০৪. মুহম্মদ-রসূলুল্লাহ (সঃ)

মুহম্মদ-রসূলুল্লাহ (সঃ)

তখন মক্কার অন্তর্গত কাবা ছিল বহু রকম দেব-দেবীর মন্দির এবং মক্কা ছিল তীর্থের এক মস্ত কেন্দ্র। কোরায়েশ কওম এই কাবার রক্ষক ও সেবায়েত ছিল। অভিজাত কওম হিসেবে কোরায়েশের ইজ্জতের অন্ত ছিল না। ৫৭১ খৃষ্টাব্দ বা তার কাছাকাছি সময়ে এই কোরায়েশ কওমে একটি শিশুর জন্ম হয়।

সূতিকাগৃহেই তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল মুহম্মদ–স্পষ্টতঃই সম্মান-বাচক উপাধি। কোরআনে তার নাম দেখতে পাই মুহম্মদ (সঃ) এবং একবার আহমদ। এ নামের মানে বিশেষ প্রশংসিত। দুনিয়ায় এ নামে যত শিশু-পুত্র আছে, অন্য কোন নামে তেমন নাই। তাঁর কওম তাঁর নাম দিয়েছিল আল-আমিন (বিশ্বস্ত)। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তার বয়স যখন ছয় বছর সেই সময় তাঁর মাতাও ইন্তিকাল করেন।

বিশ্ব-নবীদের মধ্যে একমাত্র হযরত মুহম্মদ (সঃ) ইতিহাসের পূর্ণ আলোকের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন। পঁচিশ বছর বয়সে ধনবতী ও উচ্চমনা বিধবা খাদীজার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। খাদীজা বয়সে তার চেয়ে পনর বছর বড় ছিলেন। এই সময় হতেই হযরত মুহম্মদ (সঃ) ইতিহাসের স্পষ্ট মঞ্চে এসে হাজির হলেন। খাদীজা কোরায়েশ খান্দানের মূনী ছিলেন। তিনি এক ধনী সওদাগরের বিধবা পত্নী ছিলেন এবং স্বাধীনভাবে তার কারবার পরিচালনা করে আসছিলেন। যুবক হযরত মুহম্মদকে (সঃ) তিনি তাঁর কাজে নিযুক্ত করেন। যতদিন পর্যন্ত এই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ম য়সী নারী জীবিত ছিলেন, ততদিন হযরত মুহম্মদ (সঃ) অন্য বিয়ের কথা চিন্তা করেন নাই।

হযরত মুহম্মদ (সঃ) এখন ফুরসত পেলেন এবং নিজ আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্রতী হলেন। অনেক সময় দেখা যেত, তিনি নিরালায় চিন্তা করছেন অথবা মক্কার বাইরের একটি পাহাড়ের গুহায় ধ্যানমগ্ন আছেন। একদা এইরূপ ধ্যানস্থ অবস্থায় যখন তার চিত্ত সংশয় ও সত্যের আকুল সন্ধানে উদ্বেলিত ছিল সেই সময় তিনি শুনলেন, কে তাকে আদেশ করছে?

সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নামে আবৃত্তি কর (কোরআন ৯৬ : ১)। মহানবী তার আহ্বান পেয়েছেন। কিছুদিন চলে গেল। তিনি তাঁর দ্বিতীয় আহ্বান পেলেন। বিপুল আবেগ ভারে পীড়িত হয়ে তিনি সভয়ে সত্বর গৃহে চলে গেলেন এবং তার স্ত্রীকে বল্লেন-‘আমাকে ঢেকে দাও আমাকে ঢেকে দাও।’ তখন অবতীর্ণ হল এই ওহীঃ ‘হে বস্ত্রাবৃত পুরুষ! ওঠ এবং হুঁশিয়ার কর’ (কোরআন ৭৪১)। আহ্বানের আওয়াজ একরকম ছিল না, কখনো ঘণ্টা-ধ্বনির মত কানে আসত। পরে সমস্ত আওয়াজ এক কণ্ঠস্বরে পরিণত হল : জিবরাইলের কণ্ঠস্বর।

আরবী হযরত মুহম্মদের (সঃ) বাণী আর ওল টেস্টামেন্টের হিব্রু পয়গম্বরদের বাণী একইরকম ছিল : আল্লাহু এক। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি বিশ্বের স্রষ্টা। বিচারের দিন আছে। যারা আল্লাহর আদেশ পালন করে তাদের জন্য বেহেস্তে বেশুমার পুরস্কার–যারা সে আদেশ লঙ্ঘন করে তাদের জন্য দোজখে ভয়াবহ শাস্তি। তাঁর প্রথম দিকের বাণীর এই-ই সংক্ষিপ্তসার। হযরত মুহম্মদ (সঃ) মনে করলেন, তিনি এক পবিত্র ব্রত সাধনে আদিষ্ট হয়েছেন। তিনি অনুভব করলেন, আল্লাহ্র পয়গম্বর হিসেবে তাকে এ মহান ব্রত উদযাপন করতে হবে। অপার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি তার আপন লোকদের কাছে গিয়ে তাঁর নতুন বাণী প্রচার শুরু করলেন। তারা তাকে বিদ্রুপের হাসিতে উড়িয়ে দিল । তিনি তাদের সাবধান করতে লাগলেন : বিচার দিনের কথা বলতে লাগলেন, বেহেস্তের সুখের এবং দোজখের দুঃখের জ্বলন্ত রোমাঞ্চকর বর্ণনা দ্বারা তাদের মন জয় করতে চেষ্টা করতে লাগলেন; এমন কি আন্ন গজবের ভয়ও দেখাতে শুরু করলেন। তাঁর বর্ণিত প্রাথমিক ওহীগুলি সংক্ষিপ্ত, সুন্দর এবং হৃদয়গ্রাহী ছিল। কিন্তু অতিঅল্প লোকই তার ধর্মমত গ্রহণ করতে এল। তার স্ত্রী খাদীজা, তার চাচাতো ভাই আলী এবং তার জ্ঞাতি আবুবকর তার মতে দীক্ষা নিলেন। কিন্তু কোরায়েশদের আভিজাত্য-অভিমানী প্রভাবশালী শাখা অটল রয়ে গেল। তবে আস্তে আস্তে প্রধানতঃ গোলাম এবং নিম্ন শ্রেণীর মধ্য হতে লোক এসে বিশ্বাসীদের দল ভারী করতে লাগল। কোরায়েশরা দেখল, এতকাল তারা যে ঠাট্টা-বিদ্রুপের বাণ বর্ষণ করেছে, তা কার্যকরী হয় নাই। কাজেই দস্তুরমত যুলুম করার প্রয়োজন উপস্থিত হয়েছে। এই অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে মক্কার এগারটি নব দীক্ষিত পরিবার আবিসিনীয়ায় হিযরত করতে বাধ্য হল। ৬১৫ খৃস্টাব্দে আরো তিরিশজন তাদের পথ অনুসরণ করল। আবিসিনীয়ার খৃস্টান রাজা নাজ্জাসী মুহাজিরদের তাঁর পক্ষপুট-তলে আশ্রয় দিলেন। কোরায়েশ অত্যাচারীরা তাদের হাতে মুহাজিরদের ফেরত দেওয়ার জন্য নাজ্জাসীকে অনুরোধ করে পাঠাল। কিন্তু নাজ্জাসী তার আশ্রিতদের দুশমনের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করলেন। এতগুলি অনুগামীকে হারিয়েও হযরত মুহম্মদ (সঃ) বিচলিত হলেন না। তিনি নির্ভীকভাবে প্রচার করে চলেন এবং বুঝিয়ে সুঝিয়ে বহু দেবতার পূজা হতে তাদের নিবৃত্ত করে এক আল্লাহ্র এবাদতে প্রবৃত্ত করতে চেষ্টা করতে লাগলেন। ওহী অবতীর্ণ হতে লাগল।

অল্পকাল মধ্যেই ওমর-ইবনুল-খাত্তাব এসে ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করলেন। পরবর্তীকালে ইনি ইসলামী রাষ্ট্র গঠনে কি বিপুল দানই না করেছিলেন। এই সময়ের মধ্যেই ঘটে এক রোমাঞ্চকর নৈশ-ভ্রমণ। কথিত আছে? হ্যরত মুহম্মদ (সঃ) চোখের পলকে গেলেন বায়তুল মোকাদ্দেস এবং সেখান হতে তিনি গেলেন সপ্তম আসমানে। বায়তুল মোকাদ্দেস (জেরুমালেম) আগে হতেই ইহুদী ও খৃষ্টানদের নিকট পবিত্র স্থান ছিল। যেহেতু এই নৈশ-ভ্রমণ কালে এস্থান হতে মহানবী আসমানে গমন করেন, এই জন্য মুসলমানদের চোখে মক্কা-মদীনার পরই আজো বায়তুল মোকাদ্দেস সবচেয়ে পবিত্র স্থান। এই অলৌকিক ভ্রমণ কাহিনীতে পরবর্তীকালে অনেক নতুন কথা যোগ করা হয়েছে এবং এই পরিবর্ধিত আকারে ইহা আজো পারস্য ও তুরস্কের মরমী-মহলে সমাদৃত হয়ে আসছে। একজন স্পেনীয় পণ্ডিত বলেন, এই কাহিনীই দান্তের ‘ডিভাইন কমেডী’র মূল উৎস। ফিলিস্তিনে ১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়, তা থেকেই বোঝা যায় যে, ইসলামে এ ভ্রমণের স্মৃতি আজো কত জীবন্ত ও শক্তিশালী। ইহুদীদের ক্রন্দনমান দেয়াল’-কে কেন্দ্র করে এই দাঙ্গা বেঁধে ওঠে। কেউ কেউ মেনে করে, যে বোরাকে সওয়ার হয়ে মহানবী উক্ত নৈশ-ভ্রমণ করেন, সে অপরূপ ঘোড়া এইখানে কিছুকাল অবস্থান করেছিল।

এই অলৌকিক ভ্রমণের দুইবছর পর প্রায় পঁচাত্তরজন লোকের একটি প্রতিনিধি দল হযরত মুহম্মদকে (সঃ) মদীনায় গিয়ে বাস করতে দাওয়াত করে। মদীনার ইহুদীরা একজন মসিহ্’-এর জন্য প্রতীক্ষা করছিল এবং তাদের প্রতিমা-পূজক প্রতিবেশীদের মনকে অমন একজন ধর্ম প্রচারকের আবির্ভাবের জন্য তৈরি করে রেখেছিল। মদীনা ছিল হযরত মুহম্মদের (সঃ) মায়ের শহর। তিনি তাঁর দুইশ’ অনুগামীকে কোরায়েশদের নজর এড়িয়ে চুপচাপ মদীনায় চলে যেতে অনুমতি দিলেন। তিনি নিজে সেখানে ৬২২ খৃস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর গিয়ে হাজির হলেন। এই-ই ছিল বিখ্যাত হিযরত । হিযরত পুরোপুরি পলায়ন ছিল না। এ ছিল দুই বছরের সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফল। যে চান্দ্র বছরে এই হিযরত ঘটে সতর বছর পরে খলীফা ওমরের নির্দেশমত সেই বছর হতে মুসলমানদের সরকারী অব্দ গণা শুরু হয়।

এই হিযরত হতেই হযরত মুহম্মদ (সঃ) মক্কার জীবনের অবসান এবং মদীনার জীবনের আরম্ভ। আর এখানেই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। অবজ্ঞাত পয়গম্বর হিসেবে তাঁর মাতৃভূমি ত্যাগ করে সম্মানিত নেতা হিসেবে তিনি তাঁর নব আবাস-নগরে প্রবেশ করেন। তার ভিতরের দ্রষ্টা জীবনের পার্শ্বে জেগে ওঠে–আর জেগে ওঠে তার সাথে জ্ঞান গরীয়ান এক কর্মী পুরুষ।

এই সময় একটি গ্রীষ্মকালীন সওদাগরী কাফেলা সিরিয়া হতে মক্কায় ফিরে আসছিল। মদীনার উপকণ্ঠে মুসলমানদের দ্বারা এই কাফেলা আক্রান্ত হওয়ার গুজব রটে। মক্কা ছিল তাদের বাণিজ্যিক রাজধানী। সুতরাং এই আক্রমণ সে রাজধানীর বাণিজ্যিক জীবনের মর্মমূলে নিদারুণ আঘাত হানে। কাফেলার সর্দার এ আক্রমণ-অভিসন্ধির কথা আগেই জানতে পেরে মক্কার সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিল। ফলে যে যুদ্ধ হয়, তাতে তিনশ’ মুসলমান তাদের পয়গম্বরের অনুপ্রেরণাময় নেতৃত্বে এক হাজার মক্কাবাসীকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে। সামরিক ব্যাপার হিসেবে এ যুদ্ধ যতই নগণ্য হোক না কেন, এই-ই হয়ে পড়ল হযরত মুহম্মদের (সঃ) পার্থিব ক্ষমতার বুনিয়াদ। প্রকাশ্য যুদ্ধে ইসলাম এই তার প্রথম এবং নিশ্চিত বিজয় লাভ করল। তারা ভাবল, ইসলাম যে আল্লাহ্র মনোনীত ধর্ম, এ বিজয় তারই প্রমাণ।

এ যুদ্ধে মুসলমানেরা নিয়মের প্রতি যে নিষ্ঠা এবং মৃত্যুর প্রতি যে অবজ্ঞার পরিচয় দিল, পরবর্তী এবং বৃহত্তর বিজয়কালে এই-ই হয়ে উঠেছিল তাদের বৈশিষ্ট্য। সত্য বটে, পর বছর মক্কীরা এসে তাদের প্রতিহিংসা সাধন করে গেল, পয়গম্বর স্বয়ং আহত হলেন; কিন্তু তাদের এ বিজয় স্থায়ী হল না। ইসলাম তার শক্তি পুনরুদ্ধার করে নিল এবং আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ হতে আক্রমণাত্মক যুদ্ধের আসরে নেমে এল। তার প্রচার অনিরুদ্ধভাবে এগিয়ে চলল। এযাবতকাল পর্যন্ত ইসলাম রাষ্ট্রের ভিতরের ধর্ম ছিল। মদীনায় ইসলাম রাষ্ট্র-ধর্মের সীমা অতিক্রম করে চলে গেল : ইসলাম এখন নিজেই রাষ্ট্র হয়ে বসল। এই সময় হতে জগত ইসলামকে এই নবরূপেই চিনে আসছে : একটি রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থা।

ইহুদীরা মুসলমানদের দুশমনগণের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল, এই জন্য অতঃপর হযরত মুহম্মদ (সঃ) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন। তাদের নেতৃস্থানীয় কওমের ছয়শ’ লোক নিহত হল; বাকী সবাইকে বহিষ্কৃত করে দেওয়া হল। এর ফলে যে সব খেজুর বাগান মালিকহীন হয়ে পড়ল, সেখানে মুহাজিরদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হল। ইসলামের দুশমনদের মধ্যে এই-ই হল প্রথম কওম, যাদের সম্পর্কে চরম ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছিল।

এই মদীনা-যুগে হযরত মুহম্মদ (সঃ) ইসলামকে আরবের জাতীয় ধর্মে পরিণত করলেন। তিনি ইহুদী ও খৃস্টানদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। সাথে ‘র বদলে শুক্রবারকে মনোনীত করা হল। ঘণ্টাধ্বনি ও তূর্যনাদের পরিবর্তে মিনার হতে আযান দেওয়ার ব্যবস্থা হল। রমযান মাসকে রোজার মাস গণ্য করা হল। নামাজের জন্য কিবৃলা বায়তুল মোকাদ্দেস হতে কাবার দিকে পরির্তন করা হল; মক্কায় তীর্থ গমন সিদ্ধ করা হল এবং প্রাক-ইসলামী যুগের পূজ্য কালো-পাথরকে চুমা দেওয়া জায়েজ করা হল।

৬২৮ সালে হযরত মুহম্মদ (সঃ) ১৪০০ মুমিন নিয়ে মক্কায় হাজির হন এবং একটি সন্ধি-পত্র আদায় করেন। এতে মক্কী ও মুসলমানদের প্রতি সমান ব্যবহারের শর্ত লিপিবদ্ধ হয়। এই সন্ধি দ্বারা হযরত মুহম্মদ (সঃ) ও তার আপনজন কোরায়েশদের ভিতরের দ্বন্দ্বের কার্যতঃ অবসান ঘটে। এই সময় খালিদ-ইবনুল-ওলীদ এবং আমর-ইবনুল-আস ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালের অভিযানে এঁরা দুজনেই হয়ে ওঠেন ইসলামের দুর্জয় তরবারি। এর দুই বছর পর ৬৩০ সালের জানুয়ারীর শেষ ভাগে (৮ম হিজুরী) মক্কা বিজয় পরিপূর্ণ হয়। শোনা যায়, এ সময় কাবা ঘরে তিনশ ষাটটি প্রতিমা ছিল। হযরত মুহম্মদ (সঃ) তার অনেকগুলি ভেঙ্গে ফেলেন এবং ঘোষণা করেন : “সত্য এসেছে আর মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে।” মক্কাবাসীদের সঙ্গে ব্যবহারে তিনি মহানুভবতার এক অপূর্ব আদর্শ দেখালেন–প্রাচীন জগতের ইতিহাসে এমন বিজয়-প্রবেশের তুলনা নাই বল্লেই চলে।

সম্ভবতঃ এই সময়ই হযরত মুহম্মদ (সঃ) কাবার চারপাশের স্থানকে নিষিদ্ধ ও পবিত্র বলে ঘোষণা করেন। এ সম্বন্ধে একটি ওহীও নাজেল হয়। পরবর্তীকালে এই ওহীর ব্যাখ্যাস্বরূপ বলা হয় যে, অমুসলমানের পক্ষে কাবার এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। স্পষ্টই মনে হয়, এ আয়াতে হজের সময় পৌত্তলিকদের কাবার কাছে যেতে নিষেধ করা হয়; কিন্তু আয়াতটির পূর্বোক্ত ব্যাখ্যা আজো মেনে চলা হয়। এ পর্যন্ত পরজনের মত ইউরোপীয়-খৃস্টান মক্কা-মদীনা দেখে কোনরকমে জান নিয়ে ফিরে এসেছে। প্রথম জন ছিলেন বলোগনার লুডোভিসো-ডি-বার্থেমা, (১৫০৩); সর্বশেষদের মধ্যে ছিলেন এলডন রাটার নাম ইংরেজ। অবশ্য স্যার রিচার্ড বার্টানের বর্ণনাই সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক।

৯ম হিজরীতে আকাবার খৃস্টান-প্রধান এবং মানা, আদরু ও জারবা মরূদ্যানের ইহুদী কওমদের সাথে হযরত মুহম্মদ (সঃ) সন্ধি স্থাপন করেন। দেশীয় খৃস্টান ও ইহুদীগণকে জিমীরূপে আশ্রয় দেওয়া হয়; বদলে তারা জিজীয়া দিতে রাজী হয়। জমি ও মাথা উভয়ের খাজনাই জিজীয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই নজীর পরবর্তীকালে অনেক সুদূরপ্রসারী ফল প্রসব করে।

এই ৯ম হিজরীকে বলা হয় প্রতিনিধিদলের বছর। এই বছর নিকট ও দূরের বহু প্রতিনিধিদল শাসক পয়গাম্বরের নিকট আনুগত্য স্বীকার করতে আসে। কওমের পর কওম মহানবীর সঙ্গে যোগ দেয়–ধর্ম বিশ্বাসের জন্য না হলেও অন্ততঃ সুযোগ সুবিধার জন্য। সামান্য খাজনা ও ইসলামের প্রতি আনুগত্যের স্বীকৃতি আদায় করেই মুসলিম কর্তৃপক্ষ তুষ্ট ছিলেন। ইয়ামন, হাদ্রামাউত ও ওমানের মত দূরবর্তী স্থান হতেও দলে দলে লোক এসে হাজির হয়। যারা কোনদিনই কোন একজন মানুষের প্রভুত্ব স্বীকার করে নাই, আরবের সেই সব সম্ভ্রান্ত কওম ও শেখ হযরত মুহম্মদের (সঃ) কর্তৃত্ব মেনে নিতে এবং তার পরিকল্পনায় শরীক হতে রাজী হল। এক মহত্ত্বর ধর্ম ও উন্নততর নীতির নিকট প্রতিমা পূজা নতি স্বীকার করতে লাগল।

হিজরী দশম অব্দে মহাসমারোহের সঙ্গে হযরত মুহম্মদ (সঃ) তাঁর নতুন ধর্মীয় রাজধানী মক্কায় হজ করতে গেলেন। মক্কায় এই-ই ছিল তাঁর শেষ গমন; এবং একেই বলা হয় হজ্জতুল বেদা’–বিদায় হজ্ব মক্কা হতে ফিরে আসার তিনমাস পর ৬৩২ সালের ৮ জুন মহানবী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ইন্তিকাল করেন (ইন্নালিল্লাহ্…)।

মহানবীর মদীনার জীবন-কালে অনেকগুলি দীর্ঘ ওহী নাজেল হয়। এসব বাণীতে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত প্রভৃতি ধর্মীয় বিষয়ের আলোচনা ছাড়াও বিয়ে-তালাক, গোলাম-বাঁদী, যুদ্ধ-বন্দী ও শক্রর সঙ্গে ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ক অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্ন সম্বন্ধে কথা আছে। মহানবী নিজে শৈশবে এতিম ছিলেন। গোলাম, এতিম, দুর্বল ও মযলুমদের সম্বন্ধে তিনি যে আইন করেছেন, তা নিতান্ত উদার।

হজরত মুহম্মদকে (সঃ) কেউ যখন জানত না, তখন তিনি যেমন অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন, আর গৌরবের শিখরে অবস্থানকালেও তিনি তেমনি অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। আজও আরব ও সিরিয়ায় যেমন ছোট ছোট কাদার ঘর আছে, মহানবী তেমনি একটি কাদার ঘরে বাস করতেন। সে ঘরে মাত্র কয়েকটি কোঠা ছিল; ঘরের সামনে ছিল একটি আঙ্গিনা। এই আঙ্গিনা পার হয়ে ঘরে যেতে হত। অনেক সময় তাকে তার নিজ ছেঁড়া কাপড় সেলাই করতে দেখা যেত এবং যে কোন সময় যে কেউ তার সঙ্গে দেখা করতে পারত। হোগাৰ্থ বলেন : তার ছোট বড় সমস্ত দৈনন্দিন ব্যবহারই এক রকম আইনে পরিণত হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ লোক জেনে শুনে তার অনুকরণ করে থাকে। যাঁদের কেউ কেউ ‘পূর্ণ মানুষ বলে বিশ্বাস করে, তাদের কারো ব্যবহারই এমন ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয় নাই।

তাঁর যে সামান্য সম্পত্তি ছিল, তাকে তিনি রাষ্ট্রের সম্পত্তি বলে মনে করতেন। তিনি প্রায় বারোটি বিয়ে করেন–কোন কোন বিয়ে ভালোবাসার জন্যে, আর কোন কোন বিয়ে রাজনৈতিক কারণে। তাঁদের মধ্যে তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিলেন আবুবকরের কন্যা তরুণী আয়েশা। খাদীজার গর্ভে তার কয়েকটি সন্তান জন্মে ছিল; কিন্তু এক ফাতিমা ছাড়া তাঁর জীবদ্দশাতেই বাকী সকলের মৃত্যু হয়। এই ফাতিমাই আলীর বিখ্যাত সধর্মিনী ছিলেন। হযরত মুহম্মদ (সঃ) মরিয়ম নামী কিপ্তী-খৃস্টান স্ত্রীর গর্ভে ইব্রাহিম নামে একটি ছেলের জন্ম হয় এবং শৈশবেই তার পরলোক গমন ঘটে। হযরত মুহম্মদ (সঃ) এ’ পুত্রের জন্য গভীর শোক প্রকাশ করেন।

মদীনার ধর্ম-সমাজ হতেই পরবর্তীকালে মুসলিম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। মুহাজির ও আনসারের এই মিলিত সমাজ ধর্মের বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে আল্লাহ্র জামাত বলে গণ্য হয়। আরবের ইতিহাসে রক্তের বুনিয়াদের উপর না করে ধর্মের বুনিয়াদের উপর সমাজ গঠনের চেষ্টা এই-ই প্রথম। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হচ্ছে আল্লাহ্র মহান শক্তির মূর্তিমান বিকাশ। মহানবী যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন তিনি আল্লাহর খলীফা এবং দুনিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনকর্তা ছিলেন। সুতরাং হযরত মুহম্মদ (সঃ) তাঁর ধর্ম-ঘটিত কর্তব্য ছাড়াও দুনিয়ার যে কোন রাজা-বাদশাহ্র মত রাষ্ট্রের কাজ করতেন। এই সমাজের সকল মানুষ তাদের কওম ও পূর্ব আনুগত্য নির্বিশেষে এখন পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেল । (অন্তত নীতিগতভাবে)। বিদায় হজে রসূলুল্লাহ্ যে মহান খোত দিলেন, নিম্ন কথাগুলি তারই অংশ।

‘হে জনমণ্ডলি! আমার কথা মন দিয়ে শোন এবং তা হৃদয়ে গেঁথে নাও। জেনে রাখ, প্রত্যেক মুসলমান অন্য প্রত্যেক মুসলমানের ভাই ও এখন তোমরা সকলে মিলে এক ভ্রাতৃসংঘ। যদি ইচ্ছা করে না দেয়, তবে তোমাদের এক ভাইয়ের কোন চীজ অন্য ভাইয়ের আত্মসাৎ করা বৈধ নয়।’

এতকাল পর্যন্ত আরব সমাজের বুনিয়াদ ছিল কওমী জ্ঞাতিত্ব। হযরত মুহম্মদ (সঃ) এমনিভাবে এক আঘাতে তার পরিবর্তন করে ধর্মের বন্ধনকে করলেন নব সমাজের বুনিয়াদ। হযরত মুহম্মদের (সঃ) মৌলিকতার এ একটি প্রধান দাবী। নতুন সমাজে কোন পাদ্রী পুরুহিতের স্থান রইল না। এর মসজিদ হল জনসভার স্থান, সামরিক ড্রিলের ময়দান, এবং জামাতবদ্ধ নামাজের জায়গা। নামাজের ইমাম হলেন ময়দানে সেই মুমিনদের সেনাপতি যারা সমস্ত দুনিয়ার বিরুদ্ধে পরস্পর আত্মরক্ষার জন্য আদিষ্ট। আরবে এর পরেও যারা পৌত্তলিক রয়ে গেল, তারা রইল এ সমাজের বাইরে প্রায় যেন আইনের রক্ষণেরও বাইরে। ইসলাম সমস্ত অতীতকে নাকচ করে দিল। আরবের নিকট নারীর পরই প্রিয় ছিল মদ আর জুয়া। এক আয়াত এসব বন্ধ করেছিল। প্রায় অনুরূপ আকর্ষণের বস্তু ছিল সঙ্গীত : তার উপরও বিরূপ কটাক্ষ হানা হল।

মদীনা হতে ইসলামের ধর্মরাজ্য প্রথমে সমগ্র আরবে এবং পরে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ স্থানে ছড়িয়ে পড়ল। মদীনার সমাজ ছিল পরবর্তী মুসলিম সমাজের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। এতকাল পর্যন্ত যে আরব দেশ ছিল মাত্র একটি ভৌগোলিক বাক্য, যে আরব-সমাজের লোকেরা কোন দিনই ঐক্যবদ্ধ হয় নাই, সেই আরব দেশে এবং সেই আরব-সমাজে হযরত মুহম্মদ (সঃ) তাঁর এক নম্বর জীবনে গড়ে তুললেন একটি জাতি প্রবর্তন করলেন এমন একটি ধর্ম যা খৃষ্টান, ইহুদী প্রত্যেক ধর্মের চেয়ে বেশি স্থান অধিকার করে আছে এবং দুনিয়ার মানুষের এক বিপুল অংশ যে ধর্ম মেনে চলে এবং এমন একটি সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করলেন যা অনতিবিলম্বে তৎকালীন সভ্যজগতের সুন্দরতম অঞ্চলগুলি অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিল। তিনি কখনো কোন বিদ্যালয়ে যান নাই; তবু তিনি এমন একটি গ্রন্থ রেখে গেলেন, যে গ্রন্থকে দুনিয়ার সাত ভাগের এক ভাগ মানুষ আজো সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত বিজ্ঞান এবং সমস্ত ধর্ম-তত্ত্বের আধার বলে মনে করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *