রাত নিঝুম - ১
রাত নিঝুম - ২

০৫. কবুলতি

কবুলতি

দ্বিপ্রহরে শশাঙ্ক চৌধুরী সাধারণতঃ তাঁর প্রাইভেট রুমে বসে স্টেটের যাবতীয় কাজকর্ম দেখাশুনা করেন। সে সময়টা সাধারণতঃ বড় একটা কারো সঙ্গে তিনি দেখাশুনা করেন না।

একান্ত প্রয়োজনীয় হলে অবিশ্যি আলাদা কথা।

করালীর মৃত্যুর দিন চারেক পরে। সে দিনও দুপুরে যখন তিনি প্ৰাইভেট রুমে বসে কাগজপত্র দেখাশুনা, করছিলেন, এমন সময় চাকর মধু এসে জানােল একজন পুলিশের লোক কি একটা বিশেষ জরুরী কাজে তীর সঙ্গে দেখা করতে চান, এখুনি।

শশাঙ্কমোহন বললেন, তাকে আমার বসবার ঘরে বসাগে যা, আমি আসছি। অশোক পাশেই একটা চেয়ারে বসে শশাঙ্কমোহনকে কি আবশ্যকীয় কাগজপত্ৰ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, শশাঙ্কমোহন ওর দিকে তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা কর অশোক। দেখে আসি পুলিশ আবার কেন এলো এ সময়—

 

একজন ছাব্বিশ সাতাশ বৎসর বয়সী যুবক-ব্যাক ব্ৰাস করা মাথার চুল, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। সরু বাটার ফ্লাই গোঁফ।

চোখে কালো কাঁচের চশমা। সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবী পরা। ড্রয়িং রুমে একটা সোফার উপর ঠেস দিয়ে বসে সেদিনকার খবরের কাগজটা পড়ছিল। শশাঙ্কমোহনের জুতোর আওয়াজ পেয়ে কাগজটা নামিয়ে মুখ তুলে তাকাল।

আপনি?

আমারই নাম শশাঙ্ক চৌধুরী।

নমস্কার, আমি সি, আই, ডি থেকে আসছি, কারালীচরণের হত্যার ব্যাপারে কয়েকটা কথা আমাদের জানা দরকার–

বলুন, কি কথা?

আপনি বসুন। দেখুন, বলছিলাম কি, কথাটা একটু গোপনীয়, এ ঘর…

আচ্ছা আসুন, আমার অফিস রুমে চলুন।

শশাঙ্কমোহনের পিছু পিছু আগন্তুক ভদ্রলোক দোতলায় নিজের অফিস ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরে প্রবেশ করে শশাঙ্কমোহন অশোককে ইঙ্গিতে ঘর ছেড়ে যেতে বললেন। অশোক ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।

ঘরটাকে সত্যিই নির্জন বলা যেতে পারে।

ঘরটা আকারে মাঝারি রকমের হবে।

ঘরের একটি মাত্র দরজা।

ঘরের নীচেই বাগান। সেই দিকে গোটা দুই জানালা। জানালায় সবুজ পর্দা ঝোলান।

ঘরের মধ্যে একটা গোল টেবিল। টেবিলের এক পাশে ফোন। গোটা দুই চেয়ার ও গোটা চারেক আলমারী। প্রত্যেকটি আলমারী ঠাসা ইংরাজী বাংলা সব বই। ইঙ্গিতে একটা চেয়ারে বসতে বলে, নিজে অন্য চেয়ারটা অধিকার করে শশাঙ্কমোহন বললেন, এইবার বলুন আপনার কি জিজ্ঞাস্য।

ভদ্রলোক শশাঙ্কমোহনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, বুঝতেই পারছেন আপনাদের পুরানো ভৃত্য করালীচরণের হত্যার ব্যাপারে এখানে আমি এসেছি। তাই চৌধুরী বাড়ির পুরাতন ইতিহাস আমার কিছু জানা দরকার। তারপর একটু থেমে বললেন, আচ্ছ একথা কি সত্যি যে আজ থেকে ষোল বছর আগে আপনার পিতা অনঙ্গ চৌধুরী মশাই মারা যাওয়ার পর তার উইলে জানা যায় আপনার কোন পুত্ৰ সন্তান না হলে সম্পত্তির অর্ধেক মাত্র আপনি পাবেন এবং বাকী অর্ধেক আপনার খুল্লতাত ভাই মৃগাঙ্কবাবু পাবেন?

কোথা থেকে জানলেন কথাটা। বিস্ময়ে যেন হতবাক শশাঙ্কমোহন।

জেনেছি।–সত্যি কিনা বলুন।

সত্যি-কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি একান্ত গোপনীয়, ঐ ব্যাপারটা যা একমাত্র আমি ছাড়া কেউ জানে না, সে কথাটা আপনি কোথা থেকে কেমন করে জানলেন।

ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন। আমরা যে অনেক কিছুই জানতে পারি— জানতে আমাদের হয়, নচেৎ এই খুন-জখম ইত্যাদির রহস্যকে উদঘাটন করবো কি করে।

অতঃপর শশাঙ্কমোহনকে মনে হলো যেন বেশ একটু চিন্তিত।

যাক সে কথা, আচ্ছা। আপনি বলছেন কথাটা কেউ জানে না-মৃগাঙ্কবাবুও কি জানেন না?

জানো না বলেই তো এতকাল ধারণা ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে—

কি-বলুন?

না, কিছু না।

মিঃ চৌধুরী—

বলুন।

আপনার পিতার মৃত্যুর দু-বছর পরে আপনার সন্তান হয়, তাই না?

হ্যাঁ–

আর সে সন্তান কি সত্যিই একটি মেয়েই হয়েছিল?

হ্যাঁ–শ্ৰীলেখা আমার মেয়ে–

কিন্তু, আমি যদি বলি–

কি?

ঐ শ্ৰীলেখা আপনার সন্তান আদৌ নয়—

মানে! চমকে শশাঙ্কমোহন আগন্তুকের মুখের দিকে তাকান।

তার মানে মেয়ে নয়, আসলে হয়েছিল আপনার একটি পুত্ৰ সন্তান এবং জন্ম মুহুর্তে সে অপহৃত হয়েছিল এবং আজো সে বেঁচে আছে বলেই আপনি জানেন।

শশাঙ্কমোহন সত্যিই একেবারে স্তম্ভিত-নির্বাক! আজি দীর্ঘ ষোল বছর। ধরে যে কথা কেউ জানে না-সেই কথাটা কি করে ঐ ভদ্রলোক জানতে পারলেন।

ধীরে ধীরে এক সময় আবার ভদ্রলোক মুখ তুললেন। বললেন, বুঝতে পারছি আমরা যা জেনেছি তা মিথ্যা নয়, সত্যি–

না, মিথ্যা নয়-সত্যি–সব সত্যি–

ভদ্রলোক আবার বললেন, হয়ত এ ভালই হলো মিঃ চৌধুরী-আপনার যে পুত্ৰ সন্তান হয়েছিল এবং যে পুত্র সন্তানকে কেউ না কেউ চক্রান্ত করে তার জন্মের পর তার মায়ের বুক থেকে তঁর অজ্ঞাতে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এবং আজও যখন সে জীবিত তাকে হয়ত আবার আমরা খুঁজে বের করতে পারব।–কিন্তু আমি ভাবছি, একটা কথা। আপনি যদি জানতেনই ব্যাপারটা তো-পুলিশের সাহায্য নেন নি কেন-কেন এতদিন চুপ করে মুখ বুঁজে আছেন–

তারা-তারা আমায় ভয় দেখিয়েছিল—

ভয়!

হ্যাঁ–বলেছিল যদি তাকে খোঁজ করবার কোন রকম চেষ্টা করি তো—তারা তাকে হত্যা করবে। তাই-তাই পারিনি-পাছে তাকে জন্মের মত হারাতে হয় বলে-বলতে বলতে শশাঙ্ক মোহন যেন কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

আচ্ছ মিঃ চৌধুরী-আপনার স্ত্রী-আপনার স্ত্রী জানেন কথাটা?

না।

জানেন না তাহলে তিনি?

না।

ঠিক আছে। এবারে আমি আজকের মত উঠবো শশাঙ্কবাবু–

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *