০৫. খাস কামরায় এসে

.

খাস কামরায় এসে ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন জ্ঞানেন্দ্রবাবু।

শরীর আজ অত্যন্ত অবসন্ন। কালকের রাত্রি জাগরণের ক্লান্তির ফলে সারা দেহখানা ভারী হয়ে রয়েছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। নিজের কপালে হাত বুলিয়ে চোখ বুজে শুয়ে রইলেন। তিনি।

আরদালি টেবিল পেতে দিয়ে গেল। মৃদু শব্দে চোখ বুজেই অনুমান করলেন তিনি। চোখ বুজেই বললেন–শুধু টোস্ট আর কফি। আর কিছু না।

সকালবেলা উঠে থেকেই এটা অনুভব করেছেন। সুরমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি; তিনিও লক্ষ্য করেছেন। বলেছিলেন, শরীরটা যে তোমার খারাপ হল!

তিনি স্বীকার করেন নি। বলেছিলেন–না। শরীর ঠিক আছে। তবে রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি কোথা যাবে? তার একটা ছাপ তো পড়বেই। সে তো তোমার মুখের ওপরেও পড়েছে। হেসেছিলেন তিনি।

—তা ছাড়া কালকের বিকেলের ওই আগুনটা–!

–ওঃ! এ স্নান করলেই ঠিক হয়ে যাবে।

বলেই তিনি ফাইল টেনে নিয়েছিলেন। এবং যা প্রত্যাশা করেছিলেন তাই ঘটেছিল; সুরমা একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে চলে গিয়েছিলেন। ফাইল খুলে বসার অর্থই হল তাই।

—প্লিজ সুরমা, এখন আমাকে কাজ করতে দাও।

সুমতি যেত না। কিন্তু সুরমা যান। এ-কর্তব্যের গুরুত্ব সুরমার চেয়ে কে বেশি বুঝবে? সুরমা বিচারকের কন্যা; বিচারকের স্ত্রী। এবং নিজেও শিক্ষিতা মেয়ে। সুমতিকে শেষ অবধি। বলতে হত—আমাকে কাজ করতে দাও! শেষ পর্যন্ত আমার চাকরি যাবে এমন করলে। সুমতি রাগ করে চলে যেত।

সুমতির প্রকৃতির কথা ভাববার জন্যেই তিনি ফাইল টেনে নিয়েছিলেন। নইলে ফাইল দেখবার জরুরি তাগিদ কিছু ছিল না। আসলে গত রাত্রির সেই চিন্তার স্রেত তার মস্তিষ্কের মধ্যে অবরুদ্ধ জলস্রোতের মত আবর্তিত হচ্ছিল। সত্যের পর সত্যের নব নব প্রকাশ নূতন জলস্রোতের মত এসে গতিবেগ সঞ্চারিত করছিল; কিন্তু সময়ের অভাবে সম্মুখপথে অগ্রসর হতে পারে নি। ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে তিনি শুয়ে পড়েছিলেন। ঘুমও হয় নি। স্বপ্নবিহ্বল একটা তার মধ্যে শুধু পড়ে ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য, স্বপ্নের মধ্যে সুমতি একবারও এসে সামনে দাঁড়ায় নি। সকালবেলায় কিন্তু ঘুম ভাঙতেই সর্বাগ্রে মনে ভেসে উঠেছে সুমতির মুখ। আশ্চর্য! অবচেতনে নয়, সচেতন মনের দুয়ার খুলে চৈতন্যের মধ্যে এসে দাঁড়াচ্ছে সে। সুমতিকে অবলম্বন করেই গতকালে অসমাপ্ত চিন্তাটা মনে জাগল। মনে পড়ে গিয়েছিল, লাইফ ফোর্সের, প্রাণশক্তির জীবন–সঙ্গীত শুনেছিলেন কাল ওই ঝরনার কলরোলের মধ্যে। সে ঝরঝর শব্দ এখনও তাঁর কানে বাজছে। সে এক বিন্দুই হোক আর বিপুল বিশালই হোক, আকাঙ্ক্ষা তার বিশ্বাসী। কিন্তু শক্তির পরিমাণ যেখানে যতটুকু, পাওনার পরিমাণ তার ততটুকুতেই নির্দিষ্ট, তার একটি কণা বেশি নয়। ব্ৰহ্মা-কমণ্ডলুর স্বল্প পরিমাণ, হয়ত একসের বা পাঁচপো জল, গোমুখী থেকে সমগ্র আর‍্যাবর্ত ভাসিয়ে বঙ্গোপসাগরে এসে মিশেছে তার বিষ্ণুচরণ থেকে উদ্ভব-মহিমার গুণেতে ও ভাগ্যে, সুমতির মুখে এই কথা শুনে তিনি হাসতেন। বলতেন, তা হয় না সুমতি, এক কমণ্ডলু জল ঢেলে দেখ না কতটা গড়ায়! সুমতি রাগ করত, তাঁকে বলত অধার্মিক, অবিশ্বাসী।

কথাটা প্রথম হয়েছিল দার্জিলিঙে বসে।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ সুমতিকে হিমালয়ের মাথার তুষার-প্রাচীর দেখিয়েও কথাটা বোঝাতে পারেন নি। অবুঝ শক্তির দাবি ঠিক সুমতির মতই বিশ্বগ্ৰাসী। সে-দাবি পূর্ণ হয় না। বেদনার মধ্যেই তার বিলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী, প্রকৃতির অমোঘ নির্দেশ জল আগুন বাতাস–এরা লড়াই করে নিজেকে শেষ করে স্থির হয়; কিন্তু জীবন চিৎকার করে কেঁদে মরে, জানোয়ার চিৎকার করে জানিয়ে যায়; মানুষ ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে, অভিশাপ দেয়। অবশ্য প্রকৃতির মৌলিক ধর্মকে পিছনে ফেলে মানুষ একটা নিজের ধর্ম আবিষ্কার করেছে। বিচিত্র তার ধর্ম, বিস্ময়কর। মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যেও তৃষ্ণার্ত মানুষ নিজের মুখের সামনে তুলে ধরা জলের পাত্র অন্য তৃষ্ণার্তের মুখে তুলে দিয়ে। বলে, দাই নিড ইজ গ্রেটার দ্যান মাইন। লক্ষ লক্ষ এমনি ঘটনা ঘটেছে। নিত্য ঘটছে, অহরহ। ঘটছে। কিন্তু এমহাসত্যকে কে অস্বীকার করবে যে, যে-মরণোনুখ তৃষ্ণার্ত নিজের মুখের জল অন্যকে দিয়েছিল, তার তৃষ্ণার যন্ত্রণার আর অবধি ছিল না। ওখানে প্রকৃতির ধর্ম অমোঘ। লঙ্ন। করা যায় না। মানুষের জীবনেও ওই তো দ্বন্দ্ব, ওই তো সংগ্রাম; ওইখানেই তো তার নিষ্ঠুর যন্ত্রণা। প্রকৃতি-ধর্মের দেওয়া শাস্তি! হঠাৎ জ্ঞানেন্দ্রবাবু চোখ খুলে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সামনের দিকে চাইলেন। তাকিয়েই রইলেন।

না। শুধু তো এইটুকুই নয়। আরও তো আছে। ওই তৃষ্ণার্ত মৃত্যুযন্ত্রণার সঙ্গে আরও তো কিছু আছে। যে মরণোনুখ তৃষ্ণার্ত তার মুখের জল অন্যকে দিয়ে মরে তার মুখের ক্ষীণ একটি প্রসন্ন হাস্যরেখা তিনি যেন ওই বিস্ফারিত দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছেন।

গত রাত্রে সদ্য-দেখা নদীর ব্যারাজটার কথা মনে পড়ে গেল। ব্যারাজটার ও-পাশে বিরাট রিজারভয়েরে জল জমে থইথই করছে। দেখে মনে হয় স্থির। কিন্তু কী প্রচণ্ড নিম্নাভিমুখী গতির বেগেই না সে ওই গাঁথুনিটাকে ঠেলছে ব্যারাজটার জমাট অণু-অণুতে তার চাপ গিয়ে পৌঁছেছে। সর্বাঙ্গে চাড় ধরেছে।

জীবন বাঙয়। তবু জীবনকে এচাড় এ-চাপ নিঃশব্দে সহ্য করতে হয়। চৌচির হয়ে ফাটতে চায়। তবু সে সহ্য করে।

 

খ.

আরদালি ট্রে এনে নামিয়ে দিলে।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ বললেন–কফি বানাও। ছুরি-কাটা সরিয়ে রেখে হাত দিয়েই টোস্ট তুলে নিলেন। আজ সকাল থেকেই প্রায় অনাহারে আছেন। ক্ষিদে ছিল না। রাত্রে ফিরে এসে খেতে সাড়ে বারটা বেজে গিয়েছিল। তারপরও ঘণ্টাখানেক জেগে বসেই ছিলেন। এই চিন্তার মধ্যেই মগ্ন ছিলেন। চিন্তা একবার জাগলে তার থেকে মুক্তি নেই। এ দেশের শাস্ত্ৰকারেরা বলেছেন, চিন্তা অনির্বাণ চিতার মত। সে দহন করে। উপমাটি চমৎকার। তবু তার খুব ভাল লাগে না। চিতা তিনি বলেন না। প্রাণই বহ্নি, বস্তুজগতের ঘটনাগুলি তার সমিধ, চিন্তা তার শিখা। চিন্তাই তো চৈতন্যকে প্রকাশ করে, চৈতন্য ওই শিখার দীপ্তিজ্যোতি। আপনাকে স্বপ্রকাশ করে, আপন প্রভায় বিশ্বরহস্যকে প্রকাশিত করে। যারা গুহায় বসে তপস্যা করেন, তাদের আহার সম্পর্কে উদাসীনতার মর্মটা উপলব্ধি করেন তিনি। রাত্রি জাগরণের ফলে শরীর কি খুব অসুস্থ হয়েছিল তার? না, তা হয় নি। অবশ্য খানিকটা অনুভব করেছিলেন, সমস্ত রাত্রি পাতলা ঘুমের মধ্যেও এই চিন্তা তার মনের মধ্যে ঘুরছে বিচিত্র দুর্বোধ্য স্বপ্নের আকারে। সকালবেলাতেই সে-চিন্তা ধূমায়িত অবস্থা থেকে আবার জ্বলে উঠেছে। তারই মধ্যে এত মগ্ন ছিলেন যে, খেতে ইচ্ছে হয় নি। টোস্ট খেতে ভাল লাগছে। টোস্ট তাঁর প্রিয় খাদ্য। আজ বলে নয়, সেই কলেজজীবন থেকে। প্রথম মুনসেফি জীবনে সকাল-বিকেল বাড়িতে টোস্টের ব্যবস্থা অনেক কষ্ট করেও করতে পারেন নি তিনি। সুমতি কিছুতেই পছন্দ করতে পারত না। সে চাইত লুচি-তরকারি; তরকারির মধ্যে আলুর দম। তাই তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সুরমা সুমতির এই রুচিবাতিকের নাম দিয়েছিল টোস্টোফোবিয়া। এই উপলক্ষ করেও সে সুমতিকে অনেক ক্ষেপিয়েছে। তাদের দুজনকে চায়ের নেমন্তন্ন করে তাকে দিত টোস্ট, ডিম, কেক, চা; সুমতিকে দিত নিমকি, কচুরি, মিষ্টি। সুমতি মনে মনে ক্রুদ্ধ হত কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারত না। অনেক সংস্কার ছিল সুমতির। জাতিধর্মে তার ছিল প্রচণ্ড বিশ্বাস। এবং সেই সূত্রেই তার ধারণা ছিল যে, খাদ্যে যার বিধর্মীয় রুচি, মনেপ্রাণেও সে বিধর্মের অনুরাগী। কতদিন সে বলেছে খেয়েই মানুষ বাঁচে, জন্মেই সবচেয়ে আগে খেতে চায়। সেই খাদ্য যদি এ-দেশের পছন্দ না হয়ে অন্য দেশের পছন্দ হয় তবে সে এ–দেশ ছেড়ে সে-দেশে যাবেই যাবে। এ ধর্মের খাদ্য পছন্দ না হয়ে অন্য ধর্মের। খাদ্য যার পছন্দ সে ধর্ম ছাড়বেই। আমি জানি নিজেদের কিছু তোমার পছন্দ নয়। ধর্ম না, খাদ্য না, আমি না। তাই আমি তোমার চোখের বিষ।

সুরমা এতটা অপমান করতে পারে নি। তিনিও তাকে বলেন নি। সুমতিকে নিয়ে এই জ্বালাতনের খেলা খেলবার জন্য মাঝে মাঝে স্যান্ডউইচ, কাটলেট, কেক, পুডিং তৈরি করে আরদালিকে দিয়ে পাঠিয়ে দিত। লিখত, নিজে হাতে করেছি, জামাইবাবু ভালবাসেন তাই পাঠালাম। স্যান্ডউইচে চিকেন আছে, কাটলেটের সরু হাড়ের টুকরো ভুল হবে না, কেক পুডিঙে মুরগির ডিম আছে। তোর আবার ছোঁয়ার্টুমির বাতিক আছে, ঘরে এক গোয়ালা ঠাকুরের ছবি আছে, তাই জানালাম।

আরদালি চলে গেলে সুমতির ক্ৰোধ ফেটে পড়ত।

ফেলে দিত। শুচিতার দোহাই দিয়ে স্নান করত।

সুরমা সব খবর সগ্ৰহ করত। এবং দেখা হলেই খিলখিল করে হাসত, বলত, কেমন? তিনি বাধ্য হয়ে হাসতেন। হাসতে হত। নইলে জীবন তার অসহ্য হয়ে উঠেছিল।

 

গ.

বেচারি সুরমা। এইসব নিয়ে তাঁর মনে একটা গোপন গ্লানি পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। মধ্যে মধ্যে অশরীরিণী সুমতি যখন তাঁদের দুজনের মধ্যে এসে দাঁড়ায় তখন ওঁর বিবৰ্ণ মুখ দেখে তিনি তা বুঝতে পারেন। সুমতির মৃত্যুর জন্য দায়ী কেউ নয়, সুরমার সঙ্গে স্পষ্ট কথা তার হয় না, কিন্তু ইঙ্গিতে হয়; বরাবর তিনি বলেছেন-কালও বলেছেন নিজেকে মিথ্যে পীড়ন কোরো না। আমি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে দেখেছি। তবু তার মনের গ্লানি মুছে যায় না, জ্ঞানেন্দ্রনাথ জানেন অন্তরে অন্তরে সুরমা নিজেকেই প্রশ্ন করে, কেন সে এগুলি করেছিল? কে তাকে কষ্ট দিয়ে খেলতে গিয়েছিল? হয়ত সুমতি এবং তার মধ্যে সে এসে এ কৌতুক খেলা না খেলতে গেলে সুমতির এই শোচনীয় পরিণাম হত না। আংশিকভাবে কথাটা সত্য। না। দায়িত্ব প্রথম সুমতির নিজের। সে নিজেই আগুন জ্বালিয়েছিল, সুরমা তাতে ফুঁ দিয়েছিল, ইন্ধন যুগিয়েছিল। ঈর্ষার আগুন। সেই আগুনই বাইরে জ্বলে উঠল। সত্যই, তার মনের আগুন ওই টেনিস ফাইন্যালের দিন তোলা ফটোগ্রাফখানায় ধরে বাইরে বাস্তবে জ্বলে উঠেছিল। টেনিস ফাইন্যাল জেতার পর তোলানো দুজনের ছবিখানা। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে অজ্ঞাতে হেসে ফেলেছিলেন। সুরমার কপিখানা সুরমার ঘরে টাঙানো আছে। ওই টেনিস ফাইনালের কদিন পর। দোকানি ফটোগ্রাফখানা যথারীতি মাউন্ট করে প্যাকেট বেঁধে তিনখানা তাঁর বাড়িতে আর তিনখানা জজসাহেবের কুঠিতে সুরমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তিনি নিজে তখন কোর্টে। তিনি এবং সুরমা দুজনের কেউই জানতেন না যে, ছবিতে তাঁরা পরস্পরের দিকে হাসিমুখে চেয়ে ফেলেছেন। চোখের দৃষ্টিতে গাঢ় অনুরাগের ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে। জানলে নিশ্চয় সাবধান হতেন। ফটোগ্রাফারকে বাড়িতে ফটো পাঠাতে বারণ করতেন; হয়ত ও ছবি বাড়িতে ঢোকাতেন। না কোনোদিন। জীবনের ভালবাসার দুর্দম বেগকে তিনি ওই নদীটার ব্যারাজের মত শক্ত বাধে বেঁধেছিলেন। যেদিকে তার প্রকৃতির নির্দেশে গতিপথ, সুরমার দুই বাহুর দুই তটের মধ্যবর্তিনী পথ, প্রশস্ত এবং নিম্ন সমতলভূমির প্রসন্নতায় যে-পথ প্রসন্ন, সে-পথে ছুটতে তাকে দেন নি। জীবনের সর্বাঙ্গে চাড় ধরেছিল, চৌচির হয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তবু সে-বন্ধনকে এতটুকু শিথিল তিনি করেন নি। নাথিং ইমমরাল নাথিং ইললিগাল! নীতির বিচারে, দেশাচার আইন সব কিছুর বিচারে তিনি নিরপরাধ নির্দোষ ছিলেন। কিন্তু সে কথা সুমতি বিশ্বাস করে নি। করতে সে চায় নি। তিনি বাড়ি ফিরতেই সুমতি ছবি কখানা তার প্রায় মুখের উপর ছুঁড়ে দিয়ে অগ্নারের পূর্বমুহূর্তের আগ্নেয়গিরির মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

ছবি কখানা সামনে ছড়িয়ে পড়ে ছিল। একখানা টেবিলের উপর, একখানা মেঝের উপর তার পায়ের কাছে, আর একখানাও মেঝের উপরই পড়ে ছিল—তবে যেন মুখ থুবড়ে, উল্টে।

ছবি কখানা দেখে তিনি চমকে উঠেছিলেন।

সুমতি নিষ্ঠুর কণ্ঠে বলে উঠেছিল, লজ্জা লাগছে তোমার? লজ্জা তোমার আছে? নির্লজ্জ, চরিত্রহীন–

মুহূর্তে আত্মসংবরণ করে তিনি ধীর গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন, সুমতি! তার মধ্যে তাকে সাবধান করে দেওয়ার ব্যঞ্জনা ছিল।

সুমতি তা গ্রাহ্য করে নি। সে সমান চিৎকারে বলে উঠেছিল, ছবিখানার দিকে তাকিয়ে ভাল করে দেখ, দেখ কোন পরিচয় তার মধ্যে লেখা আছে।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বন্ধুত্বের। আর ম্যাচ জেতার আনন্দের।

–কিসের?

–বন্ধুত্বের।

–বন্ধুত্বের? মেয়ের ছেলের বন্ধুত্ব? তার কী নাম?

–বন্ধুত্ব।

–না। ভালবাসা।

–বন্ধুত্বও ভালবাসা। সে বুঝবার সামর্থ্য তোমার নাই। তুমি সন্দেহে অন্ধ হয়ে গেছ। ইতরতার শেষ ধাপে তুমি নেমে গেছ।

—তুমি শেষ ধাপের পর যে পাপের পাক, সেই পাঁকে গলা পর্যন্ত ড়ুবে গেছ। তুমি চরিত্রহীন, তুমি ইতরের চেয়েও ইতর, অনন্ত নরকে তোমার স্থান হবে না।

বলেই সে ঘর থেকে চলে গিয়েছিল। কর্মক্লান্ত ক্ষুধার্ত তখন তিনি; কিন্তু বিশ্রাম আহার মুহূর্তে বিষ হয়ে উঠল—তিনিও বেরিয়ে চলে গিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। ভয়ও পেয়েছিলেন; সুমতিকে নয়, নিজের ক্রোধকে। উদ্যত ক্ৰোধ এবং ক্ষোভকে সংবরণ করবার সুযোগ পেয়ে তিনি যেন বেঁচে গিয়েছিলেন। উন্মত্তের মত মৃত্যু কামনা করেছিলেন নিজের। বৈধব্য-শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন সুমতিকে। বাইসিক্লে চেপে তিনি শহরের এক দূর-প্রান্তে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে পাথর-হয়ে-যাওয়া মানুষের মত বসে ছিলেন। প্রথম সে শুধু উন্মত্ত চিন্তা না, চিন্তা নয় কামনা, মৃত্যুকামনা, সংসারত্যাগের কামনা, সুমতির হাত থেকে অব্যাহতির কামনা। তারপর ধীরে ধীরে সে-চিন্তা স্থির হয়ে এসেছিল—দাউদাউ-করে-জ্বালা গ্রহের জ্যোতিৰ্মান হয়ে ওঠার মত। সেই জ্যোতিতে আলোকিত করে অন্তর তন্নত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খুঁজে দেখেছিলেন। বিশ্লেষণ করেছিলেন, বিচার করে দেখেছিলেন। পান নি কিছু। নাথিং ইম্মর‍্যাল, নাথিং ইললিগাল। কোনো দুর্নীতি না, কোনো পাপ না। বন্ধুত্ব। গাঢ়তম বন্ধুত্ব। সুরমা তাঁর অন্তরঙ্গতম বন্ধু, সেকথা তিনি স্বীকার করেন। আরও ভাল করে দেখেছিলেন। না, তার থেকেও কিছু বেশি। সুরমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও আছে। আছে। পরমুহূর্তে আরও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছিলেন। না! পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নয়। পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নাই,না পাওয়ার জন্য অন্তরে ফন্ধুর মত বেদনার একটি ধারা বয়ে যাচ্ছে শুধু। এবং সে-ধারা বন্যার প্রবাহে দুই কূল ভেঙেচুরে দেবার জন্য উদ্যত নয়; নিঃশব্দে জীবনের গভীরে অশ্রুর উৎস হয়ে শুধু আবর্তিতই হচ্ছে। আজীবন হবে।

চিন্তার দীপ্তিকে প্রসারিত করছিলেন ন্যায় এবং নীতির বিধান-লেখা অক্ষয় শিলালিপির উপর। অবিচলিত ধৈর্যের সঙ্গে জীবনের শ্ৰেষ্ঠ বুদ্ধি প্ৰয়োগ করে প্রায় ধ্যানযোগের মধ্যে সেলিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন। কোনো সমাজ, কোনো রাষ্ট্র, কোনো ধর্মের ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন নি; কোনো ব্যাকরণের কোনো বিশেষ পদার্থ গ্রহণ করেন নি; এবং পাঠ শেষ করে নিঃসংশয় হয়ে তবে তিনি সেদিন সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে। দেশলাই জ্বেলে ঘড়ি দেখে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন। এতটা রাত্রি! জানুয়ারির প্রথম সময়টা, রাত্রি পৌঁনে দশটা! আপিস থেকে বেরিয়েছিলেন পাঁচটায়। বাড়ি থেকে বোধহয় ছটায় বেরিয়ে এসেছেন। পৌঁনে দশটা। প্রায় চার ঘণ্টা শুধু ভেবেছেন। সিগারেট পর্যন্ত খান নি। তখন তিনি প্রচুর সিগারেট খেতেন। সুমতির তাতেও আপত্তি ছিল।

 

ঘ.

শান্ত চিত্তে তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন; ক্রোধ অসহিষ্ণুতা সমস্ত কিছুকেই কঠিন সংযমে সংযত করেছিলেন। সুমতি উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল। বাইসিক্ল তুলে রাখবার জন্য আরদালিকে ডেকে পান নি। চাকরটাও ছিল না। ঠাকুর! ঠাকুরেরও সাড়া পান নি। ভেবেছিলেন, সকলেই বোধহয় তাঁর সন্ধানে বেরিয়েছে। মনটা চি চি করে উঠেছিল। কাল লোকে বলবে কী। সন্ধান যেখানে করতে যাবে সেখানে সকলেই চকিত হয়ে উঠবে। তবুও কোনো কথা বলেন নি। নিঃশব্দে পোশাক ছেড়ে, মুখহাত ধুয়ে, ফিরে এসে শোবার ঘরে একখানা চেয়ারে বসেছিলেন। প্রয়োজন হলে ওই চেয়ারেই সমস্ত রাত্রি কাটিয়ে দেবেন। সুমতি ঠিক একভাবেই শুয়ে ছিল, অনড় হয়ে। শেষ পর্যন্ত তিনি বলেছিলেন, আমাকে খুঁজতে তো এদের সকলকে পাঠাবার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

এবার সুমতি উত্তর দিয়েছিলেন, খুঁজতে কেউ যায় নি। কারণ তুমি কোথায় গেছ, সে-কথা অনুমান করতে কারুর তো কষ্ট হয় না। ওদের আজ আমি ছুটি দিয়েছি! বাজারে যাত্রা হচ্ছে, ওরা যাত্রা শুনতে গেছে। তারপরই উঠে সে বসেছিল। বলেছিল—আমি ইচ্ছে করেই ছুটি দিয়েছি, তোমার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে।

চোখ দুটো সুমতির লাল হয়ে উঠেছে। দীর্ঘক্ষণ অবিশ্রান্ত কেঁদেছিল। মমতায় তাঁর অন্তরটা টনটন করে উঠেছিল। তিনি অকৃত্রিম গাঢ় স্নেহের আবেগেই বলেছিলেন, তুমি অত্যন্ত ছেলেমানুষ সুমতি। একটা কথা তুমি কেন বুঝছ না–

–আমি সব বুঝি। তোমার মত পণ্ডিত আমি নই। সেই অধার্মিক বাপমায়ের আদুরে মেয়ের মত লেখাপড়ার ঢঙও আমি জানি না, কিন্তু সব আমি বুঝি।

ধীর কণ্ঠেই জ্ঞানেন্দ্রবাবু বলেছিলেন, না। বোঝ না।

–বুঝি না? তুমি সুরমাকে ভালবাস না?

–বাসি। বন্ধু বন্ধুকে যেমন ভালবাসে তেমনি ভালবাসি।

–বন্ধু, বন্ধু, বন্ধু! মিথ্যে মিথ্যে মিথ্যে! বল, ঈশ্বরের শপথ করে বল, ওর সঙ্গ তোমার যত ভাল লাগে, আমার সঙ্গ তোমার তেমনি ভাল লাগে?

–এর উত্তরে একটা কথাই বলি, একটু ধীরভাবে বুঝে দেখ–তোমার আমার সঙ্গ জীবনে জীবনে, অঙ্গে অঙ্গে, শত বন্ধনে জড়িয়ে আছে। তোমার বা আমার একজনের মৃত্যুতেও সে-বন্ধনের গ্রন্থি খুলবে না। আমি কাছে থাকি দূরে থাকি একান্তভাবে তোমার–

সুমতি চিৎকার করে উঠেছিলনা, মিথ্যা কথা।

—না মিথ্যা নয়। মনকে প্ৰসন্ন কর সুমতি, ওই প্রসন্নতাই জীবনের শ্রেষ্ঠ মিষ্টতা। ওর অভাবে অন্ন যে অন্ন তাও তিক্ত হয়ে যায়। তুমি যদি সত্যই আমাকে ভালবাস তবে কেন তোমার এমন হবে? তোমার সঙ্গেই তো আমার এক ঘরে বাস, এক আশা, এক সঞ্চয়! সুরমা তো অতিথি। সে আসে, দু দণ্ড থাকে, চলে যায়। তার সঙ্গে মেলামেশা তো অবসরসাপেক্ষ। খেলার মাঠে, আলোচনার আসরে তার সঙ্গে আমার সঙ্গ।

মিনতি করে বলেছিলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ, কিন্তু সুমতি তীব্র কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল, তাই তো বলছি। আমার সঙ্গে, আমার বন্ধনে তুমি কাটার শয্যায় শুয়ে থাক, সাপের পাকে জড়িয়ে থাক অহরহ! অল্পক্ষণের জন্য ওর সঙ্গেই তোমার যত আনন্দ, যত অমৃতস্পৰ্শ।

একটি ক্ষীণ করুণ হাস্যরেখা প্রৌঢ় জ্ঞানেন্দ্রনাথের মুখে ফুটে উঠল। আনন্দ এবং অমৃতস্পর্শ শব্দ দুটি তার নিজের, সুমতি দুটি গ্রাম্য অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করেছিল। তিনি তখন ক্ষুধার্ত, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের ক্রিয়া তাঁর চৈতন্যকে জেলখানার বেত্ৰদণ্ডপাওয়া আসামির মত নিষ্করুণ আঘাত হেনে চলেছে। বেত্ৰাঘাত-জর্জর কয়েদিরা কয়েক ঘা বেত খাওয়ার পরই ভেঙে পড়ে। তার চৈতন্যও তাই পড়েছিল; প্রাণপণে নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা করেও তিনি পারেন। নি। অথবা কাচের ফানুস ফাটিয়ে দপ-করে-জ্বলে-ওঠা লন্ঠনের শিখার মত অগ্নিকাণ্ডে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজেকে। আর সংযমের কাচের আবরণে অন্তরকে ঢেকে নিজেকে আর স্নিগ্ধ এবং নিরাপদ করে প্রকাশ করতে পারেন নি। ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ অন্তর আগুনের লকলকে বিশ্বগ্ৰাসী শিখার মত আত্মপ্রকাশ করেছিল। তিনি বলেছিলেন,তুমি যে কথা দুটো বললে, ও উচ্চারণ করতে আমার জিভে বাধে। ওর বদলে আমি বলছি আনন্দ আর অমৃতস্পৰ্শ। হ্যাঁ, সুরমার সংস্পর্শে তা আমি পাই। সত্যকে অস্বীকার আমি করব না। কিন্তু কেন পাই, তুমি বলতে পার? আর তুমি কেন তা দিতে পার না?

—তুমি ভ্ৰষ্টচরিত্র বলে পারি না। আর ভ্ৰষ্টচরিত্র বলেই তুমি ওর কাছে আনন্দ পাও! মাতালরা যেমন মদকে সুধা বলে।

–আমি যদি মাতালই হই সুমতি, মদকেই যদি আমার সুধা বলে মনে হয়, তবে আমাকে ঘৃণা কর, আমাকে মুক্তি দাও।

নিষ্ঠুর শ্লেষের সঙ্গে সুমতি মুহূর্তে জবাব দিয়েছিল সাপের ছোবলের মত—ভারি মজা হয়। তা হলে, না?

বিচলিত হয়েছিলেন তিনি সে-দংশনের জ্বালায়, কিন্তু বিষে তিনি ঢলে পড়েন নি। কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে আবার তিনি ধীরকণ্ঠে বলেছিলেন—শোন সুমতি। আমার ধৈর্যের বধ তুমি ভেঙে দিচ্ছ। তার উপর আমি ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত। তোমাকে আমার শেষ কথা বলে দি। তোমার সঙ্গে আমার জীবন জড়িয়ে গেছে সামাজিক বিধানে। সে-বিধান অনুসারে তুমি আমি এ-বন্ধন ছিন্ন করতে পারি না। তুমি স্ত্রী, আমি স্বামী। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তোমার ভরণপোষণ করব, তোমাকে রক্ষা করব, আমার উপাৰ্জন আমার সম্পদ তোমাকে দোব। আমার গৃহে তুমি হবে গৃহিণী। আমার দেহ তোমার। সংসারে যা বস্তু, যা বাস্তব, যা হাতে তুলে দেওয়া যায়, তা আমি তোমাকেই দিতে প্রতিশ্রুত, আমি তোমাকে তা দিয়েছি, তা আমি চিরকালই দোব। একবিন্দু। প্রতারণা করি নি। কোনো অনাচার করি নি।

—কর নি?

–না।

–ভালবাস না তুমি সুরমাকে? এতবড় মিথ্যা তুমি শপথ করে বলতে পার?

–তোমার অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে কাউকে ভালবাসা অনাচার নয়।

–নয়?

নানা-না। তার আগে তোমাকে জিজ্ঞাসা করব, তুমি বলতে পার, ভালবাসার আকার কেমন? তাকে হাতে ছোঁয়া যায়? তাকে কি হাতে তুলে দেওয়া যায়? দিতে পার? তোমার অকপট ভালবাসা আমার হাতে তুলে দিতে পার?

এবার বিস্মিত হয়েছিল সুমতি। একমুহূর্তে উত্তর দিতে পারে নি। মুহূর্ত কয়েক স্তব্ধ থেকে বলেছিল—হেঁয়ালি করে আসল কথাটাকে চাপা দিতে চাও। কিন্তু তা দিতে দেব না।

—হেঁয়ালি নয়। হেঁয়ালি আমি করছি না। সুমতি, ভালবাসা দেওয়ার নয়, নেওয়ার বস্তু। কেউ কাউকে ভালবেসে পাগল হওয়ার কথা শোনা যায়, দেখা যায়, সেখানে আসল মহিমা যে ভালবাসে তার নয়; যাকে ভালবাসে মহিমা তার। মানুষ আগে ভালবাসে মহিমাকে তারপর সেই মানুষকে। কোথাও মহিমা রূপের, কোথাও কোনো গুণের। সুরমার মহিমা আছে, সে হয়ত তুমি দেখতে পাও না, আমি পাই, তাই আমি তাকে প্রকৃতির নিয়মে ভালবেসেছি।

—লজ্জা করছে না তোমার? মুখে বাঁধছে না? চিৎকার করে উঠেছিল সুমতি।

–না। সবল দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন তিনি, কাঁপে নি সে কণ্ঠস্বর। চোখ তার সুমতির চোখ থেকে একেবারে সরে যায় নি। মাটির দিকে নিবদ্ধ হয় নি। সুমতিই যেন বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মুহূর্ত পরে সে বিভ্রান্তি কাটাতে পেরেছিল। বিভ্রান্তি কাটিয়ে হঠাৎ সে চিৎকার করে বলে উঠেছিল—মুখ তোমার খসে যাবে। ও-কথা বোলো না।

—লক্ষবার বলব সুমতি। চিৎকার করে সর্বসমক্ষে বলব। মুখ আমার খসে যাবে না! আমি নির্দোষ, আমি নিস্পাপ।

—নিষ্পাপ? নিষ্ঠুরভাবে হেসে উঠেছিল সুমতি। তারপর বলেছিল-ধৰ্ম দেবে তার সাক্ষি!

–ধর্ম? হেসে উঠেছিলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ ধর্মকে তুমি জান না, ধর্মের দোহাই তুমি দিয়ে না। তোমার অবিশ্বাসের ধর্ম শুধু তোমার। আমার ধৰ্ম মানুষের ধর্ম, জীবনের ধর্ম। সে তুমি বুঝবে না। না বোঝ, শুধু এইটুকু জেনে রাখতোমাকে বিবাহের সময় যে যে শপথ করে আমি গ্রহণ করেছি তার সবগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে আমি পালন করেছি। করছি। যতদিন বাঁচব করবই।

–কর্তব্য। কিন্তু মন?

—সে তো বলেছি, সে কাউকে দিলাম বলে নিজে দেওয়া যায় না। যার নেবার শক্তি আছে, সে নেয়। ওখানে মানুষের বিধান খাটে না। ও প্রকৃতির বিধান। যতটুকু তোমার ও-বস্তু নেবার শক্তি, তার এককণা বেশি পাবে না। তবে হ্যাঁ, এটুকু মানুষ পারে, মনের ঘরের হাহাকারকে লোহার দরজা এটে বন্ধ রাখতে পারে। তা রেখেও সে হাসতে পারে, কর্তব্য করতে পারে, বাঁচতে পারে। তাই করব আমি। আমাকে তুমি খোঁচা মেরে মেরে ক্ষতবিক্ষত কোরো না।

সুমতি এ কথার আর উত্তর খুঁজে পায় নি। অকস্মাৎ পাগলের মত উঠে টেবিলের উপর রাখা ফাইলগুলি ঠেলে সরিয়ে, কতক নিচে ফেলে তছনছ করে দিয়েছিল। তিনি তার হাত চেপে ধরে বলেছিলেন–কী হচ্ছে?

—কোথায় ফটো?

–ফটো কী হবে?

—পোড়াব আমি।

–না।

–না নয়। নিশ্চয় পোড়া আমি।

–না।

–দেবে না?

–না। ও ফটো আমি ঘরে রাখব না, কিন্তু পোড়াতে আমি দেব না।

সুমতি মাথা কুটতে শুরু করেছিল—দেবে না? দেবে না?

জ্ঞানেন্দ্রবাবু ড্রয়ার থেকে ফটো ক-খানা বের করে ফেলে দিয়েছিলেন। শুধু ফটো কখানাই নয়, চুলের-গুচ্ছ-পোরা খামটাও। রাগে আত্মহারা সুমতি সেটা খুলে দেখে নি। গোছাসমেত নিয়ে গিয়ে উনোনে পুরে দিয়েছিল।

তাঁরও আর সহ্যের শক্তি ছিল না। আহারে প্রবৃত্তি ছিল না। শুধু চেয়েছিলেন সবকিছু ভুলে। যেতে। তিনি আলমারি খুলে বের করেছিলেন ব্রান্ডির বোতল। তখন তিনি খেতে ধরেছেন। নিয়মিত, খানিকটা পরিশ্রম লাঘবের জন্য। সেদিন অনিয়মিত পান করে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিলেন।

সুমতির অন্তরের আগুন তখন বাইরে জ্বলেছে। সে তখন উন্মত্ত। শুধু ওই ক-খানা ফটো উনোনে খুঁজেই সে ক্ষান্ত হয় নি, আরও কয়েকখানা বাঁধানো ছবি ছিল সুরমার, তার একখানা সুরমার কাছে সুমতি নিজেই চেয়ে নিয়েছিল আর কখানা সুরমা আত্মীয়তা করে দিয়েছিল, সে ক-খানাকেও পেড়ে আছড়ে কাচ ভেঙে ছবিগুলোকে আগুনে খুঁজে দিয়েছিল আর তার সঙ্গে খুঁজে দিয়েছিল সুরমার চিঠিগুলো। ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বলে তবে এসে সে শুয়েছিল। ঘণ্টা দুয়েক পর ওই আগুনই লেগেছিল চালে। সুমতির অন্তরের আগুন। প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। বনস্পতি শাখায় শাখায় পত্রে পল্লবে ফুলে ফলে যে তেজশক্তি করে সৃষ্টিসমারোহ, সেই তেজই পরস্পরের সংঘর্ষের পথ দিয়ে আগুন হয়ে বের হয়ে প্রথম লাগে শুকনো পাতায়, তারপর জ্বালায় বনস্পতিকে; তার সঙ্গে সারা বনকে ধ্বংস করে। অঙ্গার আর ভস্মে হয় তার শেষ পরিণতি।

জ্ঞানেন্দ্রবাবু দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। পুড়ে ছাই হয়েও সুমতি নিষ্কৃতি দেয় নি।

 

বাইরে ঢং ঢং শব্দে দুটোর ঘণ্টা বাজল। কফির কাপটা তাঁর হাতেই ছিল। নামিয়ে রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন। নামিয়ে রাখলেন এতক্ষণে।

আরদালি এসে এজলাসে যাবার দরজার পরদা তুলে ধরে দাঁড়াল। জুরী উকিল আগেই এসে বসেছেন আপন আপন আসনে। আদালতের বাইরে তখন সাক্ষীর ডাক শুরু হয়েছে।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ এসে নিজের আসন গ্রহণ করলেন। হাতে পেনসিলটি তুলে নিলেন। দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলেন খোলা দরজা দিয়ে সামনের কম্পাউণ্ডের মধ্যে। মন ড়ুবে গেল গভীর থেকে গভীরে। সেখানে সুমতি নেই, সুরমা নেই, বিশ্বসংসারই বোধ করি নেই—আছে শুধু একটা প্রশ্ন, ওই আসামি যে প্রশ্ন করেছে। সাধারণ দায়রা বিচারে এ-প্রশ্ন এমনভাবে এসে দাঁড়ায়। না। সেখানে প্রশ্ন থাকে আসামি সম্পর্কে। আসামির দিকে তাকালেন তিনি। চমকে উঠলেন। জ্ঞানেন্দ্রনাথ। আসামির পিছনে কী ওটা? কে?—না! কেউ নয়, ওটা ছায়া, স্কাইলাইটের ভিতর দিয়ে ঈষৎ তির্যকভাবে আকাশের আলো এসে পড়েছে আসামির উপর। একটা ছায়া পড়েছে ওর পিছনের দিকে। ঠিক যেন কে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথম সাক্ষী এসে দাঁড়াল কাঠগড়ার মধ্যে। তদন্তকারী পুলিশ কর্মচারী। হলপ নিয়ে সে বলে গেল—খগেনের মৃত্যু সংবাদ প্রথম পাওয়ার কথা, থানার পাতায় লিপিবদ্ধ করার কথা। আসামি নগেনই সংবাদ এনেছিল। জ্ঞানেন্দ্রবাবু আবার তাকালেন আসামির দিকে। আসামির। পিছনের ছায়াটা দীর্ঘতর হয়ে পূর্বদিকের দেওয়ালের গায়ে গিয়ে পড়েছে। বর্ষা-দিনের অপরাহ্নের আলো এবার পশ্চিম দিকের জানালাটা দিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়েছে। দারোগার সাক্ষি শেষ হল।

ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দে চারটে বাজল। জ্ঞানেন্দ্রনাথ বললেন– কাল জেরা হবে। উঠলেন তিনি। আঃ! তবু যেন আচ্ছন্নতা কাটছে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *