০৫. আলেফ মোক্তার

আপনি এদিকে আসুন।

সিরাজের কণ্ঠস্বর। থমথমে। বিলকিস বিস্ফারিত চোখে একবার সিরাজ, একবার আলেফ মোক্তারের দিকে তাকায়। তারপর, সিরাজকে অনুসরণ করে ঘরের ভেতরে ঢোকে।

আপনি বসুন।

নিজেই অবাক হয়ে যায়, বিলকিস অত্যন্ত শান্তভাবে খাটের কোণে গিয়ে বসে। সিরাজ একটুক্ষণ সমুখে দাঁড়িয়ে থেকে পাশে বসে তার। আলমারির নকশায় একটা উজ্জ্বল ছোট্ট আলোর বিন্দুর দিকে তাকিয়ে সে বলে, আপনার ভাই খোকা মারা গেছে। এতক্ষণ আপনাকে বলি নি। ভেবেছিলাম, বলব না।

কথাটা বলেই সিরাজ একহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।

বিলকিসের কান্না পায় না। তার মনে হয়, একটা জানা খবরই দ্বিতীয়বার কেউ তাকে শুনিয়ে গেল।

সিরাজের পিঠে হাত রাখে সে।

তখন আরো ফুঁপিয়ে ওঠে সিরাজ। এই ক মাসের প্রতিটি মৃত্যু একের পর এক তরঙ্গের মতো তার দিকে ধেয়ে আসে।

শান্ত কণ্ঠে বিলকিস। উচ্চারণ করে, খোকা নেই?

নিজেকে সামলে নেয় সিরাজ। সামলাতে একটু সময় লাগে। সেটুকু অপেক্ষা করে বিলকিস।

তারপর জিগ্যেস করে, কী হয়েছিল?

অনেকগুলো ছেলে। বাজারে দাঁড় করায়। এক সঙ্গে গুলি করেছিল।

খোকা ছিল?

হাঁ।

তুমি কখন জানলে?

তখন খোঁজ নিতে বেরুলাম। মোক্তার সাহেবের কাছে শুনলাম।

খোকার নাম করে বললেন?

না, বললেন, অনেকে ছিল, মফিজ, নান্টু, এরফান, চুনি মার্চেন্টের ছোট শালা, তারপর বললেন কাদের মাস্টারের ছেলে। বাজার করতে এসেছিল কিছু লোক, মারা গেছে, কয়েকজন দোকানদার, কয়েকটা বাচ্চা ছেলেও আছে।

দুপুরবেলায়?

কখন ঠিক জানি না।

কিছুক্ষণ শূন্যতার ভেতরে নিক্ষিপ্ত থেকে বিলকিস জিগ্যেস করে, উনি দেখতে পান না। কেউ তাকে বলেছে গুলির কথা। কে বলেছে?

প্রশ্ন করে সিরাজের কাছে উত্তর আশা না করে সে উঠে দাঁড়ায়।

কোথায় যাচ্ছেন?

ওর কাছে শুনতে চাই।

আর কী শুনবেন? বিহারীরা বিকেলবেলায় ওকে কোমরে দড়ি পরিয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। বাজারে। সেখানে ওরাই ওকে বলে ছেলেদের নাম।

ঠিক তখন দরোজার কাছে এসে দাঁড়ান আলেফ মোক্তার। হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে ভেতরে এগিয়ে আসেন। তিনি। বিলকিস উঠে তার হাত ধরে। বিছানায় নিয়ে আসে।

আলেফ মোক্তার কাতর একটা আহি ধ্বনি করে নীরব হয়ে যান। তাকে কিছু জিগ্যেস করবার মতো নিষ্ঠুর হতে পারে না বিলকিস।

অনেকক্ষণ পরে আলেফ মোক্তার বলেন, এত বড় পাষাণ, মানুষের অন্তঃকরণ নেই, হুকুম দিয়েছে, লাশ যেখানে আছে সেখানে থাকবে। কেউ হাত দিতে পারবে না। কচি ছেলেগুলোকে কাক শকুনে ছিঁড়ে খাবে, দাফন হবে না।

কে হুকুম দিয়েছে?

মিলিটারি। মিলিটারি ছাড়া হুকুম দেবার আছে কে?

তাদের মরতে হবে না কোনোদিন? তাদের মাটি দেবার দরকার হবে না কোনোদিন? ছেলেদের প্রাণ নিয়েছিস, মায়ের কোল খালি করেছিস, মায়ের মতো মাটি, তার কোলে রাখতে দিবি না। এজিদের দল? যেখানকার লাশ সেখানে থাকবে? মাটি সর্বত্র, মুখের দল। মাটি তাদের নিজের বুকে টেনে নেবে। আল্লাহর ফেরেশতা দাফন করবে। ফেরেশতার কাছে তোর হুকুম টিকবে না।

খসখসে গলায় বিলাপ করে চলেন আলেফ মোক্তার।

তার সে বিলাপ সহ্য করা যায় না। কিন্তু চুপ করতে বলবে, মনে হয় বাতাস হাহাকার করছে, অন্ধকার বিলাপ করে চলেছে। মানুষের সাধ্য নেই তা থামিয়ে দেয়।

এক সময়ে নিজেই তিনি চুপ করে যান। কেবল শোঁ শোঁ করে কষ্টকর শ্বাস নেবার শব্দ ওঠে।

সিরাজ।

আপা।

বারান্দায় এসো।

বাইরে এসে জিজ্ঞাসু চোখে সিরাজ বিলকিসের দিকে তাকায়। সিরাজ, তুমি বলছিলে না, মিলিটারি রাতে বেরোয় না?

কেন?

আমি যাব। বাজারে যাব। খোকার লাশ না দেখলে বিশ্বাস হবে না, খোকাকে আমি দেখব। তাকে আমি নিজের হাতে মাটি দেব।

কুথাটা শুনে চঞ্চল হয়ে পড়ে সিরাজ।

তুমি যাবে আমার সঙ্গে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *