প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৪. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সমাধান

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সমাধান

তাহলে, লোকায়তিকদের সঙ্গে কাপালিকদের সম্পর্ক নিয়ে একটা সমস্যা উঠছে। অবশ্যই, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসের সাধারণ বইতে এ-সমস্যার স্বীকৃতি নেই। কিন্তু মহামহোপাধ্যায় সাধারণ লেখক নন। তাই তাঁর চোখে এই সমস্যাটি ধরা পড়েছে এবং তিনি এর একটা সমাধান দেবারও চেষ্টা করেছেন।

কী রকম সমাধান?

কাপালিক মানে ঠিক কী,—এ-প্রশ্ন নিয়ে খুব বেশি আলোচনা না তুলেও মোটের উপর বার্হস্পত্যসূত্রম্‌ অনুসরণ করেই তিনি ধরে নিচ্ছেন কাপালিক বলতে কামসাধকই বোঝায়। বলাই বাহুল্য, এ-কথায় খু বেশি তর্কের অবকাশ নেই। কেননা, কাপালিকেরা যে একরকমের বামাচারী তান্ত্রিক তা সকলেই স্বীকার করবেন। এবং বামাচারী মানেই হলো কামাচারী। কেননা, বাম কথাটির রকমারি অর্থ সম্ভব বলেও অন্তত এই প্রসঙ্গে বাম মানে ‘কাম’—বাঁ-হাত বা বাঁ-দিকের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। প্রমাণ, আনন্দগিরির শঙ্কর-বিজয়(১৭)। বামাচারীদের বর্ণনায় তিনি বলছেন ‘বামবাহুল্যাৎ’, এবং এই বামবাহুল্যের যে-বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তা কামবাহুল্য ছাড়া আর কিছুই নয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বামাচাঈ বা কামাচারীর অর্থ কি? কাম শব্দটিকে আধুনিক কালে যে-অর্থে গ্রহণ করা হয় বামাচার প্রসঙ্গেও কি সেই অর্থটুকুই পর্যাপ্ত হবে?

এই কাম শব্দটিকে আজকাল আমরা যে-অর্থে বুঝি মহামহোপাধ্যায় কাপালিক-প্রসঙ্গেও সেই অর্থেই বুঝতে চান।

আজকালকার দিনে কাম নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন আমরা তাঁদের বলি কামবিজ্ঞানী বা কামশাস্ত্রজ্ঞ। বাৎসায়নের রচনা এই কর্থেই কামশাস্ত্র। কিন্তু ওই কাপালিক সম্প্রদায় বাৎসায়নের চেয়ে অনেক কালের পুরোনো। মহামহোপাধ্যায় তাই সিদ্ধান্ত করছেন, কাপালিকরাই হলো প্রাচীন ভারতে কামবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা।

কিন্তু তাহলে লোকায়তিকদের সঙ্গে কাপালিকদের সম্পর্কটা কী রকম? মহামহোপাধ্যায় আবার বার্হস্পত্যসূত্রম্‌-এর সাক্ষ্যই উদ্ধৃত করছেন : এ-বইতেই বলা হয়েছে লোকায়তিকদের মতে বার্ত্তাই একমাত্র বিদ্যা। বার্ত্তা মানে? কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে(১৮) কথাটার সংজ্ঞা পাওয়া যায় : কৃষি পশুপাল্যে বানিজ্যা চ বার্ত্তা। অর্থাৎ, বার্ত্তা বলতে বোঝায় কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য। অবশ্যই, এখানে বাণিজ্য মানে ঠিক কী তা নিয়ে তর্ক উঠতে পারে, কেননা, কৌটিল্য ছিলেন চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের লেখক এবং তখনকার কালে বাণিজ্য বলতে অন্তত আজকাল যা বোঝায় তা বোঝাতো কিনা খুবই সন্দেহের কথা। তাছাড়া, গণ বা সঙ্ঘের আলোচনা প্রসঙ্গে পরে দেখতে পাবো বার্ত্তা শব্দের প্রধানতম অর্থ শুধু কৃষিই। সে যাই হোক, মহামহোপাধ্যায় বলছেন, লোকায়তিকেরা যদি কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্যকেই একমাত্র বিজ্ঞান মনে করে থাকেন তাহলে মানতেই হবে এরাই ভারতবর্ষের আদি ‘ইকনোমিস্ট’ বা অর্থনীতি-বিজ্ঞানী।

এই হলো মহামহোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত : “লোকায়তিকেরা যেমন তাঁদের বস্তুবাদী দর্শনের সাহায্যে অর্থনীতি-বিজ্ঞানের সূত্রপাত করেছিলেন, তেমনই কাপালিকেরা,—কী ধরনের দর্শনের সাহায্যে তা অবশ্য জানা নেই,—ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন কাম-বিজ্ঞানের।”

…as the Lokayata; and that as the Lokayatas, with their Materialistic Philosophy, marked the beginning of the science of Economics, so the Kapalikas, with what system of philosophy we do not know, marked the beginning of the science of Erotics.(১৯)’

কিন্তু এই উক্তিকেই তাঁর চরম সিদ্ধান্ত হিসাবে স্বীকার করতে হলে একের পর এক সমস্যা উঠবে। প্রথমত, কামশাস্ত্রপ্রণেতা স্বয়ং বাৎসায়ন(২০) লোকায়তিকদের তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করেছেন; তাই লোকায়তিকদের সঙ্গে কাপালিকদের সম্পর্ক যদি সত্যিই গভীর হয় তাহলে কাপালিকদের আর যাই বলা যাক কামশাস্ত্রের আদি-গুরু বলা নেহাতই অসংগত হবে। আদিগুরুকে গালমন্দ করার দৃষ্টান্ত ভারতীয় ঐতিহ্যে চোখে পড়ে না। কিন্তু এ-ছাড়াও মহামহোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আরো মৌলিক সমালোচনা ওঠে। তিনি শুরু করলেন এই বলে যে প্রাচীন-পুঁথিপত্রে লেখা রয়েছে লোকায়ত ও কাপালিক আলাদা নয়, কিন্তু সিদ্ধান্ত যখন করছেন তখন বলছেন একটি সম্প্রদায় হলো অর্থনীতি-বিজ্ঞানের প্রবর্তক এবং দ্বিতীয় সম্প্রদায় হলো যৌনবিজ্ঞানের প্রবর্তক। এই দুটি কথাকে যদি এক করতে হয়ে তাহলে মানতেই হবে অর্থনীতির আলোচ্য—অর্থাৎ ধন-উৎপাদন—এবং কামবিজ্ঞানের আলোচ্য—অর্থাৎ মৈথুন ও প্রজনন—অন্তত প্রাচীন যুগের চেতনা অনুসারে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে যুক্ত ছিলো। আমাদের আধুনিক ধ্যান-ধারণা অনুসারে কথাটা নিশ্চয় হাস্যকর শোনাবে : ধন-উৎপাদনের সঙ্গে সন্তান-উৎপাদনের সম্পর্ক আবার কী? কিন্তু যে-পুঁথিপত্র নিয়ে আলোচনা তা একালের নয়, সেকালের। এবং সেকালের ধারণা যে হুবহু একালের মতোই হবে তা ভাববার কারণ নেই। বরং প্রাচীনেরা যখন বার্ত্তা-বাদী লোকায়তিকদের সঙ্গে কামাচারী কাপালিকদের এক করতে চাইছেন তখন আধুনিক গবেষকের কাছে নিশ্চয়ই প্রধান প্রশ্ন এই হবে যে একালের ধ্যানধারণাটা যতো পৃথকই হোক না কেন, মানবজাতির ক্রমোন্নতি-পথে সত্যিই কি এমন কোনো স্তরের কথা জানা আছে যখন মানুষের ধারণায় ধন-উৎপাদনের সঙ্গে মিথুনের ও সন্তান-উৎপাদনের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক ছিলো? যদি তা জানা থাকে তাহলে নিশ্চয়ই দ্বিতীয় প্রশ্ন হবে : কাপালিকদের সঙ্গে বা লোকায়তিকদের সঙ্গে মানব-ইতিহাসের সে-রকম কোনো স্তরের যোগাযোগ আছে কি না?

মহামহোপাধ্যায়ের কাছে কিন্তু এ-জাতীয় কোনো প্রশ্ন ওঠবার অবকাশ ছিলো না। তার কারণ তিনি ধরেই নিয়েছেন, কাম বা মৈথুনকে আজকের দিনে আমরা যে-চোখে দেখি প্রাচীনেরাও ঠিক সেই চোখেই দেখতেন এবং আজকের দিনে আমরা যৌন-আচরণের উদ্দেশ্য বলতে যা বুঝি প্রাচীনেরাও ঠিক তাই বুঝতেন। ফলে কামবিষয়ে অত্যধিক উৎসাহ হয় লাম্পট্য, না হয়তো নিছক ভোগাসক্তি,—খুব বেশি সমীহ করে বললে বড়ো জোর বলা যায় কামবিজ্ঞানের ভিত্তি-স্থাপনা। বস্তুত, কাপালিকদের সম্বন্ধে—তথা, সমস্ত রকম বামাচারী সম্প্রদায় সম্বন্ধেই,—আধুনিক কালে যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ তার মূলে প্রধানতই হলো এদের কামবাহুল্য।

আর ঠিক ওই কথাটাই ভুল। কেননা, প্রাচীনেরা কাম ও মৈথুনকে যে-চোখে দেখেছেন, এই ক্রিয়ার যে-উদ্দেশ্য কল্পনা করেছেন, তার সঙ্গে আমাদের আজকালকার ধ্যানধারণার মিল হয় না। তার কারণ খুব সহজ : প্রাচীনেরা ছিলেন প্রাচীন, আধুনিক নন। তাই আধুনিক ধ্যানধারণাও তাঁদের মধ্যে থাকবার কথা নয়।

ভারতবর্ষের প্রাচীন পুঁথিপত্রেই এ-কথার রাশি রাশি প্রমাণ আছে। যেহেতু পরের যুগে আস্তিকেরা, অর্থাৎ বেদপন্থীরা, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ বেদনিন্দুকদের বিরুদ্ধে, বিদ্বেষ প্রচার করবার জন্যে এই কামবাহুল্যের নজিরটাকেই অতো বড়ো করে দেখিয়েছিলেন সেইহেতুই এখানে এ-বিষয়ে বৈদিক সাহিত্যের সাক্ষ্যটুকুই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হবে। বলাই বাহুল্য, বৈদিক সাহিত্যে ভালো কি মন্দ, সুনীতিপরায়ন কি দুর্নীতিপরায়ণ—এই জাতীয় প্রশ্ন তোলা আমাদের যুক্তির পক্ষে অবান্তর। আমরা শুধু এইটুকুই দেখাতে চাই, যৌনব্যবহার সম্বন্ধে আধুনিক কালের ধারণা দিয়ে প্রাচীন কালের ধারণাকে বোঝবার কোনো উপায় নেই, এবং এ-বিষয়ে প্রাচীনকালের ধ্যানধারণাগুলির চিহ্ন শুধুই যে বেদনিন্দুক ও বৈদিক-ঐতিহ্য-নিন্দিত সম্প্রদায়গুলির মধ্যে টিকে আছে তাই নয়, এমনকি বৈদিকসাহিত্যের মধ্যেই তার অজস্র নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। বস্তুত, বামাচারের প্রকৃত তাৎপর্য বোঝবার পক্ষে বৈদিক সাহিত্যের এই নিদর্শনগুলির গুরুত্বই যেন বেশি : বেদ-ব্রাহ্মণ-উপনিষদে যে-কথা লেখা আছে তারই সাহায্যে কাপালিকাদির মধ্যে প্রচলিত ব্যবহারের অলিখিত তাৎপর্য অনুমান করা সম্ভব হতে পারে।

———————
১৭. আনন্দগিরি : শঙ্করবিজয় ।। সপ্তদশ প্রকরণ, পৃ. ১১৫।।
১৮. অর্থশাস্ত্র (রাধাগোবিন্দ বসাক) ১:৮।
১৯. H. P. Shastri op. cit. 6.