০৫. গীতগোবিন্দ : পঞ্চম সর্গ : সাকাঙ্ক্ষ পুণ্ডরীকাক্ষ

কহিলেন কৃষ্ণ, আমি আছি এইখানে,
শীঘ্র করি যাও দূতি রাধা, বিদ্যমানে।
কহ গিয়া তাঁরে মোর বিনয় বচন,
বিধি মতে সাধি হেথা কর আনয়ন।
শুনি সেই কথা সখী গিয়া রাধা ‍পাশে
বিনয়-বচনে তাঁরে এইরূপে ভাষে।

দশম সঙ্গীত

(কীর্ত্তন সুর। তাল একতালা।)

“ঘোষত মলয়-সমীর              কুসুম-শর-শাসন,
ফোটত কুসুম-নিকর            বিরহি-জন-দলন;
সখি, কাতর তব বিরহে বনমালী।
রজত হিমাংশু-ময়ূখ            বধত মুর-নাশন,
ঝরত কুসুম-সায়ক            মথয়ি মধু-মথন।
বাড়ত বিরহ বেদন,             নিশি নিশি নিপীড়ন,
গায়ত মধুকর গণ                 শ্রবণ করি দহন।
জপত হরি তব নাম,            ধরণি-তল-শায়ন,
ত্যজত সুললিত ধাম,         গহন-বিপিণ-ভবন।”
শ্রীজয়দেব-বিরচিত               হরি-বিরহ-বর্ণন
করুক সুরস-সিঞ্চিত           তৃষিত-সুজন-মন।

“তোমার সহিত যেন নিকুঞ্জ কাননে
সিদ্ধি লাভ হয়েছিল মদন-সাধনে,
পুনরপি হৃষিকেশ আসিয়া সে বনে
চিন্তিছেন আজি সদা তোমাকেই মনে।
জপিছেন তব কথা মন্ত্রের মতন,
কুচ আলিঙ্গন-সুধা ভুঞ্জিবারে মন।”

একাদশ সঙ্গীত।

(কীর্ত্তন সুর। তাল একতালা।)

বিলাসের সার                যেই অভিসার
আগুসার তায়                নাগর নিজে;
কর না বিলম্ব,              ও লো নিতম্বিনি,
অনুসর সেই                হৃদয় রাজে।
ধীর সমীরণে                যমুনা-পুলিনে
বসিয়া কেশব               কানন মাঝে;
গোপিনি-নিকর-        পীন-পয়োধর
সে চারু চিকণ             করেতে রাজে।
করি কত নাম              রসিক সে শ্যাম
অবিরাম, শুন               বাজায় বাঁশী;
অতি প্রিয় গণে            সেই রেণু-কণে
তোমারে পরশি             লাগে যা আসি।
রচিয়া শয়ন                  রাধিকা রমণ,
চৌদিকে চকিত            নয়নে চাহে;
পাখিটী উড়িলে            পাতাটী নড়িলে,
তব আগমন                 গণেন তাহে।

কেলি-প্রতিকূল              মুখর চঞ্চল
নূপুর তোমার                 ত্যজলো ধনি;
তমো-পুঞ্জ-ময়               কুঞ্জ-মাঝে চল
পরিয়া সুনীল                 নিচোল খানি।
হারে সুশোভন               মদন মোহন
শোভে, যেন ঘন            বলাকা সাজে;
তড়িতের সম                শোভিবে গো তুমি
সে শ্যাম-সুন্দর              হৃদয় মাঝে।
(পূরব জনম সুকৃতি ফলে)
(রতি বিপরীতে মাতিবে যবে)
খুলিয়া মেখলা,           হে কমল মুখি,
জঘন-দুকূল                শিথিল করি,
কিশলয়-দলে              করিয়া শয়ন
তোষ গো আপন        প্রাণেশ হরি।
(হরি, হৃদয়ের নিধি, হৃদয়ে পাবে)
অভিমানী হরি,           ও রাই কিশোরি,
দেখনা পোহায়ে          আসিছে নিশা;
রাখ মোর কথা,           চল ত্বরা করি,
পুরাও তাঁহার               প্রণয়-আশা।”
কবি জয়দেব               কেশবে সেবিয়া,
অতি রমণীয়                এ কথা ভনে;
সদয় হরির                  চরণে প্রণাম
কর হে সকল              ভকত গণে।

“কভূ ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস, কভু পথ চায়
কুঞ্জের বাহিরে গিয়া তোমার আশায়;
কভু বা পশিয়া কুঞ্জে না হেরি তোমায়
কতই বিলাপ করে অস্ফুট-ভাষায়,
কভু বা রচিয়া শয্যা চৌদিকে নেহারে,
মদন-পীড়ন বড় করিতেছে তাঁরে।

তব মান সহ দেখ ভানু অস্তে যায়,
প্রিয়-আশা-সম নিশা হল ঘোর তায়,
রথাঙ্গ-স্বনন-সম শুনি মোর বাণী
চল ত্বরা অভিসারে, শুভক্ষণ জানি।

ঘোর অন্ধকারে ভ্রমি দোঁহে দোঁহা তরে
কথায় চিনিবে যবে দোঁহে পরস্পরে,
নখাঘাত-আলিঙ্গন-অধর-চুম্বনে
বিলাস-রসেতে মত্ত হয়ে দুই জনে
কেলি-রঙ্গে মিটাইয়া প্রেম-পিপাশায়
পাবে যে শরম, মরি কত সুখ তায়।
চমকি চৌদিকে চাহি মন্থর-গমনে,
প্রতি বৃক্ষ তলে তিষ্ঠি বিশ্রাম-কারণে,
আঁধারে হরির পাশে গেলে, লো সুমুখি,
প্রেমাধার তোমা হেরি হবে কত সুখী।”

রাধিকার মুখ-পদ্মে অলি-সম যিনি,
ত্রিলোক-মুকুট-বৃন্দাবন-নীলমণি,
প্রদোষ-সমান যিনি গোপী সন্তোষণে,
হরেন ধরার ভার নাশি দৈত্য-গণে,
কংসের নিধনে ‍যিনি ধূমকেতু-প্রায়,
দেবকী-নন্দন সেই রক্ষুন তোমায়।

——————————-

মূল সংস্কৃত

অহমিহ নিবসামি যাহি রাধামনুনয় মদ্বচনেন চানয়েথাঃ |
ইতি মধুরিপুণা সখী নিযুক্তা স্বয়মিদমেত্য পুনর্জগাদ রাধাম্ ||১||

গীতম্

দেশবরাড়ীরাগরূপকতালাভ্যাং গীয়তে

বহতি মলয়সমীরে মদনমুপনিধায়
স্ফুটতি কুসুমনিকরে বিরহিহৃদয়দলনায় |
সখি হে সীদতি তব বিরহে বনমালী ||২||

দহতি শিশিরময়ূখে মরণমনুকরোতি
পততি মদনবিশিখে বিলপতি বিকলতরোহতি ||৩||

ধ্বনিত মধুপসমুহে শ্রবণমপিদধাতি |
মনসি বলিতবিরহে নিশি নিশি রুজমুপযাতি ||৪||

বসতি বিপিনবিতানে ত্যজতি ললিতধাম |
লুঠতি ধরণিশয়নে বহু বিলপতি তব নাম ||৫||

ভণতি কবিজয়দেবে হরিবিরহবিলসিতেন
মনসি রভসবিভবে হরিরুদয়তু সুকৃতেন ||৬||

পূর্ব্বং যত্র সমং ত্বয়া রতিপতেরাসাদিতাঃ সিদ্ধয়-
স্তস্মিন্নেব নিকুঞ্জমন্মথমহাতীর্থে পুনর্মাধবঃ |
ধ্যায়ংস্ত্বামনিশং জপন্নপি তবৈবালাপমন্ত্রাক্ষরং
ভুয়স্তত্কুচকুম্ভনির্ভরপরীরম্ভামৃতং বাঞ্ছতি ||৭||

গীতম্

দেশবরাড়ীরাগরূপকতালাভ্যাং গীয়তে

রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম্ |
ন কুরু নিতম্বিনি গমনবিলম্বনমনুসর তং হৃদয়েশম্ ||৮||

ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী |
পীনপয়োধরপরিসরমর্দ্দনচঞ্চলকরযুগশালী ||৯||

নামসমেতং কৃতসঙ্কেতং বাদয়তে মৃদু বেণুম্ |
বহু মনুতে ননু তে তনুসঙ্গতপবনচলিতমপি বেণুম্ ||১০||

পততি পতত্রে বিচলিত পত্রে শঙ্কিতভবদুপযানম্ |
রচয়তি শয়নং সচকিতনয়নং পশ্যতি তব পন্থানম্ ||১১||

মুখরমধীরং ত্যজ মঞ্জীরং রিপুমিব কেলিষু লোলম্ |
চল সখি কুঞ্জং সতিমিরপুঞ্জং শীলয় নীলনিচোলম্ ||১২||

উরসি মুরারেরুপহিতহারে ঘন ইব তরলবলাকে |
তড়িদিব পীতে রতিবিপরীতে রাজসি সুকৃতবিপাকে ||১৩||

বিগলিত বসনং পরিহৃতরসনং ঘটয় জঘনমপিধানম্ |
কিশলয়শয়নে পঙ্কজনয়নে নিধিমিব হর্ষনিধানম্ ||১৪||

হরিরভিমানা রজনিরিদানীমিয়মপি যাতি বিরামম্ |
কুরু মম বচনং সত্বররচনং পূরয় মধুরিপুকামম্ ||১৫||

শ্রীজয়দেবে কৃতহরিসেবে ভণতি পরমরমণীয়ম্ |
প্রমুদিতহৃদয়ং হরিমতিসদয়ং নমত সুকৃতকমনীয়ম্ ||১৬||

বিকরতি মুহুঃ শ্বাসানাশাঃ পুরো মুহুরীক্ষতে |
প্রবিশতি মুহুঃ কুঞ্জং গুঞ্জুন্মুহুর্বহু তাম্যতি |
রচয়তি মুহুঃ শয্যাং পর্যাকুলং মুহুরীক্ষতে
মদনকদনক্লান্তঃ কান্তে প্রিয়স্তব বর্ত্ততে ||১৭||

তদ্বাম্যেন সমং সমগ্রমধুনা তিগ্মাংশুরস্তং গতো
গোবিন্দস্য মনোরথেন চ সমং প্রাপ্তং তমং সান্দ্রতাম্ |
কোকানাং করুণস্বনেন সদৃশী দীর্ঘা মদভ্যর্থনা
তন্মুগ্ধে বিফলং বিলম্বনমসৌ রম্যোহভিসারক্ষণঃ ||১৮||

আশ্লেষাদনু চুম্বনাদনু নখোল্লেখাদনু স্বাস্তজ
প্রোদ্বোধাদনু সংভ্রমাদনু রতারম্ভাদনু প্রীতয়োঃ |
অন্যার্থং গতয়োর্ভ্রমান্মিলিতয়োঃ সম্ভাষণৈর্নতো-
র্দম্পত্যোরিহ ক ন কো ন তমসি ব্রীড়াবিমিশ্রো রসঃ ||১৯||

সভয়চকিতং বিন্যস্যন্তীং দৃশৌ তিমিরে পথি
প্রতিতরু মুহুঃ স্থিত্বা মন্দং পদানি বিতম্বতীম্ |
কথমপি রহঃ প্রাপ্তামঙ্গৈরমঙ্গতরঙ্গিভিঃ
সুমুখি সুভগঃ পশ্যন্ ত্বামুপৈতু কৃতার্থতাম্ ||২০||

রাধামুগ্ধমুখারবিন্দ-মধুপস্ত্রৈলোক্যমৌলিস্থলী-
নেপথ্যোচিত-নীলরত্নমবনী-ভারাবতারান্তকঃ |
স্বচ্ছন্দং ব্রজসুন্দরীজন-মনস্তোষ-প্রদোষশ্চিরং
কংসধ্বংসন-ধূমকেতুরবতু ত্বাং দেবকীনন্দনঃ ||২১||

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *