দাঁতের বদলে দাঁত, নাকের বদলে নাক নেওয়া ছিলো। এখন যেন সেসব থেকে দূরে থাকা হবে কৌশল। যে মামলায় জিতলো সে তো শান্ত হলোই, যে হারলো সে-ও ভাবলো, কী আর করা যাবে বলো, এবার থামো। যদি বলা হয় এ ধরনের শান্তিতে প্রকৃত কিছু লাভ নেই, তাহলে অপরপক্ষ বলবে যা নিয়ে বিবাদ তারইবা প্রকৃত মূল্য কী? কিছুদিন পরে বিবাদের উভয়ংক্ষিই বুঝতে পারে যা নিয়ে এত উত্তেজনা, কলহ, তা সবই নিতান্ত মূল্যহীন। এ যেন এক খেলার আইন মেনে চলা। জুয়ার খেলাতেও আইন আছে, যদিও সে আইনে টেবলের মালিকের লাভ হয় শেষ পর্যন্ত।

যাকে অন্যায় বলে মনে হয় তার প্রতিকারের জন্য মানুষের যুদ্ধ করার দিকে ঝোঁক। আছে। এবং এই আধুনিক প্রথায় সে-ঝোঁকটারও তৃপ্তি হয়ে থাকে। সূচনায় চিনতে কিছু অসুবিধা হচ্ছে বটে। দলিল দস্তাবেজ, কমিশন আর মিশন, গাউন-পরা শিক্ষিত উকিল ব্যারিস্টারের ছুটোছুটি আদালতে, গাউন ছাড়াই তাদের ছুটোছুটি সেনেটে আর মাঠে-পরবর্তী একশো বছরের সেসব বাকযুদ্ধের সূচনা পাবে এতেই! আর এও যে এক রকমের যুদ্ধ তা নাকি রানীমাই উল্লেখ করেছিলেন। অন্তত তার কথাতেই যুদ্ধ শব্দটার উল্লেখ ছিলো।

.

০২.

অন্যান্য দিনের মতো কাছারিতে কাজ হচ্ছে। নিঃশব্দেই বলা যায়। অর্থাৎ নায়েবমশায়ের খাসকামরার দিকে যত এগোবে ততই নিঃশব্দ। নতুবা এ-ঘরে ও-ঘরে চাপা গলার আলাপ, এমনকী তামাক টানার মৃদু শব্দ নিশ্চয় আছে।

কিছুক্ষণ আগে জমানবিশ মহেন্দ্র বেরিয়েছে নায়েবের কামরা থেকে, এখন আবার। সুমারনবিশ সুরেন্দ্রর ডাক পড়লো। জমানবিশকে চিন্তাকুল মুখে বেরোতে দেখা গিয়েছে।

তাকে সে অবস্থায় যে দেখেছে সে সদর-আমিন সোনাউল্লা। সোনাউল্লা চট করে সামনে যে-দরজাটা পেলো তা দিয়েই ঢুকে পড়লো। সে ঘরটা ল-মোেহরার গৌরীর।

সোনাউল্লা বললো–গতিক ভালো দেখি না।

–শুনছি তাই। বললো– গৌরী। –আসলটা জানেন কিছু?

-আরে আমি ভাই লেঠেলদের সদ্দার। কাগজপত্রের খোঁজ কী রাখি?

যেখানেই জমি নিয়ে বিবাদ সেখানেই আমিনের ডাক পড়ে। জমি মাপজোখের জন্য সঙ্গে লোকলস্কর থাকে এবং যেহেতু বিবাদ সঙ্গে দুচারজন পাইকবরকন্দাজও। এ থেকেই সোনাউল্লা কাজী, যে প্রায় মুনসেফ-ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ করে, নিজেই লেঠেলদের সদ্দার–কথাটা নিজের সম্বন্ধে তৈরি করেছে।

সে হেসে বললো–আমিও ভাবছি আলি বলে বেরিয়ে পড়ি। বিলমহলের মাপজোখ শেষ করে ফেলি। ওদিকে এ ওর জমিতে কামড় দিচ্ছে।

–আপনার কি মনে হয় গতিকটা মন্দ কাজ ফেলে রাখার জন্যই?

-শুনছি গত বছরের তুলনায় এই আট মাসের গড় আদায় বেশকিছু কম। পরগনায় পরগনায় নায়েব আহিলকারদের কাছে কড়া চিঠি যাচ্ছে নাকি।

–আপনার ভদ্রপুরের ঝামেলাটা মিটলো? গৌরী জিজ্ঞাসা করলো।

-ওটা আর আমার ঝামেলা নয়। বাঙালি নীলকরের নাম শুনেছো? দত্তবাবুরা নীলকর হতে চাইছে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুররা যেমন হয়েছিলো।

লাভ?

সাতপুরুষে ব্যবসাদার ওরা। তেজারতী বন্ধকী তো ছিলোই, এখন দাদন ব্যবসা। শুনছি আগে তাঁতীদের মহাজন ছিলো। এখন তাঁতী কই? নীলছাড়া আর ব্যবসা কোথায়? একটা তুলোর ক্ষেত দ্যাখো?

কারখানাও করবে?

–আপাতত মরেলগঞ্জের সঙ্গে বন্দোবস্ত। কিন্তু তোমার ঘরে মুসলমানী হুঁকো যদি না রাখো, আমার আসাই বন্ধ করতে হবে।

-রাখবো। গৌরী বললো–শামসুদ্দিনের দরুন সেই রাস্তা কাটার জমিটা আপনি মেপেছিলেন নাকি?

কবে! না এবার উঠি। চক্‌ ইসমাইলের দিকে যাবো। ভদ্রপুরের কানুনগোকেও চিঠি দিতে হবে। আরে গৌরী, এবার রানীমার জন্মোৎসবের খাওয়াদাওয়ার ইনচার্জো কে? গতবার মুসলমান জোতদাররা কলাপাতায় খেতে বিরক্ত হয়েছিলো।

উঠেছিলো বটে কথাটা। দেখতে সুন্দর হয়নি। মনে হয় সুরেনবাবুই ভার নেবেন। টেবল-চেয়ার কাঁচের বাসন হলেই হয়।

.

নায়েবের খাসকামরায় সুমারনবিশ সুরেন্দ্র দেখলো নায়েব তখনো জমার বই দেখছেন। পাশে গত সনের জমার চুম্বক-নথিনাকি রেভেনিউ অ্যাবস্ট্রাক্ট বলে। আঙুলের ডগায় ডগায় হিসাব হচ্ছে।

নায়েব বললো–বসো, সুরেন্দ্র।

দুপাঁচ মিনিট আরো হিসাব চললো। চুম্বক-নথিতে লাল পেনসিলের দাগ পড়লো। খাসবরদারকে ডেকে নায়েব বললো, রানীমার সঙ্গে দেখা করবো। হুকুম আনো। আর্জি নিয়ে খাসবরদার চলে গেলো, জমা বই ঠেলে দিয়ে নায়েব মুখ তুলো।

সাহসী সুরেন্দ্রও চমকে উঠলো।

নায়েব বলেলা–দ্যাখো, সুরেন্দ্র, দেওয়ান উৎসবটা শুরু করেছিলেন, তখন নিশ্চয় হেতু ছিলো। এখন কিন্তু ওটা আমাদেরই ব্যাপার। আমরাই উৎসাহ নিয়ে এগোবো। যাঁর জন্মতিথি তিনি কী আর বলেন? ছেলেরা নাটক করার কথা বলছে, কিন্তু তোমার দফাওয়ারি আগাম হিসাব, নাকি তাকে বডজেট বলে?

-এবার তিথিটাই আজ্ঞে এগিয়ে এসেছে। আমি দুএক দিনেই পেশ করবো বড়জেট।

হলেই বা। সেদিন সুমার দেখতে দেখতে হঠাৎ নজরে না পড়লে আরো কয়েকদিন পিছিয়ে যেতো জোগাড়যন্তর।

তা কি আর হতে দিতাম, হুজুর। রেলের শেয়ারের দরুন অ্যাটর্নির খত দেওয়ানজির মন্তব্যসমেত এসেছে। আড়াই লাখ মতো।

–হুঁ। বডজেটে ধরো।

 সুমারনবিশের উৎকণ্ঠাটা গেলো।

সে বললো–সব পরগনার সব জোতদারদের কি বলা হবে?

গতবারও বলেছিলো বটে। কিন্তু একজায়গায় তো থামবে। বার্ষিক দাখিল পাঁচ হাজার পর্যন্ত পত্র দাও। জমানবিশের সেরেস্তায় লিস্টি করতে বলল।

সুমারনবিশ উঠলো। কিন্তু যেন দাঁড়িয়ে পা ঘষে, যেন কিছু বলবে।

নায়েব তা লক্ষ্য করলো।

নাচগান আর আতসবাজীর কথা নাকি?

সুমারনবিশ খুশি গোপন করে বললো–আচ্ছা, হুজুর, তা পরে বলবো।

সকালের কাছারি ভাঙে দুপুরের আগে। এগারোটা বাজে আজকাল তখন। সময়টা সেদিকে চলেছে। নায়েবের খাসবরদার আর্জি পৌঁছে দিয়ে ফিরে গড়গড়ার জল বদলে ছিলিম দিলো। নায়েব দুএক টান দিলেন। হাঁ, ঠাণ্ডা বটে এ তামাকটা। যে বয়সের যা এই রকম একটা চিন্তা নায়েবের মনে একপাক ঘুরে গেলো। রাজবাড়ি থেকে রূপচাঁদ এলো। নায়েব তখনো তামাক টানছেন। কাছারি ভাঙলে যেতে বলেছেন রানীমা।

তামাক শেষ করে নায়েবউঠলো। ধীর পায়ে কাছারির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কখনো কখনো কোনো সেরেস্তায় ঢুকে পড়ে নায়েব আমলাদের খাতাপত্তর পরীক্ষা করে থাকে। কাজেই যতটুকু দেখা যায় দরজা-জানলার ফাঁকে নায়েবকে তেমন দেখে নিয়ে আমলারা কাগজে চোখ নামিয়ে নিলো।

নায়েব এই সময়ে লক্ষ্য করলো সদর-দরজা দিয়ে হরদয়াল এগিয়ে আসছে।

দেওয়ানকুঠি থেকে কোথাও যেতে খানিকটা কাছারির দিকেই আসতে হয়।

 হরদয়াল কাছে এলে নায়েব বললো, নমস্কার-কাছারিতে নাকি?

হরদয়াল বললো–রানী ডেকেছেন।

নায়েব বললো–আমিও তো যাচ্ছি, তাহলে

হরদয়াল একটু ভেবে, হেসে বললো, দুজনকেই দরকার হয়তো একত্রে।

রাজবাড়ির দরজাতে রূপচাঁদ জানালো, রানীমা দরবার-ঘরে। দেউড়ির ঘড়িতে তখন সশব্দে এগারোটা বাজলো। দরবার-ঘরের নিচু কৌচে রানী বসেছিলেন। কাছারির প্রধানতম দুজন দরবারে। রূপচাঁদ সুতরাং যথোপযুক্ত আসনের ব্যবস্থা করে রেখেছিলো।

রানী বললেন–বসো হরদয়াল, বসুন নায়েবমশাই।

নায়েব দরবার চেয়েছিলো, সুতরাং সে-ই আগে বলবে। জানালো জন্মোৎসব সম্বন্ধে বলতে চায়।

.

০৩.

রানী শুনে বললেন, তুমি যখন সে বিষয়ে এখনো আলাপ করার কথা ভাবছো, সব পাকা হয়নি। ওটাকে কি চালিয়েই যেতে হবে? না-হলেই কি নয়?

–আজ্ঞে, এটা এক বিশেষ উৎসব যা আমাদের অঞ্চলেই হয়। দশজনের আনন্দ, গ্রামের সুখ্যাত।

বলো।

গতবার জোতদারদের মধ্যে বড়োদের, সদরের হাকিমদের, মরেলগঞ্জের ওদের নিমন্ত্রণ হয়েছিলো। এবার

–মরেলগঞ্জে দিতে চাচ্ছো না? ইংরেজদের সঙ্গে ফৌজদারি-ফরিয়াদিতে কিন্তু লাভ হয় না। একটু দেরি হলো নায়েবের উত্তর দিতে। বললো–এখনো সবটা ভেবে উঠতে পারিনি।

কৌতুক বোধ করে রানীমা ভাবলেন, এ কি কখনো সম্ভব নায়েবের, মরেলগঞ্জেই দু একজন লোক নেই যে ডানকান কী করবে তা ধরতে পারছে না? বললেন–মামলা চলুক, নিমন্ত্রণ পাঠাও। তাছাড়া লীজের হলেও মরেলগঞ্জও তোমাদের একরকম পত্তনীদার। দেওয়ানি স্বত্বের মামলা ভালো নাকি বিলেত পর্যন্ত নেওয়া যাবে। বেনে নীলকরেরা ততদুর যেতে চাইবে না বোধ হয়।

কিন্তু তখনই স্নিগ্ধ ডাগর চোখদুটো যেন চঞ্চল হলো, গালে কোথাও একটু যেন রং লাগলো। বললেন রানী–তুমি কি শুনেছো? তোমাদের পেত্রো নাকি ইংরেজদের একটা কথাই ইংরেজিতে বলতেন : দেয়ার্স নাথিং আনফেয়ার ইন লভ অর ওঅর!

দরবার শেষ হলো, নায়েব উঠলো। কিন্তু ডানকান আর তার মামলা সম্বন্ধে নির্দেশ নিয়ে দরবার ভাঙা যায় কি? বরং দরকারি কথার মাঝে এসে পড়েছিলো এমন ভাবটা থাকা উচিত।

বিচক্ষণ নায়েব সেজন্যই যেন বললো–ঘরবাড়ি সংস্কার ইত্যাদির কাজে খরচটা বৃদ্ধির দিকে। রানী কথা না বলে নায়েবকে বলতে দিলেন।

নায়েব বললো– হাসিমুখে নরেশ, সুরেন, এরা যত কাজ করছে, তত যেন কাজ বাড়ছে। ওদের একটা আলাহিদা দপ্তর করলে হয় না? পৃথক হিসাবনিকাশ, তদারকি। দেওয়ানজিকে অনুরোধ করেছি ভার নিতে।

ভাবতে যেন মুহূর্তই যথেষ্ট। রানী বললেন–ভালো করেছে। নিয়োগপত্রের দরকার হবে? আচ্ছা, আমি বলি, হরদয়াল, নরেশদের কাজ দেখে দিলে তোমার উপরে খুব চাপ পড়বে?

কোনো কোনো বিষয় খুব দ্রুত অগ্রসর হয় দেখা যাচ্ছে। নতুন এই পূর্তবিভাগটি পৃথক করে খোলার ব্যাপারে তা দেখা গেলো।

নায়েব চলে গেলে হরদয়াল বললো, আমাকে ডেকেছেন?

-হ্যাঁ, হরদয়াল, বসো। রানী বললেন, ভালোই হলো তোমার হাতে কাজের ভারটা এসে। একটা শহর গড়ে তোলার মধ্যেও পৌরুষ থাকে, নয়? রানী হাসলেন। পরে অন্য পুরুষ এসে তাকে অন্য রকমে গড়তে চাইবে, তাহলেও কিছু একটা করেছি এরকম অনুভব থেকে যায় না? তুমি ভেবে দেখো আমাদের এই বাড়িতে গাড়িবারান্ডা জুড়লে কেমন হবে, তার জন্য নাকি আলগা কয়েকটা মিনারও বসাতে হবে মাথায়। কিন্তু তার চাইতেও বেশি ভাবা দরকার ছ-আনির কায়েতবাড়ি পর্যন্ত রাজবাড়ির সদর থেকে বর্ষায় বেচাল হয় না এমন পাকা সুরকি রাস্তা কী করে হয়।

কায়েতবাড়ি? হরদয়াল বিস্মিত হলো–কোথা দিয়ে যাবে? মরেলগঞ্জের আড়াআড়ি?

রানী যেন কৌতুকে হাসলেন। বললেন–না না। ফরাসডাঙা দিয়ে।

-সে তো তিন-চার ক্রোশ হয়ে যাবে, অনেক–

 রানী বললেন, অনেক টাকা বলেই তো নায়েবমশাই তোমাকে ভার নিতে বলছেন।

দরবার কি দীর্ঘস্থায়ী হবে? কৌচের উপরে কুশন ছিলো। হেলে বসলেন রানী। মোটা বাঁশগিরে রুলিতে আলো চিকমিক করলো যেন। বললেন–চীনে নানকিং কী? টাইপিং কী বিষয়?

হরদয়াল লক্ষ্য করছিলো, ভঙ্গিটা পরামর্শের বটে। সে অতি দ্রুত চিন্তা করলো, চিন্তায় থই পেয়ে বরং বিস্মিত হলো। টাইমস কাগজে সোরগোল। টাইপিং বিদ্রোহে ইংরাজ অন্য পক্ষ, সুবিধা করতে পারছে না। এমনকী সেনাপতি বদলের কথা হচ্ছে। কিন্তু রানী জানলেন কী করে? চীনাদের এক অংশ স্বজাতির স্বার্থে, ইংরেজ তাদের অবাধ বাণিজ্যের নামে মুখোমুখি।

রানী হালকা কথার সুরে বললেন, কায়েতবাড়ির ছেলে ইংরেজ পক্ষে সাবলটার্ন না কী হয়ে যেতে চায় সেখানে।

আমরা? হরদয়াল বললো–অনেকদিন পরে আবার সে রাজবাড়ির পক্ষকে আমরা বললো–আমাদের কিছু ভাবতে হবে? সাবলটার্ন বলছেন?

রানী ভাবলেন, বললেন অবশেষে-ছেলেরা যদি মত চায়, তার অবশ্য একুশ পার হয়েছে। মতনা-চাইলেও কী হতো? একটু থেমে বললেন আবার কেউ কেউ বাপের মতো হবেই। সবদিক ভেবে দেখে বলল।

রানী উঠলেন।

.

০৪.

নায়েব রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে খাসকামরায় বসতেই খাসবরদার একটু দ্বিধা করলো, কিন্তু বসছেন যখন এই ভেবে ছিলিম পাল্টে আলবোলার নলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো–এবার রানীমার জন্মদিনে তসরের গড়া চাই, হুজুর।

-সে কী? ও আচ্ছা। তা তো বটেই। গৌরীকে ডেকে দাও একবার।

ল-মোহরার গৌরী এলে নায়েব চেপে চেপে হাসলো, বললো–কীবল ছোকরা কি ব্যারিস্টার? দ্যাখো তো মনোহরকে সে-ই পরামর্শ দিচ্ছে কিনা।

অবাক গৌরী বললো–আচ্ছা-আচ্ছা, খোঁজ রাখতে হচ্ছে, হুজুর।

 কিন্তু গৌরী একা নয়। সুমারনবিশকে সামনে রেখে বেশ কয়েকজন ভিড় করে এলো। নায়েব চোখ তুলো। তার কী বুঝতে আর বাকি? বললো–ঢের হয়েছে, হাতের কাছে রামযাত্রা আছে কিনা দ্যাখো।

সুমারনবিশ আজ্ঞে বলে ইতি করতে চাইলো, কিন্তু তার পিছনে অন্যেরা এমন দরজা জুড়ে যে পিছানোর উপায় নেই।

দরজার পাশ থেকে একজন জানালো-আজ্ঞে, নাটক কলকাতায় যা হয়, ঠিয়াটার। আমাদের ব্রজকান্ত দেওয়ানজির সঙ্গে গিয়ে দেখেছে। দেওয়ানজিকে বলেছিলো ব্রজ। তিনি বলেছেন, দ্যাখোনা চেষ্টা করে। আপনি বললে রিহারস্যাল শুরু করি।

–এই মরেছে! এখন যাও, এখন যাও। ঠিয়াটারে রক্ষে নেই রিস্যাল দোসর। সেরেছো তোমরা। এখন বোঝোগে, সে কিন্তু রানীমার চোখে পড়তে পারে।

আমলারা খুশি মুখে চলে যেতেই নায়েব জমাবন্দির খাতাটা খুলছিলো, কিন্তু খাসবরদার নিবেদন করলো এগারোটা বেজে এ বেলার কাছারি ভাঙলে তবেই তিনি রাজবাড়ি গিয়েছিলেন। তিনি না-উঠলে আমলারা কেউ যেতে পারছে না।

কাছারি বারান্দায় নায়েবের পালকি। হঠাৎ একদিন যেমন সে শুনতে পেয়েছিলো সেদিন সকাল থেকেই সে নায়েব আর নয়, নায়েব-ই-রিয়াসৎ, তেমনি হঠাৎ একদিন কাছারির গোড়ায় ছ বেহারার পাকিটাকে দেখতে পেয়েছিলো।

কে এলো রে? আজ্ঞে, কেউ নয়। আপনার বাসায় যেতে।

পালকিটা চলেছে মাঝারিগতিতে। একহাত নিচে পথটা সরে সরে যাচ্ছে। রানীমার ছোটো আট বেহারার পালকিটাও মাটি থেকে কোমরসমান উঁচুতে থাকে। তাকিয়ায় কনুই রেখে আধশোয়া অবস্থায় নায়েব। এখন সে কিছু ভাবতে চায় না। এখন স্নানাহার বিশ্রামের সময় নয়? কিন্তু, তার মনের মধ্যে কেউ ফাঁকিটা ধরে হাসলোম্মুঃ। তাহলে তো উল্টোদিকে যোগই হলো।

হুঁই-হাই করে চলছে পালকি। হ্যাঁ, নিচুই তো। কাহারদের সে বেঁটে দেখে দেখে বাছাই করেছে। পাকির ছাদের দিকে চাইলো নায়েব। বেশ উঁচু। ও, হ্যাঁ, কোনো-কোনো ঘোড়ার পিঠ ওরকম উঁচু হয় বৃটে। তা ছিলো। আর লাফিয়ে উঠতো তার পিঠে। কায়েতের ছেলে, কিন্তু লাফিয়েই উঠতো বুজরুকের মতোই।

কাহাররা গুমগুম গুনগুন করে উঠলো। নায়েব বললো–আস্তে চলো, বাপারা, এ কি রাজবাড়ির পাকা হাতা?

নায়েব ভাবলো পাকা রাস্তাই তো কথায় উঠেছিলো। তা ভালো সদরে গেলে বোঝ যায় সুবিধা কোথায়, ফীটিন বলল, ল্যান্ডো বলল, সকলেরই সুবিধা। …আর রাজবাড়ির দেউড়ির কাছে যখন পাকা রাস্তায় উঠেছে বুরুকের ঘোড়া লাল আগুনের শিখার মতো ধুলো উড়তো, নাকি বালামচি?

কিন্তু, কিন্তু তুমি বাপু কায়েতের ছেলে গোবরা, তোমার কেন তেমন ঘোড়া? কী লাভ?

কী লাভ?

নায়েব নিজেকে জানালো, আসলে গৌরী বেজোদের দেখে মনে পড়েছে তোমার। তাদেরই সমবয়সী ছিলো তো। থাকলে ওদের ঠিয়াটারে জমতো।

সে স্থির করলো গিন্নিকে আজ বুঝিয়ে দেবে, (প্রথম) যে গিয়েছে সে শত কান্নাতেও ফেরে না, (দ্বিতীয়) পেটের ছেলের শোকও মানুষ ভোলে, ভাগনা বলে শোক বেশি হয় না, (তৃতীয়) আমি তো আর-এক ভাগনাকে এনে দিয়েছিলাম, ভরলো তোমার বুক?

কাহাররা কাঁধ বদলালো, তাই একটা মৃদু ঝুঁকি লাগলো। নায়েব দু হাত একত্র করে বুকে রাখলো।

না, আনন্দ হয় এমন কোনো বিষয়ে আজ আলাপকরতে হবে। তেমন বিষয়ের খোঁজেই যেন তার মনে পড়লো রানীমার কথা। সেই স্নিগ্ধ ডাগর চোখ দুটির চঞ্চল হয়ে ওঠা, ঠোঁটের কোণের সলজ্জতা আর হাসির মধ্যে সেই ইংরেজি কথা। রানীমা ইংরেজি বলেছেন শুনে তুমি কাঠ হবে, গোবরার মামী। তা এক বিদ্যুতের ঝিলিক।

হঠাৎ যেন কাহারদের হুই-হাই বেড়ে উঠলো। সে বাড়ির গিন্নিকে খুশি করতে। তো, রাজবাড়ির তত্থা। গিন্নি কাপড়চোপড় দেন, এ সুযোগে-সে সুযোগে মাহিনায় দশদিন খাওয়ান।

মর্যাদার প্রশ্ন এসব।

রানীমা অবশ্য যুদ্ধের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সড়ক কাটা কি যুদ্ধ? যুদ্ধ? আঃ অন্ধকারে অদৃশ্য ঘোড়ার কাজলকালো পেশীর মতো কিছু কী তার মনের মধ্যে টগবগিয়ে উঠছে। নাকি এক হিংস্র দাঁতের সারি। আর, জানো বাপু, বুড়োবয়সে রাশ টেনে রাখতে পিঠ ভেঙে আসে, দম ফেটে যায়; হাত…

বাড়ি পৌঁছে ধীরে-সুস্থে স্নানাহার করে নায়েব গিন্নিকে ডেকে বললো, গোবরার মামী, শোনো। একটু শোও দেখি, বাছা, আমার পাশে। এখনই সলতে পাকাতে হবে কেন? সলতে, সলতে…প্রদীপে ঘর সাজিয়ে লাভ?

তিরস্কারের মতো সুর শুনে নায়েবগিন্নি বিছানায় এলো।

নায়েবের চোখ দুটি দুপুরের ঘুমে জড়িয়ে আসছে, সেই কত দিনের অভ্যাস তো। হঠাৎ যেন উৎকর্ণ হলো সে। যেন কিছু শুনছে? পাখি? ক্রোক-ক্রোক করে ডাকছে। খুব নিস্তব্ধ দুপুরে, কিংবা পোড়োবাড়ির কাছে শোনা যায়। কাঠঠোকরাই। কিন্তু এ কী? আমার বাড়ির কাছে? নায়েব ধড়মড় করে উঠে বসলো।

পাশের লোক উঠে পড়লে শুয়ে থাকা যায় না। নায়েবগিন্নিও উঠে বসলো।

–খাস সিন্ধুকের চাবির গোছাটাই বোধ হয় ভুলে এসেছি। সেরেছে!

–আদৌ না, এসেই আমার হাতে দিয়েছে।

 –এই মরেছে! ধরা পড়েছে তা গোপন করতে নায়েব হাসলো। তা, উঠেই যখন পড়লাম, চাকরকে বলো তামাকু দিতে।

গিন্নি শয্যা থেকে নামতে গেলো। নায়েব বললো, আহা, এখনি নেবে যাচ্ছো কেন?

গিন্নি হেসে বললো, চাকর তোমার শোবার ঘরে কবে ঢুকলো যে তোমার শোবার ঘরের তামাকে হাত দেবে?

নায়েবগিন্নি নিজেই তামাক সেজে ডাবাসমেত নিয়ে এলো।

 নায়েব বললো, চলো, এবার তোমাকে কলকেতা দেখিয়ে আনি। ওদিকে কালীঘাট দক্ষিণেশ্বর দেখা হয়ে যাবে, এদিকে কলকেতা শহর, এস্তেক নবদ্বীপ। যেখানে যাও, প্রাণ ভরে ঢিপঢিপ।

গিন্নি বললো, সে শহরে নাকি গাছপালা অনেক কম, সব বাড়ি নাকি পাকা, রাস্তাঘাট সব সুরকির? রাস্তার মোড়ে মোড়ে নাকি আলো? আর

কী আর? কলকেতা বলছো?

–পথে পথে নাকি ইংরেজ-ঠাসা? এখেনে এক ডাংকাং-এ রক্ষে নেই

শহরটাই তো ইংরেজের। ওরাই পত্তন করেছে। সেখানে সবই ইংরেজি। ছোটো ছোটো বাঙালি ছেলে ফুট ফুট করে ইংরেজি বলে। বড়োদের তো কথাই নেই। স্বপ্নও নাকি ইংরেজিতে দ্যাখে। সেখানে টেবল ইংরেজি, চেয়ার ইংরেজি, মদ ইংরেজি। শিবঠাকুরও নাকি রবিবারে ইংরেজি মতে পুজো নেন।

রবিবার নিষ্ফলা না?

দ্যাখো কাণ্ড। সে কি ধূপধুনোর পূজো? আর্গিন বাজিয়ে গান। সবাই নাকি চোখ মুদে বসে থাকে আর একজন খুব বক্তৃতা দেয়? ; হু-হুঁ করে চোখের জল পড়ে।

-ছেলেছোকরারা যায়?

যায় না আবার। পেশকার বেজো বলে, আমি শুনি। মাগীরাও। হাতটাকা জামা কামিজ, পায়ে জুতোমুজো।

নায়েবগিন্নির গালটা লাল হলো। বললো, দ্যাখো, আমি শুনেছি, যেসব ইংরেজ এখেনে আসে তাদের নাকি বাপ নেই। মানে মা আছে কিন্তু, বুঝলে তো? কলকেতারও কি তাই?

–ছি-ছি! কী যে বলো? আজকাল ছেলেছোকরারা কি বাপ-মার কথা শোনে? কোনো দিনই কি শোনে? আমাদের গোবরাই ভাবলো আমাদের কথা?

দ্যাখো, তুমি আমার গোবরাকে, তুমি ওসব ছেলের সঙ্গে তুলনা দিও না। ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো নায়েবগিন্নি।

-পরের ছেলেরা ভুল করছে, আর তোমরা ছেলে বুঝি ঠিক করেছিলো? ডাবা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো : সেও ভুল করেছে, ভুলই। কলকেতার সব ভদ্রলোক সব শিক্ষিত লোক যার নিন্দে করছে, এস্তেক আমাদের দেওয়ানজি, তাই কিনা করতে গেলে তোমার ছেলে! দ্যাখো দেখি কত তফাত, যখন যে-বছর লখনউ, কানপুর, ঝাসিতে মারপিট, ঠিক সে-সময়ে সে বছর বিশ্ববিদ্যালয় বসলো কলকেতায়। কেন? ইংরেজি শিখতে নয়?

ভারি ঢং-এর কথা বোলো না গোবরার মামা। আমার ছেলে ভুল করে না। তুমি কী জানো? তুমি কী শুনেছো? খবরদার কাউকে বোলো না যেন; কিন্তু জানো আর-একজনও ছিলো সেই দলে, বলবো? রাজকুমার।

শেষ কথাটায় গলার স্বরটা অনেক নামিয়ে আনলো নায়েবগিন্নি। আঁচল তুলে চোখের কোণটা মুছলো।

-আহা-হা! বললো– নায়েব। কী লাভ? এসব খোঁজ নেওয়াই বা কেন আর এখন? ওরে তামুক দে, গেলো কোথা সব, হারামজাদাদের বাড় বেড়েছে দেখছি।

-রাগ কোরো না। শোবার ঘরে ওরা ঢোকে না। তামুক তো হাতেই।

নায়েব ভাবলো, সড়ক কাটার ব্যাপারটার সঙ্গে কী করে যেন গোবরা জড়িয়ে যায়। কিন্তু কথায় বলে নায়েব। হঠাৎ যেন খোলামেলা দেখতে পেলো। বলবে ভুল করে, কিংবা

পেত্রোর পাল্লায় পড়ে, যে করে হোক, ইংরেজ গোবরার শত্রু। তা থেকেই সেদিন ইংরেজদের উপরে রাগ হয়েছিলো। তা থেকে সড়ক কাটা। আশ্চর্য কথা দেখছি। কিন্তু এ কি উচিত তোমার রাগে মনিবকে মামলা-হামলায় জড়ানো?

গিন্নি বললো, তামুক খেয়ে কি এখনই কাছারিতে যাবে? তাহলে জলপান

-আমি বলি কী–এখন কিছুদিন দইয়ের শরবৎ দিও।

–এই শীতে দইপানা?

 –পিত্তটা বিশেষ কুপিত মনে হচ্ছে না? খামকো রাগ হয়ে যায়।

–তাহলে ওষুধ করতে হয়। বলো কী!

কী লাভ বলো? নায়েব হেসে উঠলো। তামাকের ধোঁয়াটাও গলায় লাগলো। হাসি ও কাশির মধ্যে বললো– তো, একবেলায় খোঁয়াড়সমেত সায়েবটাকে ছাই করা যায়। সবকটাকে, বন্দুকে ঠেকে না, গ্রামসমেতই যদি বলো। তাতে কিন্তু পিত্তই কুপিত হয়। রাস্তা কেটে কী বা হয় বুড়োবয়সে পিত্ত কুপিত হওয়া ছাড়া?

কাছারিতে ফিরে নায়েব ল-মোহরারকে ডাকলো। সে এলে বললো, একটা কথা ঠিক রেখো। মামলায় লম্বা লম্বা তারিখ নেবে। ঢিলে দিতে থাকো, উকিলকে টাকা ঢেলে দিক ডানকান। এদিকে শামসুদ্দিনকে ফিরিয়ে আনেনা, জমিতে চাষ দিক। না আসে, অন্য কাউকে বসাবে জমিতে। গ্রামে কি শামসুদ্দিনের অভাব পড়েছে? তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখো, খেলো খেলো এগোও। জেবন কেটে যাক ওই সড়কে। স্বত্বটা দেখে নিক।

গৌরী গেলে নায়েব হেসে তামাকেই মন দিলো আবার। তার নায়েবি মাথায় তখন খেয়াল–স্বত্বের কিন্তু দুই পক্ষ, এক স্বামীত্ব করে, অন্যে বলে তারই হক। ফিরিঙ্গি পেত্রোর ফরাসডাঙায় স্বামীত্বই বা কে করে? …ওদিকে দ্যাখো, গিন্নি যেমন বললো, রাজকুমার নাকি কী কাণ্ড!নায়েব তার ফরাস আর দেয়াল বরাবর সাজানো কুর্সির মাঝখানে ধোঁয়ায় ভরা ফাঁকটাকে দেখছিলো। ধোঁয়া, খালি পাক খাওয়া ধোঁয়া। আরে কাণ্ড! সে একেবারে স্তম্ভিত! দোলডগর, লোকলস্কর, খানাপিনায় চেপে গিয়েছে ব্যাপারটা। দখল বলে দখল? শোবার ঘরে বাঁশগাড়ি। হাওয়াঘরে শিব-গাড়া! রানীর বিচক্ষণতায় সে দিশেহারা হয়ে গেলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *